পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে
Posted in পথে প্রবাসেটোটো-কোম্পানি
আমার ভারতবর্ষ- ৭
লখনউ: ইয়েহ শহর লালদার হ্যাঁয়
আবদুল হালিম শরর প্রণীত ''মশরিকী তমদ্দুন কা আখরি নমুনা ইয়া গুজিস্তা লখনউ' পড়ে বাঙালিরা নবাবি লখনউ'কে অনেক বেশি জানতে পেরেছে। যদিও অওয়ধের নবাবি উত্তরাধিকার ওয়জিদ আলি শাহের সঙ্গে শেষ হয়েছিলো মোকাম কলকাতার মাটিতে। কিন্তু এখানকার লোকেদের জন্য মেটেবুরুজের নবাব অচেনাই থেকে গিয়েছিলেন। অচেনা থেকে গিয়েছিলো লখনউভি তহজিবের কায়দাকানুন।
ছোটোবেলায় যখন প্রথম লখনউ গিয়েছিলুম যে ব্যাপারটা সব চেয়ে বেশি করে মনে থেকে গিয়েছিলো সেটা হলো লখনউভি তহজিব। সেখানে দেখা সাধারণ রিকশা চালকদের বোলি, অর্থাৎ মুখের ভাষা এবং তহজিব বা শিষ্টাচার আমরা দেশের এই প্রান্তে তথাকথিত 'শিক্ষিত, ভদ্রলোক' দের মধ্যেও কমই দেখেছি। সমাজের নিম্নতম বর্গের মানুষের স্বভাবেও এই পর্যায়ের মার্জিত রুচির কৃষি সুলভ দেখা যেতো। এই ব্যাপারটা আমাকে প্রথম লখনউ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে।
যদিও পরবর্তীকালে দেখেছি ধীরে ধীরে সেই সূক্ষ্ম পরিমার্জনা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন বাহরাইচ আর এটাওয়া জেলা থেকে আগত রুক্ষ কৃষি শ্রমিকদের প্লাবন লখনউ শহরের বাস্তবিকতা বদলে দিয়েছে। নিকট অতীতে দেখেছি অবস্থা অনেক বেশি শোচনীয় হয়েছে। গোরখপুরি 'লঠ-মার' কলচর অর্থাৎ জঙ্গলরাজের বোলবালা থেকে নবাবি লখনউয়ের তহজিব বহু যোজন দূরে।
আকবর বাদশাহ তাঁর রাজত্বকে বারোটি সুবাহতে ভাগ করেছিলেন ষোলো শতকের শেষদিকে। অওরঙ্গজেব পর্যন্ত আসতে আসতে তার সংখ্যা হয়ে যায় বাইশ। তার মধ্যে চারটি আছে সমকালীন পাকিস্তানের ঠিকানায় । বাকি আঠেরোটির মধ্যে নানা কারণে তিনটি সুবাহ ছিলো একটু আলাদা। এই সুবাহগুলোর নবাবদের মধ্যে কয়েকটি সমতা চোখে পড়ে। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে তাঁদের শিকড় ছিলো ইরানি সভ্যতায়। দেবগিরির ব্রাহ্মণ সন্তান সূর্যনারায়ণ মিশ্রকে দশ বছর বয়সে দাস হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন ইরানি রাজপুরুষ হাজি শফি। ধর্ম পরিবর্তনের পর তাঁর নাম হয় মহম্মদ হাদী। হাজি শফি বাদশাহ অওরঙ্গজেবের চাকরি ছেড়ে ইরানে ফিরে যান। সঙ্গে নিয়ে যান মহম্মদ হাদীকে। হাজি শফির মৃত্যুর পর হাদী আবার হিন্দুস্তানে ফিরে আসেন। শিক্ষানবীশ ছিলেন বিদর্ভ সুবাহের দেওয়ান আবদুল্লাহ খুরাসানির অধীনে। পরবর্তীকালে তাঁকে আমরা চিনবো মুর্শিদকুলি জাফর খান হিসেবে। সুবাহ বঙ্গালের দুর্ধর্ষ নবাব।
কুলি কুতব বেঘ ছিলেন ইরানের হামাদান থেকে আসা একজন ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা। সময়ের ফেরে তাঁকে আমরা দেখতে পাই সুলতান কুলি কুতব শাহ নামে গোলকোণ্ডা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ফিরে আসতে। বাদশা অওরেঙ্গজেব পর্যন্ত তাঁরা স্বাধীন সুলতান ছিলেন। ১৬৮৭ সালে মুঘলরা গোলকোন্ডা দখল করে নেয়। তার পর নিজামের রাজত্ব।
তৃতীয়জন ছিলেন মীর মহম্মদ আমীন। ইরানের নিশাপুর থেকে হিন্দুস্তানে ভাগ্যান্বেষণে আসা একজন তরুণ যোদ্ধা। পরবর্তীকালে তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছিলো নওয়াব সাদত খান। লখনউয়ে অওধ শাহীর প্রতিষ্ঠাতা ।
সুবাহ বঙ্গাল, সুবাহ গোলকোন্ডা এবং সুবাহ অওধের রাজবংশ ছিলো ইরানি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অঙ্গ। মুঘল হিন্দুস্তানের অতি প্রতাপশালী সুন্নি তুর্কি রাজশক্তির থেকে আলাদা শিয়া গোষ্ঠীর মানুষ। ভারত ইতিহাস এবং সংস্কৃতির একজন ইতর সন্ধানী হিসেবে আমি এই তিন সুবাহের প্রতি চিরকালই অধিক আগ্রহী। ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসা বেশ প্রবল। যদিও মধ্যযুগ মানেই রক্তাক্ত অন্ধযুগের কাহিনী। তবু সুমার্জিত পারস্য সভ্যতার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিলো এই সব রাজাদের শাসন ব্যবস্থায়। নিজে বাঙালি হিসেবে হয়তো সুবাহ বঙ্গালের ব্যাপারস্যাপার জানার সুযোগ বেশি ঘটেছে। আবার দীর্ঘকাল গোলকোন্ডা সংস্কৃতির দেশে বসবাসের সূত্রে তাঁদের ঐতিহ্যের ভিত্তিগুলিও কিছুটা জানা হয়ে গেছে। যদিও সে অর্থে সুবাহ অওধে আমি বাস করিনি কখনও, কিন্তু দীর্ঘ চর্চা ও আসাযাওয়া থেকে তাঁদের সাংস্কৃতিক মানচিত্রটি খুব একটা অচেনাও থেকে যায়নি।
লখনউ বেড়াতে গিয়ে লোকে কী দেখবে? দেখবে বড়া আর ছোটা ইমামবাড়া, তার চত্বরে ছড়িয়ে থাকা ঘড়িমিনার, রুমি দরওয়াজা, সাতখন্ডা। দেখবে ছত্তর মঞ্জিল, রেসিডেন্সি, শাহ নজফ ইমামবাড়া, সাদত আলি খান সমাধি, জামা মসজিদ, লা মার্টিনিয়ার, এক রাশ নতুন বাগ-বাগিচা। দেখবে লখনউয়ের বিখ্যাত বাজারগুলো, হজরতগঞ্জ, আমিনাবাদ, চওক।
লখনউ সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হবে, 'নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম'। এতো সংক্ষেপে শুধু ইশারাই চলে। তবে কথায় আছে না, 'সমঝদার কে লিয়ে ইশারা হি কাফি', সেটাই ভরসা। শেষে লখনউকে নিয়ে কবির দুই ছত্র মুগ্ধতাও থাক,
'... ইয়েহ শহর লালদার হ্যাঁয়, য়ঁহা দিলোঁ মেঁ প্যার হ্যাঁয়
জিধর নজর উঠাইয়ে, বহার হি বহার হ্যাঁয়
কলি কলি হ্যাঁয় নাজনীঁ, ইয়েহ লখনউ কি সর-জঁমী...'
(শকীল বদায়ুনি)
0 comments: