প্রবন্ধ: ইন্দ্রাণী ঘোষ
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
নিভৃত প্রাণের দেবতা
ইন্দ্রাণী ঘোষ
শুনেছি আগে নাকি কলমের উপর একছত্র অধিকার ছিল পুরুষের। মেয়েরা লিখবে? ওরে বাবা! কেমন একটা বাঁকা হাসি খেলে যেত পুরুষ মুখবয়বে।brain এর exercise - সে তো পুরুষের কারবার। নিভৃতে সৃষ্টি করা, নিজের সৃষ্টির এক চিলতে আঙ্গিনা, চিলেকোঠার নিভৃত কোণ, সে তো যাদের জৈবিক পরিচয় পুরুষ, তাদের। দাড়ি দুলিয়ে, কানে দুল পরে, হাতে গিটার নিয়ে, চোখে ঢলঢল গভীরতা নিয়ে সে বিরাজ করবে, তবে না মনে হবে মর্তের সৃষ্টিকর্তা। এ হেন ধারণা ধীরে ধীরে বদলেছে অবশ্য। আমাদের ললনারা এখন বেশ বীরাঙ্গনার বিক্রমে কলম ধরেছেন, তা দেখেশুনে বেশ লাগে।
Gilbert and goober বলেছিলেন, 'pen stands for phallic creativity'
এর উত্তরে Show Walter বললেন “women write with the help of their brain.Women’s womb is the word processor.” যে কোন লেখা লেখক বা লেখিকার সন্তানসম। একটি লেখার জন্মযন্ত্রণা ও সন্তানের জন্মযন্ত্রণা এক।অনেক সময় ভ্রুণ নষ্ট হওয়ার মত লেখাও নষ্ট হয় বই কি।
Virginia Woolf কিন্তু একদম নতুন কথা বললেন। বললেন, লেখা বা কলমের সৃষ্টির কোন লিঙ্গ নেই। এই জায়গা থেকেই একদম নতুন concept এল যাকে বলা হয় androgynies text. নারী পুরুষের মিলিত সৃষ্টি, যা অনিন্দ্য সুন্দর। সেই সৃষ্টি অর্ধনারীশ্বরের মতই সম্পূর্ণ, যেমন পুরাণের কমলেকামিনী।
ঋতুপর্ণ ঘোষের-এর একটি ছবিতে অবন ঠাকুরেরর উপলব্ধির কথা শুনতে পাই, এ প্রসঙ্গে। অবন ঠাকুর এক বার দুর্গাপূজার শেষে, তারাভরা দীপাবলীর রাত্রে বেনারসে ছিলেন, তাঁর মনে হল মা ভগবতী ফিরে চললেন স্বামীর কাছে কৈলাসে, আর সারা আকাশটা যেন মা ভগবতীর আঁচল, নিচে জ্বলতে থাকা প্রদীপগুলি সেই আঁচলের খসে পরা চুমকি। এ হেন দৃশ্য থেকে জন্ম হোল একের পর এক ছবির, যা কিনা হর-পার্বতীর মিলনের ছবি, এক অর্ধনারীশ্বর-এর ছবি। এই সৌন্দর্য বোধ তুলনাবিহীন।
ঋতুপর্ণর আন্দোলন ছিল সমাজের সেই মধ্যবর্তী র্সীমারেখার মানুষদের জন্য যারা নারী পুরুষ কেউ নন। কিন্তু এই মানুষগুলো সৃষ্টিশীল। সৃষ্টির আঙিনায় কোন তফাৎ নেই। Virginia Woolf, অবন ঠাকুর, ঋতুপর্ণ কেমন সময়ের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে যেন মিলে গেলেন এক বিপুল তরঙ্গে যা একসাথে বালিতে মিশে গিয়ে আবার ফিরে গেল রত্নাকরের গর্ভে। সময়ের একেকটি রত্ন একই কথা বলে লুকিয়ে পড়ল সীমাহীন কালের সমুদ্রে।
Woolf বলেন এক ‘ফ্লাইট”এর কথা আমরা যাকে বেশ বলতে পারি ’ছুট’।Woolf বলেন “A room of one’s own” আর আমরা তাকে যদি বলি “নিভৃতির কোণ” তাহলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় আরও। একান্ত নিজের এক নিভৃত পূজার ঘর। যেখানে চলে প্রাণের দেবতার পূজা। Virginia Woolf বলেন মায়েদের কার্পেট বোনার কথা। নিপুণ আঙ্গুলের ছোঁয়ায় একেকটি স্বপ্নকে যেন রূপ দিতেন তাঁরা। রঙ্গিন সুতোয় স্বপ্ন ফুটত।
ঋতুপর্ণর রবিবারের কলমেও এক গল্প শুনি মাদুর বোনার। বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসা সেই কিশোরী যে দুপুরবেলা মাদুর বুনত, আর কিশোর ঋতুপর্ণ তাঁর কাছে মাদুর বোনা শিখতে চাইলে সে লাজুক হেসে পালাত। হয়তো বা মাদুর বোনার মাধ্যমেই তার নিভৃত প্রাণের দেবতার সাথে একা জাগার পালা চলত।
Alice walker “in search of my mother’s garden” রচনা তে বলেন তাঁর মায়ের বাগানের কথা। মা যখন বাগানে কাজ করতেন, তার চারিপাশে এক আলোর বলয় তৈরি হত যেন। এই মা দশটি সন্তানের জননী হওয়া স্বত্তেও তাঁর বাগান করা ছিল যেন মুক্তির এক অনন্ত আশ্বাস। এই কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকার মায়ের জীবন বলাবাহুল্যই মর্মান্তিক। দিন শেষে এঁর স্বামী মত্ত হয়ে প্রহার না করে ঘুমোতে যেতে পারতেন না। এই পরিবেশে থেকে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হয়েও তাঁরা জোনাকির মতো প্রাণের আলো জ্বেলে সুখের ডানা মেলতেন সৃষ্টির আকাশে।
ভিক্টোরিয়ান যুগে George Eliot নামে লিখতেন Marry Ann Evans.
একের পর এক অনবদ্য সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর আশঙ্কা ছিল পাছে তাঁর লেখা মহিলার কলমজাত বলে বাতিল হয়ে যায়, তাই এই ছদ্মনামের ব্যবহার। এখন অবশ্য এ দিন গেছে। ঠাকুর বাড়ির মেয়রা প্রথম আলোর পথ দেখিয়েছেন বহু আগেই। স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী সকলেই আলোকপ্রাপ্তা।পরবর্তী কালের নবনীতা দেবসেন, হালফিলের বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, চিত্রা দেব, জয়া মিত্র, অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী সবাই নিজের বিভায় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
সেই কৃষ্ণাঙ্গ মা, যিনি একমনে বাগান করতেন বা সেই কিশোরী মাদুরশিল্পী যার আকাশপাড়ির কথা ঋতুপর্ণ জানতে চেয়েছিলেন, এঁরা সকলেই কি নবনীতা, অরুন্ধতীদের সাথে একই আকাশে ঠিকানা খোঁজেন নি? বা সিল্ভি মানবীরা? এঁরাও কেউ সাজাতে ভালবাসেন, কেউ বা লিখতে। সকলেরই উড়ান অস্তিত্ব খুঁজতে একই আকাশে। সৃষ্টি সহজিয়া, তার গতি প্রকৃতি লিঙ্গ ভেদের অনেক উপরে। সব সৃষ্টিশীল মানুষ নিভৃত প্রাণের দেবতার পূজারী। Virginia Woolf এর সেই নিজের ঘরের খোঁজ করেন সবাই। তাই বোধহয় পৃথিবী বিখ্যাত গানের দল Beatles বলে
“there’s a place I go to, when I’m low, when I’m blue……..”
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteলেখাটি পড়ে ভালো লাগলো । স্বল্প পরিসর লেখায় এতো ইংরাজী শব্দের ব্যবহার লেখার গতিগে স্লথ করে বলেই আমার ধারণা । ভার্জিনিয়া উলফ' জর্জ ইলিয়ট ইত্যালি - লেখকের নামগুলি তো বাংলাতেই লেখা যেতো ।
ReplyDeleteDhonnobad
ReplyDeleteAmar nomoskar neben.English sobdo banglay likhte osubide hoy.
ReplyDeleteamar nomoskar neben English sobdo banglay lekha osubide tai english rakhte hoyeche.
ReplyDeleteসুলিখিত প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যের সাথে সহমত হলাম । শুধু সাহিত্য নয়,যে কোন সার্থক শিল্প সৃষ্টির আড়ালে স্রষ্টার যে মনন থাকে তা সুনিশ্চিত ভাবেই লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হওয়া এক আবশ্যিক শর্ত।
ReplyDeleteশরৎচন্দ্রের সমস্ত লেখায় যে ভাবে তিনি নারী চরিত্রের সুখ-দুঃখ-বঞ্চনা-হতাশা-দ্বন্দ্বের কথা ফুটিয়েছেন,তা একজন নারীর পক্ষেই জানা ও বোঝা সম্ভব।
তেমন ভাবেই আশাপূর্ণা দেবীর লেখাতে পুরুষদের তিনি নারীদের সাথে সাযুয্যে পুরুষদের অনুভবের কথা তাদের মত করেই তিনি ভেবেছেন।
এই উন্নত মরমী মননের জন্য শরৎচন্দ্রের এস্ট্রোজেন বা আশাপূর্ণা দেবীর টেস্টোস্ট্রেরনের অভাব কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি ।
আসলে দুটি বিষয় ভাবার আছে । যখন আমাদের দেশে নারীদের পড়াশোনা করার চলন ছিল না,তখন স্বভাবজই শিক্ষার অভাবে লেখিকার সৃষ্টি বিশেষ কিছু হয় নি । ফলে সেই যুগে সাহিত্যের পরিসরে পুরুষের বিচরন প্রায় একচেটিয়া ছিল । আর শিক্ষার অভাব তাঁদের অন্দরমুখী করায় পুরুষদের লেখাতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নারীদের এক অধীনস্থ দ্বিতীয় শ্রেনীর অস্তিত্ব হিসেবেই বিবেচনা করা হত ।
শরৎচন্দ্রই প্রথম এই নিগড় ভাঙ্গতে প্রয়াসী হয়েছিলেন । কিন্তু কালের অভিগমনের সাথে সাথে স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার হওয়া ও তার ফলশ্রুতিতে ক্রমবর্ধমান মহিলা- সাহিত্যিকের উত্থান এই অসাম্যকে দূর করতে শুরু করে,যা এখন আর নেই বললেই চলে ।
লেখাটির সাবলীলতা প্রশংসনীয় ।
Dhonnobad khub khusi holam
ReplyDeleteঅতি উত্তম একটি রচনা যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নানা তথ্য সহযোগে রচনাটি রসগ্রাহী। ভাললাগা নিয়ে গেলাম।
ReplyDeleteOnek ador chordi bhai khub khusi holam.
ReplyDelete