Next
Previous
Showing posts with label ভূতের গল্প. Show all posts
2

ভূতের গল্প - প্রিয়ম সেনগুপ্ত

Posted in




ভূতের গল্প


রাধাবিনোদের ভূত
প্রিয়ম সেনগুপ্ত



কোতলপুর জায়গাটা এখন যেমন দেখা যায়, লোকে বলে দেড়শো বছর আগেও নাকি এরকমই ছিল। প্রথমে নীলকর সাহেবরা, তারপরে ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে, গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে। কিন্তু মানুষগুলো রয়ে গেছে একইরকম।
রাঘবনারায়ণ চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ছিলেন এই গ্রামের জমিদার। জমিদারির আর অবশ্য কিছুই নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু শ’দুয়েক বছরের পুরনো বিরাট বাড়িটা। একটা দিক ভেঙেই পড়েছে। আর একটা অংশ সারিয়ে নিয়ে সেখানেই থাকেন রাঘব ও তাঁর পরিবার। গোটা আটেক ঘর এখনও বাসযোগ্য আছে। আর আছে বড় চকমেলানো দালানটা। সেখানে রোজ সকালে বসে ঝাড়া দু’ঘণ্টা খবরের কাগজ পড়েন রাঘব।
আজও সবে খেলার পাতাটা খুলেছেন, এমন সময় ঈষৎ গুঞ্জন শুনে কাগজটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। গোটা দশেক লোক ঢুকেছে দালানে। সকলেই গ্রামেরই বাসিন্দা। শিবু ডাক্তার, মধু স্যাকরা, সুদখোর মহাজন বৈকুণ্ঠ সাঁতরা, জীবন দারোগার সঙ্গে আরও জনা ছ’য়েকের ভীড়। তাদের মধ্যে একজনের কোমরে দড়ি। চোখের তলায় কালশিটে বলে দিচ্ছে হাল্কা চড়চাপড়ও দেওয়া হয়েছে তাকে।
—‘কী চাই? সক্কাল সক্কাল দলবল নিয়ে এতো হুজ্জুতি কীসের?’ বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন রাঘব। কাগজ পড়ার সময় কোনওরকম উৎপাত পছন্দ করেন না তিনি।
শিবু ডাক্তার হাত কচলাতে কচলাতে এগিয়ে এসে বলল, ‘পেন্নাম হই হুজুর। আজ্ঞে কদিন ধরে গাঁয়ে বড় চুরি হচ্ছিল আজ ভোররাতে ব্যাটাকে একেবারে হাতেনাতে ধরেছি। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলুম।’
কোতলপুর এখনও যে কোনও বিষয়ে রাঘববাবুর কথাই শেষ কথা। এখানকার লোকে আদালত থানা বলতে রাঘববাবুর কথাই বোঝে। তাঁর পূর্বপুরুষ জমিদার হলে কী হবে, রীতিমতো প্রজাদরদী আর পরোপকারী ছিলেন। তাই এখনও রীতিমতো মান্যিগণ্যি করে তাঁকে। ছোটখাটো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট থেকে চুরি–চামারি সবকিছুর বিচার তাই রাঘবকেই করতে হয়। তাতে বাদী বিবাদী দু’পক্ষেরই সময় বাঁচে।
কোমরে দড়ি বাঁধা লোকটাকে ভাল করে একবার দেখে নিলেন রাঘববাবু। লোক না হলে ছেলে বলাই ভাল। বছর ২৩–২৪ বয়স। শ্যামলা একহারা চেহারা। চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখে–মুখে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। মুখে একটা মিচকে হাসি লেগে আছে। ৭০ বছর ধরে কোতলপুরে আছেন রাঘব। এ চেহারা তাঁর চোখে পড়েনি। ছোকরা যে বাইরের চোর, সেটা বোঝাই যায়। তারপরে কটমট করে চোখ পাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘কোতলপুরে এসে চুরি? তোমার সাহস তো মন্দ নয় ছোকরা!’ রাঘববাবুর বাজখাঁই গলায় যে হুঙ্কার শুনলে জীবন দারোগা অবধি কেঁপে যায়, সেই হুঙ্কারকে‌ ছোকরা যেন পাত্তাই দিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাওয়ায় নাক তুলে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। সে দৃশ্য দেখে রাঘববাবুর ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল। জীবন দারোগা এবার দড়ি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাঘবের সামনে নিয়ে এল চোরটাকে। বলল, ‘আপনিই একটা শাস্তির বিধান দিন হুজুর। এমনিতেই সামনে পুজো আসছে। একে নিয়ে কোর্ট কাছারি করতে হলে চিত্তির।’ রাঘববাবু সবে বলতে যাচ্ছেন, ‘ব্যাটাকে মাথা মুড়িয়ে ১০০ বেত মেরে বের করে দাও,’ এমন সময় চোখ কুঁচকে চোরটা দুম করে তাঁকে একটা প্রশ্ন করে বসল।
—‘গাওয়া ঘি, তাই না স্যার? সঙ্গে ছোলার ডাল?’
থ’ হয়ে গেলেন রাঘব। সকালে চায়ের পরে লুচি খাওয়া তাঁর সেই ছোট্টবেলার অভ্যাস। সঙ্গে নারকেলের কুচি দেওয়া ছোলার ডাল চাই–ই চাই। আর শুধু লুচি হলেই হবে না, সে লুচি ভাজা হতে হবে গাওয়া ঘি–তে। কিন্তু সেকথা এই ব্যাটা কী করে জানল?
রাঘবের প্রশ্নটা যেন বুঝতে পেরে গিয়েছিল চোরটা। ডান কাঁধে মুখ ঘষে ঠোঁটের কষ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তটা মুছে নিয়ে বলল, ‘গাওয়া ঘি–র গন্ধই আলাদা। তাই না স্যার? এরকম ঘি–তে লুচি ভাজলে টক্‌ করে খেয়ে নিয়ে নেই। থালায় ফুলকো লুচিটার ওপরে আঙুলের টোকায় একটা ফুটো করে দিতে হয়। ভুস্‌ করে তখন যে হাওয়াটা বেরিয়ে আসে, আহা কী গন্ধ তার।’
রাঘববাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। এ চোর সামান্য চোর নয়। চোখমুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালই উত্তম–মধ্যম দেওয়া হয়েছে একে। তারপরেও যে এরকম রসিকতা করতে পারে, সে অন্য ধাতুতে গড়া। কিন্তু রাঘব যে ভেবড়ে গিয়েছেন, সেটা বুঝতে দিলেন না চোরটাকে। চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো? আমার নাম রাঘব দত্ত। আমার পূর্বপুরুষ এই গ্রামের জমিদার ছিলেন। এই এখন যেখানে দাড়িয়ে আছো, আজ থেকে শ খানেক বছর আগে এখানে তোমার মতো চোররা ধরা পড়লে বুকে বাঁশডলা দিয়ে হাত–পা বেঁধে তাঁরা গুমঘরে ফেলে রাখতেন। চোর দু’দিনে সিধে হয়ে যেত। আর তুমি এখানে এসে ফক্করি করছো? নেহাত আজ আর সেই ব্রিটিশ আমল নেই। থাকলে না, দশ মিনিটে শায়েস্তা করে দিতাম তোমাকে।‌’
মুচকি হেসে চোরটা এবার বলল, ‘জানি স্যার। সব জানি। জানি বলেই তো এই গ্রাম আসা।’
—‘জানো?’ রাঘবের যেন বিস্ময়ের শেষ নেই। 
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি রাঘব চৌধুরী। আপনার বাবা দাশরথি চৌধুরী। তস্য পিতা রামশংকর চৌধুরী, তস্য পিতা...’
বিরক্তিতে হাত তুলে ছোকরাকে থামিয়ে দিলেন রাঘব, ‘থাক থাক‌ তোমাকে আর আমার বংশলতিকা মুখস্থ বলতে হবে না। বলি তোমার ধান্দাটা কী হে? কদ্দিন ধরে আমার এলাকায় এসে চুরিচামারি চালাচ্ছো? আর আমার বংশ সম্পর্কে এত জানলে কী করে? কাজটা অবশ্য কঠিন নয়, কারণ আমাকে এখানে সকলে একডাকে চেনে।’
এবার একটু নড়েচড়ে বসল ছোকরা, ‘তাহলে খুলেই বলি স্যার। মানে আপনি যেমন আপনার পূর্বপুরুষের গল্প বললেন, আমি তেমনি আমার পূর্বপুরুষের গল্প বলি।’
জীবন দারোগা এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘আস্পর্ধাটা একবার দেখুন হুজুর। ধরা পড়ার পর থেকে এই একই গল্প বলে আমাদের কানের মাথা খেয়ে নিয়েছে। এবার আপনাকেও একই গল্প বলছে।’
ছোকরার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছিলেন রাঘব। তাই বললেন, ‘আহ্‌ জীবন, দেখি না কী বলে। তারপর না হয় ওই বটতলায় নিয়ে গিয়ে দু’ঘা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যাবে।’ তারপরে চোরটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কই হে, বলো কী বলবে।’
চোর যা বলল, তার সারমর্ম এই, তার নাম ভূতেশ্বর মণ্ডল ওরফে ভুতো। নদীর পাড়ে বুড়োশিব মন্দিরের পাশে যে জায়গাটা এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, সেখানে ছিল তার পূর্বপুরুষের বাস। তার ঠাকুর্দা ছিলেন জটিলেশ্বর মণ্ডল— এই গ্রামের নামকরা চোর। যাকে একডাকে সকলে জটা চোর বলে চিনত। রাঘববাবুও শৈশবে জটা চোরের কীর্তিকলাপের কথা শুনেছেন। গ্রামের পাঁচজনের বাড়ি থেকে কলাটা–মুলোটা চুরি করত জটা। তাতে অবশ্য কোতলপুরের কেউ বিশেষ বিব্রত ছিল না। সেকালে সব গ্রামেই দু’–একটা করে পেশাদার চোর থাকত। তারা চুরিও করত। ধরা পড়লে দু’একটা কানমলা, চড়চাপড় দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো। জটাও সেই স্তরেরই চোর ছিল। তবে হঠাৎ একদিন গ্রাম ছেড়ে রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। তাকে আর দেখা যায়নি। জটা আসলে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। সেখানে গিয়েই ডেরা বাঁধে। প্রথমে এক উঠতি বাবুর বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটেছিল কদিন তারপরে বুদ্ধিবলে ধীরে ধীরে শেষ জীবনে দু’পয়সা কামিয়ে ভদ্রসমাজে জাঁকিয়ে বসে। জটেশ্বরের ছেলে ঘণ্টেশ্বর বটুকেশ্বর অবশ্য অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। জুয়ো, ঘোড়ারোগ আরও নানারকম বদস্বভাবে বাপ যে সামান্য টাকা পয়সা জমিয়েছিল, সেগুলো খুইয়ে ফের বেলেঘাটার এক বস্তিতে এসে ওঠে বটুকেশ্বর। ভূতেশ্বর মানে ভুতোরও বড় হয়ে ওঠা ওই বস্তিতেই। তারপরে দিন চারেক হল সে এই গ্রামে চলে এসেছে।
সব শুনে টুনে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন রাঘব। বললেন, ‘তা এখন তুমি কী চাও হে ভুতো?’ হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড় করে ভুতো বলল, ‘আজ্ঞে, হুজুরের যদি অনুমতি হয়, তাহলে এই গ্রামেই ফের ডেরা বাঁধি। বাপ–পিত্‌মোর বসতবাড়িটাই সাফসুতরো করে নিই।’
একেবারে হাহা করে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল শিবু ডাক্তার। বলল, ‘ভুলেও এই কাজটি করতে যাবেন না হুজুর। এই জটা চোরের নাতি ঠাকুরদার গুণ পেয়েছে। এই গ্রামে থাকলে আমাদের তিষ্ঠোতে দেবে না। সব চুরি করে ফাঁক করে দেবে।’
চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়ালেন রাঘব। গম্ভীর গলায় ভুতোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার মতলবটা কী? ঝেড়ে কাশো দেখি। পূর্বপুরুষের ভিটেয় থাকার জন্য এমনি এমনি তুমি কলকাতা ছেড়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসোনি।’
ভুতো চোখ গোলগোল করে বলল, ‘সত্যি কথা বললে বিশ্বাস করবেন না স্যার। ভাববেন গুল মারছি।’
জীবন দারোগা ভুতোর পেটে রুল দিয়ে একটা খোঁচা মেরে ধমকের সুরে বলল, ‘হুজুরের সামনে সব কথা খুলে বল। না হলে...’
রাঘববাবুর ততক্ষণে হালকা কৌতূহল জেগেছে। হাত তুলে জীবন দারোগাকে থামিয়ে বললেন, ‘আঃ জীবন... তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি। দাঁড়াও, আগে ও কী বলে শুনে নিই। কই হে বলো দেখি ভুতো।’
ভুতো বলতে শুরু করল, ‘আজ্ঞে পাড়ার একটা পাঁউরুটির কারখানায় কাজ করতাম আমি। তা আপনাদের আশীর্বাদে কষ্টেসৃষ্টে দিন কেটে যাচ্ছিল। দিন কয়েক আগে বুঝলেন, জটা মণ্ডল আমাকে স্বপ্ন দিলেন।’
চোখ কুঁচকে রাঘববাবু বললেন, ‘স্বপ্ন দিলেন মানে?’
—‘আজ্ঞে স্বপ্নে এলেন। সে কী কান্না! হাপুস নয়নে কাঁদছেন, আর বলছেন ভুতো রে, বংশের মানসম্মান কি কিছু রাখবি না? আমি যেই বললাম কেন দাদু, কী হয়েছে? অমনি উনি বললেন, তুই কোন বংশের ছেলে জানিস? তোর ঠাকুরদা, ঠাকুরদার ঠাকুরদা সব যে নাম করা চোর ছিল রে। জমিদার গিন্নিকে পেন্নাম ঠোকার অছিলায় পায়ের মল খুলে নিতাম একঘর লোকের সামনে কেউ টেরটি পেতো না। আর সেই বংশের ছেলে হয়ে কি না তুই পাঁউরুটির কারখানায়...’ এই অবধি বলেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগল ভুতো।
ভূতপ্রেতে যে একেবারে বিশ্বাস নেই রাঘববাবুর, তা নয়। তবে এ ছোকরা যে হাজতবাস এড়ানোর জন্য ডাঁহা মিথ্যে বলছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি। দিনে দুপুরে এরকম গাঁজাখুরি গল্প শুনে হাসিই পাচ্ছিল তাঁর। কোনও মতে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘বটে? তোমার ঠাকুরদা স্বপ্নে এসে বললেন যাও কোতলপুরে ফিরে যাও আর বাপঠাকুরদার মতো চুরি করো, আর তুমিও সুড়সুড় করে চলে এলে?’
দু’হাত জোড় করে হাঁউমাউ করে উঠল ভুতো, ‘বিশ্বাস করুন হুজুর, গ্রামে আসতে চাইনি। বাপরে কী মশা এখানে। সাইজে চড়ুইপাখিকেও হার মানাবে। কিন্তু ওই... প্রথমে স্বপ্নে আসত, তারপরে দেখা দিতে শুরু করল।’
—‘দেখা দিতে মানে?’
—‘না হলে আর বলছি কী? যেই রাতে শুই, তক্তপোশের পাশে এসে বসে। নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। বলে, অন্তত মাসখানেক থেকে আয় বাবা। অল্প কিছু হলেও চুরি করে দেখা। আমার আত্মাটা শান্তি পাক। আমিও বারবার বলতাম, চুরি ফুরি আমি করতে পারব না। লোকে ধরতে পারলে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবে। আর উনি খালি বলতেন, কোতলপুরে যা বাবা। ওখানে জমিদারবংশের মন খুব বড়। চুরি করে ধরা পড়লে দু’–একটা চড় চাপড় দেবে হয়তো, তারপরে কান মুলে দিয়ে বলবে, যা আর চুরি করিস না।’
এবার আর হাসি চাপতে পারলেন না রাঘববাবু। ছোকরার গল্প বলার কায়দাটা জব্বর। বললেন, ‘তা, রোজ রাতে যে ভূত দেখতে, ভয় পেতে না?’
—‘তা আর পেতাম না? দাঁতে দাঁত লেগে মুচ্ছো যাই আর কী। তবে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই তো পরশু রাতেও এলেন। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে বাবা। আমার নাম রেখেছিস এতদিনে। বাপ্‌স কী ঠান্ডা হাত।’ 
রাঘববাবুর মন আনচান করছিল। কারণ রান্নাঘরের দিক থেকে এবার লুচির গন্ধ গোটা দালানে ম–ম করছে। বেশ ক্ষিদেও পাচ্ছিল। এই গুলবাজ ছোকরার পিছনে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। রাঘব উঠে দাঁড়ালেন। তারপরে বাড়ির ভিতরে হেঁটে যাওয়ার আগে জীবন দারোগাকে বললেন, ‘একে হাজতে নিয়ে যাও জীবন। একটু উত্তম–মধ্যম দাও। তারপরে কাল সকালে ছেড়ে দিও। আমি উঠি, এখন আমার বিস্তর কাজ আছে।’ কাজ বলতে যে লুচি খাওয়া, সেটা আর ভাঙলেন না তিনি‌।
*******************************************************
রাতে খাওয়া দাওয়া করার পরে ছাদে হেঁটে বেড়ানো রাঘব বাবুর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তাতে খাবার হজম হয় ভাল। ঘড়ি কাঁটা ধরে ন’টায় খেয়ে নেন তিনি। তারপরে ছাদে পায়চারি করেন তিনি। রান্না ভাল হলে দিল তরিবৎ হয়ে থাকে রাঘরবাবুর। তখন গানও করেন গুনগুন করেন তিনি। আজ যেমন রাঘববাবুর মন ভাল হয়ে আছে গিন্নির হাতের লাউচিংড়িটা খেয়ে। রাঘববাবু নিজে খাদ্যরসিক। ভাল রান্নার কদর করতে জানেন। খেতে বসেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন গিন্নিকে। গুনগুন করে গান গাইছিলেন রাঘববাবু। ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ, উঠিল বিশ্বে সে কি কলরব, সে কি মা ভক্তি, সেকি মা হর্ষ’— এই দুটো লাইনই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছিলেন তিনি। কারণ বাকিটা তিনি ভুলে গিয়েছেন। চতুর্থবার ‘সেকি মা হর্ষ’ গাইতে গিয়ে থমকে যেতে হল রাঘববাবুকে। কারণ তাঁর বাড়িতে চোর ঢুকেছে। তাও একটা নয়, দুটো। ছাদের কোণে দুটো ছায়ামূর্তি স্থির হয় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্যটা যে কী, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একজনের হাতে আবার একটা লাঠি। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললেন রাঘব। তিনি যে ভয় পেয়েছেন, সেটা বুঝতে দেওয়া চলবে না। তাহলে মাথায় ওই লাঠির বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে সব হাতিয়ে নিয়ে যাবে লোক দুটো। বরং চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করা যাক। তাতে যদি চম্পট দেয় চোররা। গলা খাঁকরে বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাই, কে ওখানে? কে? কী চাই?’ লোক দুটো এবার এগিয়ে এল। তবে হেঁটে নয় ভেসে! যেন মাটিতে পা পড়ছে না। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দুটোর মধ্যে একটা লোক রাঘবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা ঠক করে ছাদের মাটিতে ঠুকল। তারপরে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘হারামজাদা, দিনে দিনে একটা অপদার্থ তৈরি হয়েছো।’ রাঘব একটা কড়া উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু থমকে গেলেন লোকটার সাজপোশাক দেখে। এতক্ষণে রাঘব লক্ষ্য করেছেন যেটাকে তিনি লাঠি বলে ভুল করেছিলেন সেটা আসলে লাঠি নয়, ছড়ি। আগেকার দিনের বাবুদের যেমন থাকত। লোকটার সাজপোশাকও সেই বাবুদের মতোই। গায়ে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, চুনোট করা ফিনফিনে ধুতি, চোখে গোল কাঁচের চশমা। পাশের লোকটার গায়ে একটা ফতুয়া আর খেটো ধুতি। এবার রাঘবের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যা ঘটছে সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এবার ফের চাপা গলায় ধমকে উঠল লোকটা, ‘বলি, গুরুজনদের দেখলে পেন্নাম টেন্নাম করার অভ্যাসটা বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছো?’ রাঘর যে শেষ কবে কাউকে প্রণাম করেছিলেন, তা তাঁর মনে পড়ে না। কিন্তু গুরুজন কথাটায় কেমন যেন খটকা লাগল তাঁর। বুক ধুকপুক নিয়েই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আপনি? আজ্ঞে আমি ঠিক চিনতে...’ লোকটা এবার ফের দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, ‘তা পারবে কী করে, সায়েব আর্টিস্ট দিয়ে যে অয়েল পেন্টিংগুলো আঁকিয়েছিলুম, সেগুলো সব তো আমার ছেলে, মানে তোমার ঠাকুরদা গুদামঘরে বাক্সবন্দী করে ফেলে রেখেছিল। তুমি বা তোমার বাপ সেগুলো কস্মিনকালে সেগুলো খুলে দেখার দরকার মনে করোনি। যাই হোক, আমি রাধাবিনোদ চৌধুরী। তোমার বাপের ঠাকুরদা। যে বছর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি সরল, সে বছরই ফৌত হয়েছি। কালাজ্বর হয়েছিল। যাক সেকথা, নাও এবার পেন্নাম করো।’
রাঘব যে এখনও অজ্ঞান হননি, সেটা ভেবে তাঁর নিজেরই আশ্চর্য লাগছিল। কোনওমতে মাথা নিচু করে প্রণামের ভঙ্গি করে কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, ‘আজ্ঞে বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি।’
মুখঝামটা দিয়ে রাধাবিনোদ (কিংবা তার ভূত) বললেন, ‘তুমি সেদিনের ছোকরা তুমি আর কী সেবা করবে হে?’ তারপরে লাঠি শুদ্ধু হাতটা পাশের লোকটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘বরং দেখো তো এর কী সমস্যা। কিছু করা যায় কিনা।’
পাশের লোকটা (কিংবা লোকটার ভূতটা) এতক্ষণ চুপ করে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে হাত জোড় করে বলতে শুরু করল, ‘পেন্নাম হই ছোটকত্তা। আপনি আমাকেও চিনবেন না। আমার নাম জটেশ্বর মণ্ডল। কত্তা মানে জমিদারবাবু আরকী আমাকে ভালবেসে জটা বলে ডাকতেন। আপনার বাবাও আমাকে চিনতেন।’
এবার ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে রাঘববাবুর কাছে। সকালে ভুতো তাহলে মিথ্যে বলেনি। জটার ভূত তো আছেই, কোথা থেকে সে যেন আবার ডেকে এনেছে তাঁর পূর্বপুরুষ রাধাবিনোদের ভূতকেও।
এদিকে জটা চোরের ভূত বলেই চলেছে, ‘আজ্ঞে বেঁচে থাকতে আমার একটু হাতটানের দোষ ছিল। চুরিটাই আমাদের বংশপরম্পরায় পেশা। এদিকে সেই বংশের ছেলে হয়ে আমার নাতিটা যখন পাঁউরুটির কারখানায় কাজ করতে শুরু করল, তখন দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ছোটকত্তা।’
এবার রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘সেই কারণেই ও ওর নাতিকে এখানে পাঠায়। আর তুমি এতো বড় ইস্টুপিড, তাকে কিনা পুলিসের হাতে তুলে দিলে! হাজতে আড়ং ধোলাই খাওয়ালে।’
রাঘব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলেন না। চোরকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাতে অন্যায়ের কী হয়েছে। সেকথা মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করতেই দাঁত খিঁচিয়ে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘অ্যাঃ বড় আমার হাকিমসায়েব এলেন রে। বলি, আমার গাঁয়ের চোর, সে গাঁয়েরই দু’–পাঁচটা বাড়িতে চুরি করবে না তো কি কলকেতা যাবে চুরি করতে? আর তুমিও বলিহারি বাপু, নিজে একটা শাস্তির বিধান করতে পারলে না, পুলিসে দিতে হল? হায় হায় হায় এই চৌধুরী বংশের মান–ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে গেল।
এতক্ষণে রাঘব এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে এই দুই ভূত তাঁর ঘাড় মটকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। তাই মনে একটু সাহস এনে গলা খাঁকরে রাধাবিনোদের ভূতকে বললেন, ‘ইয়ে, আমার কী করা উচিত ছিল? মানে আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?’
উত্তরটা এল জটা চোরের কাছ থেকে, ‘জানেন ছোটকত্তা আমার চুরিতেও এ গাঁয়ের লোক অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। শেষটায় জমিদার বাবু বললেন, জটা তুই আমার বাড়িতে থাকবি। বাগানে কোদাল চালাবি, কুয়ো থেকে জল তুলবি, দু’বেলা ভালমন্দ খাবি। চুরি যদি আর করতে শুনেছি, তাকে চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেবো।’
গোঁফে তা দিতে দিতে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘যতদিন আমার বাড়িতে ছিল জটা কিন্তু আর চুরি করেনি। শেষটা একদিন কেঁদে পড়ে বলল, জমিদারবাবু আমাকে ছুটি দিন। চুরি না করলে মনে শান্তি পাচ্ছি না। তবে চিন্তা নেই আমি গাঁয়ের লোককে জ্বালাবো না। আমি কলকাতা চলে যাচ্ছি ওখানে চুরি করব। চোর হয় যদি চুরি না করি তাহলে আমার ধর্মনাশ হবে। কী আর করি ছেড়ে দিলাম ওকে।’
রাঘব থতমতো খেয়ে বললেন, ‘তাহলে আমি কী করব এখন?’
রাধাবিনোদের ভূত মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘ন্যাকাষষ্ঠী! তাও বলে দিতে হবে। কাল সকাল হতে না হতেই থানায় যাবে। ভুতোকে ছাড়াবে। তাকে বাড়ির কাজে রাখবে। চিন্তা নেই ভুতো যাতে খুব বেশিদিন চুরি না করতে পারে সেটা আমি দেখে নেবো। কিন্তু রাধাবিনোদ চৌধুরীর বংশধর হয়ে তুমি বিচারের ভার পুলিসের হাতে ছাড়বে আর আমার প্রজার বংশধরকে তুমি থাকতে পুলিসের পেয়াদা শাসন করবে — এ আমি মেনে নেবো না। এ আমাদের বংশমর্যাদা মাটি করার পক্ষে যথেষ্ট হে। দেখো জটাকে যেন আমার কাছে এসে তোমার নামে আর নালিশ না জানাতে হয়।’
—‘কিন্তু ভুতো যদি ফের চুরি করে?’
রাধাবিনোদের ভূত হাত তুলে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘বললাম তো খুব বেশি দিন করবে না। শুধু ওকে ভালমন্দ খাইয়ো। পেট ভরা থাকলে আর চুরি করবে না।’
কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘যে আজ্ঞে’ বলে মাথা তোলার পরে রাঘববাবু দেখলেন, দুই ভূতই বিদায় নিয়েছেন।
*********************************************************
পরদিন সকালে থানায় গিয়ে ভুতো যখন ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন রাঘব তখন বাড়ি অবধি সঙ্গে এল জীবন দারোগ। বারবারই ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘আপনার দয়ার শরীর, তাই আপনি এই হতচ্ছাড়া বিটলে ফাজিল চোরটাকে বাড়িতে এনে রাখছেন। তবে কাজটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না। দেখবেন, ও এবার আপনার ঘরেই সব সাফ করে দেবে, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।’ সেকথা রাঘববাবু গায়ে মাখলেন না। গিন্নিও খুঁতখুঁত করতে লাগলেন বটে।‌ ঘরের মধ্যে দাগী চোরকে পোষা তো কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু কাল রাতে কী ঘটেছে, সেকথা তো আর গিন্নিকে বলা যায় না। তাই ফাইফরমাশ খাটার কাজে ভুতো বহাল হয়ে গেল। দালান ঝাঁট দেয়। জল তোলে— আরও নানা কাজ মুখ বুজে করে চলে সে। 
এদিকে জীবন দারোগার আশঙ্কা যে মিথ্যে নয়, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল দিন তিনেকের মধ্যেই। প্রথমে খোয়া গেল খান তিনেক একশো টাকার নোট। তারপরে রাঘববাবুর গিন্নির একটা রুপোর বাটি। এভাবে টুকটাক জিনিস ক্রমশ হাওয়া হতে লাগল। মাস দেড়েক পরে শিবু ডাক্তারের বাড়ি থেকেও চুরি হল। রাঘববাবু জানেন কে চুরি করছে। কিন্তু রাধাবিনোদের ভূত যা আদেশ করে গিয়েছে, তা অমান্য করা সাহস তাঁর নেই। ভুতোকে ডেকে যে তিনি জেরা করেননি এমন নয়। কিন্তু চুরির কথা অম্লানবদনে অস্বীকার করে গেল সে। অসহায় লাগছিল রাঘববাবুর। ভুতোকে উত্তম–মধ্যম দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়ানোর কথা যে ভাবেননি, তা নয়। কিন্তু যখনই ভেবেছেন, তখনই রাধাবিনোদের ভূত এসে হাজির হয়েছে। রহস্যজনক ভাবে একচোখ টিপে হাসিমুখে বলেছে, ‘খাইয়ে যাও হে, ভুতোকে পেট পুরে খাওয়া যাও। পেটে খিদে না থাকলে মানুষ সৎপথে থাকে। হৃদয় জেতার চাবিকাঠি হল রসনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাঘববাবু অবাকই হয়েছেন। একটা চোরকে বাড়িতে পুষে রেখে পেটপুরে খাওয়ানোর কী যুক্তি, সেটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না তাঁর। তবু পূর্বপুরুষের আদেশ বলে কথা। রোজই ভালমন্দ খাইয়ে চলেন ভুতোকে। আর কিছু খেতেও পারে ছেলেটা। লুচি খায় তো দু’দিস্তে। ভাত খায় তো এক হাঁড়ি। এই সেদিন রসগোল্লা আনতে দিয়েছিলেন, এক জায়গায় বসে চল্লিশটা মেরে দিল টপাটপ। আবার খাওয়া শেষ করে মুখ ধুতে ধুতে বলে কী, ‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো। আসলে বড় টানাটানির মধ্যে এতদিন কেটেছে, এসব খাবার তো আগে পাইনি।’ রাঘববাবু দাঁত কিড়মিড় করে বলেন, ‘এখন তো পাচ্ছো, তা বলি কী, চুরি করার অভ্যাসটা এবার ছাড়লে হয় না?’ অমনি শিশুর মতো সরল মুখ করে সুর টেনে টেনে ভুতো বলতে থাকে, ‘চুরি! কই আমি তো আর চুরি করিনি।’
ভুতোর মুখ দেখে গা–পিত্তি জ্বলে যায় রাঘববাবুর।
*****************************************************
ব্যাপারটা ঘটল শনিবার রাতে। নিতাই সামন্ত গ্রামের ধনীদের একজন। দোতলা বাড়িও আছে। মাঝরাতে প্রথমে ধপাস করে একটা চিৎকার, তারপরে কান ফাটানো বাবাগো–মাগো চিৎকার শুনে পাড়াশুদ্ধু লোক দৌড়ে এল নিতাইয়ের বাড়ির দিকে। দেখা গেল, ড্রেনপাইপের নীচে মাটিতে পড়ে আছে ভুতো। চুরির উদ্দেশে উঠছিল, হাত ফস্কে নীচে পড়ে গেছে। কোমরটা যে ভেঙেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। ধরাধরি করে সকলে নিয়ে গেল রাঘববাবুর কাছে। ডাক্তারও ডাকা হল। শিবু ডাক্তার বলে গেল, কম করে তিনমাস একাবারে নটনড়নচড়ন হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে ভুতোকে। না হলে বাকি জীবনটা হাঁটাচলা করাই মুশকিলের হয়ে যাবে। কোমরের চোট বড় বেকায়দার জিনিস কিনা! 
সকলকে বিদায় জানিয়ে ছাদে উঠে সবে একটা সিগারেট ধরাতে যাবেন রাঘববাবু এমন সময় ফস করে উদয় হল রাধাবিনোদের ভূত। হাসি হাসি মুখে বলল, ‘কেমন বুঝলে?’
গলা খাটো বলে রাঘববাবু বললেন, ‘আপনিই ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছেন ওকে, তাই না?’
জিভ কাটল রাধাবিনোদের ভূত। বলল, ‘ছি ছি, ও আমার সন্তানের মতো। ওকে কী আমি আঘাত করতে পারি?’
—‘তাহলে?’
জিভে চুকচুক শব্দ করে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘তোমার ঘটে তো কিস্যু নেই হে। এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে? মনে আছে, তোমাকে বারবার বলতাম ওকে ভাল করে খাইয়ো।’
—‘তা বলতেন বটে। ব্যাটা আমার অন্নধ্বংস করতো।’
—‘আহা রাগ করছো কেন রাঘব। এতে তো ভালই হয়েছে।’
অবাক সুরে রাঘববাবু বললেন, ‘ভাল?’
সেই রহস্যময় হাসিটা হেসে একচোখ টিপে রাধাবিনোদের ভূত বলল, ‘রোজ দু’বেলা তোমার বাড়িতে আকণ্ঠ খেয়ে খেয়ে ভুতো চেহারাটা কেমন বাগিয়েছে দেখেছো? পেটে থলথল করছে নেয়াপাতি ভুড়ি। ঘাড়ে গর্দানে টসটস করছে চর্বি। ওই মোটা চেহারায় কী আর চুরি হয় হে?’ তারপর একটু থেমে ফের বলল, ‘আচ্ছা শোনো, ছেলেটা সেরে উঠলে ওকে একটা দোকান টোকান কিছু করে দিও। পারলে মিষ্টির দোকান। সকালে কচুরি জিলিপি পাওয়া যাবে। ময়রাদের চেহারা দেখেছো তো কেমন ভুঁড়ি হয়। ভুতোর রোগা হওয়াটা পাকাপাকি ভাবে আটকে ফেলতে হবে।’
এবার আর ভয় পেয়ে নয়, হো হো করে হাসতে হাসতে রাদাবিনোদের ভূতের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম ঠুকে রাঘববাবু বললেন, ‘যে আজ্ঞে।’
5

ভূতের গল্প - অনুষ্টুপ

Posted in



ভূতের গল্প


দৃষ্টি
অনুষ্টুপ


"মাম্মা! দেখো দেখো কি পেইছি!"

মিসেস বসু মুখ তুলে হেসে ফেললেন দেখে। একটা বেশ বড় সামুদ্রিক ফেনার টুকরো। তাঁর পাশের টেবিলে আরো টুকরো টাকরা সম্পত্তির সাথে সেটা রেখে দিয়ে মেয়ে আবার দৌড়োলো বালি মাড়িয়ে। দুদিকে দুটো বিনুনী করে দিয়ে মেয়েটাকে আস্ত পুতুলের মত সুন্দর লাগছে। গোয়ার সমুদ্র যেমন নীল, তেমনি ঝকঝকে নীল আকাশ। তেমনিই হাল্কা নীল ফ্রক পুপুর গায়ে, সাদা লেসের ফ্রিল দেওয়া গলায় হাতে বুকের কাছে। খুব আনন্দ পেয়েছে আজ সারা সকাল জলে দাপিয়ে।

বিকেলের আলো পড়ে আসছে। সূর্যাস্তটা দেখে, ঘরে ফিরে যাবেন। পুপুর অল্পেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাছাড়া খায়ওনি কিছু। গিয়ে একটা চীজ স্যাণ্ডউইচ বলবেন? না হট মিল্কের গ্লাস? দেখা যাক, বুবুনদাদা যা খাবে মেয়েও সেটাই চাইবে।

"মাম্মায়ায়ায়া!"

নাচতে নাচতে আসছে। আবার কী পেল কে জানে!

মেয়ের বাবাও আসছে ছবি তোলার পালা সেরে। মিসেস দত্ত উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে।

------

আশিস আর রজতাভ সেই কলেজ লাইফ থেকে বন্ধু। একসাথে সপরিবারে ঘুরতে আসাটা মাঝে মাঝেই হয়, ফলে দুই মিসেসও যেমন বন্ধু হয়ে গেছেন, পুপু আর তার বুবুনদাদাও পিঠোপিঠি খেলার সঙ্গী। সন্ধেবেলা বাবা মায়েদের আড্ডায় বসে বড়দের গল্প শুনতে তাদের ভারি বয়েই গেছে, দুজনে লাফাতে লাফাতে পাশের হলটায় দৌড়য় খেলবে বলে।

বড় হলটা ডাইনিং এর জানলা দিয়ে পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। তবু মিসেস বসু মনে করিয়ে দেন, "একদম সামনেই থাকবে, চোখের আড়াল হবে না!"

খেলা জমেছিল খুব। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছিল দুজনে। এসির মধ্যেও ঘামে গলা পিঠ ভিজে গেছে। পুপু এমনিতেই চঞ্চল, হাতে পায়ে দুরন্ত। হাঁপাতে হাঁপাতেও তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল সে এক পায়ে।

"লুকোচুরি খেলবি?"

এখানে? খেললেই হয়। এত চেয়ার টেবিল সোফা, দরজার আড়াল...ভালই জমবে।

"তুই যা লুকো, আমি টেন কাউন্ট করে আসছি।"

বুবুন দেওয়ালের দিকে ফিরতেই পুপু ধাঁ করে দৌড়য়। এই সোফাটার পিছনে? না দেখে ফেলবে এক্ষুণি। ওদিকের দরজাটার আড়ালে...এই রে ফাইভ অবধি বলে ফেলেছে...ছোট্ ছোট্...

দরজাটা একটা করিডোরে খুলেছে। পাশে বিশেষ জায়গা নেই, দরজার পাল্লা সোজা না রাখলে তো ধরে ফেলবে....

আরে, পাশের এই দরজাটার পিছনে অনেকটা জায়গা তো! ছোট্ট অ্যান্টিরুম একটা মনে হচ্ছে। কিন্তু অন্ধকার যে...

"নাইন...টেন...কা-মিং!" বুবুনের গলা ভেসে আসতেই সুট্ করে দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ে পুপু। উত্তেজনায়, আর হাসি চাপার প্রবল চেষ্টায় কাঁপতে থাকা ছোট্ট মেয়েটার কানে মৃদু 'ক্লিক্' আওয়াজটা পৌঁছয় না।

----------

গল্পগুলো ক্রমশঃ মুচমুচে হচ্ছিল। আপাতত মিসেস দের ভাই আর ভাই-বৌয়ের ইউরোপ ট্যুরের ধারাবিবরণী হাঁ করে গিলছিলেন মিসেস বসু। পাশের টেবিলে দ্বিতীয় পেগের সাথে সাথে গল্প গিয়ে পৌঁছেছিল কমনরুমের বজ্জাতি আর থার্ড ইয়ারের কমলিকার নামে প্রচলিত জোকে।

বুবুনের ধরা গলার 'মা' ডাকটা তৃতীয় বারে শুনতে পেলেন মায়েরা। ফ্যাকাশে ভীতু মুখটা দেখেই সবাই ধড়মড় করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন; "পুপুকে পাচ্ছি না" শোনামাত্র হুলুস্থূলু পড়ে গেল।

আধ ঘন্টার মধ্যে হোটেল তোলপাড় হয়ে গেল, কিন্তু পুপুকে পাওয়া গেল না।

-------------------

দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফিকে আলো আসছে ঘরটার পিছন দিক থেকে। প্রাথমিক উত্তেজনা কমলে, চারদিকে চোখ চালায় পুপু।

দুদিকে দেওয়াল জোড়া তাক। রাশি রাশি শিশি বোতল। থরে থরে তোয়ালে ভাঁজ করে রাখা। একটা কোণায় গাদাখানেক মপার। চেনে পুপু, ওটা ওদের বাড়ির বাথরুমেও আছে। চারটে বালতি। আরো কিছু কার্ডবোর্ডের বাক্স।

মোক্ষম লুকিয়েছে! বুবুন কিছুতেই ওকে খুঁজে পাবে না। এইত্তো কতক্ষণ হয়ে গেল, সাড়াশব্দই নেই।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল না?

একা একা ভয় করছে যে পুপুর এবার! বেরিয়ে দেখবে? আচ্ছা পুরো না হোক একটু মুখ বার করে দেখে নিক?

দরজাটা কি ভারী! ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত টেনে খুলতেই পারছে না। প্রাণপণে টান দেয় পুপু। দরজা এক বিন্দুও নড়ে না।

আরো খানিকক্ষণ টানাটানি করার পর পুপু টের পায় দরজাটা ভিতর থেকে খুলবে না। ওটা লক হয়ে গেছে।

সারা গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা মাম্মা বই পড়ে শুনিয়েছিল। আজ টের পেল।

মাম্মা! মাম্মা! মাম্মা!

চীৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ। পুপু কখন যে উবু হয়ে বসে পড়েছে এক কোণায় নিজেও খেয়াল করেনি।

পাশের তাকের রাশি রাশি ফিনাইলের বোতলগুলো আবছা অন্ধকারে একদম সৈন্যের মত লাগে। যেন এক্ষুণি কেউ বলবে "আগে বাড়ো" আর তারা জয়দাদাদের বাড়ির অসভ্য কুকুরটার মত ঝাঁপিয়ে পড়বে পুপুর ওপর।

ঠেস দিয়ে রাখা মপারটা হ্যারি পটারের ঝাঁটার মত লাগছে। উড়ে আসে যদি!

ও মাম্মা! পুপুর গালে শুকনো জলের দাগ বেয়ে আবার জলের ফোঁটা গড়ায় এঁকাবেঁকা।

ঠকাস!

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার জবুথবু বসে পড়ে পুপু। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে আওয়াজটার সঙ্গে সঙ্গে। না, আওয়াজটা দরজায় হয়নি যেমন ও ভেবেছিল।

ঘরের ভিতর দিকে হয়েছে।

এখন, আরও খচমচ করে কিছু আওয়াজ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। মাগো!

মুখে দুহাত চাপা দিয়েও অস্ফুট চীৎকারটা পুরো থামাতে পারল না পুপু। ওর গায়ে মাথায় পিঠে যেগুলো এসে পড়েছে, সেগুলো সেই ফিনাইলের বোতল।

হালকা একটা আওয়াজ। একটা মৃদু আলো। একটা ভয়াবহ দানবাকৃতি চেহারা, গা মাথা ঢাকা কালো আবরণ, ঝুঁকে ওর দিকে চেয়ে আছে...

নিথর দৃষ্টিতে...

----------

বুবুন খবর দেবার আধ ঘন্টা পর দরজাটা ভেঙেছিল হোটেলের লোকজন। ছোট অ্যান্টিরুমটার এক দিকের দেওয়ালের তাক লণ্ডভণ্ড, গড়াগড়ি খাওয়া ফিনাইলের বোতল আর মপারের মধ্যে ছোট্ট পুপু অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল।

না, কোন চোট আঘাত লাগেনি। মায়ের কোলে অল্প শুশ্রূষাতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল পুপুর। ইশ্, ওই নোংরা কাদা কাদা ছাপ, কাদামাটির ডেলা পড়ে থাকা মেঝের মধ্যে মেয়েটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল! মিস্টার শিন্ডে কড়া ম্যানেজার, ডিউটিতে থাকা দেওকী আর সায়না খুব বকুনি খেয়েছিল কাজে ফাঁকি দিয়েছে বলে।

------------

ছোটবেলার এই ঘটনাটা পুপু, মানে মণিদীপার জীবনে ভয়ংকর প্রভাব রেখে গেছে। শুরুতে ছিল ভয়। বন্ধ জায়গার ভয়। একা ঘরে থাকার ভয়। লিফটে উঠতে আতঙ্ক।

তারপর ভয় পেতে পেতে কেমন বিরক্ত ধরে গেল। হয় না, সীমা পেরিয়ে গেলে?

একইসাথে অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়া আর সিনেমা দেখার নেশা চেপে বসল। তার সাথে অলৌকিকতার অবাস্তবতা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার সাহস। যুক্তি দিয়ে সব তুচ্ছ করে দেবার জেদ।

এসব নিয়ে মুখে মুখে তর্ক করে আধা জীবন কেটে গেছিল। এই মাঝবয়েসে ট্রান্সফার নিয়ে আত্মজনহীন শহর পুনে আসার পর, এরকম এক আড্ডায় বস মোহিত পাঞ্চাল খেপে উঠে বলে বসলেন, ভূতপ্রেত নেই তো তাঁর শখ করে কেনা চারতলার ফ্ল্যাট খালি ফেলে রেখে তিনি কি এমনি এমনি গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটে এত ভাড়া গুনছেন এখনো! কিছু যদি নেই তো রাত কাটাতে পারে না কেন কেউ, সব ভাড়াটেই রাত্রে উল্টাসিধা আওয়াজ শুনে ভয়ে পালায় কেন!

যুক্তি সাজাচ্ছিল মণিদীপা। বাইরের আওয়াজ কোনভাবে ঘরে আসে, কোন ফল্টি গ্যাজেট, হাওয়া চলাচলের কোন অদ্ভুত রাস্তা..

লোকটার এমনিই গোঁয়ার বদনাম আছে। তায় ভাড়া দেবার শোক উথলোচ্ছিল। দুম করে চ্যালেঞ্জ করল, মণিদীপা এক রাত ঐ ফ্ল্যাটে কাটিয়ে দেখাক।

ঝোঁকের মাথায় চ্যালেঞ্জটা নিয়েও নিয়েছিল মণিদীপা। রকেটকে সদ্য কিনেছে তখন। তাগড়া তেজী অ্যালশেসিয়ান। তাকে নিয়ে বেলাবেলি পৌঁছে গেল ফ্ল্যাটে।

ব্যাপারটাকে মণিদীপা এখনো স্রেফ লাক বলে। জানলা বন্ধ করার সময়েই একটা কাক পাল্লায় এসে বসতে যাচ্ছিল। ঝট করে হাতটা টেনে নিতে গিয়ে হাতের পাতলা রিস্টলেটটার খোঁচামুখটায় আটকে উঠে না এলে, ফ্রেম বরাবর সেঁটে আটকানো অত সরু তার চোখেও পড়ত না।

তার ধরে ধরে ছোট্ট লুকোনো স্পীকারটা, আর পাশের ফ্ল্যাটের জানলা গলে তার উৎসমুখ বার করাটা তারপর স্রেফ জলভাত হয়ে গেছিল। স্পীকারটা খুলে রেখে আরামসে এক ঘুমে রাত কাবার করে, সকালে মিস্টার পাঞ্চালকে ফোন করে ডেকে এনে, ব্যাপার দেখিয়ে বুঝিয়ে রকেটকে নিয়ে কেটে পড়েছিল মণিদীপা। ফ্ল্যাটটা বাধ্য হয়ে কম দামে বেচলেই কেনার জন্য মুখিয়ে ছিল পাশের ফ্ল্যাটের মালিক, কাজেই মোটিভ খুঁজতেও বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি।

এর ফলে, ওর বেশ একটা নামডাক হয়ে গেছিল অফিসে। সাহসী বলে। ভূত তাড়াতে পারে বলে। উদ্ভট সব আবদারও আসছিল ওর কাছে। কার মামার বাড়িতে রাতে ঢিল পড়ছে। কার গ্রামের বটগাছের নিচে রাত কাটালে নির্ঘাৎ মৃত্যু। কোথায় নাকি রাত বিরেতে আগুন জ্বলে উঠছে। ভয়ংকর হানাবাড়ি। গা হিম করে দেওয়া শ্মশান। ভুলভুুলাইয়ার মাঠ।

এমনই কপাল, রকেট আর মণিদীপার পাল্লায় পড়লেই সব গল্পের সত্যনাশ যাকে বলে। ঢিল না কচু, হাওয়ায় ছাতে গাছের ডাল লাগছে, মামাবাবুর নতুন বৌ রোজ তাতেই মুচ্ছো যাচ্ছে। ডাল কেটে দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে রান্নাবাড়ি করে বাঁচলেন। বটগাছটা তো নেহাৎ সময় নষ্ট, না ওদের না, ওরা আর অফিসের দুই ষন্ডা জনতা মিলে সেরাত গাছতলায় কাটানোয় নেশাখোর গেঁজেলগুলোর সে রাতের আড্ডা মাটি আর কী! আগুনটা যাবার দরকারও হল না, অফিসে বসেই বলে প্রমান করে দিল আলেয়া। হানাবাড়িটায় যা সাপের আখড়া দেখল চারদিকে, সেখানে মারা যাওয়া লোক দুটোকে যে সাপে কেটে থাকতেই পারে সেটা গ্রামের কেউ অস্বীকার করতে পারল না। শ্মশানটা অবশ্য যাবার সুযোগ হয়নি, তবে হাতে কম্পাস থাকলে ভুলভুলাইয়া যে ট্যাঁ ফোঁ করতে পারে না সেটা বেশ করে প্রমাণ করে এসেছে।

কেমন একটা উদ্দীপনা এসে গেছিল। এদ্দিন ধরে বাড়ী অফিস নিজের বই পড়া গান শোনার বাইরে একার জীবনে খুব একটা কিছু ছিল না। ঐ রকেটের সাথে খেলা কি মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যাওয়া। এই ঘটনাগুলো, দু বছর ধরে টুক টুক করে কেমন একটা আলাদা পরিচিতি, বাঁচার আলাদা নেশা এনে দিল। এখন মন খোঁজে কখন কোথায় আবার এমন ছুটে গিয়ে রহস্যভেদ করা যায়।

তবে ঝোঁকের মাথায় আজ রকেটকে বাদ দিয়ে আসাটা বেশ ভুল হয়েছে, মানতে বাধ্য মণিদীপা।

-----------------

এটার খবর জানলে অবশ্যই রকেটকে নিয়ে আসত। সে ভেবে তো আসেনি! এসেছিল তো টিমমেট মীনাল পাটীলের বিয়ে খেতে। মেয়েটা ওর থেকে অনেক ছোট হলেও, খুব ন্যাওটা মণিদীপার। এত করে বলেছিল, না করতে ইচ্ছে করেনি। দুই রাত্রের তো ব্যাপার , রত্নাগিরি থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে মীনালের গ্রাম । মণিদীপার প্রতিবেশী জোহান আঙ্কল কুকুর ভালবাসেন, এরকম এক দু রাত মণিদীপা অফিসের কাজে বাইরে গেলে উনি রকেটকে সুন্দর সামলে রাখেন।

কাল রাত্রে অফিস সেরে বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে। প্রচণ্ড আপ্যায়ন করেছে মীনালের বাড়ির লোকে। পরদিন বিয়ে, তা সে তো মারাঠী বিয়ে, দিনের আলো থাকতে থাকতেই অনুষ্ঠান মিটে গেছে। রাত্রে স্বাভাবিকভাবেই আর কেউ যেতে দেয় নি, কাল সকালের বাস ধরে ফিরে যাবে। গোল বাঁধালো বরবাবাজীর চালিয়াতি স্বভাব।

মীনাল স্বভাবসিদ্ধ প্রগলভতায় সব্বার সামনেই মণিদীপার কীর্তির কথা শোনাচ্ছিল। মীনালের বাড়ির লোক হয়তো আগে শুনেছে, তারা চমকায়নি। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ব্যাপারটা তাজ্জব লাগছিল, ফলে এক সময় দেখা গেল উপস্থিত মহিলামহল মণিদীপার চারদিকে গল্প শোনা আর প্রশ্ন নিয়ে এতই মত্ত, যে বর যে একা বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে সেটাও তাদের হুঁশ নেই। বরের যদি এরপর বর্বর রাগ উপস্থিত হয়েই থাকে, দোষ দেওয়া যায় কি! দুম করে সে বলে বসল এসব ঝুট, একজন বংগালী আওরতের এত সাহস হতেই পারে না।
সত্যি সাহস থাকলে করে দেখাক, নইলে সে বিশ্বাস করবেই না।

ছোকরার সাইজ মণীদীপার অর্ধেক, বলতে নেই সে চিরকালই একটু শক্তপোক্ত ভারী চেহারার। তার ডেঁপোমি দেখে মণিদীপার মাথা থেকে পা জ্বলে গেছিল। কিন্তু বিয়ের বর বলে কথা, তাই মিষ্টি করেই জানতে চাইল খালি, কী করতে হবে?

কেন, আজ রাতটা কাটিয়ে আসুক না তাদের গ্রামের ডিসুজা হাউসে। এই তো পাশেই! অত বড় একটা প্রপার্টি, সাহেবী আমলে বানানো, সে ছোটবেলায় শুনেছে বিশাল বড়লোকের বাড়ি ছিল, অনেক দোকান হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিক, তা সে মারা যেতে কিসব মামলা মকদ্দমা হয়ে টয়ে আর কেউ আসেনি পড়ে আছে, আর কেউ রাত কাটাতেও পারেনি - যে-ই যেত সে-ই গায়েব হয়ে যেত! গত বিশ বছরে আর কারো হিম্মত হয় না পা রাখতে!

মীনাল শুরুতে ফোঁস করে উঠতে গেছিল। কিন্তু ডিসুজা হাউসের নাম শোনামাত্র সেও কেমন চুপসে গেল। আর তাতেই গোঁ চেপে গেল মণিদীপার।

মীনাল ওর এত কিছু জেনেও ভরসা পাচ্ছে না? তবে তো যেতেই হয়!

লোকে বাধা দিতে চেয়েছিল। মীনালের মা তো কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বর বেচারাও অপ্রস্তুতে পড়ে গেছিল। কিন্তু সবাইকে বলে বুঝিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে, লাঠি, টর্চ, কম্বল আর খাবার জল নিয়ে, মোবাইল ফুল চার্জ করে বরযাত্রী কয়েকজনের সঙ্গে সেই অভিশপ্ত ডিসুজা হাউসে এসে হাজির হল মণিদীপা।

বাড়িটা দেখে অট্টহাস্য করতে ইচ্ছে করছিল। এটা ভূতের বাড়ি? হ্যাঁ, পরিত্যক্ত, অযত্নের আগাছা লাঞ্ছিত, নোংরা, একটু ভাঙাচোরাও। কিন্তু তাও কি রাজকীয় বাড়ি। সারিয়ে নিলে অনায়াসে একটা রিসর্ট হতে পারে।

একটা ঘর দেখেশুনে বেছে নিয়ে মণিদীপা আস্তানা গেড়ে বসল। সঙ্গী ভদ্রলোকেরা একটু তা না না না করেই বিদায় নিলেন, পোঁ পাঁ পালালেন বলাই উচিত!

তার মিনিট দশেক পর রকেটের জন্য মন কেমন করতে লাগল। বড্ড একা একা লাগছে জায়গাটায়। এসব পুরোনো বাড়িতে যেমন হয়, এলোমেলো হাওয়া বইছে ফাটল ফোকর দিয়ে। অনভিজ্ঞ লোক সেইসব আওয়াজেই নিতান্ত কাতর হয়ে পড়তে পারে।

সেই সঙ্গে রাতজাগা কোন একটা পাখির আচমকা আচমকা ক্যাঁ ক্যাঁ। প্যাঁচাই হবে।

টপ টপ টপ...

এটা আবার কি শুরু হল? জল পড়ছে কোথাও থেকে। কোন কল টল হবে। রাত্রে হয়ত জলের প্রেশার বেড়ে এতক্ষণে জল এল।

কম্বলটা পেতে শুয়ে পড়ে মণিদীপা। টর্চ আর লাঠি হাতের একদম নাগালে নিয়ে। সাপের সময় নয় এখন, কাজেই সে চিন্তা নেই। ঘরটা মোটের ওপর পরিষ্কারই ছিল, বিছে টিছেও থাকবে না। দরজাটা আধভেজা করে রেখেছে সেটা একটা চিন্তা, কিন্তু পুরো বন্ধ করে দিলে একা বন্ধ ঘরে...

ধ্যাত্তেরি! বহুকাল বাদে আবার এই চিন্তাটা এল। আসে আসলে মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে, রাত্রে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে পড়ে এখনো। রকেটের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হয়।

ঘুমে ডুবে যায় মণিদীপা। বেশ ধকল গেছে সারাদিন।

টপ টপ টপ...

আরে দূর বাবা! কলটা কেউ বন্ধ কর না!

কে আর করবে। নিজেকেই উঠতে হয়। উঠতেই টের পায় ভীষণ শীত করছে। এত ঠাণ্ডা পড়ে এখানে রাতের দিকে কে জানত! কম্বলটাই তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় অগত্যা, সঙ্গে আর কিছু নেই। এবার কি যেন? ও হ্যাঁ সেই জল পড়া। কিন্তু সে আওয়াজ তো আবার বন্ধ হয়ে গেছে! অদ্ভুত অন্ধকার হয়ে গেছে, কিচ্ছু আন্দাজ পাচ্ছে না। পা বাড়াতেই পায়ের এক ধাক্কায় টর্চটা গড়গড় করে বেড়াতে চলে গেল। ধুত্তোর!

দরজাটা এদিকেই ছিল, ওটা বোধহয় হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে, খুলে দিলে একটুও আলো আসবে না কি?

আন্দাজে আন্দাজে ঠিক তিনটে কদম এগিয়েছিল, তারপরই পায়ের নিচের মাটি একদম আচমকা নেই হয়ে যায়।

------------

হুড়মুড় করে যেখানটায় এসে পড়ল, সেটা ভাগ্যিস বাঁধানো চাতাল নয়। হাড়গোড় ভেঙে একশা হত তাহলে! ভেজা ভেজা নরম মাটি। বদ গন্ধ। লেগেছে, কিন্তু মারাত্মক নয়।

মাথার ওপর একটা অদ্ভুত ফ্যাঁশশশ আওয়াজ হয়ে অন্ধকার হয়ে গেল।

না, পুরো অন্ধকার না। হাল্কা আলো আছে। একটা জল ফুরোনো কুয়োর তলায় দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে। চারদিকে পাথরের দেওয়াল। শ্যাওলা পড়া।

দেওয়ালের গায়ে ব্যস্তভাবে হাতড়াতে থাকে ও। বড্ড বদ্ধ জায়গা। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে জলদি বেরোতে না পারলে। বুকের ধুকপুক নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে, মানে প্যানিক অ্যাটাকটা আসতে আর দেরি নেই।

উফ কী ঠাণ্ডা এখানে, কম্বলটা কষে মাথা মুড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে নেয় মণিদীপা - কেন যে পাকামি মেরে এক্ষুণি আসতে গেল! পরে রকেটকে নিয়ে এলে হত। ভাবতে ভাবতেই একজায়গায় পাথরের বদলে হাতে কাঠ ঠেকে। আলগা, ঠেলতেই ভেতর দিক ফাঁক হয়।

ওর গলে বেরোনোর পক্ষে যথেষ্ট বড় ফাঁক। জয়ত্তারা!

ভেবেছিল গলে, পা ঝুলিয়ে বসে দেখে নেবে বাইরে কী আছে। কিন্তু কিছুটা এই বদ্ধ জায়গার আতঙ্কে তাড়া করতে গিয়ে, কিছুটা ফাঁকের ধারটা পিছল থাকার ফলে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে বস্তার মত পড়ল আবার। পড়তেই একটা ধাতব লাঠি সোজা এসে ওর মাথার মধ্যিখানে আঘাত করল।

---------------

রীতিমত ব্যথা লেগেছিল। আততায়ী কে বোঝার কোন সুযোগ নেই, কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল ধারে কাছে আরও কেউ আছে।

নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে, কান খাড়া করে আরেকটা শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শুনতে শুনতেই পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল মণিদীপা। যে-ই হোক, সে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে। নইলে এমন নিখুঁত ভাবে মাথার ঠিক পিছনে মারতে পারত না। যেকোন মুহূর্তে হয়তো দেখবে একজোড়া আগুনের মতো চোখ জ্বলে উঠছে কোন অশুভ অশরীরীর।

অশরীরী না কচু! বদমাইশ কেউ হবে।

কিন্তু, একই সঙ্গে, সে ওকে ভয়ও পাচ্ছে। সেইজন্যই আচমকা আক্রমণ করে আহত করে ফেলেও, সামনে আসছে না। নিশ্চয় দূর থেকে নজর করছে। খুব আস্তে আস্তে, একটুও আওয়াজ না করে উঠে দাঁড়ায় মণিদীপা। রকেট নেই, কিন্তু ক্যারাটেটা এমনি এমনি শিখে রাখেনি তো! অন্ধকারেই, আন্দাজে কয়েক পা এগোয় আরো।

ধাক্কা খাবার কপাল আজ। এরকম আচমকা শূন্যে ঝুলন্ত কিছু আশা করেনি ও। গাছ টাছ এত অন্ধকারেও ঠাওর করা যায়। কিন্তু এটা একটা জমাট বাঁধা অন্ধকারের মত কী জানি, কাঁধে ধাক্কাটা লাগতেই দুম দাম করে কিসব ভেঙেচুরে পড়ল। আর লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই, ওর অবস্থান আততায়ীর কাছে খুব পরিষ্কার এখন। চট করে মোবাইল বার করে আলোটা ফেলে সামনে।

যা দেখে, তাতে বহুকাল আগের এক সন্ধ্যার হিমেল আতঙ্ক মণিদীপার সারা শরীর বেয়ে শুঁয়োপোকার মত চলাচল করতে থাকে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে বোমার মত ফেটে পড়তে থাকে অবর্ণনীয় আর্তনাদ।

কুয়ো থেকে বাইরে বেরোনো না - সে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট অ্যান্টিরুমের মধ্যে, ঘরটার দেওয়াল জোড়া তাক, তার ধাক্কার চোটে এপাশের তাক থেকে পড়ে যাওয়া মেঝেতে থরে থরে সাবান ফিনাইল, একটা শুয়ে থাকা মপার।

না!
হতে পারে না!
চীৎকারটা কানের মধ্যে বাজে খালি, কান ঝাঁ ঝাঁ করে, গলা দিয়ে এত্তটুকুও আওয়াজ হয় না। মন উন্মাদের মত বোঝাতে থাকে এটা স্বপ্ন, এটা হচ্ছে না...সত্যি হচ্ছে না...

কোণা থেকে একটা চাপা আওয়াজ ভেসে এল না? শকের চোটে আর কারো উপস্থিতির কথা ভুলেই গেছিল মণিদীপা। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ফেলে সেইদিকে।

মুখে দুহাত চাপা, দৃশ্যত থরথর করে কাঁপতে থাকা বছর সাতেকের মেয়েটার পরণে সাদা লেসের আকাশনীল ফ্রক, দুদিকে দুটো বিনুনি। যে চোখ দুটো একরাশ আতঙ্ক নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে, বিস্ফারিত হলেও তাদের খুব ভাল করে চেনে মণিদীপা।

আজন্ম আয়নায় এ দুটো চোখই দেখে এসেছে সে।