গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্পপলাশডাঙার কাছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে দেখা গেছে! তিনি রাস্তায় রাস্তায় এদিকে সেদিকে ‘ভ’-বর্ণটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন! বলছেন – ভারতবর্ষ হইতে ‘ভ’-বর্ণটা নিঁখোজ হইয়া গিয়াছে। তোমরা কি কোথাও ‘ভ’-কে দেখিয়াছো?
পার্টি অফিসে রবীন্দ্রনাথের খবরটা আসতেই একজন ক্যাডার বাঁশের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে এলো – কি যা তা গুল মারছিস!
যে খবরটা এনেছিলো, সেই বনমালী সিধে দাঁড়িয়ে পার্টি অফিসে যথেষ্ট সাহসের সাথেই বললো - না গো, আমি নিজের চক্কে দেকে এলুম গো! সাইকিলে হাটের থেইক্যা এদিকেই আসছিলুম। দেখলুম, মোদের দাঁড়িয়ালা রবিঠাকুর রাস্তায় দাইড়ে আছেন! তাকে কি আর চিনি নে? মুই আর খাড়াই নি, এই আচ্চয্যি খবরটা দিতে পাট্টি আপিসে তাত্তাড়ি চইলে এলুম।
জায়গাটার নাম পলাশডাঙা, গাঁয়ের একপাশে ধানখেত, অন্য পাশে বয়ে যাওয়া বিল। তারই মাঝ দিয়ে যে রাস্তাটা হাটের দিকে চলে গেছে, সেই বিকেলেই সেখানে দেখা গেছে একজন রবীন্দ্রনাথকে! তিনি রাস্তায় কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন! লোকেদের সাথে কথা বলছেন, তাদের কিছু একটা জিজ্ঞেস করছেন!
গাঁয়ে তখন ইলেকশনের প্রস্তুতি। দেয়ালে, গাছে, স্কুলের পাঁচিলে পোষ্টারগুলো জানান দিচ্ছে কয়েকদিন বাদেই ভোট আসছে! প্রাকৃতিক ভাবে শান্ত গ্রাম। অথচ বটগাছ তলার আড্ডা সে সময়ে অশান্ত! জমায়েতে মানুষজনের তর্ক ভোটে কে জিতে আসবে – কাস্তে হাতুড়ী, হাতের পাঞ্জা, ঘাস-ফুল, নাকি জলের পদ্ম?
গ্রামের দু’তিন জন লোক এ সময়ে ওই পথ ধরে যাচ্ছিলো। লোকগুলো বিস্ময়ে গুরুদেবের দিকে এগিয়ে গেলো। তারা বুঝে উঠতে পারলো না, এই অজ পাড়াগাঁয়ে এ সময়ে রবি ঠাকুর কি করতে এসেছেন? বিষয়টা মালুম করতে হবে!
সাহস করে একজন জিজ্ঞেস করে বসলো – পেন্নাম হই ঠাকুর! আপনে কি কিছু হারাইচেন? অমন কইর্যে রাস্তায় রাস্তায় কি খুঁজচেন?
রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালেন। বললেন – বৎস, আমাদের দেশের বর্ণমালা হইতে ‘ভ’-বর্ণটা নিঁখোজ হইয়া গিয়াছে। তাই আমি ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে সর্বত্রই ‘ভ’-কে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি।
দীর্ঘদেহী ব্যক্তিত্ববান রবীন্দ্রনাথের হেঁয়ালি ভরা কথাগুলো বোঝা গেলো না! ইতিমধ্যে গাঁয়ের আরো কয়েকজন লোক ওখানে জড়ো হয়ে গেছে! স্কুলে প্রাথমিক পাশ একজন মন্তব্য করে বসলো – এইট্যা কেমন কথা! দ্যাশের থিকা ‘ভ’-বরণো হাপিস হইয়্যা যাইবো?
রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নকর্তা লোকটাকে সস্নেহে দেখলেন। ধীরে ধীরে বললেন - হে ভ্রাতা, ইহা সত্য, দেশ হইতে ‘ভ’-বর্ণটা নিঁখোজ হইয়া গিয়াছে। ইহার জন্যে কিয়ৎকাল ধরিয়া আমি অতিশয় মনোকষ্টের মধ্য দিয়া সময় অতিবাহিত করিতেছি!
জড়ো হওয়া মানুষজনের মধ্যে সোরগোল উঠলো। একজন বলে উঠলো - ঠাকুর, সেইট্যা ক্যামন কথা! বাল্যশিক্ষার হরপ, বইএর লেখা হরপ ‘ভ’ হারাইয়া গ্যাছে, এমনটা কি কইর্যা হয়?
উত্তরে রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়ে বললেন – হয়! হয়! ‘ভ’- শোভিত আমাদের এই দেশ - ভারতবর্ষ। সম্প্রতি অনুসন্ধান করিয়া আমার ঐতিহ্যময় ভারতবর্ষকে আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না! ভারতবর্ষের জনমানস হইতে ভাতৃত্ববোধ হারাইয়া গিয়াছে! মাঝে মাঝেই আত্মঘাতী জাতি-দাঙ্গা সংগঠিত হইতেছে। কিছুকাল ধরিয়া আমি অতিশয় চিন্তন করিতেছি, ভারতবর্ষের অভিধান হইতে কিভাবে ভাতৃত্ববোধ তথা ‘ভ’-বর্ণটি নিরুদ্দেশ হইতে পারে? ভারতবর্ষের ভবিতব্যে ভাতৃত্ববোধ পুণঃস্থাপিত করিবার জন্যে, ‘ভ’ কে যেমন করিয়াই হউক খুঁজিয়া আনিতে হইবে। অনুসন্ধানপূর্বক উহাকে সসম্মানে যথাস্থানে স্থাপিত করিতে হইবে!
ততক্ষণে হাটের রাস্তায় আরো কিছু জমে গেছে। তারা ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। উপস্থিত মানুষজন দাঁড়িয়ালা মানুষটার কথা ঠিক তেমন ভাবে বুঝতে পারলো না!
দাড়িয়ালা লোকটা, থুরি, রবীন্দ্রনাথ বলেই চলেছেন, - অভিধানে আমি কিছুদিন ধরিয়া ভাত শব্দটাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি! কিন্তু ‘ভ’-বর্ণ শোভিত উক্ত ভাত শব্দটিকেও আমি যথাযথভাবে খুঁজিয়া পাইতেছি না! আপনাদের গৃহে কি ভক্ষণের জন্যে যথেষ্ট পরিমানে ভাতের সরবরাহ আছে? আপনাদের গ্রামের সমস্ত গৃহবাসীরা কি সময় মতো দুইবেলা যথেষ্ট পরিমান ভাত খাইতে পারেন? না কি ভাত-বিনা উপবাসেই তাহাদের দিবস কাটাইতে হয়? এই জন্যেই বলিতেছিলাম, দেশ হইতে ‘ভ’-বর্ণ নিঁখোজ হইয়া গিয়াছে!
এরই মধ্যে ওই জায়গায় বেশ কিছু লোকের ভীড় জমে গেছে। ভাত শব্দটা শুনে গামছা পরা কয়েক জন লোক নড়েচড়ে উঠলো। তাদের মধ্যে একজন ভিখিরি গোছের পাগলাটে মানুষ বলে উঠলো – হাঁ দাদু, সাচা কথা, এ জামানায় প্যাটের ভাত যে অমিল!
ওই ভীড়ের মধ্যেই এগিয়ে এলো গ্রামের জনৈক যুবক, তার কবি কবি ভাব। ছেলেটা বিশ্বকবির গলায় গলা মেলালো – ঠিকই বলেছেন, গুরুদেব। এ জামানায় মূল্যবান ভ-বর্ণটির সত্যিই খুব আকাল চলছে! এজন্যেই আজকাল আমরা প্রকৃত ‘ভ’ বা ভালোবাসাকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রেমিক প্রেমিকারা একজন আরেকজনের সাথে হামেশাই বিট্রে করছে!
গ্রামের মধ্যে অদূরেই বাঁশগাছ কাঁপিয়ে শণশণ হাওয়া বইছিলো। আচমকা দেখা গেল সেই হাওয়াতে ভর করে, খালি গায়ে হঠাৎ করে নাট্যকার ও নির্দেশক বাদল সরকার সেখানে হাজির। তিনি ওই জটলার পাশে দুদন্ড দাঁড়িয়েই সমস্ত ব্যাপারটা মালুম করে নিলেন। নাটকীয় কায়দায় সুরুৎ করে ভীড়ের কেন্দ্রস্থলে ঢুকে পড়লেন। আকাশের নীচে খোলা মঞ্চে ঢুকেই তিনি শরীর ঝুঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথকে একটা সুদীর্ঘ সেলাম জানালেন।
বাদলবাবু জোরালো গলায় বললেন – এটা খুব সত্যি! আজকাল দেশের বর্ণমালা থেকে ‘ভ’ হারিয়ে গেছে! মানুষের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ হারিয়ে গেছে! এজন্যেই ভোমা নামের লোকটা ভাত খুঁজে পায় না! অথচ রোজ রোজ ভোমার ক্ষিধে লাগে, ভোমা ভাত চায়।
বাদলবাবু বলে চল্লেন – আজকেই ভোমা সকালবেলায় ভাত খেতে চেয়েছিল। কিন্তু পাবে কি করে? ভাত সহ সমস্ত ‘ভ’ই যে এখন অমিল! ভাত না খেতে পেয়ে পঞ্চপ্রদীপের মোড়ে দাঁড়িয়ে ভোমা প্রতিবাদ করেছিলো। এই কারণে কারা যেন ভোমাকে এলাকা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। একটু আগেই দেখে এলাম ভোমার মা রাস্তায় রাস্তায় তার ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে – ‘ও পোড়া কপাইল্যা, ও আমার প্যাটের শত্তুর – তুই কোথায় গেলি রে!’ ওর মা পাগল হয়ে গেছে। তার ছেলের নাম যে ভোমা, যা ‘ভ’-বর্ণ দিয়ে শুরু, সেকথাও ভুলে গিয়ে মা ছেলেকে ডাকছে ‘পোড়া-কপাইল্যা’ নামে!
জমে যাওয়া লোকেদের মধ্যে কান ফুসফুস চলছে!
এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথ নতুন আগন্তুক লোকটার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার তিনি এই হঠাৎ-মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন – হে বৎস, আমার প্রতীত হইতেছে, তুমিই আধুনিক রঙ্গমঞ্চের বাদল সরকার? আমি যত দূর জানি, উহাকেই জনগন আজকাল থার্ড-থিয়েটার নামে অভিহিত করে। হে নাট্যকার বাদল, তোমার বক্তব্যসমূহ আমি অন্তর দিয়া অনুধাবন করিতেছি। হে ভ্রাতা, আমিও স্বয়ং অনুরূপ চিন্তন করিতেছি। ইহা সত্য, ভারতবর্ষে সবার জন্যে ভাত নাই। ইহাও সত্য, ‘ভোমা’ নামক সন্তানটির মাতা আপনার পুত্র-নামের আদ্যাক্ষর ‘ভ’ ভুলিয়া গিয়াছে! তাই তাহাকে ‘ভোমা’ নামে সম্বোধন করিতে পারিতেছে না। নিজের ছেলেকে ভোমা-র পরিবর্তে সম্বোধন করিতেছে ‘পোড়া-কপাইল্যা’ নামে! এ জন্যেই আমি বলিতেছিলাম, ভারতবর্ষের এই চলমান সময়ে ‘ভ’-এর অতিশয় দুর্দশাময় অবস্থা!
ক্ষমতাসীন পার্টির লোকরা ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে গেছে, তাদের গ্রামে অপোজিশন পার্টির দুজন লোক ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে। এই দুজনের মধ্যে একজন রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে। বাদলবাবু নামেও একজন আছে। তারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যে গ্রামে গ্রামে ক্যাম্পেন চালাচ্ছে!
খবরটি পেয়ে, সময় নষ্ট না করে, ক্ষমতাসীন পার্টির আরো কিছু লোকজন লাঠি, শাবল, ছোরা হাতে সে জায়গায় হাজির।
ক্ষমতাসীন পার্টির একজন চেঁচিয়ে বললো – হে গুরুদেব, আপনি কোন দলের এজেন্ট হয়ে এখানে ঘুরছেন? কেন শুধুমুধু আমাদের এলাকায় এসে রটাচ্ছেন ‘ভ’-বর্ণ হারিয়ে গেছে। কেন মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন, মানুষ ভাত পায় না? আপনি কি জানেন না, আমাদের সরকার সবার দুয়ারে দুয়ারে চাল পৌঁছে দিচ্ছে!
আরেক জন মস্তান তার শাবলটা গুরুদেবের চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে উদোম বলে উঠলো, – ভোতা? বলেন- ‘ভ’ মানে ভোতা! এই শাবলের ধাক্কায় যখন তখন মানুষের মাথাটা ভোতা করে দেয়া যায়! তবুও বলবেন, আপনি ‘ভ’কে দেখতে পাচ্ছেন না? তবুও বলবেন, আমাদের দেশের থেকে ‘ভ’ হারিয়ে গেছে?
এই অবস্থায় গুরুদেব একটু থতমত খেয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি তার ধৈর্যে ও মনীষায় নিতান্তই অবিচল। গুরুদেব স্থির সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
মস্তান লোকটা গুরুদেবের সামনে হাতের শাবলটাকে হেলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগলো - ‘ভ’ মানে ভয়! আপনি ভয় পাচ্ছেন না? আমার পার্টি আপনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমি বলছি, ‘ভ’ এখনো এই দেশে সসম্মানে বেঁচে আছে। ‘ভ’ হারিয়ে যায় নি! ‘ভয়’ এ দেশে জরুরী! এখানে কেউ উলটাপালটা কিছু বললে, কিছু করলে তার মাথাটি তক্ষুনি ভেঙ্গে দেয়া হয়! নাকে-মুখে রক্ত মাখা ভীত-মানুষের ভয়ংকর ছবি আপনি কি খবর কাগজে কখনো দেখেন নি? তবুও কি আপনি বলতে চান, ভয়ংকরের ‘ভ’-বর্ণটা ভারতবর্ষ থেকে থেকে হারিয়ে গেছে?
আরেক জন দাদা গোছের লোক বাদলবাবুর দিকে এগিয়ে এলো। হাতে তার রিভলবার। সেটি দেখিয়ে দাদা লোকটা বলে উঠলো – এর নাম ‘ভয়’! একটা ভয়ানক রিভলবার - এর মধ্যে গুলি ভরা আছে। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন না? তবুও বলবেন, আপনারা আপনাদের ডিকশনারিতে ‘ভ’কে খুঁজে পাচ্ছেন না? যত্তোসব আর্বাণ ইন্টেলেকটুয়াল!
কয়েকজন মারকুট্টে লোক একটা সার্কেল করে রবীন্দ্রনাথ আর বাদল সরকারকে ঘিরে ফেললো। তারা চেঁচিয়ে মানুষ দুটোর হাত-পা ধরে টানতে লাগলো। এ একরকম জবরদস্তি!
– এক্ষুনি বলুন, এ দেশে ‘ভ’ মানে ভাতের কোনো কষ্ট নাই!এক্ষুনি বলুন, ভারতবর্ষ হইতে ‘ভ’-বর্ণটা নিঁখোজ হয়ে যায় নি!
তাদের মধ্যে নেতা গোছের একজন বারবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলো - বলুন, প্রাচীন ঋষিমুনিদের এই ভারতবর্ষে ভালোবাসা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোনো কমতি নাই। এক্ষুনি বলুন ...।
গ্রামের আরো কিছু লোক নেতা গোছের মানুষটার কথায় সঙ্গত লাগালো!
পাশের গ্রাম থেকে খবর পেয়ে ততক্ষণে চলে এসেছে ক্ষমতাসীন দলের আরো কিছু জনতা। তাদের হাতেও লোহার রড, অস্ত্রশস্ত্র। সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে তারাও উপস্থিত জনতার সাথে গলা মেলালো – এক্ষুনি বলুন, যদি না বলেন, দেখেছেন তো হাতের মালগুলো! বলুন, ভোমার কোনো ক্ষিধা নাই। বলুন, ভোমার পেট ভরা। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা ভারতবর্ষের ভেতরে ‘ভাত’ যথেষ্ট পরিমানেই আছে! বলুন, আমাদের দেশের ডিকশনারি থেকে ‘ভ’- বর্ণটা হারিয়ে যায় নি।
রবীন্দ্রনাথ দমবার পাত্র না। যেন মনে মনে স্মরণে করলেন, জালিয়ানার রক্তগঙ্গার পরে একজন প্রকৃত স্বদেশীর মতো তার গর্জে ওঠা প্রতিবাদ! কেউ তার কন্ঠরোধ করতে এলে, তিনি মানবতার স্বপক্ষে অবিচল। আজকে এই পরিস্থিতিতে তিনি কোনো মতেই মাথা নত করবেন না।
ভীড়কে উদ্দেশ্য করে তাই রবীন্দ্রনাথ নেতাগোছের লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে চললেন- ‘ভ’ বর্ণশোভিত আমাদের এই ভারতবর্ষ একটি অতি সুন্দর দেশ। জনগনমন-তে যে ভারতবর্ষকে আমি প্রস্ফুটিত করিয়াছিলাম, আমি পুনর্বার বলিতেছি, আমার স্বপ্নের ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই ভারতবর্ষকে বর্তমান সময়ে আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি! এই কারণেই আমি কহিতেছিলাম, ভারতবর্ষ হইতে ‘ভ’-বর্ণটা নিঁখোজ হইয়া গিয়াছে।
এরই মধ্যে বিপক্ষ দলের কিছু মানুষ সেখানে হাজির। ভীড়ের মধ্যে মাথা গলিয়ে তাদেরও কয়েকজন নাট্যকার বাদল সরকার আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারলো! দেখলো, দুজন বিখ্যাত মানুষকে গ্রামের লোকজন আটকে রেখেছে; তাদের উপর হম্বিতম্বি করছে। পরিস্থিতি যেকোনো মুহূর্তে খুব খারাপ দিকে এগোবে।
মারমুখী জনতার মধ্যে আটকে আছে দুজন ধীমান পুরুষ। যদিও আক্রান্ত, তবুও ভয়ডরহীন দুজনেই যথেষ্ট সাহসী। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর অবস্থা।
অকুস্থলে উপস্থিত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন আরো কয়েকজন মানুষ সামনে এগিয়ে এলো। কাঁধে ব্যাগ, পেশায় তারা হাই-স্কুলের শিক্ষক, অথবা সাংবাদিকও হতে পারে। তারা কোন ক্রমে পরিস্থিতিটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। উপস্থিত মানুষদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে তারা রবীন্দ্রনাথ আর বাদলবাবুকে ওই জনতার আবেষ্টনী থেকে মুক্ত করে নিয়ে এলো। ওনাদের দুজনকে একটা নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে দিতে হবে।
কয়েকজন লোকের মোটর সাইকেল সশব্দে স্টার্ট হয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে বিকেলের দিগন্ত রেখার দিকে মিলিয়ে গেলো।
রবীন্দ্রনাথ আর বাদলবাবুর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের মধ্যে আবার বিশৃঙ্খলা উর্ধমুখী হলো। পরষ্পর বিরোধী পার্টির দুই দল গ্রামবাসী, তারা নিজেদের মধ্যেই হাতাহাতি, মারামারি আরম্ভ করলো। কয়েক জন লোকের ঠ্যাং ভাঙলো, কিছু মানুষের মাথা ফাটলো। খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশের গাড়ি এলো! পুলিশ দেখে গ্রামের জনগন সেখান থেকে চম্পট দিলো। পুলিশ এলোপাথারি কয়েকজনকে তাদের এসইউভি গাড়িতে পুরে থানায় চালান দিলো।
পরের দিন বিকেলের জনসভায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা তার জ্বালাময়ী ভাষণে বললেন – এরকম ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের আমরা নিন্দা করি! ওদেরকে আপনারা নিশ্চয়ই দেখে রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ আর বাদলবাবুর ছদ্মবেশ ওরা বিরোধী পার্টির দালাল। আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী পার্টির হয়ে এই গ্রামে ওরা ভোটের ক্যাম্পেন করতে এসেছিল!
- বন্ধুগন। আবার বলছি, আপনারা এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আসন্ন ইলেকশনের আগে, বিরোধী পার্টির ওই লোকদুটো রবীন্দ্রনাথ আর বাদল সরকারের ছদ্মবেশ ধরে আমাদের এলাকায় গন্ডোগোল পাকাতে এসেছিল! আপনারা সবাই এই সব ভূয়ো প্রোপাগান্ডা থেকে সাবধান থাকবেন! বন্ধুগন, আমরা চাই, বিরোধীদের সমস্ত চক্তান্ত ব্যর্থ করে আপনারা দলে দলে আমাদের পার্টিকেই ভোট দিন ...!
0 comments: