নাটক: ডঃ সুজাতা ঘোষ
Posted in নাটকনাটক
কেতুর বে
ডঃ সুজাতা ঘোষ
প্রথম দৃশ্য
বসার ঘরে কার্তিক আর গণেশ দুজনে সিগারেট নিয়ে টানাটানি করছে। গণেশের ধুতি আর খালি গা, কার্তিক জিন্স প্যান্ট আর টি – সার্ট।
গণেশ - দে ভাই দে, তুই তো রোজই খাস, আমায় একটু সুখটান দিতে দে। এখানে কখনো সখনো বাবার থেকে গাঁজা ঝেড়ে টেনে নেই। কিন্তু, আহা, এই সিগারেটের স্বাদ, ওহো, একেবারে অন্য রকম।
কার্তিক - বাবা জানতে পারলে মাঝখান থেকে আমার মর্ত্যে ঘোরাঘুরিটা বন্ধ হবে। দাদা তুই বরং বাবার গাঁজাই টান, সিগারেটটা আমায় ফেরত দে, প্লিজ।
গণেশ সিগারেট আঁকড়ে ধরে তিনটে টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে পড়ল মেঝেতে। কার্তিক ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দাদা কি হল রে তোর? ঠিক আছিস তো?
গণেশ - ভীষণ ভালো লাগছে। মাঝে মধ্যে তোর বৌদি কুলফি বানিয়ে দেয় সিদ্ধি দিয়ে, বাবাকে যখন বেলের শরবত দিতে যায় তখনই এক মুঠো তুলে নিয়ে আসে আঁচলের নীচে করে। আহা, অপুর্ব স্বাদ। কিন্তু সবসময় তো আর পাওয়া যায় না। তবে তোর এই সাদা জাদুর ছড়িও বেশ ভালো।
পর্দা সরিয়ে শিব ঢুকলেন ভিতরে, সারা ঘর ধোঁয়াময়।
শিব - ও গনশা, কেতু এত ধোঁয়া কিসের? কি হল রে? কি সর্বনাশ কাণ্ড ............।
কেতু - বাবা, আপনি .................. বসুন, বসুন। ও কিছু না, আমি মর্ত্যে গেছিলাম দুদিনের ট্যুরে। তখন ওখান থেকে কিছু নতুন ধরণের জিনিষ নিয়ে এসেছি। দাদা ওঠো ওঠো, তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে না? বৌদি দুবার ডেকে গেছে বাজারে যাওয়ার জন্য। বাবা, আমাকেও বের হতে হবে, সামনেই তো তোমার আর মায়ের বিবাহ বার্ষিকী, তার আয়োজন করতে।
শিব - বেশী বড় করে কিছু করতে যাস না। এই বুড়ো বয়সে অত তেল মশলা সহ্য হয় না। রাতে তোর মা রাগারাগি করবে, ওকেই তো শুতে হয় না আমার পাশে। ও গনশা, আজ বাজার থেকে একটু ধনেপাতা নিয়ে আসিস। পাতলা ঝোল খাব।
গণেশ - কেন বাবা, পেট ঠিক নেই?
শিব - আরে গতকাল “ চাট ” না কি যেন খাওয়াল কেতু। ওর এই মর্ত্যে যাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। কি সব যে নিয়ে আসে তার ঠিক নেই। ওসব মানুষের খাওয়ার আমাদের পেটে সহ্য হবে কেন?
গণেশ - ঠিক আছে বাবা, আমি কাঁচা কলাও নিয়ে আসব সাথে।
দূর্গা এসে ঢুকলেন চা হাতে নিয়। সবেমাত্র স্নান সেরেছেন। আটপৌরে শাড়ি, গহনা, খোলা কালো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল, চওড়া সিঁদুর, মুখে হাসি।
দূর্গা - কিগো আজ কখন ফিরলে?
শিব - কোত্থেকে?
দূর্গা - মর্নিং ওয়াক থেকে।
শিব - ও ........................।
দূর্গা - যাওনি না? কতবার বলেছি, রোজ সকালে হাঁটতে যাবে অবশ্যই। কিছুতেই শুনবে না? এইভাবে মোটা হতে থাকলে হাই – প্রেসার, সুগার, আরও কত কি এসে জুটবে তার ঠিক আছে!
শিব - আরে সন্ধ্যেবেলা যাব'খন । ওই অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে ওঠা যায় নাকি? সারা জীবন ধরে না ঘুমিয়ে খালি ধ্যান করে গেলাম। এখন এই বুড়ো বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। আটটার আগে মোটেই ডাকবে না ঘুম থেকে।
দূর্গা - চা নাও। দেখ চিনি ঠিক আছে কিনা।
শিব - (চা মুখে দিয়ে) থু থু, কি গো তুমি, দুধ মেশানো তো কবেই ছেড়ে দিয়েছ, একটু চিনি দেবে, তাতেও তোমার কার্পণ্য? এইভাবে বেঁচে থেকে লাভ কি? সকালের প্রথম চা ............।
দূর্গা - প্রথম চা এইরকম খেলে পেট পরিষ্কার হয়। আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি চা খেয়ে একটু জগিং করো তো। আমি রান্নাঘরে যাই, দেখি বৌমা কি করছে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
লক্ষ্মী মাথায় মেহেন্দি লাগিয়ে, গরম জলের টবে পায়ের পাতায় লেবু মাখিয়ে চুবিয়ে রেখেছে। চোখের বন্ধ পাতায় আলু থেঁতো করে দেওয়া। গালে শশা, কপালে সাদা চন্দনে মুলতানি মাটির প্রলেপ।
একটু দূরে সরস্বতী গিটার বাজাচ্ছে কম্পিউটারে বাজা গানের সাথে তাল মিলিয়ে। মা দূর্গা ঘরে ঢুকলেন হাতে বেলপানা নিয়ে। মেয়েদের দেখে খুশি হবেন, না চিন্তিত হবেন বুঝতে পারলেন না। হাতের কাপগুলো টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, এই তোরা তাড়াতাড়ি বেলপানা খেয়ে নে, গরম হয়ে যাবে।
লক্ষ্মী - গরম হয়ে যাবে!
দূর্গা - হ্যাঁ, বরফকুঁচি মিশিয়ে দিয়েছে বৌমা।
সরস্বতী - দাদা আবার কৈলাসের মাথা থেকে কুচো বরফ কুড়িয়ে এনেছে?
লক্ষ্মী - সত্যি আর পারা যায় না। কতবার বলেছি ঠাণ্ডা লেগে যাবে, এখন তুষারপাতও হচ্ছে, কি দরকার?
দূর্গা - আরে বাবা, কেতু যে লাল রঙের নতুন ঠাণ্ডা মেশিনটা এনেছে না মর্ত্য থেকে, তার মধ্যেই বরফের টুকরো পাওয়া যায়।
সরস্বতী - ও, তাই বল। সত্যিই কেতুটা খুব ভালো করেছে মর্ত্যে যাওয়া শুরু করে। এই যে আমার কম্পিউটারটা কত কাজে লাগে। নারদ মাস্টার তো শুধু পুরনো ক্লাসিক্যাল গান শেখান। আর নেট থেকে এখানে সমস্ত নতুন নতুন গান পেয়ে যাচ্ছি। দারুণ লাগে এখন গিটার বাজাতে।
দূর্গা - তুই এখন বীনা বাজাচ্ছিস না?
সরস্বতী - মা ওটা ভীষণ ভারী, তাছাড়া সেই ছোটবেলা থেকে ওটার একপাশে বসে ভারী মোটা শব্দে হাত বোলাতে হয়। আর এটা দেখ, গলায় ঝুলিয়ে যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে বাজানো যায়। কত সুবিধা।
লক্ষ্মী - হ্যাঁ, মা, এই দেখ কেতু এই বইটা এনে দিয়েছে। এখানে কিভাবে সুন্দরী হওয়া যায়, কিভাবে রূপ – চর্চা করতে হয় সব লেখা আছে। আমি তো তাই দেখেই নিজেকে আরও সুন্দরী করার চেষ্টা করছি।
দূর্গা - ভালো, তোরা যদি খুশি থাকিস তো আমিও খুশি।
কেতু এমন সময় দৌড়ে ভিতরে ঢুকল, পিছনে তিনজন ভূত। বিশাল বড় একটা বাক্স ঘাড় থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ছোড়দা কোথায় বসাব গো?
কেতু - মা, এটা কোথায় রাখি বল তো? বাবাকে আর কষ্ট করে ঠাণ্ডার মধ্যে পাহাড় – পর্বত ডিঙিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে হবে না। এতে দাঁড়িয়ে দৌড়লেই হবে। এক মাসের মধ্যে একদম ছিপছিপে সুন্দর চেহারা।
দূর্গা - ওমা, তাই নাকি? তা এতে সবাই কি চড়তে পারে?
কেতু - মা, এটা ঘোড়া না, এটা একটা হাঁটার যন্ত্র। এর উপর শুধু দাঁড়াতে হবে, ব্যাস; বাকিটা নিজে থেকেই হবে। তা এখন কোথায় রাখব বল।
দূর্গা - তোর বাবার ধ্যন করার ঘরেও রাখতে পারিস। আর না হলে ওই বারান্দায়, যখন যার ইচ্ছা হাঁটবে। আমি না হয় মাঝে মধ্যে একটু রান্নার ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে নেব। আজকাল যত কাজই করি না কেন, কিছুতেই আর আগের মত ছিপছিপে থাকতে পারছি না। গণেশ এসে বলল, মা, বাজার রেখে এসেছি রান্নাঘরে, আর বাবা তোমাকে ডাকছে।
দূর্গা - কেন?
গণেশ - জানি না।
তৃতীয় দৃশ্য
ঘরের ভিতর শিব ডিভানের উপর পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, হঠাৎই বাইরে ঠকঠক শব্দ।
শিব - কে?
পর্নিকা - আমি পর্নিকা। এটা কি শিবুবাবুর বাড়ি?
শিব - শিবু! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার নাম অবশ্য শিব।
পর্নিকা - হ্যাঁ, আপনি, একটু কথা বলতে পারি কি?
শিব - অবশ্যই, ভিতরে এসো, দরজা খোলাই আছে।
পর্নিকা - নমস্কার, ( পরনে সর্ট স্কার্ট, স্লিভ লেস টপ, চুলে সোনালী আর গোলাপি রঙ ছড়ান, লম্বা জুতো।) আমি পর্নিকা রায়। আপনার ছেলে, কার্তিক আমার ............ মানে আমার ভালো বন্ধু।
শিব - বস, বস, তা তুমি কোন পাহাড়ে থাকো মা? আগে দেখেছি কি? কার মেয়ে বল তো? ইন্দ্রর?
পর্নিকা - না না, আমার বাবার নাম সদাশিব রায়। উনি রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসা করেন।
শিব - ব্যাবসা? দাঁড়াও, দাঁড়াও ( শিব ডিভান ছেড়ে উঠে বসলেন চেয়ারে।), আমি তো শিব, সদাশিব আবার কে?
এর মধ্যে কেতু এসে ঢোকে।
কেতু - পর্নি তুমি এখানে?
পর্নিকা - হ্যাঁ, ক্যাট, কি করব বল, বাবা আমার বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে, তাই বাধ্য হয়ে আসতে হল এখানে।
কেতু - এখানে কি করে আসলে?
পর্নিকা - আরে হেলিকপ্টারে করে, আবার কি করে? তোমার কোন মালপত্র মনে হয় ডেলিভারি দিতে আসছিল কিছু অদ্ভুত দেখতে লোক, আমি ওদের পিছু করতে করতে এখানে চলে এসেছি।
শিব - কি ব্যাপার কেতু, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কেতু - বাবা, ও মর্ত্যে থাকে। আমার পরিচিত, হঠাৎই এখানে চলে এসেছে।
শিব - মানুষ! সে কি কাণ্ড, মানুষ চলে এসেছে স্বর্গে! কেতু, কতবার তোমায় বলেছি মর্ত্যে না যেতে, কবে যে কি ঘটাবে .....................।
দূর্গা এসে পর্নিকাকে আপাদমস্তক দেখে শিবের দিকে তাকিয়ে বললেন – এবারে বুঝেছ, কেন আমি পই পই করে বলেছি যে, কেতুকে একটু শাসন কর।
পর্নিকা - মামনি, তুমিও তো আমার মতনই মর্ত্য থেকেই এসেছ, তাই না? সেই ছোট থেকেই এই গল্প শুনছি ঠামির মুখে।
দূর্গা একটু বিব্রত হয়ে বললেন - সে অনেক পুরনো কথা। তাছাড়া আমি মহাদেব শিবকে পূজা করে পেয়েছি।
পর্নিকা - আমিও তো ক্যাটকে ভালোবেসে পেয়েছি। বল না ক্যাট, তোমার মাকে। আমরা একসাথে কতবার বেড়াতে গেছি দেশে – বিদেশে। কিছু বল নি তোমার বাবা – মা কে।
শিব - দেশে – বিদেশে?
পর্নিকা - হ্যাঁ, আমাদের মর্ত্যের মধ্যে অনেক গণ্ডি আছে, সেই গণ্ডি পেরলেই অন্য দেশ। যাই হোক, ড্যাড সবই তো শুনলে, এবারে বল আমি কি করব?
শিব - ও দূর্গা, পাবু, কি করব? তোমার ইচ্ছার বাইরে তো আর ঘরের ভিতর কিছু হবে না, তুমিই বল।
দূর্গা - কেতু, ও যা বলছে তা কি সব সত্যি?
কেতু - মা, মানে ...............
দূর্গা - সব সত্যি?
কেতু - হ্যাঁ। আমিই বলতাম, কিন্তু ........................ ।
দূর্গা - তাই ভাবি, এত ঘন ঘন মর্ত্যে যাও কেন? শুধুমাত্র আসবাব আনতে, এবারে বুঝলাম আসল কারণটা।
লক্ষ্মী - ওমা, কি সুন্দর দেখতে, যেন জ্যান্ত বার্বি।
দূর্গা - সেটা আবার কি?
সরস্বতী - পুতুল, মা, পুতুল।
দূর্গা - পুতুল, কোথায় পেলি? আমি তো তোদের ছোটবেলায় মাটির ডেলা দিয়ে ভূত বানিয়ে দিতাম খেলতে।
লক্ষ্মী - কেতু টিভি এনে দিয়েছে, ওতে দেখেছি কি সুন্দর দেখতে পুতুল, ওদের নাম বার্বি।
শিব - কেতু যে কি কি এনেছে মর্ত্য থেকে, কে জানে!
দূর্গা - আশা করি এটা তোমার শেষ আনা, তাই তো? নাকি আরও কিছু আনা বাকি আছে?
কেতু - কি আর আনব ..................... , তবে ভাবছি ওখানে সফটওয়্যার কম্পানীতে একবার যদি কাজ করতে পারি, তবে জীবন ধন্য।
গণেশ - সেটা আবার কি?
কেতু - কম্পিউটারে কাজ করতে হয়, প্রচুর মাইনে, কাঁচের অফিস ............।
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
পর্নিকা - তাহলে তো ভালোই হত, কিন্তু আমার বাবা তোমাকে পেলে ব্যবসাতেই ঢোকাবে শেষ পর্যন্ত।
শিব - ও কেতু, বাবা, শেষ পর্যন্ত তুই আমার ছেলে থাকবি তো? নাকি ..................।
দূর্গা - পর্নিকা, তোমার বাবা জানেন যে, তুমি এখানে এসেছ?
পর্নিকা - মাথা খারাপ, তাহলে তো আসতেই দিত না। চুপচাপ চলে এসেছি। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর কিচ্ছুটি করতে পারবে না।
সবাই ব্যস্ত কার্তিক আর পর্নিকাকে নিয়ে। দূর্গা শিবকে আলাদা করে ডেকে বললেন - বিয়েটা দিয়েই দাও। যে মেয়ে এতদূর আসতে পারে, সে কি কার্তিককে ছেড়ে দেবে ভেবেছ? মাঝখান থেকে আমার ছেলেটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
শিব - আমি ভাবছি, মেয়েটাকে জোগাড় করল কি করে?
দূর্গা - পূজার সময় যে বাড়ি যাই, তখনই হয়তো প্যান্ডেলে দেখে থাকবে। আমি ভাবছি মেয়েটা কেমন নাছোড়বান্দা .................. স্বর্গ পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছে!
শিব - হ্যাঁ, একেবারে তোমার মত ( একেবারে তোমার মত )।
দূর্গা - বাজে বকো না, চল বসে কিছু চিন্তা করি। এটাই আমাদের বাড়ির শেষ কাজ। ধুমধাম করে বিয়ে দেব।
শিব - হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। চল ভিতরে গিয়ে আলোচনা করি।
সবাই একসাথে পর্নিকাকে নিয়ে আনন্দে হৈ চৈ করতে লাগল, যতই হোক সবার আদরের ছোট ভাইয়ের হবু বৌ।
0 comments: