0

প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


নাসায় আবদুল কালামের দেখা সেই ছবিটি 
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় 



প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৬২ সালে সারাভাই সাত জনের একটি দল নাসায় পাঠালেন। এই দলে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন, এ পি জে আবদুল কালাম (অ্যারোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ার), প্রকাশ রাও, বি রামকৃষ্ণ রাও, আর আরাভামুদন এবং প্রমোদ কালে (এঁরা সকলেই ছিলেন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার), এইচ জিএস মূর্তি এবং ডি ঈশ্বরদাস (এঁরা ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার)। আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমে সকলে গেলেন নাসা-তে— ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে অবস্থিত ল্যাংলে গবেষণা কেন্দ্রে (LRC)। এই গবেষণা কেন্দ্রে মূলত নাসা-র উচ্চতর মহাকাশ প্রযুক্তির গবেষণার কাজ হয়ে থাকে। এখানে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ নেবার পর আবদুল কালাম গেলেন মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্ট-এ গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে (Goddard Space Flight Centre)। নাসার পৃথিবী পরিক্রমাকারী উপগ্রহগুলির অধিকাংশেরই নির্মাণ ও মহাকাশ যাত্রা চলাচলের সামগ্রিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় এই কেন্দ্র থেকে। এরপর তিনি যান ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে (Wallops Flight Facility)। কেন্দ্রটি ভার্জিনিয়ার ইস্ট কোস্টের ওয়ালপস দ্বীপে অবস্থিত। এখানেই নাসা-র সাউন্ডিং রকেটের নক্সা তৈরি হয়। ছ’মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে কালাম দেশে ফিরে আসার ঠিক পরেই ভারতের প্রথম সাউন্ডিং রকেট ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষিপ্ত হয়। 

নাসা-র কেন্দ্র ভার্জিনিয়ার ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে থাকার সময় সেখানকার রিসেপশন লবিতে টাঙানো একটা ছবির প্রতি কালাম আকৃষ্ট হন। ছবিতে ছিল টিপু সুলতানের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধের দৃশ্য। অষ্টাদশ শতকের ঐ যুদ্ধে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল টিপু সুলতানের রকেটবাহিনী। এই রকেটের ধারাবাহিক ইতিহাস জানতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে অগ্নিবাণ-এর যুগ থেকে। 

হুস্‌। অমাবস্যার রাতে উপরে উঠে গেল একটা আলোর রেখা। তারপরেই বুম-ফটাস্‌। আকাশের বুকে ঝরে পড়ল নানা রঙের আলোর মালা, নয়তো আলোর ফুলঝুরি। কালী পুজোর রাতে এ দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। আকাশে রঙ ধরাতে হাউই বাজির জুড়ি নেই। এই হাউই বাজি প্রথম কারা তৈরি করেছিল? আমাদের দেশের উত্তরে রয়েছে হিমালয় পর্বত। সেটা পেরিয়ে ওপারে গেলেই চীন দেশ। চীনারাই নাকি প্রথম হাউই তৈরি করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে আটশো-ন’শো বছর আগে তারা বারুদ আবিষ্কার করেছিল। কারও কারও মতে আটশো-ন’শো বছর নয়, প্রায় দু’হাজার বছর আগেই তারা বারুদের ব্যবহার শিখেছিল। ছোট ছোট সরু নলে বারুদ পুরে তারা হাউই বাজি তৈরি করত। আনন্দ অনুষ্ঠানে তা পোড়ানো হত। এই আতসবাজি একদিন আকাশ থেকে নেমে এল যুদ্ধক্ষেত্রে। 

আতসবাজির মাথায় ছোট ছোট তীর লাগিয়ে চীনারা তৈরি করে ফেলল যুদ্ধাস্ত্র। ‘আতস’ কথাটা পারস্যের। বাংলা ভাষায় তর্জমা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় আগুন। বারুদ ভরা নলের পিছনে আগুন ধরিয়ে দিলেই তা ছুটে যেত শত্রু সৈন্যের দিকে। তীরের ফলার আঘাতে মারা পড়ত শত্রু সৈন্য। আর আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যেত শত্রুদের ছাউনিগুলি। এই আগুনের তীরগুলি শত্রু সৈন্য-র উপর যখন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ত তখন শত্রু শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যেত। ১২৩২ সালে মঙ্গোলিয়ানরা হোনান (Honan) প্রদেশের রাজধানী কাইফেন শহর ঘিরে ফেলে। শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য চীনারা তখন শহরের ভিতর থেকে আগুনের তীর ছুড়তে থাকে। ১২৮৮ সালে মঙ্গোলরা যখন ভ্যালেনসিয়া শহর আক্রমণ করেছিল তখন তারা আগুনের তীর ব্যবহার করেছিল। 

ভারতীয় পুরাণগুলিতে এই ধরনের অস্ত্রের উল্লেখ আছে। রাম-রাবণের যুদ্ধে শক্তিশেলের ঘায়ে লক্ষণ প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। এই মারণাস্ত্রটির যে বর্ণনা রয়েছে তা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি আগুনের তীর বা অগ্নিবাণের অনুরূপ কোনো অস্ত্র ছিল। মহাভারতেও এই ধরনের অস্ত্রের উল্লেখ আছে। গা দিয়ে আগুন বের হয় এমন সব তীর ছোড়ার বর্ণনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আছে। জরাসন্ধ রাজগীর থেকে একটা গদা ছুড়েছিল। সেটা নাকি পড়েছিল সুদূর বৃন্দাবনে। তাই দেখে কৃষ্ণ সহ সেখানকার রাজা ভয়ে গূজরাটের কচ্ছে পালিয়া যান। আর কোনোদিনই ফিরে আসেননি। জরাসন্ধের গদা কি অতি শক্তিশালী অগ্নিবাণ ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ পুরাণকাররা এই অস্ত্রগুলির নির্মাণ কৌশল কোথাও উল্লেখ করেন নি। তাই এই ধরনের অস্ত্র ভারতে আদৌ বাস্তবে ছিল কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। এগুলি লেখকদের কল্পনাপ্রসূত এমনও হতে পারে। যেমনটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হয়ে থাকে। যাইহোক, এই অগ্নিবাণ বা আগুনের তীর-ই হল আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আদিরূপ বা প্রাথমিক রূপ। 

চীনাদের এবং মঙ্গোলদের হাত ধরে অগ্নিবাণ যুদ্ধক্ষেত্রে যতই তেড়েফুড়ে আসুক না কেন পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। শক, হুন, পাঠান, মোঘল প্রভৃতি বিদেশীরা যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল তখন এদের আগুনের তীর ছুড়তে দেখা যায় নি। আলেকজান্ডারও এই অস্ত্র ব্যবহার করে নি। ভারতীয় রাজাদেরও এই অস্ত্র নিয়ে কোনোদিন যুদ্ধ করতে দেখা যায় নি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে যোদ্ধারা কেন এই অস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? কিছুটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে এর কারণগুলি খোঁজা যাক— 

(১) অগ্নিবাণের বারুদে আগুন দেওয়ার পর তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। 

(২) এক সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে এই অস্ত্র না ছুড়লে আশানুরূপ ফল পাওয়া যেত না। 

(৩) সে যুগের যোদ্ধারা নিজেদের বীর বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করত। অগ্নিবাণ যেহেতু দূর থেকে এবং আড়াল থেকে ছোড়া হত তাই সেটা তাদের কাছে বীরের মর্যাদা সম্পন্ন যুদ্ধ ছিল না। আড়াল থেকে যুদ্ধ করে কাপুরুষেরা, বীর যোদ্ধারা নয়। 

(৪) সামনা সামনি এবং সমানে সমানে যুদ্ধ করতে সে যুগের যোদ্ধারা ভালোবাসত। 

(৫) কামান আবিষ্কার। 

বাবর যখন ভারত আক্রমণ করেছিল তখন তার সঙ্গে কোনো অগ্নিবাণ ছিল না, ছিল কামান। ভারতীয় রাজারাও বাবরের সঙ্গে তীর-ধনুক, তলোয়ার, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। কামানের বিরুদ্ধে এইসব সাবেকি অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধে জেতা যাবে না সেটা বুঝতে পেরেও তাঁদের কোনো আগুনের তীর ব্যবহার করতে দেখা যায় নি। এ থেকে বোঝা যায় যে আগুনের তীর সম্পর্কে রাজাদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই তাঁরা এই যুদ্ধাস্ত্রটি নিয়ে কোনো চর্চা করেন নি। যে মঙ্গোলরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভ্যালেনসিয়া শহর আক্রমণের সময় আগুনের তীর ব্যবহার করেছিল কামান আসার পর তারাও এই অস্ত্রটি পরিত্যাগ করে। ফলে যদ্ধক্ষেত্র থেকে এর নাম ধীরে ধীরে মুছে যায়। শুধু আতসবাজী হয়ে আকাশে রোশনাই করতে থাকে। ক্রমে ক্রমে মানুষও ভুলে গেল অগ্নিবাণ বা আগুনের তীরের কথা। 

যুদ্ধক্ষেত্রে তখন কামানের রমরমা। বাবরের হাত ধরে ভারতবর্ষেও ঢুকে পড়েছে কামান। মোঘল রাজত্ব শেষ হতে চলেছে। ভারতের মাটিতে ইংরেজরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। একটির পর একটি রাজ্য তারা গ্রাস করে চলেছে। কঠিন বাধা পেল দাক্ষিণাত্যের মহীশূর রাজ্যে। সেখানকার রাজা তখন হায়দার আলি। রণাঙ্গনে দু’পক্ষই সৈন্য সাজিয়েছে। সামনের সারিতে কামানবাহিনী। গর্জে উঠল কামান, বন্দুক। ঝলসে উঠল তরবারি। দু’পক্ষ যখন তুমুল যুদ্ধে ব্যস্ত তখনই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। ইংরেজ সৈন্যরা সবিস্ময়ে দেখল আকাশ পথে ছুটে আসছে এক ঝাঁক আগুনের গোলা। ব্যাপারটা কী? যুদ্ধ তো এখনও চলছে। তাহলে মহীশূর রাজ্যে কীসের বিজয় উৎসব শুরু হল যে তারা আকাশে আতসবাজী ছুড়ছে? ভুল ভাঙল একটু পরেই। আগুনের গোলাগুলি ইংরেজ সৈন্যদের মাঝে এসে পড়তে শুরু করল। এক একটি পড়ছে আর বু-উ-ম শব্দে ফাটছে। বোমার ঘায়ে ইংরেজ সৈন্য তখন ধরাশায়ী। যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গেল তারা। মহীশূর রাজ্য জয়ের ইচ্ছে তখনকার মত তাদের পরিত্যাগ করতে হল। না করে উপায়ই বা কী। কামান-বন্দুক দিয়ে সামনা সামনি যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু আকাশ পথে আসা চালকহীন আগুনের গোলাগুলির সঙ্গে তারা কীভাবে যুদ্ধ করবে সে পথ তো তাদের জানা নেই? 

সেদিনকার যুদ্ধে হায়দার আলির সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের তাক করে কী ছুড়েছিল? কামানের দাপটে অগ্নিবাণ একদিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ঠাঁই হয়েছিল বাজীকরদের ভাণ্ডারে সাধারণ বাজী হিসেবে। লোকের মনোরঞ্জন করা ছাড়া তার আর কোনো ভূমিকা ছিল না তখন। ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে সেই অগ্নিবাণ আবার ফিরে এল নতুন রূপে। বারুদ ভর্তি চোঙের মাথায় এবার আর তীর লাগানো ছিল না, ছিল বিস্ফোরক। আজকের তুলনায় এদের পাল্লা খুবই কম ছিল ঠিকই, তবুও এদের মিসাইল বললে ভুল হবে না। ভারতের একটি ছোট রাজ্যে যে মিসাইল চর্চা চলছিল তা কারও জানা ছিল না। সেদিনকার সেই যুদ্ধে শুধু ইংরেজরাই নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছিল মিসাইলের কী অসীম ক্ষমতা। যুদ্ধে হেরে গেলেও ইংরেজরা সেদিন বুঝেছিল যে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিধর জাতি হিসেবে পরিচিত হতে গেলে যেনতেনপ্রকারে এই প্রযুক্তি হস্তগত করতে হবে। তবে যতদিন হায়দার আলি বেঁচে ছিলেন ততদিন মহীশূর রাজ্য পুনরায় আক্রমণের সাহস ইংরেজরা আর দেখায় নি। 

হায়দার আলির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান। ইংরেজরা আবার মহীশূর রাজ্য আক্রমণ করে। তারা জানত টিপুর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধে পেরে উঠবে না। কারণ টিপুর হাতেও আছে মিসাইল। এই মিসাইল তাঁর বাবার আমলের মিসাইলের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। শুধু পেতল নয়, পেটাই লোহার নল দিয়ে এই মিসাইল তৈরি হত। এতে থাকত তিনটে অংশ— 

(১) দিক বা নিশানা নির্ণয় ব্যবস্থা, 

(২) গতি সঞ্চার ব্যবস্থা, 

(৩) মাথার কাছে বিস্ফোরক ব্যবস্থা। 

টিপুর মিসাইলবাহিনীতে প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল। এই বিশাল মিসাইলবাহিনীর সঙ্গে কামান-বন্দুক নিয়ে এঁটে ওঠা যাবে না বুঝতে পেরে ইংরেজরা সামনাসামনি যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনীতির আশ্রয় নেয়। ইংরেজদের কূট-চালে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরঙ্গপত্তনের যুদ্ধে টিপুর পতন হয়। এই যুদ্ধে তাঁর সেনাবাহিনী সাতাশটা ব্রিগেডে বিভক্ত ছিল। এগুলিকে বলা হত কুশুন। প্রত্যেক কুশুনে থাকত মিসাইল বিশেষজ্ঞ সেনাদের একটা অংশ। এদের নাম ছিল জুর্ক। যুদ্ধে টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ব্রিটিশদের হাতে আসে অব্যবহৃত সাতশো গোটা রকেট এবং নয়শো রকেটের অংশ বিশেষ। দেশে ফিরে গিয়ে ইংরেজরা এই রকেটগুলি পরীক্ষা করে এবং এর প্রযুক্তি বুঝে নিয়ে তৈরি করে নিজেদের রকেট। 

টিপু সুলতানের রকেট বর্ষণে ইংরেজদের পর্যুদস্ত হওয়ার কাহিনীই ধরা আছে ওয়ালপস ফ্লাইট ফেসিলিটি-তে রাখা ঐ ছবিতে। এই ঘটনার কথা ভারতবর্ষ ভুলে গেলেও সুদূর আমেরিকায় সেই স্মৃতি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। মহাকাশ অভিযানে অগ্রনী মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ এইভাবে যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন ভারতীয়কে বীর হিসেবে উচ্চাসনে বসিয়েছে।


0 comments: