0

ছোটগল্প: শুভ্র নীল

Posted in





ছোটগল্প



বিষাক্ত ভ্রমর
শুভ্র নীল



(১)

এক চিলতে সাদা আলো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল গেস্ট হাউসের সামনের অংশে। 

পাশেই চৈতালি রাতের আকাশের স্নিগ্ধ চাঁদ দেখা যাচ্ছিল।

মৃদুমন্দ বাতাসে অনবরত দোলায়মান সুউচ্চ নারকেল গাছের পাতার ফাঁক গলে ঝরে পড়ছিল জ্যোৎস্না।জ্যোৎস্নার চিলতে আবছা সাদা আলোয় যেন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে বাইরের প্রকৃতি। এই মিশ্র আলোক মেলায় সামনে ফুটন্ত ফুলগুলো আরও চমৎকার দেখাচ্ছিল। সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার রব আর কোকিলের কুহুতান থেমে থেমে।


ঠিক এই অবস্থায় বিদ্যুৎহীন রুমে বসে থাকা মানে হচ্ছে এই নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের অতি মূল্যবান ও সুন্দর সময়গুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। এক কথায় নিজেকে ঠকানো। তাই আর বন্ধ রুম এ বসে থাকতে চায়নি অনিক। বেরিয়ে পড়ল গেস্ট হাউসের বাইরে। এতক্ষণ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় মনে মনে গালিই দিচ্ছিল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু বেরিয়েই গালিটা ধন্যবাদে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। বিদ্যুৎ টা না গেলে হয়তো বদ্ধ রুমে বসে বসে জাদুর বাস্কের কারিকুরি দেখতে হতো,দরজাটা সেভাবে খোলাও হতোনা। আর এই মোহনীয় প্রকৃতির রূপ ও দর্শন হতোনা।


গেস্ট হাউসের সিঁড়ি পাড় হতেই চিলতে আলোয় চোখ পড়ে অনিকের। বুঝতে চাইলো এর উৎস কোথায়। খেয়াল করে দেখল সীমানা প্রাচীরের বাইরে প্রাচীরঘেঁষা একটা দোতলা বাড়ির খোলা জানালা। হয়তো আইপিএস বা চার্জ লাইটের আলো।আলোর গতিপথ খেয়াল করে দৃষ্টিকে নিয়ে গেলো আলোর একেবারে উৎসমূলে। দেখা গেলো টেবিলে খোলাচুলে চসমা পরা একটা মেয়ে একমনে পড়ছে। একটু অবাক হল অনিক। এমন মুহূর্তে বিদ্যুৎহীন রুমে এই গরমে বসে বসে এইভাবে কেউ পড়ে!বাইরের এত সুন্দর রূপ বাদ দিয়ে এইভাবে নিবিড় দৃষ্টিতে কপালে হাত রেখে বইয়ের দিয়ে তাকিয়ে আছে। জীবনে তো অনেক পড়ুয়া লোকের দেখা মিলেছে, এই হল তার একটা ভার্সন বা উদাহরণ!! মৃদু বাতাসে থেমে থেমে কুহুতান আর ঝিঁঝিঁ রবে মন অন্যদিকে ঘুরল অনিকের। পুরো কাম্পাসে পায়চারী করতে শুরু করল সে। হাতে একটা গোলাপ নিয়ে হাঁটতে থাকল। একটু দূরে কেউ একজন গিটার বাজিয়ে গান গাইছে-
 নীলাঞ্জনা, ঐ নীল নীল চোখে চেয়ে দেখনা...।
শেখ ইশতিয়াকের সেই গানটি। গান আর পায়চারীর ফাঁকে ফাঁকে নজর চলে যায় সীমানার বাইরের বাড়িটার খোলা জানালায়। মেয়েটা তখনো পড়ছে। অনিক মনে মনে ভাবল- কি অদ্ভুত রে বাবা! অনেকক্ষণ এইভাবে হাঁটার পর বিদ্যুৎ আসল। ক্ষণিকের এই পসরাও যেন ভাঙল। যে যার যার ঘরে ফিরতে লাগলো। রাত কম হয়নি, সাড়ে ১১ টা প্রায়। অনিক ও রুমের দিকে যেতে লাগলো। দেখল মেয়েটি তখনো পড়ছে এবার বিদ্যুতের আলোতে।


রুমে ঢুকেও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মেয়েটার কথা। রাত শেষ হয়ে নতুন এক স্নিদ্ধ সকাল আসে। হোক না কোন এক বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে সে হয়তো সংগ্রামরত, তারপরও এত সিরিয়াস লোক দেখলে কাউকে আঁতেল আঁতেল লাগে অনিকের। অবশ্য অতি মেধাবীরা একটু আঁতেল টাইপেরই হয়! বিশ্ববিখ্যাত মেধাবীদের জীবন ইতিহাস ঘাটলে এমন অনেক প্রমাণ মেলে। এরপর অনিক ল্যাপটপ খুলে বসে তার কিছু কাজ আর একটু ফেইসবুকিং করার জন্য। অনেকক্ষণ টাইপ করার পর ভাবল একটু বাইরে থেকে ঘুরে এসে ঘুমিয়ে
যাবে। তখন রাত প্রায় ১.৩০। বাইরে রাতের প্যাঁচারা ডাকছে। দরজা খুলে বের হতেই আবারো চোখ চলে গেলো পাশের বিল্ডিং এর দোতলায়। দেখল, চশমিস মেয়েটা বাইরের দিকে তাকিয়ে যেন এই জ্যোৎস্না রাতের রূপ দেখছে। অনিক ভাবল, এবার বোধ হয় মেয়েটার বোধোদয় হল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা অনিকের দিকে একমনে তাকিয়ে যেন কিছু একটা বলছে সে। অনিক প্রথমে অবাক হল, কিন্তু পড়ে বুঝতে বাকি থাকলো না যে সে তার আয়ত্ত্ব করা পড়া রিভিশন দেয়ার চেষ্টা করছে। এবার নিজেকেই আঁতেল মনে হল অনিকের। রাতের প্যাঁচাগুলো যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। মৃদু বাতাসে দোলায়মান নারকেল গাছের ফাঁকে চাঁদও যেন মুচকি হাসল। সদ্য ফোটা রাতের ফুলেরাও যেন একটু ভেংচি কেটে দিল। অনিক রুমে ফিরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল কিছুটা বোকা বোকা ভাব নিয়ে। 


রাত ভোর হয়। রাতে দেরি করে ঘুমায় বলে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙ্গে অনিকের। এটা তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অভ্যাস। এভাবে রাগ জেগে একটু-আধটু পড়েছে বলেই হয়তো আজ সে এমন জায়গায়, একজন নবীন সরকারি অফিসার। ঐ মেয়েটিও হয়তো সে পথেই হাঁটছে। সকালে উঠে প্রাত্যহিক কাজ সেরে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে অনেক সময় সকালের রূপ টাও সেভাবে দেখা হয়না। তবুও অফিসে যাওয়া ও ফেরার পথে অজান্তেই চোখ চলে যায় পাশের দোতলায়। অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন বিকেলেই একটু হাঁটার জন্য বেরিয়ে পড়ে অনিক। একটা কোকিল ডাকা বিকেল, বিষণ্ণ সন্ধ্যায় একটু প্রশান্তির খোঁজে মন আকুল হয় অনিকের। বাইরে বেরোলেই দৃষ্টি যেন খোঁজে ফেরে কাউকে পাশের কোন ভবনের দোতলার ছাদের অংশটায়। দোতলার সেই রুমটার সামনেই ছাদ টাইপের অনেক খানি খোলা জায়গা। কোন বিকেলে সেই চশমিস কে দেখা যায়, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। খোলা চুল, সুন্দর মায়াবী চেহারা, লাল গোলাপ ঠোঁটে যেন ফুল ফুটে আছে।রাতের পড়ার টেবিলে ঠিক যতটাই আঁতেল লাগত, এখন ঠিক ততটাই মোহনীয় লাগে। দিনের প্রতিটি ক্ষণে প্রকৃতির এক একটা রূপের মাঝে ভালোলাগার এক নতুন মাত্রা যোগ হয় অনিকের। এভাবে চলতে চলতে একসময় মেয়েটির ও নজর যায় অনিকের দিকে। বুঝতে পারে অনিক বোধ হয় তাকে ফলো করে। এভাবে তাদের নজর বিনিময় চলতে থাকে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলতে পারেনা, বলার সুযোগও আসেনা। দুজনের মধ্যেই যেন একটা ভালোলাগা কাজ করতে থাকে। সেই ভালোলাগা যেন কখনো কখনো ভালোবাসার মুচকি হাসি হয়ে মিলিয়ে যায় ফুলেদের, চাঁদের হাসির সাথে।

(২)

দিন যায়। মাঝে মাঝে ঐ বাড়িটায় একটা হোঁৎকা কালো মোটা লোক দেখা যায়। যেমন কুৎসিৎ তার চেহারা, তেমন কর্কশ তার কণ্ঠ। তাদের সম্পর্ক নির্ণয়ে ঝামেলা লেগে যায় অনিকের মনে। মাঝে মাঝে মুরুব্বি টাইপেরও কিছু লোকজন দেখা যায়। অত সময়ও হয়ত হয়ে ওঠেনা অনিকের। তবে সাজানো ফুল বাগানে এক বিষাক্ত কালো ভ্রমরের মতই মনে হল তার কাছে। মেয়েটি এখন মাঝে মাঝে রাতেও বের হয় ছাদে। এখন আর আগের মত আঁতেল আঁতেল মনে হয় না। তবে টাইম টু টাইম পড়া ঠিকই চলে। মাঝে মাঝে রাতে ঐ বাড়ি থেকে কিছু হৈহল্লার শব্দ আসে, কিছু ধুপ-ধাপ শব্দ আসে। অবাক হয় অনিক। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে কষ্ট হয়, কি হচ্ছে!? সেরকম কোন কোন দিন আর মেয়েটিকে পড়তেও দেখা যায়না বা টেবিলে হয়তো মুখ বুঝে পড়ে থাকে। সন্দেহ গভীর হতে থাকে অনিকের।


অনেকদিন ছুটি পায়না অনিক। এবার শুক্র-শনি দুইদিন বাড়িতে ঘুরে আসতে গেলো সে। কতদিন মায়ের মুখ খানা দেখা হয়না তার। ছুটি কাটিয়ে যথারীতি ফিরে আসে। রবিবার সকালে এসেই আবার অফিসের উদ্দেশ্যে ছোটে। পাশের বাসাটা আজ একটু নীরব নীরব লাগছে। কিছুটা ভাবনা আসে তার মনে। সারাদিনের অফিস সেরে আবার যখন ফিরে আসল তখনো বাসাটায় নীরব ভাব। ওপাশের প্রকৃতিও যেন আজ মন খারাপ করে আছে। সন্ধ্যা হয়, স্নিগ্ধ বাতাসও ছোটে, ফুলেরা দোলে। সবই  ঠিক আছে কিন্তু ওপাশের বাড়িটায় আলো জ্বলেনা। গেস্ট হাউজের বয় কে ডেকে জিজ্ঞাসা করে পাশের বাসাটি এত নীরব কেন। কিন্তু সেও ভালোভাবে বলতে পারছিল না। এভাবে সে রাত পার হয়। ভাবনা ঘিরে ধরে তাকে। এক অদ্ভুত নীরবতা ফুটে উঠে যেন এক পাশে। নীরবতার মাঝেই যেন ভাবনাগুলো গতি পায়, এই গতি আর গতিপথ পাল্টানো ভাবনাগুলো মাঝে মাঝে কিছু জটিল সমীকরণ তৈরি করে মনের মধ্যে। সকাল হতেই গেস্ট হাউজের মালি এসে কয়েকটা তাজা ফুল দিয়ে যায়। মালিকে ধন্যবাদ দিয়ে পাশের বাড়ির বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সেও কিছু বলতে পারলনা। এভাবে দু-তিন দিন কাটে। পাশের এই বাড়িটিতে সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ভালোবাসার মায়াময় উদ্যান যেন শূন্য বিরানভুমিতে পরিনত হচ্ছিল। অনিকের মনে প্রশ্নের উদয় হয়- কোন খারাপ কিছু ঘটেনি তো!


(৩)

প্রতিদিনের মত অনিক অফিসে বসে আছে। থানায় এটাচমেন্ট পিরিয়ড চলছে তার। প্রতিদিন এখানে হরেক রকমের মানুষ আসে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে, বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে। সে রকমই এই সকালেও দুজন বৃদ্ধ- বৃদ্ধা আসল। এসেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওসি সাহেবকে তার মেয়েকে বাঁচাতে বলতে বলছে। বরাবরের মতই বিবাহ পরবর্তী নির্যাতন ও যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ। তাঁর মেয়েকে মারাত্মক জখম করেছে মেয়েটির স্বামী। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। ডিউটি অফিসারকে ডেকে মামলা রেকর্ড করতে বললেন ওসি। অনিক অন্যদিকে দৃষ্টি দিল। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও, এখন ভাবে- থানায় এসব নৈমিত্তিক ঘটনা। তবে বৃদ্ধ- বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগলো তার। ওনাদের অসহায়ত্ব আর সরলতা মনোযোগ আকর্ষণ করল। তারপর জিজ্ঞেস করল-


- কি হয়েছে আপনাদের মেয়ের?


অনিকের সরবতা দেখে বৃদ্ধ নড়েচড়ে বসলেন। তারপর খুব অনুনয়ের সাথে বললেন-


- বাবা, আমার মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী, মেধাবী। আমরা অভাবী বলে ওর মতের বিরুদ্ধেই এক বড়লোক ব্যবসায়ীর সাথে মেয়েটারে বিয়ে দিয়ে দেই অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই। এস এস সি ও এইচ এস সি তে জিপিএ ৫.০০ পায় সে। দেখতে সুন্দরী হওয়ায় পাত্র পক্ষ বলল - ওকে আমরা পড়ার সুযোগ দেব, ওর মেধার মূল্যায়ন করবো। পরে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। এরপর পড়ালেখাও চলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পরীক্ষা শেষ করেই সে জব এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু... বাবারে...! বলেই লোকটার গলা ভার হয়ে এল। চোখ দিয়ে কষ্ট আর ক্ষোভের অশ্রু ঝরে পড়ছিল যেন। অনিক ওনাকে স্বাভাবিক হতে বলল। তারপর বৃদ্ধাকে বলল - আপনি কিছু বলুন। তিনি ভাঙা ভাঙা বাক্যে বলা শুরু করলেন-


- এটা আমার তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। আমার কোন ছেলে নাই বাবা। দুইটা মেয়েকে কোনরকম পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়ে দেই। ওরা ভালোই আছে। আমার এই মেয়েটা একটু ভিন্ন- সংগ্রামী, পরিশ্রমী, মেধাবী এবং দেখতেও ভালো। বিয়ের পর ওর বর ব্যবসার জন্য টাকা চায় ওর কাছে। সে পরিবহন ব্যাবসার সাথে জড়িত। বলত- বিয়ের সময় তো কিছু দেয়নি, এখন তোমার বাবা-মার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আনো জমি বিক্রি করে। এভাবে বিভিন্ন সময় তাকে মারধর করত। ওর লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাত। মাঝে মধ্যে নির্মম নির্যাতন করত। বলেই বৃদ্ধ মা ও কান্না করতে লাগলেন।


ওনাদের এই আবেগ অনিক কেও আক্রান্ত করতে চাইছিল। পরক্ষণেই আবার মেয়ের বাবা শুরু করলেন-


-গত কয়েকদিন আগের নির্যাতনটা খুব বেশি ছিল। অন্যান্যবার আমরাও ভাবতাম, মেয়েও ভাবত আগে তার লক্ষ্য অর্জন হোক- একটা ভালো জব হোক। ওর পড়াশোনাটাকেও যেন সহ্য হচ্ছিল না তার। আবার গলা ভারী হয়ে আসল ওনার।



অনিক তাঁদের বিষয়টা দেখার আশ্বাস দিল।


(৪)

এফ আই আর পর্যালোচনায় দেখা যায় মেয়েটার নাম পুষ্প (২৪)।আর তার ঠিকানাও অনিকের গেস্ট হাউসের কাছেই। মনে মনে ভয় আর সন্দেহ জাগে- এই সেই মেয়েটিই নয়ত!!? মামলার তদন্তকারী অফিসারের সাথে কথা হয় অনিকের। সে পুরো মামলার বিষয়ে তার সাথে সাথেই থাকতে চায়। সেদিনই তারা হসপিটালে যায় ভিকটিমকে দেখতে, ঘটনাস্থল দেখতে। ঘটনাস্থলে এসে দেখা যায়, সেই দোতলা বাড়িটাই। অনিকের মাথা যেন চক্কর দিল, হাত যেন কাঁপছিল, গলা যেন শুকিয়ে আসছিল। ভাবছিল এইভাবেই ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষের নাম জানতে হবে!! তার সাথে পরিচয় হবে!! তাকে দেখতে হবে!! তাহলে ঐ কালো, কুৎসিত লোকটা কে?- পুষ্পর  বর?! ঐ হৈহল্লা আর ধুপধাপ শব্দ আর পরবর্তী নীরবতা টাই বা কি?! মনে মনে সেই সাজানো প্রকৃতির সবকিছুকে মনে হচ্ছিল যেন এক একটা প্রহসনের উপকরণ। এই চাঁদ, ফুল, কোকিল, দখিনা হাওয়া এরা তো এমন করতে পারেনা!! এরপর আর ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ঘটনার পর থেকে পুষ্পর  বর পলাতক। খুব মন খারাপ হয় তার। চোখও ঝাপসা হয়ে আসে।


মনের গহীনে একরাশ হাহাকার আর অদৃশ্য ক্রন্দন নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল অনিক। সাথের অফিসার অনিক কে বলল-

-স্যার, কিছু হয়েছে? আপনার মুড অফ কেন?

- না, কিছু না...! ঘটনাটা শুনে একটু খারাপ লাগলো।

-হুম! কিন্তু এমন হঠাৎ নীরবতা আর আপনাকেও যেন কেমন লাগছে।

মনে মনে অনিক বলতে থাকে - এইভাবে আমিও একটা গভীর ষড়যন্ত্রের/ প্রহসনের শিকার! সব হারানো মানুষ, যেভাবে হাহাকারের পর গভীর নীরবতার মাঝে সব কিছুর সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করে, আমার অবস্থা অনেকটা সেরকমই।


ভাবনার দোলাচলে দোল খেতে খেতে গাড়ি হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। মনে মনে অনিকের অস্থিরতা বাড়ে। দ্রুত নির্দিষ্ট কক্ষে গেলো। দরজা খুলতেই চোখ পড়ল সুন্দর মুখটার উপর। যাকে এই কয়েকদিন মনে মনে খুঁজেছে। যার উপস্থিতিতে পূর্ণিমার ভরা চাঁদ, ঝির ঝির হাওয়ায় দোলায়মান ফুটন্ত ফুলের শাখা-প্রশাখার রূপ, কোকিলের কুহুতান- সবই পরিপূর্ণ ছিল। যেন পূর্ণিমার সেই ভরা চাঁদ আহত হয়ে পরে আছে। ওপাশটা আজ বর্ণহীন। খুব কষ্ট লাগছিলো অনিকের- পুষ্পর  কপালে একটা ব্যান্ডেজ আছে। বাম পাশের চোখটা জখম  হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়েছে। এখন সেই ধুপধাপ শব্দের মিনিং টা পরিস্কার অনিকের কাছে। একটা পবিত্র ফুলের উপর বিষাক্ত কীটের আঁচড়!! এইরকম একটা মেয়ে যার ঘরে আছে সে তো অনেক সৌভাগ্যবান! কোন জনমের পুণ্যের ফল হয়তো পেয়েছে ঐ কুৎসিত গর্দভ টা। রাগে-ক্ষোভে যেন ফুঁসছিল অনিক। তদন্তকারী অফিসার ভিকটিমের সাথে কথা বলবে। অনিক আর পারছিল না। বলল- আমি একটু ওয়াশ রুম থেকে আসি, চোখ জ্বালা করছে।


অনিক আসার পর পুষ্পকে  ডাকা হল। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলতেই চোখ চোখ পড়ল অনিকের চোখে। এত কষ্টের মাঝেও একটা উজ্জ্বল হাসি যেন। অনিকও অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে দুজনের সাথে পরিচয় হবে, কথা হবে এটা সত্যিই মেনে নিতে পারছিলনা কেউই। পুষ্প  একটু হাসি দিয়ে উঠতে চাইলো। কিন্তু নার্স বারণ করল। অনিকের দিকে তাকিয়ে শুধু অস্ফুট শ্বরে বলল-


-আ...প...নি?! আমাকে দেখতে আসলেন?


এই যন্ত্রনার মধ্যেও এই ঝলমলে হাসির অর্থ আর বোঝার বাকি থাকেনি অনিকের কাছে। শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানাল।


পুষ্পর  চোখ দিয়ে অশ্রু স্রোতের বাধাহীন প্রবাহ শুরু হচ্ছিল। অনিক ও ঠিক থাকতে পারছিলনা। আবার ওয়াশ রুমে গিয়ে আসল। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল। কাঁদতে কাদতেই পুষ্প বলতে থাকে-


-আমি তো শুধু একটু সাপোর্ট চেয়েছিলাম, শুধু একটু ভালোবাসার আশ্বাস। আমি যে সংগ্রামরত। আর তো কয়টা দিন। তবুও......... ও করল না, করেনা!


এরপর অফিসার তাকে আরও বিস্তারিত জিজ্ঞেস করল। যাবার সময় অনিক পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলল-


-আপনি হারবেন না! হারতে পারেন না। আপনি অবশ্যই জয়ী হবেন। ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নিবেন।


-আপনি অনেক ভালো! আপনিও ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।


বিদায় বলেই হাত নাড়ায় দুজন। পুষ্পর চোখে আবার প্রবাহ ধারা। অনিকের চোখের কোনে শিশির বিন্দু। যেতে যেতে অফিসার বলল-


-স্যার, আপনারা কি একে অপরকে চিনতেন?


-হুম। কিন্তু কথা হয়নি কোনদিন। আমি যে গেস্ট হাউসে থাকি তার পাশেই ওনার বাসা। বের হলেই, আসতে-যেতে দেখাদেখি হতো।


ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস!


একসময় থানায় দুই মাস প্রবেশন টাইম শেষ হয়। যাওয়ার সময় হয়ে যায়। মামলার তদন্ত চলমান। এর শেষ দেখে যাওয়া হলনা অনিকের। একসময় মূল আসামী ধরা পরে। সবকিছু শিকার ও করে। অনিক পুষ্পর খোঁজ খবর নিত বিভিন্ন মাধ্যমে। চলে যায় অনিক- শুধু শরীরটা নিয়েই, কিন্তু মন যে তার এখানে। এরপর পুরো প্রবেশন টাইম শেষ হয়। ঐ জেলা ফেলে চলে যায় অন্য ইউনিটে, নতুন পোস্টিং নিয়ে। 


এরপর একদিন অনিক জানতে পারে, পুষ্প কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেছে। অনিক শুনে খুবই খুশি হয়। ঐ মামলাটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুষ্পের জব হওয়ার পর বাবা-মাকে বলে সে মামলা উঠিয়ে নেয়। নিজেও সুস্থ হয়ে উঠে। অনিকের ও অনেক খোঁজ করে, খবরাখবর নিতে চাইত কিন্তু সেভাবে খোঁজ ও পায়নি। পুষ্প নাকি মাফ করে দেয় ওর বরকে। কারণ বিজয় মুকুট তার ক্ষমাশীলতা ও ভালোবাসার ব্যাপ্তি টা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ওরা নাকি ভালোই আছে। বর ও এখন আর ওকে নির্যাতন করেনা। অপ্রাপ্তি কিন্তু একটা সুখের বোধ আসে অনিকের মনে। মনে মনে বলে- সুখে থেকো, ভালো থেকো! আর একটা প্রশ্ন তার মনে এখনো ঘুরপাক খায়- নিজেকে এভাবে আড়াল করে পবিত্র কোন কিছুর অমর্যাদা করেনি তো!

0 comments: