ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
(দেবগ্রাম নামক অখ্যাত গ্রামের সম্পন্ন এক গৃহস্থের বালক এক প্রত্যুষে গৃহত্যাগ করিল সেই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধার সাহায্যে, যে বৃদ্ধার সেই বালকটি অপেক্ষা আপনজন আর কেহ নাই, কিন্তু অনাথা বৃদ্ধা পরিবারেরও কেহ নহেন। বালকটি আর কেহ নহে, সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার কনিষ্ঠ পুত্র। কিন্তু বালকটি গৃহত্যাগ করিল এমন এক সময়ে যখন গৃহে অপর এক সন্তানের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আসিয়াছে, বাটীস্থ সকলে ভীত, সন্ত্রস্ত। এমত সময়ে বালকটী গৃহত্যাগ করিল উচ্চবিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে। বালকটি গৃহত্যাগ করিল, কিন্তু বাটীস্থ সকলের কি হইল?
পরদিন সকালে গৃহের মহিলা ও পুরুষদিগের নিকট বালকটির গৃহত্যাগের সংবাদ কি গোপন রহিল, নাকি বালকটিকে তাঁহারা বিস্মৃত হইলেন? যদি জানিলেন, তাহা কি প্রকারে? )
পরবর্তী অংশ.........
সকালে ঘরে ঘরে চা পৌঁছাইবার দায়িত্বে আছে আরও একটি কন্যা, সেও আশ্রিতা। গরীব বাপ- মায়ে তাহাকে দোজবরে বিবাহ দিয়াছিল, তাহাতে শুধুমাত্র অরক্ষণীয়া নামটি ঘুচিয়াছে। কিন্তু পাত্রের স্ত্রীটি বর্তমান, ইহার সহিত ঘর করে নাই, সেই স্ত্রীর সহিত সংসার করে। এই কন্যাটির নাম মালতী, সম্পর্কে সেও বুঝি শিবতোষের কন্যা স্থানীয়া। বাপ-মা মরিতে শিবতোষের নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে।মালতীর তাহাতে দুঃখ নাই। এইখানে আশ্রয় পাইয়া সে ভাল আছে। অমন স্বামীর ঘর করা অপেক্ষা ইহাদের সহিত সুখ-দুঃখে থাকা ঢের ভাল বলিয়া মনে করে।
মালতী কর্তামশাইয়ের ঘরে চা পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছিল, দ্বিতল হইতে নামিয়া আসিয়া পাকশালে মুখ বাড়াইয়া কহিল---উপরে কাকাবাবু বড় বৌদিদিকে ডাকছেন, কথা আছে বললেন।
তখন গ্রামাঞ্চলে শ্বশুর-বৌয়ের কথাবার্তা বিশেষ হইত না, হইলেও কদাচিৎ। রোগ বালাই হইলে তবেই, নচেৎ পিত্রালয় হইতে কেহ আসিলেও কথা হইত অন্যের মারফৎ। শিবতোষ তাহা খুব একটা মানিতেন না, প্রয়োজনে কথা কহিতেন। বধূগুলি তাঁহার কন্যাস্বরূপা। যে শিশুকন্যাগুলিকে তিনি কোমল বয়সে গৃহে আনিয়াছিলেন, তাহাদিগের অবহেলা সহ্য করিতে পারিতেন না। বোধকরি স্বীয় কন্যার মৃত্যু তাঁহাকে এইরূপ ভাবিতে বাধ্য করিয়াছিল।
মালতীর কথা শুনিয়া পারুলবালা স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। কথাটি সোনা পিসির কানে গিয়াছিল। মুখ বাঁকাইয়া বলিয়া উঠিলেন—তোমার যাবার কি দরকার বাছা, আমি শিবুকে শুধিয়ে আসছি। একি বেয়াক্কেলে কথা! শিবুর যেমন..., ‘যাই দেখি’ বলিয়া সুন্দরি শিবতোষের ঘরের দিকে যাইবার জন্য পাকশালা হইতে বাহির হইলেন। দুই জায়ে নিম্নস্বরে কিছু বলাবলি করিতে লাগিল। আজিকার সকালে আর তাহাদের ‘আরাম ঘরে’ আরাম করিয়া চা পান হইল না।
খানিক পরেই সুন্দরি ভারি মুখে ফিরিয়া আসিলেন, পারুলবালাকে বলিলেন—‘যাও বাছা, তোমাকেই ডাকছে। জানি না বাপু, এই বাড়ির সবই অন্যরকম। কে কবে শুনেছে, শ্বশুর ঠাকুর সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে বৈঠকখানায় না বসে ঘরের বৌদের ডেকে পাঠাচ্ছে! যাও, শুনে এসো। বেশী করে ঘোমটা দিও, তুমি আবার টুনটুনির মত কান পর্য্যন্ত ঘোমটা দিও না। আমাদের সময় চোখে রাস্তা দেখতে পেতাম না এত বড় ঘোমটা ছিল, যাও!’
সকালবেলা এইসব কথাবার্তা টুনটুনির ভাল লাগিতেছিল না। সুন্দরির কথার ইঙ্গিতে সে বিরক্ত বোধ করিতেছিল। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত কথা বলিতে ইচ্ছা করিল না, তাহার মনে অজানা আশঙ্কা ভিড় করিতেছিল। ছোট ঠাকুরপো কোথায়, তিনিও কি ভাসুর ঠাকুরের মত স্বদেশী হইলেন? এই বাড়ির মধ্যম পুত্রটি ছোট ঠাকুরপোকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, ছোট ঠাকুরপোর সন্ধান না পাইলে কি হইবে, এই ভাবিয়া টুনটুনির বুকে ভয় জমিতেছিল। ধীরে ধীরে সে পাকশালা হইতে বাহির হইয়া কুটনা কুটিবার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন সকালের আলোয় পুনর্বার স্বামীর ঘরে যাওয়া ঠিক হইবে না, লজ্জা করিবে, রীতি অনুযায়ী তাহা নিন্দারও বটে। কিন্তু কি এক উৎকন্ঠা তাহাকে ঘিরিয়া রহিল।
পারুলবালা এক পা এক পা করিয়া দ্বিতলে শ্বশুর মহাশয়ের ঘরের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পিছনে অত্যুৎসাহী সোনাপিসি। শিবতোষের নিকট তাড়া খাইলেও কৌতুহল বড় বালাই। ঘরের সামনে আসিয়া গলা খাঁকারি দিয়া শিবতোষকে ডাকিলেন— ‘বড়বৌমা দাঁড়িয়ে আছেন’।
বধূদিগের সম্বন্ধে সম্মান করিয়া কথা বলিতে শিবতোষই শিক্ষা দিয়াছেন। বধূদিগের এত সম্মানও কেহ কেহ ভাল চোখে দেখে না, কিন্তু শিবতোষের সম্মুখে তাহার অন্যথাও কেহ করিতে সাহস করে না। শিবতোষ বোধকরি ভিতরে গৃহিণীর সহিত কথা কহিতেছিলেন, সুন্দরির গলা পাইয়া বাহিরে আসিয়া দরজার মাঝখানে দাঁড়াইলেন, সুন্দরিকে দেখিয়া ঈষৎ ভুরু কুঞ্চিত করিলেন, বলিলেন— ‘তুমি কেন, নিচে যাও।‘
সুন্দরি একবার দুজনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিচে নামিয়া গেলেন। শিবতোষের চিন্তাচ্ছন্ন মুখ এইবার পারুলের দিকে ফিরিল। কহিলেন— ‘বড়বৌমা, রণ কোথায়, সে কি তোমায় কিছু বলে গেছে?’ শ্বশুরের সহিত কথা কহা পারুলের অভ্যাস নাই, স্বামীর ব্যাপারে তো নয়ই, কোনওদিন কহেনও নাই। পারুল ভীত হইল। তাহাকে নিশ্চুপ দেখিয়া শিবতোষ আবার প্রশ্ন করিলেন— ‘কোথায় সে’?
বড়বৌমা কি বলিলেন, শিবতোষ শুনিতে পাইলেন না। শুধু ‘ছোট ঠাকুরপো কথাটি কানে গেল। বলিয়া উঠিলেন— ‘আঃ, আবার তাকে কেন, তাকে কে বলতে বলেছে এসব কথা...ডাকো তাকে’।
পারুলবালা আবার বলিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। ঠোঁট কাঁপিতেছে, চক্ষে জল...শুধু কোনওমতে আবার বলিল— ‘ছোট ঠাকুরপো...’
শিবতোষ এইবার বিরক্ত হইলেন, ঈষৎ জোরে বলিলেন— ‘কি হচ্ছে কি, রণ কোথায়? আমি কি জ্ঞানের কথা তোমায় শুধুচ্ছি? খালি ছোট ঠাকুরপো, ছোট ঠাকুরপো......কোথায় সে?’
—‘নেই, পাওয়া যাচ্ছে না--’
—‘ক্কি...’ এইবার গর্জন করিলেন শিবতোষ। কিন্তু বলিতে বলিতেই দেখিলেন বড়বৌমা মূর্ছিত হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন। অতিকষ্টে পারুলবালা সাহস সঞ্চয় করিয়া শ্বশুরমহাশয়ের সম্মুখে কথা কহিয়াছে, কিন্তু শেষরক্ষা করিতে পারে নাই।
আতঙ্কে শিবতোষের শরীর হিম হইয়া গেল।
(ক্রমশঃ)
0 comments: