2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ: শ্রীশুভ্র

Posted in




প্রচ্ছদ নিবন্ধ 



মুখের আড়ালে মুখ – ফেসবুক 
শ্রীশুভ্র 


আমাদের নবতম ঠিকানা নাকি ফেসবুক! বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ! কিন্তু এইটি অর্থাৎ এই ফেসবুক নিত্যদিনের পার্বণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্প্রতি, তাও সে প্রায় এক দশক হয়ে এল। যখনি একটুখানি অবসর, তখনি মন উড়ু উড়ু! ঘুর ঘুর করে ফেসবুকের লগইন পাতায়। মার্ক জুকেরবার্গ! বাঙালির জন্যে এক আশ্চর্য রোমান্টিক রংমহল খুলে দিয়েছেন। এবং এই একটি ঠিকানা, যেখানে এসে মিলেছে সব বয়সের, সব ধর্মের মানুষ। জুকেরবার্গের এই ফেসবুক সারা পৃথিবীতেই আলোড়ণ ফেলে দিলেও বাঙালির জন্যে ফেসবুক ভিন্নতরো একটি মাত্রা যোগ করেছে, স্বভাব অলস বাঙালির আলস্যচর্চার এবং পরনিন্দা পরচর্চা প্রিয় বাঙালির জন্যে এ এক সত্যিই জুকেরবার্গের আশ্চর্য প্রদীপ! 

এক সময় বিশ্বনিন্দুকদের প্রচারিত বোকাবাক্স বাঙালিকে যত না ঘরকুনো করে তুলেছিল, জুকেরবার্গের ফেসবুক তাদের তার থেকেও বেশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক করে তুলেছে। তথাকথিত বোকাবক্সের যতই দুর্নাম রটুক, বাড়িতে পরিবারের সবাইকে সারাদিনে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও একত্র করে ধরে রাখতে বোকাবাক্সের কোনো জুড়ি নাই। কিন্তু ফেসবুক সবার আগে বাদ সেধেছে সেইখানেই! পরিবারের সকলকেই পরস্পর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে তার এই আশ্চর্য রঙমহলের জাদুর সম্মোহনী মায়ায়! সমালোচকরা বলবেন তা কেন? ফেসবুক মানুষের মিলনতীর্থ! শুধু কি তাই? তাঁদের মতে, শ্রেণীবৈষম্যের এই সমাজে ফেসবুকই পারে বিভেদের অসংখ্য প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে মানুষের সাথে মানুষের সহজ সুন্দর সংযোগের প্রশস্ত রাজপথটা খুলে দিতে। তা পারে। হয়তো পারবেও একদিন। বস্তুত ফেসবুকের অনন্ত সম্ভাবনার মধ্যে এইটিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু সে সুদূরপরাহত সম্ভাবনা! ততদিনে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যাবে সন্দহ নাই। কিন্তু এই বঙ্গে ফেসবুকরঙ্গ যে জমে উঠেছে সে ব্যাপারে কোনোই বিতর্ক থাকতে পারে না। আর তার বড়ো কারণ ফেসবুক বাঙালিকে দিয়েছে অনন্ত স্বাধীনতা! 

সামাজিক নানান বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ বাঙালি সমাজ প্রযুক্তিবিজ্ঞানের এই নবতম আবিস্কারের হাত ধরে মুক্তির এক দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে যে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বিশেষত আমাদের সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুস্থ পরিসরের অভাবটা অনেকটাই দূর হয়েছে এই ফেসবুকের দৌলতেই। বিরূদ্ধ সমালোচকরা অবশ্য অবাধ মেলামেশার পরিণতি কতটা ক্ষতিকর, সেই বিষয়েই তর্ক জুড়ে দেবেন। যদিও তাদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না। কারণ, এই ফেসবুকের সূত্র ধরেই আমাদের সমাজে কিছু কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা শুরু হয়েছে। কিন্তু তার দায় কি প্রযুক্তিবিজ্ঞানের এই নবতম আবিস্কারের, না আমাদেরই সমাজদেহের দুষ্ট ক্ষতের, সে প্রশ্নের মীমাংসা কে করবে? বস্তুত ফেসবুক আজ পৃথিবী জুড়েই সমাজদর্পন হয়ে উঠেছে। আমাদের বঙ্গসমাজের ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য। আমাদের ভালো, আমাদের মন্দ, আমাদের শক্তি, আমাদের দূর্বলতা, আমাদের সমৃদ্ধি, আমাদের সংকীর্ণতা সবই ফেসবুকের দর্পনে আজ স্পষ্ট প্রতিফলিত। আর এখানেই বাঙালির মুখের ছায়াপাতে ফেসবুককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে, আমাদের নৈতিকতাতেই টান পড়ে সবার আগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের খেয়াল থাকে না সেটা। 

আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাইনি আমরা কেউই, কিন্তু ফেসবুক পেয়ে গিয়েছি। পেয়ে গিয়েছি স্বপ্ন পূরণের জাদু কাঠি। পেয়ে গিয়েছি অবদমিত বাসনাগুলি প্রকাশের গুপ্ত সুরঙ্গ। পেয়ে গিয়েছি নিজেকে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মায়াবী আতসবাজী। পেয়ে গিয়েছি নিজের ঢাক নিজে বাজানোর জন্যে আস্ত একটা জয়ঢাক। আমাদের এই প্রাপ্তির তালিকা হয়ত একদিন চিত্রগুপ্তের খাতাতেও এঁটে উঠবে না, তাই ফেসবুকে মুখ দেখাতে আমাদের এত ব্যাকুলতা।

কিন্তু কোন মুখ? নিজেরই মুখ তো? নিজের আসল মুখ? নাকি সযত্নে গড়ে তোলা নিজেদের সামাজিক মুখ! যে মুখের আড়ালে আড়াল পড়ে যায়, আমারই আমিটুকু! সেই আড়ালের অবসরটুকু দিয়ে, আমরা গড়ে নিতে চাই আমাদের ভার্চ্যুয়াল সাম্রাজ্য। তাতেই তো আসল ক্যারিশমা! মানসিক তৃপ্তি। সমালোচকরা অবশ্যই একমত হবেন না কিছুতেই। সাধারণ ভাবে সকলের সম্বন্ধেই বলা যায় না একথা। হয়তো কখনো সখনো কেউ কেউ এভাবে ভাবতে চান। যাদের সংখ্যা হাতে গোনা। না তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা নয়, আমরা বলতে চাই তাঁরাই অধিকাংশ! এই যে নিজে হাতে গোড়ে তোলা নিজের সামাজিক মুখ, যে মুখের হাত ধরে আমরা পরিচিত হতে চাই এই ভার্চ্যুয়াল জগতে, সেই মুখের সাথে আমাদের নিজস্ব অবয়বের দূরত্ব কতটুকু, অনেক সময়ে খেয়াল থাকে না সেটাও। কিন্তু যখনই কোনো না কোনো স্বার্থে, কারুর না কারুর সাথে সংঘাত লাগে আমাদের, তখনই প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই দূরত্বের পরিমিতিটুকু। হয়ত আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। হয়ত সুচিন্তিত ভাবেই। কারণ এই ভার্চ্যুয়াল জগতের মূল সুবিধেটুকু হল, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গড়ে তোলার আমেজটুকু আছে ষোলআনা। কিন্তু সেই সম্পর্ক ধরে রাখার কর্তব্য বা দায়বদ্ধতা কোনাটাই নেই। 

এই যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার সাথে, তা সুস্থ সুন্দর ভাবে ধরে রাখার একটা নৈতিক দায়বদ্ধতা; যা আমাদের সমাজ সংসারে আমাদেরকে মেনে চলতেই হয়, ইচ্ছায হোক বা অনিচ্ছায়, ফেসবুকের এই ভার্চ্যুয়াল জগতে সেই দায়বদ্ধতা না থাকায়, কখন যে আমাদের সযত্নে গড়ে তোলা ভার্চ্যুয়াল মুখের আড়াল থেকে আমার গুপ্ত আমিটি বেড়িয়ে পরবে সে বিষয়ে আমাদের কোনোই মাথা ব্যাথা থাকে না। ফলে আজকের বন্ধু কালকেই ব্লকড। অনেকেই বলবেন, তা কেন, আমাদের সামাজিক জীবনেও তো হামেশাই এরকম ঘটে থাকে। শুধুতো ভার্চ্যুয়াল জগতেই নয়। ঘটে বইকি! কিন্তু তা এমন অহরহ ঘটে না। কারণ সামাজিক জীবনের দৈনন্দিন ওঠাবসায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে অনেকটাই ভালোভাবে জানার সুবাদে, চট করেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সম্পর্কের সুতো যতই আলগা হয়ে আসুক না কেন, তবু লৌকিকতাজনিত ভদ্রতাটুকু সকলকেই ধরে রাখতে হয়। সেটাই সামাজিক দায়বদ্ধতা। ঠিক যেটার অভাবেই ফেসবুকের গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলি অধিকাংশই এত ক্ষণস্থায়ী।

আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রায় মানুষের সাথে মেলামেশার গন্ডীটুকু বেশ সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফেসবুকের ভার্চ্যুয়াল জগতে সেই গন্ডীর সীমানা বিশ্বব্যাপি পরিব্যাপ্ত বলে, নতুন নতুন বন্ধু জোটানো অনেক সহজসাধ্য। ফলে যতজন বন্ধুই হাতছাড়া হোক না কেন, তাতে বিশেষ বিচলিত হওয়ার কারণ ঘটে না। অর্থাৎ বন্ধুত্ব সেখানে অনেকটাই সংখ্যাবাচক! আর সেই কারণেই কার বন্ধুতালিকায় কত বেশি প্রোফাইল সেইটিই মূল বিবেচ্য হয়ে ওঠে। তার ঢাক তত জোরেই বেজে ওঠে। সেই ঢাক পেটানোর আনন্দটাই তখন বন্ধুর সাহচর্য্যর থেকেও অধিকতর মূল্যবান হয়ে ওঠে। ফলে কোনো সম্পর্কের রসায়ন নয়, আত্মপ্রচারের বাঁধানো মঞ্চটাই আমাদের কাছে তখন পাখির চোখ হয়ে ওঠে ফেসবুকের সম্মোহনী মায়ায়। 

অর্থাৎ এই আত্মপ্রচারের মঞ্চটিই বাঙালির কাছে মুখ্য হওয়ায় আর সবকিছুই গৌন হয়ে পড়েছে। গৌন হয়ে পড়েছে মানবিক মূল্যবোধের প্রাথমিক শর্তগুলিও। আপন স্বার্থে ঘা লাগলে, কিংবা অহংবোধ আহত হলেই, আমাদের ভার্চ্যুয়াল মুখের আড়ালটা খসে পড়তে থাকে। ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে অহংসর্বস্ব স্বার্থপর আমিটির অন্তর স্বরূপ। আর তখনই বন্ধুবিচ্ছেদ! মুখের ওপর দাড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটা তখন সামান্য একটা অপশান ক্লিকের ব্যাপার মাত্র! আর কি মহিমা সেই অপশানের! কোনো জবাবদিহির দায় নেই। কোনো চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। কোনো আত্মগ্লানির খচখচানি নেই। স্বয়ং জুকের্বাগের ধারণাও নেই অন্তত বাঙালির জন্যে কত বড় একটা ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি। আর সেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রতিদিন বাঙালির মতো আর কোনো জাতিই এত বেশিবার ব্যবহার করে কিনা সন্দেহ।

তবু শুধু নির্ভেজাল বন্ধুত্বের জন্যে যারা ভরসা করতে চান ফেসবুকের এই ভার্চ্যুয়াল জগতের উপর, তাদের কোনো না কোনো দিন, কোনো না কোনো ভাবে বিপর্যস্ত হতেই হয়, অভিজ্ঞতার নিদারুণ তিক্ততায়। তাই খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়, যারা কোনো প্রসাধনের আড়াল নিয়ে নয়, আপন মুখশ্রীর অন্তর্দীপ্ত মাধুর্য্যেই আলোকিত করেন ফেসবুকের ওয়াল।

2 comments:

  1. সুন্দর , প্রাঞ্জল লিখেছেন শুভ্র । এবং অনেক সত্য কথাও বলেছেন । তথ্যভারে পীড়িত নয় লেখাটি । ফেসবুকীয় জগতের ফাঁকা এবং ফাঁপা অবয়বটি উন্মোচন করেছেন যা মোটেই বিতর্কের অবকাশ রাখে না । আবার এর অনিবার্য আকর্ষণও স্বীকার করেও প্রনিধানযোগ্য শেষ কথাটি বলেছেন যে তাই 'খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়, যারা কোনো প্রসাধনের আড়াল নিয়ে নয়, আপন মুখশ্রীর অন্তর্দীপ্ত মাধুর্য্যেই আলোকিত করেন ফেসবুকের ওয়াল।'

    ReplyDelete
  2. Facebook er kolei rritobak er jonmo tai Facebook er bhalodikta dekhtei hoy.sahitya chorchao to er maddhome dibbi chole.koto sundor lekha pora jay.

    ReplyDelete