স্মৃতির সরণী - অভীক সরকার
Posted in স্মৃতির সরণী
স্মৃতির সরণী
পাটায়াতে পটলকুমার
অভীক সরকার
ইজ্জত একেবারে ধুলোমে পড়কে বিলকুল গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে হাওয়ার সঙ্গে উড় গ্যায়া!!!
ইণ্ডিগোর ফ্লাইটে রাত আড়াইটেয় ব্যাঙ্কক এসে পৌঁছে শুনি ভোর চারটের আগে ট্রান্সফার দেবে না। এদিকে এয়ারপোর্টের দোকানপাটও দেখি সব ঝাঁপতোলা। অতএব ক-এ কমললোচনে শ্রীহরি আবৃত্তি করা ছাড়া কিছুই করার থাকে কি? লোকজন ইতিউতি ঘুরতে লাগলো, আর আমিও কমলকুমার মজুমদারের ওপর অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর লেখা একটা বই নিয়ে একটা বেঞ্চে লম্বা হবো হবো করছি, ছফুট চার ইঞ্চি হাইট আর একশো কিলো ওজনের তিনসুকিয়ার সেলস অফিসার কার্তিক শুক্লা, আমাকে একবার হাল্কা করে জিজ্ঞেস করে গেলো লাগেজ খুলে একটা ওল্ড মঙ্কের লার্জ বানিয়ে দেবে কিনা। মাতাল আর কাকে বলে?
সাউথ কলকাতার সেলস অফিসার হরিকমল দেখলাম খুব হাসিমুখে আমার দিকেই আসছে। কি রে, ব্যাঙ্ককে নেমেই রাতবিরেতে এত আনন্দ কিসের তোর? লক্ষণ তো ভালো না, অ্যাঁ? সে ছোঁড়া অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালো একটা বেশ ফাঁকা রুম ও খুঁজে পেয়েছে, একদম খালি, কয়েকটা মাদুর টাইপের কি সব পড়ে আছে, আমি কি গিয়ে একটু গড়িয়ে নেবো?
শুনে তো আমি খুবই ইম্প্রেসড, বলে কি ছেলে? এয়ারপোর্টে আজকাল শিয়ালদা'র ডর্মিটরি খুলেছে নাকি? হাজার হোক সেলসের লোক.... জিজ্ঞেস করলুম, কি রুম রে? ছোকরা সেম হাসিমুখে জানালো, বাইরে লেখা আছে "প্রেয়ার রুম" !!!
অর্থাৎ, নামাজ আদায়ের রুম! ছোকরার দোষ নেই, পেরথম বার বিদেশে এয়েচে!
সেলসের লোকেদের লাইফে স্কিম আর ইন্সেনটিভ, এই বস্তুদুটি লেগেই থাকে, যাগযজ্ঞে ওম এবং স্বাহা ধ্বনিদুটির মতই। তেমনই এক ইনসেন্টিভের পার্ট হিসেবে এই ব্যাঙ্কক যাত্রা। সর্বসাকুল্যে আটজনের টিম, পাঁচটি ফুলের মতই পবিত্র ও নিষ্পাপ সেলস অফিসার আর দুটো মুশকো টাইপের ষণ্ডা চেহারার অত্যাচারী এ এস এম, সবমিলিয়ে সাতভাই চম্পা বললেই চলে, আর পারুল বোন হিসেবে আমি, ইস্ট রিজিওনের আর এস এম, শ্রীলশ্রীযুক্ত....
বাদ্দিন, তা সেই শবরীর প্রতীক্ষার শেষে যখন হোটেলে পৌঁছলুম, সুনয়নী রিসেপশনিস্টটি...
যাদের বাজে ইতরগন্ধী ছ্যাঁচড়াপনা অপছন্দ, তেনারা এখানেই ক্ষান্ত দিলে খুবই ভালো করবেন। এমনিতেই আমার লেখা কেউ বিশেষ পড়েটড়ে না। যেসব রুচিশীল শ্রদ্ধেয় লোকজন তাও ক্ষমাঘেন্না করে মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে দেখেন, এই লেখা পড়ে যদি তেনাদের ব্লাডপ্রেশার অকস্মাৎ গগনচুম্বী হয়ে পড়ে, রাতবিরেতে সরবিট্রেট হাতে ছুটতে পারবো না, আগেই কয়ে রাখলুম বাপু, হ্যাঁ।
যাগগে যাক, তা সেই সুনয়নী রিসেপশনিস্টটি পাসপোর্ট, বুকিং পেপার্স ইত্যাদি চেক করে রাগী ডলপুতুল টাইপের টোনে প্রথমে বললেন "অল রুমস আর নন স্মোকিং, ইফ ইউ স্মোক, ওয়ান তাউজেন্দ বাত ফাইন", এতটা শুনেই ভাবছি কলকাতায় ফিরে ট্রাভেল এজেন্ট অভিষেককে তিনমাসের জেলই দেবো, না সাতদিনের ফাঁসি, এবং সময় তিনি কাংস্যনিন্দিত কন্ঠে ফের বলে উঠলেন "অ্যান্ড ইফ ইউ স্তিল আওয়ার তাওয়েল, দু তাউজেন্দ বাত ফাইন"!!
অয়ি সুন্দরী, আমাদের দেখে কি তোর তোয়ালেচোর মনে হচ্ছে, অ্যাঁ?
পরে বুঝলুম এঁয়াদের দোষ নেইকো। আমাদের দেশোয়ালি ভাইরাই নিশ্চয়ই কেউ এমত নিদর্শন রেখে গেছে আগে, নইলে এরাই বা অমন করে বলবে কেন?
এ বিষয়ে আমার এক পুরোন কলীগের কথা মনে পড়ে গেলো। ভদ্রলোক সমস্ত হোটেলের যাবতীয় জিনিসপত্র নিজের মতো করেই দেখতেন, একদম নিজের মনে করে। রুমে ঢুকেই চটপট সাবান, শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজার, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি, টি ব্যাগ, সুগার স্যাশে ইত্যাদি যা হাতের কাছে পেতেন সে সওওব দ্রুত নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে, তারপর হাউস কিপিং এ ফোন করে "এইও, তুম লোগ কা সার্ভিস তো একদম বেকার দেখতা হ্যায় রে, ঘরমে সামানপাতি রাখনেসে কি তোমলোগোকো খুব কষ্ট হোতা হ্যায় রে ব্যাটা" বলে সেইসব জিনিস আরেকদফা আনাতেন। আমরা বলাবলি করতাম দাদার বাড়িতে বিভিন্ন হোটেলের ছাপমারা চাদর, বালিশের ওয়াড়, তোয়ালে থেকে শুরু করে আদ্ধেক কনজিউমেবল ইত্যাদি যা আছে, উনি স্বচ্ছন্দে একটা মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ হোটেল খুলে বসতে পারেন।
তবে যেদিন দেখলাম দাদা হায়াত রিজেন্সির বাথরুমের মধ্যেকার জুতো পালিশের মেশিনটাকে খুব মনে দিয়ে দেখছেন, আর আমি হালকাচ্ছলে " কি গো দাদা, এবার কি এটাও নিয়ে যাবার প্ল্যান কষছো নাকি" প্রশ্ন করাতে আক্ষেপের সুরে বলেন "নারে, অত বড় ব্যাগ আনিনি", সেদিন ওনার প্রতি আমার সম্মান যাবতীয় ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ব্রেক করে ফেলে!!!
যাগগে, কি বলছিলাম যেন? হ্যাঁ। তা রুমে ঢুকে চটপট ফ্রেশ হয়ে পাটায়ার সী বিচে দৌড়ে গেলুম।
এবং অত্যন্ত নিরাশ হলুম। সরু একটা বিচ, নোংরা, কিছুই তেমন দেখার নেই, চাট্টি বিকিনিপরিহিতা সুন্দরী বাদে। এর থেকে মন্দারমণি কি তাজপুরও অনেক ভালো।
তবে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রাস্তাটি, অর্থাৎ মেরিন ড্রাইভটি ভারি বাহারি। সুন্দর সাজানো গোছানো ঝকঝকে রাস্তা। তাতে নানা দেশীবিদেশী ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে মাঝেমাঝে ছোট ছোট কফি বা বিয়ারের ঠেক। মাথা তুললেই নীল আকাশ, তাতে উঁকি দিচ্ছে রাস্তার পাশে লাগানো পাম গাছগুলোর উঁচু মাথা। রাস্তার অন্যফুটে ছোট ছোট দোকান, সেখান থেকে দরদাম করে একটা চপ্পল কিনলুম। সে জিনিস আমি এখনও ব্যবহার করি, যেমন আরাম, তেমন টেঁকসই।
তারপর হোটেলে ঢুকে দেখি সাত ভাই চম্পা গোল হয়ে বসে, মধ্যমণি এক মহিলা, বয়েস আঠাশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যেই কিছু একটা হবে। বুঝলাম ইনিই আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড। আমি ঢুকতেই সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিলো, হাজার হোক আর এস এম বলে কথা, বয়সে, সম্মানে, পদমর্যাদায়....
ভদ্রমহিলা প্রথম প্রশ্ন করলেন, "হোয়েন আর ইউ গোয়িং তু বুমবুম?"
বুমবুম? সেটা আবার কি? ধূপগুড়ির আরতিপিসির নাতির নাম তো বোধহয় শুনেছিলাম বোধহয় এরকম কিছু একটা, নাকি বোমাটোমা নিয়ে কিছু বলছে? কেষ্টদা তাহলে আজকাল এদিকেই নাকি?
সাউথ বেঙ্গলের এ এস এম সুজন অত্যন্ত ভারি গলায় জিজ্ঞেস করলো, (আমি টার্গেটের কথা বললেই ও গলাটা যেমন ভারি করে ফেলে) "হোয়াত ইস বুমবুম? "
"ইউ দোন্ত নো হোয়াত ইজ বুমবুম? সাকিং ফাকিং ম্যাসাজ? গুদ প্লেস, বেরি গুদ গার্লস...."
ইজ্জত একেবারে ধুলোমে পড়কে বিলকুল গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে হাওয়ার সঙ্গে উড় গ্যায়া!!!
সেলস অফিসাররা সঙ্গে সঙ্গে খুবই গম্ভীর ভাবে বাঙালি জীবনে বাজার অর্থনীতির ক্রমবিকাশ ও টাকার অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক ব্যাঙ্কিং ব্যবসার ওপর তার প্রভাব, এই টাইপের একটা সিরিয়াস আলোচনা করার মতো মুখ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। সুজন, আর বিহারের এ এস এম আশিস ঝা আমার বজ্রাহত মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই গলা খাঁকারি দিয়ে বল্লো "নো বুমবুম", বলেই স্পষ্ট শুনলুম, আশিস চাপা গলায় যোগ করলো, 'নট নাউ'!
তারপর বেলা দশটা নাগাদ যখন গাড়ি চেপে নং নুচ ভিলেজে পৌঁছলুম, তখনও আমার বুমবুমের ঘোর কাটেনি।
নং নুচ ভিলেজ একটি কৃত্রিম গ্রাম, দুরন্ত সাজানো গোছানো, পর্যটকদের মনোরঞ্জনের যাবতীয় ব্যবস্থা মজুত। কিছু স্থানীয় কালচারাল শো দেখলাম, এদিকওদিক প্রচুর ফটো তোলা হলো। হাতিদের নিয়ে একটা দুর্দান্ত ভালো শো হয়, যে কোন সার্কাসের থেকে শতগুণে ভালো। হাতিতে ছবি আঁকে, আর্চারি করে, ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো জিঙ্গো জিঙ্গো নাচে, ফুটবল খেলে, পেনাল্টি মিস করলে হতাশার ভঙ্গিতে মাথায় হাত, সরি শুঁড় দিয়ে বসে পড়ে, আবার গোল হলে হাইফাইভের ঢঙে হাইশুঁড় করে। মাঝেমধ্যে দর্শকদের মধ্যে কোনও ক্ষীণকটি মধ্যেক্ষামা স্কার্টপরিহিতা বিদেশিনীকে একবার শূণ্যে ঘুরিয়ে মাথায় তোলে, তাতে আবার বিপুল সিটি!!
আর আছে হাতিদের পিঠে চড়ে পুরো জায়গাটা একবার চক্কর দেওয়া, যাকে বলে রীতিমতো পরিভ্রমণ। বেশকিছু দেশীবিদেশী পর্যটকদের দেখলাম হাতির পিঠে চড়ে রাজকীয় আভিজাত্য সহকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুখ প্রচণ্ড গম্ভীর, সেটা আভিজাত্য যাতে লিক না করে যায় তার চেষ্টা, না হাতির পিঠে ওঠার ভয় বোঝা মুশকিল!
তা এসব দেখেশুনে ভারি আহ্লাদ হলো। আমারও কবে থেকে শখ, হাতির পিঠে হাওদায় চেপে, যাকে বলে রাজেন্দ্রপ্রতিম আভিজাত্যে নগর পরিভ্রমণ করবো, লোকজন রাজামশাই বলে সেলাম ঠুকবে, ওপর থেকে দিব্যাঙ্গনারা পুষ্পবৃষ্টি করবেন, পুরোহিতরা স্বস্তিবাচন আওড়াবেন, চারিদিকে 'জয় মহারাজের জয়' ধ্বনি উঠবে..
ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বেশ একটা ঘোরের মধ্যে একটা কচি দেখে হাতির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, টিকিট কাটবো কাটবো করছি, ও মা, হাতিটা ওমন ঘন ঘন মাথা নাড়াচ্ছে কেন? ও মাহুত ভাই, হোয়াত হ্যাপেন্দ?
ওপরের মাহুত বন্ধুটি আমার বরতনুটি যাকে বলে পরিপূর্ণরূপে অবলোকন করে ফিক করে হেসে বললেন "এলিফ্যান্ত অ্যাফ্রেইদ স্যার, এলিফ্যান্ত রিফিউজিং"!!!
ইচ্ছে করে না, এইসব হাতিদের ধরে ধরে আইসিস এর হাতে গণিমতের মাল বলে তুলে দিয়ে আসি???
বিকেলে ফিরে আর হোটেলে ওঠা হলো না, সোজা আলকাজার শো। আমাদের হোটেলের একদম কাছেই অবিশ্যি।
এই শো'র দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। যারা নাচে তারা প্রত্যেকেই অপারেশন করিয়ে ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছে, (শ্রদ্ধেয় সরিৎদা বলছে টেকনিক্যালি বলতে গেলে এরা ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্সভেস্টাইট, ট্রান্সসেক্সুয়াল কিচ্ছু নয়, সাপ ব্যাং বিচ্ছুও নয়, এদের কি বলবো আম্মো জানিনা মাইরি), তবে রঙে রূপে বর্ণে আলোতে নাট্যে বিভঙ্গে এ এক অনন্যসাধারণ শো। মনে হয় রামধনুর সাতটি রঙ সারা গায়ে মেখে কয়েকটি অনুপম সুন্দর মানুষী ম্যাকাও যেন সারা স্টেজ জুড়ে আলোকের এই ঝর্ণাধারায় আমাদের ধুইয়ে দিতে এসেছে। কি তার বাহার, কি তার ঔজ্জ্বল্য, যেন সত্যিই একঝাঁক রোদ্দুররঙা পাখিদের মতো এই আলোকউৎসব। এর কাছাকাছি উদাহরণ শুধু ব্রাজিলীয় রিও ডি জেনেইরোর বিশ্ববিখ্যাত কার্নিভালটি ( তথ্যসূত্র- পনেরো বছর আগেকার এক ভুলে যাওয়া চ্যানেল, এফ টিভি)। বর্ণোজ্জ্বল পোষাকে, লাস্যনৃত্যে ও কটাক্ষপাতে, অহো, কি মোহময়ীই না ছিল সেই সন্ধ্যা!
তা সেসব দেখে খুবই মোহিত টোহিত হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো, ও মা!! দেখি পাঁচটি টিএসও ভেতরে জবুথবু হয়ে বসে, আর সেলসকুলমার্তণ্ড সেই এ এস এম দুজন দ্রুত গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। আমি "ওরে থাম, আরে ও ডেরাইভার ভায়া, রোককে রে বাবা, রোককে" বলে দৌড়ে যাবো, আশিস গ্যালগ্যালে টাইপের একটা হাসি দিয়ে বল্লো "আপ রুমমে বৈঠিয়ে, হামলোগ এক ঘন্টে থোড়া ঘুমকে আতে হ্যায়!"
মানে? হ্যাঁ রে বেয়াক্কেলে ছেলে, তোর ঘাড়ের ওপর ক'টা মাথা আছে বলে তোর ধারণা, অ্যাঁ? আমি হলুম গে আর এস এম, বলতে গেলে ফ্যামিলির হেড, তুই কোন সাহসে আমাকে বাদ দিয়ে...
সুজন ভারি মিষ্টি গলায় (টার্গেট না হলেই ও গলাটা যেমন মিষ্টি করে ফেলে) বল্লো, "আহা বস, তুমি একটু রুমে গিয়ে, ইয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসো না, আমরা জাস্ট একঘণ্টার মধ্যে একটু ঘুরে টুরে আসছি, আর হ্যাঁ, এই আমার রুমের এন্ট্রি কার্ড, অ্যাগদম নতুন একটা জনি ওয়াকার কাবার্ডেই পাবে। জাস্ট একঘণ্টা.... " বলে দরজা বন্ধ করেই মাল ধাঁ!!!
রুমে বসে জনি ওয়াকার খেতে খেতে ব্যাটাচ্ছেলেদের মুণ্ডুপাত করছি মনে মনে, আর এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের উৎস খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে, ফাঁকা করিডরে...
ওটা কি? আওয়াজটা কিসের?
একটা লম্বা ছায়া হেঁটে আসছে না? আলোটা হঠাৎ কমে এলো কেন? কার পায়ের আওয়াজ? ধীরেধীরে, কিন্তু নিশ্চিত নিয়তির মতন থপথপ আওয়াজ করে কে আসে এদিকে? বুকের ভেতরটা ধ্বকধ্বক করছে অজানা আশঙ্কায়, আস্তে আস্তে ছায়াটা দীর্ঘ হয়ে রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো, গলাটা শুকিয়ে কাঠ, একটা দীর্ঘ কালো হাত দরজা খুলে ঢুকলো, ক্যাঁঅ্যাঅ্যাচ করে একটা লোমখাড়া করা আওয়াজ...তারপরই
" বস, একটা লার্জ হবে?", অত্যন্ত কাঁচুমাচু মুখ করে সামনে কার্তিক শুক্লা।
যত্ন করে বসালাম, তারপর একটা লার্জ নিজে বানিয়ে ওর হাতে তুলে দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভারি মিঠে গলায় জিজ্ঞেস করলুম, "হ্যাঁ রে বুঝভুম্বুল, কোথায় গেসলি রে তোরা? খুলে বলতো সন্টিমন্টি, একটু চিকেন নাগেটস আছে, খাবি নাকি? লে'জ এর চিপসও আছে দুপ্যাকেট।"
সে ছোঁড়া একচুমুকে প্রায় গ্লাস খালি করে একথাবায় সবকটা নাগেটস তুলে নিয়ে ব্রীড়ানতা নববধূটির মতই মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, "কোথায় গেছিলাম বলতে পারছি না বস, আপনাকে ওসব বলা বারণ, বুঝতেই তো পারছেন, পাটায়া বলে কথা, তবে কি না...."
"হ্যাঁ বাবা, তবে কি না... বল বল, খোলসা করে বল দিকিন। এই নে চিপস খাবি?"
সে ছোকরা খুবই দুঃখী দুঃখী মুখ করে চিপসের প্যাকেটটা খুলে মুখে প্রায় পুরোটাই ঢেলে দিয়ে বললে " শেষ পর্যন্ত আর করে উঠতে পারলাম না! "
এতক্ষণে এরা কোন মহান রাজসূয় যজ্ঞে ঘি ঢালতে গেছিলো সেটা অল্প অল্প মালুম হচ্ছে বটে, কিন্তু 'শেষ পর্যন্ত আর করে উঠতে পারলাম না' কথাটার অনেকরকম মানে হয়। ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে বোঝবার জন্যে সন্তর্পণে খেলিয়ে তুলবো ভাবছি...
এমন সময়ে করিডোরে সে কি গোলমাল!!! উঁকি মেরে দেখি পুরো পল্টন পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজের সৈন্যদলের মত বিধ্বস্ত হয়ে আসছে, পেছনে আশিস ঝায়ের রীতিমতো হাঁকডাক, যদি সেই সেখানে গিয়ে ভেতরে অবধি নাই বা ঢুকবি, তো যাওয়া কেন বাপু? আরে সবাই মিলে ধরে বসলো বলেই না আশিস নিয়ে গেলো সবাইকে? গুর্দা হোনা চাহিয়ে ইয়ে সব করনে কে লিয়ে, হাঁ। এই যদি হতো বিহারের টিম, আজকে পি পি ম্যাসাজ পার্লারে হাহাকার পরে যেত। ডরপোক বঙ্গালি লোকজনের জন্যে ওর নাক যে খুব বিচ্ছিরি ভাবেই কাটা গেছে, সেই কথাটাই রীতিমতো ফলাও করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শোনাচ্ছিল...
আমাকে দেখে তিনি প্রথমে হতচকিত হয়ে থেমে গেলেন তারপর হঠাৎ গলাটা অত্যন্ত আন্তরিক করে বললেন
" বস, ওয়াকিং স্ট্রিট চলেঁ?"
প্রধান যে রিঙ রোডটা সারা পাটায়া শহর ঘিরে আছে, মেরিন ড্রাইভটা ঠিক তার সমান্তরাল। আর এই দুটি রাস্তাকে সমকোণে কেটে খান দশেক যোগাযোগকারী গলি আছে, এরা বলে সয়। সয় ওয়ান থেকে সয় টেন, এই হচ্ছে রাস্তার নাম। বেশিরভাগ হোটেল এই সয়গুলো ঘিরেই। এর সঙ্গে প্রতিটি গলিতে আছে গাদাগুচ্ছের ম্যাসাজ পার্লার, আর ট্যাটু পার্লার। ম্যাসাজ পার্লারগুলোতে নর্মাল ম্যাসাজ তো হয়ই। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সুবেশা থাইরমণীরা রীতিমতো হাতফাত টেনে ঢালাও আমন্ত্রণ জানায় 'ফ্যান্তাস্তিক বদি ম্যাসাজ' এর জন্যে, এবং তার সঙ্গে 'বেরি গুদ বুমবুম গার্লস' শুনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না ইহাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য কি এবং কেন!
বস্তুত, পুরো পাটায়া একটি, যাকে বলে নিষিদ্ধ আনন্দের শহর। ওখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হচ্ছে শেয়ার বাস, ওরা বলে ভাট-বাস। যে কোন ভাট-বাসেই যেখানে যাবার জন্যেই উঠুন না কেন, প্রথম প্রশ্নই আসবে "ওয়ান্ত তু গো বুমবুম?" সন্ধ্যের পর পাটায়াতে আপনি পর্যটক বা বিপণীবালা নহে এমন যে কোনও থাইকন্যাকে নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন, "অয়ি মনোহারিণী, কত ভাটের বিনিময়ে আপনি এই সুমনোহর রাত্রিটি এই অধমের সঙ্গে লুডো খেলিতে ইচ্ছুক?", চান্স অতি হাই যে উনি সামান্য দরদামের পর আপনার বুমবুমতৃষ্ণা নিবারণে রাজি হয়ে যাবেনই! বুমবুম ইহাদের ভিত্তি, বুমবুমই ইহাদের ভবিষ্যৎ!!!
তা এই দশ নম্বর সয় যেখানে মেরিন ড্রাইভে গিয়ে মিশেছে, সেখান থেকে সমুদ্রের ধার ঘেঁষেই, নেক্সট দুকিলোমিটার মতন রাস্তার নাম ওয়াকিং স্ট্রিট।
ওয়কিং স্ট্রিট নামকরণটি সার্থক, কারণ এখানে হাঁটাহাঁটি ছাড়া যাতায়াতের আর কোন উপায়ই নেই, এমনকি বাইসাইকেল অবধি নিষিদ্ধ। তবে হেঁটে না ঘুরলে ওয়াকিং স্ট্রিটে যাওয়া না যাওয়া সমান, এ কথা রসিক জন মাত্রেই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। জনান্তিকে জানিয়ে রাখি যে ওটাই পাটায়ার ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনের অমরাবতী!
পুরো ওয়াকিং স্ট্রিটটা আসলে প্রচুর বার আর তাদের বিশাল বিশাল রঙীন নিয়ন সাইনের মালা পরে থাকা একটি জ্যান্ত যৌন কার্নিভাল। ওই যে রাস্তার দুপাশজুড়ে হুল্লোড়ে ট্যুরিস্ট উপচে পড়া বারগুলি দেখিতেছেন, সেগুলি আবার যেমনতেমন বার নহে বাবাসকল, উহাদিগকে বলে গো গো বার। প্রতিটি বারে কয়েকটি করে বড় বড় গোল কাউন্টার, প্রতিটি কাউন্টারেই স্ফটিকনির্মিত আধারে মহার্ঘ মদ্যহস্তে দেশীবিদেশী মৌতাতলোভী পর্যটকবৃন্দ, আর মধ্যিখানে একটি বা দুটি থাই সুন্দরী লাস্যনৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। সময়, অবস্থা ও বারের কৌলীন্য বুঝে সুন্দরীদের পোষাকের পরিমাণ ওঠানামা করে থাকে বটে, তবে কিনা বাঁচোয়া এই যে, সচরাচর বারগুলোর কর্তৃপক্ষ এই সব অপ্সরীদের বিকিনির বেশি পরাটা খুবই অস্বাস্থ্যকর মনে করেন! তদুপরি সারা ওয়াকিং স্ট্রিট জুড়ে হ্রস্বতম বিচিত্র পোষাকে খরিদ্দার আকর্ষণের চেষ্টারত রাশিয়ান আর থাই বেশ্যাদের দল, তাদের বিলোল ছেনালি, হাসির হররা, হুইসল আর ভুভুজেলার আওয়াজ, ড্রামের আওয়াজ, মদ আর সিগারেটের গন্ধ, গো গো বারের উপরে 'স্পেশাল পিংপং শো' দেখার জন্যে উদার আমন্ত্রণ বিলোনো দালালের দল ('এন্ত্রি ফি এইত্তি ভাত, ওয়ান বিয়ার ফ্রি'), রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুপাশে দুটি বেশ্যা বগলে ছবি তুলতে ব্যস্ত বিদেশীর দল, সব মিলিয়ে এমন জমজমাটি বাঁধনহারা শরীরী উল্লাসের নগ্ন উদযাপন আমি আর দুটি দেখিনি!!
তা এহেন আনন্দবাজারে আমরা ঢোকামাত্র আশিস টিএসওদের বগলদাবা করে উধাও! করুণ মুখে যা বলে গেলো, তার মোদ্দা কথাটা হলো এই যে, ছেলেগুলো পাটায়া এসে হবিষ্যি উইথ আলোচাল মাফিক শুকনো মুখ করে ঘুরে বেড়াবে, এই নির্মম কুনাট্য রঙ্গটি, যাকে বলে, তেনার নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়! আর এহেন বিহারি উদ্যোগপুরুষের পক্ষে জনসেবার এমন সুযোগটা ছাড়া কি উচিৎ, অ্যাঁ? তাছাড়া আমরা, অর্থাৎ আমি ও সুজন যদি একটু আধটু নিজেরাই ঘুরেটুরে দেখেটেখে নিই, তবে সেটাই এইসব নাদান পোলাপানদের পক্ষে সম্মানজনক হবে না কি? হুইস্কি পেলে এমনিতেই আমাদের দুজনের আর কিছু লাগে না, এ কথা লাতেহার থেকে তিনসুকিয়া অবধি সব্বাই জানে, অতএব...
তা সব্বাই চলে যেতেই সুজনের প্রথম বক্তব্য, "বস, মদ লাগে ।"
এইজন্যে ছেলেটাকে আমি এত্ত ভালোবাসি। আমার মনের কথাটা টক করে বুঝে নেয়।
তা অনেক মনোজ্ঞ আলোচনার পরে একদম কাছের গো গো বারে ঢুকে পড়াটাই সাব্যস্ত হলো। সেখানে গিয়ে পেগ দুয়েক ব্ল্যাক লেবেলে কলজেটা ঠাণ্ডা করে, সূক্ষ্মতম রুমাল পরিহিতা থাইকন্যাদের পোলডান্সের সঙ্গে কুচিপুড়ি বা মোহিনীঅট্টমের একটা তুলনামূলক নৃত্যতত্ত্ব আলোচনা করে সবে বেরিয়েছি, দেখি সে এক অপূর্ব মনোহর দৃশ্য!
একটি গোরা নবদম্পতির (বয়েস দেখে নবই মনে হলো) পিছনে আবেদনপটিয়সী খানপাঁচেক থাইরমণী। প্রত্যেকের একই দাবি, ইহারা যদি ইহাদিগের নৈশক্রীড়ায় কিঞ্চিৎ রোমাঞ্চবর্ধনমানসে অ্যাডিশনাল সঙ্গিনীমৃগয়ায় এসে থাকেন, তবে ওহে থ্রিসামপিয়াসী বন্ধু, আমিই তোমায় সে গান শোনাব রাতের বেলা! যদি একটিবার তোমাদের দলে নাও খেলায়... ইত্যাদি প্রভৃতি। খানিকক্ষণ বাদে নাস্তানাবুদ হয়ে সে নববধূটি সরোষে কত্তাটিকে তাহাদের দিকে ঠেলে দিয়ে যা বললেন, তার বাংলা দাঁড়ায় 'রহিল তোদের এ পাপ ভাগাড়, (এই) ক্যালানে রে লয়ে থাকো'!!! নবকাত্তিকের মতন দেখতে ছোকরাটির অবস্থা হে মরমী পাঠক, নিজের মানসনেত্রে কল্পনা করে নিন!
দুজনেই রুমাল বার করে ঘাম মুছলাম। এই ট্যুরে গিন্নিদেরও নিয়ে আসার একটা প্রস্তাব উঠেছিল বটে, রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাবের ওপর ভেটো প্রয়োগ করি। আজ নিজের দূরদর্শিতা দেখে ঝপ করে নিজের ওপরেই খানিকটা শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো, হাজার হোক রিজিওনাল ইয়ে তো বটেক...
ভাবতে ভাবতে গর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটছি, এমন সময়ে দুইটি রাশিয়ান তন্বী, (আহা,ভোল্গার মতই তাদের নীল আঁখি, উজ্জ্বল সোনার মতই তাদের গায়ের রঙ, ঝর্ণাধারার মতই তাহাদের হাস্যলহরী) দ্রুত আমাদের দিকে ধেয়ে এসে বিশুদ্ধ হিন্দিতে শুধোলে, "হেই শারুখ, হেই অমিতাভ, চলেঁ? আচ্ছা বুমবুম করুঙ্গী, টু থাউজ্যান্ড ভাট, ওক্কে? চ্যলো।"
এই আকস্মিক আক্রমণে দুজনেই অ্যাজ ইউজুয়াল স্তম্ভিত ও দিশেহারা! দুজনেই 'ইক্কিরে বাওয়া' টাইপ ভঙ্গিতে ঘনঘন মাথা নেড়ে বোঝালুম যে ন্না ন্না, আমাদের একটুও বুমবুমে মতি নেই, আমরা খুব ভালো লোক, আমরা শুধু চাদ্দিকে একটু ঘুরেটুরে দেখতে এইচি, আমাদের যেন এক্ষুণি ছেড়ে দেওয়া হয়, আমাদের খুব হিসি পেয়েছে, আমরা বাড়ি যাবো!!
দুই কন্যে তখন বিশুদ্ধ হিন্দিতে যা বললেন, তার মর্মার্থ এই যে এঁয়ারা আমাদের প্রত্যঙ্গবিশেষের অস্তিত্ব সম্পর্কে সাতিশয় সন্দিহান তো বটেই, বা থাকলেও সেদুটিকে পাটায়ার সমুদ্রে 'চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে' বলে বিসর্জন দেওয়াটাই রীতিমতো উচিতকর্ম বলে তেনাদের দৃঢ় অভিমত। বিনামূল্যে এই দামী সদুপদেশখানি বিলিয়েই তাঁরা পরবর্তী শিকারের দিকে দ্রুত ধাবমান হলেন!
এই আকস্মিক ব্লিৎজক্রিগ্রের সামনে পড়ে গলাটলা শুকিয়ে গেছিলো, ফলে রাস্তার ধার থেকে একটা বিয়ার কিনে দুচুমুক মেরে দুজনেই একটু ধাতস্থ হতে বাধ্য হলাম।
তারপর আরও গভীরে গিয়ে দেখি কেস আরও গভীর! ওয়াকিং স্ট্রিটের একটু ভিতরের দিকের গো গো বারগুলো প্রায় সবই রাশিয়ান, তাদের বাইরে বিশাল বিশাল শোকেস, সেখানে সামান্য বস্ত্রাবৃতা হইয়া একাধিক রাশিয়ান নর্তকীরা নৃত্যরতা। উহা আসলে জীবন্ত ম্যানেক্যুইন, বারের অভ্যন্তরে আরও মনোহারী শো দেখিবার বিজ্ঞাপনী আমন্ত্রণ!
ততক্ষণে দুজনেরই কিঞ্চিৎ সাহস বেড়েছে, পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে না ব্ল্যাক লেবেল তথা হাইনিকেনের কল্যাণে, তা বলা মুশকিল। দুজনেই একটা উদার আভিজাত্যপূর্ণ হাসি বিলিয়ে ঢুকে পড়লুম।
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলুম যে ইহা, যাকে বলে প্রিমিয়াম গো গো বার। কারণ এন্ট্রি ফি আশির জায়গায় আড়াইশো ভাট, (সঙ্গে একটি হাইনিকেন বিয়ার ফ্রি) এবং ঢুকতেই আসতে আজ্ঞা হোক বসতে আজ্ঞা হোকের ঘটা দেখলে নিজেকে জমিদার বলে ভ্রম হতে থাকে।
যে রাশিয়ান ভদ্রমহোদয়া কান এঁটো করা হাসি হেসে দুইজনার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন তাঁর উচ্চতা ছ ফুটের এক ইঞ্চি কম হবে না, আর কবজিটাই প্রায় আমার থাইয়ের সমান। হাতটা খুব সম্ভবত প্রেমপূর্বকই ধরেছিলেন, তবে কি না গত হপ্তাতেও একবার কবজিটা মচকে যেতেই কেন জানিনা সেই স্নেহময় পাণিপীড়নের কথা মনে পড়ে গেসলো !
ভেতরে গিয়ে বেশ একটা প্রশস্ত গদিআঁটা সোফাতে বসেছি, বিয়ার দিয়ে গেছে, ভেতরে পার্পল রঙের ধোঁয়াটে অন্ধকার বেশ চোখ সয়ে এসেছে, মিষ্টি হুক্কার গন্ধে ভরপুর আবহাওয়া এমন সময় একফুট দূরের স্টেজটি বেশ পরিস্ফুট হলো চোখের সামনে।
বেশ চওড়া স্টেজ, দেড় ফুট উঁচু মতন, ধীরেধীরে ঘুরছে। আর সেখানে পোলড্যান্সরতা চারটি উদ্ভিন্নযৌবনা রাশিয়ান কন্যে।
সত্যি বলছি, প্যারিসেও স্ট্রিপটিজ দেখেছি, কিন্তু এমন সুন্দরী খুব কমই দেখেছি জীবনে। বাইশ পঁচিশের বেশি বয়েস হতে পারে না। নীল চোখ, বাদামী চুল, পদ্মডাঁটার মতন হাত দুখানি, তিলফুল জিনি নাসা, আর গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলার কোনও মানেই হয় না। শরীরীসম্ভারের বর্ণনা করি এমন কলমের জোর আমার নেই। শরীরের মধ্যাঞ্চলটি দেখেই কালিদাসের সেই দিলতোড় শ্লোকটির কথা মনে পড়ে আর উত্তুঙ্গ বক্ষসৌন্দর্যদুটির প্রশংসা করার যোগ্য বিশেষণ আজ অবধি শিখিনি। মানুষের শরীরও যে কবিতা হতে পারে...
এমন সময় শ্রীমান সুজন তেনাদের নিম্নাঙ্গে পরিহিত অধোবাসটির দিকে আমার দৃষ্টি উল্লেখ করে আমার সেই আকণ্ঠ সৌন্দর্যসুধা পানে রীতিমতো ব্যাগড়া দিলেন। বেশ কিছু শাস্ত্রসম্মত আলোচনার পর দুজনেই সবে একমত হয়েছি যে আমাদের এক একটি রুমাল কেটে অমন দুটি করে অধোবাস হতে পারে, ইভন কিছু কাপড় হয়তো বেঁচেও যাবে, এমন সময় দেখি...
যাক্কলা, আমরা কি করলাম? হঠাৎ দেখি দুটি অপ্সরী মঞ্চ থেকে নেমে, বিলোলমদির নেত্রপাতে প্রেমসুধারস বিতরণ করতে করতে আমাদের দুজনের গা ঘেঁষে এসে বসলেন, মানে এক্কেবারে ঘেঁষে! খুব করে ঘেঁষে!!
গলা শুকিয়ে গেসলো, রবীন্দ্ররচনাবলী ছুঁয়ে বলছি মাইরি। খানিকক্ষণ কাষ্ঠহাসি হেসে রসালাপ করার পর আমাদের এহেন সৌভাগ্যের কারণ জানতে চাইলে তন্বীটি হাস্কি স্বরে জানালেন "গিভ আস সাম টিপস!"
হাজার হোক সেলসের লোক, গলির ডাস্টবিনে মাছের কানকো আর মরা বেড়ালের ছানা ফেলে দেবার আগেও একবার ভেবে নিই, কোথায় ফেলছি, কেন ফেলছি, এবং এতে আমার কি উবগার হবেক! তাই গলাটা খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলুম, যে অয়ি বরবর্ণিনী, এত্ত লোক থাকতে আমরাই ক্যাঁও? ইত্যবসরে ঘাড় ঘুরিয়ে সুজনের দিকে তাকাতেই সুজন খুবই বিপন্ন গলায় (টার্গেট কেন হয়নি জিজ্ঞেস করলেই ও গলাটা যেমন বিপন্ন করে ফেলে) বললো, "বস, এরা যা যা চায় দিয়ে দাও, কেটে পড়ি, অবস্থা ক্যাডাভারাস"।
ফলে একটা একশো ভাটের নোট বার করে দিতে গেছি, সেই তন্বীগৌরী সুন্দরীশ্রেষ্ঠা তেনার দেবতনুটি বিশিষ্ট বিভঙ্গে বাঁকিয়ে, শরীরের একটি বিশেষ ভাঁজ নির্দিষ্ট করে বললেন নোটটি সেখানে গুঁজে দিতে।
আল্লাহ কসম, সেই শরীরী ভাঁজটির উল্লেখ আমাকে মেরে ফেললেও করতে পারবো না!
নবারুণ পড়ার একটা বিচ্ছিরি সাইড এফেক্ট এই যে, প্রায় নেই হয়ে যাওয়া ছ্যাঁচ্চড় বিবেকটা মাঝেমধ্যে অকারণে চাগাড় দিয়ে ওঠে, পুষে রাখা অম্লশূলের মতই। সয় নাম্বার নাইন ধরে, টুকটুক চেপে হোটেলে ফিরে যাবার সময় একবার মনে হলো, সত্যিই কি রাশিয়া নামের দেশটা ড্রাগ মাফিয়া আর মাগি সাপ্লায়ারদের হাতে তামাদি হয়ে গেছে?
কি জানি, হয়তো গেছে। কমিউনিজমে কোনওদিনই রুচি ছিল না আমার, তদুপরি ঘোর অ্যান্টি সিপিএম, কিন্তু সোভিয়েত নারীর এই দুর্দশা দেখে কিছুতেই ভেতর থেকে খুশি হতে পারলুম না। কোথাও যেন মনে হলো আমার নিজের খুব নিজের কাউকে রাস্তায় টেনে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে!
কেন মনে হলো, জিগাইবেন না প্লিজ!
পরের দিন একটু তাড়াতাড়িই উঠতে হলো, আমাদের বুমবুমি গাইডটির দাবিদাওয়া ছিল সেরকমই। ফলে তখনও খোঁয়ারি না ভাঙা পাবলিককে টেনেটুনে পাটায়া জেটিতে নিয়ে গিয়ে দেখি একটা ওয়াটারজেট এক্কেবারে সেজেগুজে তৈরি।
তা সেই ওয়াটারজেটে করে মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে যখন কোরাল আইল্যাণ্ডে নামলুম, মাইরি বলছি, শুধুমাত্তর জলের রঙ আর বীচের ছবি দেখেই মনটা দিব্যি তরর হয়ে গেলো।
আগেই বলেছি যে পাটায়ার বীচ অতি জঘন্য। ইন্টারনেটে 'পাটায়া বলে সার্চ মারলেই যে সব দুর্দান্ত সিনিক বিউটিওয়ালা ছবিগুলো ভেসে ওঠে, সেগুলো আসলে পাটায়া থেকে একটু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব আইল্যাণ্ডের বীচগুলোর ছবি। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো এই কোরাল আইল্যান্ড।
ছোটবেলা থেকে দীঘা আর পুরী যে কতবার গেছি তার ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন রূপে বঙ্গোপসাগর ভালোই দেখা আছে। এছাড়া গোয়া, ভাইজ্যাগ, পণ্ডিচেরি, আন্দামান, চেন্নাই, কম সীবীচ দেখিনি জীবনে। এতদসত্ত্বেও প্রথম যখন কোরাল আইল্যাণ্ডে নামলুম, সেই অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যে মুহূর্তেকের জন্যে আত্মহারা হয়ে গেছিলুম, সে কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই।
প্রথমেই বলতে হয়ে এমন স্ফটিকস্বচ্ছ নীলাভ সবুজ রঙের জল আমি আজ অবধি কোনও সমুদ্রতীরে দেখিনি। জলে নেমে দাঁড়ালে জলের নিচে সাদা বালি স্পষ্ট দেখা যায়, সে জল এতই স্বচ্ছ। আর খুবই ফ্ল্যাট বীচ, মোটামুটি সমুদ্দুরের ভেতর কিলোমিটার খানেক গেলে তবে কোমরসমান জল ওঠে। পুরো ব্যাপারটাই চোখের পক্ষে যেমন আরামদায়ক, মনের পক্ষেও তেমনই প্রশান্তিকর। আর ঢেউয়ের যা বহর দেখলুম, আমাদের মাছের বাজারের জয়ন্ত ওর কই মাছ জিয়োনো বড় মুখওয়ালা হাঁড়িটাতে হাত ঢুকিয়ে জলের ওপর চাপড় মারলে এর থেকে বেশি ঢেউ ওঠে। এই ঢেউয়ে স্বচ্ছন্দে বিচে বসে হাঁটু অবধি জলে ডুবিয়ে আপনি দাস ক্যাপিটাল বা মোহমুদগর পড়তে পারেন, জাঙিয়া অবধি ভিজবে না, গ্যারান্টি দিলুম। তার ওপর গাঢ় ফিরোজানীল উজ্জ্বল আকাশ, বীচের অন্যদিকে সবুজ কালো পাহাড়, বীচের দুই সুদূরপ্রান্তে সমুদ্রের জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজের ছবি দেখতে থাকা পামগাছের সারি, আহা, মায়াময় সেই সমুদ্রতীরটির ছবি এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাই।
পুরো বীচটি বেশ চওড়া, অর্ধচন্দ্রাকারে প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার ছড়িয়ে। অন্যদিকে বালি শেষ হলে রাস্তা, আর তার ওপর গাদাগাদা দোকান, খাবারের, মদের, বিভিন্ন স্যুভেনিরের ইত্যাদি।
একটা কথা বলে রাখি, পরে ভুলে যাবো, হার্ড লিকার আপনি অনেক ব্র্যাণ্ডেরই পাবেন পাটায়াতে, কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে হাইনিকেন ছাড়া আর কোনও বিয়ার পাওয়া যায় না! কেন পাওয়া যায় না সেটা বলা খুব মুশকিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এই একই হাইনিকেন ষাট থেকে দুশো ভাটের মধ্যে বিভিন্ন দামে পাবেন, স্থান ও কাল মাহাত্ম্যে। আইন্সটাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটির এমন প্র্যাকটিকাল প্রয়োগ আর কোথাও দেখিনি বললেই চলে!!
তা কোরাল আইল্যাণ্ডেও দেখলুম একই ব্যাপার। বাহারি ওপেন রেস্তোরাঁতে যে হাইনিকেন একশো ভাটে বিকোচ্ছে, ঠিক দু পা দূরে এক থাই বুড়ি আর তার ছেলের হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া অস্থায়ী দোকানে সেই একই হাইনিকেন ষাট ভাটেই সগৌরবে অ্যাভেলায়মান!!
তা সেরকমই একটি দোকান থেকে একটি বিয়ার তুলে, পুরো বিচটি, ভালো বাংলায় বললে, পরিপূর্ণরূপে অবলোকন করতে শুরু করলুম!
স্পষ্ট বুঝলেম যে এথনিক আইডেন্টিটির দিক থেকে, এই বীচটির তিনটি ভাগ। একদম ডানদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের আম জেনেগেন, একদম বাঁদিকে ইওরোপীয় তথা গোরা চামড়ার লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আর মধ্যিখানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পীতপাবলিক, অর্থাৎ হলদেম্যানেরা! প্রত্যাশিত ভাবেই মাঝখানে আর বাঁদিকে যেসব ফেয়ারার সেক্সের পরিব্রাজিকারা ইতিউতি পরিদৃশ্যমান, প্রত্যেকেরই পরণে নানা বর্ণের বিভিন্ন ডিজাইনের বীচওয়্যার, যত বাঁদিকে সরবেন, সাইজে তা ততই হ্রস্বতর হতে থাকে, একদম বাঁদিকে গিয়ে প্রায় ছায়ার মতই ধোঁয়াধোঁয়া হয়ে পড়ে, আছে কি নেই ঠিক বুঝে উঠতে পারা যায় না!
ওয়াটারজেট তীর ছুঁতে না ছুঁতে, টিএসওরা তীরের মতই ছুটে বেরিয়ে গেসলো, কারও কোন খোঁজপত্তর ছিলো না। আশিস আর সুজনও উদাসমুখে 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে' গাইতে গাইতে ধাঁ!
আমিও ভাবলুম যাগগে, আমি সামনে থাকলে এরা এমনিতেও একটু কাঠ হয়ে থাকে, আড়ালে একটু হুল্লোড় করুক গিয়ে। এই ভেবে বেশ প্রসন্ন হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, হাতে একটা বিয়ার নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় নেহাত অবহেলা করেই সেই মধ্যিখানের জলকেলিরত পীতরমনীদের দিকে একটা আলতো করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছি কি করিনি...
আমিও ভাবলুম যাগগে, আমি সামনে থাকলে এরা এমনিতেও একটু কাঠ হয়ে থাকে, আড়ালে একটু হুল্লোড় করুক গিয়ে। এই ভেবে বেশ প্রসন্ন হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, হাতে একটা বিয়ার নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় নেহাত অবহেলা করেই সেই মধ্যিখানের জলকেলিরত পীতরমনীদের দিকে একটা আলতো করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছি কি করিনি...
উরিত্তারা, ই ক্কি ক্কাণ্ড? সাধে কি বলে সেলসের ছেলে, অ্যাঁ? আমার এক ওল্ড বস বলতেন কমপক্ষে সাতটা করে অ্যানাকোণ্ডা মরে একেকটা সেলসের লোক জন্মায়। কথাটা যে ভুল কিছু নয় সেটা নিজেকে দিয়েই বুঝতাম..এখন তো..
প্রত্যেকটি ওস্তাদ টিএসএ দেখি সেই মধ্যিখানের বিকিনিনন্দিনীদের সঙ্গে দিব্যি হা হা হি হি এবং ভাব জমিয়ে সে কি কোলঘেঁষা অন্তরঙ্গ গল্প!! পুরো 'সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার' কেস! তারপর তাদের গলা জড়িয়ে সেল্ফি তোলাতুলি, বা অন্যকে ডেকে সেই সিক্তবসনা স্বল্পবস্ত্রাদের সঙ্গে নিজেদের দ্বৈত ফটো তোলাবার ধুম দেখে, আমি তো মাইরি, বিস্ময়ে স্তম্ভিত!!
দেশে ফিরেই এদের টার্গেট কতটা বাড়ালে ব্যাপারটা বেশ সুন্দর প্রতিশোধমূলক হবে সেইটে হিংস্রভাবে ভাবতে ভাবতেই দেখি এদিকে নিজের পা দুটো কিন্তু নেহাত অবাধ্যের মতই আরও বাঁদিকে চলেছে।
তা গিয়ে দেখি সাদা চামড়ার লোকজন বেশ খোলামেলা ভাবেই রোদ পুইয়ে চামড়াটাকে খোলতাই রকমের বাদামী করে তোলার সাধনায় মগ্ন। আমার একটু লজ্জা লজ্জা করছিলো বটে, তবে কিনা আগের দিন থেকেই মনটা কেমন নলেজ নলেজ করে হাঁপিয়ে উঠছিলো তো, তাই ভাবছিলুম গিয়ে ওই কৌপীনধারিণী স্বর্ণকেশী কন্যেটির কাছে গিয়ে কিছু গভীর তত্ত্বালোচনার অবতরণ করবো কি না। আহা, নেহাতই শুদ্ধ জ্ঞানার্জনের খাতিরে আর কি, যেমন ধরুন জেমস জয়েস পুঁইচচ্চড়ি ভালোবাসতেন কি না, বা থিওরি অফ রিলেটিভিটির ওপর বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব, অথবা ফুকো দিনে কতবার ফুঁকতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তা এইসব ভেবেটেবে মুখচোখে বেশ একটা গ্রাম্ভারি ইয়ে নিয়ে এগিয়েছি..
এমন সময় দেখি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরের গাসের পানে মিটমিট্যায়া চায়্যা আসে কেডা রে?
দুটি কেশবতী কন্যে আক্ষরিক অর্থেই কটিমাত্র (একটিমাত্রও বটে) বস্ত্রাবৃতা হইয়া বীচ ফুটবল খেলছিলেন। তা দেখা যাচ্ছে যে আমাদের কার্তিক ভায়া জগতের এই আনন্দযজ্ঞে নিজেই নিমন্ত্রণ নিয়ে এসে হাজির। হাতে একটা বিয়ারের বোতল, খোলা কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এক ফোঁটাও খায় নি। একটা আনন্দবিহ্বল দীপ্তি চোখেমুখে। সারা শরীরে একটা রোমঞ্চের হিল্লোল স্পষ্ট।
আমি কাছে গিয়ে খুব স্নেহভরে মিষ্টি করে শুধোলুম, "হ্যাঁ রে কাত্তিক, এখেনে কি করছিস? টার্গেট করার জন্যে কি কিছু অ্যাডিশনাল বাজেট ফাজেট পাবি?"
ছেলে চকিতে ঘুরে আমার দিকে তাকালো বটে, কিন্তু যাকে বলে রেকগনাইজ করতে খানিকক্ষণ সময় নিলো (স্বর্গের পারিজাতবন থেকে কঠিন রুক্ষ বাস্তবের জমিতে নেমে আসতে যতটা সময় লাগে আর কি!), তারপরেই একটা সলজ্জ হাসি হেসে বললো, "না না বস, ভাবছিলুম ওদের যদি রেফারিটেফারি লাগে, তাই আর কি, হেঁ হেঁ। ইয়ে, এই বিয়ারটা আপনার কথা ভেবেই কিনেছিলাম, নিন ধরুন", বলে আমার হাতে ওর বিয়ারের বোতল ধরিয়ে ছোকরা যে দৌড়টা দিলো সেটা দেখবার মতন!
যত্তসব, পারভার্ট লোকজন, হুঁ। এই জন্যেই ইণ্ডিয়ার এত বদনাম বাইরে, সাদা চামড়া দেখলেই নালেঝোলে একাকার কাণ্ড... দুশ্চরিত্র লম্পট পাজির পাঝাড়া..
মনে মনে একচোট গালাগালি দিয়ে বেশ আয়েশ করে বিয়ারটা খেতে লাগলুম।
কোথায় খাচ্ছিলুম? কেন, ওইখানেই দাঁড়িয়ে তো!!
আহা, সত্যিই যদি ওদের একটা রেফারিটেফারি লাগে? আমার থেকে যোগ্য লোক ওরা আর পাচ্ছে কোথায় তক্ষুনি তক্ষুনি, অ্যাঁ? নেহাত ওদের অসুবিধের কথা ভেবেই আর কি, নইলে আমার আর কি বলুন? সকলের তরে প্রত্যেকে আমরা বলে হিতোপদেশে কি একটা কথা লেখা ছিলো না?
যাগগে যাক। তাপ্পর সারাদিন হুটোপাটি করে, জলকেলি করে দিব্যি চনমনে হয়ে উঠে যখন পাটায়া ফিরলুম, তখন প্রায় দুটো। লাঞ্চটাঞ্চ সেরে, দুপুরে একঘুম দিয়ে উঠে বিকেল সন্ধ্যে নাগাদ নিচে হোটেলের লবিতে বেশ একটা প্রসন্ন মেজাজ নিয়ে নেমেছি,
আবার সেই দৃশ্য!! সাতভাই চম্পা সেই গাইডটিকে ধরে বসে কি যেন একটা গম্ভীর আলোচনায় মত্ত!
আমি ঢুকতেই সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিলো, হাজার হোক আর এস এম বলে কথা, বয়সে, সম্মানে, পদমর্যাদায়....
গাইড ভদ্রমহোদয়া চোখ টিপে বললেন, "নো বুমবুম?"
অত্যন্ত কঠিন স্বরে বললু্ "অ্যাগদম নো বুমবুম।"
চারিদিকে যা সম্মিলিত চাপা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনলুম, শেষ শুনেছিলাম সচিন তেন্ডুলকর ওঁর রিটায়ারমেন্ট অ্যানাউন্স করার পর।
মহিলা আবার চোখ টিপে বললেন, "দেন, রাশিয়ান শো?"
এইবার ঘেঁটে গেলুম। কাল রাত্তিরে রাশিয়ান গো গো বারে যা হেনস্থা হয়েছি তা আর কহতব্য নয়। এটা আবার নতুন কি সার্কাস হে? না করে দেবো কি না ভাবছি, এমন সময় সুজন গলাটা খুবই করুণ করে (অ্যাপ্রেইজালের সময় এলেই ও গলাটা যেমন করুণ করে ফেলে) বললো, "ছেলেদের খুবই ইচ্ছে বস, না করাটা কি ঠিক হবে? আবার কবে এরা আসে না আসে... "
উহঃ, সেন্টিমেন্টের পুরো পাইনবন মাইরি!! আচ্ছা, চল, দেখি কি বস্তু এই রাশিয়ান শো!
সন্ধ্যে নাগাদ যখন রাশিয়ান শো'র অকুস্থলে গিয়ে সদলবলে বডি ফেল্লুম, তখন উমম, প্রায় ছটা মতন বাজে!
সিকিওরিটি দেখলুম হেবি টাইট। মোবাইল টোবাইল সব নিয়ে তো নিলই, তারপরে যা চেপেচুপে বডি সার্চ শুরু করলো, বেশ অস্বস্তিই হতে লাগলো। এসব আদিখ্যেতার বখেড়া মিটিয়ে হলের ভেতরে যখন ঢুকলুম..
দেখি গ্যালারির মতনই সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট, অর্ধবৃত্তাকারে, আর তার সামনেই সামান্য উঁচু স্টেজ, সমস্ত আলো শুধুই তাহারে লক্ষ্য করে। সিট আপনি নিজের ইচ্ছেমতন বেছে নিতেই পারেন, তবে কিনা প্রথম দুটো রো ততক্ষণে অনেকটা ভরেই গেছিলো। আমি, আশিস অ্যান্ড সুজন থার্ড রোতে বসলাম। টিএসওরা ইদিকউদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো, দুয়েকজন আবার সাইড দেখে প্রথম রোতে গিয়েই বেশ গুছিয়ে যাকে বলে আসন পরিগ্রহ করলো।
হে পাঠক, যদি কখনও পাটায়াতে যাবার সৌভাগ্য হয়, আর ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে রাশিয়ান শোতে ঢুকেই পড়েন, অধমের এই চেতাবনিটি দয়াপরবশ হয়ে মনে রাখবেন, প্রথম দুটো একটু রো ছেড়ে বসবেন প্লিজ!
কারণ হ্যাজ!
তারপর শুরু হলো রাশিয়ান শো।
আগেই বলে রাখি, নির্মোকনৃত্য বা স্ট্রিপটিজ কম কিছু দেখিনি। প্যারিসের স্ট্রিপটিজ দেখে যে রীতিমত আমোদই পেয়েছিলুম ও প্রচুর বাহবা দিয়েছিলুম, স্পষ্ট মনে আছে। আগের রাতেই রাশিয়ান গো গো বারে হলিউডি সিনেমা মার্কা পোল ড্যান্স দেখে যে খুব ব্যাড লেগেছিলো তাও বলা যাবে না।
কিন্তু এই রাশিয়ান শো হচ্ছে আদিম যৌনতার নির্লজ্জ মাংসগন্ধী খেলা। সেসব খেলার বর্ণনা দেবো না। আমি কামগন্ধহীন নিকষিত হেম নই, নীতিপুলিশ তো নইই, কিন্তু আকাট যৌন সুড়সুড়ি মার্কা মাংসখেলার অযথা পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেইলস দিতে আমার সখত আপত্তি আছে।
তা তেনাদের একপ্রস্ত বিচিত্র ভঙ্গিমায় নগ্ননাট্য শেষ হলে আমরা একটু নড়েচড়ে নিজেদের একটু 'ঠিকঠাক' করে নিচ্ছি, এমন সময়ে দেখি,
আইলা, ই ক্কিরকম দাবিদাওয়া? দু তিনজন নৃত্যপটীয়সী রমণীরত্ন দেখি মঞ্চ থেকে সহাস্যমুখে নেমে দর্শকবৃন্দের দিকে এগিয়ে হাতটাত ধরে ভারি অন্তরঙ্গ এবং উদাত্ত আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এই খেলায় তাঁদের সঙ্গী হতে। না, দর্শকাসন থেকে নয়, একেবারে মঞ্চে গিয়ে!!
তা জনগণ দেখলুম সেই দুরন্ত সম্ভাবনাময় মঞ্চসফল প্রযোজনাটির অংশ হতে মোটেই উৎসাহী নন। লোকজন টকাটক ছিটকে সরে যেতে লাগলো, দুয়েকজন গোরাচাঁদকে তো রীতিমতো হাত জোড় করে মাফটাফ চেয়ে পেছনের সিটে এসে বসতে দেখলুম। বাঁচোয়া এই যে বিনা স্ক্রিনটেস্টে হিরো হবার এই ঢালাও নেমন্তন্ন অবিশ্যি প্রথম দুটো রো'য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মানে "হ্যাঁ রে সন্টিমন্টি, একদম সামনে থেকে এইসব দেখার খুউব শখ, তাই না রে? আয় তো বাপধন, ইদিকে আয়, আমাদের সঙ্গে এট্টু ন্যান্নো ম্যান্নো খেলবি আয় দিকিন" টাইপের বার্তাটি ছিলো বড় স্পষ্ট আর কি!! প্রথম সারিতে উপবিষ্ট দর্শককুল দেখলাম এই অযাচিত সৌভাগ্যে ভারি বিব্রত হয়ে পড়েছেন, পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না!
তবে কি না তেমন করে ডাকলে ভগবান যে আর্তের ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেনই, মুনিঋষিরা তা স্পষ্ট করে শাস্ত্রে লিখে দিয়ে গেছেন, এর অন্যথা হবার যো'টি নেই। তাই খুব সম্ভবত নিজেকে ভগবান টগবান ভেবেই একটি দেড়েল ভারতীয় যুবাপুরুষ সেই নির্বস্ত্র গোপিনীদের কাতর ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন!!
সারা হলে চাপা খুশির হিল্লোল ছড়িয়ে পড়লো, সিটি আর হাততালির আওয়াজে কান পাতা দায়! উল্লসিত নর্তকীসম্প্রদায় তো তৎক্ষণাৎ তেনাকে বগলদাবা করে ভেতরে উধাও।
পাঁচ মিনিট পর যখন নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক শুরু হলো, মুখে একটা অত্যন্ত ক্যালানেমার্কা হাসি ঝুলিয়ে ভগবান দর্শন দিলেন!
শুদ্দুমাত্তর জাঙিয়াটুকু পরে!
তারপর যে বর্ণনাতীত সার্কাস শুরু হলো তার যুৎসই আলেখ্য হাজির করতে এই কিবোর্ডচির অঙ্গুলিগুলি বিলক্ষণ থরথরায়মান। সমবেত বুভুক্ষু ম্যাঙ্গো পিপলের সামনে একজন বেচারাটাইপ পুরুষ মানুষের মানসম্ভ্রম, ইজ্জৎ, মর্দানির ওপর যে এইভাবে কার্পেট বম্বিং করে ধূলিসাৎ করে দেওয়া যায়, আগে দেখি নাই! আনন্দ নিচ্ছিলুম খুবই, কিন্তু মনে মনে ভাবছিলুম, বাপ্পোস..কি ভাগ্যি আমাকে ধরে নিয়ে যায় নি!!
তা সেই ধূলোখেলা শেষ হলে ভদ্রলোকটি একটি সলজ্জ হাসি ঠোঁটে এবং পরনের বস্ত্রখণ্ডদুটি হাতে ঝুলিয়ে স্বদেশে ফিরে এলে তুমুল হর্ষধ্বনি ও শাবাশির মধ্যে তাঁকে বরণ করে নেওয়া হলো, বীরের সংবর্ধনাই পেলেন প্রায়!
আমরাও মৃদুমধুর হাস্যধ্বনির মধ্যে পরের অ্যাক্টোর জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় দেখি সেই অপ্সরারা আরেকজন হতভাগ্যকে প্রায় নড়া ধরেই স্টেজের উপর নিয়ে এলেন। আমরাও ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে নতুন মুর্গিটির দিকে চোখ তুলে চাইতেই...
চোখ দুটো কুলফিমালাইয়ের মতই জমে গেলো প্রায়!
এ যে হরি, আমাদের হরিকমল, সাউথ কলকাতার টিএসও!!
সারা হল জুড়ে খুশির হররা আর সিটির আওয়াজের মধ্যে আমরা সাতজন ক্রমেই যেন সোফার আরও ঢুকে যেতে লাগলুম। হরি, ওরে হরি, তুই কি করে এদের খপ্পরে পড়লি বাপ? এবার তোর কি হবে? তোর এই হেনস্থা এখন আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে, অ্যাঁ? ওরে তোর ঘরে রাঙা টুকটুকে বউ আছে যে, চুন্নুমুন্নু বাচ্চা আছে দুটো...
গেলো না, সে বিপর্যয় কিছুতেই আটকানো গেলো না। বেচারিকে যে আর জামাটামা খুলে নেয়াপাতি ভুঁড়িটি জনসমক্ষে দেখাতে হয় নি, সেই যা রক্ষে, বাকি সব ঐ ঐ!!
তা সেই আধ ঘন্টার আনন্দ শো'টি খতম হলে হরি যে দৌড়টা দিলো সিটে ফিরে আসার জন্যে, সে দেখলে উসেইন বোল্ট অবধি হিংসেয় জ্বলে যেতে বাধ্য। অবশ্য হরিকে মাঝপথেই আবার ফিরে যেতে হয়, একদম শেষে যে তন্বঙ্গীটি হরির কোলে চড়ে বাৎসায়ন বাবুর প্রেস্ক্রাইব করা একটি বিচিত্র কসরত প্র্যাকটিসে রত ছিলেন, তেনার অতি সংক্ষিপ্ত অন্তিম অধোবাসটি তখনও হরির মাথায় লেপ্টে ছিলো। ভদ্রমহিলা সেটি উদ্ধার করে হরিকে যে হামিটি দিলেন, খুব সম্ভবত তার টানেই হরি বার বার পাটায়া ফিরে আসতে চাইবে!
ফিরে আসার পর হরিকে পাকড়াও করে আমি ধরা গলায় প্রথম প্রশ্ন করলাম, "হ্যাঁ রে হরি, তোর কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়লো না? তুই কি ভেবে ওখানে গেলি? বলি তোর ইচ্ছে ছিলো, নাকি জোর করে ধরে নিয়ে গেলো, সত্যি করে বল দিকিন। তোকে ধরে নিয়ে গেলো আর তুই হাসিমুখে চলে গেলি? না না করতে পারলি না?"
হরি মাথাটাথা চুলকে বললো, "আসল, স্যার, এমন হাসি হাসি মুখে হাত ধরে টানলো, আমি যেন কেমন হয়ে গেলুম, স্যার, আর না করতে পারলাম না"।
বুঝলুম, কামাখ্যাতে ভেড়া বানিয়ে রাখার গল্পগুলো তাহলে খুব মিথ্যে নয়! তবে কি না সত্যের খাতিরে আমি উল্লেখ করতে বাধ্য যে হরি গুপ্তিপাড়ার ছেলে, আর গুপ্তিপাড়ার ছেলেরা কি করতে পারে আর কি করতে পারে না, সে নিয়ে আমার মনে এখনও ধন্ধ আছে খুবই!
তার পরে যেটা ঘটলো সেটা অবশ্য এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত, আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। একটি মুখোশধারী পুরুষ, (মুখোশ ছাড়া গায়ে আর একটি বস্তুই ছিল, সেটি ছোট্ট, পাতলা এবং রাবারের তৈরি, হিন্টটা ডিকোড করতে অসুবিধা হবার কথা নয়) আরেকটি নগ্নসুন্দরীকে (এনার গায়ে অবশ্য সুতোর আঁশটুকু অবধি ছিল না) বগলদাবা করে স্টেজে নিয়ে এসে বিনা বাক্যব্যয়ে যা করতে শুরু করলেন...
সে সব আমরা শুধু অত্যন্ত, যাকে বলে হাই ক্লাসের সিনেমাতেই আজ অবধি দেখিয়া আসিয়াছি। সানি লিওনি, মিয়া খলিফা, পিটার নর্থ প্রমুখ সেইসব উচ্চথটের সিনেমার দিগবিজয়ী বিশিষ্ট কলাকুশলী। শুধু সেসব জিনিস চোখের সামনে বাস্তবে কাউকে করতে দেখলে যে গলাটা বিস্ময়ে বন্ধ হয়ে আসে, এইটে প্রথম উপলব্ধি হলো।
এর পরে আর কিছু দেখার বা বলার থাকে না। বেরিয়ে আসতেই হয়।
পাশেও একটি শো ছিলো, এই রাশিয়ান শো' র অনুকরণেই, থাই শো। অতি উগ্র, নোংরা এবং বমনোদ্রেককারী। শরীরের অস্থান কুস্থান থেকে পিংপং বল বা ব্লেডের সারি বার করা, অথবা সেইখানে ব্লো পাইপ গুঁজে ব্লো ডার্ট দিয়ে মোমবাতি নেভানো, এতে গোদা শারীরিক কসরত থাকতে পারে, কিন্তু আর যাই হোক উপভোগ্য আর্ট থাকতে পারে না।
যৌনতার প্রদর্শনীও একটি শিল্প বলেই মনে করি, দক্ষতা, পরিমিতি বোধ ও সৌন্দর্যজ্ঞান সেখানেও ততটাই লাগে যতটা লাগে নাইট ওয়াচম্যান আঁকতে বা ওয়েস্টল্যাণ্ড লিখতে।
তা ছেলেপিলেদের মন দেখলাম দিব্যি ফুরফুরে। আমিও খুশি, শুধু ভাবছি এই মওকায় পরের কোয়ার্টারের টার্গেটটা আরেকটু বাড়িয়ে নিয়ে এখনই কমিট করিয়ে নেবো কি না, এমন সময় দেখি আশিস আর সুজনের মধ্যে কি একটা চোখাচোখি হয়ে গেলো, সুজনও কি একটা ঈঙ্গিত করলো টিএসও দের দিকে, পাবলিক মুহুর্তের মধ্যে ধাঁ!!
এরপরে দুই মক্কেল ভারি অন্তরঙ্গ ভাবে গা ঘেঁষে এসে বললো, "বস, চলিয়ে"।
কোথায় চলতে হবে জিজ্ঞেস করার আগেই দেখি একটা ভাট-বাস এসে হাজির এবং সেই গুণ্ডাগোছের ম্যানেজার দুটি আমাকে বেশ ভব্যতা সহকারে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে দিয়ে নিজেরা আমার দুপাশে বেশ আয়েশ করে বসলেন। বিনা প্রশ্নে যখন সেই বাস চলতে শুরু করলো, সন্দেহ হতে লাগলো, ষড়যন্ত্রটা পুরোটাই পূর্বপরিকল্পিত।
আচ্ছা, নিয়ে যাচ্ছিসই যখন তখন চল, শুধু এইটি মনে রাখিস ভাইডি, আর দুমাস বাদেই কিন্তু অ্যাপ্রেইজাল!
যদিও এদের ফুরফুরে মেজাজ, শেয়ানা মার্কা হাসি, আর নিজেদের মধ্যে ঠারেঠোরে নানারকম ঈঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিলো না যে এরা সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত। তা এসব ভাবনাচিন্তা শেষ হবার আগেই গাড়ি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো, আর এরা দুজনে তড়াক করে নেমে 'আসুন, বসুন, কি খাবেন বলুন' টাইপের কান এঁটো করা হাসি হেসে আমাকে ক্যাঁক করে ধরে হাজির করলো..
একটা তিনতলা কি চারতলা বড় বাড়ি, বাইরে বিশাল বড় নিয়ন সাইন। জায়গাটা একটা গলির মধ্যেই, একটু অন্ধকার যদিও, বস্তুত ঝলমলে ওয়াকিং স্ট্রিট, বা সুন্দরী মেরিন ড্রাইভের তুলনায় জায়গাটা বেশ নিরেস। গেটের সামনে স্যুট কোট টাই পরে জনা দুয়েক স্থানীয় পাবলিক দাঁড়িয়ে, সতর্ক চাউনি ও কাঠকাঠ হাসি।
নিয়ন সাইনে লেখা 'পি পি ম্যাসাজ পার্লার'।
নামটা আগের দিনই কোথায় একটা শুনেছিলাম বলে আবঝা করে মনে পড়ছিল, কিন্তু ধরতে পারছিলাম না। তা ম্যাসাজ পার্লার রংচঙে আর এত বড় হয় বাপের জন্মে দেখিনি, ভাবলুম এটাই বোধহয় 'নিখিল বিশ্ব দেহমর্দন সমিতি'র হেড অফিস। তা লোকজন দেখলুম ভারি শশব্যস্ত হয়ে আমাদের আদর ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।
বেশ আরামদায়ক সোফা, কয়েক ইঞ্চি বসেই গেলাম প্রায়। আশেপাশে দেখলাম আরও অনেক সোফাতে আমাদের মতই অনেকানেক মহাত্মা উপবিষ্ট। প্রায় প্রত্যেকের কাছেই স্যুট টাই পরা ধোপদুরস্ত চেহারার খিদমদগারের হাজির, হাতে ছোট নোটবুক, নিচু হয়ে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আলাপে ব্যস্ত। আরামদায়ক এসি, হালকা লাল আলো, ব্যাকগ্রাউন্ডে বিদেশী সঙ্গীতের মূর্ছনা, চট করে দেখলে পাঁচতারা হোটেলের রেস্তোরাঁ বলে ভুল হওয়া বিচিত্র কিছু না।
কিন্তু দেখার বিষয় ছিলো সামনে। এ জিনিস আগে কোনওদিন দেখিনি, পরেও কোনওদিন দেখবো বলে মনে হয় না।
যে হলে বসেছিলুম সেটা কম করে হলেও তিন হাজার স্কোয়ার ফিটের লম্বাটে হল। তার একটা সাইড ছাদ থেকে মেঝে অবধি কাঁচ দিয়ে ঢাকা। তার ওপারে প্রচুর আলো টালো ফোকাস দিয়ে রেখেছে। ছোটো ছোটো গ্যালারি টাইপের সিঁড়ি।
আর তার ওপরে বসা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন থাই মেয়ে!!
প্রত্যেকে বিকিনি পরে, যাতে অঙ্গসৌষ্ঠব স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রত্যকের ব্লাউজে গোল করে চাকতি আঁটা, তাতে নম্বর লেখা। কিছু চাকতি লাল, কিছু চাকতি নীল।
বিষয়টা বুঝতে কষ্ট হলো না, এটিই পাটায়ার সবচেয়ে খানদানি বুমবুমগৃহ। ইচ্ছেমতন চাকতির নাম্বার দেখে সঙ্গিনী বেছে নিন। নাম্বার বললেই কোটপ্যান্ট পরা দালালটি হাতের ইশারায় মেয়েটিকে উঠে আসতে বলছে আর এতক্ষণ ধরে অতল শূণ্যতা চোখে নিয়ে নির্নিমেষে সিলিঙের দিকে চেয়ে থাকা মেয়েটি একটা শেখানো প্লাস্টিক হাসি মুখে ঝুলিয়ে পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে, তারপর তারা দুজনেই মিলিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির বাঁকে।
নবমীর দিনে লেকটাউনের হামিদের পাঁঠার দোকানের কথা মনে পড়লো। বিভিন্ন সাইজের কাটা পাঁঠা হুক থেকে ঝুলছে, কাস্টমারের দীর্ঘ লাইন। হামিদ চিল্লাচ্ছে "ও দাদা রাং থেকে কতটা দিবো হাপনাকে? আর কলেজা? রাং চাই না? সিনা থেকে দিই? আরে ও আকবর, ছোটটার গুর্দা কাট বেটা, দুকিলোর বাটখারা চাপা, বাউদিকে দিতে হোবে", দীর্ঘ লাইনে সোল্লাস লোভ চোখেমুখে মেখে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেররা, ওজন আর সাইজ মিলিয়ে ঝুলিতে মাংসখণ্ড নিয়ে ঘরের দিকে দ্রুত প্রস্থান করবেন বলে, আহা দ্বিপ্রহরের স্বাদু ভোজনটির জন্যেই না এত কষ্ট স্বীকার!
একটা মোলায়েম হাসি ঝুলিয়ে অনতিবিলম্বেই এক স্যুটটাইধারী উপস্থিত হলেন, চোখেমুখে 'কাস্টমার ইজ কিং' টাইপের আদিখ্যেতা। আমাকে গুছিয়ে কিছু বলবার আগেই আমার প্রশ্ন, কিছু মেয়ের চাকতি নীল আর কিছু মেয়ের চাকতি লাল কেনে?
সুসভ্য উত্তর এল, লাল চাকতি লাগানো মেয়েগুলো একটু বয়স্ক, দেড় হাজার ভাটেই লভ্য। নীল চাকতির মেয়েগুলো লতুন ছম্মকছল্লুঁ, টাইট কচি মাল, একদম নিউ ইন ট্রেড, আড়াই হাজার ভাটের নিচে এই দুর্মূল্য মাংসপিণ্ড কি আপনার হাতে তুলে দিতে পারি স্যার?
বুমবুমে আমার বিলক্ষণ রুচি আছে, আমি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি নই, এ বিষয়ে আমার ছুঁৎমার্গও একদমই নেই। কিন্তু এভাবে পয়সার বিনিময়ে নারীমাংস ভোগে আমার তীব্র আপত্তি আছে। ফলে এই বাঙালকে সেই বুমবুম হাউস থেকে নিজের যাবতীয় হাউশ নিবৃত্ত করে বেরিয়ে আসতেই হলো।
বাইরে এসে তিনজনে বিভ্রান্ত চোখেমুখে দাঁড়িয়েছি কিং করিষ্যতি অবস্থায়, আশিস সবিনয়নিবেদনমিদং ভঙ্গিতে যা বললো তার সরলার্থ এই যে, বসের তো এমন সেবাও যে সখত না-পসন্দ সে তো বোঝাই যাচ্ছে, তবে কি এই ঝানন্দনকে তার বসের জন্যে একটা লেডিবয়েরই ব্যবস্থা করতে হবে নাকি? বসের পচুন্দ যে 'ইটস ডিফারেন্ট' সেটা আগে জানলে অবিশ্যি আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা আগে হয়েই যেত... এতটা বলেই সেই দুই ভীষণদর্শন ম্যানেজারদুটি প্রাণান্তকর দৌড় দিতে যে বাধ্য হলো তার একমাত্র কারণ যে আমি, এবং আমার অত্যধিক হিংস্র মুখভঙ্গি করে দৌড়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা, সেটা অনুমান করতে বেশি কষ্ট হবার কথা নয়। অবশ্য তিনজনেরই যে যথেষ্ট বয়েস ও যথেষ্টতর ভুঁড়ি হয়েছে সেকথাটা মাথায় থাকলে এই অপচেষ্টা করতুমই না, বলাই বাহুল্য। ফলে তিরিশ সেকেণ্ডের মাথায় কোমরে হাত দিয়ে হ্যা হ্যা করতে করতে তিনজনেই ডিসিশন নিলুম যে অগত্যা পাটায়ার শেষ রাতটা ফের ওয়াকিং স্ট্রিটেই কাটানো যাক।
পরের দুদিন কাটাই ব্যাঙ্ককে। সেখানেও বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা করে এসেছিলুম স্পষ্ট মনে আছে, যেমন একরাত হাজতে কাটানো, সুজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি। তবে কিনা আমার গুরুদেব বলেছেন "সব গুফন কথা হগগলডিরে কইয়া ফালান ঠিক না", আর আমার যে 'যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়' কেস, এ কথা আসমুদ্র লেকটাউন জানে। ফলে 'পাটায়াতে পটলকুমার' কাহিনীর নটেশাকটি আপাতত এইখানেই মুড়োলো। পরে যদি কোনওদিন মেজাজ মর্জি দিব্যি শরিফ থাকে, সেই হুইস্কিভেজা সন্ধ্যায় সেসব কথাও না হয় আয়েশ করে খুলে বলা যাবে'খন, কি বলুন, অ্যাঁ
পরের দুদিন কাটাই ব্যাঙ্ককে। সেখানেও বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা করে এসেছিলুম স্পষ্ট মনে আছে, যেমন একরাত হাজতে কাটানো, সুজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি। তবে কিনা আমার গুরুদেব বলেছেন "সব গুফন কথা হগগলডিরে কইয়া ফালান ঠিক না", আর আমার যে 'যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়' কেস, এ কথা আসমুদ্র লেকটাউন জানে। ফলে 'পাটায়াতে পটলকুমার' কাহিনীর নটেশাকটি আপাতত এইখানেই মুড়োলো। পরে যদি কোনওদিন মেজাজ মর্জি দিব্যি শরিফ থাকে, সেই হুইস্কিভেজা সন্ধ্যায় সেসব কথাও না হয় আয়েশ করে খুলে বলা যাবে'খন, কি বলুন, অ্যাঁ
অতিশয় উমদা... পটলকুমারের বর্ণনাটি পটলের দোর্মার (নাকি দোলমা) মতই উপাদেয়... :P
ReplyDeleteঅতিশয় উমদা... পটলকুমারের বর্ণনাটি পটলের দোর্মার (নাকি দোলমা) মতই উপাদেয়... :P
ReplyDeleteদারুন উপাদেয়
ReplyDeleteপটলকুমার যুগ যুগ জিও
একটি অসম্ভব চাবুক লেখা পড়লাম। আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল ও মিটল। যদিও আন্দাজে এ রকমই ভাবতাম পাটায়া... মন খারাপ হচ্ছে খুব। ট্যুরিজম কেও তো সিল্পো বলা হয় তাই না? কোন শিল্প কি এভাবে নারী মাংসের কদর্য খেলা খেলে? বেঁচে থাকবার, দুটো ভাত বা নুডলস খাবার জন্য আর কোন উপায় কি নেই?
ReplyDeleteসত্য কথার স্পষ্ট উচ্চারণ । আশাবাদী আপনি আরও লিখবেন, আরও জানব ... আমরা মানুষে কোথায় কেমন ।
ReplyDeleteBapok lekha. Hats off...
ReplyDeleteAdhunik Bangla bhasai Eto bolishtho , lekha R tar Sathe Narayan Ganguly R gondho ..
ReplyDeleteOnly u can write like this , but t beauty is tat taking out time from super busy schedule & invest time in this which is a simple bliss for Mango people like me !!
full jhakkash... kin2 boss coral island er cheye amader amader andamaner havlock beach onek bhalo r jokhn markin deshe pari debe, florida te ek2 destin ghure nio..na miami na orlando but destin... ekhane siggiri ashiley, tomai destin dekhabo..oi rokomer neel (turquoise) jol r different colour kothao dekhini
ReplyDeleteঅসাধারন ঝরঝরে লেখা। পড়তে পড়তে পুরোটা দিব্বি ছবি হয়ে গেলো। খুব সুন্দর।
ReplyDelete