0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১১

-‘বেলজোগার্স’- বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন।

স্মিৎজ তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেনের দিকে। তার জানতে ইচ্ছে করছিল যে মানুষটা কী ভাবছেন। অদম্য কৌতূহল হচ্ছিল তার মানুষটাকে সম্পূর্ণ জানবার জন্য। ঘন দাড়ির আড়ালে ফোলা বিবর্ণ মুখটা ঠিক কী ভাবছে। ফাঁকা দৃষ্টিটা বলতে চাইছে ‘বেলজোগার্স’… কারণ মুখটা সেভাবে নড়ছে না। মানুষটি আবার কেঁদে উঠলেন। নিঃশব্দে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল গালের উপর।

তিনি হিরো হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি হিরো হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তার ব্যাটালিয়নেই গণ্ডগোল হল, যেমন ‘ঘোড়ার নাদি’ ইত্যাদি। এই ঘোড়ার নাদির ঠেলা তাকেই সামলাতে হয়েছে। মাথায় স্টিলের হেলমেট পরতে তার ভীষণ বোকাবোকা লাগে; তিনি জানেন যে তাকে দেখতেও ভীষণ হাস্যকর লাগে হেলমেট পরে। কিন্তু সেটা পরেই তাকে যেতে হয়েছে মোটর সাইকেলে চেপে। তিনি হিরো ছিলেন না। কখনো তিনি এমন দাবি করেন নি যে তিনি একজন হিরো। তিনি জানতেন যে তিনি হিরো নন। তারপরে ফ্রন্ট লাইনের কাছাকাছি গিয়ে, যখন চেঁচিয়ে কম্যান্ড দেওয়া প্রয়োজন, তখন হেলমেট পরতে ইচ্ছে করেনি তার। তিনি হেলমেট খুলে ফেলেছিলেন ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে; হেলমেট হাতে নিয়ে ভেবেছিলেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, লাফ দাও এবার!’ বিশ্রী একটা বিপদের কাছাকাছি দাঁড়িয়েও তার এতটুকু ভয় করেনি।

দুত্তোর ছাই! সব্বাই জানতো যে ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি কিচ্ছুটি করতে পারবেন না। কারণ তাদের কাছে না ছিল যথেষ্ট অস্ত্র, না ছিল একটাও ট্যাঙ্ক। খামকা কেন তিনি চেঁচিয়েছিলেন ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে? প্রত্যেকটা অফিসার জানতো যে অনেক ট্যাঙ্ক, অনেক অস্ত্র- এসব কিছু বরাদ্দ ছিল হেডকোয়ার্টারের জন্য। হেডকোয়ার্টারের চারপাশে নিরাপদ ব্যূহ তৈরি করা হয়েছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, প্রচুর ট্যাঙ্ক এসব দিয়ে।

ধ্যাত্তেরি… তিনি যথেষ্ট জানতেন না নিজের সম্বন্ধে। তিনি তো একথাও জানতেন না যে তিনি বেশ সাহসী। তারপরে যখন তিনি পড়ে গেলেন আর তার মাথার খুলি দু ভাগ হয়ে গেল, তখন তার ভেতরে এই ‘বেলজোগার্স’ শব্দটা ছাড়া কিছুই ছিল না। ব্যস, কেবল ওই একটা শব্দ। ওই শব্দটাই তিনি বাকি জীবন কেবল বলে যাবেন। ওই শব্দটাই তার দুনিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সেটার অর্থ কী কেউ জানে না, হয়তো কোনোদিন কেউ জানবেও না।

অবশ্য তিনি তো একথাও জানেন না যে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোর্ট মার্শাল হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজেকে আহত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চড়া অবস্থায় নিজের হেলমেট খুলে ফেলেছিলেন। মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না; জানবেনও না কোনোদিন। তাড়া তাড়া কাগজ, কেসের ফাইল নাম্বার, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রিপোর্ট, অভিযোগ, তার মেডিক্যাল কেস হিস্ট্রি– এসব কোনো কিছুই তিনি পড়বেন না। এসবের কোনো অর্থ এখন তার কাছে নেই। তিনি কেবল পঞ্চাশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর বলে যাবেন… ‘বেলজোগার্স’।

স্মিৎজ একদৃষ্টে চেয়েছিলেন তার দিকে। তিনি নিজেই পাগলের মত উৎসুক হয়ে উঠছিলেন একথা জানবার জন্য যে মানুষটির মস্তিষ্কে এখন কী ঘটে চলেছে। আবার একই সঙ্গে মানুষটিকে কিছুটা হিংসে হচ্ছিলো তার। কারণ চারপাশের কোনো কিছুই এই মানুষটিকে স্পর্শ করছে না; শুধুই একটি শব্দের ধ্যানে তিনি বুঁদ হয়ে আছেন।

হঠাৎ শ্নাইডার এসে দরজা খুলে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে স্মিৎজ চমকে উঠলেন।

-‘কী হল?’

-‘ওরা আসছে।’ বলে উঠল শ্নাইডার… ‘আসছে বলি কেন? প্রায় এসেই গেছে। আমাদের দিক থেকে কোনো সৈন্য যায়নি বাধা দিতে।’

স্মিৎজ প্রথমে শুনতে পাচ্ছিলেন না কিছু। এখন শুনতে পাচ্ছেন। ওরা এসে গেছে। বাম দিক থেকে আওয়াজ আসছে। ট্রাক ড্রাইভারের কথার অর্থ বুঝতে পারলেন তিনি এখন। লোকটা বলেছিল… ‘শোনা যায়, কিন্তু দেখা যায় না।’

-‘পতাকাটা’… বলে উঠলেন স্মিৎজ… ‘রেড ক্রসের পতাকাটা টাঙ্গিয়ে দিলে হয়… একটা শেষ চেষ্টা আর কি!’

-‘হ্যাঁ, এখনো সময় আছে।’

-‘এই যে, এখানে আছে।’… স্মিৎজ টেবিলের উপরে রাখা স্যুটকেসের একদম নিচ থেকে টেনে বের করলেন ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরোটা। শ্নাইডার সেটা হাতে নিয়ে বলল… ‘যাওয়া যাক।’

অস্থিরতা গ্রাস করে নিয়েছিল দুটি মানুষকে; শ্নাইডার জানালা দিয়ে একবার নিজের মুণ্ডু বাড়িয়ে দেখতে গেল এবং পরমুহূর্তে সরে এল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। ‘ওরা খুব কাছে এসে গেছে’… তার গলা কেঁপে গেল… ‘বাঁধের কাছেই…’

-‘আমি যাচ্ছি। আমি গিয়ে ওদের মুখোমুখি হতে চাই।’ স্মিৎজের কথার মাঝখানে মাথা নাড়তে শুরু করলো শ্নাইডার এবং মাথার উপরে পতাকাটা তুলে ধরে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

সে সোজা হাঁটতে লাগলো বাঁধের দিকে। চারদিক থমথম করছে। ট্যাঙ্কদুটো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে জনপদের শেষ সীমানায়। রেলস্টেশনের আগে স্কুলবাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ট্যাঙ্কের কামানের নলগুলো বাড়িটার দিকে ফেরানো আছে। কিন্তু শ্নাইডার ওদের দেখতে পায়নি। সে কোনোকিছুই দেখতে পায়নি। পেটের সামনে হাস্যকরভাবে পতাকাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সে। এমনভাবে হাঁটছে যেন কুচকাওয়াজ করছে। সে কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। কিছুই দেখছে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে তার শরীরের রক্তের ভিতরে একটা ভয় পাক খাচ্ছে। সে ভয় পাচ্ছে।

শ্নাইডার সোজা হেঁটে যাচ্ছে পেটের সামনে রেড ক্রসের পতাকাটা ধরে। পুতুলের মত কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল সে। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। আবার উঠে দাঁড়ালো।

গাছের ডালপালাগুলো সাজিয়ে লতানে গাছের মাচা তৈরি হয়েছিল বাগানে। সেই মাচার ডালপালা আটকানোর জন্য একটা তার মাচাটার কাঠামো থেকে বেরিয়ে ছিল কিছুটা। সেই তারে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছিল শ্নাইডার। সে উঠে দাঁড়ালো। এখন সে দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। দুটো ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে ছিল বাঁধের পেছনে। তার ঠিক সামনের ট্যাঙ্কটা ধীরে ধীরে কামানের নলটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বাগানের গাছপালার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পেল মাত্র দুটো নয়, অজস্র ট্যাঙ্ক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। একটার পেছনে আরেকটা লাইন করে দাঁড়ানো মাঠের মধ্যে। ট্যাঙ্কগুলোর গায়ে লাগানো লাল তারাগুলো দেখে অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর মনে হল তার। সে আগে কোনোদিন দেখেনি এই লাল তারা। জঞ্জালের স্তুপ, পুকুর, পরিত্যক্ত হাসপাতালের বেডগুলি, নার্সারি, ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে বাঁধ… সে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু না, জঞ্জালের স্তুপের আর পুকুরের মাঝখানে সে থমকে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো। আগের চেয়ে অনেক বেশি এবার।

সে জানেনা আসলে ভয়ের চেহারাটা ঠিক কেমন হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল যে তার রক্ত জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে, হয়তো ভয় ব্যাপারটা এভাবেই ছড়াতে থাকে শরীরে। সে বুঝতে পারছিল না। এখন তার রক্তে যেন আগুন ধরে যাচ্ছে। সে চারদিকে লাল রঙ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বিশাল লাল রঙের তারাগুলো যেন তাকে গিলে নেবে এখনই। সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে পা দিল সেই গাছের শুকনো ডালের মত দেখতে বহুদিন আগের যুদ্ধের পুরনো বোমার আধভাঙা টুকরোটার উপরে। সেই টুকরোটা বিস্ফোরণে ফেটে পড়লো।

প্রথমে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। থমথমে নৈঃশব্দের মাঝে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দটা প্রচণ্ড অভিঘাত সৃষ্টি করলো। রাশিয়ান সেনারা শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছিল যে ওই আগ্নেয়াস্ত্র, অর্থাৎ বোমাটা তাদের দিক থেকে ছোঁড়া হয়নি। তারা শুধু দেখতে পেয়েছিল যে পতাকা হাতে করে হেঁটে আসা মানুষটা হঠাৎ একটা ধুলোর মেঘের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

বিস্ফোরণের পরে বেশ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ ছিল। তারপরেই রাশিয়ান সেনারা ঢুকে গেল সোজা সেনাছাউনির বিল্ডিংএ। পাগলের মত একটানা গোলাবর্ষণ শুরু করলো তারা। প্রথমে দক্ষিণের বিল্ডিং, তারপরে উত্তরের বাড়িটায়, যেখানে কেয়ারটেকার কাস্তেহাতুড়ি নকশা আঁকা ছোট লাল পতাকাটা উড়িয়ে দিয়েছিল।

পতাকাটা বাড়িগুলোর থেকে ভেঙে পড়া ধুলো ময়লার মধ্যে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তারপর সেনারা আবার দক্ষিণের বাড়িটায় সমান তালে গোলাবর্ষণ করতে লাগল। সাঙ্ঘাতিক ভাবে বহুক্ষণ ধরে গোলা ছুঁড়ে গেল তারা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বাড়িগুলোর দুর্বল দেওয়াল একদম গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা খেয়াল করলো যে অপর পক্ষ থেকে এতক্ষণে একটা গুলিও এসে কোনো উত্তর দেয় নি।

(চলবে)






ReplyForward











0 comments: