2

ছোটগল্প - স্বপন দেব

Posted in













ছবি - পল্লববরন পাল


ছোটগল্প


অন্তর্ধান
স্বপন দেব




“এই রিকশা, শ্যামবাজার যায়েগা?” 

যায়গা বাবু।”  

“ঠিক হ্যায় যাও”। 
-বলেই মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নির্লিপ্ত উদাসীন হয়ে গেল ছেলেটা! বেচারা রিকশাওয়ালা খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল। ছেলেটা মানে আমার বন্ধু মৈনাক। এক স্কুলে পড়েছি দুজনে, থাকি এক পাড়ায়। আড্ডা মারি একসাথেই। কিন্তু ওকে নিয়ে সর্বদাই আমাদের সকলের ভয়।কোথায় কখন কাকে কি বলে বসবে, দেবা ন জানন্তি! আমাদের স্কুলের বন্ধুরা তখন সবাই কলেজে পড়ি। কেউ বিদ্যাসাগর তো কেউ সুরেন্দ্রনাথ বা বঙ্গবাসীতে। মৈনাক হায়ার সেকেন্ডারিতে অঙ্কে ফেল করে বসে গেল। আমাদের বন্ধু মিন্টু তখন সবে এক ক্লাস টেন এর মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মিন্টু রোজ বিকেলে শার্টের কলার তুলে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে দেশবন্ধু পার্কে যায় প্রেম করতে। মেয়েটির নাম ছায়া। মিন্টুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। 

সেদিন বিকেলেও যথারীতি মিন্টু আর ছায়া একটু আগে পিছে হয়ে আমাদের চায়ের দোকানের বেঞ্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই মৈনাক বেশ চেঁচিয়েই বলল, 
“এই ছায়া, কাল দুপুরে কার সঙ্গে অন্তহীন দেখতে গিয়েছিলে? তোমাদের দুটো মাথা এক হয়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসা আমার সিনেমা দেখার দফা রফা করে দিল! কে ছিল ছেলেটা?” 

ছায়া তো হতবাক! 

কি বলছেন দাদা? কাল দুপুরে তো আমি বাড়িতেই ছিলাম। 

“বাড়ীতেই ছিলে? ও তা হবে!” -বলে মৈনাক আবার উদাস হয়ে গেল বটে কিন্তু মিন্টু আর ছায়ার ঝগড়া উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল পুরোটা রাস্তা জুড়ে। এই রকম আরো কতবার যে মৈনাকের এই পাগলপনা বদমায়েশির খেসারত দিতে হয়েছে তা গুনে বলা যাবেনা। তবে মৈনাক সঙ্গে না থাকলে যে আমাদের আড্ডাটা ঠিকমত জমতোনা এটা ঠিক।

এরপরে যা হয় আর কি। আমরা সবাই কলেজ থেকে বেরিয়ে কেউ চাকরিতে ঢুকে গেলাম, কেউ ব্যবসায় আবার কেউবা উচ্চশিক্ষায়। মৈনাক কিন্তু একই রকম থেকে গেল। আমাদের পর আমাদের চেয়ে জুনিয়র, তারপর তাদের জুনিয়র...মৈনাকের সঙ্গীর অভাব হয়নি কখনও। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি যেমন ষোলআনা, গায়ের জোরও তেমনি। বক্সিংটা ও মন দিয়েই শিখেছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। 

সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে নীল, হঠাৎ মৈনাক এসে দাঁড়ালো সামনে। 
“হ্যাঁরে নীল, রোজ দুপুরে তোর বউয়ের কাছে কে আসে? ওর দাদা?” -বলেই উদাসীন ভাবে দাঁতে একটা খড়কে কাঠি দিয়ে খোঁচাতে লাগলো মৈনাক। 

তোর স্বভাব কি জীবনেও যাবেনা মৈনাক? তোর লজ্জা করেনা, বাপের হোটেলে খেয়ে ঐ বাচ্চাগুলোর সঙ্গে আড্ডা দিতে? 

হঠাৎ উদাসীন হয়ে যাওয়া মৈনাকের কানে কিছু ঢুকল কিনা জানিনা, নীল পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। অন্যদিন বাড়ি ফিরে নীল সুনন্দা, মানে ওর বউয়ের সঙ্গে একটু আগডুম বাগডুম খেলে নেয় চা-জলখাবারের আগে কিংবা খেতে খেতে। সেদিন কিন্তু বাড়ি ফিরেই সোজা ঢুকে গেল টয়লেটে। বেরিয়ে, “কিগো, আজ কি চা’ টা হবেনা?” 

সু একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও মুখে কিছু বললোনা। তবে রাতের ডিনার অবধি নীলকে চুপচাপ দেখে, টিভিতে নীলের প্রিয় সিরিয়াল চলছে অথচ টিভি বন্ধ দেখে একবার কপালে হাত ছুঁইয়ে বলে গেল, “কিগো, শরীর ঠিক আছে তো?” 

রাতে ঘুম আসছিলনা কিছুতেই। মৈনাকের কথাগুলো যেন পুরনো বটের মত থাবা গেড়ে বসে গেছে মনের ভেতরে। ঢক ঢক করে বার তিনেক জল খেয়ে নিল নীল। 

 “আচ্ছা, কেন আমার এইরকম মনে হচ্ছে? মৈনাক কে তো আমি চিনি। কিন্তু তাহলে ওর কথা শোনার পর থেকেই কেন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা?” 


আজ পাঁচবছর বিয়ে হয়েছে নীল আর সুনন্দার। ওদের দাম্পত্যে শীতলতা আসেনি কখনও। কিন্তু তাও, আজও ওরা নিঃসন্তান। 

সকালে উঠে মাথাটা বেশ ভার নীলের। তাই নিয়েই বেরিয়ে গেল অফিসে। ভেবেছিল অফিসের কাজে আর পাঁচজনের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করেই মনের ভেতরে জমে থাকা কালো মেঘটা উড়িয়ে দেবে। কিন্তু না, অফিসেও রেহাই নেই। ঘুণপোকার মত কি যেন একটা কুরে কুরে খাচ্ছে মনের ভেতরটা। বাবলা কাঁটায় পায়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত জেগে ওঠার মত মনের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অবিরত। এতটাই মরণ নীলিমা জমে ছিল এই মনে? 

নাঃ, দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়েই পড়লো নীল। অসহ্য গরম পরেছে আজ। গরমে মাথার চুল পুড়ে যাচ্ছে নীলের, করোটি ফেটে যাচ্ছে তবু ভ্রুক্ষেপ নেই নীলের। অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি। সোজা বাড়ি। 

দরজার সামনে অজানা অচেনা একটা চপ্পল। কলিং বেল। কি হলো, সু এত দেরী করছে কেন দরজা খুলতে? আবার বেল টিপল নীল, এবারে একটানা কিছুক্ষণ। নীলের ধৈর্য যেন লাফিয়ে পড়ছে পৃথিবীর কার্নিস থেকে। দরজা খুলছেনা কেন সু? চপ্পলটা কার? কে আছে ঘরের ভেতরে? মাথা ঘুরছে নীলের। মনে হচ্ছে যেন চারদিকে মহাশূন্য, অজস্র তারা ও গ্রহাণু, প্লাজমার মতো নীহারিকা…বাতাস নেই, শব্দহীন মনের অস্থিরতার কোনও সাক্ষী নেই। অগোছালো শাড়ি, বিস্রস্ত চুল, মুখে প্রশান্ত তৃপ্তির ছাপ, হন্তদন্ত হয়ে এসে দরজা খুলল সু। যতই বয়স বাড়ছে ততই যেন রূপ খুলছে সু’এর। তাকে দেখে সু কি একটু নার্ভাস হয়ে গেল? মনে হলো নীলের। 

“বাইরে রাখা চপ্পলটা কার সু?” 

লিভিং রুমের সোফায় মুখে খবরের কাগজ ঢাকা এক অবয়ব। 

“তোমার দরজা খুলতে এত দেরী হলো কেন? আর সোফায় বসে উনি কে?”

আমি শাড়ি পরছিলাম তো। আর উনি তো তোমার বাল্যবন্ধু। উনিই তো বললেন যে আজ নাকি তুমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবে দুপুরে আর আমরা সবাই বাইরে লাঞ্চ করব। তাই তৈরী হচ্ছিলাম। 

“কে আমার বাল্যবন্ধু? কে বলেছে, যে আজ আমি তাড়াতাড়ি অফিস থেকে এসে বাইরে লাঞ্চ করব? ...এই যে, শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কে মশাই? মিথ্যে পরিচয়ে আমার বাড়িতে ঢুকে আমার স্ত্রীকে আজগুবী গল্প শোনাচ্ছেন? পুলিশে খবর দেব?” 

নাটক শুরু হওয়ার আগে হলের পর্দা যেমন ধীরে ধীরে দুপাশে সরে যায়, অবয়বটির মুখের সামনে থেকে তেমনই ধীরে ধীরে খবরের কাগজের পাতা দুটি দুপাশে সরে গেল। 

“শালা, মৈনাক তুই? এবার বাড়িতে হানা দিয়েছিস হারামি? ও নিশ্চয় তোমাকে আমার নামে অনেক কথা বলেছে। তাইনা সু?” 

না তো! উনি তো বরং তোমার প্রশংসাই করছিলেন এসে থেকে।”  

“আমি কিন্তু এবার সত্যি পুলিস ডাকবো মৈনাক!” 

মনে হয় তোকে আজ পুলিসই ডাকতে হবে নীল। রাগ করিস না। ঐ সোফাটায় বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে। আর সু, তুমি আমাকে একটু শরবত খাওয়াতে পারো? লেবুজল হলেও চলবে।”  

গা’টা রি রি করে উঠল নীল এর। সুনন্দাকে সু বলে ডাকতে শুরু করেছে? 

ঘরে ইয়োগার্ট আছে দাদা, একটু লস্যি বানিয়ে দিই?”  সুনন্দা জিগ্যেস করল। 

বা! তাহলে তো দারুণ হবে! 

শেষ বসন্তের যে হাওয়াটা মাঠঘাটের ফসল ছুঁয়ে নীলের ঘরে মৃদুমন্দ বইছিল, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আবার অরণ্যে ফিরে গেল! মৈনাকের মতলব ঠিক বুঝতে না পেরে, ওর নির্দেশিত ওর বিপরীতে রাখা সোফাটায় গা এলিয়ে দিল নীল। মৈনাকের কথায় মনে হচ্ছে ও যেন তাদের আবাল্য সম্পর্ককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছে। মৈনাক আবার নীলের দিকে তাকাল। 

হ্যাঁরে নীল, আজ যে দুপুরে অফিস কাটলি, তা কি বলে এলি? 

“তাতে তোর দরকার কিরে?” 

অ্যালিবি…অ্যালিবি… বুঝলি? 

“মানে? অ্যালিবাই কিসের? আমি কি খুন করেছি নাকি? যত্ত সব আলবাল কথা!” 

করিস নি এখনও, তবে করবি।”  

সু এসে লস্যির গ্লাসটা নামিয়ে দিল সেন্টার টেবিলের ওপর। মৈনাক লস্যির গ্লাসে একটা সিপ দিয়ে পাঞ্জাবীর বাঁ পকেটে হাত ঢোকাল। সন্তর্পনে একটা ছোটো পুরিয়ার প্যাকেট খুলে সাদা রঙের কি একটা গুঁড়ো ঢেলে দিল গ্লাসে। তারপরে খুব ছোটো করে একটা চুমুক মেরেই বিষম খাওয়ার মত করে মুখের ভেতর থেকে লস্যিটা বমি করার মত বার করে দিল সোফার ওপর। লস্যির সাদা রঙ আর সোফার লাল কুশনে যেন আলপনার দাগ কেটে গেল। 

“দিলি তো সোফাটার বারোটা বাজিয়ে? মাত্র গত মাসেই কিনেছিলাম হোমল্যান্ড থেকে। নাও সু, তোমার অতিথিকে আরও একটু লস্যি দাও!” 

ভ্রু এর ভঙ্গীতে সহাস্য সম্ভাষে মৈনাক বলল, মাথা গরম করিস না নীল। তোর এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমি ওটা ইচ্ছে করেই করেছি।”  

“ইচ্ছে করে করেছিস? কেন বে? আমার ওপর তোর এতো হিংসে কেন? বেরো এক্ষুনি বাড়ি থেকে!” 

আমি বেরিয়ে গেলে কিন্তু তুই আরো পস্তাবি নীল। 

“কেনো বে? তুই কি ছিঁড়বি আমার?” 

নীলের লিভিং রুমের দেওয়ালে টাঙানো দুটো চিত্রল হাঁসের দিকে তাকিয়ে, লস্যির গ্লাসটা তুলে এবার বেশ আয়েশ করে একটা চুমুক মারল মৈনাক। নার্সারির ইউক্যালিপ্টাসে ঝির ঝির করে জল দেওয়ার মত শব্দ করে হেসে, গলার স্বরটা নামিয়ে মৈনাক বলল, বউয়ের সামনে মুখ খারাপ করিসনি নীল। একটু আগে লস্যির গ্লাসে আমি কি মেশালাম জানিস? ওটা স্ট্রিকনিন। বিষ। আধঘন্টায় ভবযন্ত্রণার শেষ। 

“কি? কি? কি বলছিস তুই? কেন মৈনাক? কি হয়েছে তোর?” 

এবার নীল সত্যি ভয় পেয়েছে। 

সোফার ওপর পড়ে থাকা আমার বমিটা পুলিস ফরেনসিকে পাঠাবে।আর এই গ্লাসে তোর বউএর আঙুলের ছাপ। না না! গ্লাসটা ধুয়ে ফেললে বিপদ আরও বাড়বে। আমার স্টমাকে লস্যি আর সামনে কোনও গ্লাস নেই? বা তাতে কোনও আঙুলের ছাপ নেই? আর তোর এই হঠাৎ করে ভর দুপুরে অফিস থেকে বাড়ি চলে আসা? এর কি কৈফিয়ত দিবি? আর আমার লাশটা গায়েব করে দিলে কিন্তু আরো বিপদে পরবি নীল।”  

টেবিলের ওপর পড়ে থাকা লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাল মৈনাক। নীল ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। এটাও কি মৈনাকের আরেকটা চালাকি? নীল এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মৈনাকের দিকে। ওর আঙুলে এখন রুষ্ট তারার লাল সিগারেট, ওর কপালে অন্ধকারের ঘ্রাণ, মৈনাকের চোখ দুটো যেন কি খুঁজে বেড়াচ্ছে দূর নীহারিকায়। 

নীল চুপ করে বসে আছে। মৈনাক এবার এক চুমুকে পুরো গ্লাসটা সাবাড় করে দিয়ে একটা হেঁচকি তুলল। যন্ত্রণার একটা আভাস নষ্টমূল কিশোরীর হাসির মত ছড়িয়ে পড়লো মৈনাকের মুখে। তার কিছুক্ষণ পরে আর একটা। তারপর ঘন ঘন। তারপর একটানা হিক্কা তুলতে তুলতে সোফায় গড়িয়ে পড়লো চোখ বুজে যন্ত্রণাকাতর মুখে পেট টিপে। নীল এবং সু দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নীলই প্রথম উঠে মৈনাকের কাছে গেল। 

“কি হল তোর, মৈনাক?” 

সাড়া নেই। নীল বুকে হাত দিয়ে দেখল। ধুকপুক করছে তবে মনে হচ্ছে যেন খুব ক্ষীণ। আর এটা কি? মৈনাকের কষ দিয়ে গাঁজলার মত একটা ফেনা বেরোচ্ছে। নীলের মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। কি করা উচিত এখন? ডাক্তার না পুলিস? পুলিস না ডাক্তার? ডাক্তার? পুলিস? ডাক্তার? হ্যাঁ পুলিসই। সব খুলে বলবে নীল। 

সু তুমি এক কাজ কর, তোমার দাদাদের আর জামাইবাবুদের এক্ষুনি চলে আসতে বল আমাদের এখানে। আমাদের লোকবল চাই এখন। আর তোমার জামাইবাবুর কোন এক বন্ধু পুলিশে আছেন না? ওনাকেও সঙ্গে আনতে বল। হ্যালো, বটতলা থানা? আমি নীল মুখার্জি বলছি…না না নীল, এন ফর নটি। হ্যাঁ, শুনুন আমার ঘরে এইমাত্র একজন বিষ খেয়েছেন। না না, আমার স্ত্রী নয়, আমার এক বন্ধু। না না…আমার বন্ধু, বউয়ের নয়। প্লিজ আপনারা চলে আসুন। না না বেঁচে আছে এখনও। কি বলছেন, হাসপাতাল? অ্যাম্বুলেন্সে করে? ঠিক আছে আমি হাসপাতালে গিয়েই ফোন করব আবার। ছ নং ছিদাম মুদি লেন। থার্ড ফ্লোর। সু, কাকে ফোন করছ এখন? প্লিজ জিগ্যেস কর অ্যাম্বুলেন্স কোথায় পাওয়া যায় আর কিভাবে? ফোন নং টা নাও…তাড়াতাড়ি…হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি বল আমি লিখছি। ওকে। হ্যালো অ্যাম্বুলেন্স? ভাই আমার এক্ষুনি একটা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে। ছ নং ছিদাম মুদি লেন থেকে আর জি কর হাসপাতালে যাব। নীল মুখার্জি। আধঘন্টা? না না একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ। ওকে থ্যাঙ্ক ইউ।”  

সু এখনো ওর দাদাদের সঙ্গে কথা বলছে। নীল মোবাইলটা টেবিলে রেখে উঠল। বমি পাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে। টয়লেটে ঢুকল নীল। ওয়াক ওয়াক করে বেশ কিছুটা বমি করে বেসিনের কল খুলেই লিভিং রুমে ফিরে এলো নীল। মৈনাক এখনও শুয়ে আছে একই ভাবে। মুখ দিয়ে গাঁজলা কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সোফার ওপর। সু এর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো সু এখনও ওর জামাইবাবুকে ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিচ্ছে ফোনে। নীল এখন চোখে ঝাপসা দেখছে কিন্তু তার মধ্যেই কানে এলো অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের আওয়াজ। কাঁদতে কাঁদতে ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স। ব্রিজের মুখে জট, ফ্লাইওভারের নীচে মার প্যাঁচ, দিশেহারা ভীড় বাড়ি ফিরতে গিয়ে জট বেধে গেছে সুতোর মত। কেউ আর জায়গা দেয়না অ্যাম্বুলেন্সকে। মৈনাকের দিকে চেয়ে দেখল নীল। যন্ত্রণায়, নাকি বিষের প্রতিক্রিয়ায় মৈনাকের দু’-ঠোঁট নীল। কাঁদতে কাঁদতে ধীর গতিতে এগোচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। দু’পাশে ভীড়ের হল্লা, ঝাঁকামুটে, ট্রাকের নিঃশ্বাস। মৈনাকের মুখের ওপর ঝুঁকে আছে নীল। কষ বেয়ে ফেনা।

অবশেষে হাসপাতাল। ট্রলি। এমার্জেন্সি। কিন্তু ডাক্তার কই? গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে এক ছোকরা ডাক্তার মৈনাকের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া গাঁজলা দেখেই বলে উঠল, পুলিস কেস। দাঁড়ান, আগে পুলিস আসুক। কে এনেছে একে? 

“আমি। মানে আমার বাড়িতেই ও কি যেন একটা পুরিয়া শরবতে মিশিয়ে খেয়েছিল”। 

নীলের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে থাকা ছোকরা ডাক্তারের চোখেমুখে কেমন যেন এক সন্দেহের গন্ধ পেল নীল। 

“আমি পুলিস কে জানিয়েই এসেছি। ওরাই বলল আগে হসপিটালে নিয়ে যেতে। আমি এখুনি আবার ফোন করছি থানায়। 

আপনাকে কিছু করতে হবেনা। আপনি নিজের নামধাম ওখানে গিয়ে লেখান আর তারপরে অপেক্ষা করুন।  

একটা কাউন্টারের মধ্যে বসে থাকা কিছু লোকের দিকে আঙুল তুলে বলল ডাক্তার। সেখানে নামধাম, নীলের সঙ্গে মৈনাকের সম্পর্ক লিখিয়ে এসে দেখে ডাক্তার নেই। মৈনাক তখনও টেবিলে শুয়ে, চোখ বন্ধ।

অসম্ভব। আমার পক্ষে অসম্ভব সেই গতকাল সন্ধ্যে থেকে আজ এই পড়ন্ত বিকেল অবধি এত টেনশন, এত দুশ্চিন্তা, এত মানসিক নিপীড়ন সহ্য করা। নিজের সঙ্গে নিজেই একটু কথা বলে হাল্কা হতে চাইছে নীল। নিষ্প্রাণ নীলের মধ্যে অনন্ত রহস্যে কাটা-ঘুড়ি পতনের শেষ প্রান্তে এসে চিত্ত ঠিক রাখা সত্যিই অসম্ভব। 

“যা হয় হোক, আমার এখন দরকার একটু বিশুদ্ধ বাতাস আর ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা”। 

হসপিটালের ওষুধগন্ধী এমার্জেন্সি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলো নীল। এক ঝাঁক লুম্পেনের জটলা বাইচুং ভুটিয়ার মত পাশ কাটিয়ে এলোমেলো রাস্তা ধরে দেশবন্ধু পার্কের দিকে হাঁটা দিল নীল। পার্কের ভেতরে নিভন্ত গাছেদের মাঝখান দিয়ে কপোত-কপোতীদের পেছনে ফেলে সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে গেল নীল। একটা রাধাচূড়া গাছের তলায় পাতা বেঞ্চে বসে চা ওয়ালার কাছ থেকে কেনা গরম চায়ের ভাঁড়ে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে জীবনের তাপ নেওয়ার চেষ্টা করছে নীল। বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে বসে থাকার পরে নিজের অজান্তেই হাতঘড়িটার দিকে চোখ পড়ে গেল নীলের। “ইস! সাতটা বেজে গেল?” চুম্বনের তীর থেকে ফিরে আসা ঠোঁটের মত নীল আবার এগিয়ে চলল হসপিটালের দিকে। প্রায় একান্ন মিনিট মৈনাককে একা ফেলে চলে গিয়েছিল নীল। 

হসপিটালের এমার্জেন্সিতে ঢোকা মাত্রই সেই ছোকরা ডাক্তার নীলকে দেখিয়ে পুলিসের ইউনিফর্ম পরা থানার বড়োবাবুকে বললেন, এই সেই লোকটা! এই নিয়ে এসেছিল আবার এই নিয়ে গেছে কোথায়!! 

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীল বলল, “আমি তো চা খেতে আর ইয়ে করতে গেছিলাম! কেন? কি হয়েছে মৈনাকের?” 

লাশটাকে কোথায় গায়েব করে দিয়ে এলেন নীল বাবু? 

“লাশ? কোন লাশ? মৈনাক মরে গেল? আপনি কোথায় চলে গেলেন ডাক্তারবাবু?” 

হতভম্ব মৈনাক বিড়বিড় করে যেটা বলল সেটা অন্য কেউ শুনলো কি? 

“থানায় চলুন, সব বের হয়ে যাবে মুখ থেকে” -বলেই নীলের কলারটা ধরে একটা চড় কষাতে উদ্যত বড়োবাবু। 

আর ঠিক সেই অন্ধকার ষড়যন্ত্রী মুহুর্তে পাজামা’র দড়ির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এল মৈনাক! মুখে সেই একটা টুথপিক আর দু চোখে উদাসীন দৃষ্টি নিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার চপ্পলটা বোধহয় তোর বাড়ির দরজার সামনেই পড়ে আছে নীল। 

তারপরেই ডাক্তার আর থানার বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে, “নীলটা এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেল! ওকে বললাম চল 'হাসপাতাল'টা দেখে আসি। বলার পরেই আমি চোখে অন্ধকার দেখি। আমার একটু মৃগী ব্যারাম আছে। শুনেছি যে 'হাসপাতাল' মুভিটা খুব ভালো হয়েছে, আর ও ব্যাটা আমাকে সত্যিকারের হাসপাতালে নিয়ে এলো! তা এলামই যখন হাসপাতালে, ডাক্তারবাবু, একটু দেখে দেবেন আমায়? আমার না, ইদানীং স্বপ্নে মৃদু শ্বাসকষ্ট হয়, স্বপ্নেই কেবল হয় এটা!



2 comments:

  1. দারুণ স্বপনদা, অসাধারণ।

    ReplyDelete
  2. Amar Bhattacharya er LAL TAMSUK theke bemaloom onek onek paragraph jheRe "amar joubon bela" ta likhlen! faltoo lok to apni!

    ReplyDelete