ছোটগল্প: রুমনি সেন
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
নার্গিস
রুমনি সেন
নূর আলি যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে বউকে নিয়ে এল তার প্রতিবেশীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অপূর্ব সুন্দরী, ষোড়শী, রূপে যেন জগৎ আলো করে আছে। চল্লিশ বছরের বুড়ো নূর আলির এই বউ, অবাক কান্ড।
নূর আলির প্রথম বউ মারা গেছে তিন বছর হল। ছেলেমেয়েরা নানার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে। তারা কেমন আছে দেখার প্রয়োজনবোধ করে না নূর আলি। সে এখন ঝাড়া হাত পা। আবার বিয়ে করবে বলে অনেকদিন থেকেই পাত্রী খুঁজছিল, অবশেষে মনের মত পেয়ে গেল।
নূর আলির বউ এর নাম নার্গিস। এটা তার প্রকৃত নাম নাও হতে পারে। কিন্তু পাড়ার ছেলেরা তাকে এই নামই দিয়েছে। তারা নুর আলির বাড়ির পাশে হৈ হুল্লোড় করে। হ্যা হ্যা করে হাসে, বলে নার্গিস তুমি আমার হও। নূর আলি তাদেরকে কিছু বলার সাহস পায় না, কিন্তু বউকে বেদম পেটায়। বলে,
হারামজাদী মাগী, তোর জন্য এই ছেলেগুলো আমার বাড়ির ধারে রাতদিন ঘুর ঘুর করে।
প্রতিদিন নার্গিসের আর্ত চিৎকার শুনতে পায় প্রতিবেশীরা। বিশেষ করে রাত্রিবেলা নার্গিস সব চেয়ে মার খায়। তার চিৎকার রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে দেয়। নার্গিসের দেহে সব সময়ই আঘাতের চিহ্ন পাকাপোক্তভাবে দেখা যায়। কপাল ফুলে আছে, চোখের কোণে, ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ, হ্যাঁচকা টানে চুল ছেঁড়া পিঠে লাঠির বাড়ির লম্বা লম্বা কালো দাগ, লোকে এসব দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্বেও তাঁর সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয় নি। সে যেন ফোটা গোলাপের মত বিকশিত হয়ে আছে। দেখে সকলেরই গা জ্বালা করে। বিশেষত মহিলাদের। তারা আলোচনা করে,
মাগীর চাল চলন ভালো না। না হলে কি তাকে এমনি এমনি মারে?
আচ্ছা, এত মার খায় তবু লজ্জা হয় না কেন? শোধরায় না কেন?
এই সব নানা কথা তার সম্বন্ধে আলোচনা হয়।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নার্গিস একদিন বাপের বাড়ি পালাল। বাপের বাড়ি নামেই। বাপ নেই, ভাইদের সংসার। তারা নূর আলিকে খবর পাঠাল বউকে নিয়ে যেতে। আর বলে দিল বউকে যেন শাসন করে, এমন ভাবে স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসলে লোকে কি বলবে।
দিন যায় মাস যায়। পাড়ার ছেলেরা নার্গিসের প্রতি আকর্ষণ বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। আর তার বাড়ির কাছে ঘুর ঘুর করে না। যতই সুন্দরী হোক যে মেয়ে দিনে রাতে স্বামীর কাছে মার খায়, তার প্রতি আকর্ষণ ধরে রাখা সম্ভব নয়।
কিন্তু নার্গিসের মার খাওয়া অব্যাহত রইল। একটা আস্ত রক্ত মাংসের নারীদেহ, তার উপর অপূর্ব সুন্দরী, পেয়ে নূর আলি সেক্স ভায়োলেন্স সব ধরণের আনন্দই উপভোগ করছিল। তার বউ এর সঙ্গে সে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করবে তাতে কারই বা কি বলার আছে।
ঠিক এই সময়ই নার্গিসের একজন প্রেমিক জুটল। তার নাম রওশন। বয়স ২০ ২২। নার্গিসকে সে ভালোবেসে ফেলল। তার মার খাওয়া, যন্ত্রনা সে সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু কোন প্রতিবাদও করতে পারছিল না। তা হলেই তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, ওর জন্য তোমার এত আঠা কিসের? এই সব কথার সম্মুখীন হবে সে।
সে নার্গিসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। যদিও প্রথম প্রথম নার্গিস কোন উৎসাহ দেখায় নি। পুরুষের প্রতি তার প্রেম মরে গেছে। কিন্তু রওশন হাল ছাড়ল না। সে ক্রমাগত নার্গিসকে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে লাগল। খুব সাবধানে সতর্ক হয়েই অবশ্য, কারণ নূর আলি জানতে পারলে সর্বনাশ। নার্গিস জল আনতে বা পুকুর ঘাটে গেলে তখনই রওশন দু চারটে কথা বলার সুযোগ পায়।
ভালোবাসায় বনের পশু বশ হয়, নার্গিসও বশ হল।
রওশন একদিন তাকে বলল,
তোমার যন্ত্রণা আমি চোখে দেখতে পারছি না। চলো তুমি আর আমি পালিয়ে যাই।
কোথায় পালাব, যেখানেই যাই নূর আলি আমাকে ঠিক খুঁজে বার করবে আর পুলিস দিয়ে আবার ওর কাছে নিয়ে আসবে। আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই।
না না, ও কথা বোলো না। চলো আমরা ইন্ডিয়া পালিয়ে যাই। সেখানে আমাদের কেউ খুঁজে পাবে না।
নার্গিসের মুখ আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠল।
যাবে? সত্যি যাবে? কবে যাবে বলো?
এখন না, ক'দিন যাক, তারপর তোমাকে জানাবো।
দু দিন পর রওশন তাকে বলল,
পরশু ভোর চারটেয় তুমি পায়খানা করার নাম করে বেরিয়ে আসবে। কোন জিনিস পত্র নেবে না। মোড়ে আমি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। সেখান থেকে বাস স্ট্যান্ড। তারপর বর্ডার। তুমি কিছু ভেবো না। আমি সব ব্যবস্থা করেই যাচ্ছি।
কিন্তু তোমার বাড়ি? মা বাবা?
আমি কি তাদের ছেড়ে একেবারে চলে যাচ্ছি না কি? একটু গুছিয়ে নিয়ে বাবা মাকে সব জানাবো। এখন কিছু বলা যাবে না। তাহলে সব ভেস্তে যাবে।
তারা দুজন জানতেও পারল না নূর আলি কানে সব খবরই পৌঁছেছে। তাকে খবর দেওয়ার মত শুভানুধ্যায়ীর অভাব হয় নি।
সেই রাতে নূর আলি তাকে আর মারধোর করল না। ভোরবেলা নার্গিস চুপি চুপি বের হলো। হাতে পায়খানার মগ। নূর আলি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নার্গিস পথ চলতে শুরু করল। কিছু দূর গিয়ে হাতের মগটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার মন মুক্তির আনন্দে মেতে উঠেছে। আঃ সে ইন্ডিয়া যাবে, কাজ করবে, খাবে। সে শুনেছে ইন্ডিয়ায় খেটে খাওয়া লোকের কাজের অভাব হয় না। সেখানে তাকে কেউ মারবে না। সে আর রওশন একটা সুখের সংসার গড়ে তুলবে।
রওশন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে। তার মুখে হাসি,
যাক এসেছ? আমি তো চিন্তা করছিলাম, কোন বাধা পড়ল না কি। চলো চলো।
ঠিক এই সময় একদল লোক তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রওশনকে প্রচন্ড মারতে লাগল। আর নার্গিসকে তারই শাড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে নুর আলির হাতে তুলে দিল। নূর আলি তাকে সারা রাস্তা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে বাড়ি নিয়ে এল। অর্ধনগ্ন রক্তাক্ত দেহের নার্গিসকে দেখার জন্য লোভাতুর লোকের ভীড় জমে গেল।
তাকে জানালার শিকের সঙ্গে বেঁধে রাখা হল। ওইভাবেই মাসখানেক বেঁধে রাখার পর নার্গিসের মধ্যে ধীরে ধীরে পাগলামির লক্ষ্মণ দেখা গেল। অকারণে হাসে কাঁদে বিড়বিড় করে কি সব বলে। ভিজিটরের দলও ধীরে ধীরে তাকে দেখতে আসা বন্ধ করে দিল।
বউ পাগল হয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে নূর আলি তার বাঁধন খুলে দিল।
যা পাগলি বেরো। আমার ঘরে তোর জায়গা নেই।
এর কিছুদিন পর নূর আলি আবার বিয়ে করে। এই বউ নার্গিসের মত সুন্দরী না হলেও বেশ ভালোই দেখতে।
দিন যায় মাস যায়। নার্গিস এখন বদ্ধ পাগল। তার তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ এখন কয়লার মত কালো। মাথার চুল রুক্ষ জট পাকানো। দেহ অস্থিসার। সে রাস্তায় লোকের পিছন পিছন দৌড়য়,
ও ছায়েব ও লন্ডনি ছায়েব, দুইটা টাকা দিন। আল্লা আপনার ভালো করবে।
আর রওশন? তাকে তো সেই পালানোর দিনই নুর আলির ফিট করা লোকেরা মেরে ফেলেছে।
রওশন নেই। নার্গিস থেকেও নেই। শুধু আমি এখনও বেঁচে আছি তাদের দুজনের প্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়ে, তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে।
Bah! Khub Bhalo Laglo.... Amader Samaje Chiro Nipirito Naari Jatir Ekti sundar Protichhobi....
ReplyDeletesundor lekha
ReplyDelete