0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in
ভূমিকা-

আজ এই বয়সে এসেও মাঝেমাঝে রাই এর সাথে হঠাৎ দেখা করতে সাধ হয়।
সেই শিমূলগাছের অলিন্দে বা ওর পছন্দের আশ্রমের সামনে যেখানে একদা এক ভাঁড় চা আর তেলেভাজা খাওয়ার অভ্যেসটা এসে গেছিল দুজনের মধ্যেই।

নিবিড় অবকাশযাপন আর দাম্পত্যের কোনওদিন বোধহয় দেখা হয়না বলেই একসাথে চলাও আর হয়না । তাই "চলতি হাওয়ার পন্থী" হয়েই চলা শুরু অন্যদিকে। আজ শুধু আখরযাপনটাই না হয় থাকলো...... !

*****************

উৎসর্গ: 'রাই' তোমাকে,
(অন্য সবাই এটি এক ভাবে পড়বে আমরা অন‍্যভাবে পড়বো!)
**************

(১)

এতরাত্তিরেও জানলার ওপারে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েই চলেছে। এখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে বলেই শুধু নয়, হঠাৎ বৃষ্টির জন্যেও খানিক বটে চারদিক জনশূন্য,মানে প্রাণীশূন্যই বলা যায়। এই অন্তহীন বৃষ্টি ভেজা জানলার অন্যপ্রান্তে আরও একজনের দুচোখে নিশ্চুপে বৃষ্টি নেমেছে দু গাল জুড়ে। এই বৃষ্টি অবশ্য শব্দ করে নামেনা কখনো। ভেতরটা পুড়তে পুড়তে ঝাঁঝরা হতে হতে কখনো সখনো যখন আর সামলানো যায়না তীব্রতম ব্যক্তিগত আবেগগুলোকে, ঠিক তখনই বৃষ্টিকে নামাতে হয়।

হাঁটুর কাছে পোশাকটা সামলে রাই জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাকী জগৎকে কেমন ধুইয়ে দিচ্ছে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত এই অসময়ের জলধারা। বিরামবিহীন এই বৃষ্টি মনখারাপ করে দিচ্ছে থেকে থেকে। অথচ খানিকআগেই কুড়িবছরের অভ্যেসমত সপ্তাহকালীন সঙ্গমে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে অংশ নিতে হয়েছিল। সে পর্বটি খানিকক্ষণ আগে চুকেছে বলেই তার স্বামী সোমেশ রতিক্লান্ত হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আলাপ থেকে ঝালা পার করে বিস্তারে তার আগ্রহ কোনওকালেই ছিলনা। বড় গম্ভীর, অভিজাত আর নির্লিপ্ত মানুষ সে। তবুও মাঝেমাঝে জৈবিকপ্রবৃত্তিকে বশ মানানো তার পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে এই যা।

রাইএর তলপেটে একটু একটু ব্যথা হচ্ছে। মেনোপজ কি তবে এবার এসে দরজায় কড়া নাড়বে! যৌবনের শেষবেলায় এসে আবার কেন যেন ওর আজকাল মা হতে ইচ্ছে করে। ওদের একমাত্র মেয়ে তিতলি ব্যাঙ্গালোরে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। তারও ফাইন্যাল সেমেস্টার কদিন পরেই শুরু হবে। রাইএর কিন্তু এই বয়সে এসেও মিষ্টি দুধের গন্ধভরা কচি কচি বালা পড়া একটা শিশুকে আবার বুকে মধ্যে চেপে ধরতে ইচ্ছা করে। রাইএর যেন সত্যি বয়স বেড়ে বড় হয়ে আর সিরিয়াস হয়ে ওঠা হলনা । অথচ বাড়ির প্রতিটা অলিন্দ গত বিশ বছরের প্রত্যেকটা দিন রাইকে শুধুই এক আবেগ সংস্পর্শহীন অথচ পরিপূর্ণ একটা খেলাঘর নিয়ে মেতে থাকতে বাধ্য করেছে। রাই তো পুতুল খেলতে এত ভালবাসত! তাই হয়তো নকল সংসারে পুতুল খেলার খেলুড়ি হয়েই তাকে রয়ে যেতে হল সারাটা জীবন।

**********

বৃন্দাবনের আশ্রমজীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মীরা। এখন তার শয়নে স্বপনে আরাধনায় শুধু গিরিধারী লালা। এই কদিনেই মনে হয় সে যেন দীর্ঘকাল চিতোর ছেড়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার বুকের মধ্যে একটুকরো চিতোর এখনো চিতার মত জ্বলছে।রাণা সংগ্রামসিংহ,ভোজরাজ,রতনসিংহ, এমনকি উদয়সিংহ যাকে পুত্রের স্নেহে সে একদিন ভালবেসেছে, এসব নামের সুখ দুখের স্মৃতি সবই কোথাও মনের গভীরে চাপা পড়ে আছে আজও। বড় শুষ্ক ঊষর সেই অনুভূতি। যে গিরিধারীর প্রেমে তিনি বিগলিত তনু-মন-প্রাণে, সেই প্রেমও বৃষ্টি হয়ে এতদিনে এই উত্তপ্ত অঙ্গারদহন নিবৃত্ত করল কই। মীরার ঠোঁটে গান আসে এক কলি - "কুরজন কুরজন ফিরত রাধিকা শবদোঁ শুনত মুরলী কো/মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর,ভজন বিনা নর ফীকো..."
রাজপুতানার মরুময় হৃদয়ের এই সুর কতদিন আগেই হাওয়ায় বয়ে বৃন্দাবনের পথে ভেসে গেছে। গৈরিক একবস্ত্রা এক রমণী তার তৃষিত কন্ঠে ধারণ করেছে প্রেমের সুর। পরম ঐশীকে কি এভাবেই পাওয়া যায় তবে?

ভোরের দিকে জানলা দিয়ে একচিলতে তির্যক আলো চোখে এসে পড়ায় রাই ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকাল। ও কি তবে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। একটা অচেনা সুরের গান যেন ভেসে আসছিল বহুদূর থেকে। সে গান রাই এর আগে শোনেনি কখনো।

***********

আজ রবিবার বলে সোমেশ বেলা করেই উঠবে। সুতরাং এখনো ঘন্টাখানেক সে আবার একটু ঘুমাতেই পারে। কিন্তু আর না শুয়ে থেকে রাই বিছানা ছেড়ে উঠে আবার ওই জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বড় আবছা মেঘলা একটা দিনের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে। দু'একজন প্রাতঃভ্রমণকারী এরমধ্যেই হাঁটতে বেরিয়েছে। আবার একটা আধা আলসেমি অাধা কেজো একটা দিন আসছে রোজকার অভ্যেসের মত। কদিন ধরেই রাই এর মনটা ভাল লাগছে না। খুব কান্না পাচ্ছে অকারণেই। একটা গান মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটাই বোধহয় স্বপ্নে এতক্ষণ শুনছিল। তখন অচেনা লাগলেও এবার যেন সুরটা মনে হচ্ছে চেনা চেনা লাগছে !
" মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর"- এ কথাটা হঠাৎ রাই এর মনের মধ্যে অনুরণন তুলছে। সবকিছু তুচ্ছ করে এরকমভাবেও কি কেউ ভালবাসতে পারে কাউকে? রাই যে এখনো সেই সর্বদিকপ্লাবী প্রেমের উজানে ভাসতে চায়। বেলা বয়ে যাচ্ছে রাই কি তার দেখা পাবেনা।সোমেশ তার স্বামী হিসাবে বড় বেশী সিরিয়াস। অগোছালো প্রেমিক সে কখনোই নয়। এমনকি রাই এর কাপড় বদলানোর সময়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লে সে এখনো মাথা নীচু করে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সে বড় বেশী অভিবাবকের মত। তার কাছে নিশ্চিন্ত ভাতকাপড় আর আশ্রয় পাওয়া গেলেও বারান্দায় আসা কমলালেবুর কোয়ার মত রোদ্দুর মাখা উস্কোখুস্কো আদর আশা করা যায়না।

এরমধ্যে রাই হঠাৎ টের পায় তার ঊরুসন্ধির মধ্যে বয়ে চলা আর্দ্রতা। তারিখ অনুযায়ী দু একদিনের মধ্যেই যদিও এ মাসের পিরিয়ডস্ শুরু হবার কথা। যাক্, এবারে একটু আগেই তা শুরু হয়ে গেল। নিজে যে এখনো উর্বর আছে সেটা ভেবে এখন একটু ভাল লাগছে। এই উর্বরতাটা একজন নারীর কাছে খুব দামী। সন্তানের জন্ম দিতে পারাটাই যদিও কেবল মূখ্য উদ্দেশ্য নয় এ যেন প্রকৃতির সাথে সরাসরি সেই আদিসংযোগ বজায় রাখা। স্যানিটারী প্যাড হাতে নিয়ে রাই দ্রুত পায়ে বাথরুমে চলে যায়। প্রাইভেট হাইজিনটাকে ঠিকমত মেইন্টেন করাটা এই অবস্থায় খুব জরুরী ব্যাপার।

***********
কালকেই হারমোনিয়ামটা দুখিয়াকে দিয়ে নামিয়েছে রাই। ডোয়ার্কিনের স্কেলচেঞ্জিং হারমোনিয়াম। বিয়ের সময় ছোটমামা দিয়েছিল যাতে এ বাড়িতে এসেও রাই এর গানের চর্চাটা উঠে না যায়। রাই এই বাড়িতে এসে কতদিন যে রেওয়াজ করেনি। বিয়ের বছর দেড়েকের পর একসময় রেডিওতে অডিশন দেবার কথাও উঠেছিল। ততোদিনে তিতলি পেটে এসে গেছে বলে আর হয়ে ওঠেনি। রাই একবার হারমোনিয়ামটাতে হাত বোলায়। কি এক অপার্থিব সুখ এই সুরের চাবিতে হাত বোলালে যে পাওয়া যায় তা শুধু রাই নিজে জানে। ************
আজ ফেসবুকে একটা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে মোবাইল ঘাঁটতে গিয়ে দেখল রাই। দুখিয়া হার্বাল চা এর কাঁচের মগটা টেবিলে রেখে গেল। ছেলেটার নামটা বেশ ইন্টারেস্টিং 'অরাতিদমন রায়'। ছেলেটা বেশ অল্পবয়সী আর সঙ্গে একটা উজ্জ্বল দীপ্তি আছে চোখেমুখে। ছেলেটি সাহিত্যচর্চা করে বলে মনে হল। যদিও তা স্পষ্ট করে বলা নেই ওতে। সোশ্যালমিডিয়ায় রাই খুব বাড়াবাড়ি ভাবে না হলেও থাকে। একসময়ের কবিতা লেখার অভ্যেসটা এখনো মাঝে মাঝে হঠাৎ উস্কে ওঠে। আজকাল এরকম হুট করে অচেনা ছেলেদের রিকোয়েস্ট ও অ্যাকসেপ্ট করেনা। তবুও অল্পবয়সী চৌখস বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেরা বন্ধুত্বের হাতছানি দিলে এখনো বুকে চমক লাগে বৈকি। এই নির্জন একাকীত্বময় পৃথিবীতে অন্তত কেউ তো ওর বন্ধুত্বের সান্নিধ্য কামনা করে। হলই বা ভার্চুয়াল সেটা। ছেলেটার প্রোফাইল আর পোষ্টগুলোতে চোখ বোলাতে লাগল রাই। হঠাৎ একটা পোষ্টে এসে চোখ আটকে গেল।
উনিশশো ছিয়াশি সালের বইমেলার সময়ে একজন ষোল বছরের তণ্বী মেয়ের অটোগ্রাফের খাতায় সই দিতে গিয়ে দু'লাইন পদ্য লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়-
"একপ্রান্তে পড়ে আছে আলো, ও প্রান্তে আছে কালো/ব্যবহৃত হতে -হতে মানুষ বেসেছে গাছ ভালো।" সেই লাইনদুটোকে আচমকা ছেলেটার পোস্টে দেখতে পেয়ে রাই এর গায়ে পদ্মকাঁটা ফোটে। মনে মনে অনেকদিনের স্মৃতির পাতা উল্টে যায় অচিরেই।

0 comments: