মুক্ত গদ্য: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in মুক্ত গদ্য
মুক্ত গদ্য
প্রান্তিক জানলা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
আলপনা এঁকে যাই আলোয় ছায়ায়
অকস্মাৎ তাদের দেখা দুটি দ্বীপখন্ড পেরিয়ে এসে একদিন।যেভাবে আমাদের দেখা হয় পৃথিবীতে । তাদের এখন কোনও নাম নেই । গল্পের প্রয়োজনে দুটো নাম দেওয়া যাক রুদ্র ও সুমন । রুদ্র ও সুমনের দেখা এক নীলাভ দুপুরে । ফড়িং এর ছায়ায় স্তব্ধতার আহ্নিকরেখা । প্রান্তিক জানলার নিভৃত আলো এসে পড়ছে তাদের অস্তিত্বে । বকের মাছ শিকারী অভিলাষে ক্লান্তির পা – ছাপ । হারানো সম্বিতের ভেতর থেকে ফিরে আসছে দ্বিধা জড়ানো জিজ্ঞাসা
– কেমন আছিস ? ভালো তো ?
-কেন ? প্রতি জিজ্ঞাসায় জারিত সুমনের উত্তর ।
মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিগত উত্তাপ ।রুদ্র ভাবছে কেন এই কেন ? ইতি অথবা নেতিবাচক হতে পারে অবস্থান । রুদ্র হাই তুলল ।ক্লান্তি নয় অসহায় মনে হচ্ছিল ওর দাঁতের হলুদ স্মৃতি ।এনামেল উঠে যাওয়া অতীত ।ধূসর চিহ্নের মত জেগে থাকে বিষাক্ত কিছু মোচড় । থেমে যেতে ইচ্ছে করে দিগন্তের কাছে । রুদ্র থামে ।
তাকায় দূরে । এবং স্পষ্ট দেখে
১ সুমনের পাঞ্জাবীর বুকপকেটে জেগে থাকা বাষ্পমোচন ।
২ স্থির হয়ে থেমে আছে কিছু আভাস দুরারোগ্য প্রেমের মত এখনও ।
৩ মেঘ নয় তালাচাবি দেওয়া ঘর যেখানে বৃষ্টির জাদুকাঠি গচ্ছিত রেখেছে কেউ
সুমনের কাঁধে হাত রাখে রুদ্র – কতদিন পর দেখা । তোর মনে আছে ?
- কি ?
- সেইসব চিহ্ন ।
- না তো । তোর ?
সব নেই তবু দুএকটা ..এক মঞ্চে তোর সাথে দেখা হয়েছিল । ভুবন গ্রাম ।
- তাই -তখন তোর অন্য একটা নাম ছিল ।জনার্দন ।ভি ভি আই পি আলো এসে পড়ল তোর গায়ে । ওমনি ফুড়ুৎ । কোথায় হারিয়ে গেলি তুই
-হারাই নি তো , তোকেই খুঁজেছি চিরকাল ।
-আমি শালা বেকার ভবঘুরে প্রেম দিওয়ানা ।বরবাদ হয়ে যাওয়া তামাম ছাই ।
সুমন হাসে । সে তো অন্য এক নিলয়ের কথা । ভিনগ্রহের । তোর মনখারাপ এখনও গেল না
আমাকে ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দিলি তুই । আলোর দিকে । সমাবেশের দিকে ।
-ভিড় আমার পছন্দ নয় । জন্মান্ধের কোন আলোক ধারণা নেই ।
-আলোর মাইরি বিরাট নেশা । প্রেমের বাপ ...
রুদ্র এক নিঃস্পৃহ অন্ধকারে আলুলায়িত জীবনের কথা ভাবে। একা একা বাঁশি বাজায়। গাছের পাতায় ঢেকে নেয় চোখ মুখ সর্বত্র ।আত্মগোপন পর্ব ।অন্ধকার বিলাসী নয় তবু , বিপন্নতা নয় বরং তীব্র সাহসই বীরুৎ অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় ওর দিনপ্রবাহে। মেঘচাপ বিযুক্ত এক ফুরফুরে বাতাস খেলে বেড়ায় চারদিকে ।চরাচরে কোলাহল পর্ব ।তামাদি হয়ে যাওয়া দিনপুরানের ভেতর জেগে ওঠে অনাবিল শব্দের মহিমা । আড়ম্বর হীন কিন্তু প্রতিশ্রুতিময় । এক ধ্বনিত ইঙ্গিতের ভেতর মাথা তুলে অনেক দুস্প্রাপ্য জিজ্ঞাসা
–কিছু ভাবছিস ?
-হ্যাঁ । রুদ্র মাথা নাড়ে ।
- কি ? -কিরকম ভাবে বেঁচেছিলাম আমরা।একটু স্মৃতির অন্তরে দৌড়লে মন্দ হয় না ।
একমাত্র বাস স্টপেজ। স্নিগ্ধা দাঁড়িয়েছিল সেখানে ।ওর হাতে গোলাপি রুমাল ।ওড়নায় রাণী মৌমাছি । গুনগুন করে গাইছিল – এই করেছ ভালো নিঠুর হে । শব্দের ভেতর অনুরাগ বেজে ওঠে ।ঝলসে যাওয়া বর্ণমালা । তেজস্ক্রিয় আগুন । বিপজ্জনক বলেছিলি তুই। আমার তো কোনও মুদ্রাদোষ ছিলনা ।
- হ্যা । মনে পড়ল রোল নম্বর – থার্টি ফোর ।
- এখনও মনে আছে বিবর্ণতার পরেও
- আত্মার বিনাশ নেই
- বিবর্ণতা ?
- হয় তো নেই । না হলে মেমরি কার্ডে থেকে গেল কি করে ?
- অনুশোচনা আছে ? কাটাকুটি ।
-সেতু পারাপারের পর আর কোনও অনুশোচনা থাকেনা । সবই তো খেলা । অনিবার্য সুড়ঙ্গ পরিক্রমা । ভাবনাটানেল ।
-সত্য তাহলে কোনটা ? এই ফেরা না মায়াসরণি ?
- সত্য বলে কিছু নেই । মগ্নতা । যখন যেভাবে মগ্ন ... তাই স্থির।
ধূলা ঝড়ের মাঝে দিশা সন্ধান। সব চরিত্র বাস্তবিক। স্তরগুলো অনিবার্য।স্তরগুলো স্বাভাবিক ।ভাঙন প্রক্রিয়ার মধ্যেই সনাক্তকরণ নিজেকে । নিজের চারপাশ প্রদক্ষিণ । তারপর সবকিছু পুড়ে ছাই আবার ফিনিক্স পাখির মত উজ্জীবন । বৃত্ত ভেঙে সাঁতরে সাঁতরে আত্মমোচন কাল শেষ ।লিপিবদ্ধ ঘর্মাক্ষর ।সব ফালতু । কাজ কাম না থাকলে যা হয় ।
- তোর বাঁশি টা এখনও আছে ? সুমন জিজ্ঞেস করে ।
-নেই । ফেলে এসেছি । সুরগুলো আছে । মাঝে মাঝে মনে হয় জোরে জোরে বাঁশি বাজাই । তোলপাড় হোক আকাশ বাতাস। আমার তো কোন আলো ছিলনা , শব্দই ছিল কেবল । বাঁশিটাও হারিয়ে গেল ।
-আলো তো এক সময় নিভে যায় । তখন সব সমান, আঁধার ।
-শব্দ থাকে ? হ্যা । জোরের সাথে থাকে ।
- জন্মান্তর পেরিয়ে আসতে পারে ?
- জানিনা । নশ্বরতার ভাবনায় থাকে প্রগলভ বার্তা ।প্রান্তিক আবর্জনা ফেলে শুদ্ধ হয় ডাস্টবিন ।পোশাক বদল করে ছিন্নকোষ ।একদিন মেঘের আড়ালে গিয়ে থমকে যায় আবিল উপত্যকা ।ইচ্ছে করে সূর্যের আলো নাইট ল্যাম্পের মত করে দিতে ।
-তোর তো আলোর ধারণা ছিলনা কোনোদিন ।
-ছিল না বলেই তো এত রাগ হিংসা কাতরতা । এখন মনে হয় ফালতু সব ।তবু পথ থাকে । পরিক্রমণ আর অতিক্রমণের ধারণা নিয়ে -তাও নয় । কে কাকে অতিক্রম করে ? রাস্তা আলাদা হলে অতিক্রম ই তো মিনিংলেশ ।
২
এখানে রাত বা দিনের কোন তত্ত্ব নেই । এক নিরাসক্ত সময় উপত্যকা । তবু তাদের এই আলাপন মুহূর্তকে দুপুর বলেই চিহ্নিত করা যায় । কেননা ক্লান্তিতে তাদের ছায়া ছোট হয়ে আসছে । এক অলীক দিবানিদ্রায় নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্নঘোরের মধ্যে নিরাকৃতি কিছু ধারণা । আনন্দ ও বিষাদ সব মিলেমিশে একাকার । শরীরবিহীন এক চৈতন্যবোধের ভেতর হামাগুড়ি দিচ্ছে বিশাল জলরাশি । একটা সেতুনির্মাণের ইচ্ছে প্রকট হয় একসময় ।
-যাব কিকরে বাকি পথ ? অনেক সাঁতরে এসেছি। আর দম নেই । অথচ থেমে থাকাও তো যায়না । তোর কোন আকাঙ্খা নেই ? সুমন বলে ওঠে ।
- আছে । ঘুরে বেড়াতে এত ভাল লাগে এখনও ।
-আমারও ।দুটো দ্বীপ পেরিয়ে চলে এলাম .. কত কি দেখা বাকি থেকে গেছে। বারবার পোশাক বদল করলেও শেষ হবেনা ।এই চাওয়া পাওয়া।চলতেই থাকবে।
- গতিজাড্য ।বাঁচতে বাঁচতে একটা নিয়ম তৈরি হয়ে যায় নিজের চারপাশে । গল্পের মত, যেখানে সেখানে থেমে যাওয়া যায়না
- সুসঙ্গত জীবনভার বিমুক্ত এক বিশৃঙ্খল বাতাস এসে চাবুক মারুক আমাকে... বারবার চাইতাম । বেশ মজা লাগে, এখনও লাগছে ।
-দুনিয়া চিরকালই এক অসন্তুষ্টির জায়গা । সবাই স্বপ্ন দেখবে। হা পিত্যেস করবে । খোল করতাল বাজাবে। অনুভুতির দীপ জ্বেলে শরীর পুড়িয়ে মস্তি মজা এনজয় ...তারপর... সব সমান । কোনো মানে হয় এই রুদ্ধশ্বাস জার্নির। তবু কেন যে বারবার টানে । বিভ্রান্ত আবেগের ভেতর দিয়ে পথ হারাবো বলেই পথে নামা । দৃশ্য আর শব্দের শুভেচ্ছা বিনিময় ।
- কোথায় যাবি । কিছু খুঁজে পেলি ? অন্তত একটা মোমবাতি ? সুমন প্রশ্ন করে।
-না , চেষ্টা চালাচ্ছি গুরু। কিম্বা হয় তো কিছুই ভাবছিনা। যেমন জীবন নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভাবিনি ।
ক্রোমোজোম তো চক্রব্যুহের মত ।অতৃপ্ত আকাঙ্খায় গড়িয়ে যায় দিনকাল । দৌড় দৌড় দৌ......ড় । বাতিল খোলস ছুঁড়ে আসা তো কবেই চুকে গেছে । পা অবধি ডুবে আছে মনকেমন । আবার অনুপ্রবেশের ইচ্ছে ।
প্রান্তিক জানলায় রোদবাসনা ঝলমল করে একসময় । সাব্যস্ত উপবৃত্ত পেরিয়ে তৈরি হয় ডানার অবয়ব । জানলার বাইরে শান্ত নিরুত্তাপ কিছু নম্বর উড়ে যায় । ডিজিটাল পাখি । ঠোঁট থেকে ঠোঁটে ভালবাসার ভাস্কর্য বুনন ।বাতিল সম্ভাবনার ভেতর প্রানস্বপ্ন ।শিহরণ । রিসাইকল বিন স্বপ্ন বুনে দেয় - ফটোসিন্থেসিস। নৌকা ভাসছে দূরে।
ওরে ও মাঝি , রাঙা স্বপনদেশে যাব পাল তুলে দে নৌকার ........
বেশ রোম্যান্টিক। ভালো।
ReplyDeleteঅনবদ্য গদ্য । 'জীবন' অমোঘ অন্বেষণ বিপ্লবের লেখায় । আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে । লেখাটিকে কেন মুক্তগদ্য বলবো ? গল্প নয় কেন? যাইহোক গল্প বা মুক্তগদ্য যাইই বলি, বড় ভালো লিখেছেন বিপ্লব ।
ReplyDelete