0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জল রেখা ১০ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



হঠাৎ প্রচণ্ড কষ্টে ঘুম ভেঙে গেলো নিরূপের। অসহ্য ব্যথা হচ্ছে বুকে পেটে। দুর্বল শরীরেও বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেলো টয়লেটের দিকে। যা খেয়েছিল ডিনারে সব উঠে আসতে লাগলো যন্ত্রণাদায়ক অম্লতার সঙ্গে। তবুও বমি হয়ে যাবার পরে অনেকটা হাল্কা বোধ করলো নিরূপ। মুখে চোখে জল দিয়ে এসে আবার শুয়ে পড়লো। ভাবছিল সে... তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা কমে গেল তাঁর শারীরিক কষ্ট বমনের সাথে সাথে। কিন্তু অতীতের যা ভুলভ্রান্তি, সে সব কি বিষের অণু পরমাণু হয়ে ভেঙে ভেঙে মিশে গিয়েছে তার শরীরে? কোনওভাবেই কি কোনও পথ খোলা নেই সেই সব ভ্রান্তি থেকে নিষ্ক্রমণের? হয়ত বা কোনও এক অদ্ভুত সময়ে তারা সব একত্রিত হয়ে মরণবাণের মত তাকে প্রত্যাঘাত করবে। হয়ত সেই জন্য সে পালিয়ে থাকতে চায় তার অতীত থেকে। ঘুমাবার চেষ্টা করছিল সে। পারছিল না। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল তার তন্দ্রা। কখনও বা মনে আসছিল সেই অতীতের দিনগুলি। 

ঠিকঠাক তারিখ মনে পড়ছিল না তার। কত বছর আগে? চোদ্দ বছর? হ্যাঁ, তাই হবে। চোদ্দ বছর আগেই তার পোস্টিং হয়েছিল সেই পাহাড়ঘেরা শহরতলিতে। ‘সেখানে মেঘ গাভীর মত চরে’... হ্যাঁ, নিরূপ কবিতা ভালবাসত খুব। দুনিয়াটা অন্যরকম এক গোলাপি ভালবাসার চশমায় দেখত। কলেজ জীবনে সেভাবে কোনও মহিলাকে ভাল লাগেনি তার। মেয়ে ক্লাসমেট যারা ছিল তাদের বন্ধু ভাবলেও সেরকম বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি কারও সাথেই। সে যেন অপেক্ষায় থাকত কোনও এক মানসীর। যাকে কখনও সে দেখেনি, কিন্তু হঠাৎ কখনও দেখা হবে তার সাথে মাঝরাস্তায়। দমকা হাওয়ায় সরে যাবে সেই মানসীর মাথার ওড়না। চকিত চাহনিতে হঠাৎ হবে চার চোখের মিলন। সেই সময়ে বাতাসে মিশে যাবে ফুলের সুগন্ধ; সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে বেজে উঠবে মধুর সঙ্গীত,... এরকমই ভাবত সে। পরে যতবার নিজের এই ভাবনার কথা সে ভেবেছে, হাসি পেয়েছে; করুণা করেছে নিজেকেই। হয়ত বা ভাবনার ভুলের জন্যই মানুষ নিজের জীবনে অনেক ভ্রান্তির গলিঘুঁজি গড়ে তোলে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা সে খুঁজে পায়না। 

কিন্তু এই ভাবনার অনেকখানিই মিলে গিয়েছিল সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলে, যেদিন তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল আইয়মের। আইয়মকে দেখতে মোটেই আর পাঁচটা পাহাড়ি মেয়ের মত ছিলনা। কতকটা বাঙ্গালী মেয়ের মত টানা টানা চোখ, অনেকখানি টেনে আইলাইনার লাগিয়ে আরও উজ্জ্বল করে তুলত সে তার চোখের চাহনি। লাল লিপস্টিক লাগাতেও বেশ ভালবাসত সে। সেদিন বিকেলেও সেজেগুজে যাচ্ছিল সিনেমা দেখতে, নাকি মেলা দেখতে সেইই জানে। ভুল করে তার দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল। আসলে পাহাড়ের ঢালে পাঁচটা সিঁড়ি নিচেই ছিল আইয়মের বান্ধবীর দরজা। বান্ধবীকে ডাকতে ডাকতে আর ছাতার জল ঝাড়তে ঝাড়তে খোলা দরজা দিয়ে একদম ঢুকে পড়েছিল নিরূপের আঙ্গিনায়। 

নিরূপ তখন সেখানেই চায়ের টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল অফিস কলিগ দাসের জন্য। ছুটির বিকেল, শনিবার ছিল; আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা ছিল এটা মনে আছে। ওই পাড়ায় পাহাড়ের ধাপে সবগুলো বাড়ি দেখতে একই ধরণের ছিল। ভুল হওয়াটা খুব দোষের কিছু নয়। প্রথম ভুলটা আইয়মের ছিল। কিন্তু পরেরগুলো? আইয়ম তো দু মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল নিজের ভুল। বুঝতে পেরে ‘সরি’ বলে বেরিয়েই যাচ্ছিল। নিরূপের কি ওই মুহূর্তে অতটাই প্রগলভ হওয়ার প্রয়োজন ছিল? জানে না সে। বাতাসে সত্যিই সেসময় ভেসে এসেছিল নাম-না-জানা ফুলের সুগন্ধ। আইয়মের মাথার হালকা ওড়না খসে পড়েছিল বর্ষার জলের ফোঁটার চুমকি নিয়ে। অপ্রস্তুত চোখে হয়ত বা কিছু বেশীক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে সে তাকিয়েছিল নিরূপের দিকে। অচেনা কবিতার মত এক নারী পথ ভুলে এসে দাঁড়িয়েছিল তার আঙ্গিনায় ফুলে ফুলে ঢাকা নীলমণিলতা গাছটির পাশে। সেই ছবিটি এখনও অমলিন জেগে আছে নিরূপের মনে। 

আইয়ম দুঃখপ্রকাশ করে চলে যাবার জন্য যখনই পেছন ফিরেছিল, নিরূপের মনে হয়েছিল এই তার সেই মানসী। এক মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে চলে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়েছিল পেছন পেছন। জানতে চেয়েছিল, ‘ম্যাডাম, হোয়েন উইল ইউ রিপিট সাচ আ সুইট মিস্টেক?’ আইয়ম পাহাড়ের মেয়ে; সমতলের নয়। পুরুষতান্ত্রিক নয়, সে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে উঠেছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়নি এই হাল্কা ফ্লার্ট শুনে; উল্টে হেসেছিল, উচ্চস্বরে না হলেও, হেসেছিল সপ্রতিভ ভঙ্গীতে। জানতে চেয়েছিল সত্যিই কি নিরূপ অপেক্ষা করবে তার ভুল করবার জন্য? নিরূপ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল ভুলের জন্য নয়, সে অপেক্ষা করবে ঠিকের জন্য। ঠিকঠাক চিনে যেন সে আসে তার আঙ্গিনায়। বিশেষ তাড়া না থাকলে এখনই কি এককাপ চা খেয়ে যেতে পারেনা? গৃহস্থের অকল্যাণ হবে অমন শুধু-মুখে ফিরে গেলে... ইত্যাদি আরও কি যেন বলেছিল সে ওই মুহূর্তে; সেসব আর এখন মনে নেই। অত কথা সে অতীতে প্রথম দেখায় কোনও মহিলার সঙ্গে বলেনি, পরেও নয়। 

মনে আছে কথাবার্তার ফাঁকে জেনে নিয়েছিল তার নাম, আদায় করে নিয়েছিল আবার তার বাড়িতে আসার প্রতিশ্রুতি। আইয়মের হাতে গুঁজে দিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার লেখা চিরকুট। শুধু নাম নয়, ওই মুহূর্তে নিরূপ আরও জেনে নিয়েছিল ‘আইয়ম’ নামের অর্থ। মিষ্টি হেসে সেই নারী বলে গিয়েছিল তার নামের অর্থ ঋতু, সময়। নিরূপ বুঝেছিল পাহাড়ে মেঘ, বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়ার মাঝে কিভাবে যেন বসন্ত ঋতু এসে জায়গা করে নিতে চাইছে তার জীবনে। 



0 comments: