1

সম্পাদকীয়

Posted in


ছবি - পল্লববরন পাল

সম্পাদকীয়



রবিপ্রদক্ষিণপথে জন্মদিবসের আবর্তন...

তেমনভাবে ধরতে গেলে ৩০শে অগস্টই ঋতবাকের জন্মদিন। ২০১৪ সালের ওই দিনই ওয়েবের পাতায় প্রথম প্রকাশ। তৃতীয় বছরের শুরুতে একেবারে নতুন বহিরঙ্গ সজ্জায় ‘নবরূপে ঋতবাক’। বয়স বাড়ছে, সঙ্গে দায়িত্বও। ভরসা ঋতবাকের রত্নসভার সহযাত্রী বন্ধুরা, আন্তরিকতায় যাঁরা খাঁটি সোনা দিয়ে বাঁধানো। এমনই বেঁধে বেঁধে থাকি যেন চিরকাল। 

গত ২৯শে জুলাই ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস। মেয়েদের জন্য যে এই মানুষটি কতকিছু করেছেন, ভাবলে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন। এই সংখ্যায় রইলো এই মহামানবের প্রতি ঋতবাকের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। 

আর ছিলো সেই এক দাড়ি বুড়োকে স্মরণ করার দিনও... যাঁর কথা বলতে গিয়ে উত্তর আধুনিক কবিও বলেন –

গানের সুরের আসনখানি পাতলে পথের ধারে, 
গানের ভিতর দিয়ে দেখাও জীবন আপামরে... 
সুর ভুলে যেই বেড়াই ঘুরে তুচ্ছ কোন কাজে, 
উধাও আকাশ, উদার ধরা হঠাৎ বুকে বাজে... 
তখন ভাবি সুরেই বাজে এই অকাজের প্রাণ, 
হেথায় থাকা শুধু বোধহয় গাইতে তোমার গান... 
এখনও কি ভাবো তুমি, হয়নি সে গান গাওয়া, 
ঢালা গানের স্বপ্নমালা বৃথাই হলো চাওয়া... 
খেলার ছলে সাজালে যে ঐ গানেরই বাণী, 
স্রোতের লীলায় ভাসালে যে দিনের তরীখানি...

-এই বুঝি ভালো। গঙ্গা জলেই গঙ্গা পুজো...


এরই মাঝে ‘না ফেরার দেশে’ চলে গেলেন ‘ফ্যাতারু’র মা। একটা পরিবারের তথা একটা যুগের অবসান। ভালো থেকো, তুমি অনির্বাণ উলগুলান...

ঋতবাক ৩য় বর্ষ, ২৫তম সংখ্যা থেকে শুরু হলো গ্রন্থ সমীক্ষা বিভাগ – বইঘর। আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহচর্যই ঋতবাকের একমাত্র পাথেয়। 

সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় ঋতবাকের যাত্রা পথ আরও মসৃণ ও সুগম হোক।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

সুস্মিতা বসু সিং


1 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সাম্য দত্ত

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


"আমি তো বড় হইনি!"
সাম্য দত্ত



প্রস্তাবটা শুনে 'হা হতোস্মি' বলে হাঁ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার ছিল, বলুন? প্রচ্ছদ নিবন্ধ লিখব আমি! 'ঋতবাক'-এর? তৃতীয় বর্ষে পত্রিকার পথ চলা শুরু হবে আমার থার্ড ক্লাস লেখা দিয়ে বউনি করে! সম্পাদিকা ইয়ার্কি করছেন নাকি সাতসকালে? 

উঁহু! বেশ কড়া হেডমিস্ট্রেসের মত ভাবভঙ্গি, ইনি ইয়ার্কি-ঠাট্টায় আদপেও বিশ্বাস রাখেন বলে তো মনে হয় না! কিন্তু একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, উপদেষ্টা মণ্ডলী থেকে লেখক তালিকায় কত্ত বাঘা বাঘা নাম, তাঁরা থাকতে... ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ গেল, শল্য সেনাপতি! ভাবুন একবার, গ্যালারি আলো করে বসে আছেন গ্রেস, ব্র্যাডম্যান থেকে কিং রিচার্ডস, সেখানে ব্যাট করতে নামলে পটলডাঙার প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে! তারপর তিনটি স্টাম্প তিনদিকে ছিটকে গেলে আমাকেও না লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হয়, "ওসব চালাকি রাখুন স্যার, আমার এখনও ওভার বাউন্ডারি মারা বাকি আছে।" 

হে প্রবলা প্রতাপশালিনী মহামহিমময়ী মহিষাসুর থুড়ি দত্তবংশধরঘাতিনী ঋতবাক সম্পাদিকা, কী করে বোঝাই আপনাকে, একটু সিড়িঙ্গেপারা চেহারা হলেও, আমি নিতান্তই নাবালক; বড়োজোর পেশেন্টের গলা কাটতে পারি কষ্টে সৃষ্টে, কিন্তু আমার লেখা মুখবন্ধে পত্রিকার কাটতির চেয়ে বরং পাঠকের কেটে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। মুখবন্ধের ঠেলায় হয়ত ম্যাগাজিনটাই গেল বন্ধ হয়ে! পাগল না প্যান্টুলুন! কিন্তু আপন জান এবং মানের দায়িত্ব যাত্রীরই, খোয়া গেলে কম্পানি দায়ী থাকবেন না। সুতরাং মিনমিনিয়ে বললাম, "আমার শরীলটা কেমন... মানে ম্যালোরি হয়েচে, কিম্বা ডিপথেরিয়া বা থ্রম্বোসিসও হতে পারে..." কিন্তু সম্পাদিকাও বোধহয় গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন, এসব ইন্দ্রলুপ্ত অর্থাৎ ধাষ্টামো খাটল না। অতএব, বালকবীর শহিদ হইতে চলিল। চলিল তো বটে, কিন্তু কোন পথে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার হয়ে তিব্বত? আচ্ছা, শাস্তরে মহাজনের পন্থা সম্পর্কে কী যেন বলেছে? গত সংখ্যায় অনবদ্য প্রচ্ছদ নিবন্ধটি যিনি নামিয়েছিলেন, সেই নিবন্ধকারকেই 'গুরুদেব দয়া কর দীনজনে' বলে ধরে পড়লাম। উত্তর---"তথাগতের অন্তিম বাণী স্মরণ কর। আত্মদীপ হও, আত্মশরণ হও।" 
-অর্থাৎ? 
-অর্থাৎ নিজের ম্যাও নিজে সামলাও। কিন্তু খবরদার, আমার লেখা টুকলিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ঘানি টানিয়ে ছাড়ব বলে দিলাম। 

ঘনাদার চেয়েও ঘুঘু লোক মশায়! ঠিক ধরে ফেলেছে! ধরেই যখন ফেলেছে, তখন আর কিং করিষ্যতি? মনে পড়ল, একপাতা লেখার জন্য হাজার পাতা পড়ার একটা নিদান আছে। অলরাইট! জ্ঞানসমুদ্রের তীরে দুচাড্ডি উপলখণ্ড তো কুড়োই, পরে ভাবা যাবে সেগুলো ছুঁড়ে কাকে মার লাগানো যায়। অভিধান দিয়েই শুরু করা যাক, কী বলেন আপনারা?

এই সেরেছে! 'ঋতবাক' শব্দার্থ কী যেন? ওমা! অভিধান কই? তার মলাটখানা আছে বটে, ভেতরে একি! 'যশোবন্ত দারোগা- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক!' বুঝতে বাকি রইল না, এ কার অপকর্ম। রেগেমেগে বললাম, "কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক এককোণে।" কিন্তু পাগলের কি তা'তেও লজ্জা আছে? সারাটি ঘন্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে হাসতে লাগল! 

আচ্ছা, দাশু কি সত্যিই পাগল, না কেবল মিচকেমি করে? 

ধমক খেয়ে মাথা নীচু করে বসে আছি। সামনে রাখা চা-ডালমুট জুড়িয়ে জল! খবরটা আরও নাটকীয় ভাবে দিতে পারতাম, কিন্তু ভদ্রলোক নিজেই বললেন, "গাদাগুচ্ছের মর্চে-ধরা বিশেষণ আর তথাকথিত লোম-খাড়া-করা শব্দ ব্যবহার না করে চোখে যা দেখলি সেইটে ঠিকঠিক সোজাসুজি ভাবে বলে গেলে কাজ দেয় ঢের বেশি। আর একটু আগে তুই যে জানলা দিয়ে থুক করে থুতু ফেললি... ওটা আনহাইজিনিক... নেক্সট টাইম করলে গাঁট্টা খাবি।" 

ফিরতি পথে গাড়িতেও মুখ গোঁজ করে বসে ছিলাম। গাড়িটা অ্যাম্বাসাডর, মাদ্রাজি ফিলিম মার্কা পীড়াদায়ক সবুজ রঙ, তায় কানফাটানি-হাড়জ্বালানি হর্নের ঠেলায় মাথা ধরে যাবার যোগাড়। গাড়ির মালিক বললেন, "মনখারাপ করো না ভাই, ওই ধমক খেয়ে খেয়েই আমার লেখা অনেক ইমপ্রুভ করে গেছে। আমার লেটেস্ট 'করালকুম্ভীর'টা পড়ে দেখো, একটা ভুল খুঁজে পাবে না!" 

-তাগোরের সঙ্গে! তাগোর আবার কে? 
-বাঃ! রাবীনদ্রা নাত্ তাগোর! 
বুঝলাম কবিগুরুর নাম ফরাসি উচ্চারণে এই রকম দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, "তার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল? কোথায় আলাপ হয়েছিল?" মঁসিয়ে পেত্রা আমতা আমতা করে বলল, "মানে তিনি যখন পারিতে ছিলেন, তখন খবরের কাগজে তাঁর ফটো দেখেছিলাম।".... একটা অসাধারণ গল্প শেষ করে ঘনাদা আরামকেদারা ছেড়ে উঠে গেলেন। সিগারেটের টিনটা, না না, পকেটে ফেলে নয়, যেন মনের ভুলেই ফেলে রেখে গেলেন। হয়ত আমার লেখার কাজে আসবে ভেবেই!

------ "সেকি! সকালে উঠে লিখবে কেন? সূর্যের মতো আর্লি রাইজার হবার পক্ষপাতী নই আমি। সকালে উঠতে হবে, এমনকি আদৌ যে উঠতে হবে, এমন কোনও কুসংস্কার আমার নেইকো। খেয়ে আর ঘুমিয়েই আমি সারাদিন কুলিয়ে উঠতে পারিনা। ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায়, সময়মত না খেলেই আমি ভাই কাহিল হয়ে পড়ি। খাওয়ামাত্র আমার ঘুম দরকার, ঘুম থেকে উঠে খাওয়া, তারপর আবার ঘুম। সারাদিন এই চলে। সন্ধ্যের দিকে আড্ডা দিতে বেরই, তারপর নাইট শো'তে সিনেমা দেখে ফিরি গভীর রাতে। তারপর রাতে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠি পরদিন।" -তাহলে লেখেন কখন?'
-"কেন? পরের দিন!" 
বুঝতেই পারছেন কার কাছে গিয়েছিলাম পরামর্শ নিতে। মুক্তারামের মুক্তপুরুষটির তক্তার আরাম চেখে আর রাবড়িচূর্ণ খেয়ে ফিরলাম।

"6ই জুলাই 
আজ অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। গত দু'দিনে প্রফেসর রন্ডির টাইম মেশিনে বেশ কয়েকবার সফর করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতীতের দিকে বেশ খানিকটা আগেই ঘুরে এসেছি। তাই আজ ঠিক করেছিলাম, ভবিষ্যতের দিকে যাব। সাহিত্যের, বিশেষত বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমার ছেলেবেলা থেকেই একটা আকর্ষণ ছিল। পরবর্তীকালে আমি ভারতীয় এবং বিদেশী মিলিয়ে সতেরোটি ভাষা রপ্ত করি এবং প্রায় প্রত্যেকটির সাহিত্যকর্মেই আমার কমবেশি দখল আছে। তাই আজ থেকে বছর পঞ্চাশ পরে সাহিত্যচর্চার গতিপ্রকৃতি ঠিক কীরকম হবে, সেটা জানার কৌতূহল ছিল। 

রন্ডির এই মেশিনে স্থান এবং কাল দুটোই আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া যায়। আমি গিয়ে পড়লাম দু'হাজার ষাট সালের কলকাতা বইমেলার সময়। মেলার চেহারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে ঠিকই, তবে যে জিনিসটা সবথেকে বেশি নজর কাড়ে, তা হলো কাগজের ব্যবহার একেবারে অবলুপ্ত। আমি প্রায় আধঘন্টা মেলায় কাটিয়েও ছাপা বইয়ের স্টল একটিও দেখতে পেলাম না। লেখালেখির পুরোটাই হচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে, আর ছাপা পত্রিকাকে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন। 

অবিশ্যি এতে আশ্চর্য হবার আর কি আছে? যে হারে মানুষ প্রকৃতির ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তা'তে ভবিষ্যতে অন্তত কাগজের প্রয়োজনে গাছ কাটা বন্ধ করতেই হবে। আর কাগজের তুলনায় কম্পিউটারে বা মোবাইলে লেখা যেমন সহজ, পড়াও। আমিও ভাবছি গিরিডিতে ফিরে গিয়ে এবার ডায়রির বদলে ব্লগ লেখা শুরু করব।" ---

লেখাটা এইমাত্র পেলুম একটা ডায়রি থেকে । ডায়রিটা ভারি অদ্ভুত! টানলে রাবারের মত বেড়ে যায়, আগুনে পোড়েনা আর কালির রঙ বদলায় ঘনঘন। প্রথমে লাল, তারপর নীল, হলদে, সবুজ..... লেখকের নাম? নাইবা বললাম! 

মোটকথা নিবন্ধখানা নির্যস মাঠে মারা গেল। মাননীয়া সম্পাদিকা যেন কিসব পয়েন্টে লিখতে বলেছিলেন। ওয়েবম্যাগের কিস্যা ছুঁয়ে ম্যাগির সীসা, মঙ্গলগ্রহে জলের সন্ধান থেকে মঙ্গোলিয়ার ইতিহাস- সেসব গুলিয়ে ফেলে লেখাটাই পয়েন্টলেস হয়ে দাঁড়াল। তা, খুব ক্ষতি হলো কি? একবার একটু উল্টে দেখাই যাক না, কিছু পাল্টে যায় কিনা! আপনার বইয়ের তাকে কাফকা-কোঁতকা-ফুকোদের ভিড়ে যাঁরা পিছনের বেঞ্চিতে সরে বসেছেন, এক ফুঁয়ে তাঁদের ধুলো ঝেড়ে সামনে আনুন। দিনকতক টঙের ঘরে রাজত্ব করুন শ্রী ঘনশ্যাম দাস। একদিকে বসিয়ে দিন অর্জুনের নাইফ থ্রোয়িং-এর খেল, তারপর জমিয়ে দেখুন আপনি আর মগনলাল মেঘরাজ। পাশেই বিজ্ঞানের আলোচনায় মেতে উঠুন দুই প্রফেসর, শঙ্কু ও ক্যালকুলাস। এক চক্কর হেঁটে আসুন, আপনার পাশেই থাকবেন ক্রাচ বগলে রাজা রায়চৌধুরী। একবেলা সুপারিন্টেনডেন্ট স্যারের ক্লাস করুন নন্টে-ফন্টে আর কেল্টুদার সঙ্গে বসে। আর 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'তে বসে অদ্ভুতুড়ে হাসি হাসুন শীর্ষেন্দু। এঁরা আপনার অন্দরমহলে শ্যাওলা জমতে দেবেন না! 

একবার ভাবুন তো, লাল-নীল-গেরুয়া-সবুজ এমন হাজার ভূতের দেশে আমাদের বাস, অথচ নিধিরাম সর্দারকে আপনি স্রেফ ভুলে বসে আছেন! সর্বাঙ্গে বোমা বেঁধে কচি ছেলেদের ইস্কুলে ঢুকে পড়তে আপনার বুক কাঁপছেনা, অথচ আপনারই ছেলেবেলাটা মিহিদানার হাঁড়িতে চিনেপটকা রেখে, আপনারই বুকের মধ্যে বসে হাপিত্যেশ করছে! বড় হলেই বড় কষ্ট, বরং বড়বেলার ধরপাকড়ের নেশা ছেড়ে আপনিও মুকুল ধরের মত বলুন, "আমি তো বড় হইনি!" বড় আরাম পাবেন। 

তবে বড় হোক ঋতবাক। তিন থেকে তিরিশ ছুঁয়ে তিনশোর দিকে তার যাত্রা মসৃণ হোক । আমরা সেই বৃহৎ মহীরুহের ছায়ায় বসি পা ছড়িয়ে, তারপর গলা ফাটিয়ে বলি, "ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক।"








1 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিত ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


ঈশ্বরচন্দ্রের ভূগোলচর্চা
অমিত ভট্টাচার্য



১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সচিব মিয়রের ঘোষিত ১০০ শ্লোক রচনার বিনিময়ে ১০০.০০ টাকা পুরস্কার নিঃসন্দেহে বিদ্যাসত্রে উৎসাহদান। তখনকার সেই অর্থমূল্য এখন সম্ভবত এক লক্ষ টাকার সমতুল। গ্রন্থান্থরে, যেমন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত ‘সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালির দান’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌’ নামক ৪০৮টি শ্লোকসমষ্টি রচনা করেন। কোথায় একশো শ্লোক রচনায় উৎসাহ পেয়ে একশো শ্লোক লেখা! তা নয়। কাকে বলে পাণ্ডিত্য! সকাল দেখেই যেমন দিন স্থির হয় তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র যে, “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে” হবেন, তার নান্দীমুখ হয়ে গেল। লিখে ফেললেন একশো নয়, দুশো নয়, তিনশো নয়, সাকুল্যে ৪০৮টি শ্লোক।

বিদ্যার্থী অবস্থাতেও পুরস্কারের লোভে তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হননি। গ্রন্থের সূচনায় বিজ্ঞাপিত হয়েছে তাঁর শ্লোক রচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার প্রকৃত কারণ। বাঙালি সহপাঠী বিদ্যার্থীর নিন্দিত আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদে তিনি যে-শ্লোকাবলি রচনা করেছিলেন মাত্র আঠারো বা উনিশ বছর বয়সে, সেটি সরস্বতীর মন্দিরে কেবলমাত্র স্নিগ্ধ দীপ প্রজ্জ্বালন নয়, ভবিষ্যতের প্রতিবাদী চরিত্রের পূর্বাভাষও বটে। তাঁর তরুণ বয়সের চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাঁকে শিবসংকল্পে উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল বলে সংস্কৃত ভাষাতেও যে ভূগোল বা খগোল আদৌ লেখা যায়, উত্তরপ্রজন্ম তার নমুনা পেল।

বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর, সমাজ সংস্করক বিদ্যাসাগর, বর্ণপরিচয়-এর উদ্‌গাতা বিদ্যাসাগর, শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকায় বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর—প্রভৃতি নানাবিধ ভূষণে তিনি শোভিত হলেও এবং আপামর বাঙালি সে-বিষয়ে পরিচিত হলেও, ভূগোল-খগোল বর্ণনায় সফল বিদ্যার্থী ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি—এমন মানুষজনের সংখ্যাই বেশী। বস্তুত, ভূগোল এমন একটি বিষয় যা একেবারে নিম্নশ্রেণী থেকে অবশ্যপাঠ্য। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বিদ্যার্থী নিজেদের পছন্দের বিভাগ বেছে নেয়। সুতরাং, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সবিস্ময়ে আনন্দ প্রকাশ করবে—এই গ্রন্থ পাঠ করে।

আবার উচ্চতর শিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত হন—তা যে-কোনও বিষয়ের হলেও স্বয়ং বিদ্যাবারিধির কীর্তিগাথা যে তাঁদের জীবনকে নতুন আলোর দিশা জোগাবে—তা তো নিঃসন্দেহে বলা চলে।বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এমফিল বা পিএইচডি করার সময় গবেষকদের বিষয় নির্বাচন করতেই কতটা সময় চলে যায়।অথচ হাতের কাছে এমন অমূল্য সম্পদ থাকলে সে তো সোনায় সোহাগা! ভাষাচর্চায় যাঁরা রত, যেমন—বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া, অসমিয়া, মৈথিলি নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ঈশ্বরচন্দ্রের এই দুর্লভ গ্রন্থটির দিকে যাতে নজর দেন, সে জন্যই এই প্রয়াস।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ন্যায়শাস্ত্র পড়ুয়া প্রতিযোগী, অনুযোগী বা অবচ্ছেদক বিচ্ছিন্ন, লক্ষ্য-লক্ষ্যতা, আধার-আধেয়, সংযোগ-সমবায় প্রভ্রৃতি সম্বন্ধ-চর্চাকে সম্পূর্ণ পরিহার করে নিজের সুনিদির্ষ্ট চৌহদ্দির বাইরে লেখনী ধরেছেন—তা ভাবলে শিহরণ জাগে বৈ-কি! বিশেষত আজকাল সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় নিযুক্ত মানুষজন এক-একজনকে বিশেষ পত্রের সিলমোহর দিতে মুখিয়ে থাকেন। উনি তো বেদ, উনি তো বেদান্ত, উনি তো সাংখ্য, উনি তো ব্যাকরণ, উনি তো ন্যায় অথবা কাব্যের লোক। কোনো ফোরামে তাঁদের বলার ভঙ্গি বা উপস্থাপনের ধরণ যে- শারীরিক ভাষাকে ব্যক্ত করে, তাতে মনে হয় উদ্দিষ্ট ব্যাক্তি তাঁর বিষয়ের বাইরে কিছুই জানেন না বা বোঝেন না।ফলে পরীক্ষক নির্বাচনের বেলায় নামের প্রস্তাবককে ঢোক গিলতে হয়।ঈশ্বরচন্দ্র পারতেন এবং সেটি করে দেখিয়েছেন যে, প্রতিভাকে বিশেষ পত্র দিয়ে সীমায়িত করা যায়না। প্রতিভা ঈশ্বরের তৃতীয় নয়ন।

ঈশ্বরচন্দ্রের সেজো ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন জানিয়েছেন, ঠাকুরদা রামজয় বাবা ঠাকুরদাসকে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম সংবাদ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অদ্য আমাদের একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে…এ ছেলে এঁড়ের মত বড় একগুঁয়ে হইবে…এ নিজের জিদ বজায় রাখিবে’। ‘বাবার কাছে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ‘ঘাড়কেঁদো’ অর্থাৎ নিজের প্রতিভায় একবগগা।১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে অভিযান শুরু।এরপর ক্রমান্বয়ে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল তর্কালংকারের কাছে সাহিত্য পাঠ।১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের কাছে অলংকার পাঠ এবং এই ভাবে ধীরে ধীরে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের কাছে ন্যায়শাস্ত্রের পাঠ, শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির কাছে বেদান্তের পাঠ ও পরিশেষে হরনাথ তর্কভূষণের কাছে স্মৃতিশাস্ত্রের পাঠ তাঁকে বিবিধ বিষয়ের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করেছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা নিয়ে আচার্যেরা যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ঠিক সেইসময় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে এক অভিনব নিয়ম প্রবর্তিত হলো।

স্মৃতি, ন্যায়, বেদান্ত বিভাগের ছাত্রদের বার্ষিক পরীক্ষার সময় সংস্কৃত গদ্য ও পদ্য রচনার নিয়মাবলী চালু হলো। সর্বোৎকৃস্ট রচয়িতা গদ্য ও পদ্য ভেদে একশো টাকা করে পারিতোষিক পাবেন। অলংকারশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্রের আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রচনা লেখায় অংশ নিয়ে বিদ্যাসাগর প্রথম হন এবং একশো টাকা পুরস্কার পান।

শ্লোক রচনাতেও ঈশ্বরচন্দ্র সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। ওঁর রচনা মানেই মনোনীত। সেই কৃতিত্বকে সম্মান জানাতেই এই গ্রন্থ-সম্পাদনা। শম্ভুচন্দ্র জানিয়েছেন :

“জন মিয়র নামে এক সিবিলিয়ানের প্রস্তাব অনুসারে পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মতানুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ক কতকগুলি শ্লোক রচনা করিয়া একশত টাকা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সেই কবিতাগুলি মুদ্রিত করিবার অভিপ্রায় করিয়া ছিলেন।”

১২৯৯ বঙ্গাব্দে (১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র নারায়ণচন্দ্র শ্লোকাবলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্র জীবিত অবস্থায় (১৮২০-১৮৯১) গ্রন্থটি পুস্তকাকারে দেখে যেতে পারেননি। বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে যে-বিদ্যাসাগর-গ্রন্থপঞ্জী সন্নিবিষ্ট আছে তার ২৭নং ক্রমাংকে ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌-এর উল্লেখ রয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, ‘১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম প্রদেশের সিবিলিয়ান জন মিয়র বিদ্যাসাগরকে পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মতের অনুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ে শ্লোক রচনা করিতে বলেন’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সিবিলিয়ন মিয়র শ্লোকাকারে গ্রন্থ রচনা ও পুরস্কার-প্রাপ্তির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থকারের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য নেই এবং বইটির মুদ্রণও যে ওঁর তিরোধানের পরে হয়েছিল, তাও সন্দেহাতীত।

ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন মানেই বিষয় সিরিয়াস। গবেষকদের টনক নড়ে। ভূ-গোলাকার প্রায় হলেও খ বা আকাশ কীভাবে গোল হয় বিবিদিষু জানতে চান। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে কৃতবিদ্য কীভাবে তা লিখলেন ! উত্তরে বলা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন যে আকাশ শূন্য। কিন্তু তা হলেও মাটির মানুষ ওপরের দিকে তাকিয়ে যখন কড়ার মতো একটা কিছু দেখেন তখন তাকে গোল আখ্যা দিয়ে গোল বাধিয়ে দেন না। যদিও মনে হতেই পারে, এই প্রশ্ন বাড়াবাড়ি। কারণ, কবির কাব্যরচনায় সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে টানলে কাব্যরস বিঘ্নিত হয়। তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র যখন এই গ্রন্থ রচনা করেন তখন ওঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে অধীত বিদ্যার জারকরসে সিঞ্চিত করা, যা জ্ঞান ও বোধকে আলোকিত করবে।

আঠারো বছর বয়সের এক তরুণ গ্রন্থ পাঠের সময় আনন্দের তত্ত্বতালাশে বিভোর। পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মত অনুসরণ করে সম্পূর্ণ গ্রন্থটি রচিত। আঠারোটি পুরাণে সৃষ্টিই মূলকথা। এই সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভূগোল/খগোল এসেছে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের বাইরে কিছু নেই। পৃথিবী, অন্তরীক্ষ এবং আকাশ ভেদে ব্রহ্মাণ্ড ত্রিস্তর বিশিষ্ট। ‘চতুর্দ্বীপা বসুমতী’ এবং ‘সপ্তদ্বীপা বসুমতী’ পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণিত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন। এই দ্বীপগুলি হলো যথাক্রমে জম্বুদ্বীপ, প্লক্ষদ্বীপ, শাল্মলিদ্বীপ, কুশদ্বীপ, ক্রৌঞ্চদ্বীপ, শাকদ্বীপ এবং পুস্করদ্বীপ (দ্রস্টব্য বায়ুপুরাণ ১।৮৮; ৮।১৬)। মার্কণ্ডেয় পুরাণকার জানিয়েছেন—ক্রৌস্টুকি-মার্কণ্ডেয়র কথোপকথনের মাধ্যমে এই সাতটি দ্বীপের প্রসঙ্গ :

যে তে দ্বীপা ময়া প্রোক্তা জম্বুদ্বীপাদয়ো দ্বিজ।
পুষ্করান্তা মহাভাগ শৃণ্বেষাং বিস্তরং পুনঃ।।
দ্বীপাৎ তু দ্বিগুণো দ্বীপো জম্বুঃ প্লক্ষোহথ শাল্মলঃ।
কুশঃ ক্রৌঞ্চস্তথা শাকঃ পুষ্করদ্বীপ এব চ।।

(মার্কণ্ডে য় পুরাণ, ৫৪তম অধ্যায়, ৫-৬ শ্লোক):

প্রসঙ্গত ব্রহ্মপুরাণ দ্রষ্টব্য (অষ্টাদশ অধ্যায়, ১১-১৯ সংখ্যক শ্লোক)। 



পুরাণ সম্মত ভূগোল বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ হয়েছে ১৪৩ সংখ্যক শ্লোকে। স্বাভাবিক ভাবেই পুরাণমতকে অনুসরণ করেছেন বলে বেশ কিছু শ্লোকে মিথ (Myth) এসেছে। পরবর্তীকালে সে-বিষয়ে আলোকপাত করেছি। সমগ্র ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমের বিভিন্ন জনপদ, নদনদী, পর্বত প্রভৃতির বর্ণনা বেশ চিত্তাকর্ষক। নিজের সাধ্য মতো পুরাণ বর্ণিত ভূমণ্ডলের বৃত্তান্ত দিয়ে ‘ব্যোমমণ্ডল’ বা খগোল ব্যাখ্যাত হয়েছে। পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে যে-‘অন্তরিক্ষ’ উল্লিখিত হয়েছে পাদটিকায় গ্রন্থকার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিবিদিষু যদি জানতে চান ‘অন্তরীক্ষ’ কী ! তাই বলা হলো—মাটি এবং আকাশের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানকেই অন্তরীক্ষ বলে—“তয়োঃভূমিনভসোঃ অন্তঃ মধ্যদেশঃঅন্তরীক্ষম্‌”।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাধারণ মানুষ যে-দেব দিবাকরের (সূর্যের) উদয় এবং অস্ত নিয়ে ভাবিত সেই ধারণা যে ভ্রান্ত, ঈশ্বরচন্দ্র তা দেখিয়েছেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি সূর্যের উদয়াস্ত বলে যা বলা হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে সূর্যের দর্শন ও অদর্শন—


তদেবং নোদয়োহর্কস্য নৈবাস্তাস্তমনং ক্বচিৎ।

উদয়াস্তৌ হি বিজ্ঞেয়ৌ দর্শনাদর্নে রবেঃ।।

(১৬১ সংখ্যক শ্লোক)।



গ্রন্থারম্ভের সূচনায় ভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থের পারস্পরিক ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়ে মঙ্গলাচরণ করেছেন। মহেশ্বর শিবকে তাঁর অসীম মহিমার জন্য প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড সত্যই বিচিত্র ও অদ্ভুত। এর সৃজন প্রক্রিয়া আমাদের স্থূল বুদ্ধির অগোচর। পরাশর-মৈত্রেয়র সংলাপে বিষ্ণুপুরাণ-এ এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বর্ণিত। পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ নানা শক্তিসম্পন্ন হলে এক অণ্ড উৎপাদন করে। সেই সম বর্তুলাকার অণ্ডই ব্রহ্মার ডিম্বকোষ নামে খ্যাত। ব্রহ্মস্বরূপ এই অণ্ডের থেকেই সৃষ্টি বলে একে ব্রহ্মাণ্ড বলে ‘তস্মিন্নণ্ডহভবৎ’(বিষ্ণুপুরাণ, ১ । ২ । ৫৪)।

জগৎ সৃষ্টি যে ভগবানের লীলা, যা কিনা ‘অগ্নিপুরাণ’ জানিয়েছে, “জগৎসর্গাদিকাংক্রীড়াম্‌” (১৭ অধ্যায়, প্রথম শ্লোক), তার সঙ্গে আলোচ্য গ্রন্থের চিন্তন সাদৃশ্য রয়েছে। অগ্নিপুরাণ-এ বলা হয়েছে, ভগবান সৃষ্টি কামনায় প্রথমে জল সৃষ্টি করলেন। সেই জলে ব্রহ্মাণ্ডের বীজ নিক্ষিপ্ত হলো। বীজ থেকে সুবর্ণ অণ্ডের সৃষ্টি। সেই অণ্ডে ব্রহ্মা স্বয়ং আশ্রয় নিলেন (১৭। ৬-১০)।

অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে সাফল্য লাভের জন্য বিশেষত ওই তরুণ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিনয় প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলাচরণের পরে সবিনয়ে নিজের দৈন্যভাব প্রকট করতে কোনও দ্বিধা ছিল না। কালিদাস যেখানে গ্রন্থারম্ভে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের জন্য বাগ্‌ব্যবহার করেছিলেন (অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌, রঘুবংশম্‌ দ্রষ্টব্য), সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র যে ব্যতিক্রমী হবেন না—এ তো একপ্রকার নিশ্চিত। এই কারণে নিজের সামান্য অভিলাষ পূরণেও ওঁর মনে হয়েছে—জোনাকি (খদ্যোত) রাতের আঁধার দূর করবে—এই বচনে কে হাসি সংবরণ করবে! কিন্তু তথাপি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় হাল ছেড়ে না-দিয়ে গুরুদেব (যাঁদের কাছে অধ্যয়ন করেছেন) শ্রীচরণে পবিত্র সুন্দর প্রণাম জানিয়ে গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ। সহৃদয় পাঠকবর্গ ওঁর এই সংক্ষিপ্ত রচনার উদ্যোগে কোনো ভুলত্রুটি ঘটে থাকলে সংশোধন করে দেবেন—“সুধিয়ঃ শোধয়ন্ত্ব তৎ”।

শেষনাগ সাপেদের রাজা! পৃথিবী নামক পদ্মের নাল বা ডাঁটার মতো। সে তার মণ্ডালাকৃত ফণায় পৃথিবীটাকে ধরে রয়েছে বলে পৃথিবীটা নীচে পড়ে যাচ্ছে না (শ্লোকসংখ্যা ৭ দ্রষ্টব্য)। তরুণ বয়সে যখন দর্শনের যুক্তিপদ নির্মিত হয় না, বুদ্ধি তখন ‘মিথপুরাণ’—এর প্রত্ন প্রতিমায় সমাচ্ছন্ন থাকে। মন তখন উদগ্রীব হয়ে গলা তুলে প্রশ্নমালা গাঁথে না। ছবিঘর তখন বাস্তব সত্য বলে প্রতীত হয়। কত কাল যাবৎ শেষনাগ মেদিনীকে ধরে রাখবে, সে নড়লেই কী ভূকম্পন ঘটে—এতসব পরিণত প্রশ্ন তখন উঁকি দেয় না। যদিও বা দেয়, তবু পুরাণ বৃত্তান্ত বর্ণনায় সেসব প্রশ্ন নিরর্থক। 

ভারতবর্ষের বর্ণনায় ঈশ্বরচন্দ্র অকৃপণ। হাত খুলে লিখেছেন। ভারতবর্ষ হলো কর্মভূমি। উত্তরে হিমালয় থেকে প্রবাহিত নির্ঝরিণী নদীসমূহের ক্রমান্বয়ে নামোল্লেখ শ্লোকাবলিকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তছন্দের মন্দাকিনী ধারা স্বতঃ উৎসারিত হয়ে গ্রন্থটিকে সুষমা মণ্ডিত করেছে। গঙ্গা, যমুনা, সরযূ, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, নর্মদা, কাবেরী, গোদাবরী প্রভৃতির উল্লেখে নদীমাতৃক ভারতীয় সংস্কৃতির এক মনোমুগ্ধকর আশ্চর্য রচনা চিত্রায়িত হয়েছে—,”এতা নদ্যঃ প্রকীর্তিতাঃ” (৬৭ সংখ্যক শ্লোক)


সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটির বিবিধ সংস্করণ দেখেছি। গ্রন্থকার রূপে আর্যভট্ট, বরাহমিহির দু—জনকে নিয়ে সূক্ষ্ম মতপার্থক্য এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। তবে সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের শুরুতেই জানানো হয়েছে, ময় নামক এক অসুরের তপস্যায় প্রীত হয়ে স্বয়ং সূর্যদেব ওকে দর্শন দেন এবং গ্রহাদির অবস্থান সংক্রান্ত বিবিধ বিষয় অবহিত করানোর জন্য নিজের অংশজাত এক দিব্য পুরুষকে আদেশ করেন (সূর্যসিদ্ধান্ত, ২ – ৯ শ্লোক দ্রষ্টব্য)।

জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় তিনটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে। এগুলি হলো যথাক্রমে, 
ক। সূর্যসিদ্ধান্ত, খ। সিদ্ধান্তশিরোমণি এবং গ। আর্যসিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত শিরোমণি ভাস্করাচার্য প্রণীত। আর্যসিদ্ধান্ত কবে, কখন রচিত হয়েছিল, সঠিক জানা যায় না। আবুল ফজল (Abul Fazl) বাদশাহ আকবরের আইনকানুন—এর গ্রন্থে নয়টি সিদ্ধান্ত গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন যথা—১। ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, ২। সূর্যসিদ্ধান্ত, ৩। সোমসিদ্ধান্ত, ৪। বৃহস্পতিসিদ্ধান্ত, ৫। গর্গসিদ্ধান্ত, ৬। নারদসিদ্ধান্ত, ৭। পরাশরসিদ্ধান্ত, ৮। পুলস্ত্যসিদ্ধান্ত এবং ৯। বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত। এগুলির মধ্যে প্রথম চারটি ঈশ্বরের বাণী (Inspired) রূপে গৃহীত। 

ভারতীয় জ্যোতির্মণ্ডল চর্চায় সূর্যসিদ্ধান্ত এক মান্য গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র সেইমতো সূর্যসিদ্ধান্ত-কে অনুসরণ করেছেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিস্কারের বহুপূর্বে কীভাবে ভারতীয় ঋষিরা জ্যোতির্বিদ্যায় এতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন, তা ভাবলে আমাদের গর্বিত হতে হয় বৈ—কি ! সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি ১৪টি অধ্যায়ে শ্লোকাকারে রচিত, যেখানে গ্রহচরিত বর্ণিত হয়েছে “গ্রহাণাং চরিতং মহৎ”।

সূর্যসিদ্ধান্ত—র একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ের বর্ণনার সঙ্গে ভাষাগত ও বিষয়গত ঐক্য অবশ্যই অনুসন্ধিৎসু বিদ্যার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রহ্মাণ্ড, কটাহ, সম্পূট, কক্ষা, মেখলেব, মেষাদিরাশি প্রভৃতিই কেবল নয়, ব্রহ্মাণ্ডকক্ষা (১২ । ৯০), চন্দ্রকক্ষা (১২ – ৮৫), মঙ্গলকক্ষা (১২ । ৮৭), বৃহস্পতিকক্ষা (১২ । ৮৮ – ৮৯) প্রভৃতি সব যে ঐ তরুণ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন করেছিলেন তার নমুনা প্রতি ছত্রে। এমনকী সূর্যের তাপের তারতম্য গ্রীষ্মে ও হেমন্তে কেন—তাও ২০০—তম শ্লোকে তিনি যে—ব্যাখ্যা করেছেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটাই সূর্যসিদ্ধান্ত—র বচনবিন্যাসের স্থানান্তর ঘটিয়ে (১২ । ৪৬)। যদিও দেবাসুর প্রভৃতি পদের পরিবর্তন পাঠককে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। তুলনাত্মক আলোচনার প্রেক্ষিতে নমুনা প্রদর্শিত হল :

অত্যাসন্নতয়া তেন গ্রীষ্মে তীব্রকরা রবেঃ ।
দেবভাগেহসুরাণান্তু হেমন্তে মন্দতানাথা ।।

(সূর্যসিদ্ধান্ত. ১২ । ৪৬)।


এখানে ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন :

প্রত্যাসন্নতয়াস্মাকং গ্রীষ্মে ভীষ্মকরো রবিঃ ।
হেমন্তে ত্বতিদূরত্বাৎ মন্দো ভবতি মন্দসূঃ ।।

ভূগোল শীর্ষক আলোচনায় দুধরনের মতেরই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন একদল বলে থাকেন পৃথিবীটা হাঁসের ডিমের সদৃশ, আবার অন্যদল বলেন—কমলালেবুর মতো :


কৈশ্চিদ্বিনিশ্চিতা পৃথ্বী হংসীডিম্বনিভাকৃতিঃ ।
অপরৈরুচ্যতে ধীরৈর্জম্বীরসদৃশাকৃতিঃ ।।

(২৮১ সংখ্যক শ্লোক)।



এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা ভেদে চার মহাদেশের বর্ণনায় পাঠক ঋদ্ধ হয়েছেন। এশিয়ার মধ্যে ভারতের সর্বাগ্রে উল্লেখ ভারতবাসী মাত্রেই দৃষ্টি কাড়ে। ভারতবর্ষ এক বিশাল দেশ (তখন তো অবিভক্ত ভারত)। এখানে বিভিন্ন জনপদের বর্ণনায় ঈশ্বরচন্দ্র বন্ধনহীন। বস্তুত কেবল সংস্কৃত পাঠেই নয়, সমগ্র ভূমণ্ডলের বিষয়েও তাঁর অগাধ অনুসন্ধিৎসু এক স্বভাবজ পারদর্শিতার নমুনা। গৌড় নামক জনপদের প্রধান নগরী ‘কলিকাতেতি সংজ্ঞিতা’। এছাড়া অযোধ্যা, লক্ষ্মৌ, বিহার, পাটনা, কুরুক্ষেত্র, দিল্লি, কাশ্মীর, শ্রীনগর, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, লাহোর, মহীশূর, গুজরাট, উৎকল, কটক, নেপাল, কাঠমাণ্ডু, অসম প্রভৃতি স্থানের নামোল্লেখ ভারতের ইতিহাস চর্চায় উৎসাহিত করে।

ভারতবর্ষের উত্তর—পূর্বে চিন। এশিয়ার অন্তর্গত হলেও যাকে মহাদেশ বললে অত্যুক্তি হয় না—“অস্তি চীন ইতি খ্যাতো মহাদেশোহতিশোভিতঃ” (৩০৩ সংখ্যক শ্লোক)। চিনের প্রাচীর প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য বিষয়ের অন্তর্গত। চিনের রাজধানী পিকিং। এ ছাড়া জাপান, তিব্বত, লাসা, পারস্য, আরব, মক্কা, তুরস্ক, রুসিয়া, সিংহল, কলম্বো প্রভৃতির উল্লেখে সমগ্র এশিয়া নিয়ে ভাবনার সার্বিক রূপরেখা অঙ্কনের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় সংকলন নিঃসন্দেহে। বর্তমানে যারা সিংহল (শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণে যান এবং দ্বীপময় কলম্বো পরিদর্শন করেন, ঈশ্বরচন্দ্র রচিত এই গ্রন্থ পূর্বপঠিত থাকলে নির্দ্বিধায় বলবেন, “কলম্বনগরে তস্য রাজধান্যতিমঞ্জুলা” (৩১২ সংখ্যক শ্লোক)

এশিয়ার পরে ইউরোপ। ইউরোপের পূর্বদিকে এশিয়া, দক্ষিণদিকে ভূমধ্যসাগর, উত্তরদিকে উত্তর মহাসমুদ্র এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থিতি। সমুদ্রের জলপথ বরাবরই বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল হলেও এই প্রসঙ্গে ভূমধ্য সাগরের জুড়ি মেলা ভার। ইউরোপের চোদ্দোটি প্রধান দেশের মধ্যে ইংল্যান্ড অন্যতম হওয়ায় প্রথমেই সে—দেশের বর্ণনা। ইংল্যান্ড ভোগের দেশ ‘প্রজানন্দপ্রদায়িনী’ (৩১৯ সংখ্যক শ্লোক)। এর রাজধানী হলো লন্ডন। এই লন্ডনের টেম্‌স নদী সুপ্রসিদ্ধ। নদীর ওপরে রয়েছে চারটি বড়ো সেতু—“চত্বারোমহান্তঃসন্তিসেতবঃ” (৩২০ সংখ্যক শ্লোক)। লন্ডনকে আবর্তিত করে আরও নানা শহর থাকলেও বাহুল্য শঙ্কায় ঈশ্বরচন্দ্র সবিস্তারে বলেননি। ইংল্যান্ডের পরে ফ্রান্স (৩২৪ থেকে ৩২৯ সংখ্যক শ্লোক)। এর পশ্চিমে আটলান্টিক, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং উত্তরে হল্যান্ড। ফ্রান্সের প্রধান শহর প্যারিস—“প্রধাননগরং তস্য মতং পারিসসংজ্ঞিতম্‌”। এই প্যারিসে বহু সংখ্যক ধনাঢ্য পরিবারই কেবল নয়, বহু গুণীজনও এখানে বসবাস করেন। এরপর স্পেনের মাদ্রিদ নগর উল্লিখিত। ক্রমে ক্রমে পোর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মান, সুইটজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ইটালি, তুরস্ক, রাশিয়া বর্ণিত (৩১৩ থেকে ৩৮০ সংখ্যক শ্লোকে ইউরোপের পরিক্রমা)।

তৃপ্ত পাঠক দৃষ্টি দেন তৃতীয় মহাদেশ আফ্রিকার চর্চায়। এত বিশাল ইউরোপকে তো শ্লোকবদ্ধ করা যে সে ব্যাপার নয়। একজন বিবিদিষু সংস্কৃত বিদ্যার্থী যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে আমরা প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের গবেষকরা সন্ধান পেয়েছি এক নতুন আলোর। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে স্বীকার করেছেন, সংক্ষেপে ইউরোপের বর্ণনা করে এবার তৃতীয় ভাগ আফ্রিকা প্রসঙ্গে কিছু বলছি :


নিরূপিতো য়ুরোপোহয়ং সংক্ষেপেণ যথামতি ।
ইদানীমাফ্রিকো নাম তৃতীয়ো ভাগ উচ্যতে ।।

এই আফ্রিকার বর্ণনা চলেছে ৩৮১—৩৯৫ সংখ্যক শ্লোক পর্যন্ত। মিশরের চিত্তাকর্ষক শ্লোকবিন্যাস সহজ, সরল ছন্দে পাঠককে আপ্লুত করে। এই মিশরের রাজধানী কায়রো যখন ছন্দের আনুকূল্যে ‘কেরো’ রূপ পায়—তখন ঈশ্বরচন্দ্রের শ্লোক রচনার তারিফ করতে হয় (৩৯০ সংখ্যক শ্লোক)। ভূগোল লেখার জন্য যতটুকু লিখতে হয়, তিনি ততটুকুই লিখেছেন।

এইবার চতুর্থ ভাগ আমেরিকা। তরঙ্গিণী মিসিসিপি পৃথিবী জোড়া খ্যাতি আদায় করে নিচ্ছে বলে ঈশ্বরচন্দ্র এর উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার প্রধান নগর ওয়াশিংটন, যাকে নির্দেশ করা হয়েছে ‘বাসিন্টন’ রূপে (৪০৩ সংখ্যক শ্লোক)। এই বাসিন্টনের বাসিন্দারা বিন্দাস জীবন কাটান। ৩৯৬—৪০৮ সাকুল্যে তেরোটি শ্লোকে এই চতুর্থ ভাগ সীমায়িত। একেবারে অন্তিম শ্লোকে স্থান পেয়েছে ব্রাজিল এবং এই দেশ যে মনোহর হীরের আকর তা স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশিত, “মনোহরাণাং হীরাণামাকরস্তএ বর্ত্ততে”।

১৮৩৮ বা ১৮৩৯—এ একজন প্রাচ্যের সংস্কৃত বিদ্যার্থী ভূগোল-খগোল পরিক্রমায় সময় ব্যয় করছেন এবং এই ধরণীর নানা দেশের অনুপুঙ্খ বিশ্ল্বেষণে ব্রতী হয়েছেন—যখন যোগাযোগের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে যত কম বলা যায়, ততই ভালো—তখন তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। মনে রাখতে হয়, সব যুগেই আঠারো বা উনিশ রোমান্টিকতায় ভরা থাকে। সেই আঙ্গিকে বিচার করলে এক পুরোপুরি বিপরীত মেরুর মানুষের নাগাল পান উত্তর প্রজন্মের পাঠক। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের পাঠকের মনে বিহ্বল আনন্দের ঘোর। পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত—র অধ্যবসায়ী বিদ্যার্থী যখন কলকাতা থেকে আমেরিকাকে শ্লোকবন্দি করেন এবং দ্রুত এগিয়ে যান অনেক অনেক দূর দেশের ভিতরে—যেসব দেশের অজানা, অচেনা পথঘাট আজ নতুন চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত, তখন মনে হয় কতদিন আগে তিনি তাঁর দেশবাসীকে উজ্জীবিত করতে কলম হাতে নির্বিকার চিত্তে সময় অতিবাহিত করেছেন।

এটা ঠিক যে তাঁর বর্ণনার সঙ্গে গ্রন্থে বর্ণিত দেশসমূহের মিল এতদিন পর খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার; তথাপি দূর থেকে খুঁটিয়ে দেখার প্রবণতা ও আধুনিক মনন, বিভিন্ন দেশের নাম, জনপদের বিবরণ, নদী—পর্বতমালার নির্ভুল বিবরণ দিয়ে তিনি ভূগোল নিয়ে চর্চায় রত মানুষজনের কছে এক শাঁখ বাজানো ভগীরথ—এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। বস্তুত, তাঁর দেখা কলকাতাও আজ আর সেই কলকাতা নেই; ভিতরে ও বাইরে দুয়েতেই তার আমূল সংস্কার ও পরিবর্তনের ছাপ। কিন্তু ২০১৬—র পাঠক যখন জানতে পারেন, এই কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বিদ্যার্থীর বিশ্ববর্ণনে ও বিশ্বচিন্তনে মগ্ন, তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। অন্তরাত্মা নিজেকে প্রশ্ন করে ‘চিনতে পারছো’ উত্তরও পায় ‘সোহহম্‌’—আমি সেই। সুতরাং দৃষ্টিকে কেবল সামনে প্রসারিত করো, পথ চলো।

প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার তীর্থভূমিতে অধ্যয়নকারী বিদ্যার্থী যখন পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত—কে উপজীব্য করে লেখালেখি করেন, তখন কোনও বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না। কিন্তু যখন দেখা যায়, প্রাচ্যবিদ্যার সীমারেখার সংবিধান যাই হোক—না কেন, একটি কথা স্পষ্টভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, কেবল দেশের মৃত্তিকারসে সিঞ্চিত নিশ্চিত উপাদানই ভূগোল/খগোল বর্ণনার খাঁটি উপাদান নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যভেদে উভয়বিধ বিদ্যাকে একক কাঠামোয় সংযুক্ত করা জরুরী; এবং যদি তা সম্ভব তবেই ভূগোল/খগোল চর্চার ধারাবাহিকতার সূত্র খোঁজা সম্ভব হতে পারে—তখন আমাদের মনে হয় ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচ্য গণ্ডির সংকীর্ণতা হতে মুক্ত হয়ে বিশ্বজনীন ভাবনাকে বরণ করতে শিক্ষা দিচ্ছেন (শ্লোকসংখ্যা ২৩০—২৭৯ দ্রষ্টব্য)।

পুরাণ সাহিত্য তার যথোপযুক্ত মর্যাদা লাভ করুন, কিন্তু তথাপি অন্যান্য দেশে ভূগোলচর্চা কি রূপ নিচ্ছে, কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে এবং তার সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরীদের চিন্তনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কতদূর বিস্তৃত, তার সবটুকে তিনি মেলে ধরতে চেয়েছেন। এই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের সামান্য প্রয়াসও এক সার্বজনীন দ্যোতনা লাভ করেছে। এই গ্রন্থে সমগ্র শ্লোকাবলির মধ্যে একটি জীবন্ত মন যেমন পাঠক পেয়ে যান, তেমনই পান ভূগোল/খগোল চর্চার এক নিষ্ঠাবান অধ্যবয়সীকে। নিশ্চিতভাবেই এখানে কাব্যবোধের অপেক্ষা ভূগোল বোধের দৃষ্টিভঙ্গি বড়ো। একজন আধুনিমনস্ক ব্যক্তির পক্ষে এই জীবনদৃষ্টির যে প্রয়োজন যে কতখানি জরুরি, তা সহজেই অনুমেয়।

কবে ১৭৮১ সালে জনৈক হর্ষেল সাহেব (William Herschel) দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে ‘জর্জিয়ম্‌’ নামক এক গ্রহ আবিষ্কার করেছিলান এবং তাঁর নামেই সেই গ্রহ ‘হর্ষেলসংজ্ঞয়া’ লোকমুখে প্রচারিত তা জানাতেও তিনি দ্বিধাহীন। আধুনিক ভূগোলে এরই নাম Uranus। বস্তুত শ্লোক রচনার থেকেও আদর্শ সাধনাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাণপণে। ভূগোলচর্চায় ইউরোপীয় মতকে গ্রথিত করে তিনি নিজের প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের নিরবচ্ছিন্ন ধারাকে যে ভবিষ্যতে রক্ষা করবেন, তার যেন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। এক বিস্তৃত পারস্‌পেকটিভের মধ্যে পাঠককে নিয়ে গিয়ে তুলনামূলক অধ্যয়নের দরজাটা খুলে দিলেন। মনে রাখতে হয়, এই ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বসূরি ছিল না। তিনিই প্রথম, যিনি পুরাতন ভূগোলের উপকরণের সঙ্গে ইউরোপীয় মতের উপস্থাপনা করে আধুনিক চেতনার উন্মেষে সহায়ক হলেন। 

এই গ্রন্থে সূর্য থেকে দূরত্ব অনুসারে যে—গ্রহপুঞ্জ বর্তমান, তাদের ক্রমান্বয়ে উল্লেখ যথাযথভাবে করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে সুবিদিত ছয়টি গ্রহ যথাক্রমে বুধ (Mercury), শুক্র (Venus), মহী (Earth), ভৌম/মঙ্গল (Mars), বৃহস্পতি (Jupiter) এবং শনি (Saturn)—২৩৮ সংখ্যক শ্লোকে নির্দেশিত। বুধ গ্রহ সূর্যের সব থেকে কাছে (closest to the sun) বলে প্রথম স্থান পেয়েছে। আমরা পূর্ব অনুচ্ছেদেই Uranus—র কথা জেনেছি। এই গ্রহ ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত বলে ঈশ্বরচন্দ্র যথাযথভাবেই একে নির্দেশ করেছেন, যেহেতু ওঁর শ্লোকাবলির রচনাকাল ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। পক্ষান্তরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদ Johann Galle কতৃক আবিষ্কৃত Neptune—এর উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই রচনাকাল অনুযায়ী অনুল্লিখিত। 

পৃথিবী (পৃথ্বী) সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা সময় নেয় যাকে বছর বলে—“বেষ্টইয়ত্যভিতো ভানুং স সংবৎসর ইহোচ্যতে” (২৪৪ সংখ্যক শ্লোক)। কিন্তু আমরা নিজেদের সুবিধের জন্য ৩৬৫ দিনে বছর গণনা করে থাকি এবং প্রতি চার বছর অন্তর 
(৬ X ৪ = ২৪ ঘন্টা) বাড়তি পাওয়া যায়। এই অতিরিক্ত দিনটি ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্ত হওয়ায় প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি হয় ২৯ দিনের। যার ফলে চার বছর অন্তর গণনার সময় ৩৬৬ দিন ধার্য হয়। একে ইংরেজিতে বলে Leap Year. পৃথিবী তার নিজের কক্ষপথে পরিক্রমণের সময় সূর্যাভিমুখী অর্ধাংশ আলোকিত হওয়ায় দিন এবং অবশিষ্ট অনালোকিত অংশ হল রাত্রি। আমরা ঈশ্বরচন্দ্রের বক্তব্য শুনে আধুনিক ভূগোলের তুলনামূলক আলোচনা করলে সমৃদ্ধ হই। ঈশ্বরচন্দ্র বলেছেন—


তত্রার্কাভিমুখে ভাগে তৎকরস্পর্শনাদ্দিনম্‌ ।
তদন্যত্র তু রাত্রিঃ স্যাৎ তদভাবাদিতি স্থিতিঃ ।।

(২৪৬ সংখ্যক শ্লোক)।


এবার আধুনিক ভূগোলের বর্ণিত অংশে নজর দিই :


“When the earth rotates on its axis, only half of it gets light from the sun at a time. The half which faces the sun has daylight, while the half which is away from the sun experiences night.”


বস্তুত, যদি পৃথিবী তার নিজের কক্ষপথে পরিক্রমা না—করত, তবে এর অর্ধাংশ এত চিরস্থায়ী দিন এবং অবশিষ্ট অংশে হতো চিরস্থায়ী রাত্রি। 

গ্রন্থভার লাঘব করতে তিনি যে বহু বিষয়ের উল্লেখ করেননি, তা নির্দ্ধ্বিধায় স্বীকার করেছেন। কারণ, ভূগোল/খগোলের ব্যাপকতা বিষয়ে তিনি সচেতন। সেই কারণে এই দীনতার অনুভূতিটুকু তাঁকে মানবিক গুণে ভূষিত করেছে। যেমন—‘সংক্ষেপাৎ’ পদটি তিনবার যথাক্রমে—৫, ৩১৩ ও ৪০৪ সংখ্যক শ্লোকে; ‘সংক্ষেপেতঃ’ দু’বার ১৭৫ ও ৩৯৮ সংখ্যক শ্লোকে; ‘সংক্ষেপেণ’ চার বার যথাক্রমে ৩১৩, ৩৮১, ৩৯৬ ও ৩৯৮ সংখ্যক শ্লোকে ; ‘সংক্ষেপেণাধুনোচ্যতে’ দু’বার যথা ১৪৪ ও ২৩০ সংখ্যক শ্লোকে এবং পরিশেষে ‘বাহুল্যশঙ্কয়া’ দু’বার যথাক্রমে ৩২৯ ও ৩৩৩ সংখ্যক শ্লোকে লক্ষণীয়।

শ্লোক ছন্দে লিখিত হয়। এলোমেলোভাবে যথেচ্ছ রচনাকে এজন্য শ্লোক বলে না। পাঠকের চিত্তে আনন্দের উদ্রেক করে এই ছন্দ। ছন্দের নিয়ামক হলো গুরু ও লঘু স্বর বিশিষ্ট বর্ণ বা হ্রস্ব—দীর্ঘ মাত্রা। ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌  গ্রন্থটি সুবিন্যস্ত অনুষ্টুভ্‌ ছন্দে রচিত শ্লোক মালায়। ব্যতিক্রম কেবল ১৮০ ক্রমাঙ্কের শ্লোক, যেটি উপযাতি ছন্দে রচিত। সাহিত্যরসিকরা বলেন অনুষ্টুভ্‌ ছন্দ সর্বাপেক্ষা সরল ; যেহেতু এখানে নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি বর্ণেই কেবল ফুরু, লঘু বিচার্য। এখানে দুটি চরণে আটটি করে বর্ণ নিয়ে এক—একটি পদ গঠিত। সকল পাদেই পঞ্চমবর্ণ এবং ষষ্ঠবর্ণ গুরুস্বরবিশিষ্ট। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও চতুর্থপাদে সপ্তম বর্ণ লঘু স্বরবিশিষ্ট এবং প্রত্যেক পাদের অন্যান্য বর্ণ বিষয়ে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমি গুরুস্বরকে (S) এবং লঘুস্বরকে (l) চিহ্নে চিহ্নিত করে নিম্নোক্ত শ্লোকটির ছন্দ নির্ণয় করলাম :


     
অস্তি ভারত(I)ব(S)র্ষাখ্যো / দেশস্তত্রাতি(I)বি(S)স্তৃ(I)তঃ ।

তদন্তব্বর্ত্তি(I)নো(S) দেশা / বহবঃসন্তি(I) স(S)ন্ত(I)তাঃ ।।

(২৮৬ সংখ্যক শ্লোক)


এখানে প্রতিপাদে পঞ্চম বর্ণ লঘুস্বরবিশিষ্ট এবং ষষ্ঠ বর্ণ গুরুস্বরবিশিষ্ট দেখা যাচ্ছে; এ ছাড়া দ্বিতীয় ও চতুর্থপাদে সপ্তম বর্ণ লঘুস্বরবিশিষ্ট হওয়ায় এখানে অনুষ্টুভ্‌ ছন্দ প্রতিপন্ন হলো।


পরিশেষে বলি, একটি কৃশ অথচ উজ্জ্বল গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জীবদ্দশাতেই যদি মুদ্রিত আকারে আমাদের উপহার দিতেন, তবে সেই সুরুচিমণ্ডিত আভিজাত্যের কাছে আমরা আরও বিবিধ বিষয় জানতে পারতাম। যখন গ্রন্থের শেষে দেখি তিনি বলছেন—“ন্যায়শাস্ত্রাধ্যায়িনঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্মণঃ কৃতিরিয়ম্‌”, তখন দর্পে গর্বে হৃদয়—মন ভরে ওঠে। অমূল্য এই গ্রন্থের আলোচনার মাধ্যমে আমি বাংলা গদ্যের পিতৃতর্পণ করলাম। বন্দে ঈশ্বরচন্দ্রম্‌।



তথসূত্র :



১ অগ্নিপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৯৯৯. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

২ পুরাণ পরিচয়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মডার্ন বুক এজেন্সী প্রাঃলিঃ, ১৯৭৭ 
কলকাতা ৭৩

৩ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিঃ ১৯৭৩ কলকাতা  ১৩

৪ বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বুকল্যান্ড প্রাঃ লিঃ
কলকাতা ৬

৫ বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

৬ ব্রহ্মপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৯৯৯. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

৭ সূর্যসিদ্ধান্ত, শ্রী বিজ্ঞানানন্দ স্বামী সম্পাদিত, ভারতমিহির যন্ত্রালয়, ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ, কলকাতা, ২৫ নং রায়বাগান স্ট্রীট

৮ সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালীর দান, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা ৬

৯ Canningham’s Ancient Geography of India, 1924, S.N. Majumdar, Calcutta

১০ Geographical Concepts in Ancient India, 1967, B. Dubey, The National Geography Society of India, BHU, Varanasi, 1967

১১ Longman Geography, Anuradha Mukherjee, Rupasree Mukherjee, Published by Dorling Kindersley (India) Pvt. Ltd. 2012.

১২ Studies in the Geography of Ancient and Medieval India, D.C Sircar, Varanasi, 1960

১৩ Surya-Siddhanta (Eng. Trans.) 1936, E. Burges, Calcutta

১৪ Surya Siddhanta, Ed. By Sudhikat Bharadwaj, 1991, Parimal Publications, Delhi.

১৫ The Geography of Puranas, S. M. Ali, 1966 Peoples’ Publishing House, New Delhi.

১৬ The Holy Puranas, Bibek Debroy & Dipavali Debroy, Vol. I—III, 1994, B. R. Publishing Corporation, Delhi.


0 comments:

0

প্রবন্ধ - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


সংস্কৃতির ভাষা
কুন্তল মুখোপাধ্যায়



কথা বলা। শুধু তো কথা নয়, বলাও। বলা মানে অন্যের উদ্দ্যেশে বলা। তার মানে অন্যের সঙ্গে সংযোগ তৈরী করা। বাণী তা সে। ব্যক্ত বা অব্যক্ত, সরবে, নীরবে, নিভৃতে যেভাবেই প্রকাশিত হোক, তার মূল লক্ষ্য কিছু মানুষকে শোনানো; এমনকী প্রতিধ্বনি হলেও, নিজেকে শোনানো।শোনানোটা যদি অবজেকটিভ ফ্যাক্টর হয়, তবে যা শোনানো হচ্ছে তা নিশ্চয়ই সাবজেকটিভ, এবং শোনানোটাও যাকে শোনানো হচ্ছে তার কাছে পৌঁছেই হয়ে যাচ্ছে সাবজেকটিভ। এ যেন থিসিস্‌ - এন্টিথিসিস্‌ এবং সিনথেসিসের খেলা। আর একথাও প্রায় সবাই জানে এবং মানে কথার জোরে, যুক্তির জোরে অন্যকে আনা যায় যিনি বা যারা কথা বলছেন তাদের পক্ষে। কথার জোরে বুঝিয়ে বলতে পারলে, সমাজে হিংসার প্রয়োজন হয় না। কথা বা বাণীই হলো ক্ষমতার মূল সূত্রখণ্ড। ক্ষমতা পেতে, ধরে রাখতে এবং ক্ষমতার নিরিখে সমাজকে চালাতে হিংসা ছাড়া কথাই হলো চূড়ান্ত অস্ত্র। এখান থেকেই একটা হাইপোথিসিস-এর জন্ম, সংস্কৃতির কথা বলে কিছু হয় না। কারণ কথাই সংস্কৃতির বহি:প্রকাশ; এবং সংস্কৃতি যার নিয়ন্ত্রণে, ক্ষমতাও তার নিয়ন্ত্রণে।

অতি সম্প্রতি আমাদের নাটকে, চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত কথা বা বাণী সংস্কৃতির এই ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। সদ্য সদ্য মুক্তি পাওয়া কিছু বাঙলা ছবি এবং বাঙলা নাটকের সংলাপের কথা এবং সেই কথা শুনে দর্শক-শ্রোতাদের তুমুল হর্ষধ্বনি এই ক্ষমতায়নকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। বাঙলা সংস্কৃতির একটি প্রচলিত মীথ চলচ্চিত্রে, নাটকে পুলিশ মানেই খারাপ কথা, যা শালীন নয় তা বলবে। পুলিশদের চারপাশের পরিবেশ, ক্রিমিনালদের সঙ্গে যাদের মেলামেশা তাদের ভাষার গণ্ডি ভেঙে ফেলে; কথার, ভাষার অপরাধীকরণ ঘটে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সেগুলি ব্যবহৃত হয় যখন ক্রিমিনালদের সঙ্গে কথোপকথন ঘটে সেই সময়। যখন তারা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন পরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন এমনটি বলেন না। ইদানীং কালের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তাঁর ছবিতে পুলিশ-অফিসারদের মুখে যথেচ্ছ তথাকথিত অকথ্য কথা বলিয়েছেন, “বাইশে শ্রাবণ” ছবিটিতে দুই মুখ্য প্রোটাগনিস্ট চরিত্র একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এবং অন্যজন শাস্তিপ্রাপ্ত অবসৃত পুলিশ অফিসারের মুখে অনর্গল অশ্লীল কথা জুগিয়ে গেছেন। ওই একই চলচ্চিত্রে একজন মিডিয়া সাংবাদিক পুরুষ ও পুলিশ কমিশনারের মুখে কিন্তু সফিস্টিকেটেড কথাই বলানো হয়েছে। “আলতাফ্‌ গোমস্‌” নাটকে পুঁজির মালিক ও তারই সহায়ক হয়ে ওঠার কথা, অথচ নাটকে তা নয় এমন পুলিশ অফিসারের মুখে প্রায় ওই একই ধরনের কথা বা ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। যে দর্শক-শ্রোতা এই কথাগুলো শুনছেন তাদের অধিকাংশের বেশী শ্রোতা এই সব বাণী শ্রবণে যেভাবে তুমুল হর্ষ ও উল্লাস প্রকাশ করছেন, যা একটি অনন্য সামাজিক অভিজ্ঞতা, আবার বেশ কিছু দর্শক শ্রোতা ছবিতে-নাটকে ব্যবহৃত ওই ভাষার হিংস্রতার কাছে বিনম্র পরাজিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে হয় নীরবে ধিক্কার জানাচ্ছেন বা ওই স্পেস্‌ বা স্থান ত্যাগ করছেন। এই সামাজিক অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায় এই চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার-পরিচালকদের এক ধরণের “টার্গেট দর্শক” আছেন। এই টার্গেট দর্শক স্বভাবতই নাগরিক যুবা, আরবান ইয়ূথ এবং বেশ কিছু আগমার্কা বুদ্ধিজীবি। সংযোগ সুত্রের “কে বলছেন এবং কাকে বলছেন” এই ধারণাটি এখানে স্পষ্ট, কিন্তু “কেন বলছেন” –এই বিষয়টি আমাদের আলোচনার মূল সূত্র।

গোটা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ-হিংসা-সন্ত্রাস বিরোধী ছবি হিসাবে পিকাসোর “গোয়ের্ণিকা”-র আবেদন সংযোগ সূত্রের এই – “কে-কাকে-কিভাবে-কেন” বলছে রূপকল্পের (এখনও অবধি সুস্থ সংস্কৃতির) বহিঃপ্রকাশ। উদার মানবতাবাদী ছবি হিসাবে পথের পাঁচালী, দো বিঘা জমিন, অপরাজিত, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা, ভুবনসোম প্রভৃতি আরও নানা চলচ্চিত্রের কথা বলা হয়। বাঙলা নাটক রচনার বিচারে রক্তকরবী, চাঁদ বণিকের পালা, টিনের তলোয়ার, রাজরক্ত এমনকি সাম্প্রতিক অতীতের উইংকল্‌-টুইংকল্‌-ও একই গুণে সমাদৃত। এগুলোর প্রত্যেকটিই সমাজ সাপেক্ষ বাস্তব। বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের হারানের নাতজামাই, ভিয়েতনাম, ব্যারিকেড, দুঃস্বপ্নের নগরী প্রভৃতি নাটকেও পুলিশ ও সামরিক অফিসারদের কালো চরিত্র প্রদর্শন করানোর জন্য তাদের মুখে বেশ কিছু শ্লীল নয় এমন অপশব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এই সব নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশকরা খুবই সরল ভাবে দুনিয়াটাকে সাদা-কালোয় বিভাজিত করে নাটকের চরিত্রদের মুখে এইসব কথাই যোগান দিতেন। আমাদের আলোচ্য নাটক ও চলচ্চিত্র দুটিতে এই ধরণের অপশব্দ প্রয়োগের মাত্রাগত তারতম্য অনেক প্রবল।

বিগত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে হাংরি সাহিত্য ও তাদের প্রকাশ মাধ্যম “ক্ষুধার্ত” পত্রিকায় কথা ও ভাষা ব্যবহারের এক নৈরাজ্যবাদী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনের দর্শন ছিল, জীবন সম্পর্কে একটা নতুন বোধ, নতুন চিন্তা এবং নতুন সাহিত্য ভাষা সৃষ্টি করা। কিন্তু আমাদের আলোচ্য নাটক ও চলচ্চিত্র দুটিতে নাট্যভাষার বা চলচ্চিত্রের কথ্য টেকস্‌টি জীবন সম্পর্কে কোন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় বহন করছে কী? “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত”, “উইঙ্কল-টুইংকল” সেই সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এমন এক প্রতিবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরী করেছিল যা সেই মুহূর্তে সংবেদনশীল প্রভূত মানুষের মনের রূদ্ধ আবেগের অর্গল মুক্ত করেছিল। হাংরি সাহিত্য যেমন ঘোষনা করেছিল, তাদের পত্রিকা খোলা “আধুনিকতার শবদেহের উপর উল্লাসময় নৃত্য”। হাংরি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভাষা যৌনতাকে স্বাভাবিক প্রকাশে, স্বাধীনতার বড় স্পেসে নিয়ে যেতে চেয়েছে, সদ্যপ্রয়াত নবারুণ ভট্টাচার্যে’র “হারবার্ট” তার প্রমাণ। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে ও সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটকে কাহিনীর মূল চরিত্র “বাঘারু’র” মুখের ভাষা, মঞ্চে তার স্বল্প পোষাকে উপস্থিতির সমসাময়িক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি ও চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক ভাবনার দরজা উন্মুক্ত করেছিল। কিন্তু ‘আলতাফ গোমস্‌’ ও ‘বাইশে শ্রাবণ’ নাটক ও চলচ্চিত্রে নাট্যভাষা, চলচ্চিত্রের ভাষা ও যার প্রয়োগ কোনও প্রভাব সৃষ্টি করে না, কারণ এই নাটকের ও চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রগুলি শেষ অবধি প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে যায়। ‘বস্তুসমূহের ষড়যন্ত্রময় অবস্থানের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ এবং এই বিদ্রোহ সেই জীবনের, সেই সমাজের বিরুদ্ধে, যেখানে অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ বুঝতে পারে যে সে ভূল জীবন যাপন করে চলেছে। এই আত্মআবিস্কারের পথে মানুষের মনে চেতনার সঞ্চার হয়, এবং সেই চেতনার সূত্র ধরে মানুষ চয়ন করে শব্দ যা প্রকাশ পায় ভাষায়। এই ভাষা নির্মান করতে চায় এমন এক সমাজ, যা প্রচলিত সমাজের বিপ্রতীকে দাঁড়িয়ে নিজের স্বাতন্ত্র স্পষ্ট করবে।

আমরা, ভাতের হাঁড়ি থেকে দু’টো ভাত টিপে ভাতসেদ্ধ হয়েছে কিনা, তেমনটি দেখার জন্য যে চলচ্চিত্র ও নাটকদুটিকে বেছে নিয়েছি, সেগুলির অনন্যতা তাদের নির্মান কাঠামোয়। এই নাটক ও চলচ্চিত্র বাস্তব সমাজকে দেখতে চেয়েছে নির্মাতাদের সাবজেকটিভ দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণে। “বাইশে শ্রাবণে’র” কর্মচ্যুত পুলিশ অফিসারের জীবনে মদ্যপানের মধ্য দিয়ে কনশাস্‌ লেভেল ভাঙ্গার উদ্যোগ এবং মদের বোতলকে বন্ধুভাবে গ্রহণের যে জীবনধারা, সংস্কৃতি প্রদশির্ত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে পরিপার্শ্বকে আঘাত করার গর্জন আছে, কিন্তু সত্য উদ্‌ঘাটন নেই। চারপাশের মূঢ়তা ও অন্যায় সম্পর্কে এই চলচ্চিত্রের কথ্য ভাষা তেমন সক্রিয় নয়। “আলতাফ্‌ গোমস্‌” নাটকে প্রভূত তর্জন গর্জন করে পুলিশ অফিসারটি ব্যবসায়ী পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করে। বর্তমান সময়ের আর্থ সামাজিক গতির অংশ হয়ে, রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের মধ্য থেকে নাট্য ও চলচ্চিত্র সৃক্ত করা তাদের প্রতিবাদ স্পষ্ট করতে চাইছেন, কিন্তু তার প্রভাব ও পরিমণ্ডলের বাইরে যেতে না পারার দরুন সেই প্রতিবাদ ফলবতী হতে পারছে না। বাইশে শ্রাবণের পুলিশ অফিসারটি সমাজতত্ত্ববিদ দূর খেইমের সূত্রানুযায়ী সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মহত্যা করে। আলতাফ্‌ গোমস্‌ ও পুঁজির কাছে নতিস্বীকার করে। এই দুটি চলচ্চিত্র ও নাট্য শিল্পকর্মের মুখ্য চরিত্রগুলির এবং সেই সূত্রে শিল্পকর্মদুটির মধ্যে কোনও দায়িত্ব বা রেসপনসিবিলিটির প্রশ্ন নেই। অথচ কিছুদিন আগের “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত”, “উইংকল টুইংকল” বা আরও আগের “রাজরক্ত” নাটকের মধ্যে এই দায়িত্ব বা রেসপনসিবিলিটি ছিল। প্রদর্শিত শিল্প মাধ্যমগুলির ভাষার মধ্যে, বলা কথার মধ্যে যদি দায়িত্ব না থাকে তবে সংস্কৃতির ভাষার ও অবনমন ঘটতে বাধ্য। আমরা জানি,


১। সমাজ --------------- প্রতিফলিত হয় --------------- নাটক ও চলচ্চিত্রে


কিন্তু এও জানি

২। নাটক ও চলচ্চিত্র --------- প্রভাবিত করে ---------------- সমাজকে


বাইশে শ্রাবণ ও আলতাফ্‌ গোমসের নির্মাতারা প্রথম মডেলটিকে সামনে রেখে তাঁদের কাজকে, শিল্পের ন্যায্যতা দেবেন। কিন্তু প্রথম মডেলটির মতো দ্বিতীয় মডেলটিও যে সামাজিক ন্যায্যতা ও স্বীকৃতি পায়, তা অভিজ্ঞতার নিরিখেই আমরা লাভ করি। দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারের, চায়ের আড্ডায় এবং বিভিন্ন ঠেকের আলোচনায় কী অবলীলাক্রমে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে জেনিটাল অরগ্যান-এর উল্লেখ করে কথা বলা হয়। প্রথম মডেলটির সমর্থকরা বলবেন, এই সমাজকে তারা প্রতিফলিত করেছেন নাটকে-চলচ্চিত্রে, আর দ্বিতীয় মডেলটির প্রবক্তারা বলবেন নাটক বা চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে বলেই সমাজে এই ধরণের ভাষা প্রয়োগ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল ডায়নামিকস্‌ বা সামাজিক গতিশীলতার সূত্রে নাটক ও চলচ্চিত্র-এর সঙ্গে দর্শকের সংযোগ সাধনের সূত্রটি সমাজ ও সংস্কৃতির ভিতরে প্রদর্শিত এই শিল্প মাধ্যম দুটির নিজস্ব অভিপ্রায় এবং দর্শকের স্ব-অভীপ্সা উভয়ের পারস্পরিক নিরিখেই বানানো হয়। 


৩। সমাজ--------উৎসারিত অভিপ্রায়--------নাটক ও চলচ্চিত্র ------- দর্শক 


নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা জীবনের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করার কাজেই অশ্লীল শব্দ বা অবশব্দ ব্যবহার পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন এবং কোনও দায়িত্ব না নিয়েই। ফলে সংস্কৃতির ভাষায় ও রেটরীতে বাস্তবের অর্ন্তনিহিত কোনও সত্য নেই।

কেন নেই এটা বুঝতে গেলে সমসাময়িক সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে হবে। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে রেপানিজম্‌ ও ম্যাচারিজম্‌ শুধু আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে নয়, গোটা পৃথিবীতেই বাজারী অর্থনীতির পথ সুগম করে তোলে। কেইনসীয় রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পথ বদল করে রাষ্ট্র “নুন্যতম রাষ্ট্র” বানিয়ে এই সময়ই বাজারের সার্বভৌমিকতার প্রবর্তন ঘটেছে। এই বাজারীপুঁজির দাপটে রাষ্ট্র যেভাবে আগে সমাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালত করতো তা হ্রাস পেতে থাকে। রাষ্ট্রীয়নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজার সংস্কৃতিকেও করে তোলে বাজারী সংস্কৃতি। আর এই বাজারী সংস্কৃতির হাত ধরে সংস্কৃতির আঙিনায় লুম্পেনদের আধিপত্য শুরু হয়। সূচীত হয় লুম্পেন সংস্কৃতির দাপাদাপি। সংস্কৃতির মাধ্যমগুলিতে বিশেষ করে টেলিভিসনে, সিনেমায়, থিয়েটারে, সংবাদপত্রের থার্ডপেজে এবং বিজ্ঞাপনে এই লুম্পেন সংস্কৃতি মৌরুসিপাট্টা তৈরী করে। কমে যায় খেটে টাকা উপার্জন করার প্রবণতা, বেড়ে যায় চিট্‌ফান্ডের রমরমা। সমাজ জীবনে প্রকট হয়ে ওঠে নারীর অবমাননা, শিক্ষা ও শিক্ষকের অপমান, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ। লুম্পেনরা, সমাজবিরোধীরা জানে তাদের শাসন করার কেউ নেই। এই লুম্পেনদের প্রতিনিধিত্ব করে যে শাসকশ্রেণী, তাদের প্রশ্রয়ে এবং আশ্রয়ে এক প্রশ্নহীন আনুগত্যের সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে সমাজজীবন। এমনতর সমাজ জীবনই জন্ম দেয় নিস্ক্রিয় সংস্কৃতির, আদর্শহীন দায়বদ্ধতাহীন এক জীবনধারা। একজনের অধিকার বজায় রাখতে গিয়ে অন্যের অধিকার যেন ভঙ্গ না হয়, সমাজ জীবনে এই পারস্পরিক দায়বোধ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধ সংস্কৃতির জন্ম হয়। নিস্ক্রিয় সংস্কৃতিতে এই দায়বদ্ধতা নেই। তাই সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যমগুলিও কোনও চিন্তা বিবেচনা না করেই শব্দরাজি বা ভাষা ব্যবহার করছে। গেঞ্জি, লুঙ্গি কিংবা নাইটি পড়ে যেমন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অফিসে যাওয়া যায়না, রাজনৈতিক দলের মঞ্চ থেকে হামলার ডাক দেওয়া যায় না, তেমনই প্রদর্শিত শিল্প মাধ্যমগুলিকেও খেয়াল রাখতে হয় তাদের ভোক্তার কাছে তারা কি ভাষা ব্যবহার করবেন।

এখন যে দুটি নাট্য ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনকে আমরা বেছে নিয়েছি, তাদের ভোক্তা কারা? টার্গেট দর্শক কারা? কলকাতা ও কলকাতার নিকটবর্তী শহরের মধ্যবিত্ত এবং মলসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন বেশ কিছু মধ্য ও উচ্চবিত্ত হোয়াইট কালার জবহোল্ডার, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও মানসিক অতৃপ্তিতে ভোগা মানুষজন। এদেরকে ক্যাটার করার জন্যই অবশব্দ প্রয়োগকে একটি লক্ষ্যাভিমুখী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাজারী সংস্কৃতি, ভোগবাদী সংস্কৃতির এটিই প্রাথমিক চরিত্র। মঞ্চে নাটক দেখার সময় এবং সিনেমা হলে ছবি দেখার সময় হল অন্ধকার হয়ে যাবার পর ব্যক্তিমানুষ একা হয়ে যায়, এবং অন্যদের থেকে অন্ততঃ সাময়িক ভাবে মানসিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ভোগবাদী সংস্কৃতি অবশব্দ’র প্রয়োগের দুটি মাধ্যমকে নিজের মত ব্যবহার করে ব্যক্তির অবদমিত কামনা আকাঙ্খা পূরণের চেষ্টা করে। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সামনে যা পারছে না, বা অফিসে, পাড়ার ভীড়ে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা বাধোবাধো ঠেকছে সেখানে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তীব্র গালাগাল, খিস্তি শুনে হাততালি দিয়ে ওঠা বা উল্লাস করা, এই অবদমিত কামনারই বহিঃপ্রকাশ। আর রয়েছে প্রেক্ষাগৃহে সেইসব তরুণ-তরুণীর অবস্থিতি যারা দায়বোধহীন এক নিস্ক্রিয় সাংস্কৃতিরই ফসল। প্রকাশ্যে বলতে যা বাধোবাধো ঠেকছে, অন্যের মুখে তা শ্রবণে পুলকিত হচ্ছে নিস্ক্রিয় সংস্কৃতিজাত এই টার্গেট দর্শকরা। ভোগবাদীনিস্ক্রিয় সংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে শিল্প সৃজকেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ ভাষ্য হিসাবে এই পন্থাকেই বেছে নিচ্ছেন। ভোগবাদী সংস্কৃতির অধীশ্বর বাজারে তার ক্ষমতা দিয়ে নিজের স্বার্থে সংস্কৃতির ভাষা তৈরী করছে। আর এটাও সবাই জানেন, “ক্ষমতাই ভাষাকে নির্মাণ করে।” ক্ষমতা ভাষার যে সমন্বয়ের দক্ষতা তাকে বিনষ্ট করে, ক্ষমতা সংস্কৃতির সূত্রে মানুষের যে জ্ঞান, চৈতন্য উদ্ভব হবার কথা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতা। ক্ষমতাই শেখায় ডেসডেমোনাকে হত্যা করার পর ওথেলোর মানসিক যন্ত্রণা প্রকাশ জন্য ওথেলোকে নগ্ন হতে হবে, এবং কোন প্রক্রিয়ায় ওথেলোর অভিনেতা যার নগ্নতা প্রকাশ করার অভিব্যক্তি প্রস্তুত করছেন তাও দৈনিক পত্রিকার পাতায় ফলাও করে প্রকাশ পায়। ৬০-৭০ দশকের হাংরি আন্দোলনকে ভাষার অশ্লীলতা নিয়ে শুনতে হয়েছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। অবদমিত যৌনতা বলতে সেই সময় বলা হয়ে ছিল, “তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূন্য বিছানায়”। কবিকে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা সংস্থার হাতে হেনস্থা হতে হয়েছিল। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পুলিশ অফিসার আলতাফ এবং বাইশে শ্রাবণের হতাশ অবসাদগ্রস্ত পুলিশ অফিসার নাটকে, চলচ্চিত্রে যে ভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন মঞ্চে, ছবিতে তা যে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পাচ্ছে, তা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদ প্রকাশনার আনুকূল্যও লাভ করছে। বাজারীপুঁজি, ভোগবাদী সংস্কৃতির এই সমন্বয়ের ফসল আজকের সংস্কৃতি, ভাষার অবনমন।।





0 comments:

0

প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


নাসায় আবদুল কালামের দেখা সেই ছবিটি 
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় 



প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৬২ সালে সারাভাই সাত জনের একটি দল নাসায় পাঠালেন। এই দলে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন, এ পি জে আবদুল কালাম (অ্যারোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ার), প্রকাশ রাও, বি রামকৃষ্ণ রাও, আর আরাভামুদন এবং প্রমোদ কালে (এঁরা সকলেই ছিলেন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার), এইচ জিএস মূর্তি এবং ডি ঈশ্বরদাস (এঁরা ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার)। আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমে সকলে গেলেন নাসা-তে— ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে অবস্থিত ল্যাংলে গবেষণা কেন্দ্রে (LRC)। এই গবেষণা কেন্দ্রে মূলত নাসা-র উচ্চতর মহাকাশ প্রযুক্তির গবেষণার কাজ হয়ে থাকে। এখানে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ নেবার পর আবদুল কালাম গেলেন মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্ট-এ গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে (Goddard Space Flight Centre)। নাসার পৃথিবী পরিক্রমাকারী উপগ্রহগুলির অধিকাংশেরই নির্মাণ ও মহাকাশ যাত্রা চলাচলের সামগ্রিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় এই কেন্দ্র থেকে। এরপর তিনি যান ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে (Wallops Flight Facility)। কেন্দ্রটি ভার্জিনিয়ার ইস্ট কোস্টের ওয়ালপস দ্বীপে অবস্থিত। এখানেই নাসা-র সাউন্ডিং রকেটের নক্সা তৈরি হয়। ছ’মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে কালাম দেশে ফিরে আসার ঠিক পরেই ভারতের প্রথম সাউন্ডিং রকেট ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষিপ্ত হয়। 

নাসা-র কেন্দ্র ভার্জিনিয়ার ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে থাকার সময় সেখানকার রিসেপশন লবিতে টাঙানো একটা ছবির প্রতি কালাম আকৃষ্ট হন। ছবিতে ছিল টিপু সুলতানের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধের দৃশ্য। অষ্টাদশ শতকের ঐ যুদ্ধে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল টিপু সুলতানের রকেটবাহিনী। এই রকেটের ধারাবাহিক ইতিহাস জানতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে অগ্নিবাণ-এর যুগ থেকে। 

হুস্‌। অমাবস্যার রাতে উপরে উঠে গেল একটা আলোর রেখা। তারপরেই বুম-ফটাস্‌। আকাশের বুকে ঝরে পড়ল নানা রঙের আলোর মালা, নয়তো আলোর ফুলঝুরি। কালী পুজোর রাতে এ দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। আকাশে রঙ ধরাতে হাউই বাজির জুড়ি নেই। এই হাউই বাজি প্রথম কারা তৈরি করেছিল? আমাদের দেশের উত্তরে রয়েছে হিমালয় পর্বত। সেটা পেরিয়ে ওপারে গেলেই চীন দেশ। চীনারাই নাকি প্রথম হাউই তৈরি করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে আটশো-ন’শো বছর আগে তারা বারুদ আবিষ্কার করেছিল। কারও কারও মতে আটশো-ন’শো বছর নয়, প্রায় দু’হাজার বছর আগেই তারা বারুদের ব্যবহার শিখেছিল। ছোট ছোট সরু নলে বারুদ পুরে তারা হাউই বাজি তৈরি করত। আনন্দ অনুষ্ঠানে তা পোড়ানো হত। এই আতসবাজি একদিন আকাশ থেকে নেমে এল যুদ্ধক্ষেত্রে। 

আতসবাজির মাথায় ছোট ছোট তীর লাগিয়ে চীনারা তৈরি করে ফেলল যুদ্ধাস্ত্র। ‘আতস’ কথাটা পারস্যের। বাংলা ভাষায় তর্জমা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় আগুন। বারুদ ভরা নলের পিছনে আগুন ধরিয়ে দিলেই তা ছুটে যেত শত্রু সৈন্যের দিকে। তীরের ফলার আঘাতে মারা পড়ত শত্রু সৈন্য। আর আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যেত শত্রুদের ছাউনিগুলি। এই আগুনের তীরগুলি শত্রু সৈন্য-র উপর যখন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ত তখন শত্রু শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যেত। ১২৩২ সালে মঙ্গোলিয়ানরা হোনান (Honan) প্রদেশের রাজধানী কাইফেন শহর ঘিরে ফেলে। শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য চীনারা তখন শহরের ভিতর থেকে আগুনের তীর ছুড়তে থাকে। ১২৮৮ সালে মঙ্গোলরা যখন ভ্যালেনসিয়া শহর আক্রমণ করেছিল তখন তারা আগুনের তীর ব্যবহার করেছিল। 

ভারতীয় পুরাণগুলিতে এই ধরনের অস্ত্রের উল্লেখ আছে। রাম-রাবণের যুদ্ধে শক্তিশেলের ঘায়ে লক্ষণ প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। এই মারণাস্ত্রটির যে বর্ণনা রয়েছে তা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি আগুনের তীর বা অগ্নিবাণের অনুরূপ কোনো অস্ত্র ছিল। মহাভারতেও এই ধরনের অস্ত্রের উল্লেখ আছে। গা দিয়ে আগুন বের হয় এমন সব তীর ছোড়ার বর্ণনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আছে। জরাসন্ধ রাজগীর থেকে একটা গদা ছুড়েছিল। সেটা নাকি পড়েছিল সুদূর বৃন্দাবনে। তাই দেখে কৃষ্ণ সহ সেখানকার রাজা ভয়ে গূজরাটের কচ্ছে পালিয়া যান। আর কোনোদিনই ফিরে আসেননি। জরাসন্ধের গদা কি অতি শক্তিশালী অগ্নিবাণ ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ পুরাণকাররা এই অস্ত্রগুলির নির্মাণ কৌশল কোথাও উল্লেখ করেন নি। তাই এই ধরনের অস্ত্র ভারতে আদৌ বাস্তবে ছিল কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। এগুলি লেখকদের কল্পনাপ্রসূত এমনও হতে পারে। যেমনটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হয়ে থাকে। যাইহোক, এই অগ্নিবাণ বা আগুনের তীর-ই হল আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আদিরূপ বা প্রাথমিক রূপ। 

চীনাদের এবং মঙ্গোলদের হাত ধরে অগ্নিবাণ যুদ্ধক্ষেত্রে যতই তেড়েফুড়ে আসুক না কেন পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। শক, হুন, পাঠান, মোঘল প্রভৃতি বিদেশীরা যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল তখন এদের আগুনের তীর ছুড়তে দেখা যায় নি। আলেকজান্ডারও এই অস্ত্র ব্যবহার করে নি। ভারতীয় রাজাদেরও এই অস্ত্র নিয়ে কোনোদিন যুদ্ধ করতে দেখা যায় নি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে যোদ্ধারা কেন এই অস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? কিছুটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে এর কারণগুলি খোঁজা যাক— 

(১) অগ্নিবাণের বারুদে আগুন দেওয়ার পর তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। 

(২) এক সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে এই অস্ত্র না ছুড়লে আশানুরূপ ফল পাওয়া যেত না। 

(৩) সে যুগের যোদ্ধারা নিজেদের বীর বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করত। অগ্নিবাণ যেহেতু দূর থেকে এবং আড়াল থেকে ছোড়া হত তাই সেটা তাদের কাছে বীরের মর্যাদা সম্পন্ন যুদ্ধ ছিল না। আড়াল থেকে যুদ্ধ করে কাপুরুষেরা, বীর যোদ্ধারা নয়। 

(৪) সামনা সামনি এবং সমানে সমানে যুদ্ধ করতে সে যুগের যোদ্ধারা ভালোবাসত। 

(৫) কামান আবিষ্কার। 

বাবর যখন ভারত আক্রমণ করেছিল তখন তার সঙ্গে কোনো অগ্নিবাণ ছিল না, ছিল কামান। ভারতীয় রাজারাও বাবরের সঙ্গে তীর-ধনুক, তলোয়ার, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। কামানের বিরুদ্ধে এইসব সাবেকি অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধে জেতা যাবে না সেটা বুঝতে পেরেও তাঁদের কোনো আগুনের তীর ব্যবহার করতে দেখা যায় নি। এ থেকে বোঝা যায় যে আগুনের তীর সম্পর্কে রাজাদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই তাঁরা এই যুদ্ধাস্ত্রটি নিয়ে কোনো চর্চা করেন নি। যে মঙ্গোলরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভ্যালেনসিয়া শহর আক্রমণের সময় আগুনের তীর ব্যবহার করেছিল কামান আসার পর তারাও এই অস্ত্রটি পরিত্যাগ করে। ফলে যদ্ধক্ষেত্র থেকে এর নাম ধীরে ধীরে মুছে যায়। শুধু আতসবাজী হয়ে আকাশে রোশনাই করতে থাকে। ক্রমে ক্রমে মানুষও ভুলে গেল অগ্নিবাণ বা আগুনের তীরের কথা। 

যুদ্ধক্ষেত্রে তখন কামানের রমরমা। বাবরের হাত ধরে ভারতবর্ষেও ঢুকে পড়েছে কামান। মোঘল রাজত্ব শেষ হতে চলেছে। ভারতের মাটিতে ইংরেজরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। একটির পর একটি রাজ্য তারা গ্রাস করে চলেছে। কঠিন বাধা পেল দাক্ষিণাত্যের মহীশূর রাজ্যে। সেখানকার রাজা তখন হায়দার আলি। রণাঙ্গনে দু’পক্ষই সৈন্য সাজিয়েছে। সামনের সারিতে কামানবাহিনী। গর্জে উঠল কামান, বন্দুক। ঝলসে উঠল তরবারি। দু’পক্ষ যখন তুমুল যুদ্ধে ব্যস্ত তখনই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। ইংরেজ সৈন্যরা সবিস্ময়ে দেখল আকাশ পথে ছুটে আসছে এক ঝাঁক আগুনের গোলা। ব্যাপারটা কী? যুদ্ধ তো এখনও চলছে। তাহলে মহীশূর রাজ্যে কীসের বিজয় উৎসব শুরু হল যে তারা আকাশে আতসবাজী ছুড়ছে? ভুল ভাঙল একটু পরেই। আগুনের গোলাগুলি ইংরেজ সৈন্যদের মাঝে এসে পড়তে শুরু করল। এক একটি পড়ছে আর বু-উ-ম শব্দে ফাটছে। বোমার ঘায়ে ইংরেজ সৈন্য তখন ধরাশায়ী। যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গেল তারা। মহীশূর রাজ্য জয়ের ইচ্ছে তখনকার মত তাদের পরিত্যাগ করতে হল। না করে উপায়ই বা কী। কামান-বন্দুক দিয়ে সামনা সামনি যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু আকাশ পথে আসা চালকহীন আগুনের গোলাগুলির সঙ্গে তারা কীভাবে যুদ্ধ করবে সে পথ তো তাদের জানা নেই? 

সেদিনকার যুদ্ধে হায়দার আলির সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের তাক করে কী ছুড়েছিল? কামানের দাপটে অগ্নিবাণ একদিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ঠাঁই হয়েছিল বাজীকরদের ভাণ্ডারে সাধারণ বাজী হিসেবে। লোকের মনোরঞ্জন করা ছাড়া তার আর কোনো ভূমিকা ছিল না তখন। ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে সেই অগ্নিবাণ আবার ফিরে এল নতুন রূপে। বারুদ ভর্তি চোঙের মাথায় এবার আর তীর লাগানো ছিল না, ছিল বিস্ফোরক। আজকের তুলনায় এদের পাল্লা খুবই কম ছিল ঠিকই, তবুও এদের মিসাইল বললে ভুল হবে না। ভারতের একটি ছোট রাজ্যে যে মিসাইল চর্চা চলছিল তা কারও জানা ছিল না। সেদিনকার সেই যুদ্ধে শুধু ইংরেজরাই নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছিল মিসাইলের কী অসীম ক্ষমতা। যুদ্ধে হেরে গেলেও ইংরেজরা সেদিন বুঝেছিল যে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিধর জাতি হিসেবে পরিচিত হতে গেলে যেনতেনপ্রকারে এই প্রযুক্তি হস্তগত করতে হবে। তবে যতদিন হায়দার আলি বেঁচে ছিলেন ততদিন মহীশূর রাজ্য পুনরায় আক্রমণের সাহস ইংরেজরা আর দেখায় নি। 

হায়দার আলির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান। ইংরেজরা আবার মহীশূর রাজ্য আক্রমণ করে। তারা জানত টিপুর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে পেরে উঠবে না। কারণ টিপুর হাতেও আছে মিসাইল। এই মিসাইল তাঁর বাবার আমলের মিসাইলের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। শুধু পেতল নয়, পেটাই লোহার নল দিয়ে এই মিসাইল তৈরি হত। এতে থাকত তিনটে অংশ— 

(১) দিক বা নিশানা নির্ণয় ব্যবস্থা, 

(২) গতি সঞ্চার ব্যবস্থা, 

(৩) মাথার কাছে বিস্ফোরক ব্যবস্থা। 

টিপুর মিসাইলবাহিনীতে প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল। এই বিশাল মিসাইলবাহিনীর সঙ্গে কামান-বন্দুক নিয়ে এঁটে ওঠা যাবে না বুঝতে পেরে ইংরেজরা সামনাসামনি যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনীতির আশ্রয় নেয়। ইংরেজদের কূট-চালে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরঙ্গপত্তনের যুদ্ধে টিপুর পতন হয়। এই যুদ্ধে তাঁর সেনাবাহিনী সাতাশটা ব্রিগেডে বিভক্ত ছিল। এগুলিকে বলা হত কুশুন। প্রত্যেক কুশুনে থাকত মিসাইল বিশেষজ্ঞ সেনাদের একটা অংশ। এদের নাম ছিল জুর্ক। যুদ্ধে টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ব্রিটিশদের হাতে আসে অব্যবহৃত সাতশো গোটা রকেট এবং নয়শো রকেটের অংশ বিশেষ। দেশে ফিরে গিয়ে ইংরেজরা এই রকেটগুলি পরীক্ষা করে এবং এর প্রযুক্তি বুঝে নিয়ে তৈরি করে নিজেদের রকেট। 

টিপু সুলতানের রকেট বর্ষণে ইংরেজদের পর্যুদস্ত হওয়ার কাহিনীই ধরা আছে ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে রাখা ঐ ছবিতে। এই ঘটনার কথা ভারতবর্ষ ভুলে গেলেও সুদূর আমেরিকায় সেই স্মৃতি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। মহাকাশ অভিযানে অগ্রনী মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ এইভাবে যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন ভারতীয়কে বীর হিসেবে উচ্চাসনে বসিয়েছে।


0 comments:

0

বিশেষ রচনা - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ রচনা


মহাশ্বেতা
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



কোথাও কোনও ভূমিকম্প হয়নি সেদিন। যদিও বিগত ২৮ জুলাই, বিকেল তিনটেয় তিনি চলে গেলেন। অথবা, হয়েছে কোথাও, বিশাল এই দেশের সেই অন্ধকার অর্ধাংশে, যার তরঙ্গ সৌভাগ্যবশত, আমাদের আইনক্স জীবনে কখনও পৌঁছয় না, অন্তত এখনও পর্যন্ত পৌঁছয়নি কোনওদিন।

কোনও প্রতিষ্ঠানের দাক্ষিণ্য তিনি পাননি কখনও, অথবা চানওনি কোনওদিন। কমলকুমার, অমিয়ভূষণ কিংবা মহাশ্বেতাদের প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্যের প্রয়োজনও হয় না কখনও। কখন যে তাঁকে সংবর্ধিত করে গেছে কোনও জ্ঞানপীঠ, কিংবা দেশিকোত্তম, হয়তো তা নিয়ে দুর্ভাবিত হওয়ার মতো সময়ও ছিলো না তাঁর। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নিজের গরজেই অনুবাদ করেন তাঁর ছোটগল্প আর উপন্যাস, লিখে যান তাঁকে নিয়ে পাতার পর পাতা, নিজের গরজেই, কেননা তাঁকে বাদ দিলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এক সুবিশাল দেশের বিশালতর এক জনগোষ্ঠীর সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস। আক্ষরিক অর্থেই, মহাশ্বেতা ছিলেন "প্রতিযোগিতার পরপারে", কেননা জীবনে, সৃজনে ও কর্মে তাঁর নিঃসঙ্গ মহিমা এবং উত্তুঙ্গ দূরত্ব যেন তাঁকে জীবৎ কালেই করে তুলেছিলো আশ্রয়দায়িনী কোনও অতি দীর্ঘ মহীরুহ, যেন দীপ্যমান কোনও প্রতিষ্ঠান---স্বয়ংপ্রভ, অননুকরণীয় স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।

১৯২৬ থেকে ২০১৬, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। দেখেছেন মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, উত্তাল সেই মুক্তির দশক, কত সামাজিক, রাজনৈতিক উত্থান- পতন। অনুভব করেছেন বারেবারে, যে জীবনকে আমরা নিশ্চিন্ত জীবন বলে ভুল করে সানন্দে বেঁচে আছি প্রতিদিন, তার গভীরে আসলে দুশ্চিকিৎস্য ক্ষত তৈরী হয়েছে দিনে দিনে। কেননা তার বৃদ্ধি ও বিকাশের সঙ্গে প্রাচীন এই দেশের বৃহদাংশের মানুষের জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্ক, কোনও সঙ্গতি নেই। আর তাই অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য সর্বনাশ সম্পর্কে সতর্কও করতে চেয়েছেন আমাদের, তাঁর রচনার প্রতিটি অক্ষরে। কতটা সতর্ক আমরা হলাম, অথবা আদৌ হলাম কী না, আগামীদিনের ইতিহাস হয়তো তার উত্তর দেবে। তবে এটুকু বলতে পারি নির্দ্বিধায়, আগামী সে ইতিহাস তাঁরই কলমে রচিত মানুষের ইতিহাস, প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস, সাব-অল্টার্নের ইতিহাস।

ঘটনাবহুল কোনও উপন্যাসের মতো তাঁর জীবন অথবা বর্ণময় তাঁর বিপুল সাহিত্য কীর্তি কোনওটিই আজ আমি আলোচনা করতে আসি নি, আজ এই অতিসন্নিহিত শোকাচ্ছন্ন মুহূর্তগুলি সম্ভবত তার উপযুক্ত সময়ও নয়। তবে সেদিন কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে আমার ইনবক্সে এক বন্ধুর প্রেরিত বার্তায় যখন ভেসে উঠলো তিনি আর নেই, অজান্তেই আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেলো আচম্বিতে, আর আমি দেখতে পেলাম গভীর অন্ধকারে কোনও স্তনদায়িনীর ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠলো হঠাৎ, মুষ্টিবদ্ধ হলো হাজার চুরাশির মায়ের হাত, বিস্তীর্ণ কোনও অরণ্যে কে যেন হাঁক দিয়ে উঠলো "উলগুলান" ...আর সেই মুহূর্তেই চোট্টি মুণ্ডার তীর উড়ে গেলো আকাশে।

যেতে তো হয়ই সবাইকে।আমরাও যাবো, যাই, তবে কী জানেন, সেই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখে গিয়েছিলেন না---কোনো কোনো পদচিহ্ন রঙীন/চলে যাওয়ার পরেও থেকে যায় ছাপ।।



0 comments:

1

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর




ভূগোলখগোলবর্ণনম্ 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্য়াসাগর 
সম্পাদক ও অনুবাদক—অমিত ভট্টাচার্য


উনিশ শতকের তৃতীয় দশক। সমস্ত বঙ্গদেশ এক দোলাচলের মধ্যে। সমাচারচন্দ্রিকা ইংরিজি শিক্ষার কুফল সম্বন্ধে মন্তব্য করছেন। হিন্দুকলেজ ও মিশনারিদের অন্যান্য পাঠশালায় পাঠরত চার পাঁচশ হিন্দু পড়ুয়ার মধ্যে ত্রিশ চল্লিশ জন নাস্তিক হয়েছে। অভিযোগ উঠছে ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু সন্তানরা বিপথগামী ও কদাচারী হচ্ছে। প্রতিবাদীস্বরও মুখর। চন্দ্রিকাকারকে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠার আগে বুঝি কোন কদাচার হিন্দুকুলপ্রদীপরা করতেন না? মদ্যপান, যবনীগমন ইত্যাদি অবৈধ কর্মে কোনও অপরাধ নেই, অপরাধ হ'ল শুধু কষ্ট করে লেখাপড়া শেখায়? রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছেন The Persecuted যাতে সমসাময়িক হিন্দু সমাজের চিত্র সুন্দর ভাবে ফুটে উঠছে। 

একদিকে গোঁড়ামি, ভণ্ডামি অন্যদিকে ইংরিজি শিক্ষার অভিঘাত। সমাজ জুড়ে স্বাতন্ত্র‍্য ও সত্যের মর্যাদা বোধ আর ঐতিহ্যবোধ ও লোকাচারের দ্বন্দ্ব। সন ১৮৩৮। স্থাপিত হ'ল সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা। আর সে বছরই সংস্কৃত কলেজের সচিব মিয়র পদার্থবিদ্যা বিষয়ে একশ শ্লোক রচনার বিনিময়ে একশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। কিছুদিন পর আবার ঘোষণা করা হ'ল পুরাণ, সূর্যর্সিদ্ধান্ত ও ইওরোপীয় মতের অনুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ে যে ছাত্রের রচনা সর্বোৎকৃষ্ট হবে সেও একই পরিমাণ অর্থ পুরস্কার হিসেবে লাভ করবে। 

১৮৩৯ সনে সংস্কৃত কলেজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রচনা করলেন ৪০৮ টি সংস্কৃত শ্লোকের এক সম্ভার। নাম তার ভূগোলখগোলবর্ণনম। ভারতীয় পুরাণ, প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ইওরোপীয় মত অনুসারে ভূগোল যা তার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি হ'ল এই যে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষালাভ করলেও রচয়িতা বুঝেছেন যে কেবল দেশজ মৃত্তিকা রসসিঞ্চিত উপাদান বর্তমানে ভূগোল/খগোল রচনার একমাত্র উপাদান হতে পারে না। তিনি এও বুঝছেন যে পশ্চিমে ভূগোল চর্চা নানা বিবর্তনের পর যে রূপে অধুনা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের অধিগম্য তার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের চিন্তনের সাদৃশ্য তথা বৈশাদৃশ্যের এক তুলনামূলক বিচারের মাধ্যমেই একমাত্র বিশ্বজনীন ধারাবাহিক ভূগোল চর্চাকে এক সংহত রূপে একক কাঠামোয় সংযুক্ত করা যেতে পারে। আরও অবাক করার বিষয় রচয়িতার বয়স তখন মাত্র আঠারো বা উনিশ বছর। তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম রচনা করলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধনে সৃষ্ট চিন্তন প্রক্রিয়ার এক আশ্চর্য নথি। এক অর্থে সূচনা হ'ল তুলনামূলক জ্ঞানচর্যার। 

বিনয় ঘোষ রচিত বিদ্যাসাগর ও বাঙালীসমাজ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে বিদ্যাসাগর প্রণীত গ্রন্থগুলির বর্ণনা দিতে গিয়ে ২৭ নম্বর ক্রমাঙ্কে ভূগোলখগোলবর্ণম এর উল্লেখ করে লেখক জানিয়েছেন যে এই গ্রন্থ ১৮৯৩ সালে বিদ্যাসাগরের প্রয়াণের পর তাঁর পুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্ন প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় এই গ্রন্থ বিদ্যাসাগর রচিত সংস্কৃত রচনাগুলির অন্যতম বলে অভিহিত হয়েছে। 

প্রকৃতপক্ষে ২০১৬ এর পূর্বে এই গ্রন্থটির কোনও বঙ্গানুবাদ ছিলই না। আনন্দের বিষয় এই যে অতি সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য এই অতি মূল্যবান গ্রন্থটি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করে বঙ্গীয় জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রটিকে সমৃদ্ধতর করেছেন। এ গ্রন্থের প্রকাশনার দায়িত্বভার নিয়েছেন পারুল প্রকাশনী। মূল সংস্কৃত শ্লোক গুলির পাশাপাশি সুললিত বঙ্গানুবাদ এই প্রথম এই পুস্তককে সর্বসাধারণের পাঠযোগ্য করে তুলল। সংস্কৃত ভাষা না জেনেও এখন এই গ্রন্থের রসাস্বাদন সম্ভব। 

রস কথাটি আমরা সজ্ঞানে ব্যবহার করছি। অনুবাদক তাঁর ভূমিকায় আমাদের জানিয়েছেন যে "কাব্যরচনায় সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে টানলে কাব্যরস বিঘ্নিত হয়। তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র যখন এই গ্রন্থ রচনা করেন তখন ওঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে অধীত বিদ্যার জারক রসে সিঞ্চিত করা, যা জ্ঞান ও বোধকে আলোকিত করবে" (পৃঃ ও)। বস্তত, অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্যের অতি সুলিখিত কথামুখটি তাঁর অনূদিত গ্রন্থটিকে এক ভিন্ন মাত্রা দান করে। তিনি আমাদের জানান পুরাণে উল্লিখিত 'চতুর্দ্বীপা বসুমতী' ও 'সপ্তদ্বীপা বসুমতী' এর মধ্যে বিদ্যাসাগর বায়ুপুরাণে বর্ণিত দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করেছেন। এই দ্বীপগুলি হ'ল যথাক্রমে জম্বুদ্বীপ, প্লক্ষদ্বীপ, শাল্মলি দ্বীপ, কুশদ্বীপ, ক্রৌঞ্চদ্বীপ, শাকদ্বীপ এবং পুষ্করদ্বীপ। 

আমাদের অনুবাদক জানিয়ে দেন যে ২৬১ ও ২৬২ নং শ্লোকে যখন রচয়িতা বলেন যে সূর্য থেকে ১৫৮৭০০০০০ ক্রোশ দূরে জর্জীয় গ্রহ বিদ্যমান এবং যাকে শীতাংশুবসুসপ্তেন্দু বর্ষে অর্থাৎ ১৭৮১ সালে হর্ষেলসাহবঃ/দূরবীক্ষণযন্ত্রেণ প্রাগিমং সমালোকয়ৎ অর্থাৎ হর্ষেল সাহেব দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে আবিষ্কার করেন ; যে গ্রহ হর্ষেলসংজ্ঞয়া : হর্ষেল নামে পরিচিত; তখন তিনি বলছেন জার্মান বংশোদ্ভব বৃটিশ জ্যোতির্বিদ Fridrich Wilhelm Herschel বা Fredrik Willam Herschel ( 1738 - 1822) কর্তৃক আবিষ্কৃত ইউরেনাস গ্রহের কথা। এছাড়া, আমরা এও জানি যে বিদ্যাসাগর নেপচুন এর উল্লেখ করেন নি কারণ Johann Gottfried Galle ( 1812 - 1910) ১৮৪৬ এ যে গ্রহ আবিষ্কার করবেন তার কথা ১৮৩৮ এ বসে বিদ্যাসাগরের জানার কথা নয়। 

অনুবাদক আমাদের জানান যে, বিদ্যাসাগরই প্রথম "যিনি পুরাতন ভূগোলের উপকরণের সঙ্গে ইওরোপীয় মতের উপস্থাপনা করে আধুনিক চেতনার উন্মেষে সহায়ক হলেন"(পৃঃ চ)। এই কথামুখ আমাদের পরিচিত করায় সেই চিন্তন ক্রিয়ার সঙ্গে যা বঙ্গীয় নবজাগরণের দ্যোতক। 

এই গ্রন্থ আরম্ভ হয় শাস্ত্রীয় মত অনুসারে মঙ্গলাচরণের মধ্য দিয়ে: যৎক্রীড়াভাণ্ডবদভাতি ব্রহ্মাণ্ডমিদমদ্ভুতম।/ অসীমমহিমানং তং প্রণমামি মহেশ্বরম।। এরপর পুরাণানু্যায়ী ধরিত্রী বর্ণনা। প্রস্ফুটিত পদ্মের আকার বিশিষ্টা ধরিত্রী শেষনাগের ফণামণ্ডলাসীনা; তাই তিনি অধঃপতিতা হন না : দর্ব্বীকরেশ্বরো ভাতি ভূপদ্মস্যাস্য নালবৎ।/ যৎফণামণ্ডলাসীনা নাধঃ পততি মেদিনী।। (শ্লোক ৭)। 

যুক্তিবাদ নয় মিথের প্রত্নপ্রতিমাসমাচ্ছন্ন কল্পবাস্তববিশ্বে অবস্থান এ বর্ণনার। বিজ্ঞান নয়, এ কাব্য। তাই willing suspension of disbelief এর উপজীব্য। এরপর ভারতবর্ণনায় ঈশ্বরচন্দ্র অকৃপণ : অথ ভারতবর্ষস্য সংক্ষেপাৎ কিঞ্চিদুচ্যতে।/ কর্মভূমিতয়া যদ্ধি শর্ম্মদং ধর্ম্মকর্ম্মিণাম।। (শ্লোক ৫৫) 

এরপর সংক্ষেপে ভারতবর্ষের কথাপ্রসঙ্গে কিছু বলছি, যে ভারতবর্ষ কর্মভূমি রূপে ধার্মিকদের কাছে সুখপ্রদ। এরপর অনুষ্টুভ ছন্দে রচিত শ্লোকের পর শ্লোক গরিমামণ্ডিত ভারতীয় সংস্কৃতির এক মনোরম চিত্র অঙ্কণ করে। ১৪৩ নং শ্লোকে এসে পুরাণস্মমত ভূগোল বর্ণনা শেষ হয়। এরপর থেকে ১৭৭ নং শ্লোক পর্যন্ত পুরাণস্মমত খগোলবৃত্তান্ত; ২২৯ নং শ্লোক পর্যন্ত সূর্যসিদ্ধান্তের মতবর্ণন। রচয়িতা তাঁর আকরগ্রন্থের শ্লোকগুলি নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করেছেন, স্থানে স্থানে বচনবিন্যাসের স্থানান্তর ঘটিয়েছেন। 

ভারতীয় জ্যোতির্মণ্ডল চর্চার মান্যগ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত যে সব জ্যোতির্বিদ রচনা করেছিলেন দূরবীক্ষণ আবিষ্কারের বহু পূর্বে তাঁরা কতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় : "পৃথ্বীচ্ছায়াং সমাশ্রিত্য চন্দ্রং তচ্ছায়য়া রবিম।/ আচ্ছাদয়তি রাহুর্যত্তত্তয়োগ্রহণং মতম।। (শ্লোক ২২৯) : রাহু (তন্নামক অন্ধকার) পৃথিবীর ছায়াকে আশ্রয় করে চন্দ্রকে যখন আচ্ছাদিত করেন তখন তাকে চন্দ্রগ্রহণ বলা হয়; অপর পক্ষে রাহু চন্দ্রচ্ছায়াকে আশ্রয় করে রবিকে আচ্ছাদন করলে তাকে সূর্যগ্রহণ বলা হয়। এ তো প্রায় আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কন্ঠস্বর!

এরপর ২৩০ থেকে ৪০৮ নং শ্লোক পর্যন্ত ইওরোপীয়মতে ভূগোল খগোল বর্ণনা। Heliocentric Universe ও গ্রহাদির বর্ণনার পর চারটি মহাদেশের বর্ণনা আরম্ভ। আসিয়াভিধমাদ্যন্তু য়ুরোপাখ্যং দ্বিতীয়কম।/ আফ্রিকাখ্যাং তৃতীয়ঞ্চামেরিকাখ্যং চতুর্থকং।। লক্ষণীয় বিদ্যাসাগর য়ুরোপ আর এসিয়া লিখছেন। তাঁর স্মরণে আছে তাঁর পাঠককুলের কথা। বঙ্গজ জিহ্বা শ, ষ আর স এর পৃথক উচ্চারণে অক্ষম। সবই স তার উচ্চারণে। তার ভাষামাতৃকা পল্লীদুহিতা পালিতে সবই তাই স! 

এরপর মহাদেশ অনু্যায়ী দেশের বর্ণনা। অবিভক্ত ভারত, তার উত্তরপূর্বে মহাদেশসমতুল চীন (অস্তি চীন ইতি খ্যাতো মহাদেশোহতিশোভিতঃ। শ্লোক ৩০৩), জাপান, তিব্বত, পারস্য, আরব, রুসিয়া প্রভৃতির উল্লেখে এশিয়া মহাদেশের রূপরেখা আঁকেন রচয়িতা। অতঃপর, ইওরোপের চোদ্দটি দেশের বর্ণনা যার মধ্যে ঔপনিবেশিক বয়ানের অমোঘতায় স্বভাবতই প্রধান 'প্রজানন্দপ্রদায়িনী' ইংলণ্ড। 

এরপর আফ্রিকা যার বর্ণনায় ৩৯০ নং শ্লোকে ছন্দের আনুকূল্যে কায়রো হয় কেরো এবং আমেরিকা যার প্রধান বাসিন্টন বা ওয়াশিংটন। তাঁর কথামুখে অনুবাদক এক সেকাল একাল মেলানো বিচিত্র অনুপ্রাসে এই নগরীর কথা বলেন: "এই বাসিন্টনের বাসিন্দারা বিন্দাস জীবন কাটান" (পৃঃ ঙ)! কে বলে পণ্ডিতদের সেন্স অফ হিউমার থাকে না? 

আগে একবার উল্লেখ করা হয়েছে যে এই গ্রন্থের শ্লোকগুলি অনুষ্টুভ ছন্দে রচিত। ব্যতিক্রম শুধু ১৮০ ক্রমাঙ্কের শ্লোক যেটি রচিত উপজাতি ছন্দে। এই ছন্দ সংক্রান্ত এক মনোগ্রাহী আলোচনা আমরা কথামুখটিতে পাই। আমরা বেশ বুঝতে পারছি যে আমরা আসলে দুটি টেক্সট নিয়ে কথা বলে চলেছি। কিন্তু আমরা নিরুপায়। এই গ্রন্থের এটাই বৈশিষ্ট্য। দুটি টেক্সটের সংলাপ জাত এক পূর্ণতা। 

এই গ্রন্থের মুদ্রণ পারিপাট্য বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। মূল্যও মধ্যবিত্তের আয়ত্তাধীন। ১৮৩৮ সালের ভারত তথা পশ্চিমি দেশগুলির মানচিত্রগুলি বাড়তি পাওনা। 

Comparative Literature : Theory and Practice গ্রন্থের Muses in Isolation প্রবন্ধে শিশিরকুমার দাশ লিখেছিলেন, "We want Comparative Literature, which is basically a study of literature in relation to one another, as an alternative to all kinds of exclusiveness..."। 

এই গ্রন্থপাঠের শেষে আমরা বুঝি যে কী অসাধারণ এক ধীশক্তি সেই ১৮৩৯ এ বুঝেছিল যে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা বনাম পাশ্চাত্যবিদ্যাচর্চা; দেশীয় বনাম ম্লেচ্ছ ভাষা এই জাতীয় দলাদলি জ্ঞানচর্চাক্ষেত্রে নিরর্থক। পারস্পরিক তুলনা ছাড়া কোনও বিষয়কেই পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। শুধু এই কারণের জন্যই এই গ্রন্থ অপ্রমেয়। আর, একে আমাদের মত অদীক্ষিত পাঠকের সঙ্গে পরিচিত করানোর কারণে এরপর থেকে বিদ্যাসাগর নামটির সঙ্গে অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্যের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করবে পরবর্তী প্রজন্ম।


গ্রন্থকীট 


1 comments: