ছোটগল্প: অরুণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বলি
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
তা অন্ততঃ একশ-সওয়া'শ বছর আগে ছিল। এখন নেই। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অবস্থাটা ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে । বিলাসিতার নদীতে নয়, সাগরে ডুবে ছিলেন জমিদার অনন্ত মুখোপাধ্যায় ।
বিলাসিতা ছাড়া আভিজাত্যের প্রকাশ হয় না ঠিকভাবে, এমন ছিল মত তাঁর । কিন্তু আয়ের সঙ্গে ব্যয় পা মিলিয়ে চলতে পারে নি । ফলে দেনার সাগরে ডুবতে বসেছিল জমিদারী । এক এক করে মৌজার পর মৌজা বিক্রি হতে হতে হাতে পড়ে থাকা ভাবনার সঙ্গী পেনসিলটার মতই পড়েছিল সংস্কারহীন ভাঙ্গাচোরা বিশাল বাড়িটা ।
জমিদারীটা নেই তবে মেজাজটা আছে তার নিজস্ব ভঙ্গিতেই । শারদীয়া পুজোয় মা কাত্যায়নীর আরাধনা এই মেজাজের একটা দিক । বেশ ধুমধাম করে এই পুজো হয় প্রতিবার ।
দরিদ্রসেবা, কাঙালভোজন, বস্ত্র-বিতরণ এরকম জনহিতকর কাজের সঙ্গে আর একটা যা আশপাশের অন্ততঃ দশটা গ্রামকে মাতিয়ে রাখত তা হল, নবমীতে পাঁঠাবলি। জমিদারের নিজস্ব একশ আটটা তো বটেই তা ছাড়া থাকত মানতের আরও বহু ।
পুজোর প্রধান পুরোহিত, তন্ত্রধারক ছাড়াও অতিরিক্ত দুজন পুরোহিত আছেন শুধু এই পাঁঠাগুলোকে স্নান করিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে বলির জন্য উৎসর্গ করতে । সোনাকামার আর নাটাকামার এগুলোকে লাইন দিয়ে বেঁধে রাখছে ।
পাশাপাশি দু-দুটো হাড়িকাঠ রেডি করা আছে। পাশে রাখা আছে তীক্ষ্ণধার দুটো খাঁড়া । পাশে সার দিয়ে বেঁধে রাখা নিরীহ পশুগুলো মাঝে মাঝে ডাকছে । তাদের এই ডাক হয়ত নিছক কৌতূহলে অথবা খিদে পেয়ে যাবার জন্যে । না হলে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তাদের মত অবোধ পশুরা আর অবহিতই বা হবে কি করে ?
বিরাট ধুমধাম । বিশাল লোকের মেলা । মণ্ডপের বাইরে সত্যিকারের মেলাও বসেছে । সেখানে নানান খেলনা, পুতুল আর গৃহ সজ্জার জিনিসের পাশে বাচ্চা ছেলেমেয়ে আর নানান বয়েসের মেয়েদের ভীড় ।
সারা বছর জমিদারবাড়ি খাঁ খাঁ করে । সাবেক জমিদারীর প্রতীক বিরাট বিরাট থামওলা বিশাল বিশাল ঘরে ভরা বাড়িটা মাত্র জনাতিনেক বাসিন্দাকে গিলে খাবার তৃপ্তি অনুভব করে । জমিদারের উত্তরসুরি রমেশ মুখুজ্জে রেলের চাকরি থেকে বছর দুয়েক আগে অবসর নিয়েছেন । বৌ মারা গেছে বছর দশেক আগে । মেয়ে ললিতা বিধবা হয়ে পাকাপাকিভাবে বাপের বাড়িতে এসেছে তার বিয়ের পরের বছর থেকেই । আর বিয়ে সে করে নি । শ্বশুরবাড়ি তার স্বামীর সম্পত্তি থেকেও তাকে বঞ্চিত করেছে । রমেশবাবু কেস করেন নি । ভীষণ সাদাসিধে লোক তো ।
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার । থাকে কলকাতার বাইরে । বছরে একবার আসে এই পুজোর সময় । বিয়ে হয় নি অথবা করে নি । আর মা নেই, তাই সেটা দেবার চাড়ও নেই হয়ত কারো ।
বেশ একটু আবেগপ্রবণ মানুষ তো বটেই, জীবজন্তুদেরও কষ্ট দেখতে পারে না । তাই বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে অনেকেরই 'খোরাক' হতে হয় তাকে । একটু আধটু কাব্যচর্চা করে । বোধহয় সেই আবেগেরই তাড়নায় ।
নীলের এবারে বাড়ী আসতে দেরি হয়েছে । প্রাইভেট কোম্পানী । কাজটা কর্মীর হাতে হলেও ছুটিটা মালিকের হাতে । আর সেটা ক্যালেন্ডারের লাল কালির দাগ মানতে চায় না কিছুতেই । তাই অষ্টমী অবধি অফিস খোলা ।
বলি শুরু হয়ে গেছে । ঢাকের তালে নাচছে ঢাকি । সেই সঙ্গে কাঁসর ঘণ্টা ঘড়ি শাঁখ কত কি । মণ্ডপে ভীড়, ধূপ আর ধুনোর গন্ধে ম ম । পুরোহিতের গমগমে মন্ত্রোচ্চারণ । মানুষের হাসিগল্প আর ভক্তি গদগদ উচ্ছ্বাস ।
ঠিক পাশেই একটা মণ্ডপে বলির আয়োজন । এক একটা পাঁঠাকে হাড়কাঠে আটকে দিচ্ছে একজন । আর সোনা আর নাটাকামারের চকচকে ধারালো খাঁড়া গুলো চকিতে আকাশের বিজলির মত চমকাচ্ছে । ওদের দাঁড়ানোর সময় অবধি নেই । ওরা চোখ খুলে কিংবা চোখ বুজে আছে তাও তারা জানে না । কেননা তাদের সে অনুভূতিই নেই এখন । এখন তারা আর মানুষ নয় । এক একটা কলের পুতুল যেন । যান্ত্রিক গতিতে খাঁড়াগুলো নেমে আসছে পাঁঠাগুলোর ঘাড়ে । একেবারে চুলচেরা পরিমাপে । এতটুকু দিকভ্রম নেই । নেই এতটুকু কৌণিক বিচ্যুতিও ।
মুণ্ডুগুলো সব ছিটকে পড়ছে ওপাশে । সেগুলোর একটা অংশ নাকি সোনা আর নাটা কামারের প্রাপ্য । চুক্তি আগেই হয়ে আছে । সোনা আর নাটা জাত-মাতালের মত তাল ঠিক রেখে সেই মুণ্ডুগুলো গুনে চলেছে । সবার শেষে ধড় আর মুণ্ডুর সংখ্যা মিলিয়ে দেখা হবে । পাওনা গণ্ডার সব হিসেব মুখে মুখে আর মনে মনেই আছে । কোনও গণনা যন্ত্রের প্রয়োজন নেই ।
দরদরিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে গঙ্গার মত । তবে এই গঙ্গার জলের রঙ টকটকে লাল। কজন লোক কোদাল হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে । মাঝে মাঝে তারা হাতের কোদাল দিয়ে নালা আরও চওড়া করে দিচ্ছে । পবিত্র রক্তের স্রোত বাধাহীন আনন্দে বয়ে চলেছে নিজ লক্ষ্যের দিকে ।
হঠাৎ বলির মণ্ডপে একটা হৈ হৈ । বলি প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম । সোনা আর নাটা দুজনেই কোমরে দুহাত দিয়ে সঙের মত দাঁড়িয়ে । চোখ তাদের টকটকে লাল ।
কি হল ব্যাপারটা ? তবে কি পাওনাকড়ি বা মুণ্ডু ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা বেধেছে ওদের মধ্যে ? কিন্তু সব হুল্লোড় ছাপিয়ে একটা পুরুষ কণ্ঠ ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে । আর সব কণ্ঠ অস্পষ্ট হচ্ছে ।
গলাটা নীলের ।
- এসব চলবে না । এভাবে অকারণে নিরীহ পশুদের হত্যা করা কেন ? তোমরা বলি বন্ধ কর ।
জমিদারী না থাক, জমিদার আছে । ইঞ্জিনিয়ার হোক আর যাই হোক, গাঁয়ে তো তার পরিচয় জমিদারপুত্র বলেই । সুতরাং সম্ভ্রমের পাল্লায় বেশ একটু ঝুঁকেই থাকবে নীল । সকলে চুপ করে গেল । দু-একজন বয়স্ক কিছু বোঝাতে গেল, কিন্তু নীল সে সব কানেই তুলল না ।
চেঁচামেচিতে পুজো বন্ধ করে উঠে এলেন রমেশবাবু । উঠে এল আর সব পুরোহিতরা । সব বয়স্ক আর মাতব্বররা ।
- বাবা তোমাকে বলেছিলাম না এবার পুজোয় বলি বন্ধ করতে ?
মাথা ঠাণ্ডা রাখলেও পুজোর উদ্যোক্তা আর প্রধান পুরোহিত হওয়ার সুবাদে উত্তেজনা তো একটু থাকবেই । আচার-বিচারে ঘাটতি হচ্ছে কিনা সবাই তা লক্ষ করছে । এটা একটা সম্মানের বিষয় বটে । কিন্তু এই অর্বাচীনকে এখন বোঝানোর দায়িত্বটা কে নেবে ?
- বন্ধ কর বললেই কি আর বন্ধ করা যায় ? রমেশবাবু বললেন, প্রথা রয়েছে, আচার রয়েছে।
- এতগুলো পশুর প্রাণ নষ্ট করা যায়, অথচ প্রথাকে নষ্ট করা যায় না কেন বাবা ? প্রথার তো প্রাণও নেই যে সে কষ্ট পাবে ? পশুর বদলে এমন কুপ্রথাকে বলি দাও না, কাজ দেবে।
বোঝাবার চেষ্টা করলেন বাবা ছেলেকে। ছেলে বুঝল না। বাবার ছেড়ে দেওয়া হাল এবার ধরতে এলেন পাড়ার আর গ্রামের মাতব্বরেরা । আলোচনা হতে লাগল শাস্ত্রের । তর্ক চলল শাস্ত্র আর বিজ্ঞান আর যুক্তি বোধের ।
যুক্তি হেরে গেল । কারণ সে সংখ্যার বিচারে গৌণ । নীলের সঙ্গে আরও অনেক নব্যপন্থী এল বটে তবে তারা সংখ্যা-লঘুত্বের তখমা নিয়ে অচিরে বিশ্রাম করতে গেল ।
আবার ঢাক বাজল । আবার বলি শুরু হল । সবাই নিশ্চিন্ত হল । একটা নিশ্চিত অমঙ্গলের গ্রাস থেকে রক্ষা পেল গ্রামটা ।
হাড়কাঠের দিকে জোর পায়ে এগিয়ে গেল নীল । আবার বিপদ গনল সকলে । মাথা-গরম ছেলেটা না জানি কি না কি করে বসে ? সোনা আর নাটাও খুব চিন্তিত । তাদের যদি মারধোর করে বসে মালিকের ছেলে বলে কি বলবে আর কি করবে তাই ভাবতে বসে গেল তারা ।
- বাবা, শেষবারের মত বলছি বলি বন্ধ করবে কি না ?
- না না না । বাবা দৃঢ় স্বর জানিয়ে দিল অবিচল সিদ্ধান্তটা । আর সকলের নিশ্ছিদ্র নীরবতা অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল রমেশবাবুকেই ।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে নীল । চোখের তারা স্থিরভাবে নিবদ্ধ হাড়কাঠের পশুটার দিকে । আবার বেজেছে ঢাক ঢোল শাঁখ । সোনা কামারের হাতের ধারালো খাঁড়া আবার উঠেছে তার মাথার ওপর । বিদ্যুতের মত উঠেছে ঝিলিক দিয়ে ।
সেটা নামল চকিতে । নিমেষে ঘাড় আর গর্দান আলাদা করে দিয়েছে নিখুঁত দক্ষতায় । মুণ্ডুটা চকিতে গিয়ে পড়েছে ওপারে । তবে মুণ্ডুটা পাঁঠার নয় । একটা মানুষের । নীল ছুটে গিয়ে পড়েছিল সেই খাঁড়ার নীচে । কেউ বুঝতেই পারে নি যে বাধা দেবে ।
এই অবধি পড়ে পাঠক নিশ্চয় সাব্যস্ত করবেন যে, এরপর থেকে দুঃখ, অনুতাপ আর অনুশোচনায় বলি বন্ধ হয়ে গেল ? না, তা যদি হত তবে আজও সারা পৃথিবীতে কোটী কোটী মানুষ হিংসার খড়গে বলি হচ্ছে কেন ? একটা মাত্র বলি সারা বিশ্বে কোটী কোটী নরবলি বন্ধ করে দেবে – হে পাঠক, মনুষ্য সমাজের সুবুদ্ধির এমন প্রশংসা ভুলেও করবেন না ।
0 comments: