0

সম্পাদকীয়

Posted in




প্রকাশিত হলো ঋতবাক অষ্টম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা।

শীত এলো বলে। হেমন্তের রং, গন্ধ অবশ্য এখনও প্রকৃতিতে। শোনা যাচ্ছে এবারের এই শীত নাকি হতে চলেছে সাম্প্রতিককালের তীব্রতম, যা সামগ্রিক উষ্ণায়নেরই বিপ্রতীপ ফসল। এমনিতেই এই নভেম্বর মাসটার সঙ্গে বিষণ্ণতার যোগ নিবিড়। এই আধো অন্ধকার সময় হঠাৎ বয়ে আনলো বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহারের খবর। একটু যেন আলোকিত হলো চারপাশ। আরেকটি আনন্দ ঘোষণা হয়েছে দিনকয়েক আগে। অতিমারির আবহে একবছর বিরতির পর কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জানুয়ারির শেষদিন থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অবধি। প্রকাশনা, পড়ুয়া সম্প্রদায়ের কাছে এ এক বড়ো প্রত্যাশার প্রাপ্তি। বইপাগল মানুষের মেলামেশার চেনা ছবিটি আবার দেখতে পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলো ''উলটি গিনতি''। 

সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শ্রীশুভ্র

Posted in




রাস্তা ঝাঁট দিয়ে অর্থ উপার্জন বরং অনেক সহজ। কিন্তু লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন আদৌ সহজ নয়। পেশা হিসাবে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ও সংসারধর্ম পালন করে বহু মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু পেশা হিসাবে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। তাও জীবনের অনেক বছরের সংগ্রামের পর, জনপ্রিয়তার নিরীখে কোন কোন লেখক সাহিত্যিকের পক্ষেই পেশা হিসাবে লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরা সম্ভব হয়। তাদের সংখ্যা গুটি কয়েক। কিন্তু বাকি যাঁরা আজীবন লেখালেখির সাধনায় ব্যস্ত পেশা হিসাবে তাঁদেরকে অন্য কোন না কোন কাজকেই বেছে নিতে হয়। আর নয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় লেখালেখির একান্ত সাধনাকে। না রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার পেশার প্রতি কোনরকম কটাক্ষ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় আদৌ। বা পেশা হিসাবে ঝাড়ুদারীর সাথে লেখালেখির কোন তুলনা টানাও নয়। বলার কথা শুধু এইটুকুই যে একজন ঝাড়ুদারের পক্ষেও সংসার চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু একজন লেখককের পক্ষে সেই একই কাজ দুঃসাধ্য। কিন্তু কেন? প্রশ্নটি সেখানেই।

বিনা পয়সায় কেউই রাস্তা ঝাঁট দেয় না রোজ। সখের স্টান্টবাজি দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরিস্কার রাস্তায় একসাথে একধিক নতুন ঝাঁটাসহ টিভি ক্যামেরার ফুটেজ খাওয়ার নির্ধারিত দিন ছাড়া। কিন্তু বিনে পয়সায় লেখা প্রকাশের জন্যে কোন লেখকেরই উদ্যোমের কোন অভাব দেখা যায় না কখনো। একজন ঝাড়ুদার বিনা পয়সায় যে কাজ করেন না, একজন লেখক কেন সেই কাজ পয়সা ছাড়াও অম্লানবদনে করতে এগিয়ে যান? প্রশ্ন এখানেও। তবে কি রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজটিকে অর্থমূল্য বিচার করার যে আত্মসম্মান একজন ঝাড়ুদারের থাকে, একজন লেখকের তাঁর লেখাটিকে অর্থমূল্য বিচার করার মতো সেই ন্যূনতম আত্মসম্মানটুকুও কি থাকে না? থাকলে তিনি বিনে পয়সায় তাঁর লেখাকে প্রকাশকের হাতে তুলেই বা দেন কি করে? এর সহজ একটি উত্তর এই মনে হয়, পাব্লিকের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে কারুর মনে ব্যক্তিগত আনন্দ হয় না। তাই বিনা পয়াসায় সেই কাজ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। ভোটের ঠেকায় স্টানটবাজির দলীয় উদ্যোগ ছাড়া। কিন্তু পাব্লিকের কাছে বিনা পয়সায় হলেও নিজের লেখাটি পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই একজন লেখকের ব্যক্তিগত আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না বল্লেই হয়। না এইটুকুই সব নয়। আরও একটি বড়ো কারণ রয়েছে। একজন ঝাড়ুদার জানেন, প্রয়োজনে পাব্লিকই নিজেদের গরজে অর্থের বিনিময়ে তাকে দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করিয়ে নেবে। নয়তো একদিন রাস্তা দিয়ে চলাচলই দুস্কর হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনই একজন লেখকও জানেন তাঁর লেখা পড়ার গরজে পাব্লিক কোনদিনও তাঁর কাছে ছুটে আসবে না, অর্থ মূল্যে লেখা কেনা তো দুরস্থান।

এই যে পড়ার প্রতি অনাগ্রহ, না পড়লেও জীবনের কোথাও কোন অসুবিধা ঘটার কোন কারণই ঘটে না, ঘটবে না কখনোই; এই বোধ ও বিশ্বাস থেকেই লেখকের কাছ থেকে অর্থমূল্যে লেখা কিনে পড়ার মতো পাঠক থাকে না। এই সত্যটুকু সবচেয়ে ভালো জানেন একজন প্রকাশক। তাই স্কুল কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের বিষয়ে তিনি যত আগ্রহী হবেন, একজন লেখকের গল্প কবিতা প্রবন্ধ প্রকাশের বিষয়ে তাঁর যে কোন ব্যবসায়িক আগ্রহ থাকবে না সেতো বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী লাভের জন্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বই কেনার আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক, প্রয়োজনটুকু এতটাই সর্বাত্মক যে না কিনে উপায় নাই। তা সে যতই অগ্নিমূল্য হোক না কেন। খেয়ে পড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে য়ে কোন একটি ভালো ডিগ্রী এতই মহার্ঘ্য। কিন্তু একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ বা গবেষণা গ্রন্থ রোজকার বেঁচে থাকার জন্যে আদৌ জরুরী নয়। কিন্তু একটি পরিস্কার রাস্তা অনেক বেশি জরুরী। তাই সমাজের কাছে একজন লেখকের থেকেও একজন ঝাড়ুদারের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি।

আবারও বলি, ঝাড়ুদারের সাথে লেখকের কোন লড়াই বা প্রতিতুলনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমাদের সমাজে একজন লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি সেইটুকু অনুসন্ধান করাই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই হইহই করে উঠবেন হয়তো। তা কেন? তাহলে এত পত্র পত্রিকা এত বইপত্র, এত বইমেলা এসব কিসের জন্যে? খুবই সত্য। কিন্তু এসবই বই প্রকাশের সাথে যুক্ত প্রকাশক সম্প্রদায়ের জন্যে। এইগুলি না থাকলে তাদের ব্যবসায় গণেশ উল্টানো অবধারিত। অনেকেই প্রতিবাদ করবেন এই বলে যে তাঁরা যথেষ্টই বইপত্র কেনাকাটি করেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও। তাহলে সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন ওঠে কি করে? ওঠে, কারণ এই যে এত লেখা, এত লেখক, তার মধ্যে কয়জন শুধু তাঁর লেখাকেই পেশা হিসাবে আঁকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে আছেন? আমরা সবাই জানি, সেই মাত্র কয়েকজনের সংখ্যাটাই কি মারাত্মক ভাবে কম। আমরা এটাও জানি, অধিকাংশ লেখকই অন্য কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত থেকেই কেবল মাত্র নেশা আর ভালোবাসা হিসাবেই লেখালেখি চালিয়ে আসছেন। অধিকাংশ বিখ্যাত লেখকই অন্য কোন পেশায় গ্রাসাচ্ছাদনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে তবেই লেখালেখির নেশাকে টেনে নিয়ে চলেন। সেই লেখা থেকে সামান্য কিছু আয় যদিও কখনো সখনো হয়ও, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সুরাহা ঘটানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। এইখানেই আমাদের সমাজে একজন লেখকের মূল অপ্রাসঙ্গিকতা। অন্য যে কোন পেশাজীবী মানুষের যে সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেমন ডাক্তার, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, মিস্ত্রী, শিক্ষক, আমলা থেকে শুরু করে দোকানি এমন কি আমাদের লেখার শুরুতে যে ঝাড়ুদারের উপমা টানা হয়েছে, তাদের; একজন লেখকের কি সেই একই সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান এই সমাজে? সামাজিক এই প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতেই কোন কাজের প্রাসঙ্গিকতার নির্ধারণ হয়ে থাকে।

তাই লেখালেখি ও লেখকের কোনরকম প্রাসঙ্গিকতাই গড়ে ওঠে নি আমাদের সমাজে। অবশ্যই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পেশার পাঠপুস্তকের লেখকরা আমাদের এই আলোচনার মধ্যে পড়েন না। মনের খোরাক জোগানো, চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করা, জীবনবোধের বিস্তার ঘটানোর জন্যে যে সব লেখালেখি ও তার লেখকরা দুঃখের বিষয় হলেও আজও সামাজিক ভাবেই ব্রাত্য। তাদের সাধনা ও পরিশ্রম, সমৃদ্ধি ও অর্জনের কোন রকম অর্থমূল্য তৈরী হয়ে ওঠে আমাদের সমাজে। এই যে কোনরকম অর্থমূল্য তৈরী না হওয়া এটাই প্রমাণ করে একটি সমাজে লেখক শ্রেণীর অপ্রাসঙ্গিকতার। শুরুর সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করলে বলতে হয়, ঝাড়ুদার প্রাসঙ্গিক কিন্তু লেখক অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু কেন এই অবস্থা? সেটি মোটামুটি ঠিকমতো বুঝতে গেলে একবার ফিরে তাকাতে হবে আমাদের ইতিহাসের দিকেই। আধুনিক বাংলার ইতিহাস, সাগর পারের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে গড়ে দেওয়া ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ব্যাপি গড়ে ওঠা একটি জনপদের ধারাবাহিক অগ্রগতির সামাজিক ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাস পলাশীর প্রান্তরেই কবরস্থ। তারপর ব্রিটিশের স্কুলে পড়াশুনো করে মেকলের এ বি সি ডি মুখস্থ করে ব্রিটিশের তৈরী ডিগ্রী বগলদাবা করে আমাদের সুসভ্য হয়ে ওঠা। এটাই আধুনিক বাংলা ও বাঙালির সার্বিক ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস পর্যালোচনার পরিসর নেই বর্তমান আলোচনায়, তবুও এই ইতিহাসটুকুর সামগ্রিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারলে আজকের বাঙালি সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিটুকু ছোঁয়া যাবে না আদৌ। ব্রিটিশের স্কুলে এ বি সি ডি মুখস্থ করে এক একজন অকস্ফোর্ড কেম্ব্রিজ ডিকশনারীর বিশেষজ্ঞ হয়ে ম্যকবেথ থেকে শুরু করে প্যরাডাইস লস্ট আবৃতি করে আমরা শিখেছি কি করে মনমতো একটি সরকারী কি বেসরকারী চাকুরী বাগিয়ে নিতে হয়। এবং শিখেছি সেই বাগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিযোগিতার রাস্তা সাফ করতে কখন কাদের পায়ে সঠিক পরিমাণে তৈলমর্দন জরুরী। কবি কত তীব্র আক্ষেপেই না বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ কর নি’। এই যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, একটি সমাজের এই যদি আধুনিকতার সার্বিক চেহাড়া হয়, তবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই সমাজের উঁকি দেওয়ার আগ্রহ কতটুকু থাকবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী আর মাসিক উপার্জনই যে সমাজের সবকিছু বিচারের মানদণ্ড সেই সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। একজন লেখক ঠিক ততখানিই বড়ো লেখক, যত বড়ো তাঁর ডিগ্রী ও যত বেশি তাঁর মাসিক উপার্জন। তারপর তো তিনি একজন লেখক! তারও পরে তাঁর জনপ্রিয়তা। লেখা ও লেখকের সামাজিক কোন প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও। এই হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক চিত্র।

ব্রিটিশের স্কুলে সুসভ্য হয়ে ওঠা বাংলা আরও একটি শিক্ষা অর্জন করে নিতে পেরেছে সহজেই। দেশের অধিকাংশ জনগণ যত বেশি পরিমানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তত বেশি আরামেই দিন কাটবে এ বি সি ডি মুখস্থবিদ ডিগ্রীধারীদের। তাই বৃটিশ চলে যাওয়ার পর সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও অধিকাংশ বাঙালিকেই আমরা অশিক্ষিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অশিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ যত বেশি, লেখকের লেখার পাঠকও তত কম হবে। এতো জানাই কথা। ফলে আমাদের সমাজে একজন লেখকের সামাজিক অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি ব্যাপক সেটি অনুধাবন করতে গেলে এইসব বিষয়গুলির দিকেও সার্বিক নজর দিতে হবে। হবেই। কিন্তু ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির মতোই আমরাও যদি কালের ধারাবহিকতায় একটি স্বাধীন জাতির স্বাধীন সমাজের মতোই মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে দিনে দিনে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাতে বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ ও পরিসর পেতাম, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সাথে স্বাধীনভাবে মোলাকাতের মধ্যে দিয়ে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে আমাদের আপন স্বাধিকারে অর্জিত সমৃদ্ধির পথেই আমরাও একদিন অধুনিক যুগে পা রাখতে পারতাম। আধুনিক যুগের চৌহদ্দিতে সেই প্রবেশ ঘটত আমাদের নিজেদের পায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপেই। ব্রিটশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে নয়। এই যে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাঙালির একাংশের আধুনিক হয়ে ওঠার অভিশপ্ত ইতিহাস, এই ইতিহাসেই নিহিত আমাদের সার্বিক ব্যর্থতার আজকের চিত্রগুলি। পরিতাপের কথা আমাদের ইতিহাসের এই দিকটি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত মানুষদেরই কোনরকম বাস্তব ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে নি আজকেও। তার মাশুলই গুনছি আমরা প্রতিদিনের সমাজ ও জীবন বাস্তবতায়।

কিন্তু বাঙালির পাঠাভ্যাস ও তার জীবনে বইয়ের প্রকৃত অবস্থা, বাঙালি জনমানসে একজন লেখকের অস্তিত্ব ও সম্মান, এইসব বিষয়গুলি প্রকাশক মাত্রেই জানেন। তাই লেখককে একটি সৌজন্য সংখ্যা ধরিয়ে দিয়েই তিনি কোনরকমে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সাময়িকী। কিন্তু বই প্রকাশের প্রয়োজন হলেই প্রকাশকের মাথায় হাত। কে কিনবে লেখকের বই? কয়টি সংখ্যা বিক্রী হবে? বই প্রকাশকের লগ্নীই বা কি করে মুনাফার মুখ দেখবে? তিনি তো আর দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসে পড়েননি? তখনই প্রকাশক লেখকের কাছেই তাঁর বই প্রকাশ করে দেওয়ার নানান রকম স্কীমের ফাঁদ পাতেন। লেখক একবার শুধু ধরা দিলেই হলে। প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত। ফেল কড়ি মাখো তেল। তোমারই পয়সা। তোমারই বই। আমি শুধু লাভের বখড়া রেখে বই ছাপিয়েই ক্ষান্ত। তরপর তোমার বই বিক্রীই হোক আর নাই হোক। মাথাব্যাথা আমার নয় তোমার।

কিন্তু লেখকেরই বা এত মাথা ব্যাথা কেন? কি হবে লিখে? কিই বা হবে সেইসব লেখা জমিয়ে বই প্রকাশ করে? নিজের বা নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করে? প্রথমত লেখক কেন লেখেন? লেখেন নিজের কথাগুলি বলার জন্যে। সে তো ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ করেও বলা যায়। বলাই যদি হয় উদ্দেশ্য। কিন্তু না। শুধু বলাই তো আর উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য অন্য একজনকে শোনানো। বেশ তো, বাড়িতে যিনি শুনতে চান, তাঁকে শুনিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্যে আবার কষ্ট করে সময় ব্যায় করে লেখাই বা কেন। কারণ তো শুধুই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যেই নয়। কারণ সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যেই। সেই আনন্দই হলো সংযেগের আনন্দ। একজন লেখক তখনই লেখক, যখন তিনি পাঠকের সাথে সেই সংযোগ সূত্রটি গোড়ে তুলতে পারেন ঠিকমত। প্রত্যেক লেখকের অস্থিমজ্জায় এই সংযোগেরই সাধনা। লেখক চান তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের। এই যে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের একন্ত অভীপ্সা ও নিরন্তর তাগিদ, সেই তাগিদেই একজন লেখক বাজারের সব রকম নিয়মকেই শিরোধার্য্য করে নিতে বাধ্য হন। তাই বাধ্য হন বিনা পারিশ্রমিকেও লিখতে। বাধ্য হন নিজের কষ্টার্জিত অর্থে হলেও সামর্থ্য থাকলে বই ছাপাতে। বাধ্য হন অন্য কোন পেশায় নিযুক্ত হতে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ারই জন্যে। আমাদের সমাজ ও বইয়ের বাজারের কাছে লেখক তাই দাসত্বের শৃঙ্খলেই বেঁধে ফেলেন নিজেকে। না ফেললে যে তাঁর মুক্তি নাই। কেননা তাঁর মুক্তি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই বহজনের সাথে সংযোগসূত্র গোড়ে তুলতে পারার মধ্যেই।

কিন্তু সার্বিক অশিক্ষিত মানুষের সমাজে মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতার পরিসরে এমনকি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের জীবনেও লেখকের কোন লেখার সাথে এই সংযোগ সূত্র গড়ে তোলার কোন রকম প্রাসঙ্গিগতাই নাই আমাদের দেশ ও সমাজের জীবনে। তাই সাধারণ ভাবেই কি অশিক্ষিত কি শিক্ষিত সব ধরণের মানুষের কাছেই একজন লেখক ও তাঁর লেখা মূলত অপ্রাসঙ্গিক ও ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকে। পড়ে থাকে অনাদরে অবহেলায়। এইকারণেই আমাদের দেশে মানুষের বইপত্র পড়ার অভ্যস প্রায় নাই বললেই চলে। বইপত্রের পাঠক থাকলেই বইয়ের বাজার থাকতো। আর বইয়ের বাজার যত শক্তিশালী হবে ততই লেখকদের সমাদর ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে। কেবল মাত্র তখনই একজন লেখক লেখাকেই পেশা করে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদা পুরণ করতে পারবেন অন্তত। যখন লেখকও হয়ে উঠবেন সমাজেরই প্রাসঙ্গিক একটি অংশ।

অনেকেই হয়তো বলবেন আসলে ইনটারনেট প্রযুক্তির বিপ্লবের কারণেই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। অনেকেই দোষ দেবেন বোকাবাক্সেরও। কিন্তু আমাদের আলোচনা এই দুইটি বিষয়কে বাদ রাখলেও সর্বাংশেই সত্য। অর্থাৎ নেটে আসার আগে থেকেই বাঙালির পাঠভ্যাস এরকমই লজ্জাজনক ভাবেই কম ছিল। বোকাবাক্স আসারও আগে যে বইয়ের বাজার খুব বিরাট ছিল, না বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। আর ছিল না বলেই কলকাতা বইমেলের জন্ম হয়েছিল। মেলার হুজুগেও যদি কিছু পরিমানে অবিক্রীত বইয়ের সৎকার করা যায়। বাংলায় বইমেলার দাপট দেখে একথা মনে করার কোন কারণই নাই যে বাঙালি বই পাগল জাতি। বরং ঠিক এর উল্টো। বাঙালি বইয়ের থেকে দূরে থাকতেই বেশি অভ্যস্থ বলে বইকেই বাঙালির ঘরের সামনে হাজির হতে বইমেলায়র মাঠে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে। অধিকাংশ উন্নত দেশে ও জাতিতে মানুষ সারা বছর ধরেই যে পরিমাণে বই কেনে ও পড়ে, তাতে কিন্তু সেইসব দেশে বইয়ের প্রকাশককে সারা বছর ধরে বাৎসরিক বইমেলার জন্যে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না। তাই সেই সব দেশে বইমেলার হুজুগও বেশি দেখা যায় না। সেখানে মানুষ হুজুগে পড়ে বই কেনে না। কেনে বই পড়ার জন্যেই। পড়ে জীবনের সাথে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই। পড়ে তার জীবনকে জানার ও অনুধাবনের একান্ত তাগিদেরই তীব্র সংবেদন থেকেই। সেখানে বই ও লেখালেখির বিরাট বাজার বিদ্যমান। এবং হ্যাঁ ইনটারনেট বিপ্লবের পরেও। কারণ ইনটারনেট একটি মাধ্যম। ছাপাখানার মতোই। সেই মাধ্যম বইয়ের বজার সঙ্কুচিত করার বদলে বরং প্রাসরিত করেই চলেছে। আরও বেশি করে কদর বেড়েছে তাই লেখকদেরও। তাই উন্নততর দেশে ও জাতিতে লেখকের প্রাসঙ্গিকতা সমাজের অস্থিমজ্জাতেই প্রোথিত। হ্যাঁ আমাদের দেশের সেই ঝাড়ুদারদের মতোই প্রাসঙ্গিক। কিংবা হয়তো তার থেকেও বেশি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুবল দত্ত

Posted in




















ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইন্টুইশন

আমরা সবাই জানি ‘থট রিডিং’-এর কথা। লুকোনো গুপ্ত সংখ্যা অনায়াসে কেউ কেউ বলে দেয়। কিংবা লটারির প্যাকেট থেকে কেউ একটা কাগজ বের করে দেয় যেটা থেকে অবশ্যই কারো প্রাপ্তি হয়ই। এইরকম রেস কোর্সে গবেষণাগারে জীবনযাপনে কোনো জটিল সমস্যায় বিপদের ঠিক আগের মুহূর্তে অসংখ্য উদাহরণ আমাদের জীবনে পরিবেশে সমাজে ছড়িয়ে রয়েছে। এইরকম স্থিতিতে চট জলদি কারো কারো ব্রেন সক্রিয় সিগন্যাল পায় যার নাম অন্তর্জ্ঞান বা ইন্টুইশন।

অন্তর্দৃষ্টি হল, বাস্তব প্রমাণ বা সচেতন যুক্তি ছাড়া অন্তরের অনুভূতি দিয়ে কোনো বিশেষ জ্ঞান যা মস্তিষ্ক থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে এবং তার অর্জনের ক্ষমতা। বিভিন্ন জ্ঞানী একে অন্তর্দৃষ্টি বলেন আর এই শব্দটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন,যেমন অজ্ঞাত জ্ঞান, অভ্যন্তরীণ অনুভূতি,সচেতন যুক্তির প্রয়োজন ছাড়াই সহজাত কিছু বোঝার ক্ষমতা ইত্যাদি।

অনেকে মনে করেন অন্তর্দৃষ্টি কেবল অনুমানের একটি রূপ। আসলে কিন্তু এটা অনেক বেশি গভীর তত্ত্বের বিষয়। কিছু গবেষক বলেছেন যে এটি হলো সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার রূপ। পাশ্চাত্য দেশে প্রায়শই এটিকে লোকে gut feeling বলে। আসলে যখনই এমন কোনো সমস্যা আসে তখন বিচার বুদ্ধি কাজে আসেনা এবং তখনই সেটার সমাধান চাই, সেসময় কখনো কখনো কারোর মাথায় দ্রুত এই নির্দেশটি আসে। এই অন্তর্দৃষ্টি আমাদের এক অতিসূক্ষ্ম সতর্কতা প্রদান করে। অবশ্য কবি শিল্পীদেরও ইন্টুইটিভ বলা যায়। মোটকথা হঠাৎ করে ভাবের বশে করে দেওয়ার পর যখন সেটা আশাতীত ভাবে ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়,তখন সে নিজে নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়, এটা আমি কি করে করলাম? এইকথা তো আমি ভেবে করিনি?

অন্তর্দৃষ্টি শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ক্রিয়া intueri থেকে যার অর্থ বিবেচনা।কিংবা ইংরেজী শব্দ intuit থেকে মানে চিন্তা করা।

দর্শনের পদ্ধতি এবং সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান বা গণিতের মধ্যে গুণগত পার্থক্য নেই। মেটাফিলোসফিক্যাল ধারণা যে দর্শনের উপর নির্ভর করে অন্তর্দৃষ্টিও তাই। টিমোথি উইলিয়ামসন যুক্তি দিয়েছিলেন যে দর্শন চর্চায় অন্তর্দৃষ্টি কোন বিশেষ ভূমিকা পালন করে না, এবং অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে সংশয়কে অর্থপূর্ণভাবে বিচার সম্পর্কে সাধারণ সন্দেহ থেকে আলাদা করা যায় না।



আধুনিক মনস্তত্ত্ব :

সম্প্রতি মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, অন্তর্দৃষ্টি হল সমস্যাগুলির বৈধ সমাধানের তাত্ক্ষনিক ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ রিকগনিশন প্রাইমড ডিসিশন (RPD) মডেল ব্যাখ্যা করে, কেমন করে মানুষ বিচার বিশ্লেষণ না করে অপেক্ষাকৃত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বজ্ঞাতভাবে সম্ভাব্য সমাধানগুলি বেছে নেওয়ার একটি পরীক্ষা। RPD মডেলটি অন্তর্দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণের মিশ্রণ। অন্তর্দৃষ্টি হল প্যাটার্নমিলে যাওয়া প্রক্রিয়া, যা দ্রুত একশনের পরামর্শ দেয়। বিশ্লেষণ হল মানসিক অনুকরণ, একশনগুলির একটি সচেতন এবং ইচ্ছাকৃত পর্যালোচনা। ভাবনার প্রবৃত্তিকে প্রায়ই অন্তর্দৃষ্টি হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। নতুন মানব সমাজে অন্তর্দৃষ্টি ক্রমবর্ধমান মূল্যবান হয়ে উঠছে কারণ মনের অনেক তথ্য জানতে পারছি ও জানার আছে। গণিতের দর্শনে ক্যান্টের দাবী,সমস্ত গাণিতিক জ্ঞান অন্তর্দৃষ্টির বিশুদ্ধ রূপ। 1916 সালে ‘সাইকোলজিক্যাল টাইপস’-এ কার্ল জং-এর তত্ত্ব বলে, অন্তর্দৃষ্টি হল ব্রেনের একটি যুক্তিহীন ফাংশন আর চিন্তা ও অনুভূতি হল ব্রেনের যুক্তিসঙ্গত ফাংশন। জং অন্তর্দৃষ্টিকে এক অজানা উপলব্ধি বলে মনে করেন। জং বলেন যে, একজন মানুষ যার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি প্রভাবশালী, তার ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের একটি নির্দেশ যুক্তিসঙ্গত বিচারের ভিত্তিতে নয়, বরং নিবিড় উপলব্ধিতে কাজ করে। বহির্মুখী স্বজ্ঞাত নির্দেশ আশাব্যঞ্জক একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে যায়,পরিবর্তনের নিরন্তর সাধনা।


অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কে কেমন কথা বলেছেন :

শ্রী অরবিন্দ মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি বর্ণনা করেন। মনের প্রকৃতি দুরকম স্বেচ্ছাচারী স্বভাবের। প্রথমটি মানসিক অভিজ্ঞতার ছাপ রাখে যা সংবেদনশীল তথ্যের মাধ্যমে তৈরি হয় (মন বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন হতে চায়)। দ্বিতীয় প্রকৃতি হচ্ছে ক্রিয়া যখন এটি নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে চায়, ফলে মানুষ তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, রাগ দ্বেষ এবং অন্যান্য আবেগ সম্পর্কে সচেতন হয়। তিনি এই দ্বিতীয় স্বভাবকে পরিচয় দিয়ে জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, বর্তমানে ক্রমবিবর্তনের ফলে এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সংস্পর্শে মন অভ্যন্তরীণ শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের প্রতিক্রিয়াগুলিকে বাইরের বস্তুগত জগতের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিক উপায় হিসাবে নির্ভর করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ, যখন আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে চাই তখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের কাছে যা পৌঁছে দেয় তাকেই আমরা সত্য মনে করি। শ্রী অরবিন্দের মতে অন্তর্দৃষ্টি বা স্বজ্ঞান আত্মজ্ঞানের দ্বারাই জ্ঞানের ক্ষেত্রের অধীনে আসে। আত্মজ্ঞানের পরিচয় দ্বারা জ্ঞান আরও বিস্তৃত করা যায় যার ফলে স্বজ্ঞাত জ্ঞান পাওয়া যায়।

ওশোর মতে, মানুষের উত্তরণ মৌলিক জান্তব প্রবৃত্তি (natural animal instinct) থেকে তার বুদ্ধিতে হয়, ক্রমে অন্তর্দৃষ্টিতে এবং ক্রমান্বয়ে সে চেতনায় ওঠে। মানুষ ক্রমাগত সেই সচেতন অবস্থায় উঠে বাস করতে চায়। অন্তর্দৃষ্টি অবস্থায় আসা মানবতার চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি।

বৌদ্ধধর্মে আছে, তাত্ক্ষণিক জ্ঞানের মধ্যেই মন অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পায়। সচেতন চিন্তার প্রক্রিয়ার বাইরে অন্তর্দৃষ্টি থাকে, কারণ সচেতন হয়ে অচেতন তথ্য অ্যাক্সেস করতে পারে না। জেনবৌদ্ধ ধর্মে মানুষের স্বজ্ঞাত ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করার জন্য অনেক পদ্ধতি আছে, যেমন কোয়ান—যার সমাধানের ফলে ক্ষুদ্র জ্ঞানলাভের অবস্থা হয় (সাটোরি) ।

ইসলামে বিভিন্ন পণ্ডিত রয়েছে যারা অন্তর্দৃষ্টির কথা বলেন। অন্তর্দৃষ্টিকে প্রায়ই হাদাস (আরবি: حدس) বলা হয়। কখনও কখনও স্বজ্ঞাত জ্ঞান থাকার ক্ষমতা সম্পর্কিত কথা বলা হয়। সিহাব আল দীন-আল সোহরাওয়াদী তাঁর বই Philosophy Of Illumination (ইশরাক)এ বলেছেন যে, অন্তর্দৃষ্টি এক রহস্যময় জ্ঞান এবং রহস্যময় মনন (মুশাহাদা)। ইবনে সানি অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতাকে ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা বলেন। এবং এটি যে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্জন করা হয় না তাও তিনি বলেন। নিয়মিত জ্ঞান কেবল অনুকরণের উপর ভিত্তি করে হয়, কিন্তুস্বজ্ঞাত জ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতার উপর ভিত্তি করে হয়।

ওয়েস্টার্ন ফিলসফিতে প্লেটো প্রথমে অন্তর্দৃষ্টির কথা বলেছেন। তাঁর প্রজাতন্ত্র বইয়ে তিনি বাস্তবতার প্রকৃতি বোঝানোর জন্য মানুষের যুক্তির মৌলিক ক্ষমতা হিসেবে অন্তর্দৃষ্টিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। মেনো এবং ফেডো রচনায় তিনি অন্তর্দৃষ্টিকে পরমাত্মার মধ্যে বসবাসকারী একটি পূর্ব-বিদ্যমান জ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন অন্তর্জ্ঞান এমন একটি ঘটনা যা কেউ স্থূল জ্ঞান দিয়ে বা সচেতন হয়ে পায় না। তিনি গাণিতিক সত্যের একটি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে সেগুলি যুক্তি দ্বারা আসে না। প্লেটোর এই ধারণাটিকে কখনও কখনও অ্যানামনেসিস বলা হয়।

আলবার্ট আইনস্টাইন যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত। আপেক্ষিকতাবাদের জন্য সর্বাধিক পরিচিত, আলোকবিদ্যার প্রভাব ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপেয়েছেন তিনি বলেছেন, “প্রজ্ঞাবান মানুষের একমাত্র আসল সম্পদ হল অন্তর্দৃষ্টি।”

ডেসকার্টস তাঁর বই মেডিটেশনস অন ফার্স্ট ফিলোসফিতে, অন্তর্দৃষ্টিকে যুক্তিসঙ্গত যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত একটি প্রাক-বিদ্যমান জ্ঞান এবং মননের মাধ্যমে একটি সত্য আবিষ্কার বলেছেন। হিউম অন্তর্দৃষ্টিকে সময়, স্থান এবং কার্যকারণের সম্পর্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ইমানুয়েল কান্ট (জার্মান দার্শনিক) মনে করেন যে আমাদের মন আমাদের সমস্ত বাহ্যিক জ্ঞানকে স্থান আকারে এবং আমাদের সমস্ত অভ্যন্তরীণ অন্তর্দৃষ্টি (স্মৃতি, চিন্তা) সময়ের আকারে আমাদের সামনে প্রস্তুত করে। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি এবং ধারণাগুলি সমস্তই জ্ঞানের উপাদান। বিখ্যাত ইংরেজ কবি, পণ্ডিত এবং উপন্যাসিক রবার্ট গ্রেভস বলেন,অন্তর্দৃষ্টি হল সুপার-লজিক যা চিন্তার সমস্ত রুটিন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে এবং সমস্যা থেকে সরাসরি উত্তরে উঠে আসে। প্রাচীন চীনা দার্শনিক লাও তু বলেন, কারো ভিতরের Intuition বা স্বজ্ঞাত শক্তি তাকে তার শেষের দিন অব্দি যে কোনো ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অ্যান উইলসন শেফ একজন স্বনামধন্য লেখক বলেন, আমাদের অন্তর্দৃষ্টিতে বিশ্বাস করা উচিত কারণ প্রায়ই আমাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। একজন আমেরিকান অভিনেত্রী মনে করেন যে মহিলাদের একটি সহজাত স্বজ্ঞাত ক্ষমতা আছে এবং তারা পুরুষদের চেয়ে বেশি স্বজ্ঞাত।


অন্তর্জ্ঞান সিদ্ধান্ত কি?

যার অন্তর্জ্ঞান সক্রিয়, সে কীভাবে এবং কোথা থেকে মাথায় আসে তা না জেনেই অন্তর্দৃষ্টির ধারণাগুলি বলে দিতে পারে। সে বুঝতে পারে না কিকরে এটি নিজের থেকে সতঃস্ফুর্ত ভাবে মনের মধ্যে আসে। যখন কেউ আনন্দে থাকে কোনও দুশ্চিন্তা থাকে না এবং নিজের কাজে অত্যন্ত মনোযোগী হয় তখন সৃজনশীলতার মতোই স্বজ্ঞাত আসে। অন্তর্দৃষ্টি প্র্যাকটিস করা যায়। এবং এটি একটি প্রক্রিয়া যা সাধারণত চ্যানেলিং নামে পরিচিত।

আমাদের অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ছোটোখাটো ঘটনা আসেই যখন যুক্তিসঙ্গত যুক্তি প্রয়োগ করা খুব কঠিনহয়, যেখানে স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ আপনা আপনিই হয়ে যায়,এবং আমরা সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিই। উদাহরণ স্বরূপ, যেখানে অন্তর্দৃষ্টি সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যায়,সেগুলি হল জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা, কেনার জন্য সঠিক গাড়ি নির্বাচন করা, চাকরির মূল্যায়ন, শিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত, বাইরে খাওয়ার সময় খাবার নির্বাচন করা, পড়ার জন্য পরবর্তী বই নির্বাচন করা ইত্যাদি।

স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করার চেয়ে অনেক বেশি তাত্ক্ষনিক, কারণ এটি ব্রেনের অতিরিক্ত অনুভুতি কেন্দ্রকে সক্রিয় করে এবং বাইরে থেকে তথ্য সম্পর্কে সচেতন করে। একে গাট ফিলিংগ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, অতীন্দ্রিয়, অন্তর্দৃষ্টি অভ্যন্তরীণ কণ্ঠ, আধ্যাত্মিক নির্দেশ, ইত্যাদি নানা ধরনের লোক নানা নামে বলে। এই অনুভুতি কেন্দ্রগুলিকে ট্রেনিং এর জন্য এবং স্বজ্ঞাতভাবে তথ্য গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে আরও সচেতন করার জন্য আজকাল দেশে বিদেশে উচ্চতর চেতনা বিকাশের প্রচুর কেন্দ্র আছে। যারা এই ধরনের সেন্সরের অস্তিত্ব মানেন না তারা ‘আই কিউ’ বাড়ানোর জন্য সেই একই ট্রেনিং নিতে যান।


বিজ্ঞানের ভাষায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় :

কখনো কখনো হঠাৎ মাথায় কিছু বিশেষ বিচার বা জরুরী সিদ্ধান্ত আসে, তখন মনের দোটানায় হালকা পেটের ভিতর কিছু হয়, মাথা ঝিমঝিম করতে পারে, বুক ধকধক করতে পারে বা ঘাম হতে পারে। পরে সেটা একেবারেই সঠিক হতে দেখে মনে হয় এটা কি করে বললাম? এটাই আসলে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ। আগে থেকে পেটের ভিতর জানান দেওয়াটাকে হয়তো তাই বিদেশীরা gut feeling আখ্যা দিয়েছে।কখনো কখনো আমরা অধ্যাত্মিক কৃপার দোহাই দিয়ে থাকি,কিন্তু এই ঘটনা বিজ্ঞান সম্মত,এবং তা প্রমানিত হতে চলেছে। একে এখন সর্বসাধারণ ইন্টূইশন বলে জানে। মনের ভিতর থেকে স্বতষ্ফুর্ত এই আদেশ বা নির্দেশ হিত অহিত দুইই হতে পারে।

এখন বিদেশে ভবিষ্যৎ মননের পরীক্ষাগারে (future minds lab) রিসার্চ চলছে। কয়েকবছর আগে ইউনিভার্সিটি অফ সাইকোলজিস্ট এন্ড নিউরোসায়েন্টিষ্ট (UNSW) এর প্রফেসর জোয়েল পিয়ারসন একটি রিসার্চ জার্নাল পেপার পড়ার সময় এক অদ্ভুত অনুভূতির কথা বলেন। কাগজটি হাতে নিয়েই তাঁর এক অদ্ভুত অনুভুতি হলো। তিনি একটুও পেপারটা পড়েননি, তার ভিতরে বিষয় বস্তু কি সেটাও জানতেন না,কিন্তু তাঁর মনে হলো এর ভিতরে কিছু ভুল তথ্য নিশ্চয়ই আছে। গবেষণায় নিশ্চয় কিছু ত্রুটি রয়েছে যাতে ভুল তথ্য এই জার্নালের মধ্যে আছে। এবং পড়ে দেখলেন সেটাই একদম ঠিক। UNSW এর ফিউচার মাইন্ডস ল্যাবে সাতটি ছোট ছোটো ঘরে কম্পিউটারের স্ক্রিন ও মনস্তত্ত্ব এবং নিউরোসায়েন্সের পাঠ্যপুস্তকগুলি রয়েছে। ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক পিয়ারসন এবং সহ গবেষক গ্যালাং লুফিয়ান্তো এবং ক্রিস ডনকিন ইন্টুইশনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য গবেষণা পরিচালনা করেন। ওনারা এখানে প্রায় দুহাজার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অন্তর্দৃষ্টির সংজ্ঞা দিলেন, “যুক্তিসঙ্গত, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা বা অনুমান ছাড়াই সফল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা”।তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তথ্য পরিমাপের পর এই সংজ্ঞা দিয়েছেন।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা অন্তর্দৃষ্টি বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভব পেতে সাহায্য করতে পারে। মনে করুন এমন এক রেষ্টুরেন্টে ঢুকলেন যেটাতে কখনো আসেননি। ঢোকার আগেই আমাদের সচেতনতা ছাড়া, আমাদের মস্তিষ্কে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, নোংরা মেঝে, টেবিলে নকল ফুল, একটি আঁশটে গন্ধ। এই তথ্যগুলি হয়তো অতীতের কোনো অভিজ্ঞতাগুলির সাথে জুড়ে দেয় ব্রেন। নোংরা মেঝে, নকল ফুল,অদ্ভুত গন্ধ খারাপ খাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমরা সচেতনভাবে এর কোনটিই উপলব্ধি করি না। কিন্তু আমরা যা বুঝি তা হলো হঠাৎ একটা শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি, না, আমাদের এখানে খাওয়া উচিত নয়।

অন্তর্দৃষ্টি দ্রুত কাজ করে। রেস্তোরাঁর দরজা খোলার আগেই বুঝে যাই এখানে নয়। এবং এটি শারীরিক ভাবে হয়। আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে অসুস্থ বোধ করি, অথবা আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, অথবা আমরা ঘামতে শুরু করি। এইজন্যেই এটিকে gut feeling বলা হয়।

Intuition বা অন্তর্দৃষ্টিকে আমরা ধর্মের সাথে বা আধ্যাত্মিকতার সাথে জুড়ে দিই, কখনো বা আমরা সেকেলে প্রাচীন ধারণা আখ্যা দিয়ে থাকি, কিন্তু এটা ঠিক এই ঘটনা প্রায় প্রত্যেকের জীবনের সাথে জড়িত। এটি এমন একটি অনুভূতি যা আমরা স্বপনে জাগরণে মাঝে মাঝেই পাই। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ করে, একটি বিশেষ সিদ্ধান্তের সময়ে রহস্যময় আবেগের আকারে আসে। যেমন,এই অন্ধকার পথে আমার যাওয়া উচিত নয়, কিছু বিপদ নিশ্চয়ই হবে। এবং তা হয়ও। এই লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারি। এইরকম অনেক কিছু।অধিকাংশ মানুষ অন্তর্দৃষ্টি ধারণা গ্রহণ করে। তা সত্ত্বেও, তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুব একটা ছিল না। এই অন্তর্দৃষ্টি ধারণার একটি মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেছিলেন ডক্টর পিয়ারসন। তাঁর গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে কয়েকটি বিন্দুর মুভমেন্ট দেখে তাদের দিক নির্ণয় করতে বলা হয়েছিল, একই সাথে কয়েকটি পজিটিভ বা নেগেটিভ ছবি দেখতে হবে (যেমন,ছোটো শিশু ও কুকুরছানার ছবি পজিটিভ, আর, বন্দুক ও সাপের চিত্র নেগেটিভ)। ছবিগুলি বারবার ফ্ল্যাশ করা হচ্ছিল যাতে সে ছবিগুলি সচেতন ভাবে না দেখে। বৈজ্ঞানিক পিয়ারসন তাদের নির্দেশ দিতেন যে ওই ছবি বা স্পট যেন কেবল দেখতে থাকে, কিন্তু একেবারেই সচেতন ভাবে যেন না দেখে। যারা ছবিগুলো দেখছেন তাদের সচেতন ভাবে কিছু করার নেই। বিন্দুগুলির মুভমেণ্ট ডানদিকে হচ্ছিল যখন পজিটিভ ছবি ফ্লাশ করা হচ্ছিল এবং বাঁ দিকে ওই বিন্দুগুলি সরছিল তখন নেগেটিভ ছবি ফ্লাশ করছিল। ঘটনাটি দ্রুত ছিল এবং কখন বিন্দু বাঁ দিকে সরবে বা ডানদিকে এটার সিদ্ধান্ত এত দ্রুত ছিল যে তখন ব্রেনকে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে হতো। ওই ছবিগুলি রেটিনাতে পড়ছিল ও ব্রেনের অ্যামিগডালাতে প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল।

অবশ্য পড়ে ব্রেন স্ক্যানিংএর পরীক্ষা নিরীক্ষাতে অনেক বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, মানুষের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতার ছবি নেওয়া এবং তার বিশ্লেষণ করা যায়, সচেতন অবস্থায় ও অজ্ঞান অবস্থায় দু ভাবেই। অজ্ঞান অবস্থায় ব্রেনের যে চিত্র,মানে, সংবেদনশীল ছাপ,তার সাথে আগের সঞ্চিত চিত্রগুলির সাথে তুলনা করা হয়। সেসবেরও ছবি নেওয়া যায়। আমাদের সবার জীবনের অভিজ্ঞতা ব্রেনের মেমোরি সেন্টারে সঞ্চিত থাকে,যা আমাদের জীবনে আগে ঘটেছে তার উপর ভিত্তি করে। আমরা ফলাফলটিও মনে রাখি,এটি কি ভাল বা খারাপভাবে শেষ হয়েছিল? এই সঞ্চিত সংবেদনশীল ছাপগুলির সাহায্যে, আমরা অজান্তেই বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করি এবং ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। আমরা যে পরিস্থিতির যত বেশি বৈচিত্র্য অনুভব করেছি, আমাদের স্মৃতি তত বেশি সমৃদ্ধ হয়। যাইহোক, এই স্মৃতিগুলি কেবল তখনই সংরক্ষিত থাকে যেগুলি আমাদের প্রভাবিত করে। এবং ওইসব অভিজ্ঞতার স্মৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অন্তর্জ্ঞানকে প্রভাবিত করে।


অন্তর্জ্ঞান বিষয়ে কিছু সাবধানতা :

১। অন্তর্দৃষ্টির সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে। সব মানুষ নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।

অন্তর্দৃষ্টি হল অতীতের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সাধারণীকরণ, ভবিষ্যতের অবিশ্বাস্য বিভাজন নয়।

এবং পরিশেষে, স্বজ্ঞা পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে— হয় নিজেদের মধ্যে, অথবা আমাদের চারপাশের পৃথিবী। অন্তর্জ্ঞানের অভিজ্ঞতা থাকলে তবেই তা ব্যবহার করা উচিত। এবং তা জন কল্যাণের স্বার্থে ব্যবহার করা অবশ্যই দরকার। যদি নিজের স্বার্থের জন্যে, অর্থের কামনায় কিংবা কারো স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হয় তবে সেই শক্তি আর নাও থাকতে পারে।

২ খুব উত্তেজিত ও আবেগপ্রবন হয়ে ইন্টুইশন ব্যবহার করা উচিত নয়।

যদি কেউ তার অন্তর্জ্ঞান শক্তির জন্য লটারি বা ওইধরনের হঠাৎ পাওয়া ধন পেয়েছে সে যেন দ্বিতীয়বার সেই শক্তি ব্যবহার করতে না যায় তার কারণ মানসিক উত্তেজনা, ইতিবাচক বা নেতিবাচক, স্বজ্ঞাত সংকেতগুলিকে বিভ্রান্ত করতে পারে।পরে সে ডিপরেশনের শিকার হয়ে যেতে পারে।অশান্ত অবস্থায় কোনোমতেই ইনটুইটিভ সিদ্ধান্ত হয় না।

৩। খুব কম বা অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার কথা হঠাৎ মাথায় উদয় হলে তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়

হঠাত্‍ কারো মনে যদি উদয় হয়, এক্ষুণি একটা সুনামি হতে যাচ্ছে,কিংবা ওই বিল্ডিংটা হুড়মূড় করে ধসে যাবে কিংবা পুকুরে নেমে যদি কারো মনে উদয় হয় একটা কুমির এখানে নিশ্চয়ই আছে তবে সেটা কখনোই ফলপ্রসু হতে পারে না। কারণ সেটার সম্ভাবনা নেইই বললেই চলে। এমনকি প্লেনে চেপে এমনটা মনে হতে পারে যে প্লেন ক্র্যাশ করে যাবে হয়তো। কিন্তু সেটা অন্তর্জ্ঞান নাও হতে পারে।

৪। ব্রেন থেকে কিছু বিশেষ নির্দেশ তরংগ মাঝেমাঝে আসে সেটাকে ইন্টুইশন বলে ভুল করা উচিত নয়।

ক্ষিদে ভয় আসক্তি এগুলো সাধারণ বেঁচে থাকার প্রবণতা, বেসিক সার্ভাইভাল ইন্সটিন্ক্ট। এইগুলিকে অন্তর্জ্ঞান বলে ভুল করা উচিত নয়।

৫। নতুন কোনও পরিস্থিতিতে নিজের অন্তর্জ্ঞানকে বাজিয়ে দেখা উচিত নয়।


পরিশেষে :

আমার মতে অন্তর্জ্ঞান এমন একটি অমূল্য অতুলনীয় সম্পদ যা আমরা পেয়েও পাইনা। আমাদের ব্রেনের ভিতরে এমিগডালাতে এই ইন্টুইশনের সুইচ মজুদ রয়েছে, আমাদের বেশীরভাগ মানুষই সেটা আমৃত্যু অন করিনা। কারণ আমরা বেশি বেশি ব্যক্তিগত ইচ্ছা চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকি। সংকীর্ণতা, অহংকার, আন্তরিক ও বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলির সেবাতে তত্পর থাকি। অতীতের স্মৃতিতে ডুবে থাকি এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল হয়ে আত্মজ্ঞানের কথা ভুলে যাই। আমি কী এবং পৃথিবীতে আমার দিয়ে যাবার আছে, বুঝি না। আমার ধারণা প্রতিটি মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন সৃজনশীলতা আছে এবং তার সাথে অন্তর্জ্ঞান ওতপ্রোতে জড়িত। সেটারই উপলব্ধি করা চাই।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রাণীজগতে “জোর যার মুলুক তার” প্রবাদ বহু প্রচলিত ও সর্বজনবিদিত। অনুকূল পরিবেশে আপাতনিরীহ উদ্ভিদ জগতেও এই প্রবাদ আংশিক সত্য। গুল্মের বাড়বাড়ন্ত একটা আস্ত মোটাসোটা গাছকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। আবার ছোট জলাশয় পানায় ভরে গিয়ে জলে থাকা মাছেদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, অনেকসময় মারাও যায়। এই জোরের শক্তি হতে পারে সংখ্যাধিক্য, ছলচাতুরি, শারীরিক বল অথবা আবেগ সম্পন্ন প্রাণীদের ক্ষেত্রে মানসিক আবেগও হতে পারে। আকাশ থেকে হঠাৎ একটা বাজপাখি নেমে এসে পায়ের আঙুলে গেঁথে একটা পায়রা বা ইঁদুর নিয়ে উড়ে যেতে পারে আবার আট-দশটা শালিক মিলে একটা বেড়াল বা চিলকে পাড়া ছাড়া করতে পারে। একদা বলশালী বাঘ যে একাই হরিণের পাল তাড়া করে শিকার করেছে সেই আবার দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে বাণপ্রস্থে যাওয়ার মত নিভৃতে অরণ্যে উপবাসে প্রাণত্যাগ করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই একক অথবা গোষ্ঠীগত শক্তিপ্রয়োগ সীমিত কারণে, আত্মরক্ষা আর খাদ্য সংগ্রহ। ব্যতিক্রম মানুষের। মানব গণের মধ্যে আদিতে শক্তির এই দুয়ের প্রয়োগ বজায় থাকলেও পরে যত মস্তিষ্কের উন্নতি হয়েছে এবং বুদ্ধি বেড়েছে ততই বলপ্রয়োগে নিজের শক্তির প্রদর্শনী নানাভাবে করতে থাকে। তার জন্যে তারা পাথরকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই পাথরকে আবার সুনিপুণভাবে প্রয়োগ করতে ঘষে ঘষে ক্রমান্বয়ে তীক্ষ্ণ ছুঁচলো ধারালো করে তুলল। দূরে ছোঁড়ার জন্যে উপযুক্ত হাতলও বানিয়ে ফেলেছিল। প্রথমে যা ছিল শিকার করে তখনই খাওয়ার ব্যাপার, আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিখে নেওয়ার পর সংগ্রহ করে রাখতেও শুরু করল। অরণ্যের প্রান্তে এরকম একাধিক মানব গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকত। পরবর্তীকালে যখন তারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে যেতে শুরু করল তখন তাদের সামনে অনেক রকমের বিপদ এসে গেল, ভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সময়ের সাথে মানবগণের বিবর্তনে একাধিক প্রজাতির উদ্ভব হলে ভিন্ন প্রজাতির দল আফ্রিকার বাইরে প্রধানত প্রথমে ইউরোপ ও পরে এশিয়ায় চলে আসত। ইউরোপের ঠাণ্ডা আবহাওয়া তাদের অপরিচিত ছিল। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাই তারা মূলত গুহায় আশ্রয় নিত। সেইসব গুহায় বাস করত বন্যপ্রাণীরা, তাদের যুদ্ধে হারিয়ে তাড়িয়ে তবে জায়গা পেত সেখানে। ফলে শক্তির ব্যবহার যেখানে প্রথমে ছিল আত্মরক্ষা ও খাদ্য সংগ্রহের জন্যে সেটার সাথে যুক্ত হল আশ্রয়ের সমস্যা মেটাতে। এমন একটা সময় এল যখন একই সময়ে একই জায়গায় ভিন্ন প্রজাতির মানব মুখোমুখি। তখন তাদের মধ্যে থাকার জন্যে জায়গা দখলের প্রবণতা দেখা দিল, শুরু হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ। মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপকতা এবং নানা উপকরণ বিস্তার লাভ করে। মানুষের যুথবদ্ধ সভ্যতা তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে যা শেষ হয়েছে হিংস্রতায়, সৌজন্যে ষঢ়রিপু এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি। মনুষ্যেতর প্রাণির মধ্যে হিংস্রতা নেই বললেই চলে কারণ তারা প্রয়োজন ছাড়া আক্রমণ করে না, হত্যা করে না। দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির অনেক সুফল থাকলেও তা মানুষের মনে প্রতিহিংসার জন্ম দেয় যার জন্যে হিংস্রতা আধুনিক মানুষের মধ্যে মহামারি আকার নিয়েছে। মানুষের অবশ্য রিপুকে সংযত করে বুদ্ধিকে ভাল পথে চালনা করারও ক্ষমতা রয়েছে, এবং করেও। মানুষ একসময় তার পূর্বতন জীবিত প্রজাতির সাথে যৌন সঙ্গম করলেও ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের নিকেষ করতে দ্বিধা করে নি। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে মানুষ পূর্ব মানব প্রজাতিরা তিরিশ হাজার বছর আগে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সভ্যতার ক্রমোন্নতি মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী করে থাকার প্রয়োজন ও প্রবণতাকে উত্তরোত্তর উস্কে দিয়েছে। এই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শক্তির তারতম্য তাকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে প্রলুব্ধ করেছে, এক গোষ্ঠী অন্যকে শক্তিতে পরাজিত করে এলাকা বাড়িয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর একজন নেতা আছে যাকে গোষ্ঠীপ্রধান বা রাজা বলে মেনে নিয়েছে অন্যেরা ফলে গোষ্ঠীর মধ্যেই ক্রমে রাজার শক্তি আরও বেশি হয়েছে। সে তারই গোষ্ঠীর অন্যদের শাসন করে, শাস্তি দেয়। রাজার কিছু সহকারী থাকে, তারা অনুগতও বটে। তারাও অন্যভাবে ক্ষমতার স্বাদ নেয়। এভাবেই পৃথিবীর স্থলভাগ নানা ভূখণ্ডে সীমায়িত হয়ে আলাদা রাজ্য বা দেশ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে ভূ-পরিবেশভিত্তিক জীবন যাপনের পৃথক ধর্ম, সংস্কৃতি ও আচার। যোগাযোগের নিমিত্তে আপন আপন ভাষা। এরই মধ্যে কিছু মানুষ অন্য ধরনের, তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পৃথিবী ও জীবনের গোপন এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের গভীর রহস্য। কিছু প্রাকৃতিক সম্পদে সৌন্দর্য খুঁজে পায়। যা কিছু সন্ধান পায় ছন্দে ছন্দে তাকে ব্যক্ত করে যাতে সহজে প্রজন্মবাহিত হয়, হারিয়ে না যায়। এরও অনেককাল পরে সেইসব উক্তি স্মৃতি থেকে লেখা হল। আবেগ দর্শনের মধ্যে স্থায়িত্ব পেল, ও বিশ্বাস জন্মাল।

এক ভূখণ্ডের রাজা লোকলস্কর নিয়ে যখন অন্য ভূখণ্ডে এসে তার দখল নেয় তখন স্থানীয় বা দেশজ মানুষেরা বিপন্ন বোধ করে। যদি স্থানীয় মানুষেরাও ক্ষমতাবান শক্তিশালী হয় তবে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। সংখ্যাগুরু স্থানীয়দের কাছে বহিরাগতরা পরাজয় স্বীকার করে পালিয়ে যায়। আর স্থানীয়রা যদি শক্তিশালী না হয় তবে বহিরাগতদের আনুগত্য মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এক্ষেত্রে বহিরাগতরা সংখ্যালঘু হলেও জোর যার মুলুক তার। এর দুটো দিক আছে, বহিরাগতরা লুঠপাট করে চলে যেতে পারে অথবা সেখানে তাদের রাজত্ব কায়েম করতে পারে। রাজত্ব কায়েম করতে গেলে শক্তি প্রয়োগ করে দেশজ লোকেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর সরাসরি আঘাত হানতে পারে। অথবা যদি দু পক্ষই সংযমী, সহনশীল হয় তবে দু-দলের মধ্যে এসবের আদান-প্রদান করে মিশ্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। শেষেরটায় বেশিদিন রাজত্ব ভোগে সুবিধে হয়। সময়ের সাথে দু ভাবেই দেশজ সংস্কৃতি আস্তে আস্তে মুছে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। এইভাবে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশের দেশজ সংস্কৃতি, ভাষা বহিরাগতের অবদানে প্রায় নিশ্চিহ্ণ হতে বসেছে।

পৃথিবীতে একসময় একই ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে আল্পস ও পরে হিমালয়ের উদ্ভব। আল্পস ইওরোপকে সামলে রেখেছে আর হিমালয় কোলে করে আগলে রেখেছে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হিমালয়ের বিস্তার পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে হিমালয়ের অক্ষরেখা ধরে পূর্বপ্রান্ত অবধি এসে দক্ষিণে ঘুরে গিয়ে বর্মার আরাকান পর্বতমালা হয়ে জ্যা-এর আকৃতি ধরে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বিস্তীর্ণ এই এলাকায় ভূ-প্রকৃতির বিচিত্রতার জন্যে একাধিক সংস্কৃতি বহমান থাকলেও একটা সুতো কোথায় যেন সবাইকে বেঁধে রাখত যার প্রতিফলন পৌরাণিক কাহিনী মহাভারতে দেখা যায়, সুদূর গান্ধারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারতের হস্তিনাপুরে বৈবাহিক সূত্রে। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পূর্ব ইউরোপ থেকে একদল ইন্দো-এরিয়ান এসে ভারতের সেসময়ের দেশজ লোকেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। স্থানীয় অধিবাসীদের দুর্বল প্রতিরোধ অতি সহজেই উন্নত অস্ত্র ও যান ব্যবহার করে দমিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তারপর দীর্ঘদিন ধরে মিলেমিশে নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, সভ্যতা ও পৌত্তলিক ধর্মীয় সংস্কার, এবং বর্ণবৈষম্য চাপিয়ে দিয়ে তাদের পরিচিতি গ্রাস করে। বহিরাগতরা মূলত পুরুষ ছিল এবং সমাজে তাদের আধিপত্য ছিল বেশি। তারাই এখানের সমাজে মিশে স্থানীয় নারীদের সাথে যৌনমিলনের ফলে একদিকে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নেয় আবার অন্যদিকে মিশ্র জনমানসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যদিও কিছু প্রাচীন অধিবাসীদের উত্তরপ্রজন্ম এখনও রয়ে গেছে দেশের আনাচে-কানাচে, মূলত অরণ্যে উপজাতি হয়ে। প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাক্‌-ইন্দো-এরিয়ান দেশজ ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এর হাজার বছর পর নব্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বুদ্ধের পৌত্তলিক-বর্জিত অহিংস ধর্মের বাণী এশিয়ার প্রান্তে প্রান্তে আলো জ্বালায়। আরও পরে আরবের ইসলাম ধর্ম নেয় ইরান আর ইরানের সভ্যতা আসে আরবে। উত্তর-পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে আরব-ইরানের ধর্ম। পরবর্তিকালে একাধিক পশ্চিম এশিয়ার রাজা-বাদশাদের আক্রমণ বা আগমণের সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধিতা করেনি পরিবর্ত-সংখ্যাগুরু ভারতীয়েরা। আরও একবার তৈরি হয় নতুন সমাজ, মিশ্র ভাষা ও একাধিক ধর্মীয় সংস্কার। প্রায় সাতশো বছর মুসলমান সাম্রাজ্য চললেও সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মের লোকেরা কঠিন ধর্মবৈষম্য বজায় রেখে বিরোধহীন সমান্তরাল সমাজ মেনে নিয়ে একসাথে কাজ করেছে। সপ্তদশ শতক থেকে একাধিক ইউরোপীয় দেশ পৃথিবীজুড়ে দেশ দখলদারির সাথে এখানেও ঘাঁটি গাড়ে, তাদের নিজেদের সমাজের প্রতিলিপি তৈরি করে ছোট ছোট জায়গায়। উত্তর আমেরিকা সমেত অনেক দেশের জনজাতি কোণঠাসা হয়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ব্রিটিশ বাণিজ্যতরী নিয়ে এলেও ভারতীয়দের শাসক হতে দেরি করে নি কিন্তু অন্য দেশের মত সম্পূর্ণ গ্রাসও করতে পারেনি। তারাও ছিল সংখ্যালঘু বহিরাগত। সেসময়ের ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্য ইউরোপীয় উন্নত সভ্যতার শিক্ষা, প্রযুক্তি, সাহিত্য ইত্যাদির সাথে মিলিয়েমিশিয়ে এদেশের উচ্চবর্ণের শিক্ষিত লোকের মন জয় করে দু-শতকেরও বেশি সময় রাজত্ব চালায়। একসময় ভারতীয় জনগণের মধ্যে রোপিত হয় ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার বীজ। তা বৃক্ষের আকার নিলে ব্রিটিশ শাসনের ভার ভারতীয়দের হাতে সমর্পন করে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের “indigenous” বা দেশজ ধারণা অনুসারে ভারতবর্ষে প্রথম নীলচোখ-ইউরোপীয়দের আগমণের আগে যারা দীর্ঘকাল বসবাস করে এসেছে তারাই দেশজ। ‘নব্য’-সংখ্যাগুরু ভারতীয়রা একাধিক বহিরাগতদের দ্বারা রূপান্তরিত। বর্ণবৈষম্যের নিয়মানুসারে দেশজ লোকেদের বহু শতাব্দী ধরেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে আজও তারা একেবারেই প্রান্তিক, সংখ্যালঘু; ২০১১ আদমসুমারি অনুসার ভারতে ট্রাইবদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ কোটি অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার সাড়ে আট শতাংশের মত। যে সমস্ত স্থানিক গোষ্ঠী বহিরাগতদের সাথে না মিশে তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষার ঐতিহ্য বজায় রেখে নিজেদের মূল পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে তাদের নিম্নবর্গের লোক হিসেবে চিহ্ণিত করে দমন, পীড়ন ও অচ্ছুত করে রাখার প্রবণতা সেই ইন্দো-এরিয়ানদের আগমনের পর থেকেই বিভিন্ন ভাবে চলে আসছে। এইভাবে সমাজচ্যূত হয়ে থাকতে থাকতেই তারা মানসিক দুর্বল হয়ে পড়েছে। আসল দেশজ ভারতীয় হয়েও তারা নিজের দেশে ভয়ে দিন কাটায়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা কোনোরকমে অরণ্যবাসী হয়ে দিনাতিপাত করছে। সহ্য করছে সংস্কৃতি ও ভাষার লাঞ্ছনা, যাপনের জন্যে প্রশাসনের হাতে শারীরিক ও মানসিক নিগৃহীত, ধর্ষিত। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় কিছুই তারা পায় না, অথচ উন্নয়নের জন্যে উচ্ছেদ করা হয় একদা নিশ্চিন্ত অরণ্যবাস থেকে। অবশ্য জঙ্গলের জন্তুদের সাথে নিশ্চিন্তে বসবাস করার আদবকায়দা জানা থাকলেও ‘আর্বান জন্তু’দের হাতে নিগ্রহ, অসম্মানের প্রতিবাদ করতে পারে না। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এ শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানেই বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বহিরাগতদের পক্ষে মানুষে-মানুষে, অন্তর্গোষ্ঠী এবং আন্তর্গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য তৈরি ও টিকিয়ে রাখার মূল উদ্দেশ্যই হল যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে না পারে। যুথবদ্ধ বাস মানুষের সভ্যতার আদিমতম সংস্কৃতি। ঐক্যের শক্তিকে সংখ্যালঘু দুর্বৃত্তেরা সর্বকালে ভয় পায়।

আসলে সারা পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকেই পরিকল্পনা করে বহিরাগতরা দেশজ অধিবাসীদের নানাভাবে অত্যাচারের দ্বারা মানসিক দুর্বল করে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং বেশি ক্ষেত্রেই তারা সফল। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ভাষা সাহিত্য সবকিছু অসম্মান ও অগ্রাহ্য করার প্রবণতা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচার করে সমাজচ্যুত করছে। নানা ধরনের বর্ণবৈষম্য দিয়ে তাদের মানবতাকে কালিমালিপ্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। ভারতবর্ষও ব্যতিক্রম নয়। এখানের বহিরাগতরা আরও প্রাচীন। তারা আর বহিরাগত বলে ধরাই হয় না, তারাই যেন আসল ভারতীয়। একটা প্রচার আছে সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু বিচার করে গুরুরা অত্যাচার চালায় লঘুদের ওপর। আসলে দুর্বল শ্রেণিরাই বিপন্ন, শোষিত, সে যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন। এভাবেই একদা দেশজ মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে নানা সামাজিক নিয়মের মধ্যে বেঁধে দুর্বল করে বহিরাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের শক্তি বিস্তার করেছে। নারীকে দুর্বল শ্রেণি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। পুরুষ ছাড়া তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। একইভাবে প্রবীণদের জন্যে বাণপ্রস্থের ব্যবস্থা যাতে সামাজিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকেরা দূরে থাকে। আর অসুস্থ ও অশক্তদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয় না। এই সব দুর্বল শ্রেণিদের সবল করার জন্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নানা বিভাগে অনেক পরিকল্পনামাফিক কাজ হচ্ছে যার মধ্যে দুর্বল প্রান্তিক দেশজদের সবল করা। অশক্ত হয়ে বনবাস নয়, সমাজের প্রান্তে এবং বনে বাস যাদের তাদের শক্তি জোগানোই হবে মানবতার পরিচয়।

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in




টোটো-কোম্পানি
আমার ভারতবর্ষ- ৭

লখনউ: ইয়েহ শহর লালদার হ্যাঁয়

আবদুল হালিম শরর প্রণীত ''মশরিকী তমদ্দুন কা আখরি নমুনা ইয়া গুজিস্তা লখনউ' পড়ে বাঙালিরা নবাবি লখনউ'কে অনেক বেশি জানতে পেরেছে। যদিও অওয়ধের নবাবি উত্তরাধিকার ওয়জিদ আলি শাহের সঙ্গে শেষ হয়েছিলো মোকাম কলকাতার মাটিতে। কিন্তু এখানকার লোকেদের জন্য মেটেবুরুজের নবাব অচেনাই থেকে গিয়েছিলেন। অচেনা থেকে গিয়েছিলো লখনউভি তহজিবের কায়দাকানুন।

ছোটোবেলায় যখন প্রথম লখনউ গিয়েছিলুম যে ব্যাপারটা সব চেয়ে বেশি করে মনে থেকে গিয়েছিলো সেটা হলো লখনউভি তহজিব। সেখানে দেখা সাধারণ রিকশা চালকদের বোলি, অর্থাৎ মুখের ভাষা এবং তহজিব বা শিষ্টাচার আমরা দেশের এই প্রান্তে তথাকথিত 'শিক্ষিত, ভদ্রলোক' দের মধ্যেও কমই দেখেছি। সমাজের নিম্নতম বর্গের মানুষের স্বভাবেও এই পর্যায়ের মার্জিত রুচির কৃষি সুলভ দেখা যেতো। এই ব্যাপারটা আমাকে প্রথম লখনউ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে।


যদিও পরবর্তীকালে দেখেছি ধীরে ধীরে সেই সূক্ষ্ম পরিমার্জনা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন বাহরাইচ আর এটাওয়া জেলা থেকে আগত রুক্ষ কৃষি শ্রমিকদের প্লাবন লখনউ শহরের বাস্তবিকতা বদলে দিয়েছে। নিকট অতীতে দেখেছি অবস্থা অনেক বেশি শোচনীয় হয়েছে। গোরখপুরি 'লঠ-মার' কলচর অর্থাৎ জঙ্গলরাজের বোলবালা থেকে নবাবি লখনউয়ের তহজিব বহু যোজন দূরে।

আকবর বাদশাহ তাঁর রাজত্বকে বারোটি সুবাহতে ভাগ করেছিলেন ষোলো শতকের শেষদিকে। অওরঙ্গজেব পর্যন্ত আসতে আসতে তার সংখ্যা হয়ে যায় বাইশ। তার মধ্যে চারটি আছে সমকালীন পাকিস্তানের ঠিকানায় । বাকি আঠেরোটির মধ্যে নানা কারণে তিনটি সুবাহ ছিলো একটু আলাদা। এই সুবাহগুলোর নবাবদের মধ্যে কয়েকটি সমতা চোখে পড়ে। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে তাঁদের শিকড় ছিলো ইরানি সভ্যতায়। দেবগিরির ব্রাহ্মণ সন্তান সূর্যনারায়ণ মিশ্রকে দশ বছর বয়সে দাস হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন
ইরানি রাজপুরুষ হাজি শফি। ধর্ম পরিবর্তনের পর তাঁর নাম হয় মহম্মদ হাদী। হাজি শফি বাদশাহ অওরঙ্গজেবের চাকরি ছেড়ে ইরানে ফিরে যান। সঙ্গে নিয়ে যান মহম্মদ হাদীকে। হাজি শফির মৃত্যুর পর হাদী আবার হিন্দুস্তানে ফিরে আসেন। শিক্ষানবীশ ছিলেন বিদর্ভ সুবাহের দেওয়ান আবদুল্লাহ খুরাসানির অধীনে। পরবর্তীকালে তাঁকে আমরা চিনবো মুর্শিদকুলি জাফর খান হিসেবে। সুবাহ বঙ্গালের দুর্ধর্ষ নবাব।


কুলি কুতব বেঘ ছিলেন ইরানের হামাদান থেকে আসা একজন ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা। সময়ের ফেরে তাঁকে আমরা দেখতে পাই সুলতান কুলি কুতব শাহ নামে গোলকোণ্ডা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ফিরে আসতে। বাদশা অওরেঙ্গজেব পর্যন্ত তাঁরা স্বাধীন সুলতান ছিলেন। ১৬৮৭ সালে মুঘলরা গোলকোন্ডা দখল করে নেয়। তার পর নিজামের রাজত্ব।

তৃতীয়জন ছিলেন মীর মহম্মদ আমীন। ইরানের নিশাপুর থেকে হিন্দুস্তানে ভাগ্যান্বেষণে আসা একজন তরুণ যোদ্ধা। পরবর্তীকালে তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছিলো নওয়াব সাদত খান। লখনউয়ে অওধ শাহীর প্রতিষ্ঠাতা ।

সুবাহ বঙ্গাল, সুবাহ গোলকোন্ডা এবং সুবাহ অওধের রাজবংশ ছিলো ইরানি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অঙ্গ। মুঘল হিন্দুস্তানের অতি প্রতাপশালী সুন্নি তুর্কি রাজশক্তির থেকে আলাদা শিয়া গোষ্ঠীর
মানুষ। ভারত ইতিহাস এবং সংস্কৃতির একজন ইতর সন্ধানী হিসেবে আমি এই তিন সুবাহের প্রতি চিরকালই অধিক আগ্রহী। ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসা বেশ প্রবল। যদিও মধ্যযুগ মানেই রক্তাক্ত অন্ধযুগের কাহিনী। তবু সুমার্জিত পারস্য সভ্যতার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিলো এই সব রাজাদের শাসন ব্যবস্থায়। নিজে বাঙালি হিসেবে হয়তো সুবাহ বঙ্গালের ব্যাপারস্যাপার জানার সুযোগ বেশি ঘটেছে। আবার দীর্ঘকাল গোলকোন্ডা সংস্কৃতির দেশে বসবাসের সূত্রে তাঁদের ঐতিহ্যের
ভিত্তিগুলিও কিছুটা জানা হয়ে গেছে। যদিও সে অর্থে সুবাহ অওধে আমি বাস করিনি কখনও, কিন্তু দীর্ঘ চর্চা ও আসাযাওয়া থেকে তাঁদের সাংস্কৃতিক মানচিত্রটি খুব একটা অচেনাও থেকে যায়নি।

লখনউ বেড়াতে গিয়ে লোকে কী দেখবে? দেখবে বড়া আর ছোটা ইমামবাড়া, তার চত্বরে ছড়িয়ে থাকা ঘড়িমিনার, রুমি দরওয়াজা, সাতখন্ডা। দেখবে ছত্তর মঞ্জিল, রেসিডেন্সি, শাহ নজফ ইমামবাড়া,
সাদত আলি খান সমাধি, জামা মসজিদ, লা মার্টিনিয়ার, এক রাশ নতুন বাগ-বাগিচা। দেখবে লখনউয়ের বিখ্যাত বাজারগুলো, হজরতগঞ্জ, আমিনাবাদ, চওক।
লখনউ সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হবে, 'নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম'। এতো সংক্ষেপে শুধু ইশারাই চলে। তবে কথায় আছে না, 'সমঝদার কে লিয়ে ইশারা হি কাফি', সেটাই ভরসা। শেষে লখনউকে নিয়ে কবির দুই ছত্র মুগ্ধতাও থাক,

'... ইয়েহ শহর লালদার হ্যাঁয়, য়ঁহা দিলোঁ মেঁ প্যার হ্যাঁয়
জিধর নজর উঠাইয়ে, বহার হি বহার হ্যাঁয়
কলি কলি হ্যাঁয় নাজনীঁ, ইয়েহ লখনউ কি সর-জঁমী...'
(শকীল বদায়ুনি)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১১

-‘বেলজোগার্স’- বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন।

স্মিৎজ তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেনের দিকে। তার জানতে ইচ্ছে করছিল যে মানুষটা কী ভাবছেন। অদম্য কৌতূহল হচ্ছিল তার মানুষটাকে সম্পূর্ণ জানবার জন্য। ঘন দাড়ির আড়ালে ফোলা বিবর্ণ মুখটা ঠিক কী ভাবছে। ফাঁকা দৃষ্টিটা বলতে চাইছে ‘বেলজোগার্স’… কারণ মুখটা সেভাবে নড়ছে না। মানুষটি আবার কেঁদে উঠলেন। নিঃশব্দে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল গালের উপর।

তিনি হিরো হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি হিরো হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তার ব্যাটালিয়নেই গণ্ডগোল হল, যেমন ‘ঘোড়ার নাদি’ ইত্যাদি। এই ঘোড়ার নাদির ঠেলা তাকেই সামলাতে হয়েছে। মাথায় স্টিলের হেলমেট পরতে তার ভীষণ বোকাবোকা লাগে; তিনি জানেন যে তাকে দেখতেও ভীষণ হাস্যকর লাগে হেলমেট পরে। কিন্তু সেটা পরেই তাকে যেতে হয়েছে মোটর সাইকেলে চেপে। তিনি হিরো ছিলেন না। কখনো তিনি এমন দাবি করেন নি যে তিনি একজন হিরো। তিনি জানতেন যে তিনি হিরো নন। তারপরে ফ্রন্ট লাইনের কাছাকাছি গিয়ে, যখন চেঁচিয়ে কম্যান্ড দেওয়া প্রয়োজন, তখন হেলমেট পরতে ইচ্ছে করেনি তার। তিনি হেলমেট খুলে ফেলেছিলেন ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে; হেলমেট হাতে নিয়ে ভেবেছিলেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, লাফ দাও এবার!’ বিশ্রী একটা বিপদের কাছাকাছি দাঁড়িয়েও তার এতটুকু ভয় করেনি।

দুত্তোর ছাই! সব্বাই জানতো যে ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি কিচ্ছুটি করতে পারবেন না। কারণ তাদের কাছে না ছিল যথেষ্ট অস্ত্র, না ছিল একটাও ট্যাঙ্ক। খামকা কেন তিনি চেঁচিয়েছিলেন ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে? প্রত্যেকটা অফিসার জানতো যে অনেক ট্যাঙ্ক, অনেক অস্ত্র- এসব কিছু বরাদ্দ ছিল হেডকোয়ার্টারের জন্য। হেডকোয়ার্টারের চারপাশে নিরাপদ ব্যূহ তৈরি করা হয়েছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, প্রচুর ট্যাঙ্ক এসব দিয়ে।

ধ্যাত্তেরি… তিনি যথেষ্ট জানতেন না নিজের সম্বন্ধে। তিনি তো একথাও জানতেন না যে তিনি বেশ সাহসী। তারপরে যখন তিনি পড়ে গেলেন আর তার মাথার খুলি দু ভাগ হয়ে গেল, তখন তার ভেতরে এই ‘বেলজোগার্স’ শব্দটা ছাড়া কিছুই ছিল না। ব্যস, কেবল ওই একটা শব্দ। ওই শব্দটাই তিনি বাকি জীবন কেবল বলে যাবেন। ওই শব্দটাই তার দুনিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সেটার অর্থ কী কেউ জানে না, হয়তো কোনোদিন কেউ জানবেও না।

অবশ্য তিনি তো একথাও জানেন না যে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোর্ট মার্শাল হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজেকে আহত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চড়া অবস্থায় নিজের হেলমেট খুলে ফেলেছিলেন। মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না; জানবেনও না কোনোদিন। তাড়া তাড়া কাগজ, কেসের ফাইল নাম্বার, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রিপোর্ট, অভিযোগ, তার মেডিক্যাল কেস হিস্ট্রি– এসব কোনো কিছুই তিনি পড়বেন না। এসবের কোনো অর্থ এখন তার কাছে নেই। তিনি কেবল পঞ্চাশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর বলে যাবেন… ‘বেলজোগার্স’।

স্মিৎজ একদৃষ্টে চেয়েছিলেন তার দিকে। তিনি নিজেই পাগলের মত উৎসুক হয়ে উঠছিলেন একথা জানবার জন্য যে মানুষটির মস্তিষ্কে এখন কী ঘটে চলেছে। আবার একই সঙ্গে মানুষটিকে কিছুটা হিংসে হচ্ছিলো তার। কারণ চারপাশের কোনো কিছুই এই মানুষটিকে স্পর্শ করছে না; শুধুই একটি শব্দের ধ্যানে তিনি বুঁদ হয়ে আছেন।

হঠাৎ শ্নাইডার এসে দরজা খুলে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে স্মিৎজ চমকে উঠলেন।

-‘কী হল?’

-‘ওরা আসছে।’ বলে উঠল শ্নাইডার… ‘আসছে বলি কেন? প্রায় এসেই গেছে। আমাদের দিক থেকে কোনো সৈন্য যায়নি বাধা দিতে।’

স্মিৎজ প্রথমে শুনতে পাচ্ছিলেন না কিছু। এখন শুনতে পাচ্ছেন। ওরা এসে গেছে। বাম দিক থেকে আওয়াজ আসছে। ট্রাক ড্রাইভারের কথার অর্থ বুঝতে পারলেন তিনি এখন। লোকটা বলেছিল… ‘শোনা যায়, কিন্তু দেখা যায় না।’

-‘পতাকাটা’… বলে উঠলেন স্মিৎজ… ‘রেড ক্রসের পতাকাটা টাঙ্গিয়ে দিলে হয়… একটা শেষ চেষ্টা আর কি!’

-‘হ্যাঁ, এখনো সময় আছে।’

-‘এই যে, এখানে আছে।’… স্মিৎজ টেবিলের উপরে রাখা স্যুটকেসের একদম নিচ থেকে টেনে বের করলেন ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরোটা। শ্নাইডার সেটা হাতে নিয়ে বলল… ‘যাওয়া যাক।’

অস্থিরতা গ্রাস করে নিয়েছিল দুটি মানুষকে; শ্নাইডার জানালা দিয়ে একবার নিজের মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখতে গেল এবং পরমুহূর্তে সরে এল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। ‘ওরা খুব কাছে এসে গেছে’… তার গলা কেঁপে গেল… ‘বাঁধের কাছেই…’

-‘আমি যাচ্ছি। আমি গিয়ে ওদের মুখোমুখি হতে চাই।’ স্মিৎজের কথার মাঝখানে মাথা নাড়তে শুরু করলো শ্নাইডার এবং মাথার উপরে পতাকাটা তুলে ধরে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

সে সোজা হাঁটতে লাগলো বাঁধের দিকে। চারদিক থমথম করছে। ট্যাঙ্কদুটো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে জনপদের শেষ সীমানায়। রেলস্টেশনের আগে স্কুলবাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ট্যাঙ্কের কামানের নলগুলো বাড়িটার দিকে ফেরানো আছে। কিন্তু শ্নাইডার ওদের দেখতে পায়নি। সে কোনোকিছুই দেখতে পায়নি। পেটের সামনে হাস্যকরভাবে পতাকাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সে। এমনভাবে হাঁটছে যেন কুচকাওয়াজ করছে। সে কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। কিছুই দেখছে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে তার শরীরের রক্তের ভিতরে একটা ভয় পাক খাচ্ছে। সে ভয় পাচ্ছে।

শ্নাইডার সোজা হেঁটে যাচ্ছে পেটের সামনে রেড ক্রসের পতাকাটা ধরে। পুতুলের মত কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল সে। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। আবার উঠে দাঁড়ালো।

গাছের ডালপালাগুলো সাজিয়ে লতানে গাছের মাচা তৈরি হয়েছিল বাগানে। সেই মাচার ডালপালা আটকানোর জন্য একটা তার মাচাটার কাঠামো থেকে বেরিয়ে ছিল কিছুটা। সেই তারে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছিল শ্নাইডার। সে উঠে দাঁড়ালো। এখন সে দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। দুটো ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে ছিল বাঁধের পেছনে। তার ঠিক সামনের ট্যাঙ্কটা ধীরে ধীরে কামানের নলটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বাগানের গাছপালার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পেল মাত্র দুটো নয়, অজস্র ট্যাঙ্ক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। একটার পেছনে আরেকটা লাইন করে দাঁড়ানো মাঠের মধ্যে। ট্যাঙ্কগুলোর গায়ে লাগানো লাল তারাগুলো দেখে অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর মনে হল তার। সে আগে কোনোদিন দেখেনি এই লাল তারা। জঞ্জালের স্তুপ, পুকুর, পরিত্যক্ত হাসপাতালের বেডগুলি, নার্সারি, ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে বাঁধ… সে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু না, জঞ্জালের স্তুপের আর পুকুরের মাঝখানে সে থমকে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো। আগের চেয়ে অনেক বেশি এবার।

সে জানেনা আসলে ভয়ের চেহারাটা ঠিক কেমন হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল যে তার রক্ত জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে, হয়তো ভয় ব্যাপারটা এভাবেই ছড়াতে থাকে শরীরে। সে বুঝতে পারছিল না। এখন তার রক্তে যেন আগুন ধরে যাচ্ছে। সে চারদিকে লাল রঙ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বিশাল লাল রঙের তারাগুলো যেন তাকে গিলে নেবে এখনই। সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে পা দিল সেই গাছের শুকনো ডালের মত দেখতে বহুদিন আগের যুদ্ধের পুরনো বোমার আধভাঙা টুকরোটার উপরে। সেই টুকরোটা বিস্ফোরণে ফেটে পড়লো।

প্রথমে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। থমথমে নৈঃশব্দের মাঝে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দটা প্রচণ্ড অভিঘাত সৃষ্টি করলো। রাশিয়ান সেনারা শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছিল যে ওই আগ্নেয়াস্ত্র, অর্থাৎ বোমাটা তাদের দিক থেকে ছোঁড়া হয়নি। তারা শুধু দেখতে পেয়েছিল যে পতাকা হাতে করে হেঁটে আসা মানুষটা হঠাৎ একটা ধুলোর মেঘের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

বিস্ফোরণের পরে বেশ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ ছিল। তারপরেই রাশিয়ান সেনারা ঢুকে গেল সোজা সেনাছাউনির বিল্ডিংএ। পাগলের মত একটানা গোলাবর্ষণ শুরু করলো তারা। প্রথমে দক্ষিণের বিল্ডিং, তারপরে উত্তরের বাড়িটায়, যেখানে কেয়ারটেকার কাস্তেহাতুড়ি নকশা আঁকা ছোট লাল পতাকাটা উড়িয়ে দিয়েছিল।

পতাকাটা বাড়িগুলোর থেকে ভেঙে পড়া ধুলো ময়লার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তারপর সেনারা আবার দক্ষিণের বাড়িটায় সমান তালে গোলাবর্ষণ করতে লাগল। সাঙ্ঘাতিক ভাবে বহুক্ষণ ধরে গোলা ছুঁড়ে গেল তারা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বাড়িগুলোর দুর্বল দেওয়াল একদম গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা খেয়াল করলো যে অপর পক্ষ থেকে এতক্ষণে একটা গুলিও এসে কোনো উত্তর দেয় নি।

(চলবে)






ReplyForward











0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




লেখকের কথা :

ভারতচন্দ্রকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেটা আসলে অনেকদিনের। ভাবতে অবাক লাগে যে রতিরঙ্গ ধ্রুপদী ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল প্রাক ইসলাম পর্বেও, মধ্যযুগে এসে তা যেন একটি বদ্ধ নীতিবাগীশ শাসনে শুধু মুখ লুকিয়েই থেকে গেল। বৈষ্ণবপদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মুক্তি পেলেও তা দেহাতীত নিকষিত হেম হয়ে সীমারেখা টেনে সামলে নিল। মানুষ মানুষীর মিলন মান্যতা পেল না। যৌনতার বিষয়ে মঙ্গলকাব্যেও সেই সাবধানী গা বাঁচানো রীতিটিই অকারণে বহাল রইলো।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র যেন ‘প্রমিথিয়ূস’ হয়ে এসে সেই নিষিদ্ধ রতিমঞ্জরীটিকে রসিকজনের সামনে নতুন অলঙ্কারে সাজিয়ে আনলেন। বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হল ফার্সী আর হিন্দীর শব্দপ্রয়োগে।এভাবেই নিশ্চুপ হয়ে ভারত কৃষ্ণনগরে বসে বসে ধীরে ধীরে প্রাক উনিশশতকের আধুনিক ভাষা প্রবাহের প্রথম ইঁটটি গাঁথলেন। একদিন সেই পথ দিয়েই স্বচ্ছসলিলা ভাষার গঙ্গাটিকে বয়ে আনবেন ভগীরথসদৃশ স্বয়ং বিদ্যাসাগর। তারও আগে রুশ নাট্যকার লেবেদফ মজেছেন ভারতচন্দ্রে। রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন ‘বিদ্যা সুন্দর’। পরবর্তী কালে ভারতে মজবেন মাইকেল সহ একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। তারা সমালোচনাও করবেন পূর্বজ কবিটিকে দেহবর্ণনার বাহুল্যে। তবুও অস্বীকার করে এড়িয়ে যেতে পারবেন না ভাগ্যবিড়ম্বিত এই কবিপ্রতিভাটিকে যাঁর লেখাকে তার প্রায় দেড়শো বছর পরে আর এক মহাজন রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবেন ‘এ যেন রাজকন্ঠের কন্ঠের মণিমালা’।

‘ভারতমঙ্গল’ আদতে একটি উপন্যাসই। ইতিহাস বর্ণনা নয়, বরং ইতিহাস যাপন। কল্পনা ও সত্যের মিশেলে সেই দিনগুলিতে একটু স্বপ্নিল পদচারণের প্রচেষ্টা মাত্র।

আপনাদের উৎসাহ ও প্রশ্রয়ে শুধু লিখতে বসে আমিও আবিষ্কার করেছি এক অন্য ভারতচন্দ্রকে। মাননীয়া গবেষিকা ও লেখিকা শ্রীমতী বিনীতা চ্যাটার্জীর আনুকূল্য না পেলে এই লেখার উপাদান সংগ্রহই হত না। এ ঋণ পরিশোধযোগ‍্য নয়।
ইতি-
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
রচনাকাল ২০২০-২১

উৎসর্গ :‘সেই সময়’ উপন‍্যাসের প্রণেতা শ্রদ্ধেয় শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ‍্যায় মহাশয়’কে নিবেদিত।

পর্ব-১

পল্লীগ্রামের মাঘে মাসের শীতের তীব্রতা সর্বজনবিদিত। চাষের জমিগুলি ক্রমশ ভরে আসছে ফসলের উজ্জ্বলতায়। মনে হচ্ছে রবিশস্যের ফলন এ বছরটায় ভালোরই দিকে। নিজের মনেই একটা লাইন হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠলো এক সাতাশ বছরের যুবক,‘বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী’ ..অলঙ্কার শাস্ত্রটি সে ইতিমধ্যে ভালোই রপ্ত করেছে। সংস্কৃত, বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলী আর ফার্সী শিক্ষায়ও তার কোনও ফাঁকি নেই। শুধু এবার জীবিকায় একটু স্থিতি হলে আপাতত সবটা রক্ষা হয়। ইতিমধ্যেই নিজের এই সদ্যযুবা বয়সে অনেক বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে গেছে। এমনকি তার কারাবাসের স্মৃতিটিও প্রায় সাম্প্রতিকই। এত দোলাচলেও সে তার ভিতরের সরসতার কোন হানি হতে দেয়নি। বংশকৌলীন্য তারও নেহাত কম নয়, কিন্তু আজকের এই নিঃসম্বল অর্থহীনের সে অহঙ্কার আর সাজে না। যদিও সে নিজে এই সামন্ততান্ত্রিক নকল রাজাপ্রজা সেজে ঘুরে বেড়ানো ব্যাপারটায় খুব একটা আগ্রহী নয়। বরং সাধারণ্যের ভীড়টিই তাকে বেশী টানে। বাংলার আকাশে বাতাসে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু। তারই মধ্যে শাস্ত্রচর্চা আর মনোজ্ঞ কাব্যরচনা করে আত্মপ্রকাশের একটি সুপ্ত বাসনা তার। রাত্রির কালো তারা ভরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ। মনটা আজ একদম বশে নেই। মনে হচ্ছে জীবনের দিনগুলি কেবল অপচয়ই হয়ে যাচ্ছে। রাত্রি ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। দীনের কুটিরটি স্বাভাবিক কারণেই এখন নিষ্প্রদীপ। রাধা নামের তার বালিকা বধূটি আপাতত নিদ্রিতা। শয্যা ত্যাগ করে নির্ঘুম চোখে এই অনন্ত কালরাত্রির অবসানের প্রতীক্ষায় সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। এখনো পর্যন্ত এক কাব্যমনস্ক, রসজ্ঞ, রুচিবান, স্বভাববৈরাগী এক ব্রাহ্মণ সন্তান, এই তার একমাত্র পরিচয়। পিতৃদত্ত নামটি তার ‘ভারতচন্দ্র’।

এই বার একটু তখনকার ভারতের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখি। সময়কালটি বড়ই অস্থির। সুজা খাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করে ‘মহাবৎ জঙ্গ’ নাম নিয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে নবাব আলীবর্দি খাঁ। দিল্লীর মুঘল অন্দরেও তখন ‘তখত এ তাউসে’র দিকে রয়েছে শ্যেন পক্ষীদের ইতিউতি লোভী নজর। বন্দীদশায় বৃদ্ধ শাজাহান আগ্রাদূর্গে দিন গুনছেন মৃত্যুর, প্রিয়তম পুত্র দারাও নিহত, যুদ্ধে পরাজিত সুজা আরাকানে নির্বাসিত। ঔরঙ্গজেবের পথের শেষ কাঁটাটি হল এখন মুরাদ। কটকের কাছে আলীবর্দির সাথে এই মুরাদের এক ভীষণ লড়াই হল ও মুরাদ যুদ্ধে হেরে দিল্লীর দিকে পিছু হঠলেন। পথের মধ্যেই ঔরঙ্গজেবের চরেদের হাতে ধৃত হলেন ও বন্দী অবস্থায় এলেন গোয়ালিয়রে। কদিন বাদে সেই দূর্গের বন্দীশালায় অকথ্য অত্যাচারের পর তাকেও জাহান্নামের রাস্তাটি সোজা দেখিয়ে দিলেন তার ভ্রাতা বাদশা আলমগীর।

এদিকে বাংলায় ততদিনে শুরু হয়ে গেছে মারাঠা দস্যু রঘুজী ভোঁসলে আর তার অনুগত সেনাপতি ভাস্করপন্থের দ্বারা সংঘটিত বর্গীর হামলা। পল্লীবাংলা তখন জ্বলছে এক নতুন মাৎসান্যায়ের আগুনে। আলীবর্দি এই ভাস্করপন্থকে কৌশলে হত্যা করলেও রঘুজী তাঁর কাছ থেকে কটক সহ উড়িষ্যা দখল করে নেন। বার লক্ষ তঙ্কা নজরানার বিনিময়ে সেই জায়গীর উদ্ধারে তিনি সম্মত হন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ভরসায়। কিন্তু তহশীলদার সুজন সিং-এর বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব শেষ পর্যন্ত কারারুদ্ধ হন। ঠিক সেই সময় কৃষ্ণনগরাধীশ কৃষ্ণচন্দ্রের কূটকৌশলে কোতোয়ালের দপ্তরে সামান্য উৎকোচের বিনিময়ে তিনি নবাবকে মুক্ত করেন ও মুর্শিদাবাদে অক্ষতদেহে ফেরৎ পাঠান। আলীবর্দি তাঁকে সেই কৃতজ্ঞতাবশত ‘ধর্মচন্দ্র’ উপাধিতে বরণ করেন ও সেবারের মতো নদীয়ার রাজস্বটি মাপ করে দেন। এভাবেই কালের ইতিহাস তার আগম নির্গমের দাবার ছক সাজায় নিজের নিয়মে। সেই বারুদের দিনগুলির উত্তাপের মধ্যেই জন্ম নিল এই আশ্চর্য কবিপ্রতিভাটি।

‘ডিহি কলিকাতা’ এক আজব জায়গা বটে। রাস্তার দুধারে পূরীষবাহী কাঁচা নর্দমা। এখানকার আবহাওয়া মোটেও সুবিধার নয়। গ্রীষ্মকালে ভয়ঙ্কর গরম আর বর্ষাকালে ভীষণ কাদা হয়। এছাড়া সঙ্গে মশা-মাছিরও ভয়ঙ্কর উৎপাত। এরই মধ্যে শহরটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে তার পূর্বতন চেহারাটা। ২৫ নম্বর ‘ডুমটোল্লা স্ট্রীটে’র একটি অংশে এক বিচিত্রবেশী সাহেবের তাঁবু পড়েছে। সাহেবটি ইংরেজ নন, রুশী। এই হেরাসিম লেবেদফ লোকটি বেশ আমুদে। সে এক এখানে এক অদ্ভূত জিনিসের আমদানী করেছে। একধরণের যাত্রাপালার মত একটা সঙের আসর বসায় সে ফি রোববারে। নাচ -গান, পান -ভোজন সহ এই বিলিতি সঙের আসরটিতে আজকাল সাহেব সুবোদের ভালই ভীড় হচ্ছে। অপেরাটির শুরুতে সাহেব নিজে বিলিতি অর্গ্যান বাজিয়ে দুলে দুলে নেচে খানিক অঙ্গভঙ্গি করে আমোদ দেয়। তারপর দলেরই কয়েকজন ক্লাউন সেজে কিছুক্ষণ মাতিয়ে রাখে। শেষে হয় আসল নাটকটি। ইংরেজদের সাথে সাথে দু একজন ইংরেজীজানা এদেশের ভদ্রলোকও আজকাল অবাক হয়ে এই বিলিতি ভাঁড়ামোটি উপভোগ করতে আসেন। লেবেদফ তাঁর আসরে নেটিভরা আসলে খুশীই হন। এদের সহজ সরল স্বভাবটি নিজে বেশ উপভোগ করেন। তিনি দেখেছেন নেটিভরা সমাজে নিজেদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে বড্ড বাছবিচার করে। আবার তারাই যে কোন সাহেব দেখলে

স্রেফ সাদা চামড়ার দরুণই একটু ভয় মিশ্রিত সমীহ করে দূরে পালায়। আসর চলাকালীন ভিখু নামের এক বোবাকালা কিন্তু দৈত্যাকৃতির বিহারদেশীয় পাহারাদার পিতল বাঁধানো লাঠিহাতে পাহারা দেয়।

কলকাতায় ইংরেজদের সুবিশাল কেল্লাটির কাছেই গঙ্গাতীরটি কিন্তু বেশ মনোরম। তিনি মাঝে মধ্যেই এখানে বেড়াতে আসেন। নদীটিকে দেখলে তাঁর ভোল্গার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে তাঁর স্বদেশকে। হিন্দুরা এই নদীটিকে খুব পবিত্র চোখে দেখে। লেবেদফ তার মধ্যেই দেখতে পান সেই পবিত্র নদীর জলেই কখনো কখনো অর্ধদাহ্য মানুষের মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে আর সেই মৃতদেহের ওপর কি বিচিত্ররূপী একপ্রকার স্টর্ক জাতীয় পাখি সেটা থেকে নরমাংস খুঁটে খুঁটে খেতে খেতে নৌবিহারের মত ভেসে চলছে একপাড় থেকে অন্যপাড়ে। নেটিভরা এই পাখিগুলোকে বলে ‘হাড়গিলে’ পাখি।

তাঁবুতে ফিরেই গড়গড়া টানতে টানতে বিছানায় আদুরীকে কাছে টানলেন লেবেদফ। দশ সিক্কা দিয়ে জিঞ্জিরাবাজার থেকে তাকে কিনে এনেছেন বেশ কিছুদিন হল। এদেশে ফিরিঙ্গী মেয়ে দূর্লভ।তাই অনেক ইউরোপীয়ই পরিবর্ত হিসাবে দেশী বিবি রাখাটাই সহজ বলে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই মেয়েটি সম্ভবত বোধহয় নীচুজাতির। কিন্তু তার দেহবল্লরীটি যথেষ্টই উত্তেজক। এখানকার মেয়েরা গায়ে জামা রাখেনা। শাড়িটিকেই তারা গায়ে পেঁচিয়ে লজ্জ্বা নিবারণ করে। আদুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। মেয়েটির বয়েস কম তায় গড়নটিও বাড়ন্ত। গায়ের রঙটি কালো হলেও তার মুখশ্রীতে একটা অদ্ভূত মাদকতা আছে। চেহারাটি দোহারা ও কমনীয়। এইবয়সেই তার স্তনযুগল বেশ বর্তুলকার ও ভারী। এমনকি কোমরের নীচের অংশের গড়নটিও বেশ চটকদার। তাদের বিপরীত বিহারে রতিরঙ্গের সময় হঠাৎ দেখলে শ্বেতপাথরের মহাদেবের উপর উপবিষ্টা উলঙ্গিনী কালীর উপমাই মনে আসে। অর্থোপার্জনের তাগিদে স্বদেশ থেকে এত দূর বিদেশে এসে প্রবৃত্তি নির্বাপণের স্বার্থে এই স্বাদু রমণীটির আসঙ্গ সাহেবের বড় পছন্দ। আর আদুরীও তার সাহেবের সাথে নিত্যদিনের রসরঙ্গটিকে বেশ লাস্যের সাথেই উপভোগ করে বলে মনে হয়।

বিকেলের দিকে তাঁবুতে গোলকনাথ এল। বেঁটে খাটো চেহারার গম্ভীর মেজাজের এক মানুষ সে। লেবেদফ এঁর কাছেই আজকাল বাংলা, ফার্সী আর সংস্কৃত শিক্ষা করছেন। কদিন আগেই ম্যঁলিয়েরের একটি নাটক ‘লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর’ অভিনয় করিয়েছিলেন কিন্তু সেটা মোটেও জমেনি। লেবেদফের দলে এখন সাকূল্যে আটজন অভিনেতার সবাই ফিরিঙ্গী। ইসাবেলা নামের এক এলিট সোসাইটি-নচ গার্ল যে আদতে কোম্পানির হোমরাচোমরা সাহেবদের বিনোদনকারিনীই মূলত, তাকেই প্রয়োজন পড়লে ভাড়া করে নামাতে হয় কোনও গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র থাকলে। কদিন আগে পোর্শিয়া চরিত্রে অভিনয়ের সময় সে মাঝপথে সংলাপ ভুলে গিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটিয়েছিল। ইসাবেলা খুবই উদ্ধত স্বভাবের। রূপের চটকের সাথে সাথে সে গান আর অভিনয় জানে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আসলে নিয়মিত মহলায় না আসলে অভিনয় ঠিক করে নাটকটা সার্থকভাবে মঞ্চস্থ করা মুশকিল। অথচ বিলিতি নাটকে মেমসাহেবের পার্ট থাকলে তাকেই তোয়াজ করে চলতে হয়। লেবেদফ বোঝেন যে উপযুক্ত দেশীয় কাহিনীর অভাবেই স্থানীয় আমজনতার এই স্টেজের প্রতি আকর্ষণ জাগানো যাচ্ছে না। অথচ ঢপ, খেউড়, যাত্রা এমনকি কবিগানের আসরেও ভালই লোকে ভীড় করে। লেবেদফ ভাবলেন গোলকনাথকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, যদি কোনও ভাল দিশি মেটেরিয়ালের কথা সে যদি বলতে পারে। একথার দুদিন বাদেই তার তাপ্পিমারা ঝোলার ভেতর থেকে গোলক একটি বই করে দেখায়। বলে ‘এইটে একবার চেখে দেকতে পারেন সায়েব! বড় সরেস বইখানা। শ্রীরামপুরের সায়েবরাও আজকাল এসব বই ছাপচে! ‘কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ভ্রূকুঞ্চিত লেবেদফ বইখানার দিকে হাত বাড়ান।

"OONOODAH MONGUL
Exhibition the tales of
BIDDAH AND SOONDER.
To which Added
The Memoirs of Raja Prutupa Ditya
Embelled with six cuts.Calcutta :From the Press of Ferris, 1816"

গোকুলকে সেদিনের মত জলদি বিদায় করে লেবেদফ বইটি সাথে করেই বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেন। আজ সারাদিন ধরেই খুব বৃষ্টি। একটা শিরশিরে ঝোড়ো হাওয়ায় কেমন যেন শীত শীত করছে। আদুরী তড়িঘড়ি এসে তাঁবুর ভিতরে সেজবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। সে এখন খাবার বানাতে বসবে। এইসময় সাহেবের কাছে সেও কিছুক্ষণ ভিড়বে না। পড়াশোনা করার সময় তার সাহেব একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়। ওদিকে গড়গড়া টানতে টানতে বইটিতে ক্রমশ ডুব দেন লেবেদফ।

আহা! কি অদ্ভূত কাহিনীর বিস্তার আর নাটকীয় মোচড়।

"Having heard an account of Beedyaa from the mouth of Bhaat/The inclinations of Soondor boiled vehemently..."

ভাটমুখে শুনিয়া বিদ্যার সমাচার।
উথলিল সুন্দরের সুখ-পারাবার।।

এই নতুন কাব্যটির কবিটির নাম ‘ভারতচন্দ্র!’ ক্যালকাটায় এরকম একটি অসাধারণ লিরিক্যাল ব্যালাডধর্মী সাহিত্য অবহেলায় পড়ে আছে তা লেবেদফ বিশ্বাস করতেই পারেন না। স্থির করেন আগামী দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যা-সুন্দর ই হবে তাঁর পরের নাটক। নায়িকার ভূমিকায় এবার আর কোনও ফিরিঙ্গি নীলনয়না নয়। ‘বিদ্যা’ সাজবে তাঁর প্রিয়তমা আদুরী-ই।

শেষরাত্রিতে ভারত একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। দিনু বৈরাগীর বৈতালিকের খঞ্জনীর টুংটুং শব্দে ঘুম ভাঙতেই সে বিছানা ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। শীতের কুয়াশার চাদরে এখন সবদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এত ভোরেও বদনচাঁদ খেজুরের রস ভরা হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে ঠিক বাঁকে করে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতকে সামনে দেখতে পেয়ে বলল,‘একপো রস দেই দা ঠাউর! জিরেন কাঠি ডুবকি তোলা! খুব মিঠে’। ভারত ইষ্টনাম জপ করার আগে কোনও কিছুই জিহ্বাগ্রে স্পর্শ করেনা। তবুও এই কূয়াশাচ্ছন্ন ঊষাকালে সুমিষ্ট ‘রস’ শব্দটি মনের মধ্যে অনুরণিত হতে লাগল। হাত নেড়ে না’বাচক ইঙ্গিত করে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে মৌন হয়েই নবীন ভোরটির কলুষমুক্ত স্নিগ্ধ রূপ অন্তর দিয়ে উপভোগ করতে থাকলো।

রামচন্দ্র মুনশীর কাছে ফার্সী শেখা এখন ভারতের শেষের পথে। দেবানন্দপুরের এই শান্ত পল্লীগ্রামের পরিবেশটি তার বেশ ভালই লাগে। গ্রামটিকে ঘিরে আছে একটি বিশাল দিঘি, নাম কুঞ্জসায়র, দিব্যি গাছগাছালি ঘেরা তার চারপাশ আর কাকচক্ষু নির্মল টলটলে জল। দিঘিটি বঙ্গাধীপ লক্ষ্মণসেনের আমলের। এর দুপাশে সেই আমলের পোড়ামাটির দ্বাদশ শিবমন্দিরটি এখনো অক্ষত। জ্যৈষ্ঠমাসে এইখানে ধর্মরায়ের গাজনের মেলা বসে। এছাড়া আছে আদিগন্ত বিস্তৃত প্রচুর সুফলা ধানীজমি আর তার ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া মেটে রঙা আলপথ। ভারত তার সদ্যোন্মীলিত কাব্যপ্রতিভার সহজিয়া দৃষ্টি মেলে এই শ্যামবঙ্গপ্রকৃতির রূপসুধা পান করতে বড় ভালবাসে।

মুসলমান শাসকদের অসহিষ্ণুতাহেতু এখন সংস্কৃত টোলগুলিতে আগের মত ছাত্র হয়না বরং অনেক হিন্দু শিক্ষিত মানুষ মোক্তব খুলেছে। অর্থোপার্জনের জন্য আরবী আর ফার্সী জানাটাই এখন দস্তুর। আজকাল দেওয়ানী বা কাছারিতে একজন সামান্য গোমস্তাকেও এই দুটি ভাষায় দখল রাখতে হয়। ভারতের খুব শীঘ্রই একটি সেরেস্তার কাজ জোগাড় করা আশু প্রয়োজন। যদিও বংশগৌরবের নিরিখে তার রাজা হওয়ারই কথা। ভারতের পূর্বপুরুষ ভরদ্বাজ গোত্রীয় ফুলিয়ার বিখ্যাত নৃসিংহ মুখুটির বংশাবতংশ সদানন্দ রায়। সেই সুপ্রতিষ্ঠিত ভূরসুট রাজবংশের রক্তই তার ধমনীতে বিদ্যমান। বিস্ময়ের ব্যাপার বাঙালীর ইতিহাসে এই বংশেরই শাখায় আরও দু’টি মানুষের নাম একই সাথে বিখ্যাত ও কূখ্যাতির জন্য স্মরণীয়। বিখ্যাতজনটি হলেন ফুলিয়া নিবাসী শ্রীরাম পাঁচালির কবি কৃত্তিবাস ও অন্যজন হিন্দুমন্দির ধ্বংসকারী রাজীবলোচন, যিনি অবশ্য কালাপাহাড় নামেই বেশী পরিচিত।

ভারতের পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের থেকে একশো বিঘা জমি ইজারা নিয়েছিলেন একসময়। দেওয়ান রাজবল্লভের পরামর্শে সেই জমি হঠাৎই খাসভুক্ত করা হয় তাঁকে না জানিয়েই। এ নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে তিনিও করদানে অসম্মত হন। কীর্তিচন্দ্র একই সাথে সপুত্রক নরেন্দ্রনারায়ণকে রাজ্যচূত ও কারারুদ্ধ করেন। সেই থেকে ভারতের কপাল থেকে রাজতিলকটি চিরঅন্তর্হিত হয়েছে। কারাবাসের দিনগুলি ভারতের কাছে দুঃস্বপ্নভরা রাত্রি যেন।

কদিন হল একটি নতুন ছন্দে একটি সত্যপীরের পাঁচালি লেখা সে আরম্ভ করেছে। ছন্দটির নাম চৌপদী। সত্যপীর দেবতাটি আসলে হিন্দুর সত্যনারায়ণ আর মুসলমানের পীরের বর্ণসঙ্কর আরাধ্য দেবতা। একালে দুইধর্মের মানুষই এই দেবতাটিকে পুজো করে থাকে। সেই সত্যপীরকেই উপজীব্য করে কয়েক ছত্র পাঁচালী রচিত হয়েছে তার কলমে। সূচনার ভণিতাটি পড়তে বেশ সুললিত শোনাচ্ছে নিজের কানেই,

"ভরদ্বাজ অবতংস/ভূপতি রায়ের বংশ/

সদাভাবে হতকংস/ভূরসুটে বসতি/নরেন্দ্র রায়ের সুত/ভারত ভারতী যুত/ফুলের মুখটি খ্যাত/দ্বিজপদে সুমতি...."

রাধার বয়স সবে ষোলো। এগারো বছর বয়সেই ভারতচন্দ্রকে সে স্বামী হিসাবে পেয়েছে। কিন্তু তার বিয়ের প্রথম ক’টি বছর বেশ কেটেছে দূর্যোগপূর্ণ। বর্ধমান রাজের চক্রান্তের জেরে ভারতের কারাবাস তার পতিসুখ উন্মেষের বাধার কারণ হয়েছিল। কারাগার থেকে কৌশলে মুক্ত হয়ে ভারত অনেকমাস যাবৎ আত্মগোপন করে শঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরী মঠে কিছুদিন ভ্রামণিক হয়েই কাটিয়েছে। সেখানে আচার্য সর্বানন্দ পুরীর কাছে নিয়মিত সংস্কৃত শিক্ষায় তার পূর্বতন বিদ্যায় পড়েছে পরিশীলিত প্রয়োগের ছাপ। মুদ্রারাক্ষস, রঘুবংশম্,

অমরুশতক,গাথাসপ্তসতী প্রভৃতি প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও নাটকের মূলপাঠ্যগুলোর সাথে পরিচিত হবার ফলে তার ভাষাবৈদগ্ধ ও শব্দঝংকার ভারতকে বাগবৈখুরী ও অলংকার শাস্ত্র ব্যবহারে পটু করে তুলেছে। আবার মুনশীর কাছে এই ক’মাসেই যবনাভাষা দুটিও তার ভালই আয়ত্ত হয়েছে বলা যায়।

রাধাও এদিকে ধীরে ধীরে যুবতী হয়ে উঠছে। বালিকার খোলস বদলে ক্রমশ এক অচেনা নারীতে যেন নিত্যই সে প্রকাশিত হচ্ছে। ভারত তাকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করে। হাত উপরে তুলে কাঠের কাঁকই দিয়ে তার চুল আঁচড়ানোর সময় তার কুমারসম্ভবের লাইনগুলো মনে পড়ে যায়। শৃঙ্গার রসটিকে বঙ্গদেশে এখনো ব্রাত্য করে রেখেছে পন্ডিতজনেরা। অথচ এই শ্যামলিমা বিধুর বঙ্গললনাটির মধ্যে মধুররসের পূর্ণ প্রকাশ সে দেখতে পায় সততই। বৈষ্ণবপদাবলীর দেহাতীত প্রেমটি মানতে তার মন চায়না। ভারতের মতে প্রেমের আধার হল দেহই। তাকে অস্বীকার করলে পূর্বরাগের দর্শন, শ্রবণ আর স্পর্শনের শিহরণটিই চলে যায়। যদিও দেবদেবীর বাইরে এই প্রেম জিনিসটিকে মেনে নেবার মত সমাজ আজও পরিণতমনস্ক নয়। খুব গোপনে এমনকি অমর্যাদার সাথেই দেহবিনিময় করেই সবাই বাইরের শুদ্ধাচারণরীতিটিকেই প্রশ্রয় দেয়। এই বিকট দ্বিচারিতাটি ভারত মনে মনে মানতে নারাজ। অথচ একসময় এই দেশেই প্রাচীনকালে মদনোৎসব পালিত হত। সেখানে রতিশাস্ত্র ও রতিকান্ত দুজনেই অগ্রাধিকার পেত সসম্মানে।

ভারতের খুব ইচ্ছা করে তার মাতৃভাষা বাংলাতে একটি মধুর রসের আখ্যান রচনা করার। সাধারণ নরনারীই হবে তার আধার, দেবকল্প নয়। জাগতিক দোষত্রুটি মুক্ত আদর্শ মানুষের নীতিগাথার পরিবর্তে প্রেম আর তার সঙ্গে দ্বেষ, লালসা আর বিরহই হবে সেই কাব্যটির উপজীব্য।

কিন্তু তার আগে চাই একটি স্থির জীবিকার সংস্থান। ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ মাথায় নিয়ে কাব্য রচনা করা বড় কঠিন। সে জানে রাধা’র পরিধেয় শাড়িগুলি বহু ব্যবহারে এখন জীর্ণ। অনেক জায়গায় রাধা গ্রন্থি দিয়ে বেঁধে সেই ছিদ্রগুলি হাসিমুখে আড়াল করে। ভারত নিজের স্ত্রীকে এটুকু স্বচ্ছলতা এতদিনেও দিতে অপারগ সেই অক্ষমতাটিকে একটা চাপা অসন্তোষের মতো সর্বদা বুকে চেপে ঘোরে বা নির্জনে কুঞ্জসায়রের পাশে এসে বসে থাকে। কখনো সেই নিভৃতি ভঙ্গ করে একটি গোসাপ সড়সড় আওয়াজ করে শুকনো পাতার স্তুপ মাড়িয়ে আবার কোনো ঝোপের ভিতর লুকিয়ে যায়।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















১৫

স্মৃতির শহর

৯৮ এস পি মুখার্জি রোড। এটি নিছক কোনও ঠিকানা নয়। আমাদের মতো কারও কারও কাছে চেতনার নানান স্তর উন্মোচিত হয়েছিল। সরে গিয়েছিল অনেক পর্দা। যার মধ্যে একটা অবশ্যই খানাপিনা সংক্রান্ত। আর যাঁর সূত্রে ওই পরিবারে যাত্রা এবং ঘনিষ্ঠতা, তাঁর নাম অশোক সেন। এমন বর্নময় এবং বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যের সমাহার সচরাচর দেখা যায় না। কলকাতার এক বিশিষ্ট পরিবারে জন্ম। উচ্চশিক্ষা, সুদীর্ঘ প্রবাস এবং লোভনীয় একাধিক পদ তুচ্ছ নানা কারণে ছেড়ে দেওয়া – এমন বর্ণনায় এই মানুষটিকে চেনা মুশকিল। সত্যি কথা বলতে কি অশোকদাকে বোঝার চেয়ে ভুল বোঝা সহজ ছিল। তাঁর অনেক ঝোঁক বা শখের একটি ছিল রান্নাবান্না। আটপৌরে কোনও এক পদের অসামান্য একটি দিক চিহ্নিত করতে পারতেন অসাধারণ মুনশিয়ানায়। আবার ডাইনিং টেবিলের রীতিনীতি বিষয়ে অনেক পাঠই প্রথম তাঁর কাছে। নিজেও রান্না করতেন চমৎকার। অনেক বছর আগে তাঁরই হাতে প্রথম মুরগির ‘পট রোস্ট’ খেয়ে অতি আহ্লাদিত হয়েছিলাম।

ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে জীবিকা এবং অন্যান্য কারণে লক্ষ্যে মানুষ যখন আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পরে, গড়ে ওঠে নব জনগোষ্ঠী, তাদের জীবনযাত্রার ধরন-ধারণের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারটিও প্রকাশ পায় বিশেষ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। ফলত অনেক আহার্য, যা ছিল একান্তই ইউরোপের নিজস্ব, কালক্রমে তেমন অনেক কিছুই বদলে গেল চরিত্রগতভাবে আর হয়ে উঠলো ‘অ্যামেরিকান’। যেমন পিৎজা, যেমন স্টেক। এই ‘পট রোস্ট’ ও তেমনই। অশোকদাকে দেখেছিলাম একটা গোটা মুরগির পেটের ভিতর নানারকম আনাজ, যেমন গাজর, ছোটো আলু, পেঁয়াজ পুরে দিয়ে আভেনে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে গল্পে (যার মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল পরনিন্দা) মজে যেতেন। ঘণ্টাখানেক পর ‘এস হে’ বলে আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন খাবার ঘরে। সেখানে আমাদের চোখের সামনেই আভেন থেকে বার করা হতো পাখিটিকে। যে ছিদ্র দিয়ে আনাজগুলি প্রবেশ করানো হয়েছিল, সেটি তখনও সেলাই করে বন্ধ করা এবং পা-দুটিও বাঁধা। পরে রান্নাবান্নায় একটু হাত-পাকানোর পর যখন নিজেও এই ধরণের হেঁশেলপনা করতে শুরু করেছি, অশোকদাকে জিগ্যেস করেছি অনেকবার, আনাজ যা ব্যবহার করতেন, তা তো দেখতেই পেতাম, তা ছাড়া আর কী দিতেন? উত্তরে মুচকি হাসতেন কিন্তু সরাসরি কোনও উত্তর দিতেন না। এটাই সাধারণত হয়ে থাকে। খুব নামী কোনও রাঁধুনিও যখন কোনও রান্না শেখান, উপকরণ এবং প্রক্রিয়া সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়ে থাকেন নাটকীয়ভাবে কিন্তু আমি বা আপনি যখন সেই পদটি তৈরি করি, একই হয় কি তার ফলাফল? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়না। এর কারণ কি জ্ঞানের অপ্রতুলতা? আধুনিক সরঞ্জামের প্রয়োগ? নাকি আর কিছু? এই আর কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় রহস্য। এই পুরো বিষয়টার ম্যাজিক এখানেই। মিশেলিন তারার অধিকারী কোনও পাচক যখন রান্নার ক্লাস নেন, অনুপুঙ্ঘভাবে তিনি প্রতিটি পর্ব ব্যাখ্যা করেন, কোন উপকরণ কেন, কখন ব্যবহার করা হবে, কোন মাত্রায় করা হবে, এসবই থাকে সেই উপস্থাপনায়। কিন্তু দক্ষতা? এটি এমন এক বস্তু, যার সঠিক কোনও মাপকাঠি হয়না। বুঝে নিতে হয় দুটি লাইনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনও অমোঘ সংকেতকে এবং প্রয়োগ করতে হয় যথাযথভাবে। যে সাবলীলতায় জ্যামি অলিভার মুরগির ফিলো পেস্ট্রির চেয়েও পাতলা, ফিনফিনে ত্বকের মধ্যে অঙ্গুলিসঞ্চার করেন, তার অনেকটাই অর্জিত কিন্তু বাকিটা? থাইম, মারজোরাম আর মাখনের মিলমিশ জ্যামি মুরগিটিকে আভেনে প্রবেশ করানোর অন্তত দুঘণ্টা আগে সেটির ত্বকের মধ্যে চালান করে দেন, যা বলতে গেলে তৈরি করে একটি আলাদা স্তর আর তারপর রান্না হওয়ার সময় ত্বকের মেদ আর মাখন একাকার হয়ে একাত্ম হয়ে যায় মাংসের সঙ্গে আর সৃষ্টি হয় সেই প্রার্থিত স্বাদ!

এ হলো ধান ভানতে শিবের গীত! এবারের কিস্তি আরম্ভ করেছিলাম কলকাতার ক্লাবগুলিতে যে বিশেষ ধরণের রান্নার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভাবে, সে বিষয়ে কিছু লিখবো বলে। সে সূত্রে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁর প্রসঙ্গ এসে পড়েছিল, যাঁর সঙ্গী হয়েই ক্লাবযাত্রা শুরু হয়েছিল একদিন। অনেক রবিবার সকালেই তাঁর ফোন পেয়েছি এই মর্মে যে বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার মতো (পড়ুন তাঁর পছন্দমতো) কিছু রান্না হচ্ছে না। তাই আমাদের অন্য কাজ না থাকলে ডালহৌসি ইন্সিটিউট-এ তিনি আমাদের মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কী খাওয়া হতো ওই দিনগুলিতে? প্রায় সেট মেনু। সাদা ভাত, ডাল, ভেজ ঝালফ্রেজি আর চিকেন কোরমা, যাতে আলাদাভাবে আলু দেওয়ার নির্দেশ থাকতো এবং প্রায় প্রত্যেকবারই সেই আলুর সংখ্যা প্রত্যাশামতো না হওয়ার কারণ দর্শাতে হতো খাবারের পরিবেশককে। যে পদগুলির নাম করলাম, সেগুলি একপ্রকার সাধারণ তো বটেই, অতি সাধারণও বলা যেতে পারে। কিন্তু সময়, পরিবেশ, এক টিপিক্যাল রন্ধনশৈলী, উপকরণ এসবের মেলবন্ধনে যে স্বাদটি প্লেটে হাজির হতো তা সত্যিই একেবারে আলাদা, ইউনিক! এর মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভাব তো একটা ছিলই কিন্তু আরও কিছু ছিল, যা জানা নেই। যে সময়টার কথা বলছি, তখনও মোবাইল ফোন আসেনি, মাল্টিপ্লেক্স ব্যাপারটা দেশের মানুষের কাছে অধরা ছিল। আর এই গত দু-আড়াই দশকের মধ্যে যোগাযোগের পৃথিবীতে বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আরও একটা নিঃশব্দ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই। একদিকে যেমন বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়েছে, ভিন দেশের খাবারের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা দুটোই বেড়েছে পাল্লা দিয়ে, ততোই যেন প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। বিপন্ন হয়েছে হয়েছে ঐতিহ্য। খাদ্য এর আওতার বাইরে থাকেনি। তাতে হলো কি, বিশেষ বিশেষ রন্ধনপদগুলি বেঁচে থাকা শুরু করলো রেসিপি বইগুলির মধ্যে, বাস্তবে তার আর তেমন অস্তিত্ব রইলো না। তিন দশক আগে যে ক্লাবের ল্যাম্ব রোস্ট বা ইয়েলো রাইস-বল কারি একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, তা এখন আর পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না সেই রবিবার দুপুরের ভেজ ঝাল ফ্রেজি অথবা চিকেন কোরমা!

নব্বইয়ের গোড়ার দিকে, মধ্যপ্রাচ্যে কিছুদিন কাটিয়ে আসার পর জীবিকার প্রয়োজনে আরেকজন মানুষের সংস্পর্শে এলাম। তিনি তাপস সেন। মুদ্রণজগতে এর কয়েকবছর আগে আকস্মিকভাবে প্রবেশের পর থেকেই লক্ষ্য করেছি এই নামটি সমীহাসঞ্চারী। কর্মজীবনের দীর্ঘতম পর্বটি তাপসবাবুর ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে কাটানোর সুবাদে দুটি বড় ব্যাপার ঘটেছিলো। এক, কাজের প্রশ্নে খুঁটিনাটির মধ্যে ঢুকতে চাওয়ার প্রবণতা এবং চূড়ান্ত পেশাদারী মনোভাবটি তৈরি হয় ওই সময়টিতেই, তাঁর স্বভাবের ছোঁয়াচ লেগে। দুই, খাদ্য এবং পানীয় বিষয়ে তাঁর অসীম জ্ঞান আর সূক্ষ্ম রুচিবোধ ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল আমায় এবং একথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই যে এ প্রসঙ্গে আমার ধ্যানধারণার একটা নির্দিষ্ট চেহারা তৈরি হয় তাপসবাবুর সঙ্গে কলকাতার ক্লাবগুলিতে নিয়মিত যাতায়াতের ফলেই।

মনে পড়ে ওইসময় কোনওএকদিন আমরা সন্ধের মুখে হাজির হয়েছিলাম কনক্লেভ-এ। সেই প্রথমদিন কী খাওয়া হয়েছিল, সত্যি বলতে এখন আর মনে নেই। কারণ কনক্লেভ-এর মেনু ‘ফাইন ডাইনিং’- এর গোত্রভুক্ত হলেও এই ক্লাবটি শহরের নব্য ক্লাব কালচারের প্রতিভূ। আর ঠিক সেই কারণে কখনওই ওই পদগুলি আলাদাভাবে আমার স্মৃতিতে রেখাপাত করেনি। ডালহৌসি ইন্সটিটিউট-এর বাইরে বিশিষ্ট ক্লাব ফুডের সঙ্গে আবার মোলাকাত ঘটলো ক্যালকাটা ক্লাবে। ইতিমধ্যে চিংড়ি মাছের প্রতি তাপসবাবুর সীমাহীন ভালবাসার কথাও জানা হয়েছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, যেকোনোও খাদ্যবস্তু চিংড়িমাছের ছোঁয়া পেলে হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য। বিশ্বসংসারে সম্ভবত এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে এর ব্যতিক্রম ঘটে। প্রথম সেই সন্ধ্যাতেও আমাদের সামনে এসেছিল চিংড়ির দুটি পদ। ‘প্রন অন টোস্ট’ আর ‘প্রন ককটেল’। খাদ্যরসিক কেউ এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন, এমন দুটি জিনিস একসঙ্গে একদিনে কেন? প্রথমটি বিশুদ্ধ স্ন্যাক্স পরিবারের। চিংড়ি, রসুন, আদা, ডিমের সাদা, নুন আর মরিচ মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করা হয়। তারপর একদিক টোস্ট করা পাঁউরুটির একটি স্লাইসের একদিকে প্রথমে মাখানো হয় মাখন আর তারপর পুরু করে মাখিয়ে দেওয়া হয় চিংড়ির মিশ্রণ আর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তিল। অতঃপর ডুব তেলে বাদামী করে ভেজে তোলা হয় সেই পাঁউরুটির সেই টুকরোটি এবং কোণাকুণি কেটে নেওয়া সেই স্লাইসটি। তারপর এর স্বাদ কেমন হতে পারে, তা বর্ননা করার প্রয়োজন আছে কি? দ্বিতীয় জিনিসটি অ্যাপিটাইজার গোত্রভুক্ত হয়েও তার আলাদা কৌলীন্য রয়েছে। পৃথক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি পদ হিসাবে অনায়াসে ভাবা যেতে পারে ‘প্রন ককটেল’-কে। বিশেষ ধরণের গ্লাসে, সাধারণত গবলেট-এর তলায় প্রথমে বিছিয়ে দেওয়া হয় লেটুস পাতা আর তার ওপর দিয়ে দেওয়া হয় মাখনে নেড়েচেড়ে নেওয়া চিংড়ি আর ছড়িয়ে দেওয়া হয় মারি রোজ বা সহস্র দ্বীপপুঞ্জের সস! কী সুন্দর নাম না? সবশেষে ওপরে হালকাভাবে তৈরি করা হয় ঘন কুচিকরা স্প্রিং অনিয়নের একটি আলগা আস্তরণ আর গ্লাসের গায়ে আলতোভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গোটাকয়েক আস্ত চিংড়িমাছ। সৌন্দর্যায়নের স্বার্থে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এসবের ভিড়ে হিমশৈলের চুড়ার মতো জেগে থাকবে ফ্রায়েড প্রন। একটি নির্দিষ্ট মাপের টাটকা চিংড়িকে প্রথমে নুন, অয়েস্টার সস, রসুন পেস্ট, লেবুর রস, সাদা মরিচগুঁড়ো মাখিয়ে অন্তত ঘন্টাদুয়েক রেখে দেওয়া হয় ফ্রিজে। সেইসময় ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার আর সামান্য বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি করে রাখা হয় আধা তরল বা ব্যাটার। এরপর খালি ডুব তেলে মুচমুচে করে ভেজে নেওয়ার কাজটি বাকি থাকে। চিংড়ির লেজের বেরিয়ে থাকা অংশটি তিন আঙুলে ধরে মুখের দিকটা টাবাস্কো সসে ডুবিয়ে কামড় দেওয়ার সময় ভিতরের সুগন্ধি ধোঁয়াটি মুখগহবরটি ভরিয়ে ফেললে ধরে নিতে হবে কাজটি ঠিকঠাক হয়েছে। এই ফ্রায়েড প্রন-কে ধারাবাহিকভাবে অনবদ্য স্তরে পৌঁছে দিত টলি ক্লাবের হেঁশেল। হয়ত এখনও সেই ধারা বহমান। কিন্তু সেই স্বাদের সন্ধানে আর যাওয়া হয়না অনেকদিন হলো। তার প্রেক্ষাপট আলাদা।

0 comments: