2

পথে প্রান্তরে - বিধান তুঙ্গ

Posted in


পথে প্রান্তরে


কেদারনাথের পথে
বিধান তুঙ্গ



"বাবা, এতদিন পরে ফিরবে?" ছলছলে চোখে ছেলের প্রশ্ন, স্ত্রীর অভিমান ও আবেগঘন মুখের "সাবধানে থাকবে" প্রতিবারই মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়। প্রতিবারই ভাবি -আর নয়, এই শেষ - বয়স বাড়ছে, পরিবারের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা! কি করব, কাকে বোঝাই পরিযায়ী মনের কথা। হিমালয়ের অমোঘ আকর্ষণ, নিশির ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সব কিছু উপেক্ষা করে আবার চলেছি হিমালয়ে। উপাসনা মেলে আমরা সাত জন চেপে বসেছি হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। জঙ্গল, ঝরনা, বরফ, আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে হারিয়ে যাই। গাড়োয়াল হিমালয়ের মাওয়ালি গিরিপথের (১৭৫৪৯ ফুট) মধ্যে দিয়ে কেদারনাথ পৌঁছাতে চাই। কেদারনাথে পৌঁছানোর চারটি পথ রয়েছে। মাওয়ালি গিরিপথ - যে পথে আমরা চলেছি, দ্বিতীয় -এডেন কল হয়ে গঙ্গোত্রী থেকে কেদারনাথ। তৃতীয় - ত্রিযুগীনারায়ণ-পঁওলীকঁটা হয়ে, চতুর্থ - প্রচলিত পথ গৌরীকুণ্ড হয়ে।



দ্বিতীয় দিন / ২৮ মে

না! হলো না -ইচ্ছে ছিল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবো। সকাল ৫-৪০ মিনিট "চায়ে চায়ে"- সেই চিরপরিচিত ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। না! কিছুতেই এখন উঠবো না। চোখ বন্ধ করে রইলাম। আগামী দিনের চিন্তা ভীড় করছে মনের গহ্বরে, চিন্তার কোষগুলি সজাগ হয়ে গেলে ঘুম আসে? অগত্যা ভোরের ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। সবাই শুয়ে আছে, উপায় নেই বসার। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভোরের নরম আলোকে স্নাত প্রান্তিক স্টেশনগুলি একটার পর একটা আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। চরাচর জেগে উঠেছে ধীরে ধীরে, পশ্চিম ভারত একটু দেরিতে জাগে। লেকভিউতে শুভশ্রী, নূপুরের হাঁটা শেষ হয়ে যায় এতক্ষণে। ছোট্ট অনীক মায়ের পায়ের কাছে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাবা-মায়ের সাথে চলেছে হরিদ্বার - হৃষিকেশ বেড়াতে। রামরাজাতলার ডলিদি স্বামীর সাথে চলেছে হিমালয়ে। পঞ্চকেদার চারটি হয়ে গেছে, ৫৮ বছর বয়সে অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক স্বামীকে নিয়ে চলেছেন পঞ্চকেদারের কঠিনতম পথ রুদ্রনাথ। আমায়িক বয়স্ক মানুষ দুটি দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। দেখতে দেখতে উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী পৌঁছে গেলাম। ঘড়ির কাঁটাতে সকাল ৭-৩৫ মিনিট, মানে ২০ মিনিট লেট। এখনও হরিদ্বার ৯ ঘন্টার পথ।

আমাদের অভিযানের লক্ষ্য ঘুট্টু হয়ে মশারতাল, মাওয়ালি গিরিপথ ও বাসুকিতাল হয়ে কেদারনাথ। কেদারনাথের পথে যতগুলি পথ আছে, তার মধ্যে অন্যতম ও সকল অভিযাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এবং সেপ্টেম্বর -অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই পথে অভিযান হয়। প্রাক বর্ষায় এই পথ অধিকাংশই বরফে ঢাকা থাকে।..

.......একি! দাঁড়িয়ে পড়লো কেন? বেশ তো চলছিল। উপাসনা এক্সপ্রেস জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে লাসকার স্টেশনে। আমাদের বহু প্রতীক্ষিত স্টেশন হরিদ্বারের কিছু পূর্বে। সমস্ত মালপত্তর গুছিয়ে স্টেশনে নামার অপেক্ষায়। "দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে"- মোহিত হয়ে গেলাম বৃথা চ্যাটার্জির অপূর্ব কন্ঠস্বরে। সবার অনুরোধে কয়েকটি গান আমাদের শুনিয়ে দিলেন। বৃথা স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই গান নিয়েই আছেন। কয়েকজন বন্ধুর সাথে চলেছেন তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা অভিযানে। তাঁর ইচ্ছে পরবর্তীকালে আমাদের সাথে অভিযানে যাওয়ার। চলভাষের নম্বর বিনিময় করতে করতেই চলে এলো হরিদ্বার। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, সৌজন্য বিনিময়ের সুযোগটাও পেলাম না। পথের বন্ধু হারিয়ে গেল ভীড়ের মাঝে।

স্টেশনে নেমে অটো রিকশা করে বেরিয়ে পড়লাম হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে অস্বাভাবিক ভীড়, পুণ্যলাভের আশায় দলে দলে মানুষ এসেছে পুণ্যভূমি হরিদ্বারে। এখন চারধাম যাত্রা চলছে, গঙ্গোত্রী -যমুনোত্রী -কেদার-বদরী। সারা উত্তরাখণ্ড রাজ্য জুড়ে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির। "হরির-দ্বার" হলো প্রবেশ পথ। চারিদিকে কংক্রিটের জঙ্গলে ভরে উঠেছে, অপরিচ্ছন্ন মলিন পথঘাট, ইঁট -পাথরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি আধুনিক সভ্যতা থেকে সাময়িক মুক্তির আশায়।

রাতে ঠাঁই হলো পূর্ব পরিচিত হোটেল নীলকণ্ঠে। দশ দিন হাঁটার রসদ এখান থেকেই সংগ্রহ করে নিয়ে যাব। হৃষীকেশ বাজারের কাছেই হোটেলটি।

ব্যাগ গুছিয়ে রাখার আগেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হলো। মাথায় হাত -আজ রাতের মধ্যেই সব রেশন কিনে নিতে হবে, ঘুট্টু যাওয়ার গাড়ির ব্যবস্থা - কী করে সম্ভব? 

ঝড়ো হাওয়া আর মুশলধারায় বৃষ্টি হয়েই চলছে।

যাহ্‌!! লোডশেডিং হয়ে গেল - ষোলো কলা পূর্ণ। বৃষ্টি ধরে এসেছে, রেনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে টর্চ। ভাগ্যক্রমে পাশেই ভালো একটা মুদির দোকান ছিল লিস্ট দেখে বলে দিলাম। সকালে তুলে নেব গাড়িতে। গাড়ির কী হবে? -অজয় ট্রাভেলস গাড়ির ভাড়া যা চাইছে তা আমাদের বাজেটের বাইরে। প্রকৃতি বিরূপ, গাড়ির জন্য স্টান্ডে যেতে পারছি না।

"হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে, রাতে খাওয়া হবে না। চল আগে খেয়ে নিই " -রাজেশের আকুতি ভরা কন্ঠ।

রাজেশ আমাদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সক্ষম সদস্য। সবাই যা খাবে, তা থেকে বেশির ভাগ সময় অন্য কিছু খেতে হবে। কিন্তু বিপদের সময় রাজেশ সবার আগে।

"বিধানদা, নটরাজচকে চলো। খুব ভালো আমিষ খাবার পাওয়া যায়"। এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চার কিলোমিটার দূরের নটরাজচকে খেতে যাবো? যাব কি করে? প্রশ্ন শুনে উওর দিল - "অটো রিকশা ৭ টাকা নেবে"। চলো, যাওয়া যাক। গাড়ি সকালে ঠিক করা যাবে। টিপটপ খাবার হোটেলে পৌঁছলাম। সত্যিই অনবদ্য খাবার। মাটন রোগানযোশ-তন্দুরি রুটি স্যালাড সহযোগে রাতের খাবার সম্পূর্ণ করলাম। হোটেলে ফিরে পরের দিনের ভাবনা ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো। শুভ রাত্রি।



তৃতীয় দিন/ ২৯শে মে 

"বিধানদা, ওঠো ওঠো"- দরজায় স্বরূপের করাঘাতে ঘুম ভেঙে গেল। রোদ ঝলমলে সকাল। অপরাধবোধ নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। "চলো যাই, গাড়ি বুক করতে হবে"- দশ মিনিট সময় চেয়ে নিলাম রেডি হতে।

স্বরূপ ব্যানার্জী মেদিনীপুর টাউনের ছেলে, পেশায় ব্যবসায়ী, নেশায় পাহাড়ি। অসম্ভব প্রাণবন্ত ও উদ্যোমী মানুষ। যে কোনও কাজ দাও, ‘না’ বলবে না, দলের সম্পদ, উজ্জীবিত রাখে দলের সদস্যদের।

বেরিয়ে পড়লাম গাড়ির খোঁজে। অবশেষে নটরাজচকের স্টান্ডে অজয় ট্রাভেলসের অর্ধেক দরে বোলেরো গাড়ি পেয়ে গেলাম। গাড়ি নিয়ে হোটেলে ফিরে সবাইকে প্রস্তুত হতে বলে সমীরণদাকে কালকের বাজারের তালিকা মিলিয়ে নিতে অনুরোধ করলাম। সবাই ব্যাগপত্তর গাড়িতে তুলে মুদির দোকানে গেল রেশন আনতে। হৃষীকেশ ছেড়ে ঘুট্টু রওনা দিলাম সকাল ৮-৪৫ মিনিটে।

সমীরণদা আমার জেঠুর ছেলে। দাদা কম, বন্ধু বেশি। বুদ্ধিমান ও শান্ত মাথার মানুষটি বড় প্রিয় এবং নির্ভরশীল। তবে শরীর মোটেই নির্ভরশীল নয়।

রাজেশ পাল আমাদের বোলেরোর সারথি। হৃষীকেশের ছেলে, অভিজ্ঞ ও দক্ষ চালক। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই বিতর্কিত তেহেরী জলাধারে, সুন্দরলাল বহুগুণার আন্দোলন বাঁচাতে পারেনি নিম্ন তেহেরীর গরীব মানুষদের। বাঁধের কাছে পুলিশের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ উপেক্ষা করে ক্যামেরাবন্দী করা গেল জলাধার। চাম্বা, তেহেরী, অতিক্রম করে পৌঁছলাম ঘনশালীতে। চা পানের বিরতি। চালক রাজেশ এক দুঃসংবাদ বয়ে আনল - "সাব, আগে নেহি যা পাইঙ্গে"। বিনা মেঘে বজ্রপাত। কেন? কী হলো? 

দোকানদার রামকৃষরামকে জিজ্ঞাসা করলাম ঘুট্টু রাস্তায় কী হয়েছে? গাড়ি যাবে না? আশাব্যঞ্জক কিছু শোনালেন না। বললেন কাল রাতে বা সন্ধ্যায় এখানে cloud burst হয়েছে। মানুষ মারা যায়নি ঠিকই কিন্তু কিছু গোরু, মোষ, বাড়ি জলের তোড়ে ভেসে গেছে। পুলিশের কাছে ছুটে গেলাম শেষ খবরটা কি? কোনও আশা আছে কিনা, রাস্তার কি অবস্থা? 

আহ... বাঁচলাম। পুলিশ জানালো, রাস্তা প্রায় ঠিক হয়ে গেছে, ঘনশালীর এক কিলোমিটার পর মেরামতির কাজ চলছে। গাড়ি নিয়ে চলে এলাম ধ্বংসের কাছে। জলের তোড়ে রাস্তা ভেসে গেছে। দুটো যন্ত্রদানবের আধ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় অপেক্ষার অবসান ঘটল।

এগিয়ে চললাম ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে। এবার আস্তে আস্তে সবুজের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। দুপাশের সবুজ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে কালো সর্পিল রাস্তা ধরে ছুটে চলেছি। পথের পাশেই উপল বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে বহমান ভিলাঙ্গানা নদী। পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম ঘুট্টু। ভিলাঙ্গানা নদীর ডান তীরে ছোট্ট টিলার উপরে আমাদের দুদিনের আশ্রয়স্থল এই গাড়োয়াল নিগমের বাংলো। এখান থেকে শুরু হবে আমাদের যাত্রা।



চতুর্থ দিন/ ৩০শে মে

সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। দক্ষিণের আকাশে কালো মেঘ। ভিলাঙ্গানার কলকল ধ্বনি ছাপিয়ে গর্জে উঠছে মেঘ। চায়ের চুমুক আর বিদ্যুৎ ঝলকানির মধ্যেই শুভানুধ্যায়ীদের পরপর ফোন। সতর্কবাণীর বন্যা বয়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে। সবাইকে ধন্যবাদ, কথা দিলাম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেব না। পরিবার-বন্ধু সবার জন্য, নিজের জন্য পরিস্কার আবহাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সবাই প্রার্থনা করুন মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের প্রতি বিরূপ না হন।

সকালের প্রাতরাশ করতে গিয়ে পরিচয় হলো এই অঞ্চলের বিখ্যাত পথপ্রদর্শক জয়পাল সিং এর সঙ্গে। যে মানুষটাকে গত একবছর ধরে বই আর অন্তর্জালে খুঁজে বেড়িয়েছি, তিনি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ৬৫ বছরের সুঠাম চেহারার আমায়িক, পরোপকারী মানুষটি। ১৯৭২ সালে ১৫ টাকার দৈনিক মজুরিতে সামান্য কুলি হিসেবে জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন হিমালয়ের পথে পথে। বয়স বাড়লেও শরীর মন যুবকের মতো তরতাজা। হাতের তালুর মতো চেনেন গাড়োয়াল হিমালয়কে। প্রশ্ন করলাম, "মসম এইসা রহেগা? খোলে গা কি নেহি? হামলোগ যা পাইঙ্গে? "

উত্তরে যা বললেন আশাব্যঞ্জক নয়। কয়েকটি সম্ভাবনার কথা কথা বললেন - ১) এই রকম বৃষ্টি চলতে থাকলে দু-তিন দিনের মধ্যে আকাশ খুলে যাবে। ২) নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি চললে খাটলিং কেভ পর্যন্ত যেতে বাধা নেই। ৩) রোদ উঠে গেলে গিরিপথ অতিক্রমে বাধা নেই।

আমাদের উপায় নেই অপেক্ষা করা ছাড়া। জয়পাল সিং-কে গল্প শোনানোর জন্য নিগমের বাংলোতে আমন্ত্রণ জানালাম। আপাতত তাস খেলতে চললাম।

দুপুর ১২-৫০ আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। জয়, কেদারনাথ কি জয়! 

খেলায় মনোযোগ আসছে না। মনের কোণে অজানা আশঙ্কা, গাইড ও কুলি এখনও এসে পৌঁছলো না। সকাল থেকে বারবার ফোনে যোগাযোগ করছি কতদূর এলো। বাসের সমস্যার জন্য আসতে দেরি হবে। দুপুরের আহারের ব্যবস্থা নিকটবর্তী ছোট্ট একটা হোটেলে। চতুরান সিং রাওয়াত হোটেলের মালিক কাম কুক। যত্ন নিয়ে যথাসাধ্য ভালো খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। ফোনে অডার্র দিলে নিগমের বাংলোতে চা ও খাবার দিয়ে যায়। অবশেষে গাইড রঘুবীর সিং সাত জন কুলি, এক জন রাঁধুনী নিয়ে হাজির। একটা চিন্তার অবসান হলো। নিগমের একটা হল ঘরে সবার বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়লাম বাজারে সব্জি আনতে। সমস্ত রসদ সংগ্রহ করতে করতেই রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। লোডশেডিং এ কেমন ভাবে গোছানো হবে? রঘুবীরকে সকালে গোছানোর পরামর্শ দিয়ে আজকের মতো ইতি টানলাম। 




পঞ্চম দিন / ৩১শে মে

সকাল ৫টায় উচাটন মন নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। আকাশের অবস্থা কেমন? আজ কি পারব না শুরু করতে? মেঘ মুক্ত আকাশে একফালি চাঁদ আর বরফে মোড়া শৃঙ্গ দেখে হৃদয় ভরে গেল। আনন্দ আর উত্তেজনায় সবাইকে ডেকে তুললাম। একে একে সবাই হাজির, চোখ মুখে আনন্দের আভাস। বর্তমানে ঘুট্টু থেকে রী পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়। গতকাল দুটো গাড়ির সাথে কথা বলেছিলাম। সকাল ৮ টা ৩০ মিনিটে ঘুট্টুকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম -জয় কেদারনাথ- ধ্বনি দিতে দিতে। ভাঙাচোরা রাস্তার উপর দিয়ে দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম ১০ কিমি দূরের "রী" গ্রামে। 

এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের হাঁটার পথ, গন্তব্য ১০ কিমি দূরের "গাঙ্গী"। গাইডের তত্ত্বাবধানে মালবাহকেরা নিজেদের বোঝা পিঠে তুলে নিল। শুরুতেই গাইডের নির্দেশ - আপলোক সাথ সাথ রহিয়ে গা, আগে পিছে মত্ রহ। আইসতা আইসতা চলতা রহ। অনুরোধ করলাম পেছনে থেকে সবাইকে নিয়ে আসতে।। 

রী-র নিগমের বাংলোর কাছাকাছি থেকে সকাল ১০টায় শুরু হলো যাত্রা। সামান্য চড়াই - উতরাই ভেঙে নেমে এলাম একটা ঝোরার মধ্যে। ঝোরা অতিক্রম করে শুরু দমফাটা চড়াই। বুকের পাঁজর হাপরের মতো উঠানামা করছে। কারোর মুখে কথা নেই একটাই প্রশ্ন- আর কতক্ষণ ভাঙতে হবে এই চড়াই? ডান দিকে ভিলাঙ্গানা অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে। শৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা অভিক্ষিপ্তাংশগুলো বিনুনির মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে। ভিলাঙ্গানা হারিয়ে গেছে ঐ বিনুনি মধ্যে। প্রকৃতি সেজে রয়েছে অপরূপ সাজে। ক্যামেরা বন্দী করার ইচ্ছাটুকুও অবশিষ্ট নেই। প্রাণান্তকর চড়াই ভেঙে ৫ কিমি দূরের নালহান গ্রামে পৌঁছলাম ১ টা ২৫ মিনিটে। কুলিরা জানাল আজকের মতো চড়াই শেষ। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। প্রথম দিন কষ্ট হয় সবচেয়ে বেশি, শরীর অভ্যস্ত হয়ে পড়লে সয়ে যায়। 

ছোট্ট গ্রাম নালহান। গ্রামের মানুষের জীবিকা মূলত কৃষি। বাকি সময় কুলির কাজ করে। ধাপ কৃষিতে ধান, আলু, মটর চাষ করে। জমিগুলোতে সবুজের আভাস কম, সবে বীজ বুনেছে, বর্ষার জলের অপেক্ষা। 

নমস্তে বাবুজী, মিঠাই দিজিয়ে - একদল শিশু - কিশোর ঘিরে ধরলো। লাল লাল ফাটা ফাটা গাল হাসি মুখের বাচ্চাগুলোর দেহে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। লজেন্স দিয়ে বিদায় জানালাম। 

দু’কিমি পরেই ছোট্ট গ্রাম লালা অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম গাঙ্গীর উদ্দেশ্যে, ছোট্ট চড়াই - উতরাই ভেঙে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কলকাতার দূষিত বাতাস থেকে সাময়িক মুক্তি। রোডোড্রেনড্রন, বার্চ, জুনিপার, উইলো, বুনো গোলাপ, নানা নাম না জানা গাছে ঢাকা পথ। শুকনো পাতার মধ্যে আপন পদ যুগলের অদ্ভূত সুর মূর্ছনা। বাতাসে ফুলের সুবাস, নাম না জানা পাখির কলতান কষ্ট লাঘব করছে। পরিশ্রান্ত শরীর টানতে টানতে নিয়ে চলেছি। 

সঙ্গী দলের হিসাব রক্ষক কাম ম্যানেজার প্রণব। শান্ত স্বভাবের প্রণব ছাড়া এই দল অসম্পূর্ণ। প্রতি নিয়ত প্রণবকে নিয়ে মজা করতে করতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। প্রতিবার খাবার শেষ করে সবাই হাত বাড়িয়ে দেয়- হাজমোলা দাও। কাউকে নিরাশ করে না। খুঁটিনাটি নির্ভুল হিসাবের সাথে প্রাণীদের বহু তথ্য তুলে ধরে। যেমন, আজ একটা প্রাণীকে দেখলাম গিরগিটির মতো কিন্তু আকারে বড়, নাম বলল - হিমালয়ান ক্যালোটিস ভারসিকালার। অবশেষে গাঙ্গী গ্রামের দেখা পেলাম। সময় ৩ টে ১৫ মিনিট। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম, কারুকাজ করা দরজা - জানালা। গ্রামের শেষ প্রান্তে সবুজ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গাড়োয়াল মণ্ডল নিগমের বাংলোতে নিলাম রাতের আশ্রয়। রাঁধুনী কীর্তনের হাতের অপূর্ব রান্না খেয়ে আশ্রয় নিলাম গরম লেপের (খুব গন্ধ L) তলায়।



ষষ্ট দিন/ ১লা জুন

"Good morning everybody, চায়ে লিজিয়ে"-কীর্তনের অভিবাদন আর চমৎকার চায়ের স্বাদে শুরু হলো সকাল। উওর -পূর্ব কোণে তুষারমৌলি শৃঙ্গ দৃশ্যমান। ভাবছি এই শৃঙ্গগুলির কী কোনও নাম আছে? এই সময় উপস্থিত হলো গ্রামের যুবক ভীম বাহাদুর। জিজ্ঞেস করায় বলল, বালা ও সহস্রতালের নিকটবর্তী শৃঙ্গ। জনপ্রিয় পথ হলো এই সহস্রতাল। বাহাদুরের কাছে জানতে পারলাম সে বছরের বেশি ভাগ সময় থাকে খাটলিং- চৌকি অঞ্চলে। মেষ পালক।

রুটি -সব্জি ও সেদ্ধ ডিম সহযোগে প্রাতরাশ সেরে সকাল ৭-৩০ বেরিয়ে পড়লাম বিরোধা গ্রামের উদ্দেশ্য। দূরত্ব ১১ কিমি। আজ তুলনামূলক সহজ পথ, উচ্চতা ২৫০০ ফিট বৃদ্ধি পেলেও তা হবে ধীরে ধীরে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে সবাই পা চালালাম।

দু ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ৫ কিমি দূরের দেওক্ষী গ্রামে। ছোট্টছোট্ট শিশুগুলির দুহাত ভরে লজেন্স দিতে পারায় ভোরে গেল মন। অনাবিল হাসি সবার মুখে। মনে পড়ে গেল সন্তানের মুখ, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো -"বাবা,বাবা "-শেষ বার যখন হয়েছিল এই শব্দটি দুবার বলতে পেরেছে। অপত্য স্নেহ বড় সাংঘাতিক বেদনার। প্রতিদিন রাতে মাকে ছেড়ে বাবার হাতকে বালিশ না করলে ঘুম আসে না।

গ্রামের শেষপ্রান্তে দেখি সমস্ত কুলি ও আমার কিছু বন্ধু অপেক্ষা করছে। কী ব্যাপার? "সাব মাটন চাহিয়ে"- এগিয়ে এসে বলল রতন সিং। "দেখো সাব, হিরণ"। দেখলাম সত্যিই মরা একটি হরিণ রাখা আছে পাথরের উপর। বৈশাখী দেবী নামের দেওক্ষী গ্রামের বয়স্ক মহিলা কুড়িয়ে এনেছেন। ১৫ কেজি ওজনের মৃত হরিণ খাওয়ার অভিপ্রায় আমার নেই। সবাইকে হতাশ করে সামনে এগিয়ে যেতে বললাম। 800 টাকায় গোটা হরিণ ফেলে আসার গঞ্জনা সহ্য করতে হলো।

মন মাতানো সবুজ শোভা আর ভিলাঙ্গানার গর্জন শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম। বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে থলাইসাগরের লুকোচুরি খেলা চলছে, কখনও আড়ালে কখনও দৃশ্যমান। পৌঁছে গেলাম বিস্তৃত সবুজ গালিচার বুগিয়াল কল্যাণী। অসংখ্য ভেড়ার পাল, পশু চারণভূমিতে ইতিউতি বিরাজমান। পরিচয় হলো দিল্লি থেকে আসা দলের সদস্য বাঁকুড়ার সুভাষের সঙ্গে। কয়েকজন বিদেশীদের সাথে খাটলিং অঞ্চলে হিমবাহের উপর কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে বিদায় জানালাম। 

সামান্য চড়াই - উতরাই পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আজকের গন্তব্য স্থল বিরোধা। সময় দুপুর ১-৩০। খরসু, বিছুটি গাছের জঙ্গলের মধ্যে আজকের তাঁবু পাতা হলো। কাঁটা আর বিছুটির যন্ত্রণা সহ্য করে রাত ৮টায় আহার পর্ব শেষ হলো। শোয়ার পর গৌরবকে অনুরোধ করলাম গান শোনাবার। 

গৌরব দলের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করছে IOC তে। আমাদের সাথে এসেছে পাহাড়ের নেশায়। মাত্র ২৫ বছরের তরতাজা যুবক। সবার প্রিয়।



সপ্তম দিন/ ২রা জুন 

গতকাল রাতে গৌরবের গান আর ভিলাঙ্গানার কলকল জলোচ্ছ্বাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল সেই ভিলাঙ্গানার গর্জনে। গতকালের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ৭-৩০ টায় হাঁটা শুরু করার কথা, রাতে বৃষ্টির কারণে ভিজে টেন্ট শুকিয়ে শুরু করলাম ৮ টা ২০ মিনিট। আজ দীর্ঘ ১৩ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হবে তাম্বাকুণ্ড।

জয় কেদারনাথ ধ্বনি - দিয়ে দ্রুত পায়ে শুরু করলাম। সামান্য চড়াই ভেঙে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। প্রায় তিন হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। বনভূমির নীচে প্রায় ছয় ইঞ্চি শুকনো পাতার আস্তরণ। সহজেই অনুমেয় আগুন লাগলে কী হতে পারে। পাতার কারণে পথের চিহ্ন প্রায় নেই, গাইডকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলি। বারংবার গাইডকে প্রশ্ন, খারসোলি আর কতদূর? 

অবশেষে ১১ টা ৩০ মিনিটে পৌঁছলাম খারসোলিতে। খারসোলি ঝোরা পেরিয়ে অপর পারে যেতে হবে! যথেষ্ট খরস্রোতা। রাজেশ - wait কর !! ...বলতে বলতেই জুতো পরা পা ভিজিয়ে উল্টাতে উল্টাতে ওপারে পৌঁছাল। বাকিরা গাইড ও কুলির সাহায্য নিয়ে জুতো খুলে খারসোলি ঝোরা পেরিয়ে এলাম খারসোলি বুগিয়ালে। কীর্তনের বয়ে আনা খাবারে দুপুরের খাওয়া সারলাম। ১২ টা ১৫ মিনিটে হাঁটা শুরু করলাম তাম্বাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে।

ধ্বসে যাওয়া পথ ও চড়াই আমাদের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। অনেক পথ এখনও বাকি। পাহাড়ের উপর কালো মেঘের চোখ রাঙানি। পৌঁছে গেলাম সুন্দর একটা বুগিয়ালে। গাইড নাম বলতে পারল না, ম্যাপে বলছে ভূমিকা। অসংখ্য ভেড়া ও ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বুগিয়াল ছেড়ে এগিয়ে চললাম, এমন সময় দূর থেকে শিস্ দিয়ে গাইড দাঁড়াতে বলল। বলল মাটন পাওয়া যাবে, কম দামে পাওয়া যাবে।

সবার মুখ দেখে মনে হলো এ সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। অগত্যা ব্যক্তিগতভাবে নিমরাজি থাকলেও সবার জন্য 2000 টাকা দিয়ে 13 কেজি মাংস কেনা হলো। সবাই খুব খুশি। এদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছে। বলতে বলতেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি এসে গেল। ভয় ও উৎকন্ঠায় মন ভরে গেল। খাঁড়া সরু বৃষ্টি-সিক্ত পথে বাকী রাস্তা হাঁটা বিপজ্জনক, তাঁবু রেডি করা আরও মুশকিল। গাইডকে নিকটবর্তী বুগিয়াল ভেলবাগীতে থামার পরামর্শ দিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম । 

বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চলেছি। ৩টা ১৫ মিনিটে পৌঁছলাম ভেলবাগী। টেন্ট রেডি, আকাশ পরিষ্কার। কি অপূর্ব জায়গা, কোনও আফসোস হচ্ছে না এগিয়ে যেতে না পারার জন্য। ২০০ ফিট নীচে প্রবল গতির ভিলাঙ্গানা। অপর পারে পাহাড় থেকে নেমে আসা উচ্ছ্বল ঝরনা। প্রায় ৫০০ ফিট উপর থেকে ধাপে ধাপে লাফিয়ে নামছে।

"ভালু, ভালু"- গাইডের প্রবল চিৎকারে তাকিয়ে দেখি ঝরনার পাশ দিয়ে বিশাল আকারের একটি ভল্লুক অবলীলায় খাড়া পাহাড়ে চড়ছে। দ্রুত গতিতে ক্যামেরা বন্দী করলাম। ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই ভেলবাগীতে আমাদের আটকে রাখার জন্য। ভাল্লুক চিড়িয়াখানাতে দেখেছি, প্রকৃতির কোলে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

ঝরনাকে পেছনে রেখে রঙিন টেন্টর পাশে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছে সুনীত। কাল বলেছিলাম -"তুই আজ আমার সাথে হাঁটবি। মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। কয়েক ঘন্টা পর আর দেখতে পাইনি। সন্ধ্যায় জিজ্ঞেস করাতে বলল -তোমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেও পারলাম না, তোমার দুই স্টেপ আমার তিন স্টেপের সমান।

সুনীত ইতিহাসের শিক্ষক, দলের সবচেয়ে নির্ভরশীল ট্রেকার। দলের পিছিয়ে পড়া ট্রেকারদের গন্তব্য স্থলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করে। দলের সদস্যরা "শেরপা" নামে ডাকে। ছোট্ট চেহারার মানুষটির নানা ধরনের খাবারে এলার্জি থাকা সত্ত্বেও নির্বিকার মুখে যা পায় তাই খায়।



অষ্টম দিন/ ৩রা জুন 

আজ ভাল্লুকের রাজ্য ভেলবাগী থেকে ৪টা ২০ মিনিটে যাত্রা শুরু করলাম তাম্বাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। ১০২০০ ফিট উচ্চতা থেকে খাড়া পথ বেয়ে ২ ঘন্টায় ১১০০০ ফিট উচ্চতায় তাম্বাকুণ্ডে এসে পৌঁছলাম। অরণ্যসঙ্কুল ও খাড়া পাথুরে এই পথ গতকাল অতিক্রম করতে হলে শেষ বিকেলে অশেষ কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো। তাম্বাকুণ্ডে তাঁবু ফেলার জায়গাও সমীত, পাথরের এক অভারহ্যাংয়ের কাছে রান্না করার জায়গাটা চমৎকার। বৃক্ষরাজির সংখ্যা ক্রমশ বিলীয়মান, উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছের দৈহিক আকৃতি ক্রমাগত খর্ব হয়ে চলেছে।

সাময়িক বিরতি নিয়ে এগিয়ে চললাম চৌকির উদ্দেশ্যে। কাঁটা ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে চলি। নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাই। এবার নীচে নেমে ভিলাঙ্গানা অতিক্রম করে অপর পারে যেতে হবে, গাইড দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমে গেল স্নো ব্রিজের কাছে। কিছু সময় পরে দ্রুত পায়ে গাইড উপরে উঠে এল। কী ব্যাপার? হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে বলল -"সাব লকড়ি কা ব্রীজ ব্যাহে গ্যেয়া, আগে সে চলনা পড়েগা"

সবার মুখ শুকিয়ে গেল। প্রায় চার কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত চলতে হবে। চড়াই ভেঙে চলেছি আর চলেছি। গাইডের ইশারায় নীচে দেখলাম কাঠের ব্রিজ। পথ নেই, ৭০ ডিগ্রি ঢালে ঝুরো পাথরের মধ্যে পিঠে ১৫ কেজি ওজনের বোঝা নিয়ে একবার পিছলে গেলে!! সাবধানে ছোট ছোট গাছগুলোকে আশ্রয় করে নড়বড়ে পায়ে সবাই নীচে নেমে এলাম। গাইড ও কুলিরা রোপ ফিক্সড করে বসে আছে। রুদ্রমূর্তির ভিলাঙ্গানার উপর দুটো সরু গাছ ফেলা আছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা তীব্র গতির ভিলাঙ্গানা। কোমরে ডিসেন্ডার বেঁধে একে একে সবাই পেরিয়ে এলাম।

এসে গিয়েছি ফুলের রাজ্যে, ছোট ছোট গাছে জুনিপার, রোডোড্রেনড্রন ফুল ফুটে রয়েছে। শরীরটাকে কোনওক্রমে বয়ে নিয়ে চলেছি, আর একটু। এসে পড়লাম দ্বিতীয় নদী দুধগঙ্গার কাছে। জলের পরিমাণ ও তোড় দেখে গাইড বলল এখন নদী পেরনো সম্ভব নয়। দুর্বার গতিতে বহমান দুধগঙ্গা। এপারেই কোনও স্থানে ক্যাম্পিং করতে হবে। আরও এক ঘন্টার প্রচেষ্টায় চৌকির উল্টোদিকে পাতা হলো তাঁবু।

ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গাটি, চারিদিকে সুবিশাল, তীক্ষ্ণ ঢালযুক্ত পর্বতগুলির মাঝে ছোট একটু জায়গা। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে এই চৌকি।

চৌকির একদিক থেকে বয়ে আসা ভিলাঙ্গানা, অন্যপাশে দুধবামক হিমবাহ থেকে নেমে আসা উচ্ছ্বল দুধগঙ্গা। সামনে বাঁ দিকে(উত্তরে) দেখা যাচ্ছে খাটলিং হিমবাহ। থলাইসাগর ও ফাটিং পিতয়ার শৃঙ্গ। আমাদের যাত্রার সমাপ্তি ঘটলো বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে।

ক্লান্ত শরীরে অপেক্ষা রাতের খাবারের। হঠাৎ স্বরূপের চিৎকার - "তোমরা বাইরে এসো"!! আমরা ধড়মড়িয়ে বাইরে এলাম। দেখলাম একটা জন্তু দৌড়ে পালাচ্ছে। টর্চের আলোতে চোখ জ্বলজ্বল করছে, গাইড ও কুলিরা সবাই দৌড়ে এলো। কী ছিল জন্তুটা? প্রশ্ন করতে উত্তর মিলল -"লমড়ি সাব"।

চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করকে কোয়োটরা ঘিরে ধরে ছিল।

খাবারের লোভে এরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে পারে, টর্চের আলোতে এদের জলন্ত চোখ ভয়ের সৃষ্টি করেছে। একটা নয় একাধিক লমড়ি দেখা যাচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত অবশ্য বড়ো আকারে শিয়াল। যাই হোক, সবাইকে সাবধানে থাকতে বলে রাতে তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হলো। এই পাথর -বরফের রাজ্যেও বন্য প্রাণী???? 



নবম দিন/ ৪ঠা জুন

আজ আমাদের বিশ্রামের দিন ছিল। উচ্চতার সাথে শরীর খাপ খাইয়ে নেওয়া খুব জরুরী। পরবর্তী রাস্তার দূরত্ব ও উচ্চতার কথা ভেবে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলের ঢেকে থাকা তুষারমৌলি শৃঙ্গ এখন দৃশ্যমান। গাইডের তাড়া সত্ত্বেও আমরা ৪ টা ৪৫ মিনিটের আগে যাত্রা শুরু করতে পারলাম না। শুরুতেই প্রবল গতির বহমান দুধগঙ্গাকে দড়ির সাহায্য নিয়ে পেরিয়ে এলাম। সকালে নদীতে জলের পরিমাণ ও তোড় দুটোই তুলনামূলক কম থাকে। বরফ গলা জলে হাঁটুর উপর পর্যন্ত অসাড় হয়ে গেল। পিঠে বোঝা নিয়ে সিঁড়ি মতো পথ বেয়ে চলেছি। যত উঠছি শৃঙ্গগুলি ততই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। পথের ক্লান্তি ঘুচিয়ে দিচ্ছে অনুপম প্রকৃতি। গাইড রঘুবীর বলল কয়েক দিন আগে যোগীন -১ শৃঙ্গ জয় করে এসেছে বাঙ্গালী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যোগীন-১, একটু পেছনে যোগীন -৩। আরও পেছনে থলাইসাগর।

সবাই ধীর গতিতে পৌঁছলাম আজকের গন্তব্য কুণ্ডলী বা ছোট মশারতালে। উচ্চতা ১৪০০০ ফিট। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পাশে ঝরনার জল পেয়ে সবার ভালো করে স্নান করার ইচ্ছে হলো। সবাই দৌড়ে গেলেও বরফ গলা জলের উষ্ণতা সবার ইচ্ছে শুষে নিল।



দশম দিন/ ৫ই জুন 

আজ আমাদের গন্তব্য মশারতাল। সকাল ৪টা ৩০ মিনিটে সব্জি ও রুটি খেয়ে- জয় বাবা কেদারনাথ- ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে পড়লাম। এক টানা চড়াই ভেঙে যত উপরে উঠছি সামনের শৃঙ্গগুলি আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। একই ছবি বারবার ক্যামেরা বন্দী করছি। থলাইসাগর আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেল। এই থলাইসাগর শৃঙ্গ জয় করে রাতারাতি প্রচারের আলোয় এসে ছিল ছন্দা গায়েন। যোগীন শৃঙ্গগুলি যেন আরও বেশী করে অহংকার প্রকাশ করছে। এবার গঙ্গোত্রী শৃঙ্গগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাওনলি শৃঙ্গকে বিপুল মনে হচ্ছে। বাম দিকের খাড়া ঢালে ঝুলে রয়েছে দুধগঙ্গার জন্মদাতা দূধগঙ্গা বামক হিমবাহ।

"পাকড়াও, পাকড়ো"- হঠাৎ তাকিয়ে দেখি মুকেশ ও রতন সিং খাড়া ঢালে তীব্র গতিতে একটা পাখির পেছনে ছুটে চলেছে। পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে ক্রমাগত উপরে চড়ছে, পেছনে লাঠি ও পাথর হাতে দুজন বিপজ্জনক ভাবে দৌড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে দুটি বানর পাহাড়ে লাফিয়ে চড়ছে। পাখি তাড়া খেয়ে খাড়া ঢালে নেমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে এল। ফেজান্ট জাতীয় পাখি হবে। 

আমরা মশারতালের কাছাকাছি জায়গায় তাঁবু খাটালাম। সময় ১২ টা ১০ মিনিট। পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ পেলাম না আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। শুরু হলো প্রবল তুষারপাত, সঙ্গী ঝোড়া হাওয়া। দমকা হাওয়ায় তাঁবু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ভেতরে চারজন তাঁবুর রড ধরে বসে আছি, তুষারভারে তাঁবু ঝুলে পড়েছে। ভেতর থেকে আইস্ এক্স দিয়ে বরফ ফেলার চেষ্টা করছি। ভয় হচ্ছে টেন্ট না উড়িয়ে নিয়ে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করছি থেমে যাক এই তুষারঝড়। অবশেষে ৫ টা ৪০ মিনিট নাগাদ ঝড় থামলো। প্রবল ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিই, প্রার্থনা করতে লাগলাম আগামীকালের আবহাওয়া যেন ভালো থাকে। কাল আবহাওয়া ভালো থাকা খুব জরুরী। বিপজ্জনক ১৭০০০ ফিটের বেশি উচ্চতার খাড়া গিরিবর্ত অতিক্রম করতে হবে। সকাল ৬টার মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। তারও আগে ৫ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মশারতালে পুজো দিতে যেতে হবে। ঠিক হলো প্রাতরাশের পূর্বে আমি আর আর স্বরূপ রঘুবীরের সাথে যাব। কীর্তন জানালো ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে চা দেবে।



একাদশ দিন/ ৬ই জুন 

"চায়ে, চায়ে, বিধানজী উঠিয়ে"- কীর্তনের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল। টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখলাম ঠিক ৪ টা ৩০ মিনিট। ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে শরীর বেরতে চাইছে না। মনের ক্লান্তি দূর করে উঠে বসলাম । সারা রাত্রি চাপা টেনশন, উচ্চতা জনিত কারণে ভালো ঘুম হয়নি। আকাশ একদম পরিষ্কার। চটপট প্রস্তুত হয়ে স্বরূপকে সঙ্গে নিয়ে রঘুবীরের সঙ্গী হলাম। মাত্র ১৫ মিনিটের পথ, অক্সিজেনের অভাবে হাঁপিয়ে উঠছি। বরফ ও বোল্ডার পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম অনিন্দ্য সুন্দর লেক "মশারতালে"। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ের মাঝে অর্ধেক জমে থাকা চক্ষু আকৃতির লেকটি। রঘুবীর ভক্তি ভরে পূজো করে চলেছে আর আমারা ছবি তোলাতে ব্যস্ত। রঘুবীরের মৃদু ধমকে প্রার্থনায় বসলাম। পুজো সাঙ্গ করে ফিরে এলাম। প্রাতরাশ সেরে ৬ টা ১৫ মিনিটে শুরু হলো যাত্রা। মশারতাল থেকে ১০০০ ফিট উচ্চতা খাড়া পৌঁছে গেছে মাশার টপে। রঘুবীরের কেটে দেওয়া বরফের স্টেপে সাবধানে পা ফেলে উঠে চলেছি। বারংবার পিছলে যাচ্ছে পা, দু ঘন্টার কষ্টসাধ্য চেষ্টায় পৌঁছে গেলাম মাশার টপে। উচ্চতা ১৬০০০ ফিটের বেশি। চারিদিকে অগুন্তি তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি। বিশ্রাম ও ফোটো সেশনের পর এগিয়ে চললাম অভীষ্ট মাওয়ালি গিরিবর্তের দিকে।

গতকাল রঘুবীর রাওয়াতকে সঙ্গে নিয়ে প্রবল তুষারপাত উপেক্ষা করে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতে বেরিয়ে ছিল। ফিরতে পারেনি, পাথরের আড়ালে থেকে তুষারঝড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে। যত দূর চোখ যায় শুধুই বরফের হাতছানি। চলতে চলতে রঘুবীর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো গভীর খাদের কিনারে। আমি পা চালিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম -"কোই তকলিফ্"? রঘুবীর যা বলল, শেষ বার যে রাস্তায় এসেছিল সেই রাস্তায় অসংখ্য ফাটল অর্থাৎ ক্রিভাসপূর্ণ। অতয়েব বিকল্প পথের অনুসন্ধান। খাড়া ধ্বংস যুক্ত পাথুরে ঢাল ধরে এগিয়ে চলার নির্দেশ দিল। এই ভাবে এক ঘন্টার প্রচেষ্টায় পৌঁছে গেলাম মাওয়ালির পাদদেশে। কচ্ছপের পিঠের অংশ পেরিয়ে শুরু হবে মাওয়ালি গিরিপথের খাড়া চড়াই।

একে একে পায়ে পরে নিলাম গেইটার। রঘুবীর, কীর্তন, রাওয়াত দ্রুততার সাথে সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বেঁধে নিল। ১৫০ ফিটের দড়িতে প্রথমে রঘুবীর এবং শেষ কীর্তন। মাঝে আমরা। প্রাথমিক পরামর্শ দিয়ে শুরু হলো দড়ি বাঁধা অবস্থায় হাঁটা। ২০-২৫ পা হাঁটছি আবার দাঁড়িয়ে পড়ছি।

হঠাৎ করে চারিদিক সাদা মেঘে ঢেকে গেল। একে বলে White Out। ১৫ ফিট দূরের সুনীতকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ দেখে পা মেলাচ্ছি। আগে তবুও অনুমান করতে পারছিলাম কতদূর এসেছি!! পায়ের নিচে মৃত্যু ফাঁদ, ক্রিভাস। প্রকৃতি বিরূপ, ভয়ঙ্কর তুষারপাতের আশঙ্কা। প্রাণপণে হেঁটেই চলেছি। দুর্বল, ধীর গতির সমীরণদাও চলেছে নিরলসভাবে। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব, জল খেতে অবধি পারছি না। হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে চাইছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। রঘুবীর বলে চলেছে--"থোড়াসা বাকি, চলিয়ে চলিয়ে, রুকিয়ে গা মত্"। মনের সমস্ত বল, জেদ এক করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত "মাওয়ালি গিরিবর্তে।"

সবাই আনন্দে আত্মহারা, আনন্দাশ্রু চোখে দিয়ে বয়ে চলেছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুরু হলো শুভেচ্ছা বিনিময়। আকাশ পরিষ্কার। রঘুবীর শুরু করল পুজো। পুজোর প্রসাদ ও চকলেট খেয়ে উদযাপন করলাম আমাদের সাফল্য। স্মৃতি হিসাবে ক্যামেরা বন্দী হলো অসংখ্য ছবি।



দ্বাদশ দিন/ ৭ই জুন 

গতকাল পাস অতিক্রম করার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। গাইড রাঘুবীরের তাড়ায় ১১ টা ৩০ মিনিট নাগাদ হাঁটতে শুরু করি। প্রথম ঘণ্টায় পিচ্ছিল বরফে আছাড় খেতে খেতে পৌঁছে গিয়েছিলাম পুঁইয়াতালে। ছোটো একটা সরোবর। বরফের রাজ্য শেষে শুরু হয়েছিল বোল্ডারের রাজত্ব, সঙ্গে হাঁটু ভাঙ্গা উৎরাই। দীর্ঘ এবড়ো খেবড়ো পথ আর পরিশ্রান্ত শরীর টানতে টানতে ৩ টা ২০ মিনিট অর্থাৎ সাড়ে ৯ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হয়েছিল বাসুকিতালের ৩০০ মিটার আগে।

আজ আমাদের ট্রেকিং এর শেষ দিন, যদিও কেদারনাথ থেকে ১৬ কিমি হেঁটেই ফিরতে হবে। প্রচলিত বাঁধানো পথ বলে আমাদের কাছে গুরুত্ব কম। সকাল থেকেই নানা ভাবনা মনের মধ্যে ভীড় করছে। অনেক দিন হয়ে গেল বাড়ির সাথে যোগাযোগ হয়নি। কেদারনাথ এ মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। কেমন দেখতে হয়েছে বর্তমান কেদারনাথ?? আজকের আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ভালো নয়। গতকাল রাতের তুষারপাতের কারণে তাঁবু এখনও ভিজে, অপেক্ষা সূর্যের আলোর। মেঘলা আকাশে সূর্যের খোঁজ না করে ভেজা তাঁবু গুঁটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বাসুকিতালে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল। বেশ বড়ো লেকটি। শিবের ত্রিশূল আর নুড়ি-পাথরে সিঁদুরের ছোপ দেখে বুঝলাম, এখানেও মহাদেবর আরাধনা হয়। মালবাহকদের কাছে জানতে পারলাম, কিছু উৎসাহী পুণ্যলোভী মানুষ কেদারনাথ থেকে এখানে আসে পুজো দিতে। অবশ্যই এই সময় নয়। সরোবর প্রান্ত থেকে একটি পথ সোজা উঠে গেছে বাসুকি টপের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বাঁধানো পথ হারিয়ে গেল বরফ তলায়। সঙ্গে সংযোজিত হলো ঝিরিঝিরি তুষারপাত। এ পথের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যপট রয়েছে এই বাসুকি টপে।এই অঞ্চলের সমস্ত শৃঙ্গরাজি পটে আঁকা ছবির মতোই দৃশ্যমান হয়। মেঘলা আকাশে কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না।

বরফের গভীরতা ও তুষারপাতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। ৯৫ কেজি ওজনের স্বরূপ সামনে চলেছে। দেহভারে কখনও কখনও কোমর পর্যন্ত বরফে ডুবে যাচ্ছে। রাগে, কষ্টে মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। ওর তৈরি করা চৌবাচ্চাগুলিতে সন্তর্পনে পা ফেলে এগিয়ে চলেছি। কীর্তনের সহযোগিতা ও তৎপরতায় ১১ টা ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম বাসুকি টপে। একে একে সবাই চলে এলো। ঝিরিঝিরি তুষারপাতের মধ্যে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু। ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম কেদার টপ এ। শৃঙ্গের মেলা দেখা যায় এখান থেকে- ভাতৃকুণ্ড, কীর্তিস্তম্ভ, কেদারনাথ, কেদারডোম, মহালয়া, চৌকাম্বা, প্রভৃতি। সারা পথের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এখান থেকেই মেলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রকৃতি বিরূপ।

ঘন্টা ধ্বনি না? মালবাহক বাহাদুর বলল, মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি। "থোড়া আগে চলিয়ে সাব, মন্দির দেখাই দেগা"। বুকের মধ্যে উত্তেজনা অনুভব করছি। ঘন্টার শব্দ ক্রমে বাড়ছে, বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। ১১ বছর বয়ে বেড়ানো অস্বস্তি আজ দূর করতেই হবে। ২০০৫ সালের মে মাস- দু বছরের শিশু পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলাম এই পবিত্র ভূমে। গৌরীকুণ্ড থেকে হাঁটা শুরু করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি হয়ে। কেমন আছে জমজমাট সেই কেদারনাথ? কেমন আছে ভারত সেবাশ্রম?

২০১৩ সালের ১৬ই জুন মন্দাকিনীর বুকে ভেসে যাওয়া কেদারনাথ কেমন আছে? সন্ধ্যাবেলা ভারত সেবাশ্রমের মহারাজকে প্রণাম করে বলেছিলাম- "কাল চোরাবালিতাল ট্রেক করতে যাব, স্থানীয় কোনও গাইড পাওয়া যাবে?" হাঁ হাঁ করে উঠে বারণ করেছিলেন-"রাস্তা ভাঙা, প্রচুর বরফ, বিপদজনক পথ। পরিবার নিয়ে এসেছ, এখানেই ঘুরে বেড়াও। কি দরকার ওখানে যাওয়ার?" নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে কয়েকটি জরুরী পরামর্শ দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন অহেতুক ঝুঁকি না নেওয়ার। গাইড না নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই মহারাজ হারিয়ে গেছেন মন্দাকিনীর প্লাবনে। স্থানীয় ঘোড়াওলার সাহায্য নিয়ে ৩.৫ কিমি দূরের স্বর্গীয় স্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অপরূপ হিমবাহ সৃষ্ট লেক চোরাবালিতাল। গান্ধীর চিতা ভস্ম বিসর্জন দেওয়ার পর থেকে এটি গান্ধী সরোবর নামে পরিচিত হয়েছে। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর পাথরের প্লাবন নেমে এসেছিল কেদারনাথ এর বুকে। সরকারি হিসাবে প্রাণ গিয়েছিল ৬০০০ মানুষের, আহতের সংখ্যা অগুনিত। বেসরকারি মতে সংখ্যা অনেক বেশি। প্রকৃতির রুদ্ররোষ শশ্মান করে দিয়েছিল কেদারধাম। অষ্টম শতাব্দীতে দুর্গম কেদার উপত্যকায় শঙ্করাচার্যের তৈরী স্বয়ংম্ভূ মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে। শৈব শক্তি অক্ষত রেখেছে মন্দিরকে।

"বিধানদা দেখ মন্দির !" সুনীতের ডাকে ঘোর কেটে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘের আড়াল সরে গিয়ে কেদারনাথ উন্মুক্ত। হাঁটার গতি আরও বেড়ে গেল। খাড়া ঢালে নেমে গেছে পথ। টেলিক্যামেরায় চোখ দিয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এত পাথরের স্তূপ!! প্রবল স্রোতস্বিনী মন্দাকিনী আজ ক্ষীণ তটিনী। দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে মন্দিরের পাশ দিয়ে বহমান। মন্দিরের পেছনের অংশ আজ বোল্ডার ভূমিতে পরিণত। আবার ঢেকে দিলো মেঘ। ৪০০০ মিটার উঁচু কেদারটপ থেকে ক্রমাগত নেমেই চলেছি। হাঁটুর ব্যাথাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি। ধসের কারণে মাঝে মাঝেই রাস্তা অদৃশ্য, টিপটিপ বৃষ্টি পিছল রাস্তায় গতি কমিয়ে দিচ্ছে। বারে বারে মনে হচ্ছে আর একটু নামলেই পৌঁছে যাব কেদারনাথ এ। দুধগঙ্গা, মধুগঙ্গা, স্বর্গ দুয়ারী, সরস্বতী, প্রভৃতি নদীর মিলনে মন্দাকিনীর সৃষ্টি। কত যে ঝরনা নেমে এসেছে মন্দাকিনীর বুকে তার হিসেব নেই। সাদা অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, হাতড়ে বেড়াচ্ছি পথ। ডানদিকের ঝোরা পেরিয়ে নেমে এলাম মন্দাকিনীর ডান তীরে। কিন্তু ওপারে যাব কি ভাবে?? ব্রীজ নেই, পাথর ডিঙ্গিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কয়েকটি বাড়ি দেখে এগিয়ে গেল স্বরূপ। পরপর বাড়িগুলিতে খোঁজ করে কারও দেখা পেলাম না। মনে হয় ’১৩ সালের পর থেকেই পরিত্যক্ত।

তাহলে উপায়!!! ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছি যদি কারও দেখা মেলে! গাইড ও পোর্টার ছাড়াই এগিয়ে আসার ফল। দূরে অপর পাড়ে নদীর কিনারে আসা এক ব্যক্তিকে দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম কোন পথে যাব ওপারে। দূরত্ব আর নদীর জলের শব্দে শুনতে পেলনা বোধহয়। ইঙ্গিতে বোঝালাম কি চাইছি। সামনের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে এগিয়ে যেতে বলল। ১.৫ কিমি হেঁটে পৌঁছে গেলাম ভাঙা ব্রিজের কাছে। সাবধানে ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কেদারধাম এ। দুই দিক থেকে বয়ে আসা মন্দাকিনীর উপর তৈরি হয়েছে সরস্বতী ব্রিজ। নীচে হরিদ্বারের মতো বাঁধানো ঘাটে পুণ্যার্থীরা মাথায় জল দিচ্ছে। ব্রিজের অপর পারে গড়বাল মণ্ডল বিকাশ নিগম তৈরি করেছে আধুনিক কটেজ, অসংখ্য অস্থায়ী সুইস টেন্ট। মাথাপিছু ২৫০ টাকার বিনিময়ে ঠাঁই হলো অস্থায়ী সুইস টেন্টে। আধুনিক বন্দোবস্তর জন্য টেন্টগুলি বেশ ভালো। কাকভেজা হয়ে একে একে সবাই পৌঁছে গেল। কেদার টপ থেকে আসতে সময় লাগল ৩ ঘন্টা। পেটের ভেতর ছুঁচোর ডন বৈঠক শুরু হয়ে গেছে। খেতে এলাম গড়বাল মণ্ডল বিকাশ নিগম এর ভোজনালয়ে। পরিচ্ছন্ন ভোজনালয় বেশ বড়ো, এখন প্রায় ফাঁকা।

বাড়িতে ফোন করলাম, জানালাম কেদারনাথ এ পৌঁছে গেছি, সবাই ভালো আছে। পরিবারের কাতর অনুনয় -"ওখানে না থাকাই ভালো। বড়ো বিপদের জায়গা"। আশ্বস্ত করলাম ভয়ের কিছু নেই। মন্দির বড়ো টানছে, আজই সাঙ্গ করব ১১ বছরের গ্লানি। ২০০৫ সালে এসেছিলাম কেদারনাথ এ, আশ্রয় নিয়েছিলাম মন্দাকিনীর তীরে ভারত সেবাশ্রমে। সকালে মন্দির দর্শনে গিয়ে কয়েক হাজার মানুষের দীর্ঘ লাইন শিব দর্শনের ইচ্ছেকে নিভিয়ে দিয়েছিল। পুণ্য অর্জনের জন্য ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়নি। ছোট ছেলে নিয়ে এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এত কষ্ট করে এসেও সে বারে দ্বাদশ জ্যোতির্ময় লিঙ্গ দর্শন হয়নি।

স্বরূপ ও আমি পোশাক বদলে মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। গুটি গুটি পায়ে মন্দির পৌঁছনোর পূর্বেই পুলিশের হাত থামিয়ে দিল আমাদের। পরিচয় পত্র চেকিং হচ্ছে। বর্তমানে চারধাম যাত্রীদের জন্য বায়োমেট্রিক পরিচয় পত্র আবশ্যিক হয়েছে। কী হবে আমাদের? পুলিশ কর্তাকে বললাম, আমরা মাওয়ালি পাস ট্রেকিং করে কেদারনাথ এ এসেছি। বন দপ্তরের অনুমতি পত্র রয়েছে। হাসি মুখে ছেড়ে দিল। বাঁধানো পথের দুপাশে দুমড়ানো মোচড়ানো বাড়ি গুলির কঙ্কাল ২০১৩ স্মৃতি বহন করছে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিশাল বাড়িটির ভিতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে। প্লাবনের করাল গ্রাসে ভেসে গেছে বাকিটা।

পৌঁছে দেখলাম লোকজন বেশি নেই। পুজোর জন্য মন্দিরের গেট ২ ঘন্টা বন্ধ থাকবে। মন্দির কমিটির অফিসে সৌম্য দর্শন এক যুবা পাশের গেট দেখিয়ে বললো-"দর্শন করনা হ্যায়, অন্দর জাইয়ে, আভি পূজা চল রাহা হ্যায়।" অবিশ্বাসী মন কখনও কখনও কাকতলীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে না, চিরদিন গেঁথে থাকে মনের গভীরে। ত্রিকোনাকার গ্রানাইট পাথরের মূর্তি ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। এতদিনের বাসনা পূর্ণ হলো। মন্দির চত্ত্বরের মাঝে হোমাগ্নি ঘিরে কিছু ভক্ত ও সন্ন্যাসী ওম গ্রহণ করছে। ভীড়ে থিক থিক করত এই মন্দির চত্ত্বর, মানুষ শূন্য এখন।

সন্ন্যাসীদের আখড়া দেখার অভিপ্রায়ে মন্দিরের পেছনে গেলাম, কিছুই নেই কেবল বোল্ডারের রাজত্ব। শঙ্করাচার্যের সমাধি ক্ষেত্রেটিও অবশিষ্ট নেই। মন্দিরের পেছনে বিপুল আকৃতির একটি গণ্ডশিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দিরকে আড়াল করে। ভীমশিলা নামের বোল্ডারটি মন্দিরকে রোষের হাত রক্ষা করেছে। বর্তমান এই শিলা পূজিত হয়। কথিত আছে, পাণ্ডবরা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন, সংস্কার করেন শঙ্করাচার্য। দেবাদিদেবের ধ্যানের উপযুক্ত স্থান বটে। হিমালয়ের নিভৃত কোলে সাধুদের উপাসনার স্থলের বড় অভাব।

মেঘের পর্দা সরিয়ে বিকালের অন্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে কেদার চূড়ায়। মেঘ আর আলোর খেলায় মোহময় হয়ে উঠেছে চারিদিক। হায় রে আধুনিক সভ্যতা!! কয়েক মিনিটও থাকতে দেবে না নিজের মতো করে, অনুভব করতে দেবে না ভালো লাগাকে। বিকট শব্দ দানব, ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে কেদারনাথ এর শান্ত পরিবেশ। উফঃ, উফঃ, কী অসহনীয় এই শব্দ!! উত্তরাখণ্ড সরকার কেন ব্যবস্থা করেছে এই উড়ানের?? ৩ কিমি আগে শেষ করলে হয় না!! এতক্ষণের ভালোলাগার অনুভূতিগুলি বিরক্তিতে বদলে যাচ্ছে। সরকার কেদার যাত্রীদের সুবিধার্থে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু করেছে। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর উড়ানের শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে। সঙ্গে কেদার পুনর্গঠন এর কাজে ব্যবহৃত গাইতি, কোদাল, স্টোন ক্রাশার ইঞ্জিনের শব্দ মিলে মিশে ভয়াবহ অবস্থা। তোমরা সবাই একটু চুপ করবে??? আশুতোষ ধ্যান করবেন। জাগিয়ে দিও না, জাগিয়ে দিও না, জেগে উঠলে শুরু করে দেবেন তাণ্ডব নৃত্য। ধ্বংস করে দেবেন সব কিছু।




2 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. পাহাড় তো অনেক বার দেখেছি... কিন্তু এত গভীর ভাবে তো আগে অনুভব করিনি... আজ আরো একবার পুরো লেখাটা পড়ে মন বলছে..... আমি যেন বসে আছি ওই কেদারের চূড়ার অন্তীম আভার সংলগ্ন কোন স্থানে... যেখানে মানুষ শুধুই ভালোবাসতে শিখেছে... সত্যি খুব ভালো হয়েছে লেখাটা...

    ReplyDelete