ভূতের গল্প - প্রিয়ম সেনগুপ্ত
Posted in ভূতের গল্প
ভূতের গল্প
রাধাবিনোদের ভূত
প্রিয়ম সেনগুপ্ত
কোতলপুর জায়গাটা এখন যেমন দেখা যায়, লোকে বলে দেড়শো বছর আগেও নাকি এরকমই ছিল। প্রথমে নীলকর সাহেবরা, তারপরে ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে, গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। কিন্তু মানুষগুলো রয়ে গেছে একইরকম।
রাঘবনারায়ণ চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ছিলেন এই গ্রামের জমিদার। জমিদারির আর অবশ্য কিছুই নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু শ’দুয়েক বছরের পুরনো বিরাট বাড়িটা। একটা দিক ভেঙেই পড়েছে। আর একটা অংশ সারিয়ে নিয়ে সেখানেই থাকেন রাঘব ও তাঁর পরিবার। গোটা আটেক ঘর এখনও বাসযোগ্য আছে। আর আছে বড় চকমেলানো দালানটা। সেখানে রোজ সকালে বসে ঝাড়া দু’ঘণ্টা খবরের কাগজ পড়েন রাঘব।
আজও সবে খেলার পাতাটা খুলেছেন, এমন সময় ঈষৎ গুঞ্জন শুনে কাগজটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। গোটা দশেক লোক ঢুকেছে দালানে। সকলেই গ্রামেরই বাসিন্দা। শিবু ডাক্তার, মধু স্যাকরা, সুদখোর মহাজন বৈকুণ্ঠ সাঁতরা, জীবন দারোগার সঙ্গে আরও জনা ছ’য়েকের ভীড়। তাদের মধ্যে একজনের কোমরে দড়ি। চোখের তলায় কালশিটে বলে দিচ্ছে হাল্কা চড়চাপড়ও দেওয়া হয়েছে তাকে।
—‘কী চাই? সক্কাল সক্কাল দলবল নিয়ে এতো হুজ্জুতি কীসের?’ বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন রাঘব। কাগজ পড়ার সময় কোনওরকম উৎপাত পছন্দ করেন না তিনি।
শিবু ডাক্তার হাত কচলাতে কচলাতে এগিয়ে এসে বলল, ‘পেন্নাম হই হুজুর। আজ্ঞে কদিন ধরে গাঁয়ে বড় চুরি হচ্ছিল আজ ভোররাতে ব্যাটাকে একেবারে হাতেনাতে ধরেছি। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলুম।’
কোতলপুর এখনও যে কোনও বিষয়ে রাঘববাবুর কথাই শেষ কথা। এখানকার লোকে আদালত থানা বলতে রাঘববাবুর কথাই বোঝে। তাঁর পূর্বপুরুষ জমিদার হলে কী হবে, রীতিমতো প্রজাদরদী আর পরোপকারী ছিলেন। তাই এখনও রীতিমতো মান্যিগণ্যি করে তাঁকে। ছোটখাটো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট থেকে চুরি–চামারি সবকিছুর বিচার তাই রাঘবকেই করতে হয়। তাতে বাদী বিবাদী দু’পক্ষেরই সময় বাঁচে।
কোমরে দড়ি বাঁধা লোকটাকে ভাল করে একবার দেখে নিলেন রাঘববাবু। লোক না হলে ছেলে বলাই ভাল। বছর ২৩–২৪ বয়স। শ্যামলা একহারা চেহারা। চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখে–মুখে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। মুখে একটা মিচকে হাসি লেগে আছে। ৭০ বছর ধরে কোতলপুরে আছেন রাঘব। এ চেহারা তাঁর চোখে পড়েনি। ছোকরা যে বাইরের চোর, সেটা বোঝাই যায়। তারপরে কটমট করে চোখ পাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘কোতলপুরে এসে চুরি? তোমার সাহস তো মন্দ নয় ছোকরা!’ রাঘববাবুর বাজখাঁই গলায় যে হুঙ্কার শুনলে জীবন দারোগা অবধি কেঁপে যায়, সেই হুঙ্কারকে ছোকরা যেন পাত্তাই দিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাওয়ায় নাক তুলে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। সে দৃশ্য দেখে রাঘববাবুর ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল। জীবন দারোগা এবার দড়ি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাঘবের সামনে নিয়ে এল চোরটাকে। বলল, ‘আপনিই একটা শাস্তির বিধান দিন হুজুর। এমনিতেই সামনে পুজো আসছে। একে নিয়ে কোর্ট কাছারি করতে হলে চিত্তির।’ রাঘববাবু সবে বলতে যাচ্ছেন, ‘ব্যাটাকে মাথা মুড়িয়ে ১০০ বেত মেরে বের করে দাও,’ এমন সময় চোখ কুঁচকে চোরটা দুম করে তাঁকে একটা প্রশ্ন করে বসল।
—‘গাওয়া ঘি, তাই না স্যার? সঙ্গে ছোলার ডাল?’
থ’ হয়ে গেলেন রাঘব। সকালে চায়ের পরে লুচি খাওয়া তাঁর সেই ছোট্টবেলার অভ্যাস। সঙ্গে নারকেলের কুচি দেওয়া ছোলার ডাল চাই–ই চাই। আর শুধু লুচি হলেই হবে না, সে লুচি ভাজা হতে হবে গাওয়া ঘি–তে। কিন্তু সেকথা এই ব্যাটা কী করে জানল?
রাঘবের প্রশ্নটা যেন বুঝতে পেরে গিয়েছিল চোরটা। ডান কাঁধে মুখ ঘষে ঠোঁটের কষ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তটা মুছে নিয়ে বলল, ‘গাওয়া ঘি–র গন্ধই আলাদা। তাই না স্যার? এরকম ঘি–তে লুচি ভাজলে টক্ করে খেয়ে নিয়ে নেই। থালায় ফুলকো লুচিটার ওপরে আঙুলের টোকায় একটা ফুটো করে দিতে হয়। ভুস্ করে তখন যে হাওয়াটা বেরিয়ে আসে, আহা কী গন্ধ তার।’
রাঘববাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। এ চোর সামান্য চোর নয়। চোখমুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালই উত্তম–মধ্যম দেওয়া হয়েছে একে। তারপরেও যে এরকম রসিকতা করতে পারে, সে অন্য ধাতুতে গড়া। কিন্তু রাঘব যে ভেবড়ে গিয়েছেন, সেটা বুঝতে দিলেন না চোরটাকে। চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো? আমার নাম রাঘব দত্ত। আমার পূর্বপুরুষ এই গ্রামের জমিদার ছিলেন। এই এখন যেখানে দাড়িয়ে আছো, আজ থেকে শ খানেক বছর আগে এখানে তোমার মতো চোররা ধরা পড়লে বুকে বাঁশডলা দিয়ে হাত–পা বেঁধে তাঁরা গুমঘরে ফেলে রাখতেন। চোর দু’দিনে সিধে হয়ে যেত। আর তুমি এখানে এসে ফক্করি করছো? নেহাত আজ আর সেই ব্রিটিশ আমল নেই। থাকলে না, দশ মিনিটে শায়েস্তা করে দিতাম তোমাকে।’
মুচকি হেসে চোরটা এবার বলল, ‘জানি স্যার। সব জানি। জানি বলেই তো এই গ্রাম আসা।’
—‘জানো?’ রাঘবের যেন বিস্ময়ের শেষ নেই।
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি রাঘব চৌধুরী। আপনার বাবা দাশরথি চৌধুরী। তস্য পিতা রামশংকর চৌধুরী, তস্য পিতা...’
বিরক্তিতে হাত তুলে ছোকরাকে থামিয়ে দিলেন রাঘব, ‘থাক থাক তোমাকে আর আমার বংশলতিকা মুখস্থ বলতে হবে না। বলি তোমার ধান্দাটা কী হে? কদ্দিন ধরে আমার এলাকায় এসে চুরিচামারি চালাচ্ছো? আর আমার বংশ সম্পর্কে এত জানলে কী করে? কাজটা অবশ্য কঠিন নয়, কারণ আমাকে এখানে সকলে একডাকে চেনে।’
এবার একটু নড়েচড়ে বসল ছোকরা, ‘তাহলে খুলেই বলি স্যার। মানে আপনি যেমন আপনার পূর্বপুরুষের গল্প বললেন, আমি তেমনি আমার পূর্বপুরুষের গল্প বলি।’
জীবন দারোগা এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘আস্পর্ধাটা একবার দেখুন হুজুর। ধরা পড়ার পর থেকে এই একই গল্প বলে আমাদের কানের মাথা খেয়ে নিয়েছে। এবার আপনাকেও একই গল্প বলছে।’
ছোকরার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছিলেন রাঘব। তাই বললেন, ‘আহ্ জীবন, দেখি না কী বলে। তারপর না হয় ওই বটতলায় নিয়ে গিয়ে দু’ঘা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যাবে।’ তারপরে চোরটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কই হে, বলো কী বলবে।’
চোর যা বলল, তার সারমর্ম এই, তার নাম ভূতেশ্বর মণ্ডল ওরফে ভুতো। নদীর পাড়ে বুড়োশিব মন্দিরের পাশে যে জায়গাটা এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, সেখানে ছিল তার পূর্বপুরুষের বাস। তার ঠাকুর্দা ছিলেন জটিলেশ্বর মণ্ডল— এই গ্রামের নামকরা চোর। যাকে একডাকে সকলে জটা চোর বলে চিনত। রাঘববাবুও শৈশবে জটা চোরের কীর্তিকলাপের কথা শুনেছেন। গ্রামের পাঁচজনের বাড়ি থেকে কলাটা–মুলোটা চুরি করত জটা। তাতে অবশ্য কোতলপুরের কেউ বিশেষ বিব্রত ছিল না। সেকালে সব গ্রামেই দু’–একটা করে পেশাদার চোর থাকত। তারা চুরিও করত। ধরা পড়লে দু’একটা কানমলা, চড়চাপড় দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো। জটাও সেই স্তরেরই চোর ছিল। তবে হঠাৎ একদিন গ্রাম ছেড়ে রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। তাকে আর দেখা যায়নি। জটা আসলে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। সেখানে গিয়েই ডেরা বাঁধে। প্রথমে এক উঠতি বাবুর বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটেছিল কদিন তারপরে বুদ্ধিবলে ধীরে ধীরে শেষ জীবনে দু’পয়সা কামিয়ে ভদ্রসমাজে জাঁকিয়ে বসে। জটেশ্বরের ছেলে ঘণ্টেশ্বর বটুকেশ্বর অবশ্য অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। জুয়ো, ঘোড়ারোগ আরও নানারকম বদস্বভাবে বাপ যে সামান্য টাকা পয়সা জমিয়েছিল, সেগুলো খুইয়ে ফের বেলেঘাটার এক বস্তিতে এসে ওঠে বটুকেশ্বর। ভূতেশ্বর মানে ভুতোরও বড় হয়ে ওঠা ওই বস্তিতেই। তারপরে দিন চারেক হল সে এই গ্রামে চলে এসেছে।
সব শুনে টুনে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন রাঘব। বললেন, ‘তা এখন তুমি কী চাও হে ভুতো?’ হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড় করে ভুতো বলল, ‘আজ্ঞে, হুজুরের যদি অনুমতি হয়, তাহলে এই গ্রামেই ফের ডেরা বাঁধি। বাপ–পিত্মোর বসতবাড়িটাই সাফসুতরো করে নিই।’
একেবারে হাহা করে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল শিবু ডাক্তার। বলল, ‘ভুলেও এই কাজটি করতে যাবেন না হুজুর। এই জটা চোরের নাতি ঠাকুরদার গুণ পেয়েছে। এই গ্রামে থাকলে আমাদের তিষ্ঠোতে দেবে না। সব চুরি করে ফাঁক করে দেবে।’
চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়ালেন রাঘব। গম্ভীর গলায় ভুতোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার মতলবটা কী? ঝেড়ে কাশো দেখি। পূর্বপুরুষের ভিটেয় থাকার জন্য এমনি এমনি তুমি কলকাতা ছেড়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসোনি।’
ভুতো চোখ গোলগোল করে বলল, ‘সত্যি কথা বললে বিশ্বাস করবেন না স্যার। ভাববেন গুল মারছি।’
জীবন দারোগা ভুতোর পেটে রুল দিয়ে একটা খোঁচা মেরে ধমকের সুরে বলল, ‘হুজুরের সামনে সব কথা খুলে বল। না হলে...’
রাঘববাবুর ততক্ষণে হালকা কৌতূহল জেগেছে। হাত তুলে জীবন দারোগাকে থামিয়ে বললেন, ‘আঃ জীবন... তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি। দাঁড়াও, আগে ও কী বলে শুনে নিই। কই হে বলো দেখি ভুতো।’
ভুতো বলতে শুরু করল, ‘আজ্ঞে পাড়ার একটা পাঁউরুটির কারখানায় কাজ করতাম আমি। তা আপনাদের আশীর্বাদে কষ্টেসৃষ্টে দিন কেটে যাচ্ছিল। দিন কয়েক আগে বুঝলেন, জটা মণ্ডল আমাকে স্বপ্ন দিলেন।’
চোখ কুঁচকে রাঘববাবু বললেন, ‘স্বপ্ন দিলেন মানে?’
—‘আজ্ঞে স্বপ্নে এলেন। সে কী কান্না! হাপুস নয়নে কাঁদছেন, আর বলছেন ভুতো রে, বংশের মানসম্মান কি কিছু রাখবি না? আমি যেই বললাম কেন দাদু, কী হয়েছে? অমনি উনি বললেন, তুই কোন বংশের ছেলে জানিস? তোর ঠাকুরদা, ঠাকুরদার ঠাকুরদা সব যে নাম করা চোর ছিল রে। জমিদার গিন্নিকে পেন্নাম ঠোকার অছিলায় পায়ের মল খুলে নিতাম একঘর লোকের সামনে কেউ টেরটি পেতো না। আর সেই বংশের ছেলে হয়ে কি না তুই পাঁউরুটির কারখানায়...’ এই অবধি বলেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগল ভুতো।
ভূতপ্রেতে যে একেবারে বিশ্বাস নেই রাঘববাবুর, তা নয়। তবে এ ছোকরা যে হাজতবাস এড়ানোর জন্য ডাঁহা মিথ্যে বলছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি। দিনে দুপুরে এরকম গাঁজাখুরি গল্প শুনে হাসিই পাচ্ছিল তাঁর। কোনও মতে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘বটে? তোমার ঠাকুরদা স্বপ্নে এসে বললেন যাও কোতলপুরে ফিরে যাও আর বাপঠাকুরদার মতো চুরি করো, আর তুমিও সুড়সুড় করে চলে এলে?’
দু’হাত জোড় করে হাঁউমাউ করে উঠল ভুতো, ‘বিশ্বাস করুন হুজুর, গ্রামে আসতে চাইনি। বাপরে কী মশা এখানে। সাইজে চড়ুইপাখিকেও হার মানাবে। কিন্তু ওই... প্রথমে স্বপ্নে আসত, তারপরে দেখা দিতে শুরু করল।’
—‘দেখা দিতে মানে?’
—‘না হলে আর বলছি কী? যেই রাতে শুই, তক্তপোশের পাশে এসে বসে। নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। বলে, অন্তত মাসখানেক থেকে আয় বাবা। অল্প কিছু হলেও চুরি করে দেখা। আমার আত্মাটা শান্তি পাক। আমিও বারবার বলতাম, চুরি ফুরি আমি করতে পারব না। লোকে ধরতে পারলে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবে। আর উনি খালি বলতেন, কোতলপুরে যা বাবা। ওখানে জমিদারবংশের মন খুব বড়। চুরি করে ধরা পড়লে দু’–একটা চড় চাপড় দেবে হয়তো, তারপরে কান মুলে দিয়ে বলবে, যা আর চুরি করিস না।’
এবার আর হাসি চাপতে পারলেন না রাঘববাবু। ছোকরার গল্প বলার কায়দাটা জব্বর। বললেন, ‘তা, রোজ রাতে যে ভূত দেখতে, ভয় পেতে না?’
—‘তা আর পেতাম না? দাঁতে দাঁত লেগে মুচ্ছো যাই আর কী। তবে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই তো পরশু রাতেও এলেন। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে বাবা। আমার নাম রেখেছিস এতদিনে। বাপ্স কী ঠান্ডা হাত।’
রাঘববাবুর মন আনচান করছিল। কারণ রান্নাঘরের দিক থেকে এবার লুচির গন্ধ গোটা দালানে ম–ম করছে। বেশ ক্ষিদেও পাচ্ছিল। এই গুলবাজ ছোকরার পিছনে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। রাঘব উঠে দাঁড়ালেন। তারপরে বাড়ির ভিতরে হেঁটে যাওয়ার আগে জীবন দারোগাকে বললেন, ‘একে হাজতে নিয়ে যাও জীবন। একটু উত্তম–মধ্যম দাও। তারপরে কাল সকালে ছেড়ে দিও। আমি উঠি, এখন আমার বিস্তর কাজ আছে।’ কাজ বলতে যে লুচি খাওয়া, সেটা আর ভাঙলেন না তিনি।
*******************************************************
রাতে খাওয়া দাওয়া করার পরে ছাদে হেঁটে বেড়ানো রাঘব বাবুর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তাতে খাবার হজম হয় ভাল। ঘড়ি কাঁটা ধরে ন’টায় খেয়ে নেন তিনি। তারপরে ছাদে পায়চারি করেন তিনি। রান্না ভাল হলে দিল তরিবৎ হয়ে থাকে রাঘরবাবুর। তখন গানও করেন গুনগুন করেন তিনি। আজ যেমন রাঘববাবুর মন ভাল হয়ে আছে গিন্নির হাতের লাউচিংড়িটা খেয়ে। রাঘববাবু নিজে খাদ্যরসিক। ভাল রান্নার কদর করতে জানেন। খেতে বসেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন গিন্নিকে। গুনগুন করে গান গাইছিলেন রাঘববাবু। ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ, উঠিল বিশ্বে সে কি কলরব, সে কি মা ভক্তি, সেকি মা হর্ষ’— এই দুটো লাইনই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছিলেন তিনি। কারণ বাকিটা তিনি ভুলে গিয়েছেন। চতুর্থবার ‘সেকি মা হর্ষ’ গাইতে গিয়ে থমকে যেতে হল রাঘববাবুকে। কারণ তাঁর বাড়িতে চোর ঢুকেছে। তাও একটা নয়, দুটো। ছাদের কোণে দুটো ছায়ামূর্তি স্থির হয় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্যটা যে কী, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একজনের হাতে আবার একটা লাঠি। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললেন রাঘব। তিনি যে ভয় পেয়েছেন, সেটা বুঝতে দেওয়া চলবে না। তাহলে মাথায় ওই লাঠির বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে সব হাতিয়ে নিয়ে যাবে লোক দুটো। বরং চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করা যাক। তাতে যদি চম্পট দেয় চোররা। গলা খাঁকরে বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাই, কে ওখানে? কে? কী চাই?’ লোক দুটো এবার এগিয়ে এল। তবে হেঁটে নয় ভেসে! যেন মাটিতে পা পড়ছে না। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দুটোর মধ্যে একটা লোক রাঘবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা ঠক করে ছাদের মাটিতে ঠুকল। তারপরে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘হারামজাদা, দিনে দিনে একটা অপদার্থ তৈরি হয়েছো।’ রাঘব একটা কড়া উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু থমকে গেলেন লোকটার সাজপোশাক দেখে। এতক্ষণে রাঘব লক্ষ্য করেছেন যেটাকে তিনি লাঠি বলে ভুল করেছিলেন সেটা আসলে লাঠি নয়, ছড়ি। আগেকার দিনের বাবুদের যেমন থাকত। লোকটার সাজপোশাকও সেই বাবুদের মতোই। গায়ে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, চুনোট করা ফিনফিনে ধুতি, চোখে গোল কাঁচের চশমা। পাশের লোকটার গায়ে একটা ফতুয়া আর খেটো ধুতি। এবার রাঘবের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যা ঘটছে সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এবার ফের চাপা গলায় ধমকে উঠল লোকটা, ‘বলি, গুরুজনদের দেখলে পেন্নাম টেন্নাম করার অভ্যাসটা বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছো?’ রাঘর যে শেষ কবে কাউকে প্রণাম করেছিলেন, তা তাঁর মনে পড়ে না। কিন্তু গুরুজন কথাটায় কেমন যেন খটকা লাগল তাঁর। বুক ধুকপুক নিয়েই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আপনি? আজ্ঞে আমি ঠিক চিনতে...’ লোকটা এবার ফের দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, ‘তা পারবে কী করে, সায়েব আর্টিস্ট দিয়ে যে অয়েল পেন্টিংগুলো আঁকিয়েছিলুম, সেগুলো সব তো আমার ছেলে, মানে তোমার ঠাকুরদা গুদামঘরে বাক্সবন্দী করে ফেলে রেখেছিল। তুমি বা তোমার বাপ সেগুলো কস্মিনকালে সেগুলো খুলে দেখার দরকার মনে করোনি। যাই হোক, আমি রাধাবিনোদ চৌধুরী। তোমার বাপের ঠাকুরদা। যে বছর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি সরল, সে বছরই ফৌত হয়েছি। কালাজ্বর হয়েছিল। যাক সেকথা, নাও এবার পেন্নাম করো।’
রাঘব যে এখনও অজ্ঞান হননি, সেটা ভেবে তাঁর নিজেরই আশ্চর্য লাগছিল। কোনওমতে মাথা নিচু করে প্রণামের ভঙ্গি করে কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, ‘আজ্ঞে বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি।’
মুখঝামটা দিয়ে রাধাবিনোদ (কিংবা তার ভূত) বললেন, ‘তুমি সেদিনের ছোকরা তুমি আর কী সেবা করবে হে?’ তারপরে লাঠি শুদ্ধু হাতটা পাশের লোকটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘বরং দেখো তো এর কী সমস্যা। কিছু করা যায় কিনা।’
পাশের লোকটা (কিংবা লোকটার ভূতটা) এতক্ষণ চুপ করে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে হাত জোড় করে বলতে শুরু করল, ‘পেন্নাম হই ছোটকত্তা। আপনি আমাকেও চিনবেন না। আমার নাম জটেশ্বর মণ্ডল। কত্তা মানে জমিদারবাবু আরকী আমাকে ভালবেসে জটা বলে ডাকতেন। আপনার বাবাও আমাকে চিনতেন।’
এবার ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে রাঘববাবুর কাছে। সকালে ভুতো তাহলে মিথ্যে বলেনি। জটার ভূত তো আছেই, কোথা থেকে সে যেন আবার ডেকে এনেছে তাঁর পূর্বপুরুষ রাধাবিনোদের ভূতকেও।
এদিকে জটা চোরের ভূত বলেই চলেছে, ‘আজ্ঞে বেঁচে থাকতে আমার একটু হাতটানের দোষ ছিল। চুরিটাই আমাদের বংশপরম্পরায় পেশা। এদিকে সেই বংশের ছেলে হয়ে আমার নাতিটা যখন পাঁউরুটির কারখানায় কাজ করতে শুরু করল, তখন দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ছোটকত্তা।’
এবার রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘সেই কারণেই ও ওর নাতিকে এখানে পাঠায়। আর তুমি এতো বড় ইস্টুপিড, তাকে কিনা পুলিসের হাতে তুলে দিলে! হাজতে আড়ং ধোলাই খাওয়ালে।’
রাঘব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলেন না। চোরকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাতে অন্যায়ের কী হয়েছে। সেকথা মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করতেই দাঁত খিঁচিয়ে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘অ্যাঃ বড় আমার হাকিমসায়েব এলেন রে। বলি, আমার গাঁয়ের চোর, সে গাঁয়েরই দু’–পাঁচটা বাড়িতে চুরি করবে না তো কি কলকেতা যাবে চুরি করতে? আর তুমিও বলিহারি বাপু, নিজে একটা শাস্তির বিধান করতে পারলে না, পুলিসে দিতে হল? হায় হায় হায় এই চৌধুরী বংশের মান–ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে গেল।
এতক্ষণে রাঘব এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে এই দুই ভূত তাঁর ঘাড় মটকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। তাই মনে একটু সাহস এনে গলা খাঁকরে রাধাবিনোদের ভূতকে বললেন, ‘ইয়ে, আমার কী করা উচিত ছিল? মানে আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?’
উত্তরটা এল জটা চোরের কাছ থেকে, ‘জানেন ছোটকত্তা আমার চুরিতেও এ গাঁয়ের লোক অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। শেষটায় জমিদার বাবু বললেন, জটা তুই আমার বাড়িতে থাকবি। বাগানে কোদাল চালাবি, কুয়ো থেকে জল তুলবি, দু’বেলা ভালমন্দ খাবি। চুরি যদি আর করতে শুনেছি, তাকে চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেবো।’
গোঁফে তা দিতে দিতে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘যতদিন আমার বাড়িতে ছিল জটা কিন্তু আর চুরি করেনি। শেষটা একদিন কেঁদে পড়ে বলল, জমিদারবাবু আমাকে ছুটি দিন। চুরি না করলে মনে শান্তি পাচ্ছি না। তবে চিন্তা নেই আমি গাঁয়ের লোককে জ্বালাবো না। আমি কলকাতা চলে যাচ্ছি ওখানে চুরি করব। চোর হয় যদি চুরি না করি তাহলে আমার ধর্মনাশ হবে। কী আর করি ছেড়ে দিলাম ওকে।’
রাঘব থতমতো খেয়ে বললেন, ‘তাহলে আমি কী করব এখন?’
রাধাবিনোদের ভূত মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘ন্যাকাষষ্ঠী! তাও বলে দিতে হবে। কাল সকাল হতে না হতেই থানায় যাবে। ভুতোকে ছাড়াবে। তাকে বাড়ির কাজে রাখবে। চিন্তা নেই ভুতো যাতে খুব বেশিদিন চুরি না করতে পারে সেটা আমি দেখে নেবো। কিন্তু রাধাবিনোদ চৌধুরীর বংশধর হয়ে তুমি বিচারের ভার পুলিসের হাতে ছাড়বে আর আমার প্রজার বংশধরকে তুমি থাকতে পুলিসের পেয়াদা শাসন করবে — এ আমি মেনে নেবো না। এ আমাদের বংশমর্যাদা মাটি করার পক্ষে যথেষ্ট হে। দেখো জটাকে যেন আমার কাছে এসে তোমার নামে আর নালিশ না জানাতে হয়।’
—‘কিন্তু ভুতো যদি ফের চুরি করে?’
রাধাবিনোদের ভূত হাত তুলে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘বললাম তো খুব বেশি দিন করবে না। শুধু ওকে ভালমন্দ খাইয়ো। পেট ভরা থাকলে আর চুরি করবে না।’
কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘যে আজ্ঞে’ বলে মাথা তোলার পরে রাঘববাবু দেখলেন, দুই ভূতই বিদায় নিয়েছেন।
*********************************************************
পরদিন সকালে থানায় গিয়ে ভুতো যখন ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন রাঘব তখন বাড়ি অবধি সঙ্গে এল জীবন দারোগ। বারবারই ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘আপনার দয়ার শরীর, তাই আপনি এই হতচ্ছাড়া বিটলে ফাজিল চোরটাকে বাড়িতে এনে রাখছেন। তবে কাজটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না। দেখবেন, ও এবার আপনার ঘরেই সব সাফ করে দেবে, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।’ সেকথা রাঘববাবু গায়ে মাখলেন না। গিন্নিও খুঁতখুঁত করতে লাগলেন বটে। ঘরের মধ্যে দাগী চোরকে পোষা তো কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু কাল রাতে কী ঘটেছে, সেকথা তো আর গিন্নিকে বলা যায় না। তাই ফাইফরমাশ খাটার কাজে ভুতো বহাল হয়ে গেল। দালান ঝাঁট দেয়। জল তোলে— আরও নানা কাজ মুখ বুজে করে চলে সে।
এদিকে জীবন দারোগার আশঙ্কা যে মিথ্যে নয়, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল দিন তিনেকের মধ্যেই। প্রথমে খোয়া গেল খান তিনেক একশো টাকার নোট। তারপরে রাঘববাবুর গিন্নির একটা রুপোর বাটি। এভাবে টুকটাক জিনিস ক্রমশ হাওয়া হতে লাগল। মাস দেড়েক পরে শিবু ডাক্তারের বাড়ি থেকেও চুরি হল। রাঘববাবু জানেন কে চুরি করছে। কিন্তু রাধাবিনোদের ভূত যা আদেশ করে গিয়েছে, তা অমান্য করা সাহস তাঁর নেই। ভুতোকে ডেকে যে তিনি জেরা করেননি এমন নয়। কিন্তু চুরির কথা অম্লানবদনে অস্বীকার করে গেল সে। অসহায় লাগছিল রাঘববাবুর। ভুতোকে উত্তম–মধ্যম দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়ানোর কথা যে ভাবেননি, তা নয়। কিন্তু যখনই ভেবেছেন, তখনই রাধাবিনোদের ভূত এসে হাজির হয়েছে। রহস্যজনক ভাবে একচোখ টিপে হাসিমুখে বলেছে, ‘খাইয়ে যাও হে, ভুতোকে পেট পুরে খাওয়া যাও। পেটে খিদে না থাকলে মানুষ সৎপথে থাকে। হৃদয় জেতার চাবিকাঠি হল রসনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাঘববাবু অবাকই হয়েছেন। একটা চোরকে বাড়িতে পুষে রেখে পেটপুরে খাওয়ানোর কী যুক্তি, সেটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না তাঁর। তবু পূর্বপুরুষের আদেশ বলে কথা। রোজই ভালমন্দ খাইয়ে চলেন ভুতোকে। আর কিছু খেতেও পারে ছেলেটা। লুচি খায় তো দু’দিস্তে। ভাত খায় তো এক হাঁড়ি। এই সেদিন রসগোল্লা আনতে দিয়েছিলেন, এক জায়গায় বসে চল্লিশটা মেরে দিল টপাটপ। আবার খাওয়া শেষ করে মুখ ধুতে ধুতে বলে কী, ‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো। আসলে বড় টানাটানির মধ্যে এতদিন কেটেছে, এসব খাবার তো আগে পাইনি।’ রাঘববাবু দাঁত কিড়মিড় করে বলেন, ‘এখন তো পাচ্ছো, তা বলি কী, চুরি করার অভ্যাসটা এবার ছাড়লে হয় না?’ অমনি শিশুর মতো সরল মুখ করে সুর টেনে টেনে ভুতো বলতে থাকে, ‘চুরি! কই আমি তো আর চুরি করিনি।’
ভুতোর মুখ দেখে গা–পিত্তি জ্বলে যায় রাঘববাবুর।
*****************************************************
ব্যাপারটা ঘটল শনিবার রাতে। নিতাই সামন্ত গ্রামের ধনীদের একজন। দোতলা বাড়িও আছে। মাঝরাতে প্রথমে ধপাস করে একটা চিৎকার, তারপরে কান ফাটানো বাবাগো–মাগো চিৎকার শুনে পাড়াশুদ্ধু লোক দৌড়ে এল নিতাইয়ের বাড়ির দিকে। দেখা গেল, ড্রেনপাইপের নীচে মাটিতে পড়ে আছে ভুতো। চুরির উদ্দেশে উঠছিল, হাত ফস্কে নীচে পড়ে গেছে। কোমরটা যে ভেঙেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। ধরাধরি করে সকলে নিয়ে গেল রাঘববাবুর কাছে। ডাক্তারও ডাকা হল। শিবু ডাক্তার বলে গেল, কম করে তিনমাস একাবারে নটনড়নচড়ন হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে ভুতোকে। না হলে বাকি জীবনটা হাঁটাচলা করাই মুশকিলের হয়ে যাবে। কোমরের চোট বড় বেকায়দার জিনিস কিনা!
সকলকে বিদায় জানিয়ে ছাদে উঠে সবে একটা সিগারেট ধরাতে যাবেন রাঘববাবু এমন সময় ফস করে উদয় হল রাধাবিনোদের ভূত। হাসি হাসি মুখে বলল, ‘কেমন বুঝলে?’
গলা খাটো বলে রাঘববাবু বললেন, ‘আপনিই ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছেন ওকে, তাই না?’
জিভ কাটল রাধাবিনোদের ভূত। বলল, ‘ছি ছি, ও আমার সন্তানের মতো। ওকে কী আমি আঘাত করতে পারি?’
—‘তাহলে?’
জিভে চুকচুক শব্দ করে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘তোমার ঘটে তো কিস্যু নেই হে। এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে? মনে আছে, তোমাকে বারবার বলতাম ওকে ভাল করে খাইয়ো।’
—‘তা বলতেন বটে। ব্যাটা আমার অন্নধ্বংস করতো।’
—‘আহা রাগ করছো কেন রাঘব। এতে তো ভালই হয়েছে।’
অবাক সুরে রাঘববাবু বললেন, ‘ভাল?’
সেই রহস্যময় হাসিটা হেসে একচোখ টিপে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘রোজ দু’বেলা তোমার বাড়িতে আকণ্ঠ খেয়ে খেয়ে ভুতো চেহারাটা কেমন বাগিয়েছে দেখেছো? পেটে থলথল করছে নেয়াপাতি ভুড়ি। ঘাড়ে গর্দানে টসটস করছে চর্বি। ওই মোটা চেহারায় কী আর চুরি হয় হে?’ তারপর একটু থেমে ফের বলল, ‘আচ্ছা শোনো, ছেলেটা সেরে উঠলে ওকে একটা দোকান টোকান কিছু করে দিও। পারলে মিষ্টির দোকান। সকালে কচুরি জিলিপি পাওয়া যাবে। ময়রাদের চেহারা দেখেছো তো কেমন ভুঁড়ি হয়। ভুতোর রোগা হওয়াটা পাকাপাকি ভাবে আটকে ফেলতে হবে।’
এবার আর ভয় পেয়ে নয়, হো হো করে হাসতে হাসতে রাদাবিনোদের ভূতের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম ঠুকে রাঘববাবু বললেন, ‘যে আজ্ঞে।’