ব্যক্তিগত গদ্যঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
আমি পুরুলিয়া মানভূমি ভাষা বলি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
ভাষা কি নিছক ভাব বিনিময়, সেতু ? এই যে গুছিয়ে বলতে চাই, কতকিছু কতটুকু বলি । আদৌ কি পারি বলতে যা মনের ভেতর তোলপাড় করে, যা ক্রমাগত পুড়িয়ে মারে, জ্বালিয়ে মারে অস্থির করে। পারি কি তুলে আনতে সেই সমুদ্রঝিনুক ? পারিনা । তাই শব্দ সাজাই মায়াবন্ধনীর। আলো ফেলে দেখি নিজের যাতনা, রক্তপাত , আটুপাটু। না কি বেদনা আড়াল করে একগাল হেসে উঠি সৌজন্য সুন্দর? শূন্য কলস আর দারিদ্রের বিজ্ঞাপন অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ঐশ্বর্যময় কারুকাজ রঙিন আড়ম্বরে মুড়ে দিই তুমুল । । ভাষার বুননে কী অপরিসিম বিশ্বাসযোগ্য করে তুলি এই কৃত্রিম দুনিয়া । আমাদের জিভ কখনও শুকোয় না । অনলস বাক্যের পর বাক্য গঠিত হয় । আর আবরণ দিয়ে নিজেকেই মুড়ে ফেলি এক গুহার চাদরে । আমি যা , যতদূর প্রসারিত আমার স্বদীপ তাও কি সুন্দর নির্ভুল মন্ত্রে আরোপিত বাক্যবন্ধে নিভিয়ে দিচ্ছি না ? তাহলে কি এটাই শেষ অবধি প্রসারিত হল না যে ভাষা প্রোটাগনিস্ট চরিত্রকেও বিভ্রান্ত করে । ধোঁয়াশায় ঢেকে দেয় আপাদমস্তক । এতে প্রাণ কোথায় ? আমি র স্পন্দন কই ?
প্রাণ যদি তুলে আনতে নাই পারি তাহলে ভাষাও তো এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল । নিছক ক্রিয়া বিশেষ্য আর বিশেষণের সমন্বয় । প্রাণ কই , কোথায় জিয়নকাঠি ? আর প্রাণের বিহনে কোন গান নেই । তাহলে গণসংগীতের নামে কোন গান গাইছি আমি ? ই গানে ত মাদল বাইজবেক নাই, আইজ্ঞা । হ্যাঁ, এই মাদলের আওয়াজ ই তো আমার ভাষা । আমার নিজের আত্মচিত্রের অহংকার ।
মাটির ভেতরে থাকা জীবন প্রবাহ আর শেকড়ের ধ্বনিময় ঝর্ণার বাঙময় প্রকাশ ই শিল্পসম্ভব হয়ে ওঠে নিজের দৈনন্দিনতায় ।
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে যখন আমরা দেখি সামগ্রিকতার বহুচিত্রিত প্রেক্ষিত । যখন দেখি ক্লান্ত বিধস্ত উদ্ভ্রান্ত এক দিশাহীন পৃথিবী এবং অনুভব করি এর সমাধানের রাস্তা কিম্বা এই ভীরু অন্ধকার থেকে পলায়মান অমানবিক শক্তিও আমার নেই। নাতিশীতোষ্ণ আড়াল থেকে বেরিয়ে তখনও কি একধরনের ভাষা আমরা রপ্ত করি না ? । যা ক্লান্তিমোচনের যা বিচ্ছিন্নতাবোধ ( অ্যালিয়েশন ) থেকে মুক্তিমোক্ষণের এক কবোষ্ণ আশ্রয় হয়ে ওঠে । এ থেকে কি আমরা সঙ্গ এবং শুশ্রূষার উদ্দামতা ও আহ্বান অর্জন করিনা ? করি এবং তখন ভাষা শুধুমাত্র এক নিঃশব্দ প্রহরা হয়ে ওঠেনা, বেঁচে থাকার সাথে অঙ্গীভূত এক অধ্যায় ও হয়ে যায় ।
শিরা আর ধমনী জুড়ে এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের বিস্তার । ভিড়ের মধ্যে থেকেও নিজস্ব সত্ত্বা লালনের প্রয়াস অথবা অভিকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়ানো । আর বর্শা ফলকের মত কিছু অনুভূতি এসে সামগ্রিক ভিজিয়ে দেয় ঘরদোর । ভাষা তো পরে, এর অনেক আগে তো গড়ে নিতে হয় চোখ আর কান । কান যদি ঠিক না থাকে তাহলে পিওরেষ্ট ইমোশন কেও মনে হবে ন্যাকামি । আর চোখও যদি প্রতারণা করে তাহলে অন্যের হান্ড্রেড পারসেন্ট অনেষ্টিকেও মনে হবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায় । এর ফলে ধারনাই গড়ে উঠবে এক সন্দেহ বিক্ষুব্ধ পরিবেশে । তখন গড়ে উঠবে এক জগাখিচুড়ি অবয়ব । আলো আর আঁধারের মাঝে এক টালমাটাল দশা । যা আত্মবীক্ষণীক নয় ফলে শিল্পবান্ধব ও নয় ।
ভাষা তো সেই অনুভূতি যা একটি স্থির ছবিকে সচল করে । এই যে আমি পুরুলিয়ার মেঠো পথে হেঁটে চলা এক প্রান্তিক মানুষ । পলাশ আর পুটুশের বনে পা রাখি । কলমকাঠি চালের গন্ধে আলুলায়িত বাতাস । গোবরের মাড়ুলি দেওয়া উঠোন জুড়ে ধানের পালই । কাঁসাই এর জল থেকে উঠে আসে উৎসবের সুখ । ভাদু গানে মেতে উঠে বাইদ বহাল । কুঁখড়া লড়াইয়ের আমোদ পরব । ২১ শে ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি আমাদেরও ১লা নভেম্বর আছে । মাতৃ ভাষার দাবিতে দীর্ঘ লড়াইয়ের দলিল । অবিভক্ত মানভুমের বঙ্গভুক্তির ইতিহাস । আর আছে বুকের মধ্যে গুন গুন করতে থাকা ঝুমুর । আমি যদি বলি ভাষা সেই অনুভূতি, যা স্থির ছবিকে সচল করে - ইটাও ঠিক হামদের পরানের ভাষা লয়, আইজ্ঞ্ ই ভাষাতে ত মনের ভিতরের ছবিট ছুইটবেক নাই । ইঁড়কে উইঠবেক নাই, পাঘা ছিঁড়া গাই বাছুর এর পারা ।
হ্যাঁ, ভাষা এটাই । ঠিক এইভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারা । আত্মমোচন করতে পারার নাম ই তো নিজের সাবলীল প্রকাশ । এই ভাণ্ডারের অমুল্য রতন গুলি কেন অবহেলা করব ? কেন খুঁজে নেব অন্য মানচিত্র ?
0 comments: