0

প্রবন্ধ - উর্বী মুখোপাধ্যায়

Posted in




















চতুর্দশ শতকে প্লেগের অতিমারীকে অনেক ঐতিহাসিকই এক যুগবিভাজিকা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে এই ভয়াবহ মৃত্যু অভিজ্ঞতা ইউরোপের ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দেয়।তবে ঐতিহাসিক হুইজিঙ্গার মতে এই যুগবিভাজন আকস্মিক ছেদরেখা টানেনি। মধ্য যুগের অপসারণ মুহূর্ত প্রলম্বিত এবং যন্ত্রণাময় । প্লেগের মৃত্যু বিভীষিকা তাকে তীব্রতর করে মাত্র।

১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আনুমানিক প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে কুড়ি কোটি লোকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় এই অতিমারী। গুটি বা বিউবো বেরোত বলে এই প্লেগ বিউবোনিক প্লেগ নামে পরিচিত। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই গুটিগুলি সাধারণত কালো রঙের হত বলে এই প্লেগ কৃষ্ণমারী বা ব্ল্যাক ডেথ নামে খ্যাত। এই প্লেগের জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস মূলত ইঁদুর বাহিত হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধরণের গুটি সম্বলিত প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কথা ইউরোপীয় ক্ষেত্রে এর আগে শেষ শোনা যায় বাইজান্টাইন শাসক জাস্টিনিয়ানের আমলে , প্রায় ছশো বছর আগে। তবে তার ব্যাপ্তি ঠিক কত ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারও মতে এ মড়ক ছিল কৃষ্ণমারীর চেয়েও ভয়াবহ , অন্যদিকে আরেক দলের মতে তা অত্যুক্তি মাত্র। যাই হোক, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে কৃষ্ণমারী যখন শুরু হয়, ইউরোপীয় ক্ষেত্রে জাস্টিনিয়ানের আমলের প্লেগের স্মৃতি অপসৃত প্রায়, এবং এ রোগের কারণ, উপশম অথবা নিরাময় প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারও কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই। সমকালীন চিকিৎসা শাস্ত্রে গ্রীক পণ্ডিত হিপোক্রিটাসের যে লেখা পড়ানো হত তাতে প্লেগের উল্লেখমাত্র নেই। এমত পরিস্থিতিতে এই রোগ ঈশ্বরের অভিসম্পাত বলেই উল্লেখিত হতে থাকে।১৩৫০ খৃষ্টাব্দে মন্টপাইলরের চিকিৎসক সিমন দ্য কোভ্যাঁর হতাশ স্বীকারোক্তি এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। তিনি বলছেন হিপোক্রেটাসের চিকিৎসা শাস্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছে, এ পরিস্থিতির জন্য মূলত গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানই দায়ী, মানুষের পাপ ছাড়া সে বিষম ফাঁড়ায় আর কিছুই তেমন ভূমিকা নেই। প্রায় বিনা প্রতিরোধেই তাই দেখা যায় ইউরোপের এক বিশাল জনসংখ্যা এই ভীষণ মারীতে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মড়কের ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ক্রমশ কেন এই মড়ক, কোথা থেকে এল এই মারী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়।

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ক্রিমিয়ার বন্দরের কাছে কাফা অঞ্চলে ১৩৪৬ নাগাদ এই প্লেগের সংক্রমণ দেখা যায়। এই সময়ে কাফা বন্দরে জেনোয়ার এক বাণিজ্য তরী এলে সেখানেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এই জাহাজ সিসিলিতে নোঙর ফেললে সেখানেও প্লেগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এবং এই ভাবে ক্রুসেড পরবর্তী অধ্যায়ে ইউরোপ জুড়ে লোক চলাচল ও পণ্য চলাচল বৃদ্ধি পেলে সেই যাত্রাপথ ধরেই প্লেগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অধ্যাপক জন নরিসের মতে এই বয়ানে আপাত ভাবে প্লেগের বিস্তার পথ পূর্ব থেকে পশ্চিম বলে মনে হলেও আদতে ইউরোপীয় ক্ষেত্রে প্লেগের সম্প্রসার হয় দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে। প্রাথমিক ভাবে ভূমধ্যসাগরীয় এবং মার্সেই হয়ে আইবেরীয় উপকূল ভাগে প্লেগ ছড়ালেও ক্রমশ রোন নদীর উপত্যকা ও জার্মান গিরিপথ ধরে প্লেগ উত্তর ও মধ্য ইওরোপে প্রবেশ করে এবং দ্রুত উপকূল ভা্গের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে।ঐতিহাসিক বেনেডিক্টাও সাহেবের মতে এই সময়ে নৌপথে লোকচলাচলের গতি স্থলপথের তুলনায় দ্রুত হওয়ায় এই রোগ মূলত জাহাজে অবস্থিত ইঁদুরেরমাধ্যমেই বোধহয় বেশি দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু সেসময়ে প্লেগের বাহক হিসেবে ইঁদুরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকায় বানিজ্যিক ও প্রাচ্য দেশীয় সূত্রকেই বেশি দায়ী করা হয়। ‘কৃষ্ণ’ মারীর সঙ্গে মিশে প্রাচ্যদেশে উদ্ভূত এই মড়ক নিয়ে দ্রুত গুজব চাউর হতে থাকে। সমসাময়িক প্রাচ্যের সঙ্গে সংযোগকারী রেশমপথকে ধরেই ইউরোপে এই মড়কের আবির্ভাব এ নিয়ে জোর গুজব ছড়াতে থাকে। বলা হতে থাকে যে এই প্লেগের উৎস সেই সুদূর চীনদেশে , তারপর ভারত ও মধ্য প্রাচ্য হয়ে এই মড়ক শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে উপনীত হয় ও সেখান থেকেই ইউরোপে প্রবেশ করে। আরেক মত অনুসারে এই মড়ক ভারতের পর সমুদ্র পথে উপসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর মধ্যপ্রাচ্য হয়ে রাশিয়ায় মড়ক সৃষ্টি করে ইউরোপে প্রবেশ করে। অর্থাৎ প্রাচ্য দেশগুলি যেমন চীন ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যই এই রোগের উৎসস্থল । বস্তুতপক্ষে কৃষ্ণমারীর অন্যতম প্রাচীন বিবরনীকার গাব্রিয়েল দে মুসির রচনা থেকে জানা যায় ইউরোপে প্রকোপ শুরু হওয়ার আগেই প্রাচ্যে বিশেষত চীন ও ভারতে প্লেগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সমকালীন ভারতে অবস্থানরত এক ফ্লেমিস যাজককে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন এই সময়ে ভারতে বিষধর সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি আকাশ থেকে বর্ষিত হতে থাকে এবং সে বিষের ফলেই এই মড়ক শুরু হয় যার হাত থেকে কোনো ব্যক্তির রক্ষা ছিলনা।

প্লেগের প্রাদুর্ভাব ইউরোপ থেকে কিছুটা অন্তর্হিত হলে অষ্টাদশ শতকে সেখানে জোরদার বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। এ সময়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপীয়দের সমীক্ষা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল প্লেগের উৎস সন্ধানে অনালোকিত অঞ্চলের অবস্থিতি। তাই প্রায় সব গবেষণায় সমস্বরে দাবী করা হয় এই মারণ রোগের উৎস ও বৃদ্ধি পৃথিবীর অনুন্নত প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে ভারত আর চীনের নাম। ১৭২০ সালে আবে দ্য গিগ্নেস তাঁর অনুসন্ধানে এক আরবীয় রচনাকার আল-মারকিজিকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেন যে এই মড়কের উৎস বস্তুতপক্ষে ক্যাথে বা চীনে যা ক্রমশ যাযাবর তাতার আর তুর্কীদের হাত ঘুরে ভারতসহ ইসলামী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩২ এ জার্মান গবেষক হেকর এই গিগ্নেসকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে লেখেন যে প্লেগ আদতে এক প্রাচ্যদেশীয় মহামারী যা ইউরোপে এক সময়ে এক ভয়ঙ্কর মড়ক ডেকে আনে। বিংশ শতকেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যেমন হেনরি হাওয়ার্থ, ব্রদেল এমন কি জীগ্লার ও হেকরকেই প্রামাণ্য সূত্র মেনে নিয়ে তাঁদের গবেষণা সাজান। আশ্চর্‍্য বিষয় হল, এঁরা কেউই সমকালীন চৈনিক বা ভারতীয় সূত্র অনুসন্ধানের কথা ভাবেন নি। চীনা রাজকীয় জ্ঞানকোষ কু চিন তউ শু চি চেং-এ মহামারীর উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু তা বিউবোনিক প্লেগ জোর দিয়ে বলা যায়না। কারণউল্লিখিত মহামারীগুলিতে উপসর্গ রূপে গুটি বা বিউবোর কথা আমরা ১৬৪৪ এর আগে পাইনা। অন্যদিকে এই সময়ে ভারতে রচিত দুটি সমকালীন রচনাও প্লেগ সম্পর্কে নিশ্চুপ।

১৩৪৭ এর আগে পরে অথবা সমসাময়িক সময়কালে উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসন। এই সময়ে মূল বিবরণীকার জিয়াউদ্দিন বারনি এক অস্থির সময়ের চিত্র অঙ্কণ করেছেন। এই সময়ে পশ্চিম ভারত জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের চিত্র আমরা তাঁর রচনায় পাই।এ সময়ে অনাবৃষ্টি এবং নিরন্তর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে বারনি এক করুণ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির চিত্র তাঁর রচনায় উপস্থাপন করেন। এমন কি এই দুর্ভিক্ষের জেরে যে মানুষ নরখাদকে পরিণত হয়েছে সে কথাও বারনি গোপন করেননি। পাশাপাশি সম্রাটের খেয়ালে দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী পরিবর্তন ও সে কারণে পথ মধ্যে শ্রান্তিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কথাও সেখানে সবিস্তারে আছে। এমন কি শাসকের এই অদ্ভূত খেয়ালে দেশ গোরস্থানে পরিণত হয়েছে বলেও বারনি উল্লেখ করেন। কিন্তু সে উল্লেখে কোথাও প্লেগ বা মহামারীর কথা নেই। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই বারনি মহম্মদ বিন তুঘলকের দক্ষিণ ভারত অভিযানের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ওয়ারাঙ্গাল অঞ্চলে ভয়ানক মহামারীর উল্লেখ করেন। সে মারণ ব্যাধি নাকি স্বয়ং সম্রাটকেও আক্রমণ করে। তবে আরোগ্যের জন্য সম্রাট চলে যান কুইলনে। সেখানেই মাস খানেকের বিশ্রামে সেরে ওঠেন মহম্মদ বিন তুঘলক। তবে অনেক সেনা মারা যায় এই মহামারীতে। কিন্তু এখানে বারে বারে মহামারীর প্রসঙ্গ উঠলেও তার উপসর্গ কিছু বলা হয়নি । এই সময়ে ভারতে পর্যটনরত মরক্কোবাসী ইবন বতুতাও এই সময়ে দক্ষিণ ভারতে মহামারীর কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে এ মহামারীর প্রকোপ এতোই প্রবল ছিল যে তিনি একদিন আগে যে সর্বাঙ্গ সুস্থ দাসীটি কিনেছিলেন,এক দিনেই সে মড়কে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। এখানে লক্ষনীয়, বিউবোনিক প্লেগ বা গুটি বসন্তে যে গুটি বেরোয় তা থাকলে কোনো দাসীকেই সর্বাঙ্গ সুস্থ বলে বর্ণনা করা যায়না। সুতরাং বলা যেতে পারে এই ব্যাধি বিউবোনিক প্লেগ বা গুটি বসন্ত নয় … খুব সম্ভবত কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মত কোনো অসুখ যা হঠাতই সুস্থ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।

জিগ্লার প্রভৃতি ঐতিহাসিকদের মতে ভারতীয় ক্ষেত্রে এই সময়ে প্লেগের উপস্থিতি স্বীকার নেহাতই প্রাচ্যীয় সর্বময় শাসকের ভয়ে করা সম্ভব হয়নি। যা বতুতা বিদেশী পর্‍্যটক হিসেবে , জিগ্লারের মতে, নির্দ্বিধায় করেছেন। তাই তাঁরা ভারতের আভ্যন্তরীণ প রিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য বারনির চেয়ে বেশি বতুতার বিবরণের উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমরা জানি বারনি কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়েও সত্যভাষনে পিছপা হননি। এমন কি তিনি অনাহার ও অপশাসনে মৃত্যুর কথাও নির্ভয়ে উল্লেখ করেছেন। তবে মহামারী হিসেবে প্লেগের উল্লেখ করতে কেনই বা চুপ থাকবেন? তাইবারনির এই ইচ্ছাকৃত নীরবতারতত্ত্বদেশীয় গবেষক লক্ষ্মীকান্ত আনন্দবলীর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি । অন্যদিকে তিনি ইবন বতুতার রচনাও নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মূল আরবী রচনা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে মহামারীর উল্লেখে বতুতা দুটি ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে ‘ওয়াবা’ শব্দটি ব্যবহার করেন কিন্তু ফিরতি পথে দেখা সিরিয়ায় মহামারীর প্রসঙ্গে তিনি ‘তাউন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সিরিয়ার মহামারীর বর্ণণায় তিনি রোগীর গুটিজনিত যন্ত্রণা এবং তীব্র জ্বরের কথা উল্লেখ করেন , যেখানে দক্ষিণ ভারতের প্রসঙ্গে তিনি জ্বর বা গুটি কোনোটাই উল্লেখ করেননি। অর্থাত এই দুটি শব্দের পৃথক ব্যবহার বতুতা সুচিন্তিত ভাবেই করেছন। তাঁর মতে , এ দুটি শব্দ দুই ধরণেরসংক্রামক ব্যাধি নির্দেশ করতে পারে, যেখানে তাউন অবশ্যই বিউবোনিক প্লেগ, কিন্তু ওয়াবা অন্য কোন মহামারী। আনন্দবলীর মতে আসলে এই দুটি শব্দই ইংরেজি ও অন্যান্য অনুবাদে প্লেগ হিসেবে অনুদিত হয়ে এক সমস্যা তৈরি করে। এই ভ্রান্তিকর অনুবাদের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ ভারতে বিউবোনিক প্লেগের কাল্ক্রম ইউরোপের আগেই ঠেলে দেন।

সত্যি বলতে কি প্রাক-আধুনিক ভারতে বহু মহামারীর উল্লেখ থাকলেও বিউবোনিক প্লেগের মত মারাত্মক মারীর উল্লেখ খুব একটা বেশি নেই। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে এই হিন্দুস্তানের সঙ্গে তাঁর জন্মভূমির পার্থক্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন যে এখানকার মারীও ভিন্ন। মনে হয় এ ক্ষেত্রে তিনি ক্রান্তীয় মারী যেমন কলেরা, ম্যালেরিয়া বা বসন্তের উল্লেখ করেছেন। প্লেগের মত সর্বগ্রাসী মড়কের স্মৃতি বোধহয় ততদিনে মধ্য এশিয়া সংলগ্ন অঞ্চলেও কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। ১৫৭৪-৭৫ সালেমহম্মদ আরিফ কান্দাহারীর রচনা থেকে জানা যায় গুজরাটে এক ভয়ানক মহামারী দেখা দেয়। সেখানে নাকি প্রতি সকালে গাড়িতে করে মৃত মানুষের শব দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হত। তবে এই বিভীষিকাময় বর্ণ্নাতেও রোগের উপসর্গ নিয়ে বিশেষ কোন বিররণ নেই। পক্ষান্তরে জাহাঙ্গীরের শাসনকালে ১৬১৬ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে যে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। শুধু মুঘল সূত্রই নয়, ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে টমাস রোর বিবরনীতেও জানা যায় এই সময়কার প্লেগ বা মহামারী আগ্রাকে প্রায় মৃত্যু পুরী বানিয়ে ছেড়েছিল। শুধু আগ্রাই নয় , উত্তর পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই মারী ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে যার ভয়ে স্বয়ং সম্রাটও আগ্রায় বসবাস করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। শহরে বসবাসকারী অনেক খেটে -খাওয়া মানুষ প্রাণ রক্ষায় নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যায়। আগ্রা সহ বেশ কয়েকটি শ হরে লোক সংখ্যা হঠাত হ্রাস পায়। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে ফতেপুর সিক্রী এই মহামারীর প্রকোপ থেকে বেঁচে যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী তুজুক ই জাহাঙ্গীরীতে এই মহামারীর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ইঁদুরের সংসর্গের কথা উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে ১৬১৯ সালে তাঁর ফতেপুর সিক্রিতে থাকাকালীন আসাফ জার কন্যা , যার সঙ্গে আব্দুল্লা খাঁর বিবাহ হয় এবং যাঁরা ছিলেন আগ্রা নিবাসী , তিনি সম্রাটের কাছে এসে জানান যে তাঁর বাড়িতে হঠাত করেই কিছু ইঁদুর মরছিল। এবং এই মৃত ইঁদুর যারাই স্পর্শ করেছিল তাদের মধ্যে প্রথমে জ্বর ও পরে গায়ে ডালের মত বড় বড় কালো গুটি দেখা যেতে থাকে। এ ভাবেই মাত্র সাত দিনের মধ্যে এই সম্ভ্রান্ত মহিলার বাড়ির প্রায় জনা ১৭ জন এই অভূতপূর্ব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তুজুকে এই ঘটনার বিবরণ ও উপস্থাপন দেখে মনে হয় ভারতীয় ক্ষেত্রে এ ব্যাধি বা উপসর্গ কোনোটাই আগে খুব একটা দেখা যায়নি বলেই এই বিস্তারিত বিবরণ। তাও আবার খোদ সম্রাটের বয়ানে। লক্ষনীয় যার বয়ান বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এখানে ঠাঁই করে নিয়েছে তিনি কিন্তু একজন নারী, কিন্তু তাঁর পর্‍্যবেক্ষণ ক্ষমতা জাহাঙ্গীর বেশ সপ্রশংসভাবে উপস্থাপন করেছেন।

১৬৮২ সালে দাক্ষিণাত্যেও প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মাসির-ই আলমগিরিতে উল্লেখিত হয়েছে যে ১৮৮৮ সালে বিজাপুরে ঔরংজেবের উপস্থিতিকালে যে প্লেগের সংক্রমণ দেখা যায় তা থেকে এমন কি রাজারাজরারাও রেহাই পাননি। বগলে বা উরুসন্ধিতে গূটি বেরনোর দু তিন দিনের মধ্যেই সংক্রামিত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুর সেই করাল ছায়া থেকে যশোবন্ত সিঙ্ঘের পুত্র মহম্মদ সিংহ বা আমীর ফাজিল খাঁ অথবা সম্রাটের প্রিয় বাঁদী ঔরঙ্গাবাদী মহল কারো নিস্তার ছিল না। কাফি খাঁ গলায়, বগলে , কানের পিছনে প্রায় আঙুরের মত বড় যন্ত্রণাদায়ক গুটিকে এই মারণ ব্যাধির উপসর্গ রূপে বর্ণনা করেছেন।

এই গুটিসহ প্লেগের উল্লেখ কিন্তু ভারতীয় ক্ষেত্রে সপ্তদশ শতকের গোড়াতেই প্রথম দেখা যায়। অর্থাত ইউরোপে যখন ব্ল্যাক ডেথের তান্ডব চলছিল প্রাচ্যের নিজস্ব রচনায় তখনো কিন্তু প্লেগের উল্লেখ নেই বললেই চলে। সে কারণেই বোধহয় প্লেগের ইতিহাস প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে যুগবিভাজিকা রূপে স্বীকৃত নয়। কিন্তু অনেক ইতিহাস গবেষণাই প্লেগকে প্রাচ্যীয় ক্ষেত্রে থেকে উদ্ভূত এক ব্যাধি রূপে চিহ্নিত করে ইউরোপীয় ক্ষেত্রে প্লেগের ইতিহাসকে এক বহিরাগত অভিঘাত রূপে বর্ণ্না করেছেন।

আসলে প্লেগের উৎপত্তি ও বিস্তারের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ পরিবেশের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক বেনেডিক্টাও সাহেবের মতে প্লেগের জীবানু বহুদিন ধরে মানবদেহ নয়, ইউরেশিয়ায় বিস্তীর্ণ স্তেপ অঞ্চলের পশু দেহই সংক্রামিত করে আসছিল। কিন্তু ১০ শতাব্দী নাগাদ ব্যাপক কৃষির প্রসার ও যাযাবর জাতির অভিগমনের পরিমাণ হঠাত বৃদ্ধি পেলে এই জীবানু ক্রমশ মানবদেহের সংসর্গে আসে ও এক মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই এই মহমারীর প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধানে কোন জাতি বা ভৌগোলিক ক্ষেত্রকে দায়ী না করে জীবনযাত্রার পরিবর্তন বা পরিবেশের বিবর্তনের মত ব্যাপক কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি অনুঘটকের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলেই কি মহামারী নিয়ে দোষারোপ শেষ হবে? জানিনা। তবে দোষারোপের ইতিহাস বোধহয় যে কোনো অতিমারীর সঙ্গে যুক্ত। সেই অন্ধতার প্লেগের হাত থেকে বোধহয় আমাদের মুক্তি নেই।

0 comments: