1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সাম্য দত্ত

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


"আমি তো বড় হইনি!"
সাম্য দত্ত



প্রস্তাবটা শুনে 'হা হতোস্মি' বলে হাঁ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার ছিল, বলুন? প্রচ্ছদ নিবন্ধ লিখব আমি! 'ঋতবাক'-এর? তৃতীয় বর্ষে পত্রিকার পথ চলা শুরু হবে আমার থার্ড ক্লাস লেখা দিয়ে বউনি করে! সম্পাদিকা ইয়ার্কি করছেন নাকি সাতসকালে? 

উঁহু! বেশ কড়া হেডমিস্ট্রেসের মত ভাবভঙ্গি, ইনি ইয়ার্কি-ঠাট্টায় আদপেও বিশ্বাস রাখেন বলে তো মনে হয় না! কিন্তু একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, উপদেষ্টা মণ্ডলী থেকে লেখক তালিকায় কত্ত বাঘা বাঘা নাম, তাঁরা থাকতে... ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ গেল, শল্য সেনাপতি! ভাবুন একবার, গ্যালারি আলো করে বসে আছেন গ্রেস, ব্র্যাডম্যান থেকে কিং রিচার্ডস, সেখানে ব্যাট করতে নামলে পটলডাঙার প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে! তারপর তিনটি স্টাম্প তিনদিকে ছিটকে গেলে আমাকেও না লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হয়, "ওসব চালাকি রাখুন স্যার, আমার এখনও ওভার বাউন্ডারি মারা বাকি আছে।" 

হে প্রবলা প্রতাপশালিনী মহামহিমময়ী মহিষাসুর থুড়ি দত্তবংশধরঘাতিনী ঋতবাক সম্পাদিকা, কী করে বোঝাই আপনাকে, একটু সিড়িঙ্গেপারা চেহারা হলেও, আমি নিতান্তই নাবালক; বড়োজোর পেশেন্টের গলা কাটতে পারি কষ্টে সৃষ্টে, কিন্তু আমার লেখা মুখবন্ধে পত্রিকার কাটতির চেয়ে বরং পাঠকের কেটে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। মুখবন্ধের ঠেলায় হয়ত ম্যাগাজিনটাই গেল বন্ধ হয়ে! পাগল না প্যান্টুলুন! কিন্তু আপন জান এবং মানের দায়িত্ব যাত্রীরই, খোয়া গেলে কম্পানি দায়ী থাকবেন না। সুতরাং মিনমিনিয়ে বললাম, "আমার শরীলটা কেমন... মানে ম্যালোরি হয়েচে, কিম্বা ডিপথেরিয়া বা থ্রম্বোসিসও হতে পারে..." কিন্তু সম্পাদিকাও বোধহয় গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন, এসব ইন্দ্রলুপ্ত অর্থাৎ ধাষ্টামো খাটল না। অতএব, বালকবীর শহিদ হইতে চলিল। চলিল তো বটে, কিন্তু কোন পথে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার হয়ে তিব্বত? আচ্ছা, শাস্তরে মহাজনের পন্থা সম্পর্কে কী যেন বলেছে? গত সংখ্যায় অনবদ্য প্রচ্ছদ নিবন্ধটি যিনি নামিয়েছিলেন, সেই নিবন্ধকারকেই 'গুরুদেব দয়া কর দীনজনে' বলে ধরে পড়লাম। উত্তর---"তথাগতের অন্তিম বাণী স্মরণ কর। আত্মদীপ হও, আত্মশরণ হও।" 
-অর্থাৎ? 
-অর্থাৎ নিজের ম্যাও নিজে সামলাও। কিন্তু খবরদার, আমার লেখা টুকলিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ঘানি টানিয়ে ছাড়ব বলে দিলাম। 

ঘনাদার চেয়েও ঘুঘু লোক মশায়! ঠিক ধরে ফেলেছে! ধরেই যখন ফেলেছে, তখন আর কিং করিষ্যতি? মনে পড়ল, একপাতা লেখার জন্য হাজার পাতা পড়ার একটা নিদান আছে। অলরাইট! জ্ঞানসমুদ্রের তীরে দুচাড্ডি উপলখণ্ড তো কুড়োই, পরে ভাবা যাবে সেগুলো ছুঁড়ে কাকে মার লাগানো যায়। অভিধান দিয়েই শুরু করা যাক, কী বলেন আপনারা?

এই সেরেছে! 'ঋতবাক' শব্দার্থ কী যেন? ওমা! অভিধান কই? তার মলাটখানা আছে বটে, ভেতরে একি! 'যশোবন্ত দারোগা- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক!' বুঝতে বাকি রইল না, এ কার অপকর্ম। রেগেমেগে বললাম, "কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক এককোণে।" কিন্তু পাগলের কি তা'তেও লজ্জা আছে? সারাটি ঘন্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে হাসতে লাগল! 

আচ্ছা, দাশু কি সত্যিই পাগল, না কেবল মিচকেমি করে? 

ধমক খেয়ে মাথা নীচু করে বসে আছি। সামনে রাখা চা-ডালমুট জুড়িয়ে জল! খবরটা আরও নাটকীয় ভাবে দিতে পারতাম, কিন্তু ভদ্রলোক নিজেই বললেন, "গাদাগুচ্ছের মর্চে-ধরা বিশেষণ আর তথাকথিত লোম-খাড়া-করা শব্দ ব্যবহার না করে চোখে যা দেখলি সেইটে ঠিকঠিক সোজাসুজি ভাবে বলে গেলে কাজ দেয় ঢের বেশি। আর একটু আগে তুই যে জানলা দিয়ে থুক করে থুতু ফেললি... ওটা আনহাইজিনিক... নেক্সট টাইম করলে গাঁট্টা খাবি।" 

ফিরতি পথে গাড়িতেও মুখ গোঁজ করে বসে ছিলাম। গাড়িটা অ্যাম্বাসাডর, মাদ্রাজি ফিলিম মার্কা পীড়াদায়ক সবুজ রঙ, তায় কানফাটানি-হাড়জ্বালানি হর্নের ঠেলায় মাথা ধরে যাবার যোগাড়। গাড়ির মালিক বললেন, "মনখারাপ করো না ভাই, ওই ধমক খেয়ে খেয়েই আমার লেখা অনেক ইমপ্রুভ করে গেছে। আমার লেটেস্ট 'করালকুম্ভীর'টা পড়ে দেখো, একটা ভুল খুঁজে পাবে না!" 

-তাগোরের সঙ্গে! তাগোর আবার কে? 
-বাঃ! রাবীনদ্রা নাত্ তাগোর! 
বুঝলাম কবিগুরুর নাম ফরাসি উচ্চারণে এই রকম দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, "তার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল? কোথায় আলাপ হয়েছিল?" মঁসিয়ে পেত্রা আমতা আমতা করে বলল, "মানে তিনি যখন পারিতে ছিলেন, তখন খবরের কাগজে তাঁর ফটো দেখেছিলাম।".... একটা অসাধারণ গল্প শেষ করে ঘনাদা আরামকেদারা ছেড়ে উঠে গেলেন। সিগারেটের টিনটা, না না, পকেটে ফেলে নয়, যেন মনের ভুলেই ফেলে রেখে গেলেন। হয়ত আমার লেখার কাজে আসবে ভেবেই!

------ "সেকি! সকালে উঠে লিখবে কেন? সূর্যের মতো আর্লি রাইজার হবার পক্ষপাতী নই আমি। সকালে উঠতে হবে, এমনকি আদৌ যে উঠতে হবে, এমন কোনও কুসংস্কার আমার নেইকো। খেয়ে আর ঘুমিয়েই আমি সারাদিন কুলিয়ে উঠতে পারিনা। ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায়, সময়মত না খেলেই আমি ভাই কাহিল হয়ে পড়ি। খাওয়ামাত্র আমার ঘুম দরকার, ঘুম থেকে উঠে খাওয়া, তারপর আবার ঘুম। সারাদিন এই চলে। সন্ধ্যের দিকে আড্ডা দিতে বেরই, তারপর নাইট শো'তে সিনেমা দেখে ফিরি গভীর রাতে। তারপর রাতে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠি পরদিন।" -তাহলে লেখেন কখন?'
-"কেন? পরের দিন!" 
বুঝতেই পারছেন কার কাছে গিয়েছিলাম পরামর্শ নিতে। মুক্তারামের মুক্তপুরুষটির তক্তার আরাম চেখে আর রাবড়িচূর্ণ খেয়ে ফিরলাম।

"6ই জুলাই 
আজ অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। গত দু'দিনে প্রফেসর রন্ডির টাইম মেশিনে বেশ কয়েকবার সফর করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতীতের দিকে বেশ খানিকটা আগেই ঘুরে এসেছি। তাই আজ ঠিক করেছিলাম, ভবিষ্যতের দিকে যাব। সাহিত্যের, বিশেষত বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমার ছেলেবেলা থেকেই একটা আকর্ষণ ছিল। পরবর্তীকালে আমি ভারতীয় এবং বিদেশী মিলিয়ে সতেরোটি ভাষা রপ্ত করি এবং প্রায় প্রত্যেকটির সাহিত্যকর্মেই আমার কমবেশি দখল আছে। তাই আজ থেকে বছর পঞ্চাশ পরে সাহিত্যচর্চার গতিপ্রকৃতি ঠিক কীরকম হবে, সেটা জানার কৌতূহল ছিল। 

রন্ডির এই মেশিনে স্থান এবং কাল দুটোই আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া যায়। আমি গিয়ে পড়লাম দু'হাজার ষাট সালের কলকাতা বইমেলার সময়। মেলার চেহারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে ঠিকই, তবে যে জিনিসটা সবথেকে বেশি নজর কাড়ে, তা হলো কাগজের ব্যবহার একেবারে অবলুপ্ত। আমি প্রায় আধঘন্টা মেলায় কাটিয়েও ছাপা বইয়ের স্টল একটিও দেখতে পেলাম না। লেখালেখির পুরোটাই হচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে, আর ছাপা পত্রিকাকে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন। 

অবিশ্যি এতে আশ্চর্য হবার আর কি আছে? যে হারে মানুষ প্রকৃতির ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তা'তে ভবিষ্যতে অন্তত কাগজের প্রয়োজনে গাছ কাটা বন্ধ করতেই হবে। আর কাগজের তুলনায় কম্পিউটারে বা মোবাইলে লেখা যেমন সহজ, পড়াও। আমিও ভাবছি গিরিডিতে ফিরে গিয়ে এবার ডায়রির বদলে ব্লগ লেখা শুরু করব।" ---

লেখাটা এইমাত্র পেলুম একটা ডায়রি থেকে । ডায়রিটা ভারি অদ্ভুত! টানলে রাবারের মত বেড়ে যায়, আগুনে পোড়েনা আর কালির রঙ বদলায় ঘনঘন। প্রথমে লাল, তারপর নীল, হলদে, সবুজ..... লেখকের নাম? নাইবা বললাম! 

মোটকথা নিবন্ধখানা নির্যস মাঠে মারা গেল। মাননীয়া সম্পাদিকা যেন কিসব পয়েন্টে লিখতে বলেছিলেন। ওয়েবম্যাগের কিস্যা ছুঁয়ে ম্যাগির সীসা, মঙ্গলগ্রহে জলের সন্ধান থেকে মঙ্গোলিয়ার ইতিহাস- সেসব গুলিয়ে ফেলে লেখাটাই পয়েন্টলেস হয়ে দাঁড়াল। তা, খুব ক্ষতি হলো কি? একবার একটু উল্টে দেখাই যাক না, কিছু পাল্টে যায় কিনা! আপনার বইয়ের তাকে কাফকা-কোঁতকা-ফুকোদের ভিড়ে যাঁরা পিছনের বেঞ্চিতে সরে বসেছেন, এক ফুঁয়ে তাঁদের ধুলো ঝেড়ে সামনে আনুন। দিনকতক টঙের ঘরে রাজত্ব করুন শ্রী ঘনশ্যাম দাস। একদিকে বসিয়ে দিন অর্জুনের নাইফ থ্রোয়িং-এর খেল, তারপর জমিয়ে দেখুন আপনি আর মগনলাল মেঘরাজ। পাশেই বিজ্ঞানের আলোচনায় মেতে উঠুন দুই প্রফেসর, শঙ্কু ও ক্যালকুলাস। এক চক্কর হেঁটে আসুন, আপনার পাশেই থাকবেন ক্রাচ বগলে রাজা রায়চৌধুরী। একবেলা সুপারিন্টেনডেন্ট স্যারের ক্লাস করুন নন্টে-ফন্টে আর কেল্টুদার সঙ্গে বসে। আর 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'তে বসে অদ্ভুতুড়ে হাসি হাসুন শীর্ষেন্দু। এঁরা আপনার অন্দরমহলে শ্যাওলা জমতে দেবেন না! 

একবার ভাবুন তো, লাল-নীল-গেরুয়া-সবুজ এমন হাজার ভূতের দেশে আমাদের বাস, অথচ নিধিরাম সর্দারকে আপনি স্রেফ ভুলে বসে আছেন! সর্বাঙ্গে বোমা বেঁধে কচি ছেলেদের ইস্কুলে ঢুকে পড়তে আপনার বুক কাঁপছেনা, অথচ আপনারই ছেলেবেলাটা মিহিদানার হাঁড়িতে চিনেপটকা রেখে, আপনারই বুকের মধ্যে বসে হাপিত্যেশ করছে! বড় হলেই বড় কষ্ট, বরং বড়বেলার ধরপাকড়ের নেশা ছেড়ে আপনিও মুকুল ধরের মত বলুন, "আমি তো বড় হইনি!" বড় আরাম পাবেন। 

তবে বড় হোক ঋতবাক। তিন থেকে তিরিশ ছুঁয়ে তিনশোর দিকে তার যাত্রা মসৃণ হোক । আমরা সেই বৃহৎ মহীরুহের ছায়ায় বসি পা ছড়িয়ে, তারপর গলা ফাটিয়ে বলি, "ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক।"








1 comment:

  1. যথারীতি দুর্ধর্ষ, বাংলা সাহিত্যে এক নতুন নক্ষত্র এলো, শুধু মুখ তুলে চেয়ে দেখার অপেক্ষা

    ReplyDelete