2

সম্পাদকীয়

Posted in




অতিথি সম্পাদকের কলম 



আরো একটি ওয়েব পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করল – ‘ঋতবাক’ । ‘আরো একটি পত্রিকা’ কথাটার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য ভাবও খুঁজে পেতে পারেন কেউ কেউ । অন্তর্জালের বাড়-বাড়ন্তের এই সময়ে ওয়েব পত্রিকার সংখ্যাও বড় কম নয় । বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রসারে মুদ্রিত ছোট পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনের অবদান কম নয়, আমরা জানি । ওয়েব পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিদ্বন্দী বা পরিপূরক কোনটিই নয়, কারণ, উভয়ের টার্গেট পাঠক ভিন্ন । কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন । একটি ওয়েব পত্রিকা আর একটির প্রতিদ্বন্দীও নয় নিশ্চিত ভাবেই। বরং বলা ভালো ‘শত পুষ্প বিকশিত হোক। 

ওয়েব দুনিয়ায় আমাদের চেনা ঘোরাফেরায় আমরা জানি,এই সময় অনেকগুলি ওয়েব পত্রিকা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে । ‘ঋতবাক’ তাদের সঙ্গে সামিল হ’ল । এখন অন্তর্জালের ‘ফেসবুক’ আমাদের পারস্পরিক ভাবনা বিনিময়ের প্রধানতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই সত্য থেকে আর মুখ ঘুরিয়ে থাকা যাচ্ছে না । বেশ কয়েকটি ‘ফেসবুক গ্রুপ’ তাদের ওয়েব পত্রিকা প্রকাশ করছে নিয়মিত, তৈরী করছে মননশীল পাঠক-মন্ডলী, উঠে আসছেন অনেক নবীন লেখক । তাঁরা সময়ের শব্দ শোনাচ্ছেন, এই সময়, সমাজের ছবি লিখছেন, এবং নিশ্চিতভাবেই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন । 

এবং একথাও সত্য যে, প্রকাশ করার চেয়ে পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখা, পাঠক-মন্ডলীর বিশ্বাস অর্জন করা আরো কঠিন । পাঠকের বিশ্বাস অর্জন করাটা অবশ্যই হয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে । এবং পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলির কনটেনট’এ জীবন-বোধের প্রকাশকে এই প্রক্রিয়ায় সংপৃক্ত করতে না পারলে সে পত্রিকা নিজস্ব কোন চরিত্র অর্জন করতে পারে না ‘আরো একটি পত্রিকা’ হয়েই থাকে অথবা থাকে না । আমি জেনেছি, ‘ঋতবাক’ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় নিরন্তর সংপৃক্ত থাকার অঙ্গীকার করেছে । 

স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে সাতটা দশক পেরিয়ে এলাম। প্রতিটি দশকেরই বিশেষ যুগলক্ষণ থাকতে পারে, থাকেও । সবগুলিই শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব হয়তো ফেলেনা । কারণ সমাজ বন্দোবস্তের বা সেই সমাজের মানুষের‘বোধ’এর তেমন কোন হেরফের হয়না । ধরা যাক মধ্য আশি থেকে এই দুহাজার দশ – বিশ্বায়ন পরবর্তী এই চার দশকে বাঙালির সমাজ বন্দোবস্তে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন এসেছে কি ? কিংবা তার সৃজনশীলতাকে একটা নতুন বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে,খুঁজে পেয়েছে আমাদের নাড়া দেওয়ার মত কোন উপাদান ? না আসেনি। প্রবল ভাবে এসেছে এক শূণ্যতা বোধ । এই সময়ের সাহিত্য সংস্কৃতিতে তাই শুধুই শূণ্যতা বোধ, শুধুই মধ্যবিত্ত মানুষের আত্মযুদ্ধ । সাহিত্য-নাটক –গান বা বুদ্ধির চর্চায় এই চারটি দশক আগামী প্রজন্মের কাছে গর্ব করার মত কোন উপাদান দেয়নি। ‘এই সময়’ অতএব শূন্যতাবোধের সময়, অন্তত আমার উপলব্ধিতে । হয়তো আরো অনেকের কাছে । 

‘ঋতবাক’সেই শূন্যতা বোধ থেকে ছিটকে বেরোনোর কথা ধরে রাখবে তার শরীরে এটাই কাম্য । এটাই এই সময়ের প্রার্থিত সত্য । আর ‘ঋতবাক’ মানে সত্যকথন । সময়ের সত্যকথনে সে অঙ্গীকারবদ্ধ, তার শরীরে জীবনবোধের প্রতিভাস থাকবে, এই বিশ্বাস রাখা যেতে পারে । 

‘ঋতবাক’এর প্রথম সংখ্যাটিতেই আমাকে অতিথি সম্পাদকীয় লেখার গৌরব প্রদান করেছেন এর পরিচালক মণ্ডলী । তাঁদের পথচলায় অনেকের সঙ্গে আমারও শুভেচ্ছা থাকলো । ‘অলমিতি শুভায় ভবতু’ । 



ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

2 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ: শ্রীশুভ্র

Posted in




প্রচ্ছদ নিবন্ধ 



মুখের আড়ালে মুখ – ফেসবুক 
শ্রীশুভ্র 


আমাদের নবতম ঠিকানা নাকি ফেসবুক! বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ! কিন্তু এইটি অর্থাৎ এই ফেসবুক নিত্যদিনের পার্বণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্প্রতি, তাও সে প্রায় এক দশক হয়ে এল। যখনি একটুখানি অবসর, তখনি মন উড়ু উড়ু! ঘুর ঘুর করে ফেসবুকের লগইন পাতায়। মার্ক জুকেরবার্গ! বাঙালির জন্যে এক আশ্চর্য রোমান্টিক রংমহল খুলে দিয়েছেন। এবং এই একটি ঠিকানা, যেখানে এসে মিলেছে সব বয়সের, সব ধর্মের মানুষ। জুকেরবার্গের এই ফেসবুক সারা পৃথিবীতেই আলোড়ণ ফেলে দিলেও বাঙালির জন্যে ফেসবুক ভিন্নতরো একটি মাত্রা যোগ করেছে, স্বভাব অলস বাঙালির আলস্যচর্চার এবং পরনিন্দা পরচর্চা প্রিয় বাঙালির জন্যে এ এক সত্যিই জুকেরবার্গের আশ্চর্য প্রদীপ! 

এক সময় বিশ্বনিন্দুকদের প্রচারিত বোকাবাক্স বাঙালিকে যত না ঘরকুনো করে তুলেছিল, জুকেরবার্গের ফেসবুক তাদের তার থেকেও বেশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক করে তুলেছে। তথাকথিত বোকাবক্সের যতই দুর্নাম রটুক, বাড়িতে পরিবারের সবাইকে সারাদিনে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও একত্র করে ধরে রাখতে বোকাবাক্সের কোনো জুড়ি নাই। কিন্তু ফেসবুক সবার আগে বাদ সেধেছে সেইখানেই! পরিবারের সকলকেই পরস্পর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে তার এই আশ্চর্য রঙমহলের জাদুর সম্মোহনী মায়ায়! সমালোচকরা বলবেন তা কেন? ফেসবুক মানুষের মিলনতীর্থ! শুধু কি তাই? তাঁদের মতে, শ্রেণীবৈষম্যের এই সমাজে ফেসবুকই পারে বিভেদের অসংখ্য প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে মানুষের সাথে মানুষের সহজ সুন্দর সংযোগের প্রশস্ত রাজপথটা খুলে দিতে। তা পারে। হয়তো পারবেও একদিন। বস্তুত ফেসবুকের অনন্ত সম্ভাবনার মধ্যে এইটিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু সে সুদূরপরাহত সম্ভাবনা! ততদিনে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যাবে সন্দহ নাই। কিন্তু এই বঙ্গে ফেসবুকরঙ্গ যে জমে উঠেছে সে ব্যাপারে কোনোই বিতর্ক থাকতে পারে না। আর তার বড়ো কারণ ফেসবুক বাঙালিকে দিয়েছে অনন্ত স্বাধীনতা! 

সামাজিক নানান বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ বাঙালি সমাজ প্রযুক্তিবিজ্ঞানের এই নবতম আবিস্কারের হাত ধরে মুক্তির এক দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে যে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বিশেষত আমাদের সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুস্থ পরিসরের অভাবটা অনেকটাই দূর হয়েছে এই ফেসবুকের দৌলতেই। বিরূদ্ধ সমালোচকরা অবশ্য অবাধ মেলামেশার পরিণতি কতটা ক্ষতিকর, সেই বিষয়েই তর্ক জুড়ে দেবেন। যদিও তাদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না। কারণ, এই ফেসবুকের সূত্র ধরেই আমাদের সমাজে কিছু কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা শুরু হয়েছে। কিন্তু তার দায় কি প্রযুক্তিবিজ্ঞানের এই নবতম আবিস্কারের, না আমাদেরই সমাজদেহের দুষ্ট ক্ষতের, সে প্রশ্নের মীমাংসা কে করবে? বস্তুত ফেসবুক আজ পৃথিবী জুড়েই সমাজদর্পন হয়ে উঠেছে। আমাদের বঙ্গসমাজের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য। আমাদের ভালো, আমাদের মন্দ, আমাদের শক্তি, আমাদের দূর্বলতা, আমাদের সমৃদ্ধি, আমাদের সংকীর্ণতা সবই ফেসবুকের দর্পনে আজ স্পষ্ট প্রতিফলিত। আর এখানেই বাঙালির মুখের ছায়াপাতে ফেসবুককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে, আমাদের নৈতিকতাতেই টান পড়ে সবার আগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের খেয়াল থাকে না সেটা। 

আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাইনি আমরা কেউই, কিন্তু ফেসবুক পেয়ে গিয়েছি। পেয়ে গিয়েছি স্বপ্ন পূরণের জাদু কাঠি। পেয়ে গিয়েছি অবদমিত বাসনাগুলি প্রকাশের গুপ্ত সুরঙ্গ। পেয়ে গিয়েছি নিজেকে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মায়াবী আতসবাজী। পেয়ে গিয়েছি নিজের ঢাক নিজে বাজানোর জন্যে আস্ত একটা জয়ঢাক। আমাদের এই প্রাপ্তির তালিকা হয়ত একদিন চিত্রগুপ্তের খাতাতেও এঁটে উঠবে না, তাই ফেসবুকে মুখ দেখাতে আমাদের এত ব্যাকুলতা।

কিন্তু কোন মুখ? নিজেরই মুখ তো? নিজের আসল মুখ? নাকি সযত্নে গড়ে তোলা নিজেদের সামাজিক মুখ! যে মুখের আড়ালে আড়াল পড়ে যায়, আমারই আমিটুকু! সেই আড়ালের অবসরটুকু দিয়ে, আমরা গড়ে নিতে চাই আমাদের ভার্চ্যুয়াল সাম্রাজ্য। তাতেই তো আসল ক্যারিশমা! মানসিক তৃপ্তি। সমালোচকরা অবশ্যই একমত হবেন না কিছুতেই। সাধারণ ভাবে সকলের সম্বন্ধেই বলা যায় না একথা। হয়তো কখনো সখনো কেউ কেউ এভাবে ভাবতে চান। যাদের সংখ্যা হাতে গোনা। না তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা নয়, আমরা বলতে চাই তাঁরাই অধিকাংশ! এই যে নিজে হাতে গোড়ে তোলা নিজের সামাজিক মুখ, যে মুখের হাত ধরে আমরা পরিচিত হতে চাই এই ভার্চ্যুয়াল জগতে, সেই মুখের সাথে আমাদের নিজস্ব অবয়বের দূরত্ব কতটুকু, অনেক সময়ে খেয়াল থাকে না সেটাও। কিন্তু যখনই কোনো না কোনো স্বার্থে, কারুর না কারুর সাথে সংঘাত লাগে আমাদের, তখনই প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই দূরত্বের পরিমিতিটুকু। হয়ত আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। হয়ত সুচিন্তিত ভাবেই। কারণ এই ভার্চ্যুয়াল জগতের মূল সুবিধেটুকু হল, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গড়ে তোলার আমেজটুকু আছে ষোলআনা। কিন্তু সেই সম্পর্ক ধরে রাখার কর্তব্য বা দায়বদ্ধতা কোনাটাই নেই। 

এই যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার সাথে, তা সুস্থ সুন্দর ভাবে ধরে রাখার একটা নৈতিক দায়বদ্ধতা; যা আমাদের সমাজ সংসারে আমাদেরকে মেনে চলতেই হয়, ইচ্ছায হোক বা অনিচ্ছায়, ফেসবুকের এই ভার্চ্যুয়াল জগতে সেই দায়বদ্ধতা না থাকায়, কখন যে আমাদের সযত্নে গড়ে তোলা ভার্চ্যুয়াল মুখের আড়াল থেকে আমার গুপ্ত আমিটি বেড়িয়ে পরবে সে বিষয়ে আমাদের কোনোই মাথা ব্যাথা থাকে না। ফলে আজকের বন্ধু কালকেই ব্লকড। অনেকেই বলবেন, তা কেন, আমাদের সামাজিক জীবনেও তো হামেশাই এরকম ঘটে থাকে। শুধুতো ভার্চ্যুয়াল জগতেই নয়। ঘটে বইকি! কিন্তু তা এমন অহরহ ঘটে না। কারণ সামাজিক জীবনের দৈনন্দিন ওঠাবসায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে অনেকটাই ভালোভাবে জানার সুবাদে, চট করেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সম্পর্কের সুতো যতই আলগা হয়ে আসুক না কেন, তবু লৌকিকতাজনিত ভদ্রতাটুকু সকলকেই ধরে রাখতে হয়। সেটাই সামাজিক দায়বদ্ধতা। ঠিক যেটার অভাবেই ফেসবুকের গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলি অধিকাংশই এত ক্ষণস্থায়ী।

আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রায় মানুষের সাথে মেলামেশার গন্ডীটুকু বেশ সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফেসবুকের ভার্চ্যুয়াল জগতে সেই গন্ডীর সীমানা বিশ্বব্যাপি পরিব্যাপ্ত বলে, নতুন নতুন বন্ধু জোটানো অনেক সহজসাধ্য। ফলে যতজন বন্ধুই হাতছাড়া হোক না কেন, তাতে বিশেষ বিচলিত হওয়ার কারণ ঘটে না। অর্থাৎ বন্ধুত্ব সেখানে অনেকটাই সংখ্যাবাচক! আর সেই কারণেই কার বন্ধুতালিকায় কত বেশি প্রোফাইল সেইটিই মূল বিবেচ্য হয়ে ওঠে। তার ঢাক তত জোরেই বেজে ওঠে। সেই ঢাক পেটানোর আনন্দটাই তখন বন্ধুর সাহচর্য্যর থেকেও অধিকতর মূল্যবান হয়ে ওঠে। ফলে কোনো সম্পর্কের রসায়ন নয়, আত্মপ্রচারের বাঁধানো মঞ্চটাই আমাদের কাছে তখন পাখির চোখ হয়ে ওঠে ফেসবুকের সম্মোহনী মায়ায়। 

অর্থাৎ এই আত্মপ্রচারের মঞ্চটিই বাঙালির কাছে মুখ্য হওয়ায় আর সবকিছুই গৌন হয়ে পড়েছে। গৌন হয়ে পড়েছে মানবিক মূল্যবোধের প্রাথমিক শর্তগুলিও। আপন স্বার্থে ঘা লাগলে, কিংবা অহংবোধ আহত হলেই, আমাদের ভার্চ্যুয়াল মুখের আড়ালটা খসে পড়তে থাকে। ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে অহংসর্বস্ব স্বার্থপর আমিটির অন্তর স্বরূপ। আর তখনই বন্ধুবিচ্ছেদ! মুখের ওপর দাড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটা তখন সামান্য একটা অপশান ক্লিকের ব্যাপার মাত্র! আর কি মহিমা সেই অপশানের! কোনো জবাবদিহির দায় নেই। কোনো চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। কোনো আত্মগ্লানির খচখচানি নেই। স্বয়ং জুকের্বাগের ধারণাও নেই অন্তত বাঙালির জন্যে কত বড় একটা ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি। আর সেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রতিদিন বাঙালির মতো আর কোনো জাতিই এত বেশিবার ব্যবহার করে কিনা সন্দেহ।

তবু শুধু নির্ভেজাল বন্ধুত্বের জন্যে যারা ভরসা করতে চান ফেসবুকের এই ভার্চ্যুয়াল জগতের উপর, তাদের কোনো না কোনো দিন, কোনো না কোনো ভাবে বিপর্যস্ত হতেই হয়, অভিজ্ঞতার নিদারুণ তিক্ততায়। তাই খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়, যারা কোনো প্রসাধনের আড়াল নিয়ে নয়, আপন মুখশ্রীর অন্তর্দীপ্ত মাধুর্য্যেই আলোকিত করেন ফেসবুকের ওয়াল।

2 comments:

4

প্রবন্ধ: সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

Posted in





প্রবন্ধ



স্বামীজীর সরল সহজ মাতৃভক্তি 
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


সব ভক্তির সেরা ভক্তি হল এই মাতৃভক্তি। মিষ্টির থেকেও মিষ্টি আমাদের মায়ের হাসি, একযোট শক্তির চেয়েও শক্তিশালী আমাদের মায়ের আশীর্বাদ, পৃথিবীর সমস্ত ঘনত্ব-কে এক যায়গায় করলেও মায়ের ভালবাসাকে তুলনা করা যায় না। আমাদের মায়ের একটাই চাহিদা, 'তাঁর সন্তান যেন সু-সন্তান হয় আর সে যেন দুধে-ভাতে থাকে'। কথায় আছে, 'কু-পুত্র যদি-বা হয়, কু-মাতা কদাচ নয়।' ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাতাই শিশুর প্রথম এবং প্রধান গুরু। প্রাচীন মনুসংহিতায় লেখা আছে- 'গুরু হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষকের চেয়ে দশগুণ বেশী পূজনীয়। পিতা হচ্ছেন শতগুণ বেশী এবং মাতা হচ্ছেন পিতার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি শ্রদ্ধেয়া।'

ভুবনেশ্বরী দেবী বা স্বামীজী একদিনে জন্মান নি। তাঁর জীবন বহুযুগের হিন্দুধর্মের সাধনার ফল। মায়ের প্রতি তাঁর এই অসাধারণ আত্মনিবেদনের দৃষ্টান্ত মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

২০১১ সালে বেদান্ত সোসাইটি থেকে স্বামীজীর সম্বন্ধে লেখা কিছু বই কিনি, আর সাথে সাথে পড়ে ফেলি। পড়তে পড়তে জানলাম আমি স্বামীজীর মাতৃভক্তি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতাম না। তাই ইন্টারনেট খুঁজে ও স্বামী তথাগতানন্দের লেখা “স্বামীজীর মাতৃভক্তি” থেকে কিছু লেখা সংগ্রহ করে এখানে পরিবেশন করছি, আপনাদেরও ভাল লাগবে আশা রাখছি, তাহলে আমার এ লেখা সার্থকতা পাবে।

সহস্র দ্বীপোদ্যানে স্বামীজী বলেছিলেনঃ 'জগজ্জননীর সামান্যতম প্রকাশও যদি কেউ জাগতিক মায়ের মধ্যে দর্শন করতে পারেন, তবে তিনি মহৎ জীবনের অধিকারী হবেন। যদি প্রেম, জ্ঞান চাও তবেই মাকেই উপাসনা কর। আমাদের ভারতীয় পরিবারে মাতৃদেবীই হচ্ছেন গরীয়সী দেবকল্পা, কারণ পৃ্থিবীতে সমস্ত দুঃখ সহ্য করে, সমস্ত স্নেহ দিয়ে নিঃস্বার্থ ভালবাসা উজাড় করে দিতে মা-ই একমাত্র পারেন। মাতৃস্নেহ, মায়ের ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রেম নেই। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ নবরূপ হচ্ছেন মা।'

মাতৃগতপ্রাণ শ্রীরামকৃষ্ণের অভিন্নমূর্তি বিবেকানন্দ নিজ জননীকে সারা জীবন ধরে সেবা করে গেছেন। যতিরাজ মহাসন্ন্যাসী সর্বত্যাগী হয়েও তিনি তাঁর গর্ভধারিণী মার দুঃখ কষ্ট উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই তিনি বিশ্বশিক্ষার বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও মার দুঃখে সাড়া দিয়েছেন সারাজীবন। বিদেশের সব যায়গায় ভারতীয় নারীচরিত্রের আদর্শ হিসেবে তিনি তাঁর গর্ভধারিণী মা-কেই প্রকাশ করেছেন বেশি, তা তাঁর লেখা বইগুলি পড়লে জানা যায়। মাতৃত্বের চরম উৎকর্ষ তাঁর স্বার্থত্যাগে। মায়ের অস্তিত্বই হচ্ছে সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ।

“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী !!”

-এই ছিল স্বামীজীর জীবনের মূলমন্ত্র!

মার জন্য স্বামীজীর মনোভাবের বেশ কিছু উদাহরণ এখানে …

মা ভুবনেশ্বরী ছিলেন তাঁর 'নয়নের মণি'। স্বামীজী তাঁর মাকে এত ভালবাসতেন যেন মনে হোতো মায়ের জন্যই তিনি এই পৃ্থিবীতে আছেন। যারা ওঁর জীবনী পর্যালোচনা করেছেন তারা সবাই লক্ষ্য করেছেন- তাঁর মায়ের প্রতি স্বামীজীর ভালবাসা কতখানি ছিল। স্বামীজীর মা-এর নৈ্তিক শক্তি ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে চরম দ্বন্দ্বের সময়ও তিনি তাঁর মায়ের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য চিন্তা করেছেন - মায়ের প্রতি এমনই ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁর ।

পশ্চিমের গৌরবময় দিনগুলি কাটিয়ে এসে তিনি প্রথমেই মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মার কোলে মাথা রেখে একটা সরল ও অসহায় শিশুর মতো তিনি এই বলে কেঁদে ওঠেন - ' মা তোমার নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দাও মা, আমায় মানুষ করো, মা'। কি সহজ আর সুন্দর ভাবে মায়ের কাছে এসে ছেলে
আবদার করেছিলেন।

আর একবার স্বামীজী তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। মা ভুবনেশ্বরীর দিবাহার সদ্য শেষ হয়েছে । স্বামীজী খুব হতাশ হয়ে পড়েন মার প্রসাদ কণামাত্র না পেয়ে। মা একটা ডাঁটা চিবিয়ে ছিবড়েটা ফেলেছিলেন, স্বামীজী সেটা দেখতে পেয়েই মুখে পুরে দেন। তাঁর মুখে তখন পৃথিবীর সব খাবারের সেরা খাবার।

চোখ মুখে তখন সহজ সরল শিশুর আত্ম তৃপ্তির খেলা। মায়ের অন্তরের বাসনা ছিল পুত্রের সঙ্গে একটা সুদীর্ঘ তীর্থ যাত্রা করেন। দুর্বল স্বাস্থ্য সত্ত্বেও স্বামীজী মায়ের এই ইচ্ছা পূরণের জন্য কাতর হন এবং ইচ্ছা করেন তাঁরা দুজনে যেন শেষ জীবনটা একসঙ্গে কাটাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে ঢাকায় চন্দ্রনাথ আর কামাখ্যা মন্দির দর্শন করতে আত্মীয়পরিজনসহ- নিজের মাকে -স্বামীজী নিয়ে যান। নানাভাবে স্বামীজী তাঁর মাকে সুখী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন ।

১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে স্বামীজী বেলুড়মঠে প্রথম দুর্গাপূজো করেন শ্রীশ্রীমার নামে । শ্রীম ও শ্রীশ্রীসারদামা এই পূজায় উপস্থিত ছিলেন । স্বামীজীর অনুরোধে তাঁর গর্ভধারিণী মা-ও এই পূজায় উপস্থিত হন। পরে স্বামীজী তাঁর মায়ের বাড়ীতে নিজ তত্ত্বাবধানে জগদ্ধাত্রী পূজা করেন । অন্যান্য অনেক সাধুরা নিমন্ত্রিত হয়ে পুজোয় যোগদান করেন। মা-কে আনন্দ দেওয়াই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।

তাঁর মায়ের একান্ত ইচ্ছায় স্বামীজী কালীপূজার কয়েকদিন পর কালীঘাটে মা কালীর দর্শন করেন। তাঁর মায়ের মানত ছিল। বহুদিন আগে শৈশবে স্বামীজীর এক দুরারগ্য ব্যাধি হয়, তাঁর মা তখন মা কালীর কাছে পুত্রের জীবনপ্রার্থনা করেন। পুত্র ভাল হয়ে গেলে তিনি মা কালীর মন্দিরে পূজা দেবার মানত করেন। এখন স্বামীজীর এই ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে মায়ের মনে পড়ে সেই মানত পালন করা হয়নি। মায়ের কথামত স্বামীজী সমস্ত রকম আচার অনুষ্ঠান দ্বারা তার সেই মানসিক পূর্ণ করেন। আদি গঙ্গায় স্নান করে ভেজা বস্ত্রে তিনি মন্দিরে গিয়ে মা কালীর সামনে তিনবার গড়াগড়ি দেন। তারপর সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। নিজেই নাটমন্দিরে পশ্চিমদ্বারে যজ্ঞ হোম ইত্যাদি সম্পন্ন করেন। মঠে ফিরে গিয়ে তিনি মন্দিরের পুরোহিতদের খুব প্রশংসা করেন। তাঁর মায়ের মানসপূজা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে অনুমতি দেবার জন্য।

এবং ১৮৯৯ সালের মে মাসেও যখন তিনি ঐ কালী মন্দিরে পূজা দিতে যান, তখনও তাদের একই উদারতা লক্ষ্য করেন।

আবার পড়েছিঃ

"তিনি তাঁর মায়ের প্রতি প্রণতি জানিয়ে স্বীকার করেছেন যে তিনি জীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন সবই তাঁর মায়ের নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য।"

মা বলেছিলেন, সত্য-কে যেন জীবনের ধ্রুবতারা করেন - তাতে যত-ই বাধা আসুক না কেন, সত্য থেকে যেন তিনি বিচলিত না হন। অন্যায়-কে কোনদিন যেন মেনে না নেন তিনি মুখ বুজে।

স্বামীজী  স্কুলে পড়াকালীন একবার সব প্রশ্নের উত্তর ঠিক লেখেন, ভূগোলের মাস্টারমশাই তাও বলেন তিনি ভুল লিখেছেন...কিন্তু স্বামীজী  তা মেনে নেন নি। কারণ তিনি জানতেন তিনি যা লিখেছেন একেবারে শতকরা ভাগ ঠিক। তাই তিনি তর্ক শুরু করলে মাস্টারমশাই তাকে প্রচন্ড বেত্রাঘাত করেন কিন্তু তবুও তিনি অন্যায় প্রস্তাব-কে মেনে নেন নি। মুখ বুজে সত্যের পূজা করেছিলেন।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সব কথা বলতেন তিনি তাঁর আদরিনী মা-কে, সেদিন ও যখন তার দুঃখের কথা মাকে জানালেন, তখন মায়ের ঠোঁট জুড়ে শান্ত আর মিস্টি হাসির ঝিলিক। তাঁর স্নেহ মাখা মিস্টি কথায় সব দুঃখ ভুলে গেলেন তিনি। তিনি ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন আর বললেন, “ আমি আজ সত্যি খুব খুশি হয়েছি, আর নিজেকে খুব গর্বিত লাগছে তোমার জন্য বিলে। সত্যের পথে সব সময় এগিয়ে যাবে, যত-ই মিথ্যের পাহাড় বাধা হয়ে আসুক না কেন! তুমি যদি জানো, তুমি যা করেছো সেটা ঠিক, তাহলে অন্য লোকে যাই ভাবুক না কেন, তুমি নিজে যা ভাল বুঝবে তাই করবে।” অনেক সময় লোকে তাঁকে ভুল বুঝেছে বিশেষতঃ তাঁর অতি প্রিয় নিকটজনেরাও, এবং তিনি এর জন্য মনোকষ্ট পেয়েছেন। তবু তিনি তাঁর অদ্ভুত খেয়ালমত যেটা নিজের কাছে ন্যায্য মনে হয়েছে, তাই করেছেন। তাঁর কাছে নিজের মা-এর বাণী -ই ছিল ধ্রুব সত্য, তিনি মরে গেলেও সেই পথ থেকে বিচ্যুত হতেন না। এই ছিল তাঁর জীবনের সাধনা।

মাস্টারমশাই পরে বাড়ি গিয়ে দেখেন যে নরেন সব ঠিক লিখেছে। পরের দিন স্কুলে এসে তিনি ক্ষমা চান নরেন-এর কাছে।

আর একবার মাকে সামান্য খুশী করার জন্য স্বামীজীর কাতরতা। একদা তিনি এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলরাম বোসের বাড়িতে ছিলেন। ডায়াবেটিসের রূগী, রাতে মোটে ঘুমোতে পারতেন না, সেজন্য দিনে বিশ্রাম নিতেন। একদিন তাঁর মায়ের এক পরিচারিকা সেই অঞ্চলে আসে এবং নরেনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজীর ঘরে গিয়ে দেখেন তিনি নিদ্রিত; পরিচারিকাকে সে কথা জানান। সে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠলে স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজীকে সেই ঘটনা জানান। তিনি তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তাঁকে না ডাকার জন্য খুব তিরস্কার করেন। মা হয়ত কোন বিশেষ দরকারে পরিচারিকাকে পাঠিয়েছিলেন এই কথা মনে হওয়ায়, তিনি তৎক্ষণাৎ একটি গাড়ী ভাড়া করে মার সঙ্গে দেখা করতে যান, এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে মা তাকে পাঠান নি। সে স্বেচ্ছায় নরেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে অকারণ তিরস্কার করেছেন বুঝতে পেরে তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ী পাঠান ব্রহ্মানন্দকে মার বাড়ীতে আসার জন্য। স্বামী ব্রহ্মানন্দ এসে পৌঁছুলে স্বামীজী তখন বিনীতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

অনেক পুরনো কথা, কিন্তু স্বামীজী-র বলার ধরণটাই অন্য--- ধক্ করে মনে গিয়ে লাগে, ভুলতে দেয়না কিছুতেই। হাজার, দুহাজার লোকের সামনে বক্তৃতার শেষে এদেশী বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার পথে বলতেন-

“আজ তোমাদের পোলাও রেঁধে খাওয়াবো। মাছের টক, খুব ঝাল দিয়ে ছোলার ঘুগনি, ঠিক আমার মা যেমন রাঁধতেন”।

এক সেকেন্ডের জন্য-ও তিনি মা-কে ভুলতে পারতেন না। খাওয়ার পরে গান গেয়ে শোনাতেন কখনও মায়ের কাছে শেখা রামায়ণ-মহাভারতের, পুরানের কখনও বা নিজের মায়ের গল্প। নিত্য নতুন ভাবে সঙ্গীদের সেবা, মনোরঞ্জণ, একটু আনন্দ দেওয়া ছিল মা ভুবনেশ্বরীর সবচেয়ে আদরের বিলের শখ । স্বামীজী স্বভাবতঃই মায়ের চারিত্রিক মহিমা কীর্তন করতেন।

“সবসময় দুর্দশাগ্রস্ত, স্নেহের আধার, মায়ের অহেতুক স্নেহ ভালবাসাই আমাকে বড় করেছে, তাঁর ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না। আমি জানি আমার জন্মের আগে থেকে তিনি এ পর্যন্ত যত উপবাস, প্রার্থনা এবং নানা কৃচ্ছসাধন করেছেন আমি তা পাঁচমিনিটও করতে পারতাম না। ঐ দু বছর ধরে তিনি এ সব করেছেন। আমার যা ধর্মজ্ঞান, আচারবিচার সবই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। আমার মা জেনেশুনেই আমাকে এ ভাবে মানুষ করেছেন। আমার মধ্যে যা সদ্‌গুণ সবই আমার মা জ্ঞানতঃ আমাকে দিয়েছেন।”

মৃত্যুর চার বছর আগে মায়ের দুঃখ দেখে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজী  ১৮৯৮ সালের ২২শে নভেম্বর ক্ষেত্রীর মহারাজা অজিত সিংহকে এক পত্রে লিখেছেন –

“ আমি আজ আপনার কাছে এক বিশেষ আর্জি নিয়ে লিখছি, জানি যে আপনার কাছে খুলে সবকিছু জানাতে আমার এতটুকুও লজ্জা নেই, এই জীবনে আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু। অন্তরে একটা পাপবোধ সবসময়ই যন্ত্রণা দেয় এই ভেবে যে দেশমাতৃকার সেবা করতে গিয়ে আমি আমার গর্ভধারিণীর প্রতি অবহেলা করেছি। এখন আমি আমার মার কাছে থাকতে চাই, এতে আমার এবং মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলি নির্বিঘ্নে কাটবে। তিনি এখন একটি অপরিসর কুঁড়ে ঘরে বাস করেন। আমি তাঁর জন্য একটি ভদ্রোচিত বাসস্থান তৈ্রী করে দিতে চাই। একদিন যাকে আপনি বন্ধু বলে বরণ করেছিলেন তার জন্য এই অনুগ্রহটুকু করা কি শ্রীরামচন্দ্রের বংশধরের পক্ষে একেবারে অসম্ভব? আমি জানি না আর কার কাছে আমি হাত পাততে পারতাম। আমি তো আমার জন্য কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে অপারগ। আমার পারিবারিক অবস্থার কথা মহারাজ সবই অবগত আছেন, যা আর কেউ জানে না। আমি এখন ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয় এবং মৃতপ্রায়-আমি কি আপনার কাছে এই শেষ অনুগ্রহটুকু ভিক্ষা করতে পারি?”

স্বামীজীর এই বিখ্যাত পত্রে নিজের মা-এর প্রতি তাঁর এক গভীর মমতা ফুটে উঠেছে। তিনি ছিলেন স্বয়ং প্রেমের প্রতিমূর্তি। চিঠির আবেগ ও গুরুত্ব বুঝতে পেরে মহারাজা সত্বর স্বামীজীর কাছে জানতে চান তাঁর মায়ের জন্য কি পরিমাণ অর্থ তাঁর প্রয়োজন।

১৮৯৮ সালে ১লা ডিসেম্বর স্বামীজী তাঁকে এই মর্মে আবার লেখেন,

“ আপনার কাছে আর একটি প্রার্থনা - আপনি আমার মায়ের আজীবন একশত টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করুন – যেন আমার মৃত্যুর পরেও এই টাকা ঠিকমত তাঁর কাছে পৌঁছায়। যদি কোনদিন আপনার স্নেহ ও দাক্ষিণ্য থেকে বিচ্যুত হই, এই দরিদ্র সাধুকে একদিন আপনি স্বয়ং ভালবেসেছিলেন এই কথা মনে রেখে আমার দুর্ভাগিনী মার প্রতি দাক্ষিণ্যে যেন আপনি কখনো বিমুখ না হন, এই প্রার্থনা করি।”

আর এক পত্রে মিসেস ওলি বুলকে লেখেন,

“ আমার আছে ক্রমশঃ এই ব্যাপারটা নিশ্চিত মনে হচ্ছে যে আপাততঃ মঠের সমস্ত চিন্তা ফেলে রেখে কিছুদিনের জন্য আমার মার কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। আমার জন্য উনি অনেক দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। ওঁর জীবনের শেষ সময়টা যেন নির্বিঘ্নে কাটে - এখন আমার সেই চেষ্টাই করা উচিত। আপনি নিশ্চয়ই জানেন শ্রীমদ্ শঙ্করাচার্য্য নিজেও ঠিক এই কাজই করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে মাকে ছেড়ে আসাটাই আমার পক্ষে একটা বিরাট আত্মত্যাগ – আর এখন সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে যাওয়াটা তার চেয়েও বড় আত্মত্যাগ।”

মায়ের প্রতি স্বামীজীর গভীর আনুগত্যই তাঁদের দুজনের সম্পর্ক দৃঢ় ও মধুর করে তোলে। তাঁর আর একটা পরিচয় দিয়ে আমার লেখার এই পর্যালোচনা শেষ করিঃ

দোতলায় গিয়ে তিনি কাতরস্বরে ডাকলেন “বি লু উ উ” সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বালকপুত্র ঘরের কোণা থেকে বার হয়ে এলেন। ভবিষ্যতের বিরাট বিবেকানন্দ তাঁর কাছে সেই বালকের মতই ছিলেন। মা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে স্বামীজী সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের পথে যেতে যেতে নিজেদের কথা বলতেন। বেলুড়ে থাকাকালীন মাঝে মাঝে নিজের মা-র কাছে যেতেন। কিন্তু তিনি যদি সপ্তাহে একবারও না গিয়ে উঠতে পারতেন, মা স্বয়ং সাংসারিক সমস্যার আলোচনা করতে বেলুড় মঠে এসে হাজির হতেন। বিলু যে তাঁর বড় আদরের ধন, তাঁর সব সময়ের সাথী।

১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর চরম সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ব্রাহ্ম নেতা প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার স্বামীজীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে অনেক বাঙ্গালীকে দলে টানেন। স্বামীজী মায়ের অবশ্যম্ভাবী মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে ১৮৯৪ সালে ২৬শে এপ্রিল নিউইয়র্কে মিস ইসাবেল ম্যাকিন্ডলিকে লেখেনঃ

“আমার দেশের লোকে আমার বিরুদ্ধে বলছে(মিঃ মজুমদার প্রমুখ) আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমার বৃদ্ধা জননী দেশে আছেন, শুধু তাঁর কথা চিন্তা হয়। সারাজীবন তিনি অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন, তা সত্ত্বেও জনগণের এবং ঠাকুরের সেবায় আমাকে নিবেদন করার কষ্ট সহ্য করেছেন; তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে দান করে এখন যদি তাঁকে শুনতে হয় যে সেই সন্তান দূরদেশে এখন অমানুষের মত জীবন যাপন করছে - যা মিঃ মজুমদার কলকাতায় রটাচ্ছে, সেই দুঃসংবাদ নিঃসন্দেহে মার মৃত্যুর কারণ হবে। কিন্তু ঠাকুরের অসীম কৃপা তাঁর সন্তানদের কেউ কখনো আঘাত করতে পারবে না।”

অথচ আজ এই কম্পিউটার যুগের ছেলেমেয়েরা সময় পায় না বলে মা-কে অজুহাত দেখায়। একটা এক মিনিটের ফোন- তাও তাদের সময় কেড়ে নেয় মা-এর খোঁজখবর করার থেকে।

তিনি সুযোগ পেলেই প্রায়ই মার প্রশংসা, ও তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন। তিনি বলতেন তাঁর মায়ের মতন প্রবল আত্মসংযমী এবং তাঁর মতো একটানা ততদিন উপোস কেউ করতে পারে স্বামীজী এমন কাউকে জানেন না। তাঁর মা একসময় একটানা চোদ্দদিন ধরে উপবাস করেছিলেন।

স্বামীজীর অনুগামীদের অনেকেই তাঁর মুখ থেকে শুনেছেন,

“এ কাজ করতে মা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর চরিত্র আমার জীবনে এবং আমার কাজে সতত অনুপ্রেরণা দান করে।”

মায়ের গুণকীর্তন করতে স্বামীজীর কখনও ক্লান্তি ছিল না। ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারী প্যাসাডিনা, ক্যালিফোর্নিয়াতে তিনি ভারতীয় নারীর ওপর যে বক্তৃতা দেন, তাতে বলেন-

“আমার মা এবং বাবা বছরের পর বছর উপবাস ও প্রার্থনা করার ফলে আমার জন্ম হয়। আমার মা একজন নিষ্ঠাবতী সন্ন্যাসিনীর মত আমাকে লালন করেছেন। তিনি তাঁর শরীর, মন, খাদ্য, বস্ত্র -সব যত্নের সঙ্গে পবিত্র রাখতেন আমি তাঁর কোলে জন্মাবো বলে।”

সেই বক্তৃতাতেই তিনি উল্লেখ করেন তাঁর মায়ের গভীর আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তিনি কি করে উপলব্ধি করেছিলেন।

“ছোট বেলায় যখন আমরা বালক ছিলাম প্রতিদিন প্রত্যুষে ছোট এক বটি জল নিয়ে আমরা মায়ের কাছে যেতাম। তিনি তাঁর পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা ছুঁইয়ে দিলে আমরা সেই জল পান করতাম।”

স্বামীজী ছিলেন ফলিত বেদান্তের প্রাণপুরুষ। মায়ের প্রতি তাঁর এই অসাধারণ আত্মনিবেদনের দৃষ্টান্ত মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন বেদান্ত! শুধু যে মাতৃভক্তির নজির রেখে গেছেন তিনি তাই নয় অসংখ্য ক্ষেত্রেই তিনি দ্য ফলোয়ার অব অল। তাঁর জীবনের কত ছোট ছোট এরকম কাহিনী আছে যা আমাদের অজানা থেকে গেছে।

আর আজ আমরা মাকে ভালবাসি “মাদার্স- ডে” করে, কে কত দামি জিনিস মাকে দিয়েছে আলোচনা করে; আর নয়ত মাকে ফুল পাঠিয়ে বা কোন ভাল রেস্টোরান্টে খাইয়ে কিংবা মাকে একখানা দামি শাড়ী কিনে দিয়ে। আর সেই মা ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন শুধু মনে মনে বলেন, “ওরে একবার মা বলে ডাক, মা বলে ডাক, মা বলে ডাক মা-কে।”

স্বামীজীর নিঃশঙ্ক উক্তিঃ

“যতদিন দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত্য অভুক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত্য তিনি মুক্তি চান না।”

তিনি বলেছেনঃ

“অনেক মন্দির আছে, কিন্তু মানুষের শরীর সবচেয়ে বড় মন্দির। আর সেই মন্দিরে যিনি বিরাজ করছেন, তাকে আমরা অবজ্ঞা করি”।

স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ সংঘের জন্য এবং বলা যেতে পারে সমগ্র মানব জাতির জন্য দুটি আদর্শ দিয়ে গেলেন...

আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ, অর্থাৎ –আত্মমুক্তি ও জগতের কল্যাণ। জগদ্ধিতের উদ্দেশ্যে স্বামীজী কর্মযোগ প্রবর্তন করেছেন। কর্মযোগ দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। একটি হল—কর্মই উপাসনা, এর অর্থ হল সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা পরমেশ্বরের নিমিত্ত নিবেদিত।

দ্বিতীয় নীতিটি হল--'শিবজ্ঞানে জীবসেবা', অর্থাৎ –মানুষকে ঈশবরজ্ঞানে সেবা করা। স্বামী বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম গুহ্যশাস্ত্র থেকে বেদান্তের জীবনপ্রদ শাশ্বত সত্যগুলিকে বার করে তাদের আধুনিক ভাব ও ভাষার‍ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনসমস্যার সমাধানে সেগুলি কীভাবে কার্য্যকরী হতে পারে তা ব্যাখ্যা করে দেখান।

স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর প্রবুদ্ধকর ভাবগুলিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক বিজ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক ধ্যান -ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রিয় করা, শক্তিপ্রদ করা, এবং পুনর্ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। তিনি ভারতের সর্ব প্রথম মহান চিন্তাবিদ যিনি বিজ্ঞান ও ধর্ম বা আরো সঠিকভাবে বলা চলে, বিজ্ঞান ও বেদান্তের মধ্যে সমন্বয়সাধনের প্রয়াস করেছেন। স্বামীজী দেখিয়েছেন বিজ্ঞান ও ধর্ম---মানবীয় চেতনার দুটি ভিন্ন স্তরে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে এবং তারা একে অপরের বিরুদ্ধ নয়, বরং পরিপূরক।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আপেক্ষিক তত্ত্ব, গাণিতিক, প্রযুক্তি, পরমাণু, পদার্থবিদ্যা, কণাবিদ্যা, এবং বিজ্ঞানের অপরাপর ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের প্রেক্ষায় বেদান্তের সনাতন তত্ত্বের স্বামী বিবেকানন্দ-কৃত ব্যাখ্যার নতুন বিশ্লেষণ দরকার ছিল। তিনি রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের জন্য একটি প্রতীক স্থির করেছিলেন যার কেন্দ্রস্থলে একটি রাজহংস আছে। প্রতীকটি পরমাত্মার উপলব্ধির (পরমহংস) গঠনে কর্ম, -ভক্তি- জ্ঞান-ধ্যানের সমন্বয়ের মূর্তপ্রকাশ।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সমগ্র জীবনে এই আদর্শকেই অনুসরণ করেছিলেন এবং সেই আদর্শকেই অনুশীলন করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কখনই ব্যক্তিত্বের একদেশদর্শিতাকে সমর্থন করতেন না। স্বামীজী সংস্কৃত ভাষায় লেখা “শ্রী রামকৃষ্ণ স্তোত্রম”-এ তাঁর গুরুরদেবের বর্ণনা করেছেনঃ অদ্বয়তত্ত্বসমাহিতচিত্তং প্রোজ্জ্বলভক্তিপটাবৃতবৃত্তম্ কর্মকলেবরমদ্ভূতচেষ্টং যামি গুরুং শরণং ভববৈ্দম্। (যাঁর চিত্ত অদ্বৈত্তত্ত্বে সমাহিত, যাঁর চরিত্র অতি উজ্জ্বল ভক্তিরূপ বস্ত্রের দ্বারা আবৃত, যাঁর জীবন লোককল্যাণে নিযুক্ত, যাঁর কার্যাবলী অপূর্ব, সেই সংসাররোগের চিকিৎসক গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করি।)

স্বামীজী পাশ্চাত্যের শিষ্যদের বলেছিলেন তিনি আবার আসবেন, কারণ তিনি মানুষের প্রেমে পড়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেনঃ

“নিন্দাবাদ একেবারে দূর করো। তোমাদের মুখ বন্ধ হোক, হৃদয় খুলে যাক।। এই দেশের এবং সমগ্র জগতের পরিত্রাণ করো। তোমাদের প্রত্যেককেই ভাবতে হবে, সমস্ত ভার তোমাদেরই ওপর।”

তিনি বলতেনঃ

“যত বয়স বাড়ছে, আমি তত ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে মহত্ত্ব খোঁজার চেষ্টা করছি। আমার জানতে ইচ্ছে করে একজন মহৎ ব্যক্তি কী খান, কী পরেন, এবং কীভাবে উনি তাঁর পরিচারকদের সংগে কথা বলেন।”

তিনি বলেছেন -

“শক্তিই উপনিষদের বানী। আমি দেহ নই, মন নই, আমি আত্মা - এই বোধ এবং উপলব্ধি থেকেই শক্তির সঞ্চার হয়”।

4 comments:

9

প্রবন্ধ: ইন্দ্রাণী ঘোষ

Posted in




প্রবন্ধ 



নিভৃত প্রাণের দেবতা 
ইন্দ্রাণী ঘোষ 


শুনেছি আগে নাকি কলমের উপর একছত্র অধিকার ছিল পুরুষের। মেয়েরা লিখবে? ওরে বাবা! কেমন একটা বাঁকা হাসি খেলে যেত পুরুষ মুখবয়বে।brain এর exercise - সে তো পুরুষের কারবার। নিভৃতে সৃষ্টি করা, নিজের সৃষ্টির এক চিলতে আঙ্গিনা, চিলেকোঠার  নিভৃত কোণ, সে তো  যাদের জৈবিক পরিচয় পুরুষ, তাদের। দাড়ি দুলিয়ে, কানে দুল পরে, হাতে গিটার নিয়ে, চোখে ঢলঢল গভীরতা নিয়ে সে বিরাজ করবে, তবে না মনে হবে মর্তের সৃষ্টিকর্তা। এ হেন ধারণা  ধীরে ধীরে বদলেছে অবশ্য। আমাদের ললনারা এখন বেশ বীরাঙ্গনার বিক্রমে কলম ধরেছেন, তা দেখেশুনে বেশ লাগে। 

Gilbert and goober বলেছিলেন, 'pen stands for phallic creativity' 

এর উত্তরে Show Walter বললেন “women write with the help of their brain.Women’s womb is the word processor.” যে কোন লেখা লেখক বা লেখিকার সন্তানসম। একটি লেখার জন্মযন্ত্রণা ও সন্তানের জন্মযন্ত্রণা  এক।অনেক সময় ভ্রুণ  নষ্ট হওয়ার মত লেখাও নষ্ট হয় বই কি।

Virginia Woolf  কিন্তু একদম নতুন কথা বললেন। বললেন, লেখা বা কলমের সৃষ্টির কোন লিঙ্গ নেই। এই জায়গা থেকেই একদম নতুন concept এল যাকে বলা হয় androgynies text. নারী পুরুষের মিলিত সৃষ্টি, যা অনিন্দ্য সুন্দর। সেই সৃষ্টি অর্ধনারীশ্বরের মতই সম্পূর্ণ, যেমন পুরাণের কমলেকামিনী। 

ঋতুপর্ণ ঘোষের-এর একটি ছবিতে অবন ঠাকুরেরর উপলব্ধির কথা শুনতে পাই, এ প্রসঙ্গে। অবন ঠাকুর এক বার দুর্গাপূজার শেষে, তারাভরা দীপাবলীর রাত্রে বেনারসে ছিলেন, তাঁর মনে হল মা ভগবতী ফিরে চললেন স্বামীর কাছে কৈলাসে, আর সারা আকাশটা যেন মা ভগবতীর আঁচল, নিচে জ্বলতে থাকা প্রদীপগুলি সেই আঁচলের খসে পরা চুমকি। এ হেন দৃশ্য থেকে জন্ম হোল একের পর এক ছবির, যা কিনা হর-পার্বতীর মিলনের ছবি, এক অর্ধনারীশ্বর-এর ছবি। এই সৌন্দর্য বোধ তুলনাবিহীন। 

ঋতুপর্ণর আন্দোলন ছিল সমাজের সেই মধ্যবর্তী র্সীমারেখার মানুষদের জন্য যারা নারী পুরুষ কেউ নন। কিন্তু এই মানুষগুলো সৃষ্টিশীল। সৃষ্টির আঙিনায় কোন তফাৎ নেই। Virginia Woolf, অবন ঠাকুর, ঋতুপর্ণ কেমন সময়ের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে যেন মিলে গেলেন এক বিপুল তরঙ্গে যা একসাথে বালিতে মিশে গিয়ে আবার ফিরে গেল রত্নাকরের গর্ভে। সময়ের একেকটি রত্ন একই কথা বলে লুকিয়ে পড়ল সীমাহীন কালের সমুদ্রে। 

Woolf বলেন এক ‘ফ্লাইট”এর কথা আমরা যাকে বেশ বলতে পারি ’ছুট’।Woolf বলেন “A room of one’s own” আর আমরা তাকে যদি বলি “নিভৃতির কোণ” তাহলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় আরও। একান্ত নিজের এক নিভৃত পূজার ঘর। যেখানে চলে প্রাণের দেবতার পূজা। Virginia Woolf বলেন মায়েদের কার্পেট বোনার কথা। নিপুণ  আঙ্গুলের ছোঁয়ায় একেকটি স্বপ্নকে যেন রূপ দিতেন তাঁরা। রঙ্গিন সুতোয় স্বপ্ন ফুটত। 

ঋতুপর্ণর রবিবারের কলমেও এক গল্প শুনি মাদুর বোনার। বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসা সেই কিশোরী যে দুপুরবেলা মাদুর বুনত, আর কিশোর ঋতুপর্ণ তাঁর কাছে মাদুর বোনা শিখতে চাইলে সে লাজুক হেসে পালাত। হয়তো বা মাদুর বোনার মাধ্যমেই তার নিভৃত প্রাণের দেবতার সাথে একা জাগার পালা চলত। 

Alice walker “in search of my mother’s garden” রচনা তে বলেন তাঁর মায়ের বাগানের কথা। মা যখন বাগানে কাজ করতেন, তার চারিপাশে এক আলোর বলয় তৈরি হত যেন। এই মা দশটি সন্তানের জননী হওয়া স্বত্তেও তাঁর বাগান করা ছিল যেন মুক্তির এক অনন্ত আশ্বাস। এই কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকার মায়ের জীবন বলাবাহুল্যই মর্মান্তিক। দিন শেষে এঁর স্বামী  মত্ত হয়ে প্রহার না করে ঘুমোতে যেতে পারতেন না। এই পরিবেশে থেকে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হয়েও তাঁরা জোনাকির মতো প্রাণের আলো জ্বেলে সুখের ডানা মেলতেন সৃষ্টির আকাশে। 

ভিক্টোরিয়ান যুগে George Eliot নামে লিখতেন Marry Ann Evans. 

একের পর এক অনবদ্য সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর আশঙ্কা ছিল পাছে তাঁর লেখা মহিলার কলমজাত বলে বাতিল হয়ে যায়, তাই এই ছদ্মনামের ব্যবহার। এখন অবশ্য এ দিন গেছে। ঠাকুর বাড়ির মেয়রা প্রথম আলোর পথ দেখিয়েছেন বহু আগেই। স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী সকলেই আলোকপ্রাপ্তা।পরবর্তী কালের নবনীতা দেবসেন, হালফিলের বাণী  বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, চিত্রা দেব, জয়া মিত্র, অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী সবাই নিজের বিভায় উজ্জ্বল  জ্যোতিষ্ক।

সেই কৃষ্ণাঙ্গ মা, যিনি একমনে বাগান করতেন বা সেই কিশোরী মাদুরশিল্পী যার আকাশপাড়ির কথা ঋতুপর্ণ জানতে চেয়েছিলেন, এঁরা সকলেই কি নবনীতা, অরুন্ধতীদের সাথে একই আকাশে ঠিকানা খোঁজেন  নি? বা সিল্ভি মানবীরা? এঁরাও কেউ সাজাতে ভালবাসেন, কেউ বা লিখতে। সকলেরই উড়ান অস্তিত্ব খুঁজতে একই আকাশে। সৃষ্টি সহজিয়া, তার গতি প্রকৃতি লিঙ্গ ভেদের অনেক উপরে। সব সৃষ্টিশীল মানুষ নিভৃত প্রাণের দেবতার পূজারী। Virginia Woolf এর সেই নিজের ঘরের খোঁজ করেন সবাই। তাই বোধহয় পৃথিবী বিখ্যাত গানের দল Beatles বলে 

“there’s a place I go to, when I’m low, when I’m blue……..”

9 comments:

2

বিশেষ রচনা: মকসুদা হালিম

Posted in





বিশেষ রচনা 



মুখপাত 

শ্রীমতী মকসুদা হালিম বাংলাদেশের একজন উদারচেতা মননশীল মানুষ। তাঁর কাছে আমরা ঋতবাকের জন্য লেখা চেয়েছিলাম। সময় স্বল্পতায় তিনি তাঁর একটি ব্যক্তিগত অনুভব আমাদের কাছে উন্মুখত করেছেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরকে অতিক্রম করে বেশ কিছু সার্বজনীন প্রশ্নের উপরে আলোকপাত করেছে । 

সেই লেখাটি এখানে আমরা প্রকাশ করলাম । 




স্বগতোক্তি 
মকসুদা হালিম 


আমার মতো শ্রদ্ধেয়া একবার ভালবেসে কাছে টেনে নিয়ে আবার কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি 
-এই অভিযোগের জবাব। 

আমি মকসুদা হালিম কাউকে ভালবেসে কাছে টেনে আবার তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবো--- এ ধরণের মন মানসিকতা আমার নাই। যাকে একবার ভালবেসে পাশে স্থান দেই, সে আদরণীয়ই থাকে সর্বদা। 

আমি কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দেই নাই। শুধু নারী জাতিকে অশ্রদ্ধা, আর অসম্মান, আমাকে ক্রুদ্ধ করে। যারা নারীকে সম্মান জানাতে পারে না, তাদের তো নারীর বন্ধু হওয়া সাজে না। এদেরকে আমি আন ফ্রেন্ড করি মাত্র, ছুঁড়ে ফেলি না। 

কেউ কেউ অনুশোচনা করে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে, আবার কেউ কেউ এতো দাম্ভিক যে মাতৃসম কারো কাছে ক্ষমা চাইতেও তাদের অহংএ বাধে। 

প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখো ! পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতায় নারীর মহিমা উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মগ্রন্থেই নারীর অসীম শক্তির মহিমা কীর্তন ব্যক্ত হয়েছে। কয়দিন আগেই একটা গ্রুপে বিতর্ক হচ্ছিলো-‘বিধাতা’ পুরুষ নাকি নারী ? সাব্যস্ত হল— ‘বিধাতা’ অবশ্যই নারী, নচেৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হলো কি ভাবে ? 

হিন্দু শাস্ত্রে ‘বিধাতা’ জগজ্জননী ! আদ্যাশক্তি মহামায়া নারী। নিজের অংশ দিয়ে দেবতা সৃষ্টি করেছেন। স্বর্গলোকে বিপদগ্রস্ত হলে এইসব বাঘা বাঘা দেবতাদেরও কিছু করার ক্ষমতা নাই, তখন নারীশক্তির ডাক পড়ে ! মহাদেব শঙ্করের মতো ধ্বংসের দেবতাও নারীর পদতলে পিষ্ট হয়। 

হাদিস বলে, ‘জননীর পদতলে জান্নাত। জননীকে সন্তুষ্ট রাখো, জান্নাত অবধারিত !’ পিতার কথা বলা হয় নি। আল- কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘শেষ বিচারে হাশরের ময়দানে প্রতিটা জীব মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হবে। পিতৃ নয়’!

সৃষ্টিকর্তা নরক সৃষ্টি করেছেন, কাদা দিয়ে। নারীর অঙ্গে কর্দম লেপন করেন নি। পুরুষের পাঁজরের হাড় ছিনিয়ে নিয়ে নারীকে সৌন্দর্য মন্ডিত, মহিমান্বিত, সকল শক্তির আধার আর কমনীয় করে গড়েছেন। এই পাঁজরের হাড় পুরুষ স্বেচ্ছায় দয়া করে দান করে নি। সৃষ্টিকর্তার এ হেন কর্মের তাৎপর্যও কেউ চিন্তা করে দেখে না। পাঁজরের হাড় যেমন জীবের বেঁচে থাকার উপকরণ সমূহকে সুরক্ষিত রাখে তেমনি নারীও পুরুষের সকল নিদান কালের ত্রাতা ! 

‘নারী নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ না করলে আমরা আজ বেহেশতে মহা আরামে বাস করতাম’—এই কথা যারা বলে, তারা নিতান্তই অধার্মিক ! কারণ আল্লাহ কোরআনে স্পষ্ট করে বলেছেন, এই পৃথিবীতে তিনি মানুষের আবাদ করবেন বলেই মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনকিছুই হয় না। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নারী এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছে। পুরুষ করতে পারে নাই। 

পৃথিবীতে কোন নারী নবী-রাসুলের আবির্ভাব হয় নি সত্য কিন্তু নারী এই নবী রাসুলের জন্ম দিয়েছে ! নারী রাষ্ট্র শাসন করবে না, কারণ রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই অমানুষ ! নারী বিশ্ব শাসন করবে। জননী, জায়া, প্রেয়সী, ভগিনী কন্যা হয়ে নারী যে স্নেহ, মায়া, সহানুভূতি, প্রেম আর সেবা দান করে, বিশ্ব সংসার তার কাছে নতজানু ! ষণ্ড পুরুষের মতো নারীর গায়ে শক্তি নাই, সে গোলাপের মতো কোমল, যার ঘ্রাণে বিশ্ব জগত আমোদিত। নারী যে আন্তরশক্তিতে কি বিপুল শক্তিময়ী— বহু প্রাচীন কাল থেকেই পুরুষ সেটা টের পেয়ে শঙ্কিত  হয়েছে ! নারীর শক্তি খর্ব না করলে তাদের অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যাবে, আর নয় তো পুরুষ মৌমাছির মতো নারীর দাসত্ব করে যেতে হবে। 

তাই পুরুষ যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে, আচারের নামে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে নারীকে পদতলে পিষ্ট করে চলেছে। আর বেঁধে পিটালে, সিংহও তার স্বভাব ভুলে সার্কাসের ক্লাউন সাজতে বাধ্য হয় ! নারী যে আশালীন- অশ্লীল আচরণ করে তার জন্য দায়ী কে ? নারী, নাকি পুরুষ ? পরিবেশ আর পরিস্থিতি নারীকে অশালীন করে। 

নারীর যৌবন আর সৌন্দর্যকে পণ্য করে পুরুষেরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা বানিয়ে নিজেদের উদর পূর্তি করে। তোমরা পুরুষেরা নারীকে নিয়ে বাণিজ্য করবে, আবার চাইবে নারী বোরখা পরে হেরেমে বন্দী থাকুক ? তেইশ জোড়া এক্স ক্রোমোজোমের সবটুকু নিয়ে নারী পরিপূর্ণ—স্বয়ং সম্পূর্ণ মানবী ! তার মধ্যে কোন ভেজাল নাই। একটা ওয়াই-এর ভেজাল নিয়ে পুরুষের কিসের এতো অহংকার ?

2 comments:

14

রম্য রচনা: দেবাশিস কাঞ্জিলাল

Posted in




রম্য রচনা



বুড়ি aka সদানন্দ চক্রবর্তী 
দেবাশিস কাঞ্জিলাল 



বুড়ি কোন মেয়ের নাম নয়, সে একজন পুরুষ মানুষ, খাতাকলমে তা অবিশ্যি হল সদানন্দ চক্রবর্তী । 

আমার পুরোনো পাড়ায় থাকত । আজ সকাল ছটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম, ওই যাকে বাংলায় মর্নিংওয়াক বলে সেই অনিচ্ছার দায়বদ্ধতা পালনের জন্য। দেখা হল তার সাথে। আমার উল্টোদিকে ফিরছে । 

একটা বারমুডা-দ্বীপের আধাপ্যান্টের ওপরে হাতকাটা গেঞ্জী পরা । পায়ে একটা ডাকব্যাক কোম্পানীর গামবুট। এক হাতে একটা একগজ মত কাঠের ডান্ডা, দরজার খিল মত যা’হোক কিছু একটা হবে । অন্য হাতে একটা ঠোঙ্গা, তার থেকে জিলিপী ছড়াতে ছড়াতে চলেছে, সাথে গোটা দশেক রাস্তার কুকুর, বুড়িকে ঘিরে তারা গার্ড-অব-অনার দিয়ে জিলিপী খেতে খেতে চলেছে । 

বুড়িকে কিছু বলার আগেই সে একদমে বলে গেল, ‘কেমন আছো দেবুদা, ও বাড়িতে আর যাওনা বুঝি, তা’বেশ, সে যাকগে, তুমি বুঝি রোজ এই সময়ে আসো মর্নিংওয়াকে, আচ্ছা তাও বেশ ভালো । এখানে একটা কথা বলে রাখি, চিরকাল সব কথায় এই ‘বেশ’ আর ‘ভালো’ মুদ্রাদোষের জন্য অনেকবার বিপদে পড়েছে সে । যেমন তার কোন বন্ধুর মাতৃবিয়োগের খবর পেয়ে সেই বন্ধুকে সে বলেছিল,’তা ভালো, অনেকদিন তো বাঁচা হয়ে গেছে, কেমন বেশ চলে গেলেন, এই বয়সে বেঁচে থাকার বড়ো কষ্ট ।‘ 

তাকে যখন তার হাতের লাঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলুম, সে বললে, ‘আমি তো রোজ ভোর চারটেতে আসি, তখন এত কুকুরের উৎপাত থাকে তাই এই লাঠিটা আনি, কুকুরেরা এখন আমার কাছে আর অত ভোরে ঘেঁষে না লাঠি দেখে। 

আমি বললাম, কিন্তু বুড়ি, কুকুররা তো দেখছি সব ‘লেঠেল-তুমি’র সাথেই চলছে, আর তুমিই বা খামোকা ওদের জিলিপী খাওয়াচ্ছ কেন ? 

বুড়ি হাসলে, হেসে বললে, দেবুদা, কি আর বলি ! আমি যে বৈষ্ণব তা ওরা বুঝে গেছে, আর আমি আসলে যে ওদের কিছুতেই মারতে পারব না তাও জেনে ফেলেছে । তাই অত ভোরে লোকজন না থাকলে বেশী কাছে ঘেঁষে না। 

কিন্তু একটু লোকজন বাড়তে শুরু হলে তখন সাহস পায়, তখন এসে পায়ে পায়ে চলতে শুরু করে। কেষ্টর জীব তো, আমারও একটু মায়া পড়ে গেছে, তাই মাঝে মাঝে ওদের একটু গরম জিলিপী খাওয়াই । তুমি খাবে নাকি এক পিস ? 

আমি বললাম, না ভাই, আমি ওই জিলিপী খেলে কুকুররা রেগে যাবে, বলবে তোমার এখনো কুকুরত্বে প্রমোশন হয় নি, তুমি তবে আমাদের ভাগের জিলিপী খাবে কেন ! সে যা হোক গে, এখন তুমি বলত, এই যে তুমি কুকুরদের জন্য লাঠিও আনছো, আবার জিলিপীও খাওয়াচ্ছ, এই দুই উলটো, ব্যাপার কি ভাবে মেলাচ্ছো ভাই ? 

বুড়ি অম্লান বদনে বললে, এটা আমি সাহেবদের কাছ থেকে শিখেছি দেবুদা, একে বলে Carrot & Stick Theory. এই থিয়োরীতে তুমি কাউকে যখন পিটবে, তখন মাঝে মাঝে তাকে গাজরের হালুয়া খাওয়াবে, এই জগতে এখন এই থিয়োরীরই জয়-জয়াকার, খুব চলছে ! 

আমি বললাম, কিন্তু এটা কেমন ব্যাপার হল ? 

বুড়ি বললে, বুঝতে পারলে না ! নাঃ, তোমার শেখার আর কোনই আশা নেই দেখছি ! আচ্ছা, একটা এক্সাম্পল দি, এই ধরো গাজায় ইজরায়েল বোমা ফেলে বাচ্চাদের মারচে তো, আবার দেখো সেখানে বন্ধুদের দিয়ে মড়াদের বাঁচানোর জন্য কি সুন্দর ওষুধপত্তর পাঠাচ্ছে । 

আর তাছাড়া, দেবুদা, এখন আর কেউ অত কিছু মেলায় না, যার যখন যা ইচ্ছে করে, তাই করে। তুমি যা করবে তাই নিয়ম হবে, দেখছো না চাদ্দিকে ! সে যাকগে, এখন চলি, আপিসের দেরী হয়ে যাবে । 

এই বলে আমার আর কোন উত্তরটুত্তোর না শুনেই বুড়ি হনহন করে তার কুকুরদের নিয়ে জিলিপী খাওয়াতে খাওয়াতে হাঁটা লাগাল ওই পাড়ার দিকে। 

আর আমি বুড়ির কথাটা ভাবতে ভাবতে রেলকোম্পানীর গাছের ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম উল্টোদিকে ।

14 comments:

3

রম্য রচনা: সৌরেন চট্টপাধ্যায়

Posted in




রম্য রচনা



যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক 
সৌরেন  চট্টপাধ্যায় 


এত কি ভাবছেন মশাই? দিনগুলো চলে যাচ্ছে ঢেউয়ের মতন, অথচ কি পেলেন আর কি পেলেন না -- মোদ্দা হিসেব তো সেটাই! তাই নিয়ে এত্তো চিন্তা! 

তা একদিক দিয়ে নেহাৎ কমটাই বা কি হয়েছে দাদা? পার্টির গুরুর ন্যাজ ধরে মোটা মাইনের সরকারি চাকরি, নামকরা আবাসনে মাটি থেকে অত উঁচুতে অমন একখানা হাল ফ্যাশানে সাজানো জম্পেশ নিরিবিলি ফ্যালাট, গ্যারাজে পড়শির চোখ টাটানো ঝাঁ চকচকে নতুন মডেলের রথ! দামী জুতোয় চেকনাই পালিশ, ডিজাইনারের শার্ট! কামানো গালে, বগলে আর রুমালে ভাঁজে ভেবে চিন্তে লাগানো সুগন্ধি নির্যাসে কামনার অঢেল গন্ধ! মাস গেলে বড়দরের গোলামির নিশ্চিৎ পুরস্কার, সঙ্গে আবার নিজের পুরুষাকারে বাঁ হাতে অর্জিত কিঞ্চিৎ এক্সট্রা! 

একজোড়া ধেরে কপোত-কপোতী আর হিসেব কষে ডিমে তা দিয়ে ফোটানো দুটো গাব্দা-গোব্দা হাম্পটি ডাম্পটি। কোথাও তো এতোটুকু খামতি নেই! বেশ তো আছেন, ইহলোকে আর কি চাই, দাদা! 

বুড়ো গাছদুটোকে তো বেশ কায়দা করে বৃদ্ধাশ্রমের বাগানে পুঁতে দিয়ে এসেছেন। তা একরকম ভালোই করেছেন। সেকেলে সিজনড মাল, আপনাদের মত টবের বাহারি লতাদের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছিল না। কি রকম ঝরঝরে লাগছে এখন বলুন দিকি! 

উইকএণ্ডে জরুরী কাজের ছুতোয় কোন বিলাস মৌচাকে সুন্দরী মক্ষীরাণীর সঙ্গে অভিজাত অভিসারের অসভ্যতায় স্ট্যাটাস বজায় রাখা, মাঝে মধ্যে ছুটিছাটায় (পরের পয়সায়) পাহাড় কিংবা সমুদ্র সৈকতে সপরিবারে বিলিতি কায়দায় বিশ্রাম, আপিসের কর্তার ঠ্যাঙে নানা ধরণের তেল-টেল মাখিয়ে বিদেশ ভ্রমণ! কিছুই তো বাদ নেই ওস্তাদ! 

না, না, চটে যাবেন না স্যার, চটে যাবেন না। এই সবেই তো আপনার ফাইভ স্টার পরিচয়! কে না জানে ওটুকু না থাকলে ভদ্দরলোক আর ফালতু লোকের মধ্যে ফারাকটাই বা থাকে কি করে বলুন! চেনা মনুষদের সঙ্গেও মেপে কথা বলতে হবে বইকি, হাজার হোক নিজের হাই লেবেলটা তো ঠিক রাখতে হবে! একটা লক্ষণগণ্ডী তো থাকা দরকার না কি! বন্ধু আর আপনজনদের স্ট্যাটাসও তো ম্যাচিং হতে হবে মোজা আর টাই-এর রঙের মত! ঠিক কি না! না হলে তো মুখ ঘুরিয়ে নিতেই হবে, ইজ্জৎ বলে কথা! 

সাতসকালে বাচ্চাদের ট্যাঁস বানানোর কারখানায় চালান দিয়ে আকাশবাসিনী সইদের সঙ্গে গিন্নীর জমিয়ে পি.এন.পি.সি, দুপুরে পার্লার-বিহার আর শপিং মলে মার্কেটিং; সন্ধ্যেয় আবার দূরদর্শনে শ্বাশুরী-বউএর সিরিয়ালে ঝগড়া আর শাড়ি-গয়নার বাহার দর্শন -- সবই চলছে নিখুঁত যন্ত্রের মত। ওসবে আবার নাক গলালেই তো মুশকিল, তাই না দাদা! 

রাতে একটু ফিল্মি স্টাইলে টং হয়ে ফিরে আভিজাত্যের মুখোশটা খুলে রেখে কাঁচা খিস্তি আর টুকটাক ভাঙচুরের মধ্যে প্রেমের সিরিয়ালটাও হয়ে যায় প্রাণহীন যন্ত্রের মত। পরের দিন সকালে আবার সেই সুখী গৃহকোণ! বাঃ বাঃ বেড়ে খেল দেখাচ্ছেন মাইরী! এক্কেবারে ওই কাপড় কোম্পানীর 'কমপ্লীট ম্যান'।
তো এত্তো  সব  সুখের ভীড়ে দুঃখু  বেচারার  ঠাঁই কোথায় বলুন তো! 

তা এ পর্যন্ত তো মন্দ হল না বস। কিন্তু! --- 

এই মারাত্মক 'কিন্তু'-টাই তো শালা পাগলা করে দেয় মাঝে মাঝে! রক্তে চিনি, হৃদয়ে টাইমিং-এর গোলমাল, মেজাজ খিটখিটে, মনটাও হারামজাদা মনমরা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, সব কিছু যেন গড়বর করে দিচ্ছে। ওই ব্যাটা লোভী মনটা বোধ হয় একটু সুযোগ পেলেই সেই কৈশোরের মত উচ্ছল হয়ে, মুখোশ-বাঁধন সব ছিঁড়ে খুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বাধাহীন অরণ্যর মত অযান্ত্রিক হতে চায়! কি গুরু, ঠিক বলছি তো! 

এই দেখুন আবার ভাবতে বসলেন! যাচ্চলে!

3 comments: