পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে
Posted in পথে প্রবাসেআমার ভারতবর্ষ
মুসম্মন বুরুজ (শাহি বুরুজ)
নসিব-এ-হিন্দৌস্তাঁ
পর্তুগিজ যাজক বুজিও এদেশের লোককে খুব ভালো চিনতেন। সেই কবে মানুচ্চিকে বলেছিলেন, ' দারা অত্যন্ত ভালো লোক, উদার, বুদ্ধিমান, সুশাসক। কিন্তু সেটাই এদেশের লোকের কাছে তাঁর প্রধান দোষ। হিন্দুস্তানের লোকেরা নীচ স্বভাবের। তারা দারা শুকোহের মতো মহান, হৃদয়বান শাসককে ভক্তি করেনা। তাদের জন্য দরকার তাদের মতো'ই নীচ, নৃশংস, অত্যাচারী স্বভাবের শাসক।
বের্নিয়ার আর ত্যাভারনিয়েরও খুব অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, দিল্লি-আগ্রার সব প্রভাবশালী আমির-ওমরাহরা সারা জীবন বাদশা শাহজাহানের থেকে কী ধরনের সাহায্য, অনুকম্পা লাভ করেছিলেন। বাদশা শাহজাহানের দৌলতেই তাঁরা লাভ করেছিলেন ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু অসুস্থ, অসহায় বাদশাকে পুত্র অওরঙ্গজেব যখন আগ্রা দুর্গে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে গৃহবন্দি করলেন, তাঁরা কেউ টুঁ শব্দ করলেন না। পিতৃপ্রতিম বাদশাহকে তাঁরা নীরবে, সভয়ে, সশংক ত্যাগ করলেন।
হিন্দুস্তানের সর্বকালের সবচেয়ে বিলাসী, সম্পদশালী, জাঁকালো রাজা নির্বাসিত হলেন আগ্রা দুর্গের এককোণে। তখন তাঁর রাজত্ব বলতে শুধু মুসম্মন (শাহি) বুরুজ আর শাহজহানি মহল। শুশ্রূষা বলতে কন্যা জহানারা বেগম। তবে অওরঙ্গজেব বাদশাহের জনানা মহলকেও সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই জীবিত বেগম আকবরি মহল আর ফতেহপুরি মহল। শাহজহানের প্রথম সন্তান শাহজাদী পরহুনর বেগমও ছিলেন সেখানে। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিলোনা। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেখাশোনা করতেন বাদশাহ এবং সঙ্গিসাথিদের। তিনি চলে যেতে দায়িত্বে আসেন একজন নীচ স্বভাবের খোজা সর্দার, মুতমদ। মানুচ্চির ভাষায়, 'বেবুনে'র মতো চেহারা তাঁর। প্রতিপদে বাদশাকে অপদস্থ করাই ছিলো তাঁর প্রিয় কাজ।
বাদশাহ শাহজহান তখন খুবই ধর্মমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কোরান পড়তেন, জপ করতেন, পণ্ডিতদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বাকি সময় শাহজহানি মহলের ঝরোখা থেকে তাজের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করা মানা ছিলো। একে ওকে চিঠি লিখতেন বলে অওরঙ্গজেবের আদেশে বাদশার মহলে কালি-কলম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিঠি বলতে শুধু অওরঙ্গজেব আর তাঁর মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করে লেখা পত্ররাজি। যার মধ্যে শুধু অওরঙ্গজেবের চিঠিগুলি উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি সমানে দোষারোপ করতেন দারা আর তাঁর ওয়ালিদসাহেবকে। একমাত্র বক্তব্য, যদি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এতোদিনে হিন্দুস্তান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হয়ে যেতো।
বাদশা শাহজহান পূর্বপুরুষ, যেমন আকবর আর জহাঙ্গিরের সূর্যদর্শনের জন্য নির্মিত লালপাথরের বুরুজটিকে নতুন ভাবে বানিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলের যমুনা নদীর শোভা দেখার জন্য। আগ্রা দুর্গের এটিই সব চেয়ে উঁচু নির্মাণ। সতেরো শতকে তিনের দশকে তৈরি আটকোনা মর্মর পাথরের এই প্রাসাদটির সৌন্দর্য এক কথায় অনুপম। এই প্রাসাদটির মর্মর পাথরের জাফরি, কুলুঙ্গি আর দেওয়ালের ইনলে কারুকাজ পিয়েত্রা দুরা শৈলীর। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে গোল বুরুজ আর চমৎকার ফোয়ারা। বন্দি বাদশা শাহজাহান এখানেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ আট বছর। এই প্রাসাদের ঝরোখা থেকেই তিনি তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাঁর অন্তিম শয্যাও পাতা হয়েছিলো ঠিক এর মাঝখানে। গ্রেট মুঘলদের উপযুক্ত একটি কীর্তি, মুসম্মন বুরুজ।
তখন বয়স চুয়াত্তর। পয়লা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৬। সোমবার। বাদশাহ বুঝতে পারলেন দিন শেষ হয়ে এলো। কিন্তু তিনি সজ্ঞানে, সচেতন আছেন। জহানারার অনুরোধে লিখলেন পুত্র অওরঙ্গজেবের অপরাধ মার্জনা পত্র। লিখলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটিও। কীভাবে অন্ত্যেষ্টির কাজ করতে হবে, তার নির্দেশ। জহানারা কাঁদছিলেন। তাঁকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বাকিদের বললেন জহানারার যত্ন করতে। রাতের থেকেই তাঁর জন্য কোরান পাঠ শুরু হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনিও শেষ প্রার্থনা সমাপন করলেন। ভোর তিনটে নাগাদ বাদশাহ শাহজাহানের ইন্তেকাল হলো।
জহানারা অনুরোধ করলেও অওরঙ্গজেব 'শাহি দাফন' মঞ্জুর করলেন না। আগ্রা থেকেই সইয়দ মহম্মদ কনৌজি আর কাজি কুরবান এসে তাঁর মরদেহের পরিচর্যা করে একটি চন্দন কাঠের কফিনে স্থাপন করলেন। অওরঙ্গজেব এলেন না। পুত্র মোয়াজ্জামকে পাঠালেন। যমুনা নদীতে বজরা করে নিয়ে যাওয়া হলো তাজমহলে। মমতাজমহলের পাশের কবরে বাদশা শাহজহান সমাহিত হলেন দুপুর নাগাদ।
এসবই মনে পড়ছিলো যখন মুসম্মন বুরুজের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে বাদশাহের সাড়ে তিনশো বছর পর তাজকে দেখছিলুম আমরা। শাহজহানকে মনে পড়ছিলো। তাঁর শান-শওকত, অজেয় প্রতাপ, অপার ধনসম্পদ। এভাবেই শেষ হয়। মনে পড়ছিলো পাদরি বুজিওর ভবিষ্যদবাণী। এদেশের লোক ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণেই বেছে নেয় অওরঙ্গজেবের মতো শাসক। দারাশুকোহ তাদের জন্য অপাংক্তেয়। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের নসিবও এক নরক থেকে অন্য নরকের কুম্ভীপাকে আবৃত্ত হতে থাকে। পরিত্রাণ পেতে অনেক রক্তক্ষয়, শহাদৎ….
আমরা হয়তো ভুলিনা। আবার মনেও রাখিনা। এই আমাদের ভারতবর্ষ...
0 comments: