0

ছোটগল্পঃ উৎসব দত্ত

Posted in


ছোটগল্প


স্যার 
উৎসব দত্ত




অনেকদিন পরে স্যারের বাড়ি গেছি। বেল বাজাতে নবোদা দরজা খুলল। প্রথমে আমায় চিনতে পারেনি। 

বললাম - 
- আমি শেখর। ২০০৪ এর ব্যাচ। 

- 'ওহ! নীলাঞ্জনাদের সাথে পড়তে তুমি তাই তো?' 

- মাথা নাড়লাম। স্যার আছেন? 

- আছেন। তবে আজকাল স্যার কারোর সাথে দেখা করেন না। অনেক দিন হল পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। 

আমি শুনে কিছুটা অবাক হলাম। স্যার পড়াচ্ছেন না, এটাও হতে পারে! যে লোকটা সারাজীবন অধ্যাপনা করে কাটিয়ে দিলেন, বিয়ে করলেন না, শেষে কিনা পড়ানোই ছেড়ে দিলেন! আমি নবো দা কে বললাম - 

- অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য কোলকাতা এসেছি। ভাবলাম স্যারের সাথে দেখা করে যাবো এবার। কোলকাতায় তো আসা হয়না। যদি একবার দেখা পেতাম খুব ভালো লাগত।

আমার কথায় নবোদা একটু যেন নরম হলেন। 

- 'ভেতরে এসো। বসো। আমি স্যারের সাথে একবার দেখা করে আসছি।'

- স্যারকে বোলো শেখর এসেছে। স্যার না করবেনা দেখো! 

নবোদা মাথা নাড়তে নাড়তে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল সেই আগের মতো। 

আমরা পড়তে এসে এই ঘরটায় বসতাম। ছোট্ট একটা বিছানা তার ঠিক পাশে আলমারি ভর্তি বই। সামনে পুরনো দিনের লাল মেঝে। আমরা এখানে কার্পেট পেতে বসতাম। স্যার কোনোদিন বিছানায় বসতেননা। আমাদের সাথে মেঝেতেই বসতেন। স্যার মাঝখানে আমরা দুই ধারে। আমরা মানে ছেলেরা মেয়েরা একসাথেই বসতাম। প্রথমদিনেই স্যার বলে দিয়েছিলেন ছেলে মেয়ে কেউ আলাদা বসবেনা। 

এতদিন পরে এই ঘরটায় ঢুকে অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ স্যারের জন্যই। ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য স্যারের কাছে এসেছিলাম। স্যারের গল্পগুলো এক এক করে মনে পড়ছিল। কি রসিক মানুষ বাব্বা। প্রায় প্রতি কথায় পান করতেন। Twelfth Night পড়াতে গিয়ে আমাদের হাসিয়ে পেটে খিল ধরিয়ে দিয়েছিলেন প্রায়। 

আচমকা আমার Down Memory Lane আটকে গেলো। নবোদা নীচে আসার শব্দে। 
- 'ওপরে চলো। স্যার তোমার সাথে দেখা করবেন।' 

- বললাম তোমায়। শেখর নাম শুনলে স্যার না বলবেননা।

-'স্যারের শরীর ভালো নেই বেশি সময় নষ্ট করবেনা।' 

নবোদার কথা গুলো কেমন রুক্ষ শোনাচ্ছিল। বরাবরই একটু ক্যাঁটক্যাঁটে কোনোদিন হাসতে দেখিনি। কিন্তু এখন যেন আরও বেশি ক্যাঁটক্যাঁটে হয়ে গেছে। হয়তো এতদিন পরে দেখছি বলে কিম্বা অযাচিত ভাবে ভুল সময় চলে এসেছি।

স্যারের ঘরে ঢুকে বেশ কিছুটা অবাক হলাম। বইয়ের আলমারির সাথে নতুন যোগ হয়েছে দেওয়াল ভর্তি হাতে আঁকা ছবি। কোনোটায় ফাঁকা খাঁচা আবার একটায় আরাম কেদারার ছবি আঁকা। 

ফতুয়া আর পায়জামা পরে একটা সোফায় বসে আছেন। মাথায় চুল নেই। চোখ মুখ ফুলে গেছে। 

- স্যার চিনতে পারছেন ? আমি শেখর। ২০০৪ সালে আপনার কাছে পড়তাম। দীপক, নীলাঞ্জনাদের সাথে । আপনি আমায় মজা করে 'ভুতো' বলে ডাকতেন। 

স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েই আছেন। চোখটা ঘোলাটে। মুখে কোন অভিব্যাক্তি নেই। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নবোদার দিকে তাকিয়ে বললাম-

- স্যার কেমন আছেন? চেহারা এতো ভেঙ্গে গেলো কি করে? 

নবোদা আমার দিকে চেয়ে চুপ করে রইল তারপর এক নাগাড়ে বলে গেলো - 

- 'দেড় বছর আগে অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে স্যার ভাষা হারিয়েছেন।  ক্যান্সার- ছয়মাস অন্তর কেমো দিতে হয়। এখন বেটোফেন আর দেওয়ালের এই ছবিগুলো ছাড়া স্যার কোন ভাষা বুঝতে পারেননা।'

আমি কি বলব বুঝতে না পেরে স্যারের জন্য আনা বইটা বের করেও না দিয়েই চুপচাপ চলে গেলাম। স্যার আমার দিকে তখনও তাকিয়ে রইলেন।

0 comments: