0

গল্প - সজল কুমার মাইতি

Posted in




ল্যান্ড ফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে প্রফেসর দিগবলয় কুশারীর স্ত্রী কৃপালিনী সোফা থেকে উঠে বাতগ্রস্ত পা টানতে টানতে গিয়ে রিসিভার তুলে বলেন,

—হ্যালো

—স্যার আছেন? আমি পারভিন বলছি। ফোনের অপর প্রান্তের উত্তর।

—ধর দিচ্ছি।

রিসিভারটা পাশে রেখে কৃপালিনী দেবী স্বামীর উদ্দেশ্যে ডাক ছাড়েন,

—শুনছো? পারভিন ফোন করেছে। পা টানতে টানতে আবার সোফায় গিয়ে বসেন।

—আসছি।

পড়ার ঘর থেকে প্রফেসর কুশারী স্ত্রীকে উত্তর দেন। এবং চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফোনের কাছে এসে রিসিভারটা তুলে বলেন, হ্যালো।

—স্যার, আপনি শিক্ষক দিবসে আমার প্রণাম নেবেন। ম্যাডামকেও জানাবেন। ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। অন্য প্রান্ত থেকে পারভিন।

—তুমি ও ভাল থেকো। আর্শীবাদ করি আরও বড় হও। সবার মুখ উজ্জ্বল কর। স্যারের আর্শীবাদ ছাত্রীকে।


পুরো নাম পারভিন সুলতানা। বাবা নফর চাঁদ জুটমিলের কর্মচারী ছিলেন। মিলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় ছাঁটাই হন। এখন রিকশা চালান। একবার অটোর সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে একটি হাত গেছে। বাকি একহাতে এখন সব কাজকর্ম করতে হয়। থাকেন হুগলীর চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগরের ঘিঞ্জি এলাকার এক ভাড়া বাড়িতে। আগে থাকতেন এখানকার অল্প দূরের এক বস্তিতে। চুঁচুড়া অনেক পুরনো শহর। গঙ্গানদী এর গা ঘেঁষে বয়ে গেছে। এখানকার গঙ্গা অন্য জায়গার তুলনায় অনেক চওড়া। গঙ্গার তীর বরাবর জায়গায় জায়গায় অনেক ঘাট আছে স্নানের জন্য। পুণ্যার্থী ও সাধারণ মানুষ অনেকেই সেখানে নিয়মিত গঙ্গাস্নান করেন। নদীর তীর পেভার ব্লক দিয়ে সাজানো হয়েছে। বসার জায়গাও হয়েছে। মানুষজন, প্রেমিক প্রেমিকা সবাই সেখানে বসে, আড্ডা দেয়। পারভিনও মাঝে মাঝে বই নিয়ে চলে আসে। একেবারে ফাঁকা দেখে জায়গা বেছে বসে। পড়াশোনা করে। গঙ্গানদী দেখে। জেলে নৌকো গঙ্গাবক্ষে ভেসে বেড়ায়। ফেরি লঞ্চে লোক নদী পারাপার করে। সে সব বসে বসে দেখে পারভিন। ভাল লাগে, দুঃখ বেদনা ভোলা যায় এইসব দেখতে দেখতে। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় পারভিনের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই হাওয়ার লোভেও সে আসে। এই শহর অনেকটা উত্তর কলকাতার মতো। অনেক বনেদী পরিবার বংশ পরম্পরায় বাস করেন এখানে। বাড়িগুলোও ঠিক উত্তর কলকাতা প্যাটার্নের। ঢোকার গেট। বাইরে আড্ডা দেওয়ার রক বারান্দা। সবই একরকম। চুঁচুড়ার এই রবীন্দ্রনগরের বস্তি এলাকা দুষ্কৃতিদের স্বর্গরাজ্য। সব জায়গার বস্তি এলাকার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পারভিন বড় হতেই তার বাবা এই বস্তি জায়গা থেকে একটু দূরে ভদ্র পরিবেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে যান। মা বাবার একমাত্র সন্তান পারভিন। বড় আদরের। ছোটবেলা থেকেই সে মেধাবী। সংসারে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু খুশি ও সুখের অভাব হয় নি। পড়াশোনায় তুখোড় পারভিন ছোট থেকেই টিউশন পড়িয়ে নিজের পড়ার সব খরচ জোগাড় করে এসেছে। বাবা মার ওপর তার পড়ার জন্য অতিরিক্ত কোনো আর্থিক বোঝা চাপায় নি। একসাথে টিউশন চলেছে, নিজের পড়াও চলেছে। কোন সময়ে দুই-এর মধ্যে কোন খামতি বা ফাঁকিবাজি দেখা যায় নি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সব সময় এক নম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলোশিপ পাওয়ার পর ফেলোশিপের টাকায় এই বাড়িতে পারভিনরা ভাড়া নিয়ে এসেছে। প্রফেসর কুশারী পারভিনের পিএইচডির সুপারাইজার।

প্রফেসর দিগবলয় কুশারী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসফির সিনিয়র অধ্যাপক। তাঁর আন্ডারে বর্তমানে আটজন স্কলার কাজ করছে। পারভিন তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু স্যারের সবচেয়ে প্রিয়। স্যারের স্পেশালাইজেশন পলিটিক্যাল ফিলসফি। দেশে বিদেশে বহু নামী জার্নালে স্যারের পেপার ছাপানো হয়েছে। সেই সব জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরও অনেক উঁচুতে। স্যারের বহু লেখাও অন্য অনেকের পেপারে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। স্যার তাঁর বিষয়ে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও আছে। পিএইচডি রেজিষ্ট্রেশনের আগে স্যারের সঙ্গে পারভিনের পরিচয়। তখন থেকেই স্যারের বাড়িতে যাতায়াত পারভিনের। পিএইচডির সেমিনারের আগে অনেক দিনই স্যারের বাড়িতে সারাদিন আলোচনার জন্য থেকে গেছে পারভি। তারপর থিসিস ফাইনাল সাবমিসনের সময় ও মাঝেমধ্যে স্যারের বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। ভাইভা ভোসির আগের দিন থেকে রাতে ও স্যারের বাড়িতে থেকেছে পারভিন। সে তো এ বাড়িরই মেয়ে। স্যার ম্যাডাম দুজনেই কন্যাস্নেহে পারভিনকে দেখেন। পারভিনও স্যার ম্যাডামকে পিতা মাতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। স্যারের বাড়ি পারভিনের কাছে তার দ্বিতীয় বাড়ি। এখানের রান্নাঘর থেকে প্রতিটি রুমেই তার অবাধ গতি। সে তো সন্তানহীন এই দম্পতির যেন একমাত্র সন্তান। ডক্টরেট ডিগ্রী অ্যাওয়ার্ড হওয়ার পর এখন কলকাতার এক কলেজে কন্ট্রাকচ্যুাল টিচারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট পেয়ে জয়েন করেছে। কিন্তু স্যারের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা তার আলোচনার আসর প্রায়শই বসে। দুজনে তখন তর্কে নিমগ্ন থাকে। আলোচ্য বিষয় সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হেজেল, কান্ট থেকে ভারতীয় পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত। এমনকি মার্ক্সবাদ ও বর্তমান জিও পলিটিক্যাল পাওয়ার, কনফ্লিক্ট নিয়েও আলোচনা হয়। আলোচনায় সমাজনীতি, রাজনীতি, স্বাধীনতা, অধীনতা প্রায় কোন বিষয় বাদ যায় না। ম্যাডামও এই আলোচনার রসদ চা টিফিন নিয়মিত সরবরাহ করে থাকেন তাঁদের কাজের লোককে নির্দেশের মাধ্যমে। এই আলোচনা মাঝে মাঝে মধ্যরাত্রিও পেরিয়ে যায়। ছাত্রী-শিক্ষক উভয়ের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অনেক নতুন ধারণার জন্ম দেয়। অনেক নতুন চিন্তা ভাবনার সুযোগ করে দেয়। চিন্তনযোগ্য চিন্তার উদ্রেক আসতে বাধ্য হয় এই সব আলোচনা থেকে। একেই বলা উচিত সঠিক চিন্তাশীল বা বুদ্ধিজীবি। বাকি সব বিজ্ঞাপনে, ব্যক্তি প্রচারে।

আজ ন্যাকের প্রস্তুতি কাজের চাপে কলেজ থেকে বেরুতে দেরি হয়ে গেছে। পারভিন আজ নিজের বাড়ি না গিয়ে স্যারের বাড়ি চলে এসেছে। বাড়িতে স্যার ম্যাডাম দুজনেই আছেন। পারভিনকে দেখে দুজনেই খুশি। ম্যাডাম পারভিনকে বলেন, তুমি বাথরুমে যাবে তো? ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি তোমার নতুন চুড়িদার বাথরুমে দিয়ে রাখছি।

—চুড়িদার কোথায় ছিল?"

—আমি গড়িয়াহাট থেকে তোমার জন্য একজোড়া চুড়িদার এনে রেখেছি। পারভিনের জিজ্ঞাসার উত্তরের ম্যাডাম।

—আমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসছি। বলে পারভিন বাথরুমে ঢুকে যায়।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে পারভিন দেখে ম্যাডাম তার জন্য চা টিফিনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সত্যিই এগুলোর এখন দরকার মনে মনে পারভিন তার কথাই ভাবছিল। খুশি মনে চেয়ারে বসে গোগ্রাসে সবকিছুর সদ্ব্যবহার করে। খেতে খেতে পারভিন বলে, ম্যাডাম, আমি আসছি কিচেনে। আপনাকে সাহায্য করব।

—তার দরকার নেই। কমলাকে (স্যারের বাড়ির রাঁধুনি) আমি বলে দিয়েছি। ও সব সামলে নেবে। তোমার যদি কিছু আলাদা খেতে ইচ্ছে করে বল। আমি বলে দিচ্ছি। তুমি বরং স্যারের সঙ্গে তোমাদের বিষয়ের আলোচনা কর। ততক্ষণে এদিকে রান্না ও কমপ্লিট হয়ে যাবে।

পারভিন স্টাডিতে গিয়ে দেখে স্যার কিছু একটা লেখালেখিতে মগ্ন। পারভিনের আসার শব্দে স্যার চোখ তুলে বলেন, এসো পারভিন। চা খাওয়া হয়েছে তো?

মাথা নেড়ে সায় দেয় পারভিন। একটা চেয়ার টেনে স্যারের সামনে বসে। ধীরে ধীরে ছাত্রী শিক্ষক আলোচনা শুরু হয়। আজ পারভিনে মনে মেল ফিমেল লিটারেসি রেট ও তার বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব নিয়ে কিছু প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছিল। সে স্যারের সঙ্গে সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু করে।

পারভিন—স্যার, সারা বিশ্বে মেল ফিমেল লিটারেসি রেটে কিন্তু মেয়েরা অনেক পেছিয়ে। আবার উন্নত দেশ গুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা শোচনীয়। অথচ পুরুষ মহিলা এক কয়েনের দু দিক। দুজনের সমান উন্নতি না হলে সমাজ কিভাবে এগোবে? অর্থনৈতিক উন্নতিও কিভাবে সম্ভব? শিশু জন্মের পর তার প্রথম শিক্ষক তো তার মা। আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমার মা তার যতটুকু শিক্ষা ছিল তা দিয়েই আমাকে আমার প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছে। বাবার সময় কোথায় আমাকে পড়ানোর? সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে বাড়ি ফিরে কোনরকমে মুখে দুটো দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। আবার সকাল সকাল কাজে ও তো বেরুতে হবে।

—তোমার যুক্তি একদম ঠিক। কিন্তু এটা ও ঘটনা যে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অনেকক্ষেত্রে ফিমেল লিটারেসি রেট একশো শতাংশ। উন্নতশীল দেশগুলোতেও এই রেট ক্রমবর্ধমান। অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে এই রেট চিন্তার কারণ অবশ্যই। তা বলে আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোন একটা দেশ পিছিয়ে থাকলে, কোন একটা পরিবার অশিক্ষার অন্ধকারে থাকলে সমাজ, জাতি, দেশ, এমনকি বিশ্বকে তার মূল্য চোকাতে হয়। পরিবেশের মধ্যে জীবাণু থাকলে আমিও বাদ যাব না আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে। বালির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে রাখলে নিরাপদ থাকা যায় না।

—সে তো ঠিক। আমার সন্তান দুধে ভাতে থাকলেই হল, বিশ্ব সংসার নিপাত যাক। আমার কিছু যায় আসে না। তা তো হতে পারে না। অপরের সন্তানও এই সমাজের অঙ্গ। যে সমাজে দশ জনের মধ্যে ন’জন অশিক্ষিত, সে সমাজ কখনও উন্নতি করতে পারে না। আবার দেখা যায়, মুসলিম সমাজে মেয়েদের শিক্ষার হার ভয়ংকরভাবে কম। এই সমাজ পিছিয়ে থাকার এটাও অন্যতম কারণ। মা অশিক্ষিত হলে সন্তান শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়া স্বাভাবিক। তালিবানরা ওই দেশের মহিলাদের ওপর যে হারে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করছে তার ফলে আফগানিস্তানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। চিন্তা করুন স্যার, সঠিক শিক্ষার আলো যদি দেখানো যেত, ঐ মহিলাদের মধ্য থেকে কোন বিজ্ঞানী, কোন সাহিত্যিক, কোন সমাজ সংস্কারক, নিদেনপক্ষে কোন গায়ক বা শিল্পী ও তো বেরিয়ে আসতে পারত। আমরা সে পথ অবরুদ্ধ করে রেখে দিলাম ধর্মের নাম দিয়ে। এবং ধর্মের সেই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আপনার। সারা বিশ্ব আপনার সঙ্গে একমত না হলেও আপনার কিছু যায় আসেনা। এ তো গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল। আর দেখুন, নিজের দেশের লোক নিজের দেশের লোককে শাসন করবে এই অজুহাতে সারা বিশ্ব চুপ করে থাকছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ের ফল যাচ্ছে জয়ীর পক্ষে। দেশের আপামর জনগণ এই শাসককে চায় কিনা তার উত্তর নেই। হাতে অস্ত্র থাকলেই রাজা। শাসনের সব অধিকার। এ স্বাধীনতা না নগ্ন পরাধীনতা! বিশ্ব তার দায় এড়াতে পারে না এই পরিস্থিতিতে। এই দেশের সাধারণ মানুষ যদি মনে প্রাণে এই জিনিস চাইত, তাহলে জান বাজি রেখে কেউ প্লেনের পাখার ওপর ভর করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবত না। এক অন্ধকারময় ভবিষ্যতের অপেক্ষায় এই চিরযুদ্ধবিধস্ত অভাগা দেশ আফগানিস্তান।

—তুমি কিছু পার্টিনেন্ট কোয়েশ্চেন তুলেছ। ব্যক্তি থেকে পরিবার হয়। আবার পরিবার থেকে সমাজ, দেশ ও জাতি। এর মূল ভিত্তি কিন্তু নারী ও পুরুষ। সবকিছুতে এদের সমানাধিকার কাম্য। দু’পায়ের একটা যদি কোন কারণে বিকলাঙ্গ হয় তাহলে যেমন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করা সম্ভব হয় না, নারীকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে পেছিয়ে রাখলে সে সমাজ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না। সে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রতিটি বিষয়েই। আর স্বাধীনতার কথা বলছ? সে তো এক বিশাল ধারণা। তুমি আমি কে? এর ব্যাখ্যা দিতে তাবড় তাবড় ব্যক্তিরাও ব্যর্থ হয়েছেন। স্বাধীনতা তো কেবল বছরের একটা দিন ধূমধাম করে উদযাপন করা নয়! কিছু বক্তৃতা, কিছু নাচগান, কিছু ফুল মালা, কিছু মিষ্টি বিতরণ। এসব কিন্তু স্বাধীনতা নয়। কর্মের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, নিজের মতো জীবনযাপনের অধিকার না থাকলে, সে স্বাধীনতার কোন অর্থ হয় না। আবার ব্যক্তি স্বাধীনতা সমষ্টি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে ফেললে সমস্যা। সেই বয়স্ক ঝুড়িওয়ালীর গল্প জান তো? যে স্বাধীন হয়েছি শুনে বড় রাস্তার মাঝখান দিয়ে ঝুড়ি মাথায় চলতে থাকে। তাকে দেখে রাস্তার সব গাড়ি ঘোড়া থমকে গেছে। গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। পুলিশ গিয়ে তাকে রাস্তা থেকে সরে আসতে বলে। তার উত্তরে সে বলে, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমি আমার খুশি মতো যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি। না হলে কিসের স্বাধীনতা?’ এই হল স্বাধীনতার অর্থ এই ভদ্রমহিলার কাছে। আসলে আমার স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে সে আর স্বাধীনতা থাকে? শাসক হওয়া তখনই শোভা পায় যখন প্রজা বা শাসিত নিজের হাতে শাসনদন্ডের দায়িত্ব দেয়। নতুবা এ তো দখলদারি।

—আচ্ছা স্যার, সেই যমরাজ আর যুধিষ্ঠিরের কথোপকথনে যুক্তির যে লড়াই দেখা গেছে, তা নিয়ে আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যক্তির সবকিছু তো নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের দ্বারা। সেক্ষেত্রে মন যেমন দ্রতগামী চোখও তো দ্রুতগামী। মুহূর্তে মন যত্রতত্র গমন করতে পারে আবার চোখ ও মুহূর্তে যেকোন জায়গায় যেতে পারে। এদের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করা কি সম্ভব?

—তোমার ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত হলে ও বলব যুধিষ্ঠির ভুল ছিলেন না। দেখ, মানুষের সব কর্মই তার মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মনের মতো চোখও দ্রুতগামী। এই দুইয়ের মধ্যে গতির মাপ করার যন্ত্র আমার অন্তত জানা নেই। তবে পারভিন তোমায় বলতে পারি, চোখ যত দ্রুতগামী হোক না কেন তার সীমাবদ্ধতা আছে। দৃষ্টিশক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন দূরত্ব অব্দি দেখতে পায়। কিন্তু সর্বোচ্চ দৃষ্টিশক্তির ব্যক্তিও এক বিশেষ দূরত্ব গিয়ে দিগন্ত বলয়ে আটকে যায়। তারপর তার দৃষ্টি ঐ সীমানা পেরোতে পারে না। আর মন চঞ্চল যেমন, গতিও তত দ্রুতগামী। মুহূর্তে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যেতে পারে। এক দেশ থেকে অন্য প্রান্তের দেশে পৌঁছে যেতে পারে। এজন্যই বলা হয় মানস ভ্রমণ। তার গতি কোন সীমানার সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে না।

—রাত অনেক হল। এবার সবাই খেতে এসো। মেয়েটা সারাদিন খাটাখাটুনি করে এসেছে, ওকে একটু বিশ্রাম করতে দাও। ম্যাডামের ধমকে আজকের আলোচনার আসরের এখানেই ইতি।

পারভিন বাবাকে নিয়ে কয়েক দিন খুব ব্যস্ত। বাবা অসুস্থ। ডাক্তার দেখানো থেকে বাবার সেবাযত্ন সবকিছুই নিজের দায়িত্বে নিজ হাতে করছে পারভিন। বাবার বয়সও হয়েছে। কর্মক্ষমতা কমেছে। ওষুধ ও সেবাযত্নে কিছুটা সুস্থ হলেও দুর্বলতা রয়েছে। মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে পারভিন সিদ্ধান্ত নেয় এখানকার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দেবে। কলকাতায় তার কলেজের কাছে একটি ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থা করেছে। সেখানে বাবা মাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে পারভিন। বাবা প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে মেয়ের কথায় রাজি হন। আসলে অনেক দিনের সম্পর্ক এই চুঁচুড়া শহরের সঙ্গে। সেই বন্ধন কাটাতে তো একটু সময় লাগবে? কষ্টও হবে। তা সেই সম্পর্ক ও কষ্টের বেড়াজাল কেটে সবাই রওনা দেয় কলকাতা শহরের উদ্দেশ্যে। বাসস্থান বদলের এই পরিকল্পনা স্যার ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া। অফিস আওয়ারে লোকাল ট্রেনে একজন মহিলার পক্ষে মফস্বল শহর থেকে কলকাতায় আসা যে কি কঠিন তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। এতটা দূরত্ব রেগুলার যাতায়াতের পরিশ্রমও সহ্য করতে পারছিল না পারভিন। বাড়ি ফিরে খুব টায়ার্ড হয়ে যেত। পড়াশোনা করার মতো এনার্জি আর পেত না। সেই জন্য এই বাড়ি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। নাড়ির টান ছিঁড়ে এগিয়ে চলা।

কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের এই ভাড়া বাড়িতে পারভিনের অনেক সুবিধে হয়েছে। কলেজের কাছেই হয়েছে এই বাড়ি। কিন্তু সমস্যা একটা হয়েছে। পারভিনের বাবা এখানে বেকার হয়ে গেছেন। বাড়িতে বসে থাকতে হয়। কাজ না থাকার গ্লানি ভেতরে ভেতরে কুরে খেতে থাকে। তার থেকে হতাশার ছায়া দেখা যায়। বাবার এই অবস্থা দেখে পারভিন স্যারের সঙ্গে আলোচনা করে। স্যার এক এনজিওর সন্ধান দেন। পারভিনের বাবার হ্যান্ডিক্যাপড সার্টিফিকেট ছিল। এর সুবাদে এনজিও থেকে একটা মোবাইল স্টলের ব্যবস্থা করা গেল। সেই স্টলে সকালে পারভিনের বাবা পাড়ায় দুধ বিক্রির কাজে নেমে পড়লেন। অল্প দিনের মধ্যে বিভিন্ন বাড়িতে দুধ সরবরাহের নির্ভরঘোগ্য ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। বিক্রি বাট্টা ভালই হতে থাকল। ক্রমে তা বাড়তেও থাকল। বাবার মুখে হাসি ফেরাতে পেরেছে পারভিন। এখন রোজ পারভিনের বাবা সকাল সকাল এই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান।

নিজের একটা পেপার এক জার্নালে পাঠানোর আগে ফাইনাল করার কাজে ব্যস্ত পারভিন। আজ স্যারের বাড়ি যায় পারভিন। পেপারের ফাইনাল টাচ দেওয়ার আগে স্যারের সঙ্গে একটু আলোচনা করে নিতে চায়। পারভিনকে দেখে ম্যাডাম বলেন, এবার অনেকদিন পর এলে পারভিন। বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?

—হ্যাঁ ম্যাডাম, সবাই ভাল আছে। বাড়ি শিফট নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আর বাবার বিষয়টা তো জানেন? সব মিলিয়ে আসা হয় নি।

—ঠিক আছে। আগে বস। আমি চা বলে দিচ্ছি। তোমার স্যার একটু বেরিয়েছেন। এক্ষুণি চলে আসবেন।

পারভিন ফ্রেশ হয়ে চায়ের টেবিলে বসে। পারভিনের চা খেতে খেতে দেখে স্যার এসে বাড়ি ঢুকলেন। ফ্রেশ হয়ে স্যারও চায়ের টেবিলে যোগ দিলেন। চা খাওয়ার মাঝে স্যার পারভিনের বাড়ির খবরাখবর নেন। চা খাওয়া শেষ হলে স্যার পারভিনকে বলেন, পারভিন, তোমার এখানকার কাজ হয়ে গেলে স্টাডিতে চলে এসো। আজ তোমার পেপারটা ফাইনাল করতেই হবে। স্যার স্টাডিতে গিয়ে বসেন। কিছু পরে পারভিনও স্টাডিতে যায়। স্টাডিতে স্যার পারভিন মুখোমুখি চেয়ারে বসে। স্যার পারভিনের কাছ থেকে পেপার চেয়ে নেন। মন দিয়ে পড়ে দেখেন। কিছু জায়গায় সাইন অফ ইন্টারোগেশন, কিছু জায়গায় সোর্স মেনশন আর কিছু রেফারেন্সের কথা পয়েন্ট আউট করেন। বলেন, পারভিন, দেখ এই জায়গাগুলোতে কিছু আরও বইয়ের উল্লেখ করা দরকার। সাইন অফ ইন্টারোগেশন-এর জায়গাগুলো দেখান। সোর্স আর রেফারেন্সগুলো ঠিকঠাক লিখে দাও। পেপার তোমার যথেষ্ট ভাল হয়েছে। পলিশি রেকমন্ডেশনে বতর্মান কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করে দাও। ব্যস। পারভিন স্যারের কথামতো একে একে সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে। সোর্স, রেফারেন্স কমপ্লিট করে। পলিশি রেকমন্ডেশনও কমপ্লিট করে। থরোলি গোটা পেপার আবার ভাল করে দেখে। আবার অল্প কিছু চেঞ্জও করে। এবার স্যারকে ফাইনাল চেকের জন্য দেয়। স্যার নিজের কমেন্ট করা জায়গাগুলো চেক করে দেখেন। এবার স্যার খুশি। স্যারের চোখ মুখ দেখে বোঝা যায়। স্যার পারভিনকে বলেন, কালই পেপারটা মেল করে দিও। সেমিনারের পরে ওদের যে জার্নালে পেপার ছাপার কথা বলেছে সেই জার্নাল খুব ভাল। ওরা সবকিছু নিয়ম মেনে করে। ডবল ব্লাইন্ড রিভিউ হয় প্রত্যেক পেপারের। তারপর সিলেক্টেড হলে ওরা অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার ইস্যু করে। এর তিন মাসের মধ্যে পেপার পাবলিসড্‌ হয়। পারভিন মাথা নেড়ে স্যারের কথায় সায় দেয়।

পেপারের টেনশন এখন গেছে। ছাত্রী শিক্ষক আড্ডার মুডে অন্যান্য দিনের মতো আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়ে।

—পারভিন, বাড়ির ঝামেলা মিটেছে? বাবা এখন ঠিক আছেন তো?

—হ্যাঁ স্যার। সব ঠিকঠাক মিটে গেছে। দুধের গাড়ি পেয়ে বাবা এখন খুব খুশি। পাড়ায় বাবার ডিমান্ডও বেড়ে গেছে। হাতে পয়সা এলে প্রত্যেকের মন ভাল হয়ে যায়। বাবাও এখন খুব খুশি। কিন্তু স্যার, একটা ব্যাপার আপনাকে শেয়ার না করে পারছিনা। এর মধ্যে আমাদের এক রিলেটিভ মারা গেছেন। তার কবরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্য যে ঝামেলা ও টাকার দাবি করেছিল তা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ডেডবডিকে স্নান করিয়ে গাড়িতে তোলার খরচও অনেক। আমরা একে গোসল করা বলি। সব মিলিয়ে বলে কুড়ি হাজার টাকা লাগবে। আবার কবরের জন্য প্যাকেজের ব্যবস্থার মধ্যে যাওয়া হবে নাকি তা জিজ্ঞেস করে বেরিয়াল গ্রাউন্ডের লোকজন। সেজন্যও কুড়ি পঁচিশ হাজার লাগবে বলে জানায়। স্যার, আপনি বলুন। কোনো গরিব পরিবারের পক্ষে অসুস্থতার খরচ সামলে শেষকৃত্যের জন্য এত টাকা জোগান দেওয়া সম্ভব? এইসব অসহায় পরিবার কি করে এত টাকা জোগাড় করে এই সমস্যার সমাধান করবে?

—ঠিক তাই। ধর্মের নামে দুর্নীতি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে অত্যাচার আজ আর কোনো বিরল ঘটনা নয়। অহরহ ঘটে যাচ্ছে। মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর চেয়ে অন্যায় কিছু হয় না। তুমি দেখ সমাজ চোখ বন্ধ করে আছে। প্রশাসক অন্য দিকে তাকিয়ে আছে অথবা জড়িত আছে। প্রতিবাদী বিভিন্নভাবে অত্যাচারের শিকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী, বুদ্ধি বিবেকহীন সেল্ফস্টাইলড বুদ্ধিজীবীর দল নির্বাক, নিশ্চুপ। আর‘ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, শব্দ কোরোনা’। তাহলে তোমায় একটা ঘটনা বলি। এই অতিমারীর মধ্যে আমার এক আত্মীয় মারা গেছেন। হাওড়ায় থাকতেন। শবদেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় শিবপুর বার্নিংঘাটে। সেখানে গিয়ে জানা গেল ওখানে কেবল করোনার মৃতদেহ সৎকার করা হয়। ওদের পরামর্শমতো সালকিয়া বাঁধাঘাট শ্মশানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানে মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। আগে কাউন্টারে টাকা জমা করতে হলো। বারোশো টাকা জমা নিল। একটা সাদা কাগজে শুধু পেড লেখা। কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন সৎকার কমপ্লিট হয়ে গেলে এখান থেকে রিসিট কালেক্ট করে নিতে। তখন এই কাগজ দেখালে সব কাজ হয়ে যাবে। ঐ কাগজ দেখিয়ে সব কাজ হয়েও গেল। ফেরার পথে কাউন্টারে ঐ সাদাকাগজ যাতে ইলেকট্রিক চুল্লীর লোকেরা টিক করে দিয়েছিল, দেখিয়ে রিসিট পাওয়া গেল। পরে যখন রিসিট দেখা হলো তাতে লেখা ছশো টাকা। এখন ওদের ঐ রিসিট দেখিয়ে প্রমাণ করার উপায় নেই যে ওরা বারোশো টাকা নিয়ে এই ছশো টাকার রিসিট দিয়েছে। এই অতিমারীতে জীবন জীবিকা নিয়ে মানুষ ব্যতিব্যস্ত, তার মধ্যে এইসকল ব্যক্তি মৃতদেহ সৎকারের নামে চিটিংবাজী করে চলেছে। এবং এত পরিকল্পনামাফিক যে তা প্রমাণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। একে তুমি কি বলবে? সব ধর্মে খুঁজলে এরূপ ভুরিভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।

—হ্যাঁ স্যার। আপনি ঠিক বলেছেন। প্রদীপের তলায় অন্ধকার। শুধু কি তাই? প্রশাসক জনগণের ভোটে জেতে কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে জনগণের বিরুদ্ধেই সেই ক্ষমতার প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ করে। প্রশাসক নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করবে এই হলো নিয়ম। কিন্তু দেখুন প্রশাসক অন্য দলের সমর্থকদের পছন্দ করে না। সরকারি বিভিন্ন সুবিধা সুযোগ থেকে এক বা অন্য অছিলায় তাদের বঞ্চিত করে। যেন ব্যক্তির পছন্দসই দলকে সমর্থন করার অধিকার নেই। প্রশাসক ভুলে যায় যে, কোনদিন সেও বিরোধী দলে বসতে পারে। সরকার আর দল যে আলাদা তা প্রশাসক বিস্মৃত হয়। সমাজে এই বঞ্চনা সবক্ষেত্রে বহুলমাত্রায় দেখা যায়। উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, ব্রাক্ষন-শূদ্র, ক্ষমতাশালী-ক্ষমতাহীন—সবকিছুতে বঞ্চনা চলছে। জানি না কবে এই বঞ্চনার শেষ হবে!

—সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি দানা বেঁধেছে। প্রতিবাদীর সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে পৌঁছেছে। আবার একদলীয় শাসনের আধিপত্য বাড়লে এই দুর্নীতি সর্বোচ্চস্তরে পৌঁছয়। প্রতিবাদীর ওপর অত্যাচার বাড়ে, সংখ্যাও কমে। চাটুকারিতা বৃদ্ধি পায়। বিবেকের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে বেড়ায়। সমাজ পেছুতে থাকে। পারভিন, জানো তো? হিটলারের সময়ে বুদ্ধিজীবিদের এক বিশাল অংশ তার ভক্ত হয়ে উঠেছিল। সমালোচনার পরিবর্তে কেবল প্রশংসার স্তুতি বিরাজ করতো।

—স্যার, এই বঞ্চনার প্রশ্নে আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে। নারীর বঞ্চনা নিয়ে নারীবাদীদের আন্দোলন। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের পুরোধায় নারীরা তো আছে, অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবি পুরুষের দলও তাতে নাম লিখিয়ে হাততালি কুড়োতে চায়। অবশ্যই নিজেদের জীবিকার পথ প্রশস্ত করার বিষয় মাথায় রেখে। কিন্তু স্যার, দেখুন, আমি মেয়ে, নারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উচ্চতর ডিগ্রী পেয়েছি, তার পথে কোথাও কখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। মেয়েরা তো মহাকাশে যাচ্ছে, সেনায় জয়েন করছে। শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, সাহিত্যেসব কাজেই মেয়েরা আজ পুরুষের সঙ্গে সমানতালে লড়ে যাচ্ছে। মেয়েদের উন্নতির পথে বাধা পুরুষরা নয়, অনেকক্ষেত্রে মেয়েরাই মেয়েদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখায় আমি পড়েছি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা। সেখানে মেয়েরাই সংসারের কত্রী। পুরুষ সংসারের এক সদস্য মাত্র, কর্ত্রীর সিদ্ধান্ত তার কাছে অবশ্যই মান্য। আমাদের দেশের কিছু অংশে এখনো মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান আছে। বিদেশের কিছু দেশেও এই ব্যবস্থা দেখা যায়। আমরা নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার জন্য পুরুষতান্ত্রিকতার এই অজুহাত খাড়া করি। অযথা পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে পড়ি। সংসারে নারী পুরুষের যেমন সমান অধিকার, তেমন যোগ্যতা অনুসারে সমান সুযোগ। এখানে বৈষম্যের প্রশ্নই নেই। বৈষম্য যেখানেই হবে, তার প্রতিবাদ অবশ্যই করনীয়। তাতে নারী পুরুষ বিভেদের প্রশ্নই ওঠে না। বৈষম্য, বঞ্চনা হলে কেবল নারীদের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করব আর পুরুষের ক্ষেত্রে চুপ করে থাকব তা চলতে পারে না। নারী হয়ে ও পুরুষের বঞ্চনা বৈষম্যের প্রতিবাদ আমি করব। সমাজে নারী পুরুষ দুইই তো সমান। অন্যথায় আমি বায়াসড্‌, নিরপেক্ষ নই।

—পারভিন, অনেক রাত হয়ে গেছে। চল, ডিনার করে নেবে। আজ আর বাড়ি ফিরতে হবে না। বরং বাড়িতে একটা ফোন করে জানিয়ে দাও। ম্যাডামের কথায় ছাত্রী শিক্ষকের হুঁস ফেরে।

—না, এত রাতে আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং পেপারটা ফাইনালাইজ কর। আমি একটু দেখে নেব। যত দেরি হোক আজই মেল পাঠিয়ে দাও। কারণ, ওরা পেপার যদি অ্যাকসেপ্ট করে, সেমিনারে অ্যাটেন্ড করার জন্য তোমার পাসপোর্ট, ভিসা এসবের জন্য সময় লাগবে। যত তাড়াতাড়ি অ্যাকসেপটেন্স লেটার পাবে, তত তাড়াতাড়ি এই প্রসেস শুরু করতে পারবে। আর পেপার প্রেজেন্টেড না হলে ওরা ওদের জার্নালে ছাপবে না।

—স্যার, আমি একটা অ্যাপ ক্যাব ধরে নিয়ে চলে যেতাম। অসুবিধে হতো না। কিন্তু, স্যার আপনি যে কথা বলছেন তাও ঠিক। ম্যাডাম, আপনি রেডি করুন আমরা ডিনার টেবিলে আসছি।

পরদিন দুপুরে পারভিন যখন মেল খুলে দেখে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি থেকে পেপার পাওয়ার অ্যাকনলেজমেন্ট মেল এসেছে। ওখান থেকে জানতে পারে আগের দিন রাত দুটো দশে মেলে পেপার পাঠিয়েছিল। আসলে রাত অনেক হয়েছিল বলে আর ঘড়ি দেখে নি। মেল সেন্ট করেই শুয়ে পড়েছিল। ওরা জানিয়েছে সাতদিনের মধ্যে পেপারের ফেট জানিয়ে দেবে।

কয়েকদিন পারভিন খুব ব্যস্ত। কলেজের পরীক্ষা, বাড়ির কিছু আসবাব কেনা এই সব নিয়ে মশগুল ছিল। পেপারের কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। স্যারের ফোনে হুঁস ফেরে। মেল খুলে দেখে, ওরা পেপার অ্যাকসেপ্ট করেছে। কিন্তু সেমিনারে পার্টিসিপেশন কনফার্ম করতে বলেছে তিন দিনের মধ্যে। এদিকে পারভিনের না হয়েছে পাসপোর্ট, না হয়েছে ভিসা। স্যারের সঙ্গে কনসাল্ট করে পারভিন সেমিনারে পার্টিসিপেশন কনফার্মেসন মেল পাঠিয়ে দেয়। খুশির হাওয়ায় ফুরফুরে মুডে আছে পারভিন। কিন্তু ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে।

আজ স্যারের বাড়ি এসেছে পারভিন। স্যারের সঙ্গে বসে পাসপোর্টের জন্য অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন করবে। পারভিনকে দেখে স্যারও খুশি। বসতে না বসতে ম্যাডাম পারভিনকে চা এগিয়ে দেন। চা খেয়ে স্যার ও পারভিন স্টাডিতে ঢোকে। ম্যাডাম পারভিনকে বলেন, পারভিন, তোমার স্যার আজ বাজার থেকে চিংড়ি নিয়ে এসেছেন। তোমার ফেভারিট চিংড়ির মালাইকারি হবে।

—ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার পছন্দ মনে রেখেছেন দেখছি।

স্যার ও পারভিন মিলে স্যারের স্টাডিতে যায়। পারভিন সঙ্গে করে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে এসেছে। পারভিন স্যারের কম্পিউটারের বসে। স্যার চেয়ার টেনে পাশে বসেন। রেজিশ্ট্রেসন থেকে ফর্ম ফিলাপ সবই অনলাইনে হয়ে। যেখানে আটকাচ্ছিল স্যার সাহায্য করছিলেন। রেফারেন্স হিসেবে স্যারের ও ম্যাডামের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার দেয়। অনলাইন পুলিশ ভেরিফিকেশন ফর্মও ফিলাপ করে দেয়। তৎকাল অ্যাপ্লিকেশন হওয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট বাড়ি পৌঁছে যায়। পাসপোর্ট পাওয়ার পর অনলাইনে ভিসার অ্যাপ্লিকেশনও করে দেয় পারভিন। যেহেতু টেম্পোরারি ট্রাভেল ভিসা, সেজন্য ভিসা পেতে কোন অসুবিধে হয় নি।

সিঙ্গাপুর যাওয়ার দিন দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। পারভিনও জিনিসপত্র গোছানোয় ব্যস্ত। আবার একদিন স্যারের কাছে এসে পিপিটি তৈরি কমপ্লিট করে নেয়। প্লেনের টিকিট পেতে কোন অসুবিধে হয় নি। স্যারের পরামর্শে একটা ট্রলি ব্যাগ আর এক সাইড ব্যাগ নেয়। কারণ কেবিন লাগেজ হিসেবে নিয়ে যাওয়া যাবে। প্লেন ল্যান্ড করলে তাড়াতাড়ি বেরিয়েও যাওয়া যাবে।

আজ মাঝরাতে থাই এয়ারওয়েজের প্লেনে পারভিন সিঙ্গাপুর যাবে। ব্যাগে নিজের জামাকাপড়, ল্যাপটপ, পেন ড্রাইভ ও অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিয়েছে পারভিন। প্লেনের টিকিট, আধার কার্ড নিজের সাইড ব্যাগে নিয়েছে। প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি বের করতে পারবে। আজ স্যার নিজের গাড়িতে ড্রাইভ করে পারভিনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছেন। গাড়ি থেকে নেমে পারভিন স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। স্যার দুহাত তুলে আর্শীবাদ করেন,‘বিজয়ী ভবঃ’। মাঝরাতের থাইএয়ারওয়েজের প্লেনে উঠতেই সুন্দরী এয়ারহোস্টেস ভায়োলেট কালারের অর্কিড দিয়ে স্বাগত জানায়। নিজের বোর্ডিং পাস দেখিয়ে নিজের সিটে বসে। উইন্ডো সিট মেলায় বাইরের দৃশ্য দেখার কিছুটা সুযোগ পায়। জীবনের প্রথম প্লেন চড়ার অভিজ্ঞতা। ভেতরে কিছু টেনশন, কিছু কল্পনা, কিছু আশা আশঙ্কা। অবশেষে প্লেন টেক অফ করে। এ তো শুধু প্লেনের উড়ান শুরু নয়, এ তো পারভিনের জীবনের, পারভিনের ক্যারিয়ারের উড়ান শুরু।

ভোরবেলায় চাঙ্গি এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করতে পারভিন নিজের লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসে। এই প্লেন কানেক্টিং প্লেন। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে প্লেন চেঞ্জ করতে হয়েছে। দুই প্লেনেই খাবার অনেক দিয়েছিল। এত খাওয়া যায় না। পারভিন যতটা পেরেছে খেয়েছে। প্লেনে ঠান্ডাও প্রচণ্ড ছিল। ওরা ব্ল্যাঙ্কেট দিয়েছিল। কিন্তু তাতে ঠান্ডা রোখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এদিকে এয়ারপোর্টে ইউনিভার্সিটির নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একাধিক ব্যক্তি অপেক্ষা করছিল। পারভিনের সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি পৌঁছতে সেজন্য কোন অসুবিধে হয় নি। এখানে হসপিটালিটি খুব ভাল। থাকা খাওয়ার সু-বন্দোবস্ত আছে। পারভিনকে দু বেডের একটা রুম দেওয়া হয়েছে। রুম পার্টনার জোহানেসবার্গ ইউনিভার্সিটির এক মহিলা অধ্যাপক। মহিলা ব্ল্যাক হলেও ইংরেজি সুন্দর বলেন। পারভিনের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। রুমে সবকিছুই আলাদা। ইন্টারনেট থেকে সবকিছুর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেমিনারে তিরিশ দেশ থেকে একশো পঁচিশ জন ডেলিগেট এসেছেন। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখানে তিন দিন ধরে তাদের পেপার প্রেজেন্ট করবেন। এই ইন্টারনেশানাল সেমিনারে এত পেপারের ছড়াছড়ি যে প্যারালাল প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা আছে। বিকেলে ছোট্ট করে সাইট সিয়িং-এর ব্যবস্থাও রয়েছে।

পারভিনের প্রথম দিন ফার্স্ট হাফে পেপার প্রেজেন্টেশন আছে। সকাল সকাল এসে রেজিশ্ট্রেসন করে নিয়েছে পারভিন। ভাল কিট দিয়েছে এরা। চা কফির অফুরন্ত ব্যবস্থা। সঙ্গে ভ্যারাইটির স্ন্যাক্স। ঘড়ির কাঁটা মেনে সেমিনার শুরু হল। স্বল্প উদ্বোধনী হয়ে পেপার প্রেজেন্টেশন শুরু হয়ে গেল। পারভিনের টার্ন আসতে দুরুদুরু বুকে পেপারের একটি প্রিন্টেড কপি হাতে পোডিয়ামে ওঠে। পিপিটির কপি আগে থেকে নিয়ে প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা ছিল। পারভিন প্রেজেন্টেশনের জন্য পনের মিনিট সময় পেল। তাতেই মেয়ে সেমিনার হল কাঁপিয়ে দিল। কোয়েশ্চন আনসার সেশন নিয়ে প্রায় হাফ অ্যান আওয়ার সময় চলল পারভিনের সেশন। হাততালির গমগম শব্দে পারভিন সন্তুষ্ট চিত্তে পোডিয়াম থেকে নিজের সিটে ফিরে আসে।

একশো পঁচিশটা পেপার থেকে শর্ট লিস্ট করে পনেরোটা সিলেক্ট করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকে তিন মিনিট করে সময় পাবে আবার তাদের পেপার প্রেজেন্ট করার জন্য। বেস্ট পেপার সিলেক্টেড হবে এই পনেরোটি পেপার থেকে। আজ দ্বিতীয় দিনের শেষে এই লিস্ট প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। শেষ দিন সকালে এদের প্রেজেন্টেশন আছে। সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্টও জানিয়ে দেওয়া হবে। তারপরে ভ্যালিডেক্টরি সেশন। বিকেলে লোকাল ট্যুর। শর্ট লিস্টেড পেপারের মধ্যে পারভিনের পেপারও আছে। আজ রাতে মেল ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পারভিন। পারভিন ভেতরে ভেতরে ভীষণ চঞ্চল, অস্থির। মাত্র তিন মিনিটে কি করে পেপার প্রেজেন্ট করবে সেই নিয়ে চিন্তায় আছে। স্যারের কাছে পারভিনের জিজ্ঞাসা।

—স্যার, মাত্র তিন মিনিটে কি করে একটা পেপার প্রেজেন্ট করব? এটা কি সম্ভব?

—শোনো, যেমন নৈবেদ্য তেমন পুজো বলে এক কথা প্রচলিত আছে। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের হাতে উপায় বা কি আছে? তাদের তো একটা প্রসেস এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। হাতে সময় ও বাঁধাধরা। তাছাড়া প্রত্যেকে তো একই সময় ও সুযোগ পাচ্ছে। এরমধ্যে যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে সেই সেরা। কনসট্রেন্ট সবারক্ষেত্রে তো সমান। অতএব বলার কিছু নেই। তবে মূল প্রশ্ন এই স্বল্প সময়ে কি করে তোমার পেপারের মূল প্রতিপাদ্য বিচারকমন্ডলীকে বোঝাতে পারবে? তা না করতে পারলে তুমি ব্যর্থ। এই চ্যালেঞ্জ তোমাকে নিতেই হবে। এইটা তো আসল লড়াই। একই সুযোগের মধ্যে তুমি কিভাবে তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পার? তা যদি সফলভাবে করতে পার, তবেই তুমি সফল। ‘যো জিতা ওহি সিকন্দর’। দেখ, তিন মিনিটের মধ্যে পেপার প্রেজেন্ট করতে হলে তোমাকে এই তিনটে বিষয়ের ওপর কনসেন্ট্রেশন করতে হবে। তোমার পেপারের ‘অবজেক্টিভ, মেথডলোজি ও ফাইন্ডিংস অফ দ্য স্টাডি’ এই তিনটি পয়েন্ট ইন ব্রিফ বলতে হবে ঐ সময়ের মধ্যে। বিচারক মন্ডলী এই তিনটে বিষয় থেকে তোমার পেপারের মূল প্রতিপাদ্য সংক্ষেপে হলেও অন্তত বুঝতে পারবেন। তোমার কাছে চ্যালেঞ্জ ঐ সময়ের মধ্যে কতটা পরিষ্কার করে এই তিনটি বিষয় প্রেজেন্ট করতে পারবে। মনে রেখ যত সংক্ষেপ হোক তিনটি পয়েন্ট কিন্তু তোমায় কভার করতেই হবে। মনে থাকবে?

—হ্যাঁ স্যার। প্রাইমারি টেনশন কেটে গেছে। একটা ধাপতো পেরিয়ে এসেছি। দেখি বাকিটা। হারানোর তো কিছু নেই।

—এগজাক্টলি, দ্যাট শ্যুড বি দ্য স্পিরিট। কিপ ইট আপ। উই শ্যাল ওভারকাম।

এবার পারভিন পরের দিনের প্রেজেন্টেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্যারের কথা মাথায় রেখে পেপারের ‘অবজেক্টিভ, মেথডলোজি ও ফাইন্ডিংস’ নিয়ে কনসেন্ট্রেট করে। ঘড়ি ধরে চেষ্টা করে তিন মিনিটের মধ্যে সংক্ষেপে তিনটি পয়েন্ট কভার করার ট্রায়াল দেয়। রুমমেট এ ব্যাপারে পারভিনকে যথেষ্ট সাহায্য করে। যেহেতু পুরো পেপার পারভিনের নখদর্পণে, সংক্ষেপ করাটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। মনকে শান্ত রাখতে চায়, টেনশনফ্রি থাকতে চায়।

পরেরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে পারভিন। স্নান করে নিয়েছে। হালকা ব্রেকফাস্ট করে এক কাপ হট কফি নিয়েছে। একটু আগেই আজ বেরিয়ে সেমিনার হলে পৌঁছে গেছে। মনে মনে নিজের বক্তব্য একবার ঝালিয়ে নিয়েছে। মনে মনে মা-বাবা, স্যার-ম্যাডামের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে নেয়। সামনের সারিতে গিয়ে বসে। পাক্কা ন’টায় সেমিনার শুরু হয়। চার নম্বরে পারভিনের ডাক পড়ে। হাতে কাগজগুচ্ছ নিয়ে পারভিন পোডিয়ামে ওঠে। স্যারের পরামর্শ মতো সরাসরি অবজেক্টিভ দিয়ে শুরু করে। ধীরে ধীরে মেথডলোজি ও ফাইন্ডিংস সংক্ষেপে হাইলাইট করে। তিন মিনিটের বেল বেজে যায়। একটি পয়েন্ট বলেই নিজের প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট করে পারভিন। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে। নিজেকে অনেকটা রিলাক্সড লাগে। একটা ক্লাস ভালভাবে নিয়ে কোন শিক্ষকের যেমন ফিলিংস হয়, পারভিনের ঠিক সেরকম ফিলিংস হচ্ছিল। নিজের প্রেজেন্টেশনে নিজেই তুষ্ট। রেজাল্ট কি হল তার যেন পরোয়া নেই। একে একে পনেরো জনের প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট হয়। সেশন শেষ। টি ব্রেক। হাফ অ্যান আওয়ার পরে ভ্যালিডেক্টরি সেশন শুরু হবে।

ভ্যালিডেক্টরি সেশনের শুরুতে ঘোষিকা অ্যানাউন্স করেন যে বেস্ট পেপার প্রেজেন্টেশনের রেজাল্ট প্রথমে ঘোষণা করা হবে। সব অতিথি অভ্যাগতরা আসন গ্রহণ করে নিয়েছেন। শুরু হয় ঘোষণা। জয়েন্টলি থার্ড হয়েছে আমেরিকা ও জার্মানির দুটি পেপার। সেকেন্ড নিউজিল্যান্ডের। আশা আশঙ্কায় পারভিনের বুক দুরুদুরু করতে থাকে। থার্ড সেকেন্ড কোনটায় নেই। ভরসার জায়গাটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। অবশেষে ঘোষিকা বলতে শুরু করেন, ফার্স্ট, ইট ইজ দ্য বেস্ট পেপার প্রেজেন্টেড বাই মেজ পারভিন সুলতানা ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল, ইন্ডিয়া। অল দ্য জুরিজ হ্যাভ ইউন্যানিমাসলি ডিসাইডেড দিস পেপার অ্যাজ দ্য বেস্ট পেপার ইন দিস সেমিনার। কনগ্রাচুলেশনস, মিস সুলতানা।

উত্তেজনায় পারভিন সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। চোখে আনন্দাশ্রু। তখন সেমিনার হল করতালিতে মুখরিত।

একে একে অতিথিদের ভাষন শেষ। ডেলিগেটদের তরফ থেকে কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। এবার বেস্ট পেপারের প্রাইজ বিতরন। সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস এর ডিরেক্টর মিস্টার জুরিখ এই প্রাইজ দেবেন। থার্ড, সেকেন্ডকে দেওয়ার পর পারভিনের পালা আসে। ফার্স্ট প্রাইজের অর্থমূল্য ভারতীয় মুদ্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আছে একটি মেডেল ও একটি সার্টিফিকেট। পারভিনকে পদক ও মানপত্র দেওয়ার সময় মিস্টার জুরিখ বলেন, মিস সুলতানা, ইটস অ্যান অফার ফ্রম আওয়ার সেন্টার ফর ইউ। ইউ ক্যান অ্যাপ্লাই উইথ ফুল কারিক্যুলাম ভিটা উইদিন টু উইকস। উই অলওয়েজ অনার ট্যালেন্ট। আওয়ার ডোরস আর অলওয়েজ ওপেন টু দ্য বেস্ট ট্যালেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ইফ ইউ ডিসাইড, ইউ ক্যান জয়েন আওয়ার সেন্টার। অল দ্য বেস্ট।

—থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার। আই ফিল লাকি অ্যান্ড অনার্ড অ্যান্ড ফিল প্রিভিলেজড টু হ্যাভ সাচ অ্যান অফার। স্যার, লেট মি অ্যালাউ সাম টাইম টু টক টু মাই পেরেন্টস অ্যান্ড টিচার্স। আই মাস্ট অ্যাসিওর টু ইনফর্ম ইউ ভেরি সুন। ওয়ান্স এগেন থ্যাংক ইউ অল ফর গিভিং মি সাচ অ্যান আনফরগেটেবল এক্সপেরিয়েন্স।

লাঞ্চের পর বিকেলে বিশাল টুরিস্ট বাসে কর্তৃপক্ষ ডেলিগেটদের মধ্যে যারা ইচ্ছুক তাদের নিয়ে কিছু জায়গায় বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন। পারভিনও উঠে পড়েছে বাসে খুশির আনন্দে। প্রথমে ওরা যায় সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত সি অ্যাকোয়ারিয়ামে। এই অ্যাকোয়ারিয়ামের একটি বৈশিষ্ট্য হল সমুদ্রের এক অংশের সঙ্গে সরাসরি এর যোগ থাকে। কাঁচের মধ্যে দিয়ে দর্শক সরাসরি সামুদ্রিক জীব দেখার সুযোগ পান। মোবাইল এলিভেটারের সাহায্যে টুরিস্টরা অ্যাকোয়ারিয়াম দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে পারেন। এটা একটা থ্রিলিং, একটা অদ্ভুত এক্সপেরিয়েন্স। পারভিনের মতো অতি সাধারণ বাড়ির মেয়ের কাছে এর প্রতিটিই আশ্চর্যের। পারভিন সত্যিই আনন্দ পাচ্ছিল, বিস্মিত হচ্ছিল। এরপর বাস চলল ডলফিন লেকে। সেখানে পৌঁছে পারভিনের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ডলফিনেরদল বল নিয়ে খেলা, লাফিয়ে লাফিয়ে কসরত দেখিয়ে ও দর্শকদের মনোরঞ্জন করছিল। এ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমনকি লেকের পাড়ে লাফিয়ে উঠেও কসরত দেখাচ্ছিল। একজন ট্রেন্ড মানুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মূহুর্মুহু করতালির শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছিল। পারভিনের আনন্দ আজ বাঁধনহারা। বাস চলল শেষ ইভেন্ট কভার করতে। শেষ ইভেন্ট হল সমুদ্রের তীরে লেজার শো। এই শো পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত লেজার শো। শোনা যায় এক বাঙালি এই শো’র নির্দেশক। সন্ধ্যের পর শো শুরু হল। সমুদ্রের জলের ওপরে সেই সব দৃশ্য নয়নাভিরাম। একের পর এক শো যেন বলতে চাইছে আমাকে দেখ। দর্শকদের সমস্যা কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেখে। প্রতিটি শো’ই অত্যাশ্চর্য। মন ভরে যায়। শো শেষে সবাই ফিরে এসে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়ে। পারভিন সবকিছু গুছিয়ে নেয়। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। সকালে ফ্লাইট।

আজ খুব ভোরে উঠে পড়েছে পারভিন। আনন্দে ডগমগ করছে। বেস্ট পেপারের আনন্দ, বাড়ি ফেরার আনন্দ। সব মিলিয়ে পারভিন যেন বর্ষার ময়ূরী। প্রতিটি সেকেন্ড তার কাছে এখন এক যুগ। ইউনিভার্সিটি থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার ট্রান্সপোর্ট প্রোভাইড করা হয়েছে। পারভিন আগেই ইউনিভার্সিটির দেওয়া গাড়িতে উঠে বসে। বাকিরা ধীরে ধীরে আসে। গাড়ি অল্প সময়ের মধ্যে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়। একে একে সবাই নেমে এয়ারপোর্টে ঢুকে যায়। পারভিন ও এয়ারপোর্টে ঢুকে লাগেজ স্ক্যান করিয়ে নেয়। বোর্ডিং পাস ও করিয়ে নেয়। সিকিউরিটি চেক বাকি আছে। লাউঞ্জে বসে থাকার সময় পারভিনের খেয়াল হয় যে মা বাবা, স্যার ম্যাডামের জন্য কিছু নেওয়া হয় নি। জীবনে প্রথম বিদেশ সফরে এসেছে। এক্কেবারে খালি হাতে যাবে? প্রত্যেকের জন্য লাউঞ্জ থেকে কিছু ছোটখাটো গিফট কিনে নেয়। অল্প কিছুক্ষণ পর সিকিউরিটি চেক শুরু হয়ে যায়। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। সিকিউরিটি চেকের পর পারভিন নির্দিষ্ট লাউঞ্জে গিয়ে বসে। অ্যানাউন্সমেন্ট হতে এরোব্রীজ দিয়ে প্লেনে উঠে নিজের নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পারভিন। প্লেন টেক অফ করার সঙ্গে সঙ্গে তিন দিনের বিদেশ সফরের শেকড় যেন মাটি ছাড়া হতে থাকে পারভিনের মন থেকে। এখন শুধু বাড়ির কথা, মা বাবার কথা, স্যার ম্যাডামের কথা ঘুরে ফিরে মনের মনিকোঠায় বাসা বাঁধতে থাকে। যেন সে বহু বছর বাড়ি ছাড়া এই কথা বারবার মনে হতে থাকে পারভিনের। এর মধ্যে প্লেন কখন নেতাজি সুভাষ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে গেছে পারভিন খেয়াল করে নি। সবার তাড়াহুড়োতে পারভিনের সম্বিত ফেরে। তাড়াতাড়ি নিজের লাগেজ নিয়ে নেমে আসে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখে মা বাবা, স্যার ম্যাডাম সবাই তার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। পারভিন দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মায়ের চোখেও জল। বাকিদের চোখও ছলছল করছে। তবে এ খুশির আনন্দাশ্রু। এ আকাশ ছোঁয়ার মুক্তোধারা।

0 comments: