0

প্রবন্ধ - সুবল দত্ত

Posted in




















ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইন্টুইশন

আমরা সবাই জানি ‘থট রিডিং’-এর কথা। লুকোনো গুপ্ত সংখ্যা অনায়াসে কেউ কেউ বলে দেয়। কিংবা লটারির প্যাকেট থেকে কেউ একটা কাগজ বের করে দেয় যেটা থেকে অবশ্যই কারো প্রাপ্তি হয়ই। এইরকম রেস কোর্সে গবেষণাগারে জীবনযাপনে কোনো জটিল সমস্যায় বিপদের ঠিক আগের মুহূর্তে অসংখ্য উদাহরণ আমাদের জীবনে পরিবেশে সমাজে ছড়িয়ে রয়েছে। এইরকম স্থিতিতে চট জলদি কারো কারো ব্রেন সক্রিয় সিগন্যাল পায় যার নাম অন্তর্জ্ঞান বা ইন্টুইশন।

অন্তর্দৃষ্টি হল, বাস্তব প্রমাণ বা সচেতন যুক্তি ছাড়া অন্তরের অনুভূতি দিয়ে কোনো বিশেষ জ্ঞান যা মস্তিষ্ক থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে এবং তার অর্জনের ক্ষমতা। বিভিন্ন জ্ঞানী একে অন্তর্দৃষ্টি বলেন আর এই শব্দটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন,যেমন অজ্ঞাত জ্ঞান, অভ্যন্তরীণ অনুভূতি,সচেতন যুক্তির প্রয়োজন ছাড়াই সহজাত কিছু বোঝার ক্ষমতা ইত্যাদি।

অনেকে মনে করেন অন্তর্দৃষ্টি কেবল অনুমানের একটি রূপ। আসলে কিন্তু এটা অনেক বেশি গভীর তত্ত্বের বিষয়। কিছু গবেষক বলেছেন যে এটি হলো সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার রূপ। পাশ্চাত্য দেশে প্রায়শই এটিকে লোকে gut feeling বলে। আসলে যখনই এমন কোনো সমস্যা আসে তখন বিচার বুদ্ধি কাজে আসেনা এবং তখনই সেটার সমাধান চাই, সেসময় কখনো কখনো কারোর মাথায় দ্রুত এই নির্দেশটি আসে। এই অন্তর্দৃষ্টি আমাদের এক অতিসূক্ষ্ম সতর্কতা প্রদান করে। অবশ্য কবি শিল্পীদেরও ইন্টুইটিভ বলা যায়। মোটকথা হঠাৎ করে ভাবের বশে করে দেওয়ার পর যখন সেটা আশাতীত ভাবে ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়,তখন সে নিজে নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়, এটা আমি কি করে করলাম? এইকথা তো আমি ভেবে করিনি?

অন্তর্দৃষ্টি শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ক্রিয়া intueri থেকে যার অর্থ বিবেচনা।কিংবা ইংরেজী শব্দ intuit থেকে মানে চিন্তা করা।

দর্শনের পদ্ধতি এবং সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান বা গণিতের মধ্যে গুণগত পার্থক্য নেই। মেটাফিলোসফিক্যাল ধারণা যে দর্শনের উপর নির্ভর করে অন্তর্দৃষ্টিও তাই। টিমোথি উইলিয়ামসন যুক্তি দিয়েছিলেন যে দর্শন চর্চায় অন্তর্দৃষ্টি কোন বিশেষ ভূমিকা পালন করে না, এবং অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে সংশয়কে অর্থপূর্ণভাবে বিচার সম্পর্কে সাধারণ সন্দেহ থেকে আলাদা করা যায় না।



আধুনিক মনস্তত্ত্ব :

সম্প্রতি মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, অন্তর্দৃষ্টি হল সমস্যাগুলির বৈধ সমাধানের তাত্ক্ষনিক ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ রিকগনিশন প্রাইমড ডিসিশন (RPD) মডেল ব্যাখ্যা করে, কেমন করে মানুষ বিচার বিশ্লেষণ না করে অপেক্ষাকৃত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বজ্ঞাতভাবে সম্ভাব্য সমাধানগুলি বেছে নেওয়ার একটি পরীক্ষা। RPD মডেলটি অন্তর্দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণের মিশ্রণ। অন্তর্দৃষ্টি হল প্যাটার্নমিলে যাওয়া প্রক্রিয়া, যা দ্রুত একশনের পরামর্শ দেয়। বিশ্লেষণ হল মানসিক অনুকরণ, একশনগুলির একটি সচেতন এবং ইচ্ছাকৃত পর্যালোচনা। ভাবনার প্রবৃত্তিকে প্রায়ই অন্তর্দৃষ্টি হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। নতুন মানব সমাজে অন্তর্দৃষ্টি ক্রমবর্ধমান মূল্যবান হয়ে উঠছে কারণ মনের অনেক তথ্য জানতে পারছি ও জানার আছে। গণিতের দর্শনে ক্যান্টের দাবী,সমস্ত গাণিতিক জ্ঞান অন্তর্দৃষ্টির বিশুদ্ধ রূপ। 1916 সালে ‘সাইকোলজিক্যাল টাইপস’-এ কার্ল জং-এর তত্ত্ব বলে, অন্তর্দৃষ্টি হল ব্রেনের একটি যুক্তিহীন ফাংশন আর চিন্তা ও অনুভূতি হল ব্রেনের যুক্তিসঙ্গত ফাংশন। জং অন্তর্দৃষ্টিকে এক অজানা উপলব্ধি বলে মনে করেন। জং বলেন যে, একজন মানুষ যার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি প্রভাবশালী, তার ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের একটি নির্দেশ যুক্তিসঙ্গত বিচারের ভিত্তিতে নয়, বরং নিবিড় উপলব্ধিতে কাজ করে। বহির্মুখী স্বজ্ঞাত নির্দেশ আশাব্যঞ্জক একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে যায়,পরিবর্তনের নিরন্তর সাধনা।


অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কে কেমন কথা বলেছেন :

শ্রী অরবিন্দ মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি বর্ণনা করেন। মনের প্রকৃতি দুরকম স্বেচ্ছাচারী স্বভাবের। প্রথমটি মানসিক অভিজ্ঞতার ছাপ রাখে যা সংবেদনশীল তথ্যের মাধ্যমে তৈরি হয় (মন বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন হতে চায়)। দ্বিতীয় প্রকৃতি হচ্ছে ক্রিয়া যখন এটি নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে চায়, ফলে মানুষ তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, রাগ দ্বেষ এবং অন্যান্য আবেগ সম্পর্কে সচেতন হয়। তিনি এই দ্বিতীয় স্বভাবকে পরিচয় দিয়ে জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, বর্তমানে ক্রমবিবর্তনের ফলে এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সংস্পর্শে মন অভ্যন্তরীণ শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের প্রতিক্রিয়াগুলিকে বাইরের বস্তুগত জগতের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিক উপায় হিসাবে নির্ভর করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ, যখন আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে চাই তখন আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের কাছে যা পৌঁছে দেয় তাকেই আমরা সত্য মনে করি। শ্রী অরবিন্দের মতে অন্তর্দৃষ্টি বা স্বজ্ঞান আত্মজ্ঞানের দ্বারাই জ্ঞানের ক্ষেত্রের অধীনে আসে। আত্মজ্ঞানের পরিচয় দ্বারা জ্ঞান আরও বিস্তৃত করা যায় যার ফলে স্বজ্ঞাত জ্ঞান পাওয়া যায়।

ওশোর মতে, মানুষের উত্তরণ মৌলিক জান্তব প্রবৃত্তি (natural animal instinct) থেকে তার বুদ্ধিতে হয়, ক্রমে অন্তর্দৃষ্টিতে এবং ক্রমান্বয়ে সে চেতনায় ওঠে। মানুষ ক্রমাগত সেই সচেতন অবস্থায় উঠে বাস করতে চায়। অন্তর্দৃষ্টি অবস্থায় আসা মানবতার চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি।

বৌদ্ধধর্মে আছে, তাত্ক্ষণিক জ্ঞানের মধ্যেই মন অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পায়। সচেতন চিন্তার প্রক্রিয়ার বাইরে অন্তর্দৃষ্টি থাকে, কারণ সচেতন হয়ে অচেতন তথ্য অ্যাক্সেস করতে পারে না। জেনবৌদ্ধ ধর্মে মানুষের স্বজ্ঞাত ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করার জন্য অনেক পদ্ধতি আছে, যেমন কোয়ান—যার সমাধানের ফলে ক্ষুদ্র জ্ঞানলাভের অবস্থা হয় (সাটোরি) ।

ইসলামে বিভিন্ন পণ্ডিত রয়েছে যারা অন্তর্দৃষ্টির কথা বলেন। অন্তর্দৃষ্টিকে প্রায়ই হাদাস (আরবি: حدس) বলা হয়। কখনও কখনও স্বজ্ঞাত জ্ঞান থাকার ক্ষমতা সম্পর্কিত কথা বলা হয়। সিহাব আল দীন-আল সোহরাওয়াদী তাঁর বই Philosophy Of Illumination (ইশরাক)এ বলেছেন যে, অন্তর্দৃষ্টি এক রহস্যময় জ্ঞান এবং রহস্যময় মনন (মুশাহাদা)। ইবনে সানি অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতাকে ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা বলেন। এবং এটি যে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্জন করা হয় না তাও তিনি বলেন। নিয়মিত জ্ঞান কেবল অনুকরণের উপর ভিত্তি করে হয়, কিন্তুস্বজ্ঞাত জ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতার উপর ভিত্তি করে হয়।

ওয়েস্টার্ন ফিলসফিতে প্লেটো প্রথমে অন্তর্দৃষ্টির কথা বলেছেন। তাঁর প্রজাতন্ত্র বইয়ে তিনি বাস্তবতার প্রকৃতি বোঝানোর জন্য মানুষের যুক্তির মৌলিক ক্ষমতা হিসেবে অন্তর্দৃষ্টিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। মেনো এবং ফেডো রচনায় তিনি অন্তর্দৃষ্টিকে পরমাত্মার মধ্যে বসবাসকারী একটি পূর্ব-বিদ্যমান জ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন অন্তর্জ্ঞান এমন একটি ঘটনা যা কেউ স্থূল জ্ঞান দিয়ে বা সচেতন হয়ে পায় না। তিনি গাণিতিক সত্যের একটি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে সেগুলি যুক্তি দ্বারা আসে না। প্লেটোর এই ধারণাটিকে কখনও কখনও অ্যানামনেসিস বলা হয়।

আলবার্ট আইনস্টাইন যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত। আপেক্ষিকতাবাদের জন্য সর্বাধিক পরিচিত, আলোকবিদ্যার প্রভাব ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপেয়েছেন তিনি বলেছেন, “প্রজ্ঞাবান মানুষের একমাত্র আসল সম্পদ হল অন্তর্দৃষ্টি।”

ডেসকার্টস তাঁর বই মেডিটেশনস অন ফার্স্ট ফিলোসফিতে, অন্তর্দৃষ্টিকে যুক্তিসঙ্গত যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত একটি প্রাক-বিদ্যমান জ্ঞান এবং মননের মাধ্যমে একটি সত্য আবিষ্কার বলেছেন। হিউম অন্তর্দৃষ্টিকে সময়, স্থান এবং কার্যকারণের সম্পর্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ইমানুয়েল কান্ট (জার্মান দার্শনিক) মনে করেন যে আমাদের মন আমাদের সমস্ত বাহ্যিক জ্ঞানকে স্থান আকারে এবং আমাদের সমস্ত অভ্যন্তরীণ অন্তর্দৃষ্টি (স্মৃতি, চিন্তা) সময়ের আকারে আমাদের সামনে প্রস্তুত করে। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি এবং ধারণাগুলি সমস্তই জ্ঞানের উপাদান। বিখ্যাত ইংরেজ কবি, পণ্ডিত এবং উপন্যাসিক রবার্ট গ্রেভস বলেন,অন্তর্দৃষ্টি হল সুপার-লজিক যা চিন্তার সমস্ত রুটিন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে এবং সমস্যা থেকে সরাসরি উত্তরে উঠে আসে। প্রাচীন চীনা দার্শনিক লাও তু বলেন, কারো ভিতরের Intuition বা স্বজ্ঞাত শক্তি তাকে তার শেষের দিন অব্দি যে কোনো ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অ্যান উইলসন শেফ একজন স্বনামধন্য লেখক বলেন, আমাদের অন্তর্দৃষ্টিতে বিশ্বাস করা উচিত কারণ প্রায়ই আমাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। একজন আমেরিকান অভিনেত্রী মনে করেন যে মহিলাদের একটি সহজাত স্বজ্ঞাত ক্ষমতা আছে এবং তারা পুরুষদের চেয়ে বেশি স্বজ্ঞাত।


অন্তর্জ্ঞান সিদ্ধান্ত কি?

যার অন্তর্জ্ঞান সক্রিয়, সে কীভাবে এবং কোথা থেকে মাথায় আসে তা না জেনেই অন্তর্দৃষ্টির ধারণাগুলি বলে দিতে পারে। সে বুঝতে পারে না কিকরে এটি নিজের থেকে সতঃস্ফুর্ত ভাবে মনের মধ্যে আসে। যখন কেউ আনন্দে থাকে কোনও দুশ্চিন্তা থাকে না এবং নিজের কাজে অত্যন্ত মনোযোগী হয় তখন সৃজনশীলতার মতোই স্বজ্ঞাত আসে। অন্তর্দৃষ্টি প্র্যাকটিস করা যায়। এবং এটি একটি প্রক্রিয়া যা সাধারণত চ্যানেলিং নামে পরিচিত।

আমাদের অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ছোটোখাটো ঘটনা আসেই যখন যুক্তিসঙ্গত যুক্তি প্রয়োগ করা খুব কঠিনহয়, যেখানে স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ আপনা আপনিই হয়ে যায়,এবং আমরা সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিই। উদাহরণ স্বরূপ, যেখানে অন্তর্দৃষ্টি সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যায়,সেগুলি হল জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা, কেনার জন্য সঠিক গাড়ি নির্বাচন করা, চাকরির মূল্যায়ন, শিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত, বাইরে খাওয়ার সময় খাবার নির্বাচন করা, পড়ার জন্য পরবর্তী বই নির্বাচন করা ইত্যাদি।

স্বজ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করার চেয়ে অনেক বেশি তাত্ক্ষনিক, কারণ এটি ব্রেনের অতিরিক্ত অনুভুতি কেন্দ্রকে সক্রিয় করে এবং বাইরে থেকে তথ্য সম্পর্কে সচেতন করে। একে গাট ফিলিংগ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, অতীন্দ্রিয়, অন্তর্দৃষ্টি অভ্যন্তরীণ কণ্ঠ, আধ্যাত্মিক নির্দেশ, ইত্যাদি নানা ধরনের লোক নানা নামে বলে। এই অনুভুতি কেন্দ্রগুলিকে ট্রেনিং এর জন্য এবং স্বজ্ঞাতভাবে তথ্য গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে আরও সচেতন করার জন্য আজকাল দেশে বিদেশে উচ্চতর চেতনা বিকাশের প্রচুর কেন্দ্র আছে। যারা এই ধরনের সেন্সরের অস্তিত্ব মানেন না তারা ‘আই কিউ’ বাড়ানোর জন্য সেই একই ট্রেনিং নিতে যান।


বিজ্ঞানের ভাষায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় :

কখনো কখনো হঠাৎ মাথায় কিছু বিশেষ বিচার বা জরুরী সিদ্ধান্ত আসে, তখন মনের দোটানায় হালকা পেটের ভিতর কিছু হয়, মাথা ঝিমঝিম করতে পারে, বুক ধকধক করতে পারে বা ঘাম হতে পারে। পরে সেটা একেবারেই সঠিক হতে দেখে মনে হয় এটা কি করে বললাম? এটাই আসলে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নির্দেশ। আগে থেকে পেটের ভিতর জানান দেওয়াটাকে হয়তো তাই বিদেশীরা gut feeling আখ্যা দিয়েছে।কখনো কখনো আমরা অধ্যাত্মিক কৃপার দোহাই দিয়ে থাকি,কিন্তু এই ঘটনা বিজ্ঞান সম্মত,এবং তা প্রমানিত হতে চলেছে। একে এখন সর্বসাধারণ ইন্টূইশন বলে জানে। মনের ভিতর থেকে স্বতষ্ফুর্ত এই আদেশ বা নির্দেশ হিত অহিত দুইই হতে পারে।

এখন বিদেশে ভবিষ্যৎ মননের পরীক্ষাগারে (future minds lab) রিসার্চ চলছে। কয়েকবছর আগে ইউনিভার্সিটি অফ সাইকোলজিস্ট এন্ড নিউরোসায়েন্টিষ্ট (UNSW) এর প্রফেসর জোয়েল পিয়ারসন একটি রিসার্চ জার্নাল পেপার পড়ার সময় এক অদ্ভুত অনুভূতির কথা বলেন। কাগজটি হাতে নিয়েই তাঁর এক অদ্ভুত অনুভুতি হলো। তিনি একটুও পেপারটা পড়েননি, তার ভিতরে বিষয় বস্তু কি সেটাও জানতেন না,কিন্তু তাঁর মনে হলো এর ভিতরে কিছু ভুল তথ্য নিশ্চয়ই আছে। গবেষণায় নিশ্চয় কিছু ত্রুটি রয়েছে যাতে ভুল তথ্য এই জার্নালের মধ্যে আছে। এবং পড়ে দেখলেন সেটাই একদম ঠিক। UNSW এর ফিউচার মাইন্ডস ল্যাবে সাতটি ছোট ছোটো ঘরে কম্পিউটারের স্ক্রিন ও মনস্তত্ত্ব এবং নিউরোসায়েন্সের পাঠ্যপুস্তকগুলি রয়েছে। ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক পিয়ারসন এবং সহ গবেষক গ্যালাং লুফিয়ান্তো এবং ক্রিস ডনকিন ইন্টুইশনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য গবেষণা পরিচালনা করেন। ওনারা এখানে প্রায় দুহাজার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অন্তর্দৃষ্টির সংজ্ঞা দিলেন, “যুক্তিসঙ্গত, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা বা অনুমান ছাড়াই সফল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা”।তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তথ্য পরিমাপের পর এই সংজ্ঞা দিয়েছেন।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা অন্তর্দৃষ্টি বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভব পেতে সাহায্য করতে পারে। মনে করুন এমন এক রেষ্টুরেন্টে ঢুকলেন যেটাতে কখনো আসেননি। ঢোকার আগেই আমাদের সচেতনতা ছাড়া, আমাদের মস্তিষ্কে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, নোংরা মেঝে, টেবিলে নকল ফুল, একটি আঁশটে গন্ধ। এই তথ্যগুলি হয়তো অতীতের কোনো অভিজ্ঞতাগুলির সাথে জুড়ে দেয় ব্রেন। নোংরা মেঝে, নকল ফুল,অদ্ভুত গন্ধ খারাপ খাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমরা সচেতনভাবে এর কোনটিই উপলব্ধি করি না। কিন্তু আমরা যা বুঝি তা হলো হঠাৎ একটা শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি, না, আমাদের এখানে খাওয়া উচিত নয়।

অন্তর্দৃষ্টি দ্রুত কাজ করে। রেস্তোরাঁর দরজা খোলার আগেই বুঝে যাই এখানে নয়। এবং এটি শারীরিক ভাবে হয়। আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে অসুস্থ বোধ করি, অথবা আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, অথবা আমরা ঘামতে শুরু করি। এইজন্যেই এটিকে gut feeling বলা হয়।

Intuition বা অন্তর্দৃষ্টিকে আমরা ধর্মের সাথে বা আধ্যাত্মিকতার সাথে জুড়ে দিই, কখনো বা আমরা সেকেলে প্রাচীন ধারণা আখ্যা দিয়ে থাকি, কিন্তু এটা ঠিক এই ঘটনা প্রায় প্রত্যেকের জীবনের সাথে জড়িত। এটি এমন একটি অনুভূতি যা আমরা স্বপনে জাগরণে মাঝে মাঝেই পাই। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ করে, একটি বিশেষ সিদ্ধান্তের সময়ে রহস্যময় আবেগের আকারে আসে। যেমন,এই অন্ধকার পথে আমার যাওয়া উচিত নয়, কিছু বিপদ নিশ্চয়ই হবে। এবং তা হয়ও। এই লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারি। এইরকম অনেক কিছু।অধিকাংশ মানুষ অন্তর্দৃষ্টি ধারণা গ্রহণ করে। তা সত্ত্বেও, তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুব একটা ছিল না। এই অন্তর্দৃষ্টি ধারণার একটি মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেছিলেন ডক্টর পিয়ারসন। তাঁর গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে কয়েকটি বিন্দুর মুভমেন্ট দেখে তাদের দিক নির্ণয় করতে বলা হয়েছিল, একই সাথে কয়েকটি পজিটিভ বা নেগেটিভ ছবি দেখতে হবে (যেমন,ছোটো শিশু ও কুকুরছানার ছবি পজিটিভ, আর, বন্দুক ও সাপের চিত্র নেগেটিভ)। ছবিগুলি বারবার ফ্ল্যাশ করা হচ্ছিল যাতে সে ছবিগুলি সচেতন ভাবে না দেখে। বৈজ্ঞানিক পিয়ারসন তাদের নির্দেশ দিতেন যে ওই ছবি বা স্পট যেন কেবল দেখতে থাকে, কিন্তু একেবারেই সচেতন ভাবে যেন না দেখে। যারা ছবিগুলো দেখছেন তাদের সচেতন ভাবে কিছু করার নেই। বিন্দুগুলির মুভমেণ্ট ডানদিকে হচ্ছিল যখন পজিটিভ ছবি ফ্লাশ করা হচ্ছিল এবং বাঁ দিকে ওই বিন্দুগুলি সরছিল তখন নেগেটিভ ছবি ফ্লাশ করছিল। ঘটনাটি দ্রুত ছিল এবং কখন বিন্দু বাঁ দিকে সরবে বা ডানদিকে এটার সিদ্ধান্ত এত দ্রুত ছিল যে তখন ব্রেনকে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে হতো। ওই ছবিগুলি রেটিনাতে পড়ছিল ও ব্রেনের অ্যামিগডালাতে প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল।

অবশ্য পড়ে ব্রেন স্ক্যানিংএর পরীক্ষা নিরীক্ষাতে অনেক বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, মানুষের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতার ছবি নেওয়া এবং তার বিশ্লেষণ করা যায়, সচেতন অবস্থায় ও অজ্ঞান অবস্থায় দু ভাবেই। অজ্ঞান অবস্থায় ব্রেনের যে চিত্র,মানে, সংবেদনশীল ছাপ,তার সাথে আগের সঞ্চিত চিত্রগুলির সাথে তুলনা করা হয়। সেসবেরও ছবি নেওয়া যায়। আমাদের সবার জীবনের অভিজ্ঞতা ব্রেনের মেমোরি সেন্টারে সঞ্চিত থাকে,যা আমাদের জীবনে আগে ঘটেছে তার উপর ভিত্তি করে। আমরা ফলাফলটিও মনে রাখি,এটি কি ভাল বা খারাপভাবে শেষ হয়েছিল? এই সঞ্চিত সংবেদনশীল ছাপগুলির সাহায্যে, আমরা অজান্তেই বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করি এবং ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। আমরা যে পরিস্থিতির যত বেশি বৈচিত্র্য অনুভব করেছি, আমাদের স্মৃতি তত বেশি সমৃদ্ধ হয়। যাইহোক, এই স্মৃতিগুলি কেবল তখনই সংরক্ষিত থাকে যেগুলি আমাদের প্রভাবিত করে। এবং ওইসব অভিজ্ঞতার স্মৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অন্তর্জ্ঞানকে প্রভাবিত করে।


অন্তর্জ্ঞান বিষয়ে কিছু সাবধানতা :

১। অন্তর্দৃষ্টির সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে। সব মানুষ নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।

অন্তর্দৃষ্টি হল অতীতের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সাধারণীকরণ, ভবিষ্যতের অবিশ্বাস্য বিভাজন নয়।

এবং পরিশেষে, স্বজ্ঞা পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে— হয় নিজেদের মধ্যে, অথবা আমাদের চারপাশের পৃথিবী। অন্তর্জ্ঞানের অভিজ্ঞতা থাকলে তবেই তা ব্যবহার করা উচিত। এবং তা জন কল্যাণের স্বার্থে ব্যবহার করা অবশ্যই দরকার। যদি নিজের স্বার্থের জন্যে, অর্থের কামনায় কিংবা কারো স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হয় তবে সেই শক্তি আর নাও থাকতে পারে।

২ খুব উত্তেজিত ও আবেগপ্রবন হয়ে ইন্টুইশন ব্যবহার করা উচিত নয়।

যদি কেউ তার অন্তর্জ্ঞান শক্তির জন্য লটারি বা ওইধরনের হঠাৎ পাওয়া ধন পেয়েছে সে যেন দ্বিতীয়বার সেই শক্তি ব্যবহার করতে না যায় তার কারণ মানসিক উত্তেজনা, ইতিবাচক বা নেতিবাচক, স্বজ্ঞাত সংকেতগুলিকে বিভ্রান্ত করতে পারে।পরে সে ডিপরেশনের শিকার হয়ে যেতে পারে।অশান্ত অবস্থায় কোনোমতেই ইনটুইটিভ সিদ্ধান্ত হয় না।

৩। খুব কম বা অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার কথা হঠাৎ মাথায় উদয় হলে তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়

হঠাত্‍ কারো মনে যদি উদয় হয়, এক্ষুণি একটা সুনামি হতে যাচ্ছে,কিংবা ওই বিল্ডিংটা হুড়মূড় করে ধসে যাবে কিংবা পুকুরে নেমে যদি কারো মনে উদয় হয় একটা কুমির এখানে নিশ্চয়ই আছে তবে সেটা কখনোই ফলপ্রসু হতে পারে না। কারণ সেটার সম্ভাবনা নেইই বললেই চলে। এমনকি প্লেনে চেপে এমনটা মনে হতে পারে যে প্লেন ক্র্যাশ করে যাবে হয়তো। কিন্তু সেটা অন্তর্জ্ঞান নাও হতে পারে।

৪। ব্রেন থেকে কিছু বিশেষ নির্দেশ তরংগ মাঝেমাঝে আসে সেটাকে ইন্টুইশন বলে ভুল করা উচিত নয়।

ক্ষিদে ভয় আসক্তি এগুলো সাধারণ বেঁচে থাকার প্রবণতা, বেসিক সার্ভাইভাল ইন্সটিন্ক্ট। এইগুলিকে অন্তর্জ্ঞান বলে ভুল করা উচিত নয়।

৫। নতুন কোনও পরিস্থিতিতে নিজের অন্তর্জ্ঞানকে বাজিয়ে দেখা উচিত নয়।


পরিশেষে :

আমার মতে অন্তর্জ্ঞান এমন একটি অমূল্য অতুলনীয় সম্পদ যা আমরা পেয়েও পাইনা। আমাদের ব্রেনের ভিতরে এমিগডালাতে এই ইন্টুইশনের সুইচ মজুদ রয়েছে, আমাদের বেশীরভাগ মানুষই সেটা আমৃত্যু অন করিনা। কারণ আমরা বেশি বেশি ব্যক্তিগত ইচ্ছা চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকি। সংকীর্ণতা, অহংকার, আন্তরিক ও বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলির সেবাতে তত্পর থাকি। অতীতের স্মৃতিতে ডুবে থাকি এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল হয়ে আত্মজ্ঞানের কথা ভুলে যাই। আমি কী এবং পৃথিবীতে আমার দিয়ে যাবার আছে, বুঝি না। আমার ধারণা প্রতিটি মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন সৃজনশীলতা আছে এবং তার সাথে অন্তর্জ্ঞান ওতপ্রোতে জড়িত। সেটারই উপলব্ধি করা চাই।

0 comments: