0

সম্পাদকীয়

Posted in



আশঙ্কাটা ধিকি ধিকি আগুনের মতো জ্বলছিল অনেকদিন। একটু স্তিমিতও হয়ে এসেছিল কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মুক্ত কণ্ঠস্বর, ঘনিষ্ঠ যাপন থেকে উঠে আসা সাহিত্যের ভাষা মৌলবাদের দ্বারা আক্রান্ত হলো। লেখক রক্তাক্ত হলেন নাকি শুভবুদ্ধি আর মননশীলতা? ধর্মান্ধতার নগ্নরূপ আমরা দেখেছিলাম এই শহরেও। আমাদের বিবেকী সততা আমরা সেদিনও রক্ষা করতে পারিনি। আর এবার, আপাতচূড়ান্ত নিরাপত্তার অসহায় চেহারা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। ধ্বংসের বীজ যদি আমাদের অন্তঃস্থলে বসবাস করে, বাহ্যিক প্রকরণ কি তাকে সুরক্ষা দিতে পারে? Pen is mightier than sword আপ্তবাক্যটি বাঁচিয়ে রাখার এমন দায় আগে কখনও আসেনি।

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in




















দূর আকাশে আলো মাখা মেঘ বকের ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। কোথাও নদীর বুকে ছায়া পড়েছে সেই নীলাঞ্জনময় আকাশের।আকাশ বড় রূপময়। নদী রূপময়ী।আকাশের নীল দর্পণ সমন্বিত আলো নদী- জলকে চুম্বন করছে।ত্রিপুরার কমলপুরের ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজোর কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় কত কী।শরৎ মানেই উজ্জ্বল নীল আকাশ।নদীর তীরে বালুকাবেলায় অজস্র কাশফুল।তাদের মাথায় মাথায় চিহ্নিত চাঁদের আলো।সেই জ্যোৎস্না দেখে মানুষ গান বাঁধেন।মানুষ কবিতা লেখেন।মানুষ দিগ্বিজয়ে যান।প্রাচীন কালে যখন রাজাদের রাজত্ব ছিল, তখন রাজারা এই শরতে, দিগ্বিজয়ে যেতেন।তাঁদের হাতি, ঘোড়া, লোক-লশকর, পাইক-বরকন্দাজ, তলোয়ার, বন্দুক,কামান নিয়ে তাঁরা দিগ্বিজয়ে বেরতেন।

আমরা ছেড়ে আসা সময়ের স্কুলপাঠ্য বাংলা রচনায়- শরৎকাল শিরোনামে পড়েছি- ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি,আশ্বিন-কার্তিক-এই দু মাস আরাধনার মাস।দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী- সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী মাতৃরূপের নানা প্রতিচ্ছবি এই আলোকধারায় প্রতিভাত হন। তখন নদীতে নতুন জল।বর্ষা অতিক্রান্ত সময়ে সেই বহতা স্রোত ক্রমশ কাচ যেন।তার ওপর রোদ্দুর পড়লে অজস্র হীরক- ঝিল্লি গড়ে ওঠে।মাঝিরা গান গাইতে গাইতে নৌকো নিয়ে চলে যান দূর থেকে দূরান্তে।

ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজো দেখলেই মনে হয় তেমন কোনো আড়ম্বর নেই।সাদামাটা, একটু যেন জৌলুশ ছাড়াই ওই পুজো। এই বংশানুক্রমিক পুজোর প্রচলন কবে হয়েছে সঠিকভাবে বলতে পারেন না ভট্টাচার্য পরিবারের জীবিত উত্তরপুরুষেরা।

দূরে কোথাও ঢাক বাজছে।পুরোহিত আরতি করছেন দেবী প্রতিমার।আঠারো প্রদীপের আলো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে দেবীর চোখে, মুখে, ঠোঁটে,গালে,দশ হাতে। তিনি দশপ্রহরণধারিণী, তিনি অসুরদলনী।তিনি দুর্গা।দুর্গামণ্ডপে যে মূর্তি তৈরি হচ্ছিল এতদিন,ধীরে ধীরে, তৈরি হচ্ছিল মূর্তির সাজ, খড় আর দড়িতে বাঁধা কাঠামোর ওপর কাদা-মাটির আস্তরণ ধীরে ধীরে রূপ পেয়েছে চক্ষু দানের মাধ্যমে দেবীর শরীরে।দেবীর মুখ প্রতিভাত হয়ে ওঠে মহালয়ার ভোরে,দেবীপক্ষের শুরু, পিতৃপক্ষের শেষে চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে প্রতিমা- মুখ জীবন্ত হয়ে ওঠে মূর্তিকরের তুলির ছোঁয়ায়।

কমলপুরের ভট্টাচার্য পাড়ার যে দুর্গাপুজো ,তা প্রচলনের কথা এই পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য জনেদের কথায়-মুখে মুখে জানা যায়। পাঁচশো বছর আগে যুক্তবঙ্গের সোনারগাঁও অঞ্চলে এই পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।যদিও সব পুজোর পেছনেই এরকম স্বপ্নাদেশের কথা থাকে।সেই সত্য,মিথ্যা, কল্পনা, অতিকথন- সব মিলেমিশে পুজো প্রচলনের কথা আমরা বুঝতে পারি।সেই সময় যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ, যিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, তিনি অত্যন্ত সাধারণ,সাদাসাপটা ভাবে অতি অল্প আয়োজনে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।আমরা জানি দুর্গাপুজোকে বলা হয় কলির অশ্বমেধ।দুর্গাপুজোর ব্যয় অনেক।কিন্তু এই গুরুকূলবাড়ির দুর্গা আরাধনার কথা বলতে গেলে ইতিহাসের পুরনো পাতা ওল্টাতে হয়।আসলে এই যে সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকা ব্রাহ্মণ পরিবার, তাঁদের পাশে জমিদারবাড়ি, সেখানে খুব ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত।ব্রাহ্মণের ইচ্ছে তিনি দুর্গাপুজো করবেন।কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নেই।ব্রাহ্মণ সজল নয়নে জমিদার বাড়ির ঢাক-ঢোল- কাঁসি- দুর্গা আরাধনা, মণ্ডপে মানুষের ভীড়, সবটা লক্ষ্য করতে থাকেন।তাঁর মনে হতে থাকে- আমি কী পারব না কোনোদিন এরকমভাবে মাতৃ আরাধনা করতে? তখন এক রাত্রে তিনি স্বপ্নাদেশ পেলেন। দেবী দুর্গা স্বয়ং এসে বললেন, এরকমই শুনে এসেছি আমরা,তুই দুঃখ করছিস কেন? তোর কীসের কষ্ট। ব্রাহ্মণ বললেন- 'মা আমার কষ্ট অনেক, আমি কীভাবে বলি? 'তখন দেবী তাকে বললেন - তুই আমার পুজো কর।ব্রাহ্মণ বললেন -আমি কীভাবে করব? আমার অর্থ কোথায়,সামর্থ্য কোথায়, আমি কী করে আপনাকে সন্তষ্ট করব মা? দেবী বললেন- সব আছে তোর।বাড়ির পাশে যে বড় কলা গাছের ঝোপ আছে সেখান থেকে পাকা কলা ও কলা গাছ নিয়ে আয়।কলা গাছের থোড় দিয়ে খেসারি ডাল রান্না করে ভোগ দিবি।আর কলা দিয়ে তৈরি হবে পিঠে। ব্রাহ্মণ সব শুনলেন,শুনে চুপ করে রইলেন।শেষ রাতের আলো- অন্ধকার তাঁকে ছুঁয়ে গেছে।তাঁর ভেতরে আনন্দাশ্রু। তিনি ঠিক করলেন এবার দুর্গাপুজো হবে।সামনেই দেবীপক্ষ।পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে আসছে।ব্রাহ্মণ কোমর বেঁধে নামলেন।তাঁর সমস্ত জ্ঞাতি এবং বংশের লোকজনদের নিয়ে কলা গাছের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হবে দুর্গাপুজোর ভোগ এবং ভোগ-উৎসব।সেই থেকেই শুরু হল ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজো। অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে।

তাঁদের বাড়ির দুর্গা আরাধনা শুরুর পর্বে সেই স্বপ্নাদেশ পাওয়া ব্রাহ্মণ আনাজপাতি যোগাড় করে ভোগ দিতেন।ফল,ফুল- সবই নিজের এক্তিয়ারে, নিজেদের বাড়িতে ফলান। পরে এই পরিবারের উত্তরাধিকারী রামকান্ত ভট্টাচার্য, তিনি ত্রিপুরায় প্রথম আসেন এবং জানা যায়, সেই সময় ঢাকার ভট্টাচার্য পরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগ ছিল।বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক সুপ্রিয় দত্তের গবেষণা থেকে জানতে পারি যে, সেই সময় বিশিষ্ট শিল্পী ও লেখক গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু জায়গা-জমি কমলপুর ও কুলাই অঞ্চলে ছিল। ঠাকুরবাড়ির নায়েব প্রীতি সেন রামকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়িতেই থাকতেন, সম্ভবত সেটা ১৯২০ সাল।

রামকান্ত ভট্টাচার্যরা ছয় ভাই।পরবর্তী কালে তাঁরা কমলপুরে চলে আসেন এবং তাঁদের বসবাসের এলাকা ভট্টাচার্য পাড়া নামেই আজও পরিচিত। দিনের পর দিন চলে যায়। রামকান্ত ভট্টাচার্য ও তাঁর সাত ভাইয়ের বংশধরদের নিয়ে এখনকার ভট্টাচার্য পাড়া।এই পরিবারের একটি ছোট্ট শাখা কলকাতায়,কয়েকটি পরিবার বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর এবং আমেরিকায় নিজেদের শিকড় ছড়িয়েছে। পরিবারের সব মানুষেরা কমলপুরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গার আরাধনা শুরু হয় এবং সেই নিয়মেই আজ পর্যন্ত পুজো চলেই আসছে। এই পরিবারের প্রাচীন মানুষেরা এবং এই অঞ্চলের অন্য অন্য পুরনো বাসিন্দারা, লোকেরা তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারি উনিশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আরাধনা মাত্র একবারই বন্ধ ছিল।

ভট্টাচার্য পাড়ার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল, এই প্রতিমার মুখ যদি আমরা দেখি, সেই এক হাজার প্রদীপের আলোয় কাঁসর-ঘণ্টা, ঢাক ইত্যাদির শব্দে, সাজে তৈরি হয় দেবীমুখ, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা।অর্থাৎ সোনাকে ব্যাপকভাবে তাপ দিয়ে, তার যে রঙ তৈরি হয়, সেই রঙ রয়েছে দেবীমুখে।আমাদের দেবীর রূপের যে বিবরণ আছে, সেখানে দুর্গার নানাবর্ণ। কখনও মুখ বা শরীর অতসী ফুল রঙের। কখনও তিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। মহিষাসুরকে বধ করার সময় দেবী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা হয়েছিলেন।সেই কথা আমাদের শ্রী শ্রী চণ্ডী জানিয়ে দেয়।কাঁচা হলুদের রঙও থেকে যায় তাঁর গায়ের রঙে।পুজোর যে ঘন্টাধ্বনি, যে কাঁসরের আওয়াজ, আঠারো প্রদীপের আলো, পুরোহিতের হাতে দুলতে দুলতে তা হয়ত চলে যাচ্ছে কল্পনার অমরাবতীর দিকে।আমরা দেখতে পাচ্ছি,দূরে কোথাও ঢাক বাজছে ত্রিপুরার মানিকভান্ডারের সেবিকা ধরও দেখতে পাচ্ছে, ঢাক বাজছে খুব জোরে,সঙ্গে কাঁসি-কাঁসরের কাঁই না না না,কাঁই না না না...।সেখানে একটি কথা,একটি কাহিনি ঘুরেছে মুখে মুখে।কাহিনিটি এরকম।

রাতের অন্ধকারে প্রতিমার মুখে রঙ করতে গিয়ে যিনি প্রতিমা তৈরি করছেন, সেই কুম্ভকারমহাশয়, তিনি ঘুমের ঘোরে ভুল করে অন্য রঙ দিয়ে দেন।তখন তো জোরাল আলো-আলোক শিখা নেই,তখন তো বিদ্যুতের ঝনঝনা নেই,তখন হ্যারিকেন আর কুপির আলোই যথেষ্ট ছিল। তখনতো মানুষের উপায়ও ছিল না বেশি করে আলো জ্বালার। ফলে সাধারণ কেরোসিনের বাতি দিয়েই কাজ চালিয়েছেন তাঁরা অথবা রেড়ির তেলের প্রদীপে। এরকমভাবে দেবী প্রতিমার মুখের রঙ করতে করতে শিল্পী বা কুম্ভকার তাঁর হয়ত ঘুমের ঘোরে ভুল হয়েছিল। দেবী প্রতিমার মুখ দেখে কুম্ভকার বা কারিগর ঘাবড়ে যান।কেননা দেবীর মুখ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ হয়ে গেছে।কারিগর, শিল্পী বা কুম্ভকারের- তাঁর ঘুমের ঘোরে ভুল হয়েছিল।ফলে তড়িঘড়ি একটা ধারাল ব্লেড খুঁজে নিয়ে তিনি দেবী প্রতিমার মুখের রঙ তুলতে শুরু করেন।তখন এই বংশেরই একজনকে স্বপ্নাদেশ দিলেন দেবী দুর্গা। তিনি বললেন, এই রঙ থাক।এই রঙ তুলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, এই কুম্ভকার বা কারিগরকে থামাও।আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। যে রঙ আছে, তাই থাক।' এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি দৌড়ে চণ্ডীমণ্ডপে যান এবং কারিগরকে নিরস্ত করেন। সেই থেকে দেবীর মুখ,দেবীর শরীর হাত,পা, গলা- সবই তপ্তকাঞ্চনবর্ণ।এখন এরকম কথা, মিথ বা চলন কথা বা দেবীর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার কথা বহু জায়গায় প্রচলিত রয়েছে।স্বপ্ন, মিথ ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে নানাভাবে।এই সমস্ত মিথ কালে-দিনে মানুষের মুখে মুখে তথাকথিত সত্য বা সত্যের কাছাকাছি বলে প্রতিভাত হয় এবং মানুষ সেটা সত্য বলেই বিশ্বাস করতে থাকে।আমরা সেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে যাচ্ছি না।আমরা বরং পিছিয়ে গিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকাই।

একসময় প্রতি নবমীতে দেবী মূর্তির সামনে বলির প্রচলন ছিল।তখন কয়েকটা পাঁঠা বলি দেওয়া হত।তবে এখন আর পাঁঠা বলি হয় না।ইদানীং আখ, আদা,কলা, চালকুমড়ো,লেবু বলি দেওয়া হয়।আর কাল্পনিক শত্রুর চেহারা মাটি দিয়ে তৈরি করে, মানকচু পাতায় মুড়ে বলি দেওয়া হয় দেবী প্রতিমার সামনে।নবমীতে দেবী দুর্গাকে মাছ রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন তাঁকে ফল-মিষ্টির পাশাপাশি রান্না করা ভোগও দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় দেওয়া হয় বৈকালিক ভোগ।আর পরিবারের সবাই ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত নিরামিষ খেয়ে পুজা করলেও নবমীতে দুর্গা আরাধনার পর আমিষ খাওয়ার অনুমতি আছে।

দুর্গা মূর্তির পাশাপাশি থাকেন নারায়ণ শিলা।যিনি শ্রীধর নামে পরিচিত এবং পূজিত।তাঁরও পুজো হয়ে থাকে এই দেবী পুজোর সঙ্গে। হয় চণ্ডীপাঠ, সন্ধিপূজা এবংলক্ষ্মী পূজা, কালীপূজা। পুজোর এই তিন দিন ভট্টাচার্য পাড়ার সকলে মিলে পাশাপাশি বসে একসঙ্গে আহার সারেন।খুব যে সেখানে বড় বড় কোনো পদের আয়োজন করা হয় তা নয়,সেই আয়োজন না থাকলেও সাদামাটাভাবে যে খাবার হয়,যে প্রসাদ হয়, যে ভোজের আয়োজন হয়, সবাই মিলে তা গ্রহণের আনন্দই আলাদা।প্রতিদিন একজনকে পুজোর যে কাজকর্ম, তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।তাঁর ওপরই সব দায়ভার।পাড়ার প্রত্যেক বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে, বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারাও তাঁরা তাঁদের মতো নিজেদের যুক্ত রাখেন।এবং সবাই পুজোর কাজ করেন মন দিয়ে। এই পরিবারের এখন যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সুরজিৎ ভট্টাচার্য-তাঁর বয়স ছিয়াশি।তিনি নিজে দুর্গা আরাধনার পৌরহিত্য করেন।জীবিত সব পুরুষ বংশধরদের নামে সংকল্প করে এই পূজা সম্পন্ন হয়। কোনো নারীর নামে হয় না।কেন নারীদের নামে সংকল্প করা হয় না,তা আমাদের জানা নেই।

সারাবছর ধরে যারা বাইরে থাকে, পুজোর সময় তাদের ঘরে ফেরার একটা টান থেকে যায়।সবার সঙ্গে দেখা হবে।সবার সঙ্গে কথা হবে।এই যে আগ্রহ ও ইচ্ছে, তা কিন্তু সবার মনে তৈরি হতে থাকে।সে যে ঘরের ডাক।বাড়ির ডাক।জন্মভূমির ডাক বা পিতৃভূমির ডাক, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।ঢাক,ঢোল বেজে উঠে। বাজে কাঁসি, ঘন্টা।আড্ডা, গল্প,ভোগের প্রসাদ, আনন্দ, হৈচৈ-এই চার-পাঁচ দিন কীভাবে কীভাবে যেন কেটে যায়।তিন দিনের পর আসে দশমী।সেখানে তখন সেই লাইনগুলো আমাদের মনে পড়ে- 'যেওনা রজনী আজি লয়ে তারা দলে।'

সকলের চোখে তখন বিষাদাশ্রু।দেবী চলে যাবেন।তিনি চলে যাবেন অর্থাৎ তাঁর নিরঞ্জন হবে। কিন্তু তিনি কোথায় যাবেন? তিনি যাবেন না।আমাদের কল্পনার কৈলাসে তিনি যাবেন।উড়িয়ে দেওয়া হবে নীলকন্ঠ পাখি।এখন তো আর নীলকন্ঠ পাখি ওড়ান হয় না।তার প্রতীকী নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হয়। বা মাটির নীলকন্ঠ উড়িয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু তিনি যাবেন না।তাই আমরা বলি, পুনরাগমনায়চ- অন্তরের দেবী তিনি ঘটে অবস্থান করছিলেন, এবার তিনি আমার অন্তরে বিরাজ করবেন,বসবেন। পরে প্রতিমা ভাসান হলে দেবী শূন্য দালান, সেখানে জেগে থাকা প্রদীপ,প্রদীপের শিখা যেন সার্বিক এক কান্নার ঘোর আমাদের মধ্যে বপন করে। যে আনন্দধারা বয়ে চলে এই পাঁচদিন ধরে, সব যেন নিরানন্দ অন্ধকারে কন্যা- বিবাহের পর, কন্যা-বিদায়ের পর, কন্যা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে বাপের বাড়িতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, অনেকটা যেন সেইরকম ছবি ফুটে ওঠে সকলের সামনে।আবার সবাই বলতে থাকেন, বছর ঘুরে আবার এসো মা।এই যে তাঁকে ডাকা, তাঁকে নিয়ে আসার যে বাসনা,সেই বাসনার ঘোর জেগে থাকে নতুন মূর্তি,নতুন প্রতিমার আবাহন নিয়ে। কত কী বদলে যায়,কতজন চলে যায়,যেখান থেকে মানুষ কোনোদিন ফেরে না, যেখানে মৃত্যুর ঘোর অন্ধকার, তার মধ্যে আর দেখা হয় না প্রিয় মুখ।আবার নতুন যে জন্ম, ছোট ছোট হাত,ছোট ছোট পা,তাদের বড় বড় প্রত্যয়, অর্থাৎ নতুন যারা এসেছে, তারা আবার প্রস্তুত হয় দেবী প্রতিমার আবাহনের জন্য।

সুখ -দুঃখ আনন্দ-বেদনা- সমস্ত কিছু গতানুগতিক জীবন ধারা, তার বাইরে গিয়ে এই পুজো। ভট্টাচার্য পাড়ার মধ্যে যেন এক আনন্দ-অনুভূতি এবং চেতনায় যেন ভোরের সূর্য হয়ে জেগে থাকে। যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা উচ্চারণ করেন, জগজ্জননী এই যে দুর্গা, তিনি যেন সর্বদা কল্যাণ করেন এই ভট্টাচার্য পাড়ার শুধু নয়,সমস্ত দেশ, সমগ্র জাতির মঙ্গল সাধন করেন তিনি। ভট্টাচার্য পাড়ার মানুষেরা মনে মনে বলতে থাকেন। আবার এসো মা।কল্যাণে এসো,আনন্দে এসো,সূর্যোদয়ে এসো,জীবনে এসো,জীবন ধারায় এসো।

0 comments:

1

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in



মহাকাল। দেবাদিদেব। এত যে বিশেষণ সে সবই এমন একজনের উদ্দেশ্যে যিনি কিনা ছিলেন এক অনার্য দেবতা। বনে জঙ্গলে শ্মশানে মশানে যার অবস্থিতি। জঙ্গলের আরণ্যক মানুষ ও পশু সমভাবে তাঁর কাছ থেকে বরাভয় লাভ করেছে। পরনে বাঘছাল আর গায়ে চন্দন নয়, শ্মশানের ছাই মেখে তিনি যথেচ্ছ ভ্রমণশীল। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট স্বর্গ নেই। সভ্য নাগরিক জীবনে তিনি ব্রাত্য। তাঁকে বেদ মানে না। আর্য ঋষিদের যজ্ঞের অনুষ্ঠানে তাঁর নামে ‘স্বাহা’ আহুতি নেই। বলতে গেলে তিনি আমাদের ‘মূল নিবাসী’ দের একচ্ছত্র ঈশ্বর।

এই আহুতি আমাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধভঞ্জনের আহুতি।

শুরু করা যাক প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। সিন্ধু সভ্যতার খননকাজ চলছে। মাঠ পরীক্ষায় উন্নত নগর জীবনের অভূতপূর্ব সব নিদর্শন উঠে আসছে। আমাদের চমকিত করে উঠে আসছে অতি উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা। উন্নত পয়ঃপ্রণালী, সেচ ব্যবস্থা, নগরের স্থাপত্য, সব কিছুর মধ্যেই আমাদের সভ্যতার গর্বকে চূর্ণ করার আয়োজন। এই সব নিদর্শনের মধ্যে উঠে আসছে মাটির পুতুল, খেলনা গাড়ি, খেলনা হাতি, চালখেলার ছক ইত্যাদি। আর আসছে মুদ্রা ও ভাস্কর্য। লৌহ যুগ তখনও দূরে। সেই ভাস্কর্যের মধ্যে দেখা যাচ্ছে পশু পরিবেষ্টিত এক মহিমাময় পুরুষ। পশুপতিনাথ। বেদ সম্ভবত তখনও উত্তর পশ্চিমের অক্ষু নদী ও হিন্দুকুশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে গুটিকয় যাযাবর নৃশংস শিকারি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও একেশ্বরবাদ বহু দূরের গল্প। শুধু প্রাকৃতিক শক্তির পূজা চলছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল অব্যাহত। এক এক গোষ্ঠীর নেতা ইন্দ্র নামে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের নিয়মনীতির বালাই নেই। তারা সমৃদ্ধ গ্রাম জনপদ নগর দেখলেই আক্রমণ করে, শস্য লুঠ করে নারী নির্যাতন শিশুহত্যা কিছুই বাদ যায় না। বেদ তাদের পরিচয় দিচ্ছে ‘পুরন্দর’। যিনি পুরকে ধ্বংস করেন। এই লুন্থন এই চৌর্যবৃত্তি মহিমাময় আকার নিলো। ওদিকে আরণ্যক মানুষেরা ভীত। অরণ্যকে দ্রুত গ্রাস করছে এক একটি গোষ্ঠী। উপায়? বৃক্ষতলে পূজিত দেবদেবীকে তারা দক্ষিণ পশ্চিমে সিন্ধুর সমৃদ্ধ নাগরিক রাজ্যগুলিতে দান করতে শুরু করল। আমরা দেখতে পেলাম আরণ্যক দেবতা পশুপতিনাথ নগরে আরাধিত হতে শুরু করলেন। নিপুণ শিল্পীর হাতে আমরা সেই মূর্তির উৎকৃষ্ট শৈল্পিক রূপ দেখতে পাই। জানতে পারি আরণ্যক দেবতা কেমন করে নগরের দেবতা হয়ে উঠলেন। এই আশ্রয় ও সহমর্মিতার মধ্যেই দেখতে পাই একটি ধর্মীয় সমন্বয়। মহাকাল নিশ্চয় তখন তাঁর ভস্মে ঢাকা শরীর নিয়ে কপালে চাঁদের কণাকে ধরে রেখে মুচকি হেসেছিলেন। ‘কাল’কে কে জানে? কাল পরম গতি। আজ যা বর্তমান কাল তা অতীত আবার আজ যা বর্তমান গতকাল তা ভবিষ্যৎ ছিল। একমাত্র ‘মহাকাল’ এই রহস্য জানেন। তাতেও কি তাঁকে গ্রহণ করতে পারে উত্তরের বর্বর যাযাবরেরা? অগ্নিহোম যাদের আরাধনা অনুষ্ঠান, যারা আরণ্যক মানুষ ও বনের পশুর প্রাণের তোয়াক্কা করেনা তারা কী করেই বা এই অরণ্য দেবতাকে, যিনি অগ্নিযজ্ঞ মানেন না তাঁকে গ্রহণ করবে?

কীভাবে মহাকাল পশুপতিনাথ শিবে পরিণত হলেন তা দেখার আগে একবার অন্যন্য ধর্মে তাঁর উপস্থিতি দেখে নিই।

সুমেরিয়ার দেবতা আদাদ। বুনো মহিষের পিঠে চেপে যেন যুদ্ধে যাচ্ছেন। আমাদের মহেশ্বরের সঙ্গে তাঁর আর কি কি মিল? যিনি ঝড়ের দেবতা, এবং একই সঙ্গে ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা। দক্ষিণ সুমেরে তিনি ধ্বংসের দেবতা আবার উত্তরে তিনি কল্যাণময়। আদাদের পিতা ‘আনু’। অর্থাৎ ব্যোম বা শূন্য। ঠিক যেমন মহেশ্বর আরণ্যকদের কাছে কল্যাণময়, আর উত্তরের যাযাবর যাজ্ঞিকদের কাছে তিনি স্বয়ং মৃত্যু। এ থেকে বুঝতে পারা যায় প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির মধ্যে ধর্মীয় ও দার্শনিক আদানপ্রদান চলত।

একটি কাহিনী বলা যাক।

সতী মহাকালকে পতিত্বে বরণ করেছেন। কিন্তু চালচুলোহীন ভিখারি এক পুরুষের গলায় মালা? স্বর্গের দেবতা বা উত্তরের জাতির দেবতাদের কাছে তিনি ব্রাত্য আভিজাত্যহীন। তাই সতী তাঁর পিতৃগৃহে ত্যাজ্য হলেন। কীভাবে? সতীর পিতা রাজা দক্ষ এক যজ্ঞ করলেন। সেই যজ্ঞে সতীপতির নিমন্ত্রণ রইল না। এক তো তিনি অগ্নিহোম করে অরণ্যের ক্ষতি পছন্দ করেননা, ফলে যজ্ঞ পণ্ড হতে পারে, দ্বিতীয়ত তিনি স্বগোত্রীয় দেবতা নন। অন্য জাতে বিয়ে করে সতী মহা অন্যায় করেছেন। কিন্তু সংবাদ পেয়ে সতী উপস্থিত হলেন এবং রাগে দুঃখে অপমানে আত্মহত্যা করলেন। মহেশ্বর এলেন সেই সংবাদ পেয়ে। উপস্থিত দেবতারা তাঁকে ব্যাঙ্গ করলেন নিন্দামন্দ করলেন খুব। মহেশ্বর রুদ্র রূপ ধারণ করলেন। দক্ষের মাথা কাটা পড়ল। অগত্যা যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে ছাগমুণ্ড বসিয়ে যজ্ঞ শেষ করা হল। নটরাজ তখন প্রলয় নাচন নাচছেন। এই পৌরাণিক কাহিনীর অন্তরালে এক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করেছিলেন। শিব, মহাকাল, পরম জ্ঞানের প্রতীক। তিনি ত্রিকালস্রষ্টা। তাঁকে ছাড়া যজ্ঞের অর্থ, দক্ষের পশুর মাথা। ছাগমুণ্ড। সেখানে কখনোই পরম জ্ঞানের আলো পৌঁছবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাচীন আর্য যুগে কিন্তু একেশ্বরবাদ সেভাবে আসেনি। নানা দেবতার ছড়াছড়ি। দেবী নেই। কারণ আর্যরা নারীর মনুষ্যত্ব শিকার করেনা। উপনিষদের যুগে প্রথম একেশ্বরবাদের দর্শন। সমস্ত দেবতাদের উর্দ্ধে তিনি। তিনিই ব্রহ্ম, অবাংমানসোগোচর। তিনি আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। সমস্ত জগত জুড়ে তাঁর অস্তিত্ব অথচ তিনি আমাদের বাক্য মনের অতীত। এই উপনিষদের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম অষ্টম শতক। এ সময়ে সিন্ধুর নগরের আর অস্তিত্ব নেই। এক অজ্ঞাত কারণে প্রলয় ঘটে গেছে। শূন্য নগরের ধ্বংসস্তুপে ইতস্তত মৃতদেহ ও ব্যবহৃত নানা বস্তু। সেই সব সিন্ধুনাগরিক মিশে গিয়েছেন বৃহৎ ভূমির নানাস্থানে। তাঁদের একটি বৃহৎ অংশ পরিযায়ী নাগরিকেরা বিন্ধ্য পেরিয়ে রাজমহল পেরিয়ে পুণ্ড্র অঞ্চলে বাসা বেঁধেছিলেন। ধীরে ধীরে শৈববাদ প্রাচীন আরণ্যক ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে মিশে গেল মূল স্রোতে। এক সংকর জাতির উদ্ভব হলো সমগ্র জম্বুদ্বীপ (ভারতীয় উপমহাদেশ) জুড়ে। প্রাচীন বেদের কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে তখন পূর্বের শ্রামনিক প্রভাব ও অনার্য প্রভাবে জন্ম হয়েছে এক নতুন দর্শনের। উপনিষদের শ্লোকে এই নবলব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ। উপনিষদ তাই জ্ঞানকাণ্ড।

উপনিষদের ঋষি এই মহেশ্বরকে ‘রুদ্র’নামে ভূষিত করলেন।

একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য
ইমাঁল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ
প্রত্যঙ্ জনাং স্তিষ্ঠন্তি সঞ্চুকোপালে
সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ – ৩/২)

বিগলিতার্থঃ রুদ্রই পরম মায়াবী, কারণ তিনি অদ্বিতীয়—ব্রহ্মবিদগণ দ্বিতীয় কারো আকাঙ্ক্ষায় ছিলেননা। সেই রুদ্রই এই সমুদয় লোককে স্বীয় শক্তিসহায়ে নিয়মিত করেন। তিনি অন্তর্যামী। তিনিই এই নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, পালক ও সংহারক।

ঋষি স্বীকার করছেন রুদ্র সকল দেবতাদেরও দেবতা। জগত কারণ, মহাকারণ। স্বীকার করছেন বেদ যাকে ব্রাত্য বলেছিল সেই মহাকালই আসলে জগত কারণ।

কিন্তু মহাকালের দুটি রূপ আছে। একটি সংহারক অন্যটি কল্যাণময় মঙ্গলদায়ক। যখন রোগে শোকে যুদ্ধে দুর্ভিক্ষে যখন জর্জরিত হই তখন সেই প্রলয়ঙ্কর মূর্তি। আর যখন শান্তম শিবম অদ্বৈতম, তখন তিনি মঙ্গলদায়ক। ঠিক যেমন মধ্যাহ্নের দিনমণি জগত দাহনের কারণ, আবার ঊষার বালার্ক জলরাশি সঞ্চয় করে বর্ষণ ঘটায়। শস্য ফলে। একটু দূরের কথা হলেও বলে নেওয়া দরকার, সেসময় বেদের ঋষিরা বিশ্বাস করতেন এ জগতের সৃষ্টির মূলে পুরুষ। বীর্য বা শুক্র। তাঁরা বলছেন, তদেব শুক্রম তদ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য)। বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে বীর্য পাত হয় ধরিত্রীর বুকে। তাই শস্য ফলে ঠিক যেমন আমাদের সন্তান জন্মায়। শুধু পুরুষই সৃষ্টিকর্তা। নারী আধার মাত্র। কিন্তু সত্য তা নয়। নারীর ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্র নিষিক্ত হলে তবেই ভ্রূণের সৃষ্টি হয়। একথা ভারতের আদিবাসীরা জানতেন। তাই তাঁদের ধর্মে নারীর স্থান ওপরে।

উপনিষদ যখন রুদ্রের বন্দনা করছেন ঠিক তখনই এক ব্রহ্মবাদিনী নারী মহাকালের কাছে অন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। ক্রন্দনরতা বিদুষী (মার্জনা করবেন, নাম জানতে পারিনি)

রুদ্র যত্তে দক্ষিণ মুখম, তেন মাং পাহি নিত্যম।

রুদ্র তোমার তেজ সংবরণ করো। তোমার কল্যাণময় রূপে প্রকাশ হও, আমি দেখি।

এই ব্রহ্মবাদিনীকে প্রণাম হই। কারণ তিনিই প্রথম রুদ্রকে শান্ত হতে প্রার্থনা করলেন। সশিব হতে প্রার্থনা করলেন। আর তার সঙ্গে মিশে গেল আর একটি গভীর গূঢ় শব্দ—অদ্বৈতম।

যতক্ষণ ভেদ ততক্ষণ মহাকাল রুদ্র। দুই থাকলেই রুদ্র। কিন্তু এক থাকলে অভেদ হলেই তিনি শিব। মঙ্গলময়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন—শিব ঐক্যবন্ধনে।এখানে বন্ধনের পরিবর্তে আমরা শিব ঐক্য স্থাপনে ও বলতে পারি।

এই যে নারীকে সামাজিক মর্যাদায় নরের তুল্য করতে হল এ তো রুদ্রকে শান্ত করতেই!

এত কথার মূলে কীভাবে ‘শিব’কে বৈদিক ধর্মে স্থান দিতে হল তার ইতিহাস জানানো।

পরের অংশে দেখব এক উচ্চতর এবং জটিল দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে। খৃষ্টীয় নবম শতকে কাশ্মীরে একদল শৈব আচার্যের আবির্ভাব হয়। ৮২৫ খৃষ্টাব্দে আচার্য বসুগুপ্ত এই তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। যদিও বেদ একে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেনা। এই দর্শনকে বলে কাশ্মীরি শৈববাদ, বিশ্বের ভাষায় প্যান্থিজম।

কী আছে কাশ্মীরি শৈববাদে?

কাশ্মীরি শৈববাদ অনুসারে শিবের পাঁচটি মুখ। এই পাঁচটি মুখকে যথাক্রমে পরমশিব, শিবশক্তি, সদাশিব, সদাখ্যা, ও সদবিদ্যা বা ঈশ্বর তত্ত্ব বলে।

পরমশিব বা মহাকাল যিনি মহাকারণ, তিনি আপন আনন্দে নিরালম্ব অবস্থায় এই জগত সৃষ্টি করেন। পিতৃরেতঃকে আমরা সেই পরমশিব বলতে পারি। এ অবস্থায় প্রাণের যে বিশুদ্ধ অস্তিত্ব থাকে তাইই পরমশিব। এরপরে পরমশিব আবরণে প্রবিষ্ট হলেন। যাকে বলা হয়—শিবশক্তিতত্ত্ব।

শক্তি এই শরীর। নারী এই দেহের জন্মদাত্রী। তাই ভ্রূণের আবরণে প্রাণকে শিবশক্তিতত্ত্ব বলে। লক্ষ করার বিষয় হল, শিব ও শক্তি পৃথক অস্তিত্ব নয়। অভেদ অস্তিত্ব। অনেকেই শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি দেখেছেন। মূর্তির দক্ষিণ দিকে শিব ও বামে শক্তি মূর্তি। যোগের ভাষায় অবশ্য এর অর্থ লম্বিতভাবে দেহের দক্ষিণ অংশে ঈশ্বরীয় প্রকাশ ঘটে। আর বাম অংশ প্রকৃতি। দেহকে রক্ষা করছেন। দু’য়ে মিলে অর্ধনারীশ্বর। প্রতিটি মানুষ জীবিতকালে এই অর্ধনারীশ্বর রূপে পৃথিবীতে থাকে। মৃত্যুর পর প্রাণের যে চেতনাময় অস্তিত্ব তা আবার পরমশিবে রূপান্তরিত হয়। তাই প্রতি দেহে নর ও নারী সমভাবে বর্তমান। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে নরকে নারীতে বা নারীকে নরতে রূপান্তর সম্ভব। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা না থাকলে এ অসম্ভব ছিল। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই তাই এই শিবশক্তি সত্ত্বা বর্তমান।

সদাশিব শিবের সেই মুখ যখন তিনি শান্ত আনন্দে বর্তমান। এই জগত সৃষ্টি করে তার মধ্যেই বাস করছেন। যোগের ভাষায়, দেহে একটি সদা আনন্দের হিল্লোল থাকে। তাইই সদাশিব। শিব তখন লীলা করছেন। যোগক্রীড়া।

সদ্যাখ্যা তত্ত্ব একটি অদ্ভুত দর্শন। সমস্ত জগত জুড়ে যখন অভেদের সূত্রপাত ঘটে, যখন মানুষে মানুষে শিবের প্রকাশে মৈত্রী স্থাপন হবে তখন সদাখ্যা তত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশ।

ঈশ্বর তত্ত্বে জগত শিবময়। প্রতিটি মানুষে তার ঐশ্বরীয় সত্ত্বার প্রকাশ ঘটবে। পূর্ণ অদ্বৈত।

কাশ্মীরে যখন এই অপূর্ব দর্শনের উদ্ভব ঘটছে তখন সারা ভারত জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযানী সম্প্রদায়ের দারুণ প্রভাব। মহাযান ধর্মে নাগার্জুন কল্পনা করেছেন আরও তিন বোধিসত্ত্বের। সবাই জানেন মহাযান মতে অসংখ্য বোধিসত্ত্ব। সেই মোট অনুসারে নাগার্জুন সৃষ্টি করলেন অমিতাভ বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব এবং মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব। অমিতাভ বোধিসত্ত্ব অমিতজ্যোতিস্বরূপ। জগত সৃষ্টির কারণ। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব তিনিই যিনি পরম করুণায় জগতকে অবলোকন করছেন। মনে পড়ে, শিবের অর্ধনিমীলিত করুণায় আর্দ্র দুটি চোখ। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব আর কাশ্মীরি শৈববাদের ঈশ্বরতত্ত্বে কোনো তফাত নেই। নাগার্জুনের এই তত্ত্ব যদিও প্রায় হাজার বছর আগেকার। তবু দর্শনের তত্ত্বে কেমন অদ্ভুত মিলে যায় দুটি পৃথক মত।

কেউ কেউ বলেন শিবমূর্তির চেয়ে শিবলিঙ্গ পূজা প্রাচীন। খুবই সম্ভব। কারণ যোনী থেকে উত্থিত লিঙ্গকে আমরা প্রায় সব শিবমন্দিরেই স্থাপিত দেখি। একমাত্র এই লিঙ্গপুজার ক্ষেত্রেই কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নিষ্ঠা আচার বিচার নেই। পুরোহিতের প্রয়োজন পড়েনা। স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে লিঙ্গের মাথায় দুধ ঘি মধু গঙ্গাজল ঢেলে আরাধনা করতে পারেন। প্রাচীন যুগে লিঙ্গকেই স্রষ্টা ভাবা হয়েছে। এ ভাবায় কোনো ভুল নেই। এই যে বিশ্বপ্রপঞ্চ, এর সৃষ্টিও সেই বৃহৎ লিঙ্গ থেকে। যোনী ব্রহ্মশক্তি। লিঙ্গ অর্থে অবশ্য চিহ্নও হয়। এই যে ধারনাটি প্রতীকে চিহ্ন ধারণ করেছে। মহামানব বলছেন—শিবপূজা কেন করে জানো? প্রার্থনা করে মানুষ, হে ঈশ্বর, আমায় যেন আর এই রক্ত নাল মুত্রের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে আসতে না হয়। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস)। আরও গভীরে এর অর্থ এই হয় দেহ থেকে উত্থিত হয়ে যেন আর দেহে পুনরায় না মিশি। জীবন্মুক্ত হই। কাশ্মীরি শৈববাদেরও মূল তাই। জীবন্মুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরতত্ত্বে অবস্থিতি। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বও তাই। জগতের প্রতিটি মানুষের প্রতি করুণা। কেন? কারণ এই জগতের প্রতিটি মানুষই আমি। শিব। অদ্বৈতের পূর্ণ প্রকাশ। তখন কে আর কাকে হিংসা করে? কে আর দেহে আবদ্ধ হয়?

জীবন্মুক্তির এই চিত্র আমাদের পরম প্রার্থনীয়। এ জীবনেই সেই আস্বাদ লাভ করতে হবে। নাহলে মহতী বিনষ্টি। এই যে প্রথমে পরমাত্মা (পরমশিব), তাঁর থেকেই এই দেহ (শিবশক্তিতত্ত্ব)। দেহ ও আত্মার মিলন যখন পরমানন্দের জন্ম দেয়, যখন এই দেহে ঈশ্বরীয় লীলার পূর্ণ প্রকাশ তখন সদাশিব। যখন সেই আনন্দে জগতের প্রতি প্রাণের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ হবে, এক অদ্ভুত ভালোবাসা জন্মাবে তখন সদাখ্যাতত্ত্ব। এবং অবশেষে—

সর্বভূতস্থম আত্মানম সর্বভূতানি য আত্মনি, সম্পশ্যন ব্রহ্ম, পরমং যাতি নান্যেন হেতুনা।

সবার মধ্যে যিনি নিজেকে এবং নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন তিনিই ব্রহ্ম। তিনিই পরমকারণ শিব। তিনি সর্বকালে প্রকাশিত। ন ততো বিজুগপ্সুতে। তাঁকে গোপন করা যায়না। এইই ঈশরতত্ত্ব। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ মানুষে। পশুপতিনাথ মানুষের পাশবিক বৃত্তিকে সংহার করেন রুদ্র রূপে। আর তাকে ঈশ্বরে রূপান্তরিত করেন শিব রূপে।

তাই আর এক মহামানবের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—জীবই শিব। এই নিবন্ধে সেই সত্য শিব সুন্দরের আরাধনা করি। তিনি আমাদের জাগতিক মায়া থেকে মুক্ত করুন। ঐক্য স্থাপন করুন। মানুষে মানুষে আত্মিক ঐক্য স্থাপিত হোক।

[সাহিত্য আর সংবাদ মার্চ ২০২১]

1 comments:

0

প্রবন্ধ - উর্বী মুখোপাধ্যায়

Posted in




















চতুর্দশ শতকে প্লেগের অতিমারীকে অনেক ঐতিহাসিকই এক যুগবিভাজিকা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে এই ভয়াবহ মৃত্যু অভিজ্ঞতা ইউরোপের ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দেয়।তবে ঐতিহাসিক হুইজিঙ্গার মতে এই যুগবিভাজন আকস্মিক ছেদরেখা টানেনি। মধ্য যুগের অপসারণ মুহূর্ত প্রলম্বিত এবং যন্ত্রণাময় । প্লেগের মৃত্যু বিভীষিকা তাকে তীব্রতর করে মাত্র।

১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আনুমানিক প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে কুড়ি কোটি লোকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় এই অতিমারী। গুটি বা বিউবো বেরোত বলে এই প্লেগ বিউবোনিক প্লেগ নামে পরিচিত। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই গুটিগুলি সাধারণত কালো রঙের হত বলে এই প্লেগ কৃষ্ণমারী বা ব্ল্যাক ডেথ নামে খ্যাত। এই প্লেগের জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস মূলত ইঁদুর বাহিত হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধরণের গুটি সম্বলিত প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কথা ইউরোপীয় ক্ষেত্রে এর আগে শেষ শোনা যায় বাইজান্টাইন শাসক জাস্টিনিয়ানের আমলে , প্রায় ছশো বছর আগে। তবে তার ব্যাপ্তি ঠিক কত ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারও মতে এ মড়ক ছিল কৃষ্ণমারীর চেয়েও ভয়াবহ , অন্যদিকে আরেক দলের মতে তা অত্যুক্তি মাত্র। যাই হোক, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে কৃষ্ণমারী যখন শুরু হয়, ইউরোপীয় ক্ষেত্রে জাস্টিনিয়ানের আমলের প্লেগের স্মৃতি অপসৃত প্রায়, এবং এ রোগের কারণ, উপশম অথবা নিরাময় প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারও কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই। সমকালীন চিকিৎসা শাস্ত্রে গ্রীক পণ্ডিত হিপোক্রিটাসের যে লেখা পড়ানো হত তাতে প্লেগের উল্লেখমাত্র নেই। এমত পরিস্থিতিতে এই রোগ ঈশ্বরের অভিসম্পাত বলেই উল্লেখিত হতে থাকে।১৩৫০ খৃষ্টাব্দে মন্টপাইলরের চিকিৎসক সিমন দ্য কোভ্যাঁর হতাশ স্বীকারোক্তি এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। তিনি বলছেন হিপোক্রেটাসের চিকিৎসা শাস্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছে, এ পরিস্থিতির জন্য মূলত গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানই দায়ী, মানুষের পাপ ছাড়া সে বিষম ফাঁড়ায় আর কিছুই তেমন ভূমিকা নেই। প্রায় বিনা প্রতিরোধেই তাই দেখা যায় ইউরোপের এক বিশাল জনসংখ্যা এই ভীষণ মারীতে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মড়কের ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ক্রমশ কেন এই মড়ক, কোথা থেকে এল এই মারী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়।

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ক্রিমিয়ার বন্দরের কাছে কাফা অঞ্চলে ১৩৪৬ নাগাদ এই প্লেগের সংক্রমণ দেখা যায়। এই সময়ে কাফা বন্দরে জেনোয়ার এক বাণিজ্য তরী এলে সেখানেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এই জাহাজ সিসিলিতে নোঙর ফেললে সেখানেও প্লেগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এবং এই ভাবে ক্রুসেড পরবর্তী অধ্যায়ে ইউরোপ জুড়ে লোক চলাচল ও পণ্য চলাচল বৃদ্ধি পেলে সেই যাত্রাপথ ধরেই প্লেগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অধ্যাপক জন নরিসের মতে এই বয়ানে আপাত ভাবে প্লেগের বিস্তার পথ পূর্ব থেকে পশ্চিম বলে মনে হলেও আদতে ইউরোপীয় ক্ষেত্রে প্লেগের সম্প্রসার হয় দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে। প্রাথমিক ভাবে ভূমধ্যসাগরীয় এবং মার্সেই হয়ে আইবেরীয় উপকূল ভাগে প্লেগ ছড়ালেও ক্রমশ রোন নদীর উপত্যকা ও জার্মান গিরিপথ ধরে প্লেগ উত্তর ও মধ্য ইওরোপে প্রবেশ করে এবং দ্রুত উপকূল ভা্গের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে।ঐতিহাসিক বেনেডিক্টাও সাহেবের মতে এই সময়ে নৌপথে লোকচলাচলের গতি স্থলপথের তুলনায় দ্রুত হওয়ায় এই রোগ মূলত জাহাজে অবস্থিত ইঁদুরেরমাধ্যমেই বোধহয় বেশি দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু সেসময়ে প্লেগের বাহক হিসেবে ইঁদুরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকায় বানিজ্যিক ও প্রাচ্য দেশীয় সূত্রকেই বেশি দায়ী করা হয়। ‘কৃষ্ণ’ মারীর সঙ্গে মিশে প্রাচ্যদেশে উদ্ভূত এই মড়ক নিয়ে দ্রুত গুজব চাউর হতে থাকে। সমসাময়িক প্রাচ্যের সঙ্গে সংযোগকারী রেশমপথকে ধরেই ইউরোপে এই মড়কের আবির্ভাব এ নিয়ে জোর গুজব ছড়াতে থাকে। বলা হতে থাকে যে এই প্লেগের উৎস সেই সুদূর চীনদেশে , তারপর ভারত ও মধ্য প্রাচ্য হয়ে এই মড়ক শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে উপনীত হয় ও সেখান থেকেই ইউরোপে প্রবেশ করে। আরেক মত অনুসারে এই মড়ক ভারতের পর সমুদ্র পথে উপসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর মধ্যপ্রাচ্য হয়ে রাশিয়ায় মড়ক সৃষ্টি করে ইউরোপে প্রবেশ করে। অর্থাৎ প্রাচ্য দেশগুলি যেমন চীন ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যই এই রোগের উৎসস্থল । বস্তুতপক্ষে কৃষ্ণমারীর অন্যতম প্রাচীন বিবরনীকার গাব্রিয়েল দে মুসির রচনা থেকে জানা যায় ইউরোপে প্রকোপ শুরু হওয়ার আগেই প্রাচ্যে বিশেষত চীন ও ভারতে প্লেগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সমকালীন ভারতে অবস্থানরত এক ফ্লেমিস যাজককে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন এই সময়ে ভারতে বিষধর সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি আকাশ থেকে বর্ষিত হতে থাকে এবং সে বিষের ফলেই এই মড়ক শুরু হয় যার হাত থেকে কোনো ব্যক্তির রক্ষা ছিলনা।

প্লেগের প্রাদুর্ভাব ইউরোপ থেকে কিছুটা অন্তর্হিত হলে অষ্টাদশ শতকে সেখানে জোরদার বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। এ সময়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপীয়দের সমীক্ষা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল প্লেগের উৎস সন্ধানে অনালোকিত অঞ্চলের অবস্থিতি। তাই প্রায় সব গবেষণায় সমস্বরে দাবী করা হয় এই মারণ রোগের উৎস ও বৃদ্ধি পৃথিবীর অনুন্নত প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে ভারত আর চীনের নাম। ১৭২০ সালে আবে দ্য গিগ্নেস তাঁর অনুসন্ধানে এক আরবীয় রচনাকার আল-মারকিজিকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেন যে এই মড়কের উৎস বস্তুতপক্ষে ক্যাথে বা চীনে যা ক্রমশ যাযাবর তাতার আর তুর্কীদের হাত ঘুরে ভারতসহ ইসলামী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩২ এ জার্মান গবেষক হেকর এই গিগ্নেসকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে লেখেন যে প্লেগ আদতে এক প্রাচ্যদেশীয় মহামারী যা ইউরোপে এক সময়ে এক ভয়ঙ্কর মড়ক ডেকে আনে। বিংশ শতকেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যেমন হেনরি হাওয়ার্থ, ব্রদেল এমন কি জীগ্লার ও হেকরকেই প্রামাণ্য সূত্র মেনে নিয়ে তাঁদের গবেষণা সাজান। আশ্চর্‍্য বিষয় হল, এঁরা কেউই সমকালীন চৈনিক বা ভারতীয় সূত্র অনুসন্ধানের কথা ভাবেন নি। চীনা রাজকীয় জ্ঞানকোষ কু চিন তউ শু চি চেং-এ মহামারীর উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু তা বিউবোনিক প্লেগ জোর দিয়ে বলা যায়না। কারণউল্লিখিত মহামারীগুলিতে উপসর্গ রূপে গুটি বা বিউবোর কথা আমরা ১৬৪৪ এর আগে পাইনা। অন্যদিকে এই সময়ে ভারতে রচিত দুটি সমকালীন রচনাও প্লেগ সম্পর্কে নিশ্চুপ।

১৩৪৭ এর আগে পরে অথবা সমসাময়িক সময়কালে উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসন। এই সময়ে মূল বিবরণীকার জিয়াউদ্দিন বারনি এক অস্থির সময়ের চিত্র অঙ্কণ করেছেন। এই সময়ে পশ্চিম ভারত জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের চিত্র আমরা তাঁর রচনায় পাই।এ সময়ে অনাবৃষ্টি এবং নিরন্তর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বারনি এক করুণ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির চিত্র তাঁর রচনায় উপস্থাপন করেন। এমন কি এই দুর্ভিক্ষের জেরে যে মানুষ নরখাদকে পরিণত হয়েছে সে কথাও বারনি গোপন করেননি। পাশাপাশি সম্রাটের খেয়ালে দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী পরিবর্তন ও সে কারণে পথ মধ্যে শ্রান্তিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কথাও সেখানে সবিস্তারে আছে। এমন কি শাসকের এই অদ্ভূত খেয়ালে দেশ গোরস্থানে পরিণত হয়েছে বলেও বারনি উল্লেখ করেন। কিন্তু সে উল্লেখে কোথাও প্লেগ বা মহামারীর কথা নেই। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই বারনি মহম্মদ বিন তুঘলকের দক্ষিণ ভারত অভিযানের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ওয়ারাঙ্গাল অঞ্চলে ভয়ানক মহামারীর উল্লেখ করেন। সে মারণ ব্যাধি নাকি স্বয়ং সম্রাটকেও আক্রমণ করে। তবে আরোগ্যের জন্য সম্রাট চলে যান কুইলনে। সেখানেই মাস খানেকের বিশ্রামে সেরে ওঠেন মহম্মদ বিন তুঘলক। তবে অনেক সেনা মারা যায় এই মহামারীতে। কিন্তু এখানে বারে বারে মহামারীর প্রসঙ্গ উঠলেও তার উপসর্গ কিছু বলা হয়নি । এই সময়ে ভারতে পর্যটনরত মরক্কোবাসী ইবন বতুতাও এই সময়ে দক্ষিণ ভারতে মহামারীর কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে এ মহামারীর প্রকোপ এতোই প্রবল ছিল যে তিনি একদিন আগে যে সর্বাঙ্গ সুস্থ দাসীটি কিনেছিলেন,এক দিনেই সে মড়কে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। এখানে লক্ষনীয়, বিউবোনিক প্লেগ বা গুটি বসন্তে যে গুটি বেরোয় তা থাকলে কোনো দাসীকেই সর্বাঙ্গ সুস্থ বলে বর্ণনা করা যায়না। সুতরাং বলা যেতে পারে এই ব্যাধি বিউবোনিক প্লেগ বা গুটি বসন্ত নয় … খুব সম্ভবত কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মত কোনো অসুখ যা হঠাতই সুস্থ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।

জিগ্লার প্রভৃতি ঐতিহাসিকদের মতে ভারতীয় ক্ষেত্রে এই সময়ে প্লেগের উপস্থিতি স্বীকার নেহাতই প্রাচ্যীয় সর্বময় শাসকের ভয়ে করা সম্ভব হয়নি। যা বতুতা বিদেশী পর্‍্যটক হিসেবে , জিগ্লারের মতে, নির্দ্বিধায় করেছেন। তাই তাঁরা ভারতের আভ্যন্তরীণ প রিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বারনির চেয়ে বেশি বতুতার বিবরণের উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমরা জানি বারনি কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়েও সত্যভাষনে পিছপা হননি। এমন কি তিনি অনাহার ও অপশাসনে মৃত্যুর কথাও নির্ভয়ে উল্লেখ করেছেন। তবে মহামারী হিসেবে প্লেগের উল্লেখ করতে কেনই বা চুপ থাকবেন? তাইবারনির এই ইচ্ছাকৃত নীরবতারতত্ত্বদেশীয় গবেষক লক্ষ্মীকান্ত আনন্দবলীর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি । অন্যদিকে তিনি ইবন বতুতার রচনাও নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মূল আরবী রচনা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে মহামারীর উল্লেখে বতুতা দুটি ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে ‘ওয়াবা’ শব্দটি ব্যবহার করেন কিন্তু ফিরতি পথে দেখা সিরিয়ায় মহামারীর প্রসঙ্গে তিনি ‘তাউন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সিরিয়ার মহামারীর বর্ণণায় তিনি রোগীর গুটিজনিত যন্ত্রণা এবং তীব্র জ্বরের কথা উল্লেখ করেন , যেখানে দক্ষিণ ভারতের প্রসঙ্গে তিনি জ্বর বা গুটি কোনোটাই উল্লেখ করেননি। অর্থাত এই দুটি শব্দের পৃথক ব্যবহার বতুতা সুচিন্তিত ভাবেই করেছন। তাঁর মতে , এ দুটি শব্দ দুই ধরণেরসংক্রামক ব্যাধি নির্দেশ করতে পারে, যেখানে তাউন অবশ্যই বিউবোনিক প্লেগ, কিন্তু ওয়াবা অন্য কোন মহামারী। আনন্দবলীর মতে আসলে এই দুটি শব্দই ইংরেজি ও অন্যান্য অনুবাদে প্লেগ হিসেবে অনুদিত হয়ে এক সমস্যা তৈরি করে। এই ভ্রান্তিকর অনুবাদের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ ভারতে বিউবোনিক প্লেগের কাল্ক্রম ইউরোপের আগেই ঠেলে দেন।

সত্যি বলতে কি প্রাক-আধুনিক ভারতে বহু মহামারীর উল্লেখ থাকলেও বিউবোনিক প্লেগের মত মারাত্মক মারীর উল্লেখ খুব একটা বেশি নেই। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে এই হিন্দুস্তানের সঙ্গে তাঁর জন্মভূমির পার্থক্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন যে এখানকার মারীও ভিন্ন। মনে হয় এ ক্ষেত্রে তিনি ক্রান্তীয় মারী যেমন কলেরা, ম্যালেরিয়া বা বসন্তের উল্লেখ করেছেন। প্লেগের মত সর্বগ্রাসী মড়কের স্মৃতি বোধহয় ততদিনে মধ্য এশিয়া সংলগ্ন অঞ্চলেও কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। ১৫৭৪-৭৫ সালেমহম্মদ আরিফ কান্দাহারীর রচনা থেকে জানা যায় গুজরাটে এক ভয়ানক মহামারী দেখা দেয়। সেখানে নাকি প্রতি সকালে গাড়িতে করে মৃত মানুষের শব দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হত। তবে এই বিভীষিকাময় বর্ণ্নাতেও রোগের উপসর্গ নিয়ে বিশেষ কোন বিররণ নেই। পক্ষান্তরে জাহাঙ্গীরের শাসনকালে ১৬১৬ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে যে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। শুধু মুঘল সূত্রই নয়, ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে টমাস রোর বিবরনীতেও জানা যায় এই সময়কার প্লেগ বা মহামারী আগ্রাকে প্রায় মৃত্যু পুরী বানিয়ে ছেড়েছিল। শুধু আগ্রাই নয় , উত্তর পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই মারী ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে যার ভয়ে স্বয়ং সম্রাটও আগ্রায় বসবাস করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। শহরে বসবাসকারী অনেক খেটে -খাওয়া মানুষ প্রাণ রক্ষায় নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যায়। আগ্রা সহ বেশ কয়েকটি শ হরে লোক সংখ্যা হঠাত হ্রাস পায়। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে ফতেপুর সিক্রী এই মহামারীর প্রকোপ থেকে বেঁচে যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী তুজুক ই জাহাঙ্গীরীতে এই মহামারীর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ইঁদুরের সংসর্গের কথা উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে ১৬১৯ সালে তাঁর ফতেপুর সিক্রিতে থাকাকালীন আসাফ জার কন্যা , যার সঙ্গে আব্দুল্লা খাঁর বিবাহ হয় এবং যাঁরা ছিলেন আগ্রা নিবাসী , তিনি সম্রাটের কাছে এসে জানান যে তাঁর বাড়িতে হঠাত করেই কিছু ইঁদুর মরছিল। এবং এই মৃত ইঁদুর যারাই স্পর্শ করেছিল তাদের মধ্যে প্রথমে জ্বর ও পরে গায়ে ডালের মত বড় বড় কালো গুটি দেখা যেতে থাকে। এ ভাবেই মাত্র সাত দিনের মধ্যে এই সম্ভ্রান্ত মহিলার বাড়ির প্রায় জনা ১৭ জন এই অভূতপূর্ব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তুজুকে এই ঘটনার বিবরণ ও উপস্থাপন দেখে মনে হয় ভারতীয় ক্ষেত্রে এ ব্যাধি বা উপসর্গ কোনোটাই আগে খুব একটা দেখা যায়নি বলেই এই বিস্তারিত বিবরণ। তাও আবার খোদ সম্রাটের বয়ানে। লক্ষনীয় যার বয়ান বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এখানে ঠাঁই করে নিয়েছে তিনি কিন্তু একজন নারী, কিন্তু তাঁর পর্‍্যবেক্ষণ ক্ষমতা জাহাঙ্গীর বেশ সপ্রশংসভাবে উপস্থাপন করেছেন।

১৬৮২ সালে দাক্ষিণাত্যেও প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মাসির-ই আলমগিরিতে উল্লেখিত হয়েছে যে ১৮৮৮ সালে বিজাপুরে ঔরংজেবের উপস্থিতিকালে যে প্লেগের সংক্রমণ দেখা যায় তা থেকে এমন কি রাজারাজরারাও রেহাই পাননি। বগলে বা উরুসন্ধিতে গূটি বেরনোর দু তিন দিনের মধ্যেই সংক্রামিত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুর সেই করাল ছায়া থেকে যশোবন্ত সিঙ্ঘের পুত্র মহম্মদ সিংহ বা আমীর ফাজিল খাঁ অথবা সম্রাটের প্রিয় বাঁদী ঔরঙ্গাবাদী মহল কারো নিস্তার ছিল না। কাফি খাঁ গলায়, বগলে , কানের পিছনে প্রায় আঙুরের মত বড় যন্ত্রণাদায়ক গুটিকে এই মারণ ব্যাধির উপসর্গ রূপে বর্ণনা করেছেন।

এই গুটিসহ প্লেগের উল্লেখ কিন্তু ভারতীয় ক্ষেত্রে সপ্তদশ শতকের গোড়াতেই প্রথম দেখা যায়। অর্থাত ইউরোপে যখন ব্ল্যাক ডেথের তান্ডব চলছিল প্রাচ্যের নিজস্ব রচনায় তখনো কিন্তু প্লেগের উল্লেখ নেই বললেই চলে। সে কারণেই বোধহয় প্লেগের ইতিহাস প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে যুগবিভাজিকা রূপে স্বীকৃত নয়। কিন্তু অনেক ইতিহাস গবেষণাই প্লেগকে প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে থেকে উদ্ভূত এক ব্যাধি রূপে চিহ্নিত করে ইউরোপীয় ক্ষেত্রে প্লেগের ইতিহাসকে এক বহিরাগত অভিঘাত রূপে বর্ণ্না করেছেন।

আসলে প্লেগের উৎপত্তি ও বিস্তারের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ পরিবেশের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক বেনেডিক্টাও সাহেবের মতে প্লেগের জীবানু বহুদিন ধরে মানবদেহ নয়, ইউরেশিয়ায় বিস্তীর্ণ স্তেপ অঞ্চলের পশু দেহই সংক্রামিত করে আসছিল। কিন্তু ১০ শতাব্দী নাগাদ ব্যাপক কৃষির প্রসার ও যাযাবর জাতির অভিগমনের পরিমাণ হঠাত বৃদ্ধি পেলে এই জীবানু ক্রমশ মানবদেহের সংসর্গে আসে ও এক মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই এই মহমারীর প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধানে কোন জাতি বা ভৌগোলিক ক্ষেত্রকে দায়ী না করে জীবনযাত্রার পরিবর্তন বা পরিবেশের বিবর্তনের মত ব্যাপক কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি অনুঘটকের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলেই কি মহামারী নিয়ে দোষারোপ শেষ হবে? জানিনা। তবে দোষারোপের ইতিহাস বোধহয় যে কোনো অতিমারীর সঙ্গে যুক্ত। সেই অন্ধতার প্লেগের হাত থেকে বোধহয় আমাদের মুক্তি নেই।

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




বই - স্বপ্নসম্ভবা
লেখক - মহুয়া মল্লিক
প্রকাশক - তুহিনা প্রকাশনী
মুল্য - ২৭৫/-

স্বপ্নসম্ভবা দুটি উপন্যাসের সংকলন। পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত ধারাবাহিক ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এবং ‘মুখোশ গ্রামে স্বর্গের ফুল’ উপন্যাস দুটি বই আকারে আনলেন প্রকাশক।

‘স্বপ্নসম্ভবা’ একটি প্রায় ডিসটোপিয়ান নভেল। ডিসটোপিয়ান প্রায়, কেননা উপন্যাসের শেষে লেখক একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছেন। গোড়ার কথা বলি। আমরা যারা বিদেশে কখনও যাইনি, বসবাস করিনি, তাদের কাছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি এক অদ্ভুত জগত। স্বপ্নময়। সেখানে মানুষ সুখের তুঙ্গে অবস্থান করে। তাদের অভাব বলে কিছু তো নেইই, উপরন্তু জীবনটা যেন হাওয়ায় ভেসে থাকার মতো। উইক এন্ড মানেই পার্টি বা ঝটিকা সফর। গাড়ির মাথায় মাল চাপিয়ে লম্বা সফর, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সুখের হাতছানিতে অনেক বাবা মা তাদের মেয়ের জন্য একটি উপযুক্ত বিদেশবাসী (পড়ুন গ্রিনকার্ড হোল্ডার) পাত্র খোঁজেন। মেয়ে চোখের সামনে না থাকলেও চলবে। সে তো সুখের স্বর্গে যাচ্ছেই, উল্টে বাবা মাও একরকম শ্লাঘা অনুভব করতে পারেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে একটা চাপা (কখনও কখনও প্রকাশ্যেই) গর্ব প্রকাশ করেন। ওদিকে যে মেয়েটি উপযুক্ত পাত্রের হাতে পড়ে বিদেশে সংসার পাততে গেল, তার হাতে কিন্তু ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছাড়া যোগ্যতার আর কোনো সার্টিফিকেট থাকছে না। এদেশে সে হয়ত কিঞ্চিত পড়াশুনো করেছে, কিন্তু তার মুল্য ওদেশে বিন্দুমাত্র নেই। ফলে, সে এই আশাতীত সুখের সংসার গড়তে সদা সচেষ্ট। সপ্তাহ-শেষের পার্টিতে সে গুচ্ছের রান্নাবান্না করে ঘর সাজিয়ে ইকেবানা করে স্বামীর বন্ধুবান্ধবের মনোরঞ্জন করে। স্বামী এটি তার প্রাপ্য বলেই মনে করে। সে তো হাউজ ওয়াইফ বিয়ে করেছে! ফলে, পিতৃয়ার্কি, বা পিতৃতন্ত্র, বা ক্ষমতাতন্ত্র, যে নামেই ডাকি, সে তার কাজ শুরু করে দেয়। মেয়েটি বাপ মায়ের অহংকার বাড়াতে, স্বামীর কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে এরপর অত্যাচারিত হয়েও মুখ বন্ধ রাখে। ক্রমশ সেই অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। ফেসবুকে যে সুখী দাম্পত্যের ছবি লটকানো হয়, নিত্য নতুন পদের ছবি, বাগানের ছবি, সেসবের মধ্যে দিয়ে মেয়েটির সম্পর্কের কালশিটেগুলো দেখতে পাওয়া যায় না। ‘স্বপ্নসম্ভবা’ এমনই কয়েকটি মেয়ের গল্প। একে ডিসটোপিয়া বলব না? লেখক অবশ্য শেষে এদের প্রত্যেকের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার, কোথাও বা ফিরে আসার একটি চিত্র এঁকেছেন। সাহিত্যে যেটুকু আশ্বাস দেওয়া যায় আর কি। আমার যেন মনে হয়েছে, তিনি আসলে আমাদের এই আদেখলাপনাকেই বিদ্রুপ করেছেন। মেয়েদের বিয়ের জন্য বিদেশবাসী কৃতী পাত্র খোঁজার চেয়ে যে মেয়েটিকে স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই চেতনা হতে গেলে মোহমুক্তির প্রয়োজন। লেখক যে সত্যটা তুলে ধরেছেন সেটি সমসাময়িক ঘটনাবলীর উল্লেখযোগ্য দলিল। একেবারে শেষে তৃষার নিজেকে নিয়ে উৎসব উদযাপন মুক্তির কথা বলে। এই মুক্তিতে একটি মানুষ স্বয়ং সম্পূর্ণ। তার চেতনায় আর কারোর উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। একেবারেই নেই। এর চেয়ে বড় উত্তরণ আর কী হতে পারে।

‘মুখোশের গ্রামে স্বর্গের ফুল’ আকারে ছোট। এটি অবশ্য একটি মেয়ের আত্মানুসন্ধানের গল্প। এখানেও গার্হস্থ্য অত্যাচার পেরিয়ে উত্তরণ। তবে এই উপন্যাসের বিশেষত্ব হল, পুরুলিয়ার ঐতিহ্য, ছৌ নাচের মুখোশ সম্পর্কে লেখকের বিস্তারিত গবেষণা। কাহিনীর উৎকর্ষ ছাপিয়ে এই গবেষণা সেখানে প্রান্তিক মানুষের জীবন যাপন ও শিল্পানুরাগের চিত্র তুলে ধরেছে। এটি গোচরে আসা দরকার। একই ভাবে কিভাবে সেখানেও শিল্পীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে তার অর্থনৈতিক দুর্গতি বজায় রেখে পুঁজির আস্ফালন চলে, সেটিও স্বল্প পরিসরে জানিয়েছেন লেখক। সমাজসচেতনতা দুটি উপন্যাসেরই মূল লক্ষ্য।

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





আমার ভারতবর্ষ

মুসম্মন বুরুজ (শাহি বুরুজ)


নসিব-এ-হিন্দৌস্তাঁ
পর্তুগিজ যাজক বুজিও এদেশের লোককে খুব ভালো চিনতেন। সেই কবে মানুচ্চিকে বলেছিলেন, ' দারা অত্যন্ত ভালো লোক, উদার, বুদ্ধিমান, সুশাসক। কিন্তু সেটাই এদেশের লোকের কাছে তাঁর প্রধান দোষ। হিন্দুস্তানের লোকেরা নীচ স্বভাবের। তারা দারা শুকোহের মতো মহান, হৃদয়বান শাসককে ভক্তি করেনা। তাদের জন্য দরকার তাদের মতো'ই নীচ, নৃশংস, অত্যাচারী স্বভাবের শাসক।

বের্নিয়ার আর ত্যাভারনিয়েরও খুব অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, দিল্লি-আগ্রার সব প্রভাবশালী আমির-ওমরাহরা সারা জীবন বাদশা শাহজাহানের থেকে কী ধরনের সাহায্য, অনুকম্পা লাভ করেছিলেন। বাদশা শাহজাহানের দৌলতেই তাঁরা লাভ করেছিলেন ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু অসুস্থ, অসহায় বাদশাকে পুত্র অওরঙ্গজেব যখন আগ্রা দুর্গে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে গৃহবন্দি করলেন, তাঁরা কেউ টুঁ শব্দ করলেন না। পিতৃপ্রতিম বাদশাহকে তাঁরা নীরবে, সভয়ে, সশংক ত্যাগ করলেন।

হিন্দুস্তানের সর্বকালের সবচেয়ে বিলাসী, সম্পদশালী, জাঁকালো রাজা নির্বাসিত হলেন আগ্রা দুর্গের এককোণে। তখন তাঁর রাজত্ব বলতে শুধু মুসম্মন (শাহি) বুরুজ আর শাহজহানি মহল। শুশ্রূষা বলতে কন্যা জহানারা বেগম। তবে অওরঙ্গজেব বাদশাহের জনানা মহলকেও সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই জীবিত বেগম আকবরি মহল আর ফতেহপুরি মহল। শাহজহানের প্রথম সন্তান শাহজাদী পরহুনর বেগমও ছিলেন সেখানে। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিলোনা। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেখাশোনা করতেন বাদশাহ এবং সঙ্গিসাথিদের। তিনি চলে যেতে দায়িত্বে আসেন একজন নীচ স্বভাবের খোজা সর্দার, মুতমদ। মানুচ্চির ভাষায়, 'বেবুনে'র মতো চেহারা তাঁর। প্রতিপদে বাদশাকে অপদস্থ করাই ছিলো তাঁর প্রিয় কাজ।

বাদশাহ শাহজহান তখন খুবই ধর্মমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কোরান পড়তেন, জপ করতেন, পণ্ডিতদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বাকি সময় শাহজহানি মহলের ঝরোখা থেকে তাজের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করা মানা ছিলো। একে ওকে চিঠি লিখতেন বলে অওরঙ্গজেবের আদেশে বাদশার মহলে কালি-কলম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিঠি বলতে শুধু অওরঙ্গজেব আর তাঁর মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করে লেখা পত্ররাজি। যার মধ্যে শুধু অওরঙ্গজেবের চিঠিগুলি উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি সমানে দোষারোপ করতেন দারা আর তাঁর ওয়ালিদসাহেবকে। একমাত্র বক্তব্য, যদি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এতোদিনে হিন্দুস্তান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হয়ে যেতো।

বাদশা শাহজহান পূর্বপুরুষ, যেমন আকবর আর জহাঙ্গিরের সূর্যদর্শনের জন্য নির্মিত লালপাথরের বুরুজটিকে নতুন ভাবে বানিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলের যমুনা নদীর শোভা দেখার জন্য। আগ্রা দুর্গের এটিই সব চেয়ে উঁচু নির্মাণ। সতেরো শতকে তিনের দশকে তৈরি আটকোনা মর্মর পাথরের এই প্রাসাদটির সৌন্দর্য এক কথায় অনুপম। এই প্রাসাদটির মর্মর পাথরের জাফরি, কুলুঙ্গি আর দেওয়ালের ইনলে কারুকাজ পিয়েত্রা দুরা শৈলীর। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে গোল বুরুজ আর চমৎকার ফোয়ারা। বন্দি বাদশা শাহজাহান এখানেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ আট বছর। এই প্রাসাদের ঝরোখা থেকেই তিনি তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাঁর অন্তিম শয্যাও পাতা হয়েছিলো ঠিক এর মাঝখানে। গ্রেট মুঘলদের উপযুক্ত একটি কীর্তি, মুসম্মন বুরুজ।

তখন বয়স চুয়াত্তর। পয়লা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৬। সোমবার। বাদশাহ বুঝতে পারলেন দিন শেষ হয়ে এলো। কিন্তু তিনি সজ্ঞানে, সচেতন আছেন। জহানারার অনুরোধে লিখলেন পুত্র অওরঙ্গজেবের অপরাধ মার্জনা পত্র। লিখলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটিও। কীভাবে অন্ত্যেষ্টির কাজ করতে হবে, তার নির্দেশ। জহানারা কাঁদছিলেন। তাঁকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বাকিদের বললেন জহানারার যত্ন করতে। রাতের থেকেই তাঁর জন্য কোরান পাঠ শুরু হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনিও শেষ প্রার্থনা সমাপন করলেন। ভোর তিনটে নাগাদ বাদশাহ শাহজাহানের ইন্তেকাল হলো।


জহানারা অনুরোধ করলেও অওরঙ্গজেব 'শাহি দাফন' মঞ্জুর করলেন না। আগ্রা থেকেই সইয়দ মহম্মদ কনৌজি আর কাজি কুরবান এসে তাঁর মরদেহের পরিচর্যা করে একটি চন্দন কাঠের কফিনে স্থাপন করলেন। অওরঙ্গজেব এলেন না। পুত্র মোয়াজ্জামকে পাঠালেন। যমুনা নদীতে বজরা করে নিয়ে যাওয়া হলো তাজমহলে। মমতাজমহলের পাশের কবরে বাদশা শাহজহান সমাহিত হলেন দুপুর নাগাদ।


এসবই মনে পড়ছিলো যখন মুসম্মন বুরুজের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে বাদশাহের সাড়ে তিনশো বছর পর তাজকে দেখছিলুম আমরা। শাহজহানকে মনে পড়ছিলো। তাঁর শান-শওকত, অজেয় প্রতাপ, অপার ধনসম্পদ। এভাবেই শেষ হয়। মনে পড়ছিলো পাদরি বুজিওর ভবিষ্যদবাণী। এদেশের লোক ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণেই বেছে নেয় অওরঙ্গজেবের মতো শাসক। দারাশুকোহ তাদের জন্য অপাংক্তেয়। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের নসিবও এক নরক থেকে অন্য নরকের কুম্ভীপাকে আবৃত্ত হতে থাকে। পরিত্রাণ পেতে অনেক রক্তক্ষয়, শহাদৎ….


আমরা হয়তো ভুলিনা। আবার মনেও রাখিনা। এই আমাদের ভারতবর্ষ...

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





পর্ব ২৩

ইতালির সবুজ হৃদয় – উমব্রিয়া

আজ এক মানুষখেকোর গল্প বলি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। মধ্য ইতালির গুব্বিও শহরে শুরু হল এক নেকড়ের উৎপাত। শুরুর দিকে সে গৃহপালিত পশু শিকার করলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো মানুষের ওপর হামলা করা অনেক সহজ কাজ। অতঃপর খুব শিগগির সে হয়ে উঠল এলাকার বাসিন্দাদের ত্রাসের কারণ। জনালয়ের বাইরে ওঁত পেতে থাকতো আর অসতর্ক কেউ কাছাকাছি এলেই আর রক্ষা ছিল না। অত্যন্ত চতুর এই প্রাণীটির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধই কাজ করছিল না। গুব্বিও শহরে সেইসময় বাস করছেন সন্ত ফ্রান্সিস। ততদিনে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। ফ্রান্সিস একদিন দলবল নিয়ে রওনা হলেন হিংস্র শ্বাপদটির ডেরার দিকে। দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেয়ে নেকড়েটি ধেয়ে এলো সেদিকে। তার চোখ থেকে তখন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালা। এমতাবস্থায় ফ্রান্সিস অন্যদের দাঁড়াতে বলে নিজে এগিয়ে গেলেন আর যখন তিনি নেকড়েটির মুখোমুখি, তাঁর আলখাল্লার মধ্যে থেকে বের করে আনলেন প্রভু যিশুর ক্রস, তাকে সম্বোধন করলেন ভাই বলে। নেকড়েটি কেমন যেন বিবশ হয়ে গেলো। তার মুখ থেকে লালা পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। সে প্রথমে সন্তের পায়ের কাছে বসলো আর তারপর অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়লো সেখানেই। এই ঘটনার সঙ্গে কোনও হেঁশেলের সরাসরি সম্পর্ক নেই, যা আছে তা হল সন্ত ফ্রান্সিসের সঙ্গে গুব্বিও, আসিসি – উমব্রিয়া প্রদেশের এবং এইসব জনপদে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানান কাহিনির, এক বড়লোক বাপের আয়েশি ছেলে থেকে সন্ত হয়ে ওঠার ইতিহাস আর সেই সন্তের কারণে তো বটেই, আরও একটি বিশেষ কারণে প্রাচীন যুগ থেকেই উমব্রিয়ার খ্যাতি। তা হল ‘পরকেত্তা’ (Porchetta) উৎসবের ঐতিহ্য। একটি আস্ত শুয়োরের পেটের মধ্যে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ভরে সেলাই করে সেটিকে কাঠকয়লার আঁচে ধীরে ধীরে পুড়িয়ে নেওয়ার রীতি এখানে যুগ-যুগান্তের। একসময় যা শুরু হয়েছিল গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপনের প্রয়োজন থেকে, ক্রমশ তা পরিণত হল এক কারনিভালে। অবশ্য শুধুমাত্র ইতালিতেই নয়, স্পেন, পর্তুগাল এমনকি দীর্ঘ স্পেনীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্স-এও ছড়িয়ে পড়ে এই প্রথা, যেখানে তার জনপ্রিয়তা হয় ‘লাচেন’ (Lechon) নামে। সে আলোচনায় পরে আসা যাবে।

বিশ্বের হেঁশেল মানচিত্রে ইতালির যে প্রদেশটির নামডাক জগৎজোড়া, সেটি হল টাস্কানি। আশ্চর্য খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এই দেশটির প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে অভ্রান্ত নিজস্বতা এবং যে বিশেষ চারিত্রিকতা এই লেখকের সীমিত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে, তা হল আপন আপন বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের যে আকুলতা। সেই কারণেই হয়ত ইতালি (এবং অবশ্যই ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল) তেমন একটি ভূখণ্ড, যার হেঁশেল-সংস্কৃতির ওপরে বিশ্বায়নের যথেষ্ট আগ্রাসন থাকলেও তা আজকের দিনেও অনেকটাই নিরাপদ। এটি খুব বড় ব্যাপার। সবাই এটা পারেনি। ইতালিয়ানরা পেরেছে। মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইতালির প্রতিটি আলাদা আলাদা মুক্তোসম প্রদেশ নিয়ে যদি একটি মালা গেঁথে ফেলা যায়, টাস্কানি বা পারমার দীপ্তি হবে হীরকসম। কিন্তু উমব্রিয়া? তার পরিচিতি একটু স্বতন্ত্র। সে নিভৃতচারী কোহিনুর। সন্ত ফ্রান্সিসের কথা তো আমরা জানি। আসিসির সঙ্গে তাঁর নাম এক নিস্বাসে উচ্চারিত হয় কিন্তু উমব্রিয়া মানে তো আর শুধু আসিসি নয়। আসিসি, পারুজিয়া, গুব্বিও এবং আরও অনেক ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়, ঘন অরণ্য, সেখানে আপন খেয়ালে বিচরণ করে বেড়ায় নানান গৃহপালিত প্রাণী। এলাকার মানুষজন সারমেয় নিয়ে খুঁজতে বেরোয় ট্রাফল্‌ আর দিনের শেষে ফিরে এসে আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে ওয়াইনের গ্লাস হাতে। বাতাসে তখন পোড়া মাংসের ঘ্রাণ। ফেলে আসা সেই সময়ের দিকে একটু তাকানো যাক।

সাবেক রোমে একটা ঘটনা ঘটতো। চাষবাস আর উর্বরতার দেবী ছিলেন চেরেস। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য নিবেদন করা হত দুগ্ধপোষ্য শুয়োরছানা। ‘চেরেলিয়া’ নামে বিখ্যাত এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও অনেক প্রথা। কালক্রমে এই বিষয়টির চরিত্র গেলো সামান্য বদলে, তা ছড়িয়ে পড়লো ইতালির অন্যত্র এবং টাস্কানি, লাজিও কিংবা উমব্রিয়ার মতো অঞ্চলে সবিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করল ‘পরকেত্তা’ নামে। আসলে উমব্রিয়াতে ছিল শরীরতত্ত্বের ওপর একটা আস্ত লাইব্রেরি আর এখানকার শল্যচিকিৎসকদের দক্ষতা ছিল অনন্য সাধারণ পর্যায়ের – যার প্রভাব পড়লো এই ‘পরকেত্তা’ উৎসবেও। কী অদ্ভুত! এটাই নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। এ তো শুধু দুই সংস্কৃতির এক হয়ে যাওয়া নয়, দু-ধরনের দক্ষতা এবং প্রথারও মিলন। উমব্রিয়ায় শরীরতত্ত্বের চর্চা থাকার কারণে পরকেত্তার জন্য শুয়োরশাবকটিকে প্রস্তুত করার জন্য যেটা প্রথম পদক্ষেপ, তা হল নিখুঁতভাবে শরীর থেকে হাড়গোড় সব বের করে নেওয়া, সেই শিল্পটি উমব্রিয়াবাসী দুর্দান্তভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। আরেকটা বিষয় ছিল। সেটা হচ্ছে ম্যারিনেশনের সময় একটি বিশেষ উপাদানের ব্যবহার – মৌরি। নুন, মরিচ, রসুন আর রোজমেরির সঙ্গে উমব্রিয়ার যত্রতত্র ফুটে থাকা মৌরি – স্বাদ, গন্ধের কারণে যার চারিত্রিকতা একেবারে অন্যরকম। এই মৌরি নিয়ে কথা বলতে গেলে আবার মহাভারত হয়ে যাবে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেই এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। সম্ভবত গ্রিসে। গ্রিক এবং রোমানরা রান্না ছাড়াও মৌরি ব্যবহার করত চিকিৎসার প্রয়োজনে। এও শোনা যায় যোদ্ধারা সমরাঙ্গনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বলবর্ধক পানীয় হিসাবে পান করতেন মৌরি চা! তা উমব্রিয়ার সেই মাটি আর জলহাওয়ার গুণে ওখানে যে বুনো মৌরিগাছের ঝাড় বেড়ে ওঠে, অবিশ্বাস্য মনমাতানো তাদের সৌরভ। আর সেই মৌরিতে মাখামখি হয়ে চামড়াসমেত হাড়গোড়হীন শুয়োরশাবকটি যখন ঢিমে কাঠকয়লার আঁচে তিন-চার ঘণ্টা ধরে পুড়ে যায়, তার বাইরের আস্তরণটি হয়ে ওঠে মুচমুচে আর ভিতরটি থেকে যায় তুলতুলে নরম, রসালো। ভাবতে অবাক লাগে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকতার কারণে সুদূর ফিলিপিন্সে ‘লাচেন’ নাম ধারণ করে এই পদটি হয়ে উঠল জনপ্রিয়তম স্ট্রিট ফুডগুলির একটি। এই কারণেই সদা বহমান এবং পরিবর্তনশীল এই রন্ধন সংস্কৃতি এত রহস্যময় এবং আকর্ষণীয়। ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেবীকে একটি প্রাণী উৎসর্গ করে যে প্রথা শুরু হয়েছিল দু’হাজার বছরেরও আগে, আধুনিক সময়ে তা হয়ে দাঁড়ালো একটি চিত্তাকর্ষক উৎসবে। তখন ‘পরকেত্তা’ হয়ে উঠল ‘পরকেতিয়ামো’ – যা এই অঞ্চলগুলিকে বিশ্বের হেঁশেল অভিধানে আভিজাত্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু উমব্রিয়া মানে শুধুই ‘পরকেতিয়ামো’ নয়। আরও আরও কিছু। ট্রাফল্‌, ওয়াইন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমনিতে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি – এই সময়টা হল ট্রাফল্‌-এর সময়। কিন্তু উমব্রিয়াতে ট্রাফল্‌ খুঁজতে যাওয়ার কোনও সময় নেই। প্রতিদিন, সারা বছর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে থাকা সবুজের মধ্যে চলে ট্রাফল্‌ খোঁজার খেলা। এমন পরিবারও আসিসি বা গুব্বিওতে আছে, যারা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে এই খেলার ব্যাটন, বিগত পাঁচশো বছর কি আরও বেশি সময় ধরে। কী এই ট্রাফল্‌, যা নিয়ে এত উন্মাদনা? কেনই বা এর দাম এত আকাশছোঁয়া? প্রাচীন এই পরিবারগুলি কেন ট্রাফল্‌ রান্নার প্রণালীগুলি এত গোপনীয়তায় মুড়ে রেখেছে? প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে যেতে হবে অনেক গভীরে।

পপলার, উইলো বা ওক জাতীয় গাছের মূলে একধরনের ছত্রাক জন্মায়, যা একাধিক রঙ বা গোত্রের হতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল এই ছত্রাকটির রহস্যময় আচরণ। একইসঙ্গে অপ্রতুলতা। বাছাইকরা একদল সারমেয়কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মাটির তলায় ঠিক কোন গাছটির মূলে ট্রাফল্‌ রয়েছে গন্ধ থেকে তা বের করার জন্য। কোনও কোনও সময় সারাদিনের খোঁজাখুঁজির ফল হতে পারে শূন্য অথবা হয়ত প্রাপ্তি যা হল প্রত্যাশার তুলনায় তা অনেক কম। দুর্লভ প্রজাতির একটি ট্রাফল্‌-এর দাম ভারতীয় মুদ্রায় তিন লক্ষ টাকারও বেশি হতে পারে। কালো এবং সাদা, সাধারণত এই দু’রকম বর্ণেই দৃশ্যমান হয় এই বস্তুটি। ট্রাফল্‌ দিয়ে হতে পারে অসংখ্য অপূর্ব, স্বাদু রান্না, অলিভের মতো তৈরি করা যায় তেলও বা রুটির ওপর মাখনের মতো লাগিয়েও খাওয়া যায় ট্রাফল্‌ পেস্ট। এই পর্যন্ত লিখে মনে হচ্ছে ক্যাভিয়ারের সঙ্গে ট্রাফল্‌-এর একটা সঙ্গত তুলনা হতে পারে অনেক কারণেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় অমিলটা হল এর অনুসন্ধানের পিছনে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক অবদান এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বিনোদনের দিকটি। আরও একটি উল্লেখ্য বিষয়। প্রকৃতি প্রকৃত অর্থেই এই মানুষগুলির কাছে মাতৃসমা। অন্যতর তাৎপর্যে গাছের মূলে জন্মানো একটি ছত্রাক অনুসন্ধান তাদের কাছে শেষ অবধি হয়ে দাঁড়ায় আপন শিকড়ের অনুসন্ধান।

প্রথমবার বার্লিন শহরের এক সুপার মার্কেটে বারবারাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে জানতে পারি প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টির সুলুক-সন্ধান আর কদিন আগে ঘুম থেকে উঠে এই কিস্তিটি আরম্ভ করেও বুঝতে পারিনি শেষ অবধি লেখাটি ট্রাফল্‌-শিকারি কুকুরের মতোই এই বিন্দুতে পৌঁছে যাবে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২০

লাল ট্রাকটা শহরের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে চলছিল। ট্রাকের চতুর্দিক চেপে বন্ধ করা, গদি আঁটা দরজাটা খিল আটকানো। দরজার দু পিঠেই লেখা আছে, ‘গোরোস ব্রাদার্স, বুদাপেস্ট, সব রকমের মালপত্র বহন করা হয়’। ট্রাকটা থামে। ট্রাকের ছাদের ফুটো দিয়ে একজন মুণ্ডু বের করে চারদিক দেখতে থাকে। লোকটা মাঝে মাঝে নিচু হচ্ছে, আবার চেঁচিয়ে কী সব বলে যাচ্ছে। লোকটা দেখছে আলো দিয়ে সাজানো ক্যাফে, আইসক্রিম পার্লার, রাস্তায় গ্রীষ্মের হাল্কা পোশাকে সুসজ্জিত মানুষজন। কিন্তু হঠাৎ আরেকটা সবুজ রঙের ভ্যানের দিকে লোকটার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সবুজ ভ্যানটা এই লাল ট্রাকটাকে অপরিসর পথে ওভারটেক করে যাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন চালাচ্ছে ভ্যানটা। চালকের পাশে আরেকজন বসে আছে খাকি ইউনিফর্ম পরা, তার কোলে একটা সাবমেশিনগান। সবুজ ভ্যানের ছাদের খোলা অংশটায় চারদিকে বাঁকানো তারজালি পেরেক দিয়ে আটকানো। সবুজ ভ্যানটা খুব জোরে হর্ন বাজাচ্ছে, এঁকেবেঁকে চলছে রাস্তা দিয়ে। একটু পরে একটা মোড় এলো। তারপর ওই ভ্যানটা লাল ট্রাকটাকে অতিক্রম করে উত্তর দিকে চলে গেল। লাল ট্রাকটা দক্ষিণের রাস্তা ধরেছে। ছাদে মুণ্ডু বের করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। লোকটার রোগাপাতলা, বেঁটেখাটো চেহারা, মুখটা বুড়োটে গোছের। লোকটা মাথা নিচু করে ট্রাকের ভিতরের দিকে মুখ করে বলে ওঠে.. ‘এটা পরিষ্কার যে আমরা শহর ছাড়িয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছি, আশেপাশে বেশি বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে না আর!’ লোকটার কথার উত্তরে কেউ জড়ানো চাপা গলায় কিছু একটা বলে উঠল। লাল ট্রাকটা আরও জোরে চলতে শুরু করল। এতটাই জোরে যে সেই গতির জন্য কাউকে বাহবা দেওয়া চলে না। পথঘাট ফাঁকা এবং অন্ধকার। পথের ধারে গাছে গাছে ঝুলে থাকা জোলো বাতাস মিঠে অথচ বেশ ভারি। ছাদ থেকে মুখ বের করে লোকটা আবার চেঁচিয়ে উঠল… ‘একেবারেই কোনো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের রাস্তা। দক্ষিণ দিকে চলেছি আমরা।’ ট্রাকের ভিতরের কথার গুঞ্জন আরও জোরদার হয়ে উঠল। ট্রাকটা গতি বাড়াল আবার।



ছাদে মুণ্ডু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এর আগে ট্রেনে অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে সে। তাছাড়া এখন যে দুটি মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দু’জনের উচ্চতা দু রকম। ফলে লোকটির বেশ শারীরিক কষ্ট হচ্ছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কারণ, ট্রাকের মধ্যে একমাত্র তার চেহারাই ছোটখাট, রোগাটে গড়নের। কাজেই তাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে বাইরের দৃশ্যাবলীর দিকে নজর রাখবার জন্য। সে অনেকক্ষণ ধরে নতুন কিছু দেখেনি। অন্ধকার প্রান্তর আর পথের ধারে গাছগুলো দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছে তার। তারপর সে দেখতে পেল রাস্তায় মোটরবাইকের পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন সৈনিক একটা ম্যাপের উপরে টর্চ দিয়ে কী যেন দেখছে। লাল ট্রাকটা তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা মুখ তুলে দেখল।



তারপর বেশ কিছুক্ষণ লোকটা কিছুই দেখেনি। তারপর এক কলাম সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের বাহিনীর দেখা পেল সে। একটা ট্যাঙ্কে মনে হয় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে। ওটার নিচে শুয়ে চিত হয়ে একজন কী যেন করছে। আরেকজন পাশে কার্বাইডের লণ্ঠন ধরেছে। একটা খামারবাড়ি দেখা গেল। অন্ধকার খামারবাড়ি পেরিয়ে যেতে যেতেই বামদিকে আবার এক কলাম ট্রাক বাহিনী দেখা গেল। খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে এই বাহিনী। ট্রাকে সৈন্যরা বসে আছে। বাহিনীটা তাদের অতিক্রম করে বেরিয়ে গেল। ওই বাহিনীর পেছন পেছন একটা ছোট ধূসর রঙের গাড়ি আসছিল। সেই গাড়িতে কম্যান্ডারের পতাকা আটকানো। ওই গাড়িটা ট্রাকগুলোকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল।





একটা খামারবাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় কিছু সৈনিক বসে আছে। মনে হচ্ছে ওরা খুব ক্লান্ত। কেউ শুয়ে পড়েছে মাটিতে। কেউ ধূমপান করছে। তারপর একটা গ্রাম এলো। গ্রামটা পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরে ট্রাকের ছাদ দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেল। রাস্তার ডানদিকে বিশাল সাঁজোয়া গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।বিশাল খাড়াই কামানের নলগুলো গাঢ় নীল অন্ধকার আকাশের দিকে মুখ করে রাখা। রক্তলাল আভায় কেঁপে উঠল কামানের নলের নিচের অংশ। পাশে খামারবাড়ির গায়েও দেখা গেল রক্তাভা।লোকটা চমকে উঠল। লোকটা এর আগে গোলাগুলির শব্দ শোনেইনি কোনোদিন। লোকটা ভয় পেয়ে গেল। ভয়ের চোটে পেট গোলাতে শুরু করল তার। তার নাম সার্জেন্ট ফিঙ্ক। সে দানিউব নদীর ধারে লিঞ্জ শহরের একটা বড় মিলিটারি হাসপাতালের ম্যানেজার ছিল। তার বস যখন তাকে হাঙ্গেরি থেকে আসল টোকাইয়া আনতে পাঠিয়েছিল, তখন তার ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের বলে মনে হয়নি। টোকাইয়া কী এমন একটা ব্যাপার! কী এমন সাদা ওয়াইন, যা বিশেষ জাতের আঙুর থেকে হাঙ্গেরিতেই বানানো হয়! হুঃ… এত জায়গা থাকতে দুনিয়ায়… শেষমেশ হাঙ্গেরিতেই যেতে হবে! তবে হ্যাঁ, সে নিজে, ফিঙ্ক… একমাত্র ফিঙ্ক কদর জানে টোকাইয়ার। গোটা হাসপাতালের মধ্যে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই যে আসল আর নকল টোকাইয়ার মধ্যে তফাৎ করতে পারবে। তার বস, প্রধান মেডিক্যাল অফিসার, গিঞ্জিয়ার আসল টোকাইয়া খেতে খুবই ভালবাসে। অবশ্য গিঞ্জিয়ারের এক গেলাসের ইয়ার কর্নেল ব্রেজেন হয়তো আরও বেশি ভালবাসে টোকাইয়া খেতে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবাই আধবুড়ো ব্রেজেনকে ডাকাডাকি করে, খাতিরযত্ন করে তার রোগাটে, গম্ভীর মুখের জন্য আর গলায় ঝোলানো এক টুকরো বিরল মেডেলের জন্য। ফিঙ্কের বাড়িতে একটা বার আছে। নানা রকম পানীয়ের সংগ্রহ আছে। এখন এই যে বস তাকে পঞ্চাশ বোতল টোকাইয়া আনতে পাঠাল, এর পেছনে ওই কর্নেলের নির্ঘাত কোনো কারসাজি আছে। নির্ঘাত এরা নিজেদের মধ্যে কোনো একটা বাজি ধরেছে, কিম্বা ওই কর্নেল হয়ত বসের কাছে তার নামে কিছু একটা চুকলি খেয়েছে। বস তার উপরে ক্ষেপে আছে। এখন ঠ্যালা সামলাও!

হাঙ্গেরির টোকাই অবধি গিয়ে পঞ্চাশ বোতল আসল টোকাইয়া কিনেছে সে। সেখানকার এক সরাইখানার মালিক যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাকে। সরাইখানা ছাড়াও বেশ কিছু আঙ্গুরখেত আছে লোকটার এবং সে নিজেও জানে আসল টোকাইয়ার মর্ম। টোকাইতে গেলে মানেই তুমি আসল টোকাইয়া পাবে, এত সহজ নয় ব্যাপারটা। সেখানেও প্রচুর জাল জিনিস বিক্রি হয়।যাই হোক, সে আসল জিনিস কিনেছে। একটা স্যুটকেস এবং এক ট্রাঙ্ক ভর্তি টোকাইয়া নিয়ে আসছিল সে। স্যুটকেসটা তার সঙ্গে আছে। এই লাল ট্রাকের পেটের মধ্যে আছে সেটা। কিন্তু ট্রাঙ্কটা আনতে পারেনি সে।



জেন্টগিয়র্গি স্টেশনে নেমে আর সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নেবার সুযোগ হল কোথায়? ট্রেন থেকে নামা মাত্রই সব যাত্রীদের ভেড়ার দঙ্গলের মত ঘিরে ধরে এই ট্রাকে তুলে দেওয়া হল। আপত্তি জানিয়ে কোনো লাভ হল না। গোটা স্টেশন ঘিরে রাখা হয়েছিল। কেউ কেউ একটু চেঁচামেচি করে প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রহরী সৈনিকরা বোবা কালার মত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুই তাদের কানে গেলনা।



ফিঙ্ক আপাতত টোকাইয়া নিয়ে বেশ ভয় পাচ্ছে… তার বস খুব খুঁতখুঁতে ওয়াইনের ব্যাপারে। তাছাড়া নিজের সম্মানের বিষয়ে বিশেষ স্পর্শকাতর। মনে হয়, তার বস কর্নেলকে কথা দিয়েছে যে আগামি রবিবার বসে একসঙ্গে টোকাইয়া খাবে। বোধ হয়, সময়টাও স্থির করে রেখেছে। এদিকে আজই তো বৃহস্পতিবার, নাকি শুক্রবার সকাল? উফফ, তার দিনরাতের হিসেব সবকিছু গুলিয়ে গেছে। আচ্ছা, এখন শুক্রবার মধ্যরাত। তার উপর এই ট্রাক সোজা দক্ষিণদিকে যাচ্ছে প্রবল গতিতে। রবিবারের মধ্যে লিঞ্জে ওয়াইন নিয়ে পৌঁছাবে কী ভাবে সে? ফিঙ্কের বেশ ভয় করছে। বসকে ভয়, তার উপরে ওই কর্নেল বন্ধুকে ভয়… ওই কর্নেলকে তার একটুও পছন্দ নয়। ওই কর্নেল সম্বন্ধে একটা গোপনীয় কথা সে জেনেছে। অবশ্য কাউকে বলেনি ব্যাপারটা। কারণ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, এত বিশ্রী রকমের অবিশ্বাস্য সেই ব্যাপারটা।এতই বিশ্রী এবং বীভৎস সেই কথাটা … নাহ, সে কাউকে বলতেও পারবে না।

মাঝেমধ্যে কর্নেলের ঘরে খাদ্য বা পানীয় নিয়ে যেতে হয়, কিম্বা কোনো বই পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় তাকে… তখনই সে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। সে যে ব্যাপারটা দেখেছে, সেটা হয়ত কর্নেল জানেনা। কর্নেলকে খুব সমাদরে রাখা হয়। একদিন সন্ধ্যায় কর্নেলের ঘরের দরজায় টোকা না দিয়েই ঢুকে পড়ছিল সে আরেকটু হলে। তখনই ব্যাপারটা নজরে আসে তার। আধো অন্ধকারে ওই আধদামড়া বুড়োটার মুখচোখের যে অভিব্যক্তি সে দেখে ফেলেছিল, গা গুলিয়ে উঠেছিল তার। ঘেন্নায় সে নিজেই সেদিন এক কণা খাবার দাঁতে কাটতে পারেনি। অল্পবয়েসী কোনো পুরুষ যদি নিজের ঘরে এইসব করে ধরা পড়ত… তার গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া হত… আর তাতেই উচিত শিক্ষা হত।

(চলবে)





ReplyForward











0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















নতুন মহারাজের আমলে রান্নার স্বাদ বদলে গেছে। রান্নাঘর আর ডাইনিং হলের পিঁড়িগুলো বেশ পরিষ্কার। এখন প্রত্যেক রোববারে ওসব গরম জল আর সোডা দিয়ে ধোয়া হয়। তদারক করেন ব্রহ্মচারী সুবীর আর ব্রহ্মচারী বরেন। বড় মহারাজ ওঁদের কড়া করে বলেছেন-- তোমরা রান্নার ঠাকুর আর চাকরকে খাটাও না? এখন ডাইনিং হলেই রাত্তিরে দুধ দেওয়া হয়।
আমরা কখনও ওতে লেবু চিপে ছানা বানাই বা কলাই করা মগে দইয়ের সাজা দিয়ে পেতে দিই। সকালে উঠে যখন দেখি জমে গেছে তখন কী ভালো লাগে।
ক্লাস ইলেভেনের অসীমদাকে মহারাজ বিশেষ পারমিশন দিলেন -- ও স্টেনলেস স্টিলের থালায় খাবে আর রোজ ওর পাতে একটা করে ডিম দেওয়া হবে। এটা ওর বাবা স্বামীজিকে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন। এর পয়সাটা উনিই প্রতিমাসে জমা করে দেবেন।
আমি বুঝতে পারি--অসীমদা বেশ বড়লোক ঘরের ছেলে। ও পাঁচটাকা দামের চটি পরে , আমরা আট আনার হাওয়াই চটি বা বারো আনার চপ্পল। ওর কাছে বেশ নগদ পয়সা থাকে। যদিও নিয়ম হল কোন আবাসিক ছাত্রের হাতে পয়সা দেওয়া যাবে না। যা দেওয়ার অফিসে জমা রাখতে হবে।
ডাইনিং হলের দেওয়ালে বেশ বড় করে দুটো লাইন বাঁধিয়ে উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা আছে। কানাইদা করে গেছলেন।
গীতার থেকে নেওয়া দুটো শ্লোকঃ
"ওঁ ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতং,
ব্রহ্মৈবতেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।
হরি ওঁ তৎ সৎ।"
[ ব্রহ্মরূপী অগ্নিতে ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মকে অর্পণ করে ব্রহ্মদ্বারা আহুতি দেওয়া হল। এই নৈবেদ্য ব্রহ্মকর্ম সমাপনের উদ্দেশে ব্রহ্মএর কাছেই যাবে।]
কাগজটা হলদেটে, ফ্রেমটা একদিকের দড়ি ছিঁড়ে কেতরে রয়েছে। কেউ ঠিক করছে না। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদাকে বলে কোন লাভ হল না, দুটো হুঁ আর হাঁ শোনা ছাড়া।
কিন্তু আমাকে যে রোজ ডাইনিং হলে গীতা পড়তে হয় --জোরে জোরে পাঠ করি।--যতক্ষণ ভাত ডাল ও একটা তরকারি পরিবেশন সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ। দুবেলা। তারপর পকেট গীতা বন্ধ করে পাশে রেখে ওই দুইলাইন জোরে জোরে টেনে টেনে বলি। অনেকেই গলা মেলায়। তারপর হাপুশ হুপুশ করে খাওয়ার শব্দ। সেকেন্ড কোর্স , বেশির ভাগ দিন মাছের ঝোল দেওয় হয়।
খাওয়া শেষ হলেও কেউ আগে উঠবে না। আমি খেয়াল করে দেখব অধিকাংশের খাওয়া হয়েছে কি না। তারপর উঁচু আওয়াজে শ্লোগান দেওয়ার মতন বলবঃ
" জয়, গুরু মহারাজ কী জয়, --জয়!
জয়, সাধূমহারাজ কী জয়,--জয়!
জয়, গঙ্গা মাঈকী জয়,--জয়!"
কখনও সখনও এই বিশেষ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করি। মাসে একদিন মাংস আর গুঁড়োদুধের পায়েস। সেদিন কী যে হয়! পঞ্চা ঠিক করে রাঁধতে পারে না, তায় দুশো জনের রান্ন। মাংস পুড়ে যায়, পায়েসে দুধ তলায় লেগে যাওয়ায় পোড়া গন্ধ টের পাই। তবু আমরা উলুত পুলুত করে খাই।
সেদিন মাংসটা আগে দেয়। বন্ধুরা চোখের ইশারায় বলে এবার গীতাপাঠ শেষ করে "ব্রহ্মার্পণং" বল্‌ দিকি!
আমি দেখেও দেখি না, পাঠ চালিয়ে যাই। ওরা চোখ বড় করে, পাতে রাখা মাংসের দিকে ইশারা করে করুণ ভাব ফুটিয়ে তোলে। আমি আরও মগ্ন হয়ে সাংখ্যযোগের অধ্যায়ে ডুবে যাই--
গম্ভীর আওয়াজে পড়িঃ
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক;ঃ,
ন চৈনং ক্লেদয়ন্তাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।
ওরা দাঁত কিড়মিড় করে ইশারায় বলে ক্যালাবে, কিন্তু জানে যে কিছুই হবে না। কারণ এই দায়িত্বটি আগে যিনি পালন করতেন সেই অমল নাগ পাশ করে যাওয়ায় কাজটা বন্ধ হয়ে গেছল। তখন ক্লাস সেভেনের প্রদ্যুম্ন গিয়ে কানাইদাকে বলেছিল-- আমি এটা পারব। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে করে শিখেছি।
রামকানাইদা হেসে বলেছিলেন-- পারবি? বেশ, একবার পড়ে শোনা।
শুনে বললেন --ঠিক আছে, তবে তোর তিনটে স , মানে সন্দেশের স, শালগমের শ আর ষাঁড়ের ষ,-- সব একরকন শোনাচ্ছে। আর র ও ড়, এবং ণ। আয় ব্যাটা, দেখে নে। অভ্যাস কর। তারপর সোমবার থেকে লেগে পড়।
নীচুক্লাসের ছেলে ডাইনিং হলে রোজ গীতাপাঠ করছে-- হল্লা হয়ে গেল। কেলটে এবং পুকুরের পচা জলে হাতে পায়ে খোস-পাঁচড়া হওয়া ঘেয়ো বাচ্চা প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদোকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখতে লাগল।
সেভেনের বাচ্চারা গর্বিত।
--অ্যাই পোদো, আমাকেও শিখিয়ে দে না!
--- আচ্ছা, পোদো, প্রথম থেকে না দেখে কতটা বলতে পারবি? একবার করে দেখা! বইটা কিন্তু আমার হাতে থাকবে।
--ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ,
মামকাপান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বতঃ সঞ্জয়?
-- বারে পোদো, বেশ তো! হ্যাঁরে পোদো, তুই কি বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবি? আমাদের কানাইদার মতন?
পোদো অহংকারী ভঙ্গিতে ঘ্যাম লইয়া গম্ভীর হইয়া যায়। বিধাতাপুরুষ সেদিন অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন বোধহয়।
****************************************************
গায়ের ব্যথাট্যাথা সারিয়ে ক্রিকেটে মন দিয়েছি। বছরের প্রথম, এখনও পড়ার চাপ নেই। কিন্তু ক্লাস টেনের ম্যাথস যে রকেটের স্পীডে এগিয়ে চলেছে। ক্লাস নাইনের সময় প্রদ্যুম্নকে হিউম্যানিটিজ অথচ সংস্কৃত, অর্থনীতির সঙ্গে ইলেক্টিভ ম্যাথস্‌ জাতীয় বেয়াড়া কম্বো নেওয়ায় ভুগতে হয়েছিল। ওকে ম্যাথস্‌ ক্লাস করতে হয়েছিল টেকনিক্যাল স্ট্রিমের সঙ্গে। ক্লাস টেনে ওকে বসতে দেওয়া হল সায়েন্সের সঙ্গে। ও আর বিপ্লব পাশাপাশি বসে।
কিন্তু ও যে স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব নিয়েছে আর এর ফলে অংকের ক্লাস হরবখত মিস হচ্ছে। চাঁদার হিসেব, কুমোরটুলি গিয়ে প্রতিমার বায়না, ঢাকি ঠিক করা, ঠাকুর আনতে যাওয়া--কত কাজ। এই ফাঁকে হরদম গেটপাস বানাতে হচ্ছে আর অচলায়তনের পাথরের দেয়ালের বাইরে গিয়ে মাঠ, গরু-ছাগল চরছে , কর্পোরেশনের কলের থেকে জল ভরার লাইনে চুলোচুলি হচ্ছে --এইসব প্রাণভরে দেখতে পাচ্ছে।
মাঝে মাঝে , যেন ভুল করে, অংকের ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু ঢুকে মনে হচ্ছে যেন বানের জলে সাঁতার কাটা!
আগের ক্লাসটায় এপি সিরিজ বোঝানো হচ্ছিল, সে একরকম। কিন্তু তারপর জিপি একটু খটোমটো আর এইচ পিটা কেমন যেন জালিমার্কা।
আজ তো দেখছে দুটো তিনটে সিরিজ জড়িয়ে মড়িয়ে একটা। তোমাকে সেগুলো আলাদা করতে হবে। মরেছে! এরচেয়ে ঘুড়ির মাঞ্জার জট ছাড়ানো অনেক সোজা।
ওকে স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে ডাকলেন। ও অসহায় চোখে একবার বোর্ডের মধ্যে সংখ্যা আর সাইনগুলোর দিকে তাকায় আবার লাস্ট দুটো বেঞ্চ আলো করে বসে থাকা আশ্রমের আবাসিক বন্ধুদের দিকে।
পেছন থেকে কিছু ধরতাই এল বটে, ফিসফিস করে, কিন্তু ধরতে জানতে হয়। ওর মনে বাজছে 'তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গিয়ে আর পেলাম না'।
অংকের স্যার কেন যে ওকে টার্গেট করলেন?
ওরও দোষ আছে, সব ব্যাপারে পট্পট করে উত্তর দেওয়ার রোগ।
ওর বন্ধু রমেন শেষ বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিল। তার বাদামী রঙের কভারে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা "আদর্শ বাংলা ব্যাকরণ"; কিন্তু ভেতরে আসল বইটা হল লাইব্রেরি থেকে আনা "চরিত্রহীন"। একবার মনে হল স্যার ওকে দেখছেন। পোদো সতর্ক করায় ও বলল-- দাঁড়া, এখন কিরণময়ী বৌদি দেওরকে লুচি ভেজে দিতে দিতে লাইন মারছে-- ডিস্টার্ব করবি না। স্যার-ফ্যার তুই সামলে নিস।
ধেত্তেরি!
কিন্তু একটু পরে চোখে পড়ল স্যার পড়াতে পড়াতে চক ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করছেন। সব ক্লাসেই উনি এটা করেন। এর মানে হচ্ছে উনি এবার ওই টুকরো অন্যমনস্ক ছাত্রের কপালে ছুঁড়ে মারবেন। আর গোটা স্কুল জানে, ওঁর টিপ ফস্কায় না। গাঁয়ের আম পাড়া টিপ।।
স্যার তাকিয়ে আছেন রমেনের দিকে, মুখে বলছেন -- র‌্যাশনাল আর ইর‌্যাশনাল নাম্বারের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝ, আর রিয়েল ও ইমাজিনারি। বেশ!
বলতে বলতে উনি রমেনের সামনের দুই সারির ছেলেদের মাথা সরিয়ে নিতে ইশারা করলেন।
প্রদ্যুম্ন কী করবে? কী করে রমেনকে সাবধান করবে? ও তো পোদোর ভরসাতেই ক্লাসে গল্পের বইটা পড়ছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। স্যার যে ওকেও কড়া নজরে রেখেছেন।
এবার উনি রাইফেল শ্যুটারদের মত লক্ষ্যস্থির করছেন। মুখ চলছে- ইয়েস, ইন্টিজার--পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ--। বুলেটের মত চকটা ছুটে এল। কিন্তু পোদোর হাতের লাল বাঁধানো খাতা ওর অজান্তেই চকটাকে স্যারের টেবিলে টেবল টেনিসের মত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন করে দিল।
ভাগ্যিস স্যারের গায়ে লাগে নি, শুধু ওঁর টেবিলে পড়েছে।
এতক্ষণ দম বন্ধ করে তামাশা দেখা গোটা ক্লাস হো-হো হাসিতে ফেটে পড়েছে।
কিন্তু পোদোর মুখ শুকিয়ে গেছে। ও এটা কী করল? স্যারের কিল যে বিখ্যাত। উনি দোষী ছেলেদের ঘাড় ধরে ঝুঁকিয়ে পিঠটা উঁচু করিয়ে তারপর গোয়ালাদের মত গদাম করে মারেন।
--- লালখাতা কার? উঠে এস। উঠে এস, আমার সময় নষ্ট কর না।
গোটা ক্লাসে আবার সন্নাটা। মহা ল্যাবা পক পক করে বাতেলা দেওয়া পোদোর কপালে আজ দুঃখু আছে।
এক পা এক পা করে এগোতে থাকি। স্যারের টেবিল ও আমার মধ্যের দুরত্ব ক্রমশঃ কমে আসছে। মার থেকে বাঁচার কি কোন উপায় নেই? আছে, একটা আছে। ও সহজে চোখে জল আনতে পারে। কী করে পারে কে জানে! কিন্তু পারে।
একটা নাটকের রিহার্সালে অমন রেডিমেড চোখের জল দেখে কানাই মহারাজ খুব তারিফ করেছিলেন। তারপর থেকেই ও আশ্রমের নাটকের দলে রেগুলার।
উঃ, এখন কানাইদা মাথায় থাকুন, ওঁর আশীর্বাদ পেলেই যথেষ্ট। পোদো পা মেপে মেপে ফেলার ফাঁকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুঃখের ঘটনা মনে মনে রি-ওয়াইন্ড করে সিনেমার মত দেখতে থাকে।
অংকের স্যার হতভম্ব। একী, ক্লাস টেনের ছেলের চোখে জল কেন? আরে আমি তো মারি টারি নি, শুধু উঠে আসতে বলেছি।
বন্ধুপ্রীতি ভাল, কিন্তু ভাল কাজের জন্যে। ও যে ক্লাস ফলো করছে না, তুমি ওর পক্ষ নিচ্ছ? এটা কি ভালো?
পোদোর মুখে কথা নেই।
কিন্তু স্যারের নরম গলা শুনে গোটা ক্লাসের সংহতি বোধ জেগে উঠল। ওরা শামলা পরে আর্গুমেন্ট শুরু করল।
-- স্যার! ও খুব ভাল ছেলে স্যার। ওকে ছেড়ে দিন স্যার। ভুল করে করে ফেলেছে স্যার। নাইনে হাফ ইয়ার্লিতে অংকে টপ করেছিল স্যার। সায়েন্সের ছেলেদের থেকেও বেশি পেয়েছিল।
স্যার কড়া চোখে প্রদ্যুম্নকে মেপে নিয়ে বললেন--বেশ, ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু বোর্ডে এই অংকটা কষে দেখাক, কেমন অংকের ছেলে!
পোদোর প্রাণপাখি উড়িয়া গেল, ও মাথা নাড়ল।
কিন্তু গোটা ক্লাস উৎসাহের সঙ্গে--হ্যাঁ স্যার , হ্যাঁ স্যার, ও পারবে স্যার বলে পোদোর গলা হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে দিল।
না, পোদো ওরফে প্রদ্যুম্ন কৃষ্ণপুত্র হলেও সেদিন কোন দেবতার বরাভয় পায় নি।
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লে স্যার উঠে দাঁড়িয়ে ওকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে উঁচু গলায় বললেন--গোটা ক্লাস মিথ্যেবাদী। এ ড্যাম লায়ার! এই ছেলে ভবিষ্যৎ অংকে নয়, চিৎপুরের যাত্রাদলে।


স্যার যাই বলুন আমার তো স্বপ্ন রণজি ট্রফিতে অফস্পিনার হিসেবে খেলার। বেশ ভালই টার্ন করাচ্ছি। ফ্লাইট আর ফ্লিপারটা একটু কন্ট্রোল হলে--, তবে আশ্রমের আঙিনায় টেনিস বলে খেলাটাও ছাড়ি নি। এতে আমার মত ভীতুর ফিল্ডিং শুধরে যেতে পারে। কভার বা গালিতে দাঁড়াতে থাকি।
কিন্তু কোথাকার জল যে কোথায় গড়ায়!
আজ রোববার। ন'টার থেকে ধর্মক্লাস, দশটায় টেনিস বলে কোর্টইয়ার্ড ক্রিকেট।
তবে সেদিনের ঘটনার পর থেকে বড় ও মেজোমহারাজ আমাদের এই সাপ্তাহিক ধর্মক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওটা এখন ছোট মহারাজ সুনীলদার দায়িত্ব। সুনীলদা আজকে একটু বেশি জমে গেছেন। শুরু করেছিলেন বেদের হোমাপাখির গল্প দিয়ে , কিন্তু খেই হারিয়ে রবীন্দ্রনাথের বোলপুর প্রবন্ধের 'গাড়ি ছুটিয়া চলিল। সবুজ তরুশ্রেণী" এই সব বলতে লাগলেন। এরমধ্যে ক্লাস এইটের এক কারবাইড-পাকা ছেলে ফিনিক্স আর হোমাপাখির গল্পের কম্পারেটিভ স্টাডিতে মেতে উঠল, সুনীলদা শুনলেন। ভাবলাম ছুটি দেবেন। কোথায় কি?
সবাই উসখুস করছে, কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু আজ সুনীলদা কোন ওপেনিং দিচ্ছেন না।
আমি নিচুগলায় কিছু বলার চেষ্টা করতেই বিপ্লব জোরে চিমটি কেটে বলল-- মুখ বন্ধ রাখ। তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!
দূর! সময় চলে যাচ্ছে, আজকের খেলার কী হবে? কী যে হবে তা প্রশান্ত হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিল।
এরপর যা ঘটল তাকে স্বতঃস্ফুর্ত বললে কম বলা হয়।
সুনীলদা প্রশ্ন করেছেন--মানুষ কখন চারপেয়ে হয়?
বিপ্লব নীচু গলায়-- যখন চারপাইয়ে শোয়, এটা কোন প্রশ্ন হল?
--- কী? পারলে না তো? যখন বিয়ে করে। বৌয়ের দায়িত্ব নেয়।
-- তাহলে মহারাজ, যখন বিয়ের পর বৌয়ের বাচ্চা হবে তখন কি ছ'পেয়ে হবে? আর দুটো বাচ্চা হলে?
-- তোমার এসব জেনে লাভ?
-- না, কোন লাভ নেই। মিনিমাম কৌতূহল। মানে জানতে চাইছি ঠাকুর এ নিয়ে কিছু বলে গেছেন কি না?

ধর্মক্লাসে বিরতি। না, বিরতি নয়, পূর্ণচ্ছেদ। সুনীলদাও আর নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার উৎসাহ দেখান না। আমাদের ব্যাচটা বেয়াড়া। ইলেভেনের ছেলেরা বোর্ডের চিন্তায় মগন। ধর্মক্লাসে আসতে চায় না।
কিন্তু সেদিন সবাই খুশি। দশ-দশ ওভার খেলা হতেই পারে।
ফটাফট টস করে ফিল্ডাররা দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার ব্যাটিং সাইড, শেষের দিকে নামি। দশ ওভারে চান্স নেই। তাই আম্পায়ারিং করছি। উইকেট কিপার ও আমি হাফপ্যান্টের উপর গামছা জড়িয়ে নেমেছি।

সবাই পজিশন নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু বোলার বল করতে এসে থেমে গেল।
শর্ট লেগ কোথায় গেল? টেনিস বলের ম্যাচে শর্ট লেগ অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, কারণ এখানে ফিল্ড করলে ব্যাকফুটে খেলা ডিফেন্সিভ স্ট্রোকের থেকেও বল তুলে নেওয়া যায়। আর কোন চোট খাওয়ার ভয় নেই। ওখানে তো আমাদের গ্রেট রমেনের দাঁড়াবার কথা। গেল কোথায়? বাথরুমে? কী বিরক্তিকর!
তখন নিখিলেশ বলে উঠল--ওই তো রমেন! ডাক শালাকে!
ডাইনিং হলের বারান্দায় বড় থামের পাশে রমেন প্রায় কোণঠাসা করে কড়া চোখে নিচুগলায় কিছু বলছে সোমেশ দত্তকে। আমাদের ব্যাচে সোমেশকে নিয়ে একটু হাসাহাসি হয়। বড় ঘরের ছেলে।নিষ্পাপ স্বপ্নালু চোখ, আদরে বড় হয়েছে। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিল।
ওর নরম সরম ভাব দেখে আশ্রমের ছেলেরা ওর নাম দেয় মাদী দত্ত। কয়েক বছর পরে ওই নামটা ওর সঙ্গে সেঁটে যায়।
সেবার ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া একটা ফচকে ছেলে ওকে খ্যাপাবার জন্যে তাসাপার্টির বাদ্যের অনুকরণে মুখে বোল তৈরি করেঃ
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
কুড়ুকুড় -- ঝুংকুরুকুর,
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!

বিব্রত সোমেশকে ঘিরে তিনটে বাচ্চা নেচে বেড়ায় আর মুখে ওই বোল তোলে। সেটা সুনীল মহারাজের চোখে পড়ে যায় । উনি এসে সোমেশকে একতরফা হেনস্থার থেকে রক্ষা করেন।
বাকি তিনটেকে ভালকরে থাপড়ে সিধে করেন আর মারতে মারতে বলতে থাকেন-- অসভ্য কথা বলছ, অসভ্য কথা বলছ? মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়! অসভ্য কথা বলছ?
তারপর থেকে সবার সামনে কুড় কুড় বোল তোলা বন্ধ হয়ে গেছল। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কখনও কখনও ওকে মাদী বলে সম্বোধন করে মজা পেত।
এহেন সোমেশ বিব্রত মুখে থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আর রমেন ওর দিকে ঝুঁকে একটা হাত ওই থামে কায়দা করে ঠেকিয়ে কী যে বিড় বিড় করছে বোঝা যাচ্ছে না। যেটুকু বুঝতে পারছি যে ওদের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি চলছে। আমি একবার চেঁচালাম-- আব্বে রমেন! ওসব প্রেমলাপ শেষ কর। ঝুড়ি চাপা দে। শর্ট লেগে আয়, নইলে--।
ও ক্রুদ্ধ বাইসনের মত মাথা তুলে আমাকে দেখে হাত তুলে ইশারা করে--আসছি!
ধেত্তেরি! আর ভাল লাগে না। ঘরে গিয়ে একটা সিগ্রেট খেলে কেমন হয়! কিন্তু আম্পায়ার যে সরতে পারে না।
একটা আর্ত চীৎকার! সবাই একসঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে দৌড়্লাম।
বাইসনের শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে রমেন সমানে ঘুষি মারছে সোমেশ দত্তের মুখে। সোমেশ প্রানপণে ঠেকাতে চেষ্টা করছে, দুহাত তুলে মুখ আড়াল করছে, কিন্তু এর্মধ্যেই ওর ঠোঁট ফেটে কষ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে!
কী কান্ড!
-- কী রে রমেন ? দত্তকে অমন করে মারছিলি কেন?
রমেন রাগী মোষের মত ফোঁস ফোঁস করে, উত্তর দেয় না।
--সোমেশ , তুই বল।
-- আমি কি বলব? ও খালি বলছে-- তুই আমাকে ভালবাসিস কি না বল? আমি ওর কথা বুঝতেই পারছি না। বল্লাম , তোরা সবাই আমার বন্ধু। আমি সবাইকেই ভালবাসি।এতে জিগ্যেস করার কি আছে?
কিন্তু ---কিন্তু ও জিদ করছে যে আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারব না। আমি নাকি শুধু রমেনের!
যেই বলেছি যে এরকম কিছু হয় না, আমি কাউকে আলাদা করে স্পেশাল ভালবাসতে পারব না, অমনি ও আমাকে মারতে লাগল আর বিড়বিড় করছিল -- আমাকে ভালবাসতেই হবে, তুই শুধু আমার! অন্য কাউকে ভালবাসলে মেরে ফেলব। এ কী পাগলামি বলত! এখন আমি কী করি, তোরাই বলে দে।
ও ফোঁপায়। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। রমেন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর আমাদের ক্রিকেট খেলার সেদিন তিল-আলোচাল -কলা দিয়ে মেখে পিন্ডদান হয়।

0 comments: