ব্যক্তিগত গদ্য - মৌসুমী ঘোষ দাস
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
খোলা চিঠি
মৌসুমী ঘোষ দাস
কেমন আছিস পাগলি? আমি ভাল নেই রে! ক’দিন ধরে কেবলই তোর কথা মনে পড়ছে, তোর গলা শুনতে ইচ্ছে করছে! কোনও কাজে মন দিতে পারছি না, জানিস! সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যেন! এতদিন পর হঠাৎ তোর অভাবটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে শুধু!
এখন রাত তিনটে বেজে একচল্লিশ। সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। আর একটু পরেই পাখির ডাকের সঙ্গে ভোরের আলো ফুটবে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই! টিভি চালিয়ে দিয়ে ঘুমোনোর সেই পুরনো বদ অভ্যেসটা এখনও আছে আমার। সে জন্য তুই কত বকাবকি করতিস। আজও তেমন টিভি খোলা রয়েছে। কিন্তু মনটা শুধু তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! জানি এসব শুনে তুই বলবি এখন নাটক করছি! কারণ তুই আর বিশ্বাস করিস না যে এখনও কেবল তুই, শুধু তুইই আছিস আমার সারা মন জুড়ে!
আজ আবার পয়লা আগস্ট। কত বছর আগে ঠিক মনে নেই, আমি তো আবার কিছুই মনে রাখতে পারিনা- এ তোর মস্ত বড় অভিযোগ ছিল! তবে এমনি এক পয়লা আগস্টের বৃষ্টিঝরা বিকেলে, বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে তুই এসেছিলি আমার কাছে, সে কথা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে! যদিও পরে জেনেছিলাম, তুই অনেক আগে থেকেই আমাকে মনে মনে ভালবাসতিস।
তোকে জড়িয়ে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করতে কেন জানি খুব ভাল লাগছে আজ! আর তাই মনটা বার বার সেই অতীতে ফিরে গিয়ে সোনাঝরা দিনগুলোকে বর্তমানে এনে উপস্থিত করছে! সেইসব দিনের অনুভূতিগুলো এখনও কেমন জীবন্ত হয়ে আছে, জানিস! যেন এখুনি এই মুহূর্তে ঘটছে! তোর মনে আছে রে, আমাদের দুজনার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার কথা? শুভদের বাড়ির সবাই কলকাতা গিয়েছিল। অত বড় বাড়িতে শুভ একা। তোকে একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে কাছে পাবো বলে ওদের বাড়িতে দেখা করার প্ল্যান করেছিলাম। শুভদের তিনতলা বাড়ির ছাদটা পাড়ার অন্য বাড়ির ছাদের চেয়ে উঁচু ছিল বলে আসে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে ওদের বুক সমান উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছাদের ভেতরটা দেখা যেত না। শুভ তখন নিচে কম্পিউটার ঘরে। আমরা দুজনা হাত ধরে সেদিন ছাদে খোলা আকাশের নিচে কত ভালোবাসা-বাসি করেছিলাম! খোলা আকাশ, পাখি, মেঘ, বাড়ির চারিধারের সারিবদ্ধ নারকেল গাছেরা, ছাদ-বাগানের ফুলেরা সেদিন সাক্ষী ছিল আমাদের প্রেমের!
দুজনার প্রেম যখন বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তুই বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এক ছুটে চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই আমি তোকে থামালাম। তারপর গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে সেদিন মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুব ভিজেছিলাম দুজনা! তোকে অপরূপা লাগছিল! বুকের ওড়না হাওয়ায় উড়ছিল। সাদা কুর্তি আর লাল সালোয়ার ভিজে গায়ের সাথে সেঁটে গিয়ে তোর শরীরের ভাস্কর্য ফুটে উঠেছিল! তোকে দেখতে পুরীর মন্দিরের দেওয়ালের গায়ের মূর্তির মত লাগছিল! মুগ্ধ হয়ে দু চোখ দিয়ে তোকে শুধুই গিলছিলাম! কিন্তু আমার সেই পরম অনুভূতির কথা সেদিন তোকে বলা হয়নি!
খুব মনে পড়ছে তোকে নিয়ে প্রথম যেদিন টোটোতে চড়েছিলাম! লোক-লজ্জা উপেক্ষা করে সারাটা পথ তুই আমার ডান হাতটা ধরে বসেছিলি! আমার কনুইটা একটু করে তোর বাম বুক স্পর্শ করছিল! কি অসাধারণ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছিল! আর কি ভীষণ দুঃসাহসী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, জানিস! তুই বার বার মুগ্ধ চোখে ঘুরে ঘুরে দেখছিলি আমাকে! তোর কপালে উড়ে এসে পরা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে, হাওয়ায় উড়ে যাওয়া শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, - “কি এত দেখছিস রে?”
তুই আমার কাঁধে মাথা রেখে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলেছিলি, “তোকে দেখছি, আমার ভালবাসাকে দুচোখ ভরে দেখেই যে আমার সুখ”! কথাটা শুনে মন ভরে গিয়েছিল আমার! ইচ্ছে করছিল আমার ভালোলাগার কথাটাও তোকে বলি, কিন্তু কি জানি কেন আমি কিছুই বললাম না! সারাটা পথ শুধুই তোর স্পর্শ অনুভব করে গেলাম!
বড্ড অল্পতেই খুশি হতিস রে! আসলে তোর চাহিদা ছিল কম। আমার একটুখানি সান্নিধ্য পেলেই তোর মন ভরে যেত! যেন আমাকে ভালোবেসেই তোর রাজ্যের সুখ! কেন আমাকে এত ভালবাসতিস বলতো? কি পেয়েছিলি এই সৃষ্টিছাড়াটার মধ্যে?
তোর কি মনে আছে আমাদের প্রথম চুমু খাওয়া? আমার কিন্তু তারিখটাও মনে আছে! তেরোই অক্টোবর! কি ঠিক বললাম তো? গভীর আবেগে তুই ভালোবাসার কথা বলতেই, আমি অতর্কিতে তোকে কাছে টেনে নিয়ে তোর নরম ঠোঁটে আমার ঠোঁটদুটো চেপে ধরেছিলাম! প্রথমে তুই তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগলি! আমিও তেমনি, কিছুতেই তোকে ছাড়ছি না, আষ্টেপৃষ্ঠে তোকে আরও আবদ্ধ করে ফেলছি, ধীরে ধীরে তুই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করলি। আমার ব্যপক লেগেছিল, কিন্তু সেদিন বলিনি! তুই কিন্তু বলেছিলি, তোকে ছেড়ে দিতেই বেশ কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মত আমার দিকে চেয়ে থেকে, তারপর আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলি, “এই প্রথম চুমু নাকি তোর জীবনের পরম সম্পদ হয়ে থাকবে”! শুনে মুচকি হেসেছিলাম সেদিন!
তবে আমার বেশ ভাল লাগত যখন অনেকদিন পর দুজনা সামনা সামনি হতাম। লজ্জাবতী লতার মত তুই কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যেতিস, হাতটা ধরে আলতো একটা চাপ দিয়ে কাছে টানতেই, আমার বুকে এসে মুখ লুকাতিস! তোর নরম শরীরটা আমার আলিঙ্গনে তিরতির করে কাঁপত! কি যে ভাল লাগতো! প্রতিবারই যেন তোকে নতুন করে পেতাম! আমার সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথাও বলা হয় নি।
তুই খুব তৃষ্ণার্ত হতিস, তোকে পেয়ে আমার কেমন অনুভূতি, কতটা ভালোবাসি, কতটাই বা মিস করি - এসব কথা জানবার জন্য! কিন্তু খানিকটা ইচ্ছে করেই তোকে তড়পাতে চাইতাম বলেই কোনওদিন বলিনি আমার মনের ভালোলাগার কথা! তুই শুধু আমার সম্পর্কে ধারণা নিয়ে গেলি, আমার কোনও আবেগ নেই, মনের গভীরতা নেই, সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই! কিন্তু আজ আমি তোকে সব বলতে চাই। আমার সব ভালোলাগা অনুভূতির কথা তোকে বলতে চাই! কারণ, আজ বুঝেছি ভালোলাগা অনুভূতিটা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রকাশ করাটা খুব জরুরী!
নদীর জলে ডুবে যাওয়া লাল সূর্যটার মত সুন্দর সেই দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে! আসলে তুই তো আমাকে আঁকড়ে থাকতেই চেয়েছিলি! তোর সমস্ত মন প্রাণ আমাতেই সমর্পণ করেছিলি! বড্ড চোখে হারাতিস আমাকে! আমিই সময় দিতে পারিনি তোকে। ভেবেছিলাম তুই তো আছিসই! তোকে আলাদা করে অত গুরুত্ব দেওয়ার কি বা আছে! কাজ নিয়ে এত মেতে ছিলাম, তাই কখন যে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো হারিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি রে! তখন মাথায় ছিল একটাই নেশা, পয়সা রোজগার করতে হবে! অনেক টাকা চাই! কারণ, হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম, এ জগতে টাকাই সুখ, শান্তি, নাম, প্রতিপত্তি, সব এনে দেয়! টাকা না থাকার জন্য প্রথম জীবনে কম কষ্ট, কম অসম্মান তো পাইনি! তুই তো সবই জানিস! দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেমন করেই হোক প্রচুর অর্থের মালিক হতে হবে! হয়েওছি।
কিন্তু আমাকে সেভাবে না পেয়ে বাধ্য হয়ে তুই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিস! যখন দিনের পর দিন আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য তুই ছটফট করতিস, আমার একটা ফোনের অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটাতিস, আমি তখন আমার কাজ নিয়ে মেতে। তোর সাথে একটু দেখা করার সময় পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি! অথবা ইচ্ছে করেই দেখা করার চেষ্টা করিনি! তোকে একটু ছটফট করিয়ে চোরা আনন্দ পেতাম যে! তোর ‘আমাকে না পাওয়ার’ প্রবল কষ্টটাকে ‘যতসব ছেলেমানুষি’ বলে মনে করতাম! আমার কথা ভেবে রাতের পর রাত তোর ঘুম হয় না শুনে ‘পাগলামি’ বলে উড়িয়ে দিতাম! আসলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝিনি তখন! তোর পাগলকরা ভালোবাসাটা অত্যন্ত সহজলভ্য বলে মনে করেছিলাম! অথচ দেখ, আজ তোর কথা ভেবেই ঘুম নেই চোখে! তবে রাতের পর রাত না ঘুমোতে পেরেও কোনও ক্লান্তি নেই শরীরে! তোকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে অদ্ভুত ভাবে উজ্জীবিত হই আমি! এটাই তো ভালোবাসা, তাই না পাগলি?
সত্যি বলছি রে, সব হওয়া সত্ত্বেও কিছু একটা নেই যেন! আসলে ভালোবাসা না থাকলে জীবনে শান্তি থাকে না -এটা আজ আমি বুঝেছি! “যার জীবনে ভালোবাসা নেই, তার কিছু নেই! সে পৃথিবীতে সব চাইতে দরিদ্র” - তুই বলতিস এ কথা। তখন উপলব্ধি করিনি! আজ অনুভব করি, সখি ভালোবাসা কারে কয়! অনাদরে, অবহেলায় আজ তুই কত দূরে সরে গেছিস! আমার ভুবন হয়ে উঠেছে কেবলি যাতনাময়! এই দেখ, আবার কাব্য করে ফেললাম!
অভিমান হলে একটা কথা তুই প্রায় বলতিস, “ভালোবাসা মুখে বলে হয় না, ভালোবাসা অনুভবের। সত্যি করে কেউ কাউকে ভালবাসলে সে অন্তর থেকে অনুভব করতে পারবেই পারবে!” এই যে সারাদিন কেবল তোর কথাই ভেবে যাচ্ছি, তুই কি অনুভব করতে পারছিস? আমার কথা মনে পড়ে তোর? না কি একেবারেই ভুলে গেছিস?
আর একটা কথাও খুব বলতিস, “সম্পর্কটাকে মাঝে মাঝে renew করতে হয়। তাতে বাঁধন পোক্ত হয়, longevity বাড়ে”! এখন বুঝি, তুই ঠিক বলতিস। শত কাজের মধ্যেও যদি তোকে একটু বুঝতাম, একটু সময় দিতাম, তাহলে অভিমান করে তুই এত দূরে সরে যেতিস না!
আজ আমি ভীষণ একা! আমার মত নিঃস্ব আর কেউ নেই! প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করি! তোকে সেই আগের মত করে ফিরে পেতে চাই! কতদিন দেখিনি বল তো! ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে রে! তোর অভিযোগ ছিল, আমার নাকি একটুও আবেগ নেই! আচ্ছা বল তো পাগলি, এই যে শুধু তোর কথাই ভেবে যাচ্ছি, এটা কি আবেগ নয়? এটা কি ভালোবাসা নয়? তবে আর তোকে দূরে সরে থাকতে দেবো না! ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে আনবোই আনবো ।
আপন মনে অনেক কথা বলে গেলাম! এখন সকাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চিঠিটা তোকে পৌঁছে দেবে বলে আমার ঘরের ব্যালকনির সামনে এক টুকরো মেঘ এসে দাঁড়িয়ে আছে! খোলা চিঠিটা মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে দিলাম। জানি এই চিঠি তুই পাবিই পাবি! তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম পাগলি। ভাল থাকিস, আর ভাল রাখিস।
ইতি
তোর সন্টাই-মন্টাই
0 comments: