0

প্রবন্ধ - অমিত ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


ঈশ্বরচন্দ্রের ভূগোলচর্চা
অমিত ভট্টাচার্য



১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সচিব মিয়রের ঘোষিত ১০০ শ্লোক রচনার বিনিময়ে ১০০.০০ টাকা পুরস্কার নিঃসন্দেহে বিদ্যাসত্রে উৎসাহদান। তখনকার সেই অর্থমূল্য এখন সম্ভবত এক লক্ষ টাকার সমতুল। গ্রন্থান্থরে, যেমন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত ‘সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালির দান’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌’ নামক ৪০৮টি শ্লোকসমষ্টি রচনা করেন। কোথায় একশো শ্লোক রচনায় উৎসাহ পেয়ে একশো শ্লোক লেখা! তা নয়। কাকে বলে পাণ্ডিত্য! সকাল দেখেই যেমন দিন স্থির হয় তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র যে, “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে” হবেন, তার নান্দীমুখ হয়ে গেল। লিখে ফেললেন একশো নয়, দুশো নয়, তিনশো নয়, সাকুল্যে ৪০৮টি শ্লোক।

বিদ্যার্থী অবস্থাতেও পুরস্কারের লোভে তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হননি। গ্রন্থের সূচনায় বিজ্ঞাপিত হয়েছে তাঁর শ্লোক রচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার প্রকৃত কারণ। বাঙালি সহপাঠী বিদ্যার্থীর নিন্দিত আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদে তিনি যে-শ্লোকাবলি রচনা করেছিলেন মাত্র আঠারো বা উনিশ বছর বয়সে, সেটি সরস্বতীর মন্দিরে কেবলমাত্র স্নিগ্ধ দীপ প্রজ্জ্বালন নয়, ভবিষ্যতের প্রতিবাদী চরিত্রের পূর্বাভাষও বটে। তাঁর তরুণ বয়সের চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাঁকে শিবসংকল্পে উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল বলে সংস্কৃত ভাষাতেও যে ভূগোল বা খগোল আদৌ লেখা যায়, উত্তরপ্রজন্ম তার নমুনা পেল।

বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর, সমাজ সংস্করক বিদ্যাসাগর, বর্ণপরিচয়-এর উদ্‌গাতা বিদ্যাসাগর, শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকায় বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর—প্রভৃতি নানাবিধ ভূষণে তিনি শোভিত হলেও এবং আপামর বাঙালি সে-বিষয়ে পরিচিত হলেও, ভূগোল-খগোল বর্ণনায় সফল বিদ্যার্থী ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি—এমন মানুষজনের সংখ্যাই বেশী। বস্তুত, ভূগোল এমন একটি বিষয় যা একেবারে নিম্নশ্রেণী থেকে অবশ্যপাঠ্য। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বিদ্যার্থী নিজেদের পছন্দের বিভাগ বেছে নেয়। সুতরাং, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সবিস্ময়ে আনন্দ প্রকাশ করবে—এই গ্রন্থ পাঠ করে।

আবার উচ্চতর শিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত হন—তা যে-কোনও বিষয়ের হলেও স্বয়ং বিদ্যাবারিধির কীর্তিগাথা যে তাঁদের জীবনকে নতুন আলোর দিশা জোগাবে—তা তো নিঃসন্দেহে বলা চলে।বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এমফিল বা পিএইচডি করার সময় গবেষকদের বিষয় নির্বাচন করতেই কতটা সময় চলে যায়।অথচ হাতের কাছে এমন অমূল্য সম্পদ থাকলে সে তো সোনায় সোহাগা! ভাষাচর্চায় যাঁরা রত, যেমন—বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া, অসমিয়া, মৈথিলি নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ঈশ্বরচন্দ্রের এই দুর্লভ গ্রন্থটির দিকে যাতে নজর দেন, সে জন্যই এই প্রয়াস।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ন্যায়শাস্ত্র পড়ুয়া প্রতিযোগী, অনুযোগী বা অবচ্ছেদক বিচ্ছিন্ন, লক্ষ্য-লক্ষ্যতা, আধার-আধেয়, সংযোগ-সমবায় প্রভ্রৃতি সম্বন্ধ-চর্চাকে সম্পূর্ণ পরিহার করে নিজের সুনিদির্ষ্ট চৌহদ্দির বাইরে লেখনী ধরেছেন—তা ভাবলে শিহরণ জাগে বৈ-কি! বিশেষত আজকাল সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় নিযুক্ত মানুষজন এক-একজনকে বিশেষ পত্রের সিলমোহর দিতে মুখিয়ে থাকেন। উনি তো বেদ, উনি তো বেদান্ত, উনি তো সাংখ্য, উনি তো ব্যাকরণ, উনি তো ন্যায় অথবা কাব্যের লোক। কোনো ফোরামে তাঁদের বলার ভঙ্গি বা উপস্থাপনের ধরণ যে- শারীরিক ভাষাকে ব্যক্ত করে, তাতে মনে হয় উদ্দিষ্ট ব্যাক্তি তাঁর বিষয়ের বাইরে কিছুই জানেন না বা বোঝেন না।ফলে পরীক্ষক নির্বাচনের বেলায় নামের প্রস্তাবককে ঢোক গিলতে হয়।ঈশ্বরচন্দ্র পারতেন এবং সেটি করে দেখিয়েছেন যে, প্রতিভাকে বিশেষ পত্র দিয়ে সীমায়িত করা যায়না। প্রতিভা ঈশ্বরের তৃতীয় নয়ন।

ঈশ্বরচন্দ্রের সেজো ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন জানিয়েছেন, ঠাকুরদা রামজয় বাবা ঠাকুরদাসকে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম সংবাদ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অদ্য আমাদের একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে…এ ছেলে এঁড়ের মত বড় একগুঁয়ে হইবে…এ নিজের জিদ বজায় রাখিবে’। ‘বাবার কাছে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ‘ঘাড়কেঁদো’ অর্থাৎ নিজের প্রতিভায় একবগগা।১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে অভিযান শুরু।এরপর ক্রমান্বয়ে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল তর্কালংকারের কাছে সাহিত্য পাঠ।১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের কাছে অলংকার পাঠ এবং এই ভাবে ধীরে ধীরে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের কাছে ন্যায়শাস্ত্রের পাঠ, শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির কাছে বেদান্তের পাঠ ও পরিশেষে হরনাথ তর্কভূষণের কাছে স্মৃতিশাস্ত্রের পাঠ তাঁকে বিবিধ বিষয়ের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করেছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা নিয়ে আচার্যেরা যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ঠিক সেইসময় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে এক অভিনব নিয়ম প্রবর্তিত হলো।

স্মৃতি, ন্যায়, বেদান্ত বিভাগের ছাত্রদের বার্ষিক পরীক্ষার সময় সংস্কৃত গদ্য ও পদ্য রচনার নিয়মাবলী চালু হলো। সর্বোৎকৃস্ট রচয়িতা গদ্য ও পদ্য ভেদে একশো টাকা করে পারিতোষিক পাবেন। অলংকারশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্রের আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রচনা লেখায় অংশ নিয়ে বিদ্যাসাগর প্রথম হন এবং একশো টাকা পুরস্কার পান।

শ্লোক রচনাতেও ঈশ্বরচন্দ্র সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। ওঁর রচনা মানেই মনোনীত। সেই কৃতিত্বকে সম্মান জানাতেই এই গ্রন্থ-সম্পাদনা। শম্ভুচন্দ্র জানিয়েছেন :

“জন মিয়র নামে এক সিবিলিয়ানের প্রস্তাব অনুসারে পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মতানুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ক কতকগুলি শ্লোক রচনা করিয়া একশত টাকা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সেই কবিতাগুলি মুদ্রিত করিবার অভিপ্রায় করিয়া ছিলেন।”

১২৯৯ বঙ্গাব্দে (১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র নারায়ণচন্দ্র শ্লোকাবলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্র জীবিত অবস্থায় (১৮২০-১৮৯১) গ্রন্থটি পুস্তকাকারে দেখে যেতে পারেননি। বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে যে-বিদ্যাসাগর-গ্রন্থপঞ্জী সন্নিবিষ্ট আছে তার ২৭নং ক্রমাংকে ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌-এর উল্লেখ রয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, ‘১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম প্রদেশের সিবিলিয়ান জন মিয়র বিদ্যাসাগরকে পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মতের অনুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ে শ্লোক রচনা করিতে বলেন’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সিবিলিয়ন মিয়র শ্লোকাকারে গ্রন্থ রচনা ও পুরস্কার-প্রাপ্তির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থকারের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য নেই এবং বইটির মুদ্রণও যে ওঁর তিরোধানের পরে হয়েছিল, তাও সন্দেহাতীত।

ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন মানেই বিষয় সিরিয়াস। গবেষকদের টনক নড়ে। ভূ-গোলাকার প্রায় হলেও খ বা আকাশ কীভাবে গোল হয় বিবিদিষু জানতে চান। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে কৃতবিদ্য কীভাবে তা লিখলেন ! উত্তরে বলা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন যে আকাশ শূন্য। কিন্তু তা হলেও মাটির মানুষ ওপরের দিকে তাকিয়ে যখন কড়ার মতো একটা কিছু দেখেন তখন তাকে গোল আখ্যা দিয়ে গোল বাধিয়ে দেন না। যদিও মনে হতেই পারে, এই প্রশ্ন বাড়াবাড়ি। কারণ, কবির কাব্যরচনায় সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে টানলে কাব্যরস বিঘ্নিত হয়। তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র যখন এই গ্রন্থ রচনা করেন তখন ওঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে অধীত বিদ্যার জারকরসে সিঞ্চিত করা, যা জ্ঞান ও বোধকে আলোকিত করবে।

আঠারো বছর বয়সের এক তরুণ গ্রন্থ পাঠের সময় আনন্দের তত্ত্বতালাশে বিভোর। পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও য়ুরোপীয় মত অনুসরণ করে সম্পূর্ণ গ্রন্থটি রচিত। আঠারোটি পুরাণে সৃষ্টিই মূলকথা। এই সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভূগোল/খগোল এসেছে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের বাইরে কিছু নেই। পৃথিবী, অন্তরীক্ষ এবং আকাশ ভেদে ব্রহ্মাণ্ড ত্রিস্তর বিশিষ্ট। ‘চতুর্দ্বীপা বসুমতী’ এবং ‘সপ্তদ্বীপা বসুমতী’ পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণিত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন। এই দ্বীপগুলি হলো যথাক্রমে জম্বুদ্বীপ, প্লক্ষদ্বীপ, শাল্মলিদ্বীপ, কুশদ্বীপ, ক্রৌঞ্চদ্বীপ, শাকদ্বীপ এবং পুস্করদ্বীপ (দ্রস্টব্য বায়ুপুরাণ ১।৮৮; ৮।১৬)। মার্কণ্ডেয় পুরাণকার জানিয়েছেন—ক্রৌস্টুকি-মার্কণ্ডেয়র কথোপকথনের মাধ্যমে এই সাতটি দ্বীপের প্রসঙ্গ :

যে তে দ্বীপা ময়া প্রোক্তা জম্বুদ্বীপাদয়ো দ্বিজ।
পুষ্করান্তা মহাভাগ শৃণ্বেষাং বিস্তরং পুনঃ।।
দ্বীপাৎ তু দ্বিগুণো দ্বীপো জম্বুঃ প্লক্ষোহথ শাল্মলঃ।
কুশঃ ক্রৌঞ্চস্তথা শাকঃ পুষ্করদ্বীপ এব চ।।

(মার্কণ্ডে য় পুরাণ, ৫৪তম অধ্যায়, ৫-৬ শ্লোক):

প্রসঙ্গত ব্রহ্মপুরাণ দ্রষ্টব্য (অষ্টাদশ অধ্যায়, ১১-১৯ সংখ্যক শ্লোক)। 



পুরাণ সম্মত ভূগোল বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ হয়েছে ১৪৩ সংখ্যক শ্লোকে। স্বাভাবিক ভাবেই পুরাণমতকে অনুসরণ করেছেন বলে বেশ কিছু শ্লোকে মিথ (Myth) এসেছে। পরবর্তীকালে সে-বিষয়ে আলোকপাত করেছি। সমগ্র ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমের বিভিন্ন জনপদ, নদনদী, পর্বত প্রভৃতির বর্ণনা বেশ চিত্তাকর্ষক। নিজের সাধ্য মতো পুরাণ বর্ণিত ভূমণ্ডলের বৃত্তান্ত দিয়ে ‘ব্যোমমণ্ডল’ বা খগোল ব্যাখ্যাত হয়েছে। পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে যে-‘অন্তরিক্ষ’ উল্লিখিত হয়েছে পাদটিকায় গ্রন্থকার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিবিদিষু যদি জানতে চান ‘অন্তরীক্ষ’ কী ! তাই বলা হলো—মাটি এবং আকাশের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানকেই অন্তরীক্ষ বলে—“তয়োঃভূমিনভসোঃ অন্তঃ মধ্যদেশঃঅন্তরীক্ষম্‌”।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাধারণ মানুষ যে-দেব দিবাকরের (সূর্যের) উদয় এবং অস্ত নিয়ে ভাবিত সেই ধারণা যে ভ্রান্ত, ঈশ্বরচন্দ্র তা দেখিয়েছেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি সূর্যের উদয়াস্ত বলে যা বলা হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে সূর্যের দর্শন ও অদর্শন—


তদেবং নোদয়োহর্কস্য নৈবাস্তাস্তমনং ক্বচিৎ।

উদয়াস্তৌ হি বিজ্ঞেয়ৌ দর্শনাদর্নে রবেঃ।।

(১৬১ সংখ্যক শ্লোক)।



গ্রন্থারম্ভের সূচনায় ভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থের পারস্পরিক ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়ে মঙ্গলাচরণ করেছেন। মহেশ্বর শিবকে তাঁর অসীম মহিমার জন্য প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড সত্যই বিচিত্র ও অদ্ভুত। এর সৃজন প্রক্রিয়া আমাদের স্থূল বুদ্ধির অগোচর। পরাশর-মৈত্রেয়র সংলাপে বিষ্ণুপুরাণ-এ এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বর্ণিত। পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ নানা শক্তিসম্পন্ন হলে এক অণ্ড উৎপাদন করে। সেই সম বর্তুলাকার অণ্ডই ব্রহ্মার ডিম্বকোষ নামে খ্যাত। ব্রহ্মস্বরূপ এই অণ্ডের থেকেই সৃষ্টি বলে একে ব্রহ্মাণ্ড বলে ‘তস্মিন্নণ্ডহভবৎ’(বিষ্ণুপুরাণ, ১ । ২ । ৫৪)।

জগৎ সৃষ্টি যে ভগবানের লীলা, যা কিনা ‘অগ্নিপুরাণ’ জানিয়েছে, “জগৎসর্গাদিকাংক্রীড়াম্‌” (১৭ অধ্যায়, প্রথম শ্লোক), তার সঙ্গে আলোচ্য গ্রন্থের চিন্তন সাদৃশ্য রয়েছে। অগ্নিপুরাণ-এ বলা হয়েছে, ভগবান সৃষ্টি কামনায় প্রথমে জল সৃষ্টি করলেন। সেই জলে ব্রহ্মাণ্ডের বীজ নিক্ষিপ্ত হলো। বীজ থেকে সুবর্ণ অণ্ডের সৃষ্টি। সেই অণ্ডে ব্রহ্মা স্বয়ং আশ্রয় নিলেন (১৭। ৬-১০)।

অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে সাফল্য লাভের জন্য বিশেষত ওই তরুণ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিনয় প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলাচরণের পরে সবিনয়ে নিজের দৈন্যভাব প্রকট করতে কোনও দ্বিধা ছিল না। কালিদাস যেখানে গ্রন্থারম্ভে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের জন্য বাগ্‌ব্যবহার করেছিলেন (অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌, রঘুবংশম্‌ দ্রষ্টব্য), সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র যে ব্যতিক্রমী হবেন না—এ তো একপ্রকার নিশ্চিত। এই কারণে নিজের সামান্য অভিলাষ পূরণেও ওঁর মনে হয়েছে—জোনাকি (খদ্যোত) রাতের আঁধার দূর করবে—এই বচনে কে হাসি সংবরণ করবে! কিন্তু তথাপি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় হাল ছেড়ে না-দিয়ে গুরুদেব (যাঁদের কাছে অধ্যয়ন করেছেন) শ্রীচরণে পবিত্র সুন্দর প্রণাম জানিয়ে গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ। সহৃদয় পাঠকবর্গ ওঁর এই সংক্ষিপ্ত রচনার উদ্যোগে কোনো ভুলত্রুটি ঘটে থাকলে সংশোধন করে দেবেন—“সুধিয়ঃ শোধয়ন্ত্ব তৎ”।

শেষনাগ সাপেদের রাজা! পৃথিবী নামক পদ্মের নাল বা ডাঁটার মতো। সে তার মণ্ডালাকৃত ফণায় পৃথিবীটাকে ধরে রয়েছে বলে পৃথিবীটা নীচে পড়ে যাচ্ছে না (শ্লোকসংখ্যা ৭ দ্রষ্টব্য)। তরুণ বয়সে যখন দর্শনের যুক্তিপদ নির্মিত হয় না, বুদ্ধি তখন ‘মিথপুরাণ’—এর প্রত্ন প্রতিমায় সমাচ্ছন্ন থাকে। মন তখন উদগ্রীব হয়ে গলা তুলে প্রশ্নমালা গাঁথে না। ছবিঘর তখন বাস্তব সত্য বলে প্রতীত হয়। কত কাল যাবৎ শেষনাগ মেদিনীকে ধরে রাখবে, সে নড়লেই কী ভূকম্পন ঘটে—এতসব পরিণত প্রশ্ন তখন উঁকি দেয় না। যদিও বা দেয়, তবু পুরাণ বৃত্তান্ত বর্ণনায় সেসব প্রশ্ন নিরর্থক। 

ভারতবর্ষের বর্ণনায় ঈশ্বরচন্দ্র অকৃপণ। হাত খুলে লিখেছেন। ভারতবর্ষ হলো কর্মভূমি। উত্তরে হিমালয় থেকে প্রবাহিত নির্ঝরিণী নদীসমূহের ক্রমান্বয়ে নামোল্লেখ শ্লোকাবলিকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তছন্দের মন্দাকিনী ধারা স্বতঃ উৎসারিত হয়ে গ্রন্থটিকে সুষমা মণ্ডিত করেছে। গঙ্গা, যমুনা, সরযূ, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, নর্মদা, কাবেরী, গোদাবরী প্রভৃতির উল্লেখে নদীমাতৃক ভারতীয় সংস্কৃতির এক মনোমুগ্ধকর আশ্চর্য রচনা চিত্রায়িত হয়েছে—,”এতা নদ্যঃ প্রকীর্তিতাঃ” (৬৭ সংখ্যক শ্লোক)


সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটির বিবিধ সংস্করণ দেখেছি। গ্রন্থকার রূপে আর্যভট্ট, বরাহমিহির দু—জনকে নিয়ে সূক্ষ্ম মতপার্থক্য এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। তবে সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের শুরুতেই জানানো হয়েছে, ময় নামক এক অসুরের তপস্যায় প্রীত হয়ে স্বয়ং সূর্যদেব ওকে দর্শন দেন এবং গ্রহাদির অবস্থান সংক্রান্ত বিবিধ বিষয় অবহিত করানোর জন্য নিজের অংশজাত এক দিব্য পুরুষকে আদেশ করেন (সূর্যসিদ্ধান্ত, ২ – ৯ শ্লোক দ্রষ্টব্য)।

জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় তিনটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে। এগুলি হলো যথাক্রমে, 
ক। সূর্যসিদ্ধান্ত, খ। সিদ্ধান্তশিরোমণি এবং গ। আর্যসিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত শিরোমণি ভাস্করাচার্য প্রণীত। আর্যসিদ্ধান্ত কবে, কখন রচিত হয়েছিল, সঠিক জানা যায় না। আবুল ফজল (Abul Fazl) বাদশাহ আকবরের আইনকানুন—এর গ্রন্থে নয়টি সিদ্ধান্ত গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন যথা—১। ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, ২। সূর্যসিদ্ধান্ত, ৩। সোমসিদ্ধান্ত, ৪। বৃহস্পতিসিদ্ধান্ত, ৫। গর্গসিদ্ধান্ত, ৬। নারদসিদ্ধান্ত, ৭। পরাশরসিদ্ধান্ত, ৮। পুলস্ত্যসিদ্ধান্ত এবং ৯। বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত। এগুলির মধ্যে প্রথম চারটি ঈশ্বরের বাণী (Inspired) রূপে গৃহীত। 

ভারতীয় জ্যোতির্মণ্ডল চর্চায় সূর্যসিদ্ধান্ত এক মান্য গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র সেইমতো সূর্যসিদ্ধান্ত-কে অনুসরণ করেছেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিস্কারের বহুপূর্বে কীভাবে ভারতীয় ঋষিরা জ্যোতির্বিদ্যায় এতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন, তা ভাবলে আমাদের গর্বিত হতে হয় বৈ—কি ! সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি ১৪টি অধ্যায়ে শ্লোকাকারে রচিত, যেখানে গ্রহচরিত বর্ণিত হয়েছে “গ্রহাণাং চরিতং মহৎ”।

সূর্যসিদ্ধান্ত—র একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ের বর্ণনার সঙ্গে ভাষাগত ও বিষয়গত ঐক্য অবশ্যই অনুসন্ধিৎসু বিদ্যার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রহ্মাণ্ড, কটাহ, সম্পূট, কক্ষা, মেখলেব, মেষাদিরাশি প্রভৃতিই কেবল নয়, ব্রহ্মাণ্ডকক্ষা (১২ । ৯০), চন্দ্রকক্ষা (১২ – ৮৫), মঙ্গলকক্ষা (১২ । ৮৭), বৃহস্পতিকক্ষা (১২ । ৮৮ – ৮৯) প্রভৃতি সব যে ঐ তরুণ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন করেছিলেন তার নমুনা প্রতি ছত্রে। এমনকী সূর্যের তাপের তারতম্য গ্রীষ্মে ও হেমন্তে কেন—তাও ২০০—তম শ্লোকে তিনি যে—ব্যাখ্যা করেছেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটাই সূর্যসিদ্ধান্ত—র বচনবিন্যাসের স্থানান্তর ঘটিয়ে (১২ । ৪৬)। যদিও দেবাসুর প্রভৃতি পদের পরিবর্তন পাঠককে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। তুলনাত্মক আলোচনার প্রেক্ষিতে নমুনা প্রদর্শিত হল :

অত্যাসন্নতয়া তেন গ্রীষ্মে তীব্রকরা রবেঃ ।
দেবভাগেহসুরাণান্তু হেমন্তে মন্দতানাথা ।।

(সূর্যসিদ্ধান্ত. ১২ । ৪৬)।


এখানে ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন :

প্রত্যাসন্নতয়াস্মাকং গ্রীষ্মে ভীষ্মকরো রবিঃ ।
হেমন্তে ত্বতিদূরত্বাৎ মন্দো ভবতি মন্দসূঃ ।।

ভূগোল শীর্ষক আলোচনায় দুধরনের মতেরই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন একদল বলে থাকেন পৃথিবীটা হাঁসের ডিমের সদৃশ, আবার অন্যদল বলেন—কমলালেবুর মতো :


কৈশ্চিদ্বিনিশ্চিতা পৃথ্বী হংসীডিম্বনিভাকৃতিঃ ।
অপরৈরুচ্যতে ধীরৈর্জম্বীরসদৃশাকৃতিঃ ।।

(২৮১ সংখ্যক শ্লোক)।



এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা ভেদে চার মহাদেশের বর্ণনায় পাঠক ঋদ্ধ হয়েছেন। এশিয়ার মধ্যে ভারতের সর্বাগ্রে উল্লেখ ভারতবাসী মাত্রেই দৃষ্টি কাড়ে। ভারতবর্ষ এক বিশাল দেশ (তখন তো অবিভক্ত ভারত)। এখানে বিভিন্ন জনপদের বর্ণনায় ঈশ্বরচন্দ্র বন্ধনহীন। বস্তুত কেবল সংস্কৃত পাঠেই নয়, সমগ্র ভূমণ্ডলের বিষয়েও তাঁর অগাধ অনুসন্ধিৎসু এক স্বভাবজ পারদর্শিতার নমুনা। গৌড় নামক জনপদের প্রধান নগরী ‘কলিকাতেতি সংজ্ঞিতা’। এছাড়া অযোধ্যা, লক্ষ্মৌ, বিহার, পাটনা, কুরুক্ষেত্র, দিল্লি, কাশ্মীর, শ্রীনগর, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, লাহোর, মহীশূর, গুজরাট, উৎকল, কটক, নেপাল, কাঠমাণ্ডু, অসম প্রভৃতি স্থানের নামোল্লেখ ভারতের ইতিহাস চর্চায় উৎসাহিত করে।

ভারতবর্ষের উত্তর—পূর্বে চিন। এশিয়ার অন্তর্গত হলেও যাকে মহাদেশ বললে অত্যুক্তি হয় না—“অস্তি চীন ইতি খ্যাতো মহাদেশোহতিশোভিতঃ” (৩০৩ সংখ্যক শ্লোক)। চিনের প্রাচীর প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য বিষয়ের অন্তর্গত। চিনের রাজধানী পিকিং। এ ছাড়া জাপান, তিব্বত, লাসা, পারস্য, আরব, মক্কা, তুরস্ক, রুসিয়া, সিংহল, কলম্বো প্রভৃতির উল্লেখে সমগ্র এশিয়া নিয়ে ভাবনার সার্বিক রূপরেখা অঙ্কনের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় সংকলন নিঃসন্দেহে। বর্তমানে যারা সিংহল (শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণে যান এবং দ্বীপময় কলম্বো পরিদর্শন করেন, ঈশ্বরচন্দ্র রচিত এই গ্রন্থ পূর্বপঠিত থাকলে নির্দ্বিধায় বলবেন, “কলম্বনগরে তস্য রাজধান্যতিমঞ্জুলা” (৩১২ সংখ্যক শ্লোক)

এশিয়ার পরে ইউরোপ। ইউরোপের পূর্বদিকে এশিয়া, দক্ষিণদিকে ভূমধ্যসাগর, উত্তরদিকে উত্তর মহাসমুদ্র এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থিতি। সমুদ্রের জলপথ বরাবরই বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল হলেও এই প্রসঙ্গে ভূমধ্য সাগরের জুড়ি মেলা ভার। ইউরোপের চোদ্দোটি প্রধান দেশের মধ্যে ইংল্যান্ড অন্যতম হওয়ায় প্রথমেই সে—দেশের বর্ণনা। ইংল্যান্ড ভোগের দেশ ‘প্রজানন্দপ্রদায়িনী’ (৩১৯ সংখ্যক শ্লোক)। এর রাজধানী হলো লন্ডন। এই লন্ডনের টেম্‌স নদী সুপ্রসিদ্ধ। নদীর ওপরে রয়েছে চারটি বড়ো সেতু—“চত্বারোমহান্তঃসন্তিসেতবঃ” (৩২০ সংখ্যক শ্লোক)। লন্ডনকে আবর্তিত করে আরও নানা শহর থাকলেও বাহুল্য শঙ্কায় ঈশ্বরচন্দ্র সবিস্তারে বলেননি। ইংল্যান্ডের পরে ফ্রান্স (৩২৪ থেকে ৩২৯ সংখ্যক শ্লোক)। এর পশ্চিমে আটলান্টিক, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং উত্তরে হল্যান্ড। ফ্রান্সের প্রধান শহর প্যারিস—“প্রধাননগরং তস্য মতং পারিসসংজ্ঞিতম্‌”। এই প্যারিসে বহু সংখ্যক ধনাঢ্য পরিবারই কেবল নয়, বহু গুণীজনও এখানে বসবাস করেন। এরপর স্পেনের মাদ্রিদ নগর উল্লিখিত। ক্রমে ক্রমে পোর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মান, সুইটজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ইটালি, তুরস্ক, রাশিয়া বর্ণিত (৩১৩ থেকে ৩৮০ সংখ্যক শ্লোকে ইউরোপের পরিক্রমা)।

তৃপ্ত পাঠক দৃষ্টি দেন তৃতীয় মহাদেশ আফ্রিকার চর্চায়। এত বিশাল ইউরোপকে তো শ্লোকবদ্ধ করা যে সে ব্যাপার নয়। একজন বিবিদিষু সংস্কৃত বিদ্যার্থী যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে আমরা প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের গবেষকরা সন্ধান পেয়েছি এক নতুন আলোর। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে স্বীকার করেছেন, সংক্ষেপে ইউরোপের বর্ণনা করে এবার তৃতীয় ভাগ আফ্রিকা প্রসঙ্গে কিছু বলছি :


নিরূপিতো য়ুরোপোহয়ং সংক্ষেপেণ যথামতি ।
ইদানীমাফ্রিকো নাম তৃতীয়ো ভাগ উচ্যতে ।।

এই আফ্রিকার বর্ণনা চলেছে ৩৮১—৩৯৫ সংখ্যক শ্লোক পর্যন্ত। মিশরের চিত্তাকর্ষক শ্লোকবিন্যাস সহজ, সরল ছন্দে পাঠককে আপ্লুত করে। এই মিশরের রাজধানী কায়রো যখন ছন্দের আনুকূল্যে ‘কেরো’ রূপ পায়—তখন ঈশ্বরচন্দ্রের শ্লোক রচনার তারিফ করতে হয় (৩৯০ সংখ্যক শ্লোক)। ভূগোল লেখার জন্য যতটুকু লিখতে হয়, তিনি ততটুকুই লিখেছেন।

এইবার চতুর্থ ভাগ আমেরিকা। তরঙ্গিণী মিসিসিপি পৃথিবী জোড়া খ্যাতি আদায় করে নিচ্ছে বলে ঈশ্বরচন্দ্র এর উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার প্রধান নগর ওয়াশিংটন, যাকে নির্দেশ করা হয়েছে ‘বাসিন্টন’ রূপে (৪০৩ সংখ্যক শ্লোক)। এই বাসিন্টনের বাসিন্দারা বিন্দাস জীবন কাটান। ৩৯৬—৪০৮ সাকুল্যে তেরোটি শ্লোকে এই চতুর্থ ভাগ সীমায়িত। একেবারে অন্তিম শ্লোকে স্থান পেয়েছে ব্রাজিল এবং এই দেশ যে মনোহর হীরের আকর তা স্পষ্টাক্ষরে নির্দেশিত, “মনোহরাণাং হীরাণামাকরস্তএ বর্ত্ততে”।

১৮৩৮ বা ১৮৩৯—এ একজন প্রাচ্যের সংস্কৃত বিদ্যার্থী ভূগোল-খগোল পরিক্রমায় সময় ব্যয় করছেন এবং এই ধরণীর নানা দেশের অনুপুঙ্খ বিশ্ল্বেষণে ব্রতী হয়েছেন—যখন যোগাযোগের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে যত কম বলা যায়, ততই ভালো—তখন তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। মনে রাখতে হয়, সব যুগেই আঠারো বা উনিশ রোমান্টিকতায় ভরা থাকে। সেই আঙ্গিকে বিচার করলে এক পুরোপুরি বিপরীত মেরুর মানুষের নাগাল পান উত্তর প্রজন্মের পাঠক। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের পাঠকের মনে বিহ্বল আনন্দের ঘোর। পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত—র অধ্যবসায়ী বিদ্যার্থী যখন কলকাতা থেকে আমেরিকাকে শ্লোকবন্দি করেন এবং দ্রুত এগিয়ে যান অনেক অনেক দূর দেশের ভিতরে—যেসব দেশের অজানা, অচেনা পথঘাট আজ নতুন চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত, তখন মনে হয় কতদিন আগে তিনি তাঁর দেশবাসীকে উজ্জীবিত করতে কলম হাতে নির্বিকার চিত্তে সময় অতিবাহিত করেছেন।

এটা ঠিক যে তাঁর বর্ণনার সঙ্গে গ্রন্থে বর্ণিত দেশসমূহের মিল এতদিন পর খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার; তথাপি দূর থেকে খুঁটিয়ে দেখার প্রবণতা ও আধুনিক মনন, বিভিন্ন দেশের নাম, জনপদের বিবরণ, নদী—পর্বতমালার নির্ভুল বিবরণ দিয়ে তিনি ভূগোল নিয়ে চর্চায় রত মানুষজনের কছে এক শাঁখ বাজানো ভগীরথ—এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। বস্তুত, তাঁর দেখা কলকাতাও আজ আর সেই কলকাতা নেই; ভিতরে ও বাইরে দুয়েতেই তার আমূল সংস্কার ও পরিবর্তনের ছাপ। কিন্তু ২০১৬—র পাঠক যখন জানতে পারেন, এই কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বিদ্যার্থীর বিশ্ববর্ণনে ও বিশ্বচিন্তনে মগ্ন, তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। অন্তরাত্মা নিজেকে প্রশ্ন করে ‘চিনতে পারছো’ উত্তরও পায় ‘সোহহম্‌’—আমি সেই। সুতরাং দৃষ্টিকে কেবল সামনে প্রসারিত করো, পথ চলো।

প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার তীর্থভূমিতে অধ্যয়নকারী বিদ্যার্থী যখন পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত—কে উপজীব্য করে লেখালেখি করেন, তখন কোনও বিস্ময়ের উদ্রেক হয় না। কিন্তু যখন দেখা যায়, প্রাচ্যবিদ্যার সীমারেখার সংবিধান যাই হোক—না কেন, একটি কথা স্পষ্টভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, কেবল দেশের মৃত্তিকারসে সিঞ্চিত নিশ্চিত উপাদানই ভূগোল/খগোল বর্ণনার খাঁটি উপাদান নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যভেদে উভয়বিধ বিদ্যাকে একক কাঠামোয় সংযুক্ত করা জরুরী; এবং যদি তা সম্ভব তবেই ভূগোল/খগোল চর্চার ধারাবাহিকতার সূত্র খোঁজা সম্ভব হতে পারে—তখন আমাদের মনে হয় ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচ্য গণ্ডির সংকীর্ণতা হতে মুক্ত হয়ে বিশ্বজনীন ভাবনাকে বরণ করতে শিক্ষা দিচ্ছেন (শ্লোকসংখ্যা ২৩০—২৭৯ দ্রষ্টব্য)।

পুরাণ সাহিত্য তার যথোপযুক্ত মর্যাদা লাভ করুন, কিন্তু তথাপি অন্যান্য দেশে ভূগোলচর্চা কি রূপ নিচ্ছে, কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে এবং তার সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরীদের চিন্তনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কতদূর বিস্তৃত, তার সবটুকে তিনি মেলে ধরতে চেয়েছেন। এই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের সামান্য প্রয়াসও এক সার্বজনীন দ্যোতনা লাভ করেছে। এই গ্রন্থে সমগ্র শ্লোকাবলির মধ্যে একটি জীবন্ত মন যেমন পাঠক পেয়ে যান, তেমনই পান ভূগোল/খগোল চর্চার এক নিষ্ঠাবান অধ্যবয়সীকে। নিশ্চিতভাবেই এখানে কাব্যবোধের অপেক্ষা ভূগোল বোধের দৃষ্টিভঙ্গি বড়ো। একজন আধুনিমনস্ক ব্যক্তির পক্ষে এই জীবনদৃষ্টির যে প্রয়োজন যে কতখানি জরুরি, তা সহজেই অনুমেয়।

কবে ১৭৮১ সালে জনৈক হর্ষেল সাহেব (William Herschel) দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে ‘জর্জিয়ম্‌’ নামক এক গ্রহ আবিষ্কার করেছিলান এবং তাঁর নামেই সেই গ্রহ ‘হর্ষেলসংজ্ঞয়া’ লোকমুখে প্রচারিত তা জানাতেও তিনি দ্বিধাহীন। আধুনিক ভূগোলে এরই নাম Uranus। বস্তুত শ্লোক রচনার থেকেও আদর্শ সাধনাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাণপণে। ভূগোলচর্চায় ইউরোপীয় মতকে গ্রথিত করে তিনি নিজের প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের নিরবচ্ছিন্ন ধারাকে যে ভবিষ্যতে রক্ষা করবেন, তার যেন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। এক বিস্তৃত পারস্‌পেকটিভের মধ্যে পাঠককে নিয়ে গিয়ে তুলনামূলক অধ্যয়নের দরজাটা খুলে দিলেন। মনে রাখতে হয়, এই ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বসূরি ছিল না। তিনিই প্রথম, যিনি পুরাতন ভূগোলের উপকরণের সঙ্গে ইউরোপীয় মতের উপস্থাপনা করে আধুনিক চেতনার উন্মেষে সহায়ক হলেন। 

এই গ্রন্থে সূর্য থেকে দূরত্ব অনুসারে যে—গ্রহপুঞ্জ বর্তমান, তাদের ক্রমান্বয়ে উল্লেখ যথাযথভাবে করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে সুবিদিত ছয়টি গ্রহ যথাক্রমে বুধ (Mercury), শুক্র (Venus), মহী (Earth), ভৌম/মঙ্গল (Mars), বৃহস্পতি (Jupiter) এবং শনি (Saturn)—২৩৮ সংখ্যক শ্লোকে নির্দেশিত। বুধ গ্রহ সূর্যের সব থেকে কাছে (closest to the sun) বলে প্রথম স্থান পেয়েছে। আমরা পূর্ব অনুচ্ছেদেই Uranus—র কথা জেনেছি। এই গ্রহ ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত বলে ঈশ্বরচন্দ্র যথাযথভাবেই একে নির্দেশ করেছেন, যেহেতু ওঁর শ্লোকাবলির রচনাকাল ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। পক্ষান্তরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদ Johann Galle কতৃক আবিষ্কৃত Neptune—এর উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই রচনাকাল অনুযায়ী অনুল্লিখিত। 

পৃথিবী (পৃথ্বী) সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা সময় নেয় যাকে বছর বলে—“বেষ্টইয়ত্যভিতো ভানুং স সংবৎসর ইহোচ্যতে” (২৪৪ সংখ্যক শ্লোক)। কিন্তু আমরা নিজেদের সুবিধের জন্য ৩৬৫ দিনে বছর গণনা করে থাকি এবং প্রতি চার বছর অন্তর 
(৬ X ৪ = ২৪ ঘন্টা) বাড়তি পাওয়া যায়। এই অতিরিক্ত দিনটি ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্ত হওয়ায় প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি হয় ২৯ দিনের। যার ফলে চার বছর অন্তর গণনার সময় ৩৬৬ দিন ধার্য হয়। একে ইংরেজিতে বলে Leap Year. পৃথিবী তার নিজের কক্ষপথে পরিক্রমণের সময় সূর্যাভিমুখী অর্ধাংশ আলোকিত হওয়ায় দিন এবং অবশিষ্ট অনালোকিত অংশ হল রাত্রি। আমরা ঈশ্বরচন্দ্রের বক্তব্য শুনে আধুনিক ভূগোলের তুলনামূলক আলোচনা করলে সমৃদ্ধ হই। ঈশ্বরচন্দ্র বলেছেন—


তত্রার্কাভিমুখে ভাগে তৎকরস্পর্শনাদ্দিনম্‌ ।
তদন্যত্র তু রাত্রিঃ স্যাৎ তদভাবাদিতি স্থিতিঃ ।।

(২৪৬ সংখ্যক শ্লোক)।


এবার আধুনিক ভূগোলের বর্ণিত অংশে নজর দিই :


“When the earth rotates on its axis, only half of it gets light from the sun at a time. The half which faces the sun has daylight, while the half which is away from the sun experiences night.”


বস্তুত, যদি পৃথিবী তার নিজের কক্ষপথে পরিক্রমা না—করত, তবে এর অর্ধাংশ এত চিরস্থায়ী দিন এবং অবশিষ্ট অংশে হতো চিরস্থায়ী রাত্রি। 

গ্রন্থভার লাঘব করতে তিনি যে বহু বিষয়ের উল্লেখ করেননি, তা নির্দ্ধ্বিধায় স্বীকার করেছেন। কারণ, ভূগোল/খগোলের ব্যাপকতা বিষয়ে তিনি সচেতন। সেই কারণে এই দীনতার অনুভূতিটুকু তাঁকে মানবিক গুণে ভূষিত করেছে। যেমন—‘সংক্ষেপাৎ’ পদটি তিনবার যথাক্রমে—৫, ৩১৩ ও ৪০৪ সংখ্যক শ্লোকে; ‘সংক্ষেপেতঃ’ দু’বার ১৭৫ ও ৩৯৮ সংখ্যক শ্লোকে; ‘সংক্ষেপেণ’ চার বার যথাক্রমে ৩১৩, ৩৮১, ৩৯৬ ও ৩৯৮ সংখ্যক শ্লোকে ; ‘সংক্ষেপেণাধুনোচ্যতে’ দু’বার যথা ১৪৪ ও ২৩০ সংখ্যক শ্লোকে এবং পরিশেষে ‘বাহুল্যশঙ্কয়া’ দু’বার যথাক্রমে ৩২৯ ও ৩৩৩ সংখ্যক শ্লোকে লক্ষণীয়।

শ্লোক ছন্দে লিখিত হয়। এলোমেলোভাবে যথেচ্ছ রচনাকে এজন্য শ্লোক বলে না। পাঠকের চিত্তে আনন্দের উদ্রেক করে এই ছন্দ। ছন্দের নিয়ামক হলো গুরু ও লঘু স্বর বিশিষ্ট বর্ণ বা হ্রস্ব—দীর্ঘ মাত্রা। ভূগোলখগোলবর্ণনম্‌  গ্রন্থটি সুবিন্যস্ত অনুষ্টুভ্‌ ছন্দে রচিত শ্লোক মালায়। ব্যতিক্রম কেবল ১৮০ ক্রমাঙ্কের শ্লোক, যেটি উপযাতি ছন্দে রচিত। সাহিত্যরসিকরা বলেন অনুষ্টুভ্‌ ছন্দ সর্বাপেক্ষা সরল ; যেহেতু এখানে নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি বর্ণেই কেবল ফুরু, লঘু বিচার্য। এখানে দুটি চরণে আটটি করে বর্ণ নিয়ে এক—একটি পদ গঠিত। সকল পাদেই পঞ্চমবর্ণ এবং ষষ্ঠবর্ণ গুরুস্বরবিশিষ্ট। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও চতুর্থপাদে সপ্তম বর্ণ লঘু স্বরবিশিষ্ট এবং প্রত্যেক পাদের অন্যান্য বর্ণ বিষয়ে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমি গুরুস্বরকে (S) এবং লঘুস্বরকে (l) চিহ্নে চিহ্নিত করে নিম্নোক্ত শ্লোকটির ছন্দ নির্ণয় করলাম :


     
অস্তি ভারত(I)ব(S)র্ষাখ্যো / দেশস্তত্রাতি(I)বি(S)স্তৃ(I)তঃ ।

তদন্তব্বর্ত্তি(I)নো(S) দেশা / বহবঃসন্তি(I) স(S)ন্ত(I)তাঃ ।।

(২৮৬ সংখ্যক শ্লোক)


এখানে প্রতিপাদে পঞ্চম বর্ণ লঘুস্বরবিশিষ্ট এবং ষষ্ঠ বর্ণ গুরুস্বরবিশিষ্ট দেখা যাচ্ছে; এ ছাড়া দ্বিতীয় ও চতুর্থপাদে সপ্তম বর্ণ লঘুস্বরবিশিষ্ট হওয়ায় এখানে অনুষ্টুভ্‌ ছন্দ প্রতিপন্ন হলো।


পরিশেষে বলি, একটি কৃশ অথচ উজ্জ্বল গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জীবদ্দশাতেই যদি মুদ্রিত আকারে আমাদের উপহার দিতেন, তবে সেই সুরুচিমণ্ডিত আভিজাত্যের কাছে আমরা আরও বিবিধ বিষয় জানতে পারতাম। যখন গ্রন্থের শেষে দেখি তিনি বলছেন—“ন্যায়শাস্ত্রাধ্যায়িনঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্মণঃ কৃতিরিয়ম্‌”, তখন দর্পে গর্বে হৃদয়—মন ভরে ওঠে। অমূল্য এই গ্রন্থের আলোচনার মাধ্যমে আমি বাংলা গদ্যের পিতৃতর্পণ করলাম। বন্দে ঈশ্বরচন্দ্রম্‌।



তথসূত্র :



১ অগ্নিপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৯৯৯. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

২ পুরাণ পরিচয়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মডার্ন বুক এজেন্সী প্রাঃলিঃ, ১৯৭৭ 
কলকাতা ৭৩

৩ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিঃ ১৯৭৩ কলকাতা  ১৩

৪ বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বুকল্যান্ড প্রাঃ লিঃ
কলকাতা ৬

৫ বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

৬ ব্রহ্মপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১৯৯৯. নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা ৯

৭ সূর্যসিদ্ধান্ত, শ্রী বিজ্ঞানানন্দ স্বামী সম্পাদিত, ভারতমিহির যন্ত্রালয়, ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ, কলকাতা, ২৫ নং রায়বাগান স্ট্রীট

৮ সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালীর দান, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা ৬

৯ Canningham’s Ancient Geography of India, 1924, S.N. Majumdar, Calcutta

১০ Geographical Concepts in Ancient India, 1967, B. Dubey, The National Geography Society of India, BHU, Varanasi, 1967

১১ Longman Geography, Anuradha Mukherjee, Rupasree Mukherjee, Published by Dorling Kindersley (India) Pvt. Ltd. 2012.

১২ Studies in the Geography of Ancient and Medieval India, D.C Sircar, Varanasi, 1960

১৩ Surya-Siddhanta (Eng. Trans.) 1936, E. Burges, Calcutta

১৪ Surya Siddhanta, Ed. By Sudhikat Bharadwaj, 1991, Parimal Publications, Delhi.

১৫ The Geography of Puranas, S. M. Ali, 1966 Peoples’ Publishing House, New Delhi.

১৬ The Holy Puranas, Bibek Debroy & Dipavali Debroy, Vol. I—III, 1994, B. R. Publishing Corporation, Delhi.


0 comments: