1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়




মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,
হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী…

উদগ্র উত্তাপে শহর উদ্‌ভ্রান্ত… তবুও বাঙালীর সাহিত্য রসবোধে টান ধরানোর সাধ্য নেই স্বয়ং প্রকৃতিরও। তাই প্রকৃতির এই ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময়েই প্রকাশিত হল ঋতবাক প্রথম বর্ষ, দশম সংখ্যা। 

এমাসেই গেল বাঙালীর অন্যতম প্রধান উৎসব, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। জন্মের ১৫৫ বছর পরেও ভদ্রলোক কি অসম্ভব প্রাসঙ্গিক আর আধুনিক, ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। 

কিন্তু একইসঙ্গে একথাও মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের যথার্থ এবং সম্পূর্ণ মূল্যায়ন বুঝি আজও হয়নি। এখন আর শুধু আলোচনা ভালো লাগে না... এবার সময় হয়েছে তাঁকে উপলব্ধি করার, জীবনের মূল্যবোধে সম্পৃক্ত করে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের নির্ঘন্ট এসেছে এবার। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি মনের আনন্দ’... এ কথা বার বার উচ্চারণ করলেই শুধু হবে না আর... এবার এই আরাম কে, শান্তি কে, আনন্দ কে সুগভীর ভাবে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততায় দ্রব করে জীবনের অনির্বচনীয় নিগূঢ় ক্রিয়ায় মিলিত করে পূর্ণতার অভিমুখে ধীরোদাত্ত গমনেই আত্মনিয়োগ করতে হবে। আর এই ভাবেই হয়তো তাঁর যথার্থ এবং সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা যাবে।

এরই মধ্যে বড় অসময়ে পরবাসে চলে গেলেন আমাদের সকলের কাছের মানুষ, সাম্প্রতিক কালের বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথাশিল্পী, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। অবিনশ্বর কেউই নন... কিন্তু তাই ব’লে এতো তাড়াতাড়ি? বাংলা সাহিত্যের যে আরো অনেক কিছু পাওয়া হল না ! ঋতবাক-এর পক্ষ থেকে বিনম্র প্রণতি সেই অমর সাহিত্যিকের উদ্দেশ্যে। 

ক’দিন আগেই ঘোষিত হয়েছে ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে দু’চার কথা না বললেই নয়। আপনারা জানেন, ঋতবাক প্রথম সংখ্যা, অর্থাৎ অগাস্ট, ২০১৪ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ পর্যন্ত প্রকাশিত সমস্ত লেখার মধ্য থেকেই নির্বাচিত হবে ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণের লেখা, কবিতার ক্ষেত্রে অবশ্য ‘এবং একুশ’ থেকেও বাছা হবে কবিতা, এমনই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই লেখা নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে এমন একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের কাছে লেখাগুলি যাবে, যিনি কোনো ভাবেই ফেসবুকের সঙ্গে জড়িত নন। তাই, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আমাদের কাউকেই চেনেন না। আর সেই কারণেই, সেখানে লেখা নির্বাচনের একমাত্র মাপদণ্ড হবে লেখার বিষয়গত এবং গুণগত মান। 

ঠিক এই জায়গাতেই আমার-আপনার দায়িত্ব শতগুণ বৃদ্ধি পায়। নিশ্চিত জানি, লেখার বিষয় নির্বাচন এবং গুণগত মান রক্ষার বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক ও যত্নবান আপনারা। প্রত্যাশা রাখি, আমার কাজকে শত-সহস্রগুণ বর্ধিত করে সুচিন্তিত, মনোজ্ঞ লেখায় ভরে উঠুক ঋতবাক-এর ই-মেইল আই.ডি। 


শুভেচ্ছান্তে
সুস্মিতা বসু সিং

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



একশো দশ বছর আগের এক সকাল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। কলকাতার যে রাস্তাটিকে অধুনা আমরা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ বা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ বলে চিনি, সেই পথের দৃশ্য। একটি মিছিল চলেছে সে পথ দিয়ে। একটু অদ্ভূত ধরনের মিছিল। যোগদানকারীদের সবার হাতে রাখী। যে যাকে পাচ্ছে, পরিয়ে দিচ্ছে। দোকানদার থেকে আরম্ভ করে পথচারী অবধি, ঘোড়ার গাড়ির মুসলমন কোচোয়ান থেকে নিয়ে নমঃশূদ্র দিনমজুর পর্যন্ত, কেউ বাদ যাচ্ছে না। 

মিছিলের সামনে হাঁটছেন শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত দীর্ঘকেশ এক শুভ্রকান্তি শালপ্রাংশু পুরুষ। তাঁর কন্ঠে আমাদের একটি অতি পরিচিত গান... ‘‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান।’’ রবীন্দ্রনাথ চলেছেন তাঁর নবরচিত গানখানি গাইতে গাইতে, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ নীতির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্বের পুরোভাগে। বস্তুত, এই রাখীবন্ধন শোভাযাত্রার পরিকল্পনাটি রবীন্দ্রনাথেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক ভাবে আলাদা করে দিয়ে ইংরেজ সরকার তার বিভাজন নীতি বাঙালির উপর আরোপ করতে চাইছে, সেই দুই সম্প্রদায়ের মৈত্রীবন্ধনকে দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টা এই আকালিক রাখীবন্ধন উৎসব।

এর মাস দুয়েক আগে কলকাতার টাউন হলে একটি বিশাল জনসমাবেশেও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই প্রথমবার তিনি সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন খোলাখুলি, এবং এমন একটি বিষয়ে, যা আজও আমাদের এবং আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশকে স্বততঃ বিব্রত করছে। ক্রান্তদর্শী কবি বুঝেছিলেন, এ সমস্যা ভারতবাসীর মনের এমন গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে, যাকে উচ্ছ্বেদ করা অতি প্রয়োজনীয় হলেও প্রায় অসম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের অসামান্য দূরদর্শীতার আরও বহু নিদর্শন আছে। ১৯৩০সালে, অর্থাৎ বলশেভিক বিপ্লবের মাত্র তেরো বছর পর লেখা রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যাপারে যে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, সেই সংশয় সত্য প্রমাণিত হয় তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচ্য নয়। এখানে আমরা উঁকি মারার চেষ্টা করবো সেই বিষয়টির অভ্যন্তরে, যার বিরূদ্ধে প্রতিবাদে সেই যুগপুরুষ সেদিন পথে নেমেছিলেন। মাপার চেষ্টা করবো তারপর থেকে কতখানি পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি, সেই দূরত্বটুকু।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ সেদিন সফল হয়েছিলো। ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়েছিলো বিভক্ত বাংলাকে পুনর্যুক্ত করতে। ১৯১১-র ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ স্বয়ং সে ঘোষণা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা যে হয়নি, আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস আজও দীর্ঘশ্বাস চেপে সে সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। ১৯৪৭-এ রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে এ দেশের ভৌগোলিক ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতো কি না, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু ঘটনা হল, স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরেও ভারতবর্ষ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিক্ষত।

যে দেশের সত্তর শতাংশ মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরোয় না, সেই দেশে যে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা থাকবে, তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আশ্চর্য এই, যে আজও এদেশের রাজনীতি সেই ধর্মোন্মাদনার উপর ভিত্তি করে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসে আছে। এখানে আজও রাজনৈতিক সম্মেলনে অন্য সম্প্রদায়ের উপর বিষোদ্গার করা হয়। মানুষকে প্ররোচনা দেওয়া হয় ধর্মস্থান আক্রমণ করার জন্য... এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে ধ্বংস করা হয় শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য! এও যে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ, তাই নিয়ে খুব বেশি দ্বন্দ্বের অবকাশ আছে কি?

প্রাকস্বাধীনতা যুগে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী বলা হতো। সেই অর্থে রাসবিহারী বসু, সুভাষ বোস থেকে শুরু করে ভগৎ সিং, বীর সাভারকর, সূর্য সেনরা সবাই সন্ত্রাসবাদী ছিলেন। কিন্তু আজকের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তাঁদের সমীকরণ করতে গেলে তাঁদের আত্মারা হয়তো ইংরিজিতে যাকে বলে ‘turning in their graves’, তাই-ই করবে।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভাবে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি জানতেন, বৃটিশ সিংহকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাড়ানো বহুদিন নির্জিত, ভগ্নমেরুদণ্ড ভারতবাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি চরমপন্থী বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন। আসলে, দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথও বোধহয় বুঝতে পারেননি যে স্বাধীন ভারত নিজেই অচিরে ধর্মীয় সন্ত্রাসের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠবে। তার জন্য কোনও বহিরাগত শক্তির প্ররোচনার প্রয়োজন হবে না।

কিন্তু এমন পরিস্থিতি হলো কেন? দেশভাগের সময়ে হওয়া দাঙ্গার পর তো প্রায় চার দশক এ আপদ ছিলো না। নব্বইয়ের দশক থেকে আবার মাথা চাড়া দিলো ধর্মোন্মাদনা। রামজন্মভূমি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাঙা হলো বাবরি মসজিদ, এবং তারপর থেকে শুরু হয়ে গেলো ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদের একের পর এক বিস্ফোরণ... আক্ষরিক অর্থে! এর কি খুব প্রয়োজন ছিলো এমনিতেই হাজারো আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষে?

রাজনীতিবিদদের কাছে হয়তো এর উত্তর আছে। আমাদের রাজনীতি ভোট আকর্ষণ করার জন্য কি কি করতে পারে, সে কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তবে ভাবার সময় বোধহয় এসেছে। ধর্মকে কি এই ভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোনও সদর্থক প্রয়োজন আছে? 

রবীন্দ্রনাথের মতে, নেই। এনিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কিছুটা মতবিরোধও ছিলো। স্বাধীন ভারতবর্ষের কোনও নির্বাচন তিনি দেখে যেতে পারেনি। কিন্তু তবু তিনি বুঝেছিলেন, অনগ্রসর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির স্বার্থও একসময় গিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে পরিণত হবে। তাই-ই হয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রদায় তোষণনীতি... আমাদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির আরেক অন্ধকার দিক।

এই ধর্মান্ধতার প্রতিকার কি? সেই চর্বিতচর্বনই আসবে আবার ঘুরে ফিরে – শিক্ষার বিস্তার, সমাজ সচেতনতার প্রসার, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু যে দেশে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মানুষও কন্যাভ্রূণ হত্যার মতন জঘন্য কাজে ব্যাপৃত হন, সেখানে এই সব ভারি ভারি কথাকে অন্তঃসারশূণ্য ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। বস্তুত, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এ দেশটা যেন বর্তমানে পশ্চাতাভিমুখে চলেছে। চারদিকে ধর্মের ধ্বজা উড়ছে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হচ্ছে আবহমান কাল ধরে চলে আসা মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর। জোরদার প্রচেষ্টা চলছে ভারতবর্ষের নাম পাল্টে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নামে নামাঙ্কিত করার...

রবীন্দ্রনাথের মতন অপরিমেয় মাপের মানুষ এযুগে আর জন্মান না। জন্মালে যে হতাশ হতেন, তাই নিয়ে বোধহয় বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে সেই সঙ্গে হয়তো প্রতিকারের চেষ্টাও করতেন। হয়তো পথে নামতেন মৈত্রীবন্ধন মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে। লিখতেন নতুন নতুন গান... 

সে সব করার সময় এখন আর কারও নেই। জীবন এখন বড় জটিল আর ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার চাপে প্রতিনিয়ত নিষ্পিষ্ট হচ্ছে মানুষের ঔচিত্যবোধ। যদি নাও হয়, তবু এক আপাত নিরাপত্তাবোধের ঘেরাটোপে মানুষের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকছে নিজের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের গণ্ডীর ভিতর। তার বাইরেটা দেখার ক্ষমতা বা আগ্রহ কোনওটাই নেই বেশির ভাগ মানুষের। আসন্ন বিপদের আঁচ পেলেও তাই খরগোশের মতন গর্তে মুখ ঢুকিয়ে থাকছি আমরা... কোনও রকমে বাকি জীবনটা নিরাপদে কাটিয়ে দেওয়ার আশায়।

ভরসা, শুধু নবীন প্রজন্মের উপর। তারা যদি একদিন রুখে উঠে বলে, নাহ! আর সহ্য করা হবে না এই সংকীর্ণতা, সেদিন হয়তো আমরাও তাদের কন্ঠে কন্ঠ মেলাবো। ততদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আকুতি জানানো যাক... ‘‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা... আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা!’’





0 comments:

1

প্রবন্ধঃ সুপ্রভাত লাহিড়ী

Posted in


প্রবন্ধ 



বিশ্বকবির আঁকা ছবি
সুপ্রভাত লাহিড়ী 


রবীন্দ্র চিত্রকলা সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করে নিলে, অর্থাত্‍ তাঁরই অঙ্কিত চিত্র সম্বন্ধে সম্যক জানতে হলে, তাঁরই বক্তব্য তুলে ধরলে এই আলোচনা ভূমিকা পর্বের পথ সুগম হয়ে যায়। চিত্রলিপির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:

People often ask me about the meaning of my pictures. I remain silent even as my pictures are. It is for them to express and not to explain. They have nothing ulterior behind their own appearance for the thoughts to explore and words to describe and if that appearance carries its ultimate worth then they remain, otherwise they are rejected and forgotten even though they may have some scientific truth or ethical justification. অর্থাত্‍: 

লোকে প্রায়ই আমার আঁকা ছবির অর্থ কী তা আমায় জিজ্ঞাসা করে। আমিও আমার ছবির ন্যায় নীরব থাকি। ব্যক্ত করাই তো ওদের কাজ, ব্যাখ্যা করা নয়। পরিষ্ফুট রূপের পিছনে কী আছে যে চিন্তা দিয়ে আবিষ্কার করতে হবে, ভাষা দিয়ে বর্ণনা করতে হবে। সেই প্রস্ফুটন যদি যথার্থরূপে বর্ণিত হয়, তবেই তো ওরা রইল, নচেত্‍ ওরা পরিত্যক্ত এবং বিস্মৃত হতে বাধ্য; যতই তার মধ্যে নিহিত থাক বিজ্ঞানের কোনো তথ্য বা সত্য অথবা নৈতিক কোনো যুক্তি অথবা নৈতিক কোনো যুক্তিযুক্ততা।

ছবি আঁকার ব্যাপারে আগ্রহ ও কৌতুহল তরুণ বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছিল। কিন্তু ছবি আঁকার ব্যাপারে তাঁর একাগ্রতা দেখা যায় প্রায় সত্তর বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সূত্র নিহিত আছে কবিতার খাতায়, বর্জিত ছত্র এবং স্তবকগুলির মধ্যে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি স্বতন্ত্র কিংবা সংযুক্তভাবে এক-একটা ছাঁদ নিয়ে গড়ে উঠেছে। শিল্পগুরু নন্দলাল বসুর ভাষায়, ‘……এখানে সেখানে আর-একটু কারিকুরি করলেই কোনোটি ফুল, কোনোটি পাখি, কোনোটা আবার অপরিচিত অদ্ভুত প্রাণী হেন সাকার শরীরী হয়ে উঠেছে-ঠিকটি না হয়ে ওঠা পর্যন্ত লেখক হিসাবে, লেখ শিল্পী হিসাবে তাঁরও কিছুতেই রেহাই নেই। ভাবের বাঙ্ময় প্রকাশ তাঁর সারা জীবনের সাধনা ও সিদ্ধি, এক্ষেত্রেও অপরিচ্ছন্ন অসম্পূর্ণতা তাঁর পক্ষে সহ্য করা কঠিন। ফলে স্বতঃ উদ্ভূত রূপের নিরুপণে ক্রমেই রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হলেন রঙ নিয়ে, তুলি নিয়ে, রীতিমত ছবি আঁকাও শুরু হয়ে গেল.....।’

নিছক কাটাকুটি করতে করতে যে সৃষ্টি তিনি করেছিলেন তা আমাদের শুধু অপার বিস্ময়েই অভিভূত করে না, সময়ে সময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর এই রূপ সৃষ্টির মাধ্যমের কথা ভাবলে!

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রসংগে স্টেলা ক্রামরিশ এর মত হল, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ছাঁদেই নিহিত ছবির অঙ্কুর। ছবির রেখা এসেছিল হাতের লেখার ছন্দ থেকে। তাঁর মনে হয়েছিল যে কোনাচে খোঁচাওয়ালা রেখাসম্পাত ছিল ইচ্ছাকৃত।

পরিতোষ সেনও মনে করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের ছবি, হাতের লেখা থেকেই উদগত হয়েছিল। তাঁর ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে এরকমই একটা সূক্ষ্ণ সম্পূর্ণতা আছে যা শ্রেষ্ঠ শিল্পকার্যে থাকে।’

স্টেলা ক্রামরিশ মনে করেছিলেন, রঙ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ খানিকটা জাপানী ছবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের ছবির রঙ গাঢ় এবং তীব্র, পক্ষান্তরে জাপানী ছবির রঙ হালকা, স্বচ্ছ এবং অনুজ্জ্বল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ও এই মত পোষণ করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের রুচি ছিল ভিন্ন। 

দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরির মতে, ‘কবির ছবিকে কোনো ট্র্যাডিশান, স্টাইল, টেকনিক ইত্যাদির সংগে তুলনা করে ভালমন্দের মানদন্ডে চড়ানো চলে না। তাঁর ছবিতে তাঁর প্রকাশভঙ্গি বিচার করতে হলে আমাদের যুগের মানুষকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। চিত্রাঙ্কনের সাংস্কারিক রীতি মেনে শিল্পকে চলতি নিয়মের আশ্রয় নিতেই হবে এমন শর্ত সুন্দরের আইনে বাঁধা নেই।’

রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে অলোচনায় প্রথম লেখেন কোঁতেম এনা এলিসাবেং ব্লাঁকো হ্যা দ’ নোয়াই। ফরাসী ভাষায় লেখা এই আলোচনা, যা বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃশ্যমান স্বপ্ন।’ উনিশশো ত্রিশের ৪মে, প্যারির তেয়াতর পিগাল-এ উদ্বোধিত রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম প্রদর্শনী পুস্তিকায় ছাপা হয়। এই আলোচনার ইংরাজী অনুবাদ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। কোঁতেম দ নোয়াই-এর এই লেখাটির সংগে শ্রীমতী আর॰এস॰মিলওয়ার্ট-এর লেখা একটি আলোচনাও ‘মডার্ন রিভিউ’ তে ছাপা হয়। ‘রুপম’ পত্রিকায় উনিশশো ত্রিশের এপ্রিল, অক্টোবর সংখ্যায় আনন্দ সংখ্যায় আনন্দ কোন্টিশ কুমার স্বামীর যে আলোচনা প্রকাশিত হয় সেটি ডিসেম্বরের ন্যুইয়ার্কে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী পুস্তিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়।

মস্কোর স্টেট ম্যুজিয়ামে কবির চিত্র প্রদর্শনীতে এত্রিয়াকোফ আর্ট গ্যালারীর অধ্যক্ষ অধ্যাপক ক্রিস্টি কবিকে স্বাগত জানিয়ে জনতার সামনে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আমরা দার্শনিক, কবি বলেই জানতাম। আর তাঁর ছবি একটা খামখেয়ালী ব্যাপার বলেই জানা ছিল। কিন্তু আজ তাঁর ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি।’

কলকাতায় উনিশশো বত্রিশে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখে ডঃ সরসীলাল সরকার একটি মনোজ্ঞ আলোচনা লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি সম্পর্কে এটিই ছিল প্রথম আলোচনা। আবার বিরূপ মন্তব্যও হয়েছিল অনেক পত্রপত্রিকায়। ‘এজরা পাউন্ড’ এবং ‘রোঁমা রোঁলা’ রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথ নাথ যে ‘রং কানা’ এটাও রোঁমা রোঁলার সেই আলোচনায় পাওয়া যায়। কোঁতেম এনা রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর বছর দশেক আগে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কাছে রহস্যবাদী সন্ন্যাসী কবি রূপেই পরিগণিত হয়েছিলেন। সেই কবির মায়াময় সুশোভন হস্ত থেকে প্রজ্বলিত ছবি তাঁকে অপার বিস্ময়ে নিমজ্জিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ছবি যেন দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রান্তসীমায়।

কুমার স্বামীর মতে, ‘এই ছবি অকৃত্রিমভাবে মৌলিক, এর অভিব্যক্তি অকৃত্রিম ও অকপট একজন প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের মধ্যে এক অসাধারণ চিরযুগের উপস্থিতি এই ছবি ঘোষণা করেছে...এতে শিশুসুলভ সরলতা আছে, ছেলেমি নেই...কবিতা তাঁকে সামাজিক মর্যাদা দিলেও তাঁর ব্যক্তিপরিচয় কবিতায় নেই।’ কুমার স্বামীর কথায় উইলিউম ব্লেইক ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই ছবি আঁকিয়ে রহস্যবাদী কবি হলেও দুজনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। ব্লেইকের বিবরণধর্মী ছবির আশ্রয় কবিতার চৌহদ্দিতে আর পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ব্যাপার উদগত হলেও কবিতাকে ছেড়ে সে রূপ নিয়েছে এক অপূর্ব সৃষ্টিতে।

স্টক হোমস এক দৈনিকের আলোচনায় বলেছিলেন যে, ‘এই চিত্রকলা দেশ, কাল, পাত্র নিরপেক্ষতায় সর্বকালের বৈচিত্রকে তুলে ধরতে উত্‍সুক...প্রচলিত কোনো শিল্পনীতির ছকেই এই ছবিকে ফেলা যাবে না। এখানে আর এক রবীন্দ্রনাথকে দেখছি যিনি আমাদের কাছে সম্পুর্ণ নূতন।....মনে হয় এই রবীন্দ্রনাথ নিজের কাছেও সম্পূর্ণ পরিচিত নন। এ যেন ঠিক আদিম কালের সমুদ্র, আবহমানকাল থেকে সূর্য ও চন্দ্র কিরণের প্রতিবিম্ব যে আপনবক্ষে বহন করে চলেছে....অথচ সেই সমুদ্রই জানে না, কী তার পরিমাপ, কী তার গভীরতা!’

রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সরসীলালকে লিখেছিলেন, ‘ছবির কথা কিছুই বুঝি নে। ও গুলো স্বপনের ঝোঁক, ওদের ঝোঁক রঙিন নৃত্য....সৃষ্টি কেন হয় তার ব্যাখ্যা অসম্ভব।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর আঁকা ছবিতে নাম দিতেন না। কেন দিতেন না, তা স্পষ্ট করেই তিনি জানিয়ে ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং দিলীপ কুমার রায়কে। অথচ রবীন্দ্রনাথের ছবির নামকরণ প্রসঙ্গে রানী চন্দ ‘সব হতে আপন’এ লিখেছেন, ‘প্রতিটি ছবির নাম চাই। সব ছবি গুরুদেবের ঘরে আনা হল। বড়দারা সবাই আছেন। এক একটি করে ছবি এনে গুরুদেবের সামনে ধরি, গুরুদেব ছবির নামকরণ করেন।’ সংশয়ের সৃষ্টি সেখানেই। কারণ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের যে চিঠি ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছিল, তাতেই পরিষ্কার ভাবে তাঁর মত উদ্ধৃত ছিল, ‘ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।’ রবীম্দ্রনাথের ছবির নামকরণ সম্পর্কিত বক্তব্য সম্বন্ধে সংশয় থেকেই যায়, কারণ রানী চন্দ্রের ‘সব হতে আপন’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে প্রকাশিত হয়েছিল। 

রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিভিন্ন আর্ট ক্রিটিকরা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এই স্বল্প পরিসরে এবং প্রতিবেদকের চিত্রকলা সম্বন্ধে সীমিত জ্ঞান নিমিত্ত, এ বিষয়ের আলোচনা আর প্রসারিত করা বোধহয় ঠিক হবে না। তবে রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে এমন একটা মৌলিকতা আছে, আছে এমন ছন্দোময় অখণ্ডতা, যা সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। আকৃষ্ট করে খ্যাতনামা চিত্রকলাবিদদেরও। তাঁর ছবির ব্যাপ্তি, গভীরতা প্রমাণ দেয় তাঁর জীবন সম্বন্ধে অতল অভিজ্ঞতাপ্রসূত গভীর জ্ঞান। তাই শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, 'অতীতের বিশদ সঞ্চয়, অন্তরের অতি গভীর 'উষ্ণতা ও তাপ' রঙে রূপে, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে....এত রঙ, এত রেখা, এত ভাব সঞ্চিত ছিল অন্তরের গুহায়, যা সাহিত্যে কুলোলো না, গানে হলো না....শেষে অগ্নিগিরির উদগীরণের মতো ছবিতেও ফুটে বের হতে হলো....। আর এই থেকে আর্টের পন্ডিতেরা কোনো আইন বের করে যে কাজে লাগাতে পারবে, আমার তা মনে হয় না।'





সংকেত সুত্র:

১)শ্রী নন্দলাল বসু- 'গুরুদেবের আঁকা ছবি(রবীন্দ্রায়ন:২য় খন্ড)

২)The meaning of Art, Rabindranath Tagore, Lalit Kala Academy, New Delhi॰

৩)Comtesse Qde Noailles 'Rabindranath Tagore's dreams made visible:

Rabindranath Tagore's Paintings: Modern Review-1930

৪)Ananda K॰ Coomaraswamy-'Drawings by Rabindranath Tagore:

Rupam, April-October,1930॰

৫)সরসীলাল সরকার; রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প; বিচিত্রা, পৌষ, ১৩৩৯।

৬) রানী চন্দ, ‘সব হতে আপন’ বিশ্বভারতী,১৩৯১।

৭) শোভন সোম, ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’-জন্মশতবর্ষ পরবর্তী আলোচনা’,

বিভাব (বিশেষ রবীন্দ্র সংখ্যা; ১৩৯৪)

৮) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর্ট প্রসংগ, বিশ্বভারতী, শ্রাবণ, ১৩৪৯।

1 comments:

0

প্রবন্ধঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in



প্রবন্ধ 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট পুরুষ চরিত্রগুলির প্রাসঙ্গিকতকা 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী



আমাদের মনে আছে, ‘জীবনস্মৃতি’তে বলা সেই মানুষটির গল্প, যে বলতো ঈশ্বরকে তার চোখের সামনে সে বিজবিজ করতে দেখে । এমনটা যে দেখে, তার নিরন্তর সামীপ্য কাউকে বিব্রত করে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট । বিব্রত হতেনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । পছন্দ হতো না তাঁর কাজ-নষ্ট করে দেওয়া সেই খ্যাপা সংসর্গ । কিন্তু আমরা জানতে পারি, কোনো একদিন দুপুরবেলায় সেই একই মানুষের আবির্ভাবে ‘সম্পূর্ণ আনন্দিত’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি । সহৃদয় অভ্যর্থনায় ডেকে নিয়েছিলেন কাছে । 


‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময় । তারে জেনে তাঁর পান়ে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি ।’ 


অচলায়তন-এ আয়তনের গুরু ও দর্ভকদের গোঁসাই, শোনপাংশুলদের দাদাঠাকুর, পঞ্চকের দাদাঠাকুর-গুরু, অচলায়তনের দেওয়াল ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে তার ভিতের উপর নতুন সৌধ গড়ে তুলতে সবাইকে কাজে লাগিয়েছেন । রক্তকরবী-তে নন্দিনীর প্রেরণায় যক্ষপুরীর রাজা ধ্বজাপূজার দিনে ‘মহাপবিত্র ধ্বজদণ্ড’ ভেঙে আরও অনেক ভাঙ্গার সঙ্গী হতে আহ্বান জানায় নন্দিনীকে। সমাজের অচলায়তন ভেঙে তার উপর নতুন শ্বেতসৌধ নির্মাণ সম্ভব কি না কিংবা দমন-পীড়ণ, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-স্বৈরাচারের প্রতীক যক্ষপূরীর ধ্বংসসাধন কবে হবে, এই প্রশ্নের চাইতে ‘ওরে মন হবেই হবে’ –এই প্রত্যয়ই মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে উদ্বুদ্ধ করে । মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তাকে দুঃসাহসী করে তোলে । তাকে পৃথিবীর সব চাইতে শক্তিধর ‘রাজ’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার শক্তি দেয় । 


‘হিন্দুয়িজম’ – এর প্রবক্তা ‘গোরা’ পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত জাতি-বর্ণ-কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন করে ভারতবর্ষকে চিনিয়েছিলেন । গোরা আইরিশ বংশজাত । খ্রিস্টান মায়ের সন্তান হয়ে পালিত হলো সংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত আনন্দময়ীর আবেষ্টনে । গোরা ব্যাপটাইজড হয়ে খ্রিষ্টান হয়নি । গোরার বলিষ্ঠ দেহ, দৃপ্ত চলন, গম্ভীর কণ্ঠ, প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং সর্বাতিক্রমী চরিত্র বাঙালীর এমনকি কোনো ভারতীয়ের সঙ্গে মেলানো মুশকিল । স্বদেশের প্রতি অন্ধভক্তি গোরার । আচরণ প্রায় মৌলবাদী । রাস্তায় ঘাটে ইংরেজদের সঙ্গে মারামারি করার জন্য মুখিয়ে থাকে । তবে সে হিংসাবাদী নয় । সে সংগঠন তৈরি করে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে দেশের অভ্যন্তর দেখতে বেরিয়ে পড়ে, জেলেও যায়, তর্ক বিতর্ক লেখালিখিও চলে সেইসাথে । স্বদেশের প্রতি অন্ধভক্তি গোরার । আচরণ প্রায় মৌলবাদী । বিনয় বোঝে, গোরা হিঁদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না । সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এক খুব বড়ো রকম করে দেখে । হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতান্ত শৌখিন প্রাণ – অল্প একটু ছোঁয়াছুঁয়িতেই তা শুকিয়ে যায়, গোরা সেটা কিছুতেই মনে করে না । গোরা দিনের পর দিন গ্রামে কাটিয়েছে । সে দেখেছে ভদ্র শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে আমাদের দেশটা কেমন । গোরা দেখেছে, পবিত্রতাকে বাইরের জিনিস করে তুলে ভারতবর্ষে অধর্ম করা হচ্ছে । উৎপাত ডেকে এনে মুসলমানকে যে-লোক পীড়ন করছে তারই ঘরে জাত থাকবে আর উৎপাত স্বীকার করে মুসলমানের ছেলেকে যে রক্ষা করছে এবং সমাজের নিন্দাও বহন করতে প্রস্তুত হয়েছে তারই ঘরে জাত নষ্ট হচ্ছে ! এসব দেখেই গোরা নাপিতের ঘরে আহার সেরে বললো, ‘আমি তোমার এখানে দু-চার দিন থাকবো ।’ নাপিত জানে গোরা সেখানে থাকলে তাদের আর রক্ষা থাকবে না । গোরা এই ভয়কেই কাপুরুষতা মনে করে । গোরাকে আমরা বলতে শুনি, ‘আমি আজ ভারতবর্ষীয় । ......এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন ।’ 


গোরা একবার পরেশবাবুকে বলে, ‘অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না । অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অন্তকে আশ্রয় করেছেন – নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায় ? যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই । বাক্যের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ ।’ গোরার মুখের এই ভাষ্যের মধ্যে এক সত্যতা, এক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে । গোরা বারবার এই কথা প্রচার করে এসেছে যে, পৃথিবীতে অনেক প্রবল জাতি একেবারে ধ্বংস হয়েছে । ভারত কেবলমাত্র সংযমেই, কেবল দৃঢ়ভাবে নিয়ম পালন করেই, এত শতাব্দীর প্রতিকুল সংঘাতেও আজ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে এসেছে । আমরা দেখি, সুচরিতাকেই যেন বিশেষভাবে সম্বোধন করে গোরা বলে, ‘একথা নিশ্চয়ই জানবেন ভারতের একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সার্থক হবে । ভারত রক্ষা পাবে । আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ, আপনি ভারতবর্ষের ভিতরে আসুন, এর সমস্ত ভালমন্দের মাঝখানেই নেবে দাঁড়ান – যদি বিকৃতি থাকে তবে ভিতর থেকে সংশোধন করে তুলুন কিন্তু একে দেখুন, বুঝুন, ভাবুন, এর দিকে মুখ ফেরান, এর সঙ্গে এক হোন ।’ গোরার কণ্ঠে আমরা শুনি, ‘আমাদের ধর্মতত্ত্বে যে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধা প্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমরা জাগ্রত করতে চাই । আমি তার মাথা হেঁট করে দেবো না, নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলবো না, এই আমার পণ ।’ চরঘোষপুরের ঘটনার ভিতর দিয়ে গোরার সমাজদর্শন আজও প্রসঙ্গ হারায় না ।


‘ডাকঘর’ নাটকের অমল বলেছিলো, বড় হয়ে সে কি করবে । বলেছিলো, ‘যা আছে সব দেখব – কেবলি দেখে বেড়াব ।’ পিসেমশাই অবাক হয়েছিলেন শুনে । বলেছিলেন, ‘শোনো একবার ! দেখবে কী ? দেখবার এত আছেই বা কী ?’ সত্যিই তো, দেখবার এত আছেই বা কী ! জীবনের ছবি বলি বা প্রকৃতির, প্রাত্যহিক অভ্যাসে তাকে তো আমরা পেয়েই চলেছি প্রতি মুহূর্তে । সে তো আমাদের অতিপরিচিত আর তাই অতিজীর্ণ । এই যে আমরা বড় রাস্তাটা ধরে প্রত্যহ যাচ্ছি কিছু মানুষজন গাছপালা এবং দোকানপসারের পাশ কাটিয়ে, সেখানে নতুন করে দেখার আর কিছু বাকী থাকে নাকি ? আবার কোনো পিসিমা যাদি জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙেন, লেজের উপর ভর দিয়ে কাঠবেড়ালি যদি কুটুস কুটুস করে খেয়ে যায় খুদগুলো, কিংবা দূরে দেখা যায় কোনো এক পাহাড়চুড়ো, বাঁশের লাঠির আগায় পুঁটুলি বেঁধে ঘটী হাতে সেই পাহাড়ের দিকে যদি চলে যেতে থাকে একজন মানুষ । এসবের মধ্যে আমরা যা যা দেখি অমলের দেখতে পাওয়াটা যে আরও একটু এগিয়ে চলে । সে দেখে, পাহাড়ের উপর থেকে কাঁধে চিঠির থলি নিয়ে লন্ঠন হাতে নেমে আসছে এক ডাক-হরকরা, নদীর ধারে জোয়ারির খেত, আখের খেত, খেতের মধ্যে ঝিঁঝিঁপোকা, লেজ দুলানো কাদাখোঁচা । ঠাকুরদা শুনে বলেছিলেন, ‘অমন নবীন চোখ তো আমার নেই তবু তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখতে পাচ্ছি ।’ চোখের এই নবীনতা শুধু বয়সেরই নবীনতা নয় । সব বয়সের মধ্যে সে-নবীনতা উদ্যত থাকতে পারে । যে-কোনো বস্তু বা ঘটনাকে যখন সময়ের প্রবাহের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে দেখতে পাই তখনই চোখের নবীনতা আসে । বর্তমানের এই মুহূর্তটাকে যদি অতীত করে ভাবি কোনো ভবিষ্যতের দিকে সরিয়ে নিয়ে তবে সে তখনই এক নতুন রূপ ধরে । তার চারপাশে তৈরি হয়ে ওঠে এক মায়ামণ্ডল । তখনই দেখা যায় একই সঙ্গে মিলে যায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ । থাকার সঙ্গে মিলে যায় না-থাকা, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় মৃত্যু ।


‘রাজা’ নাটকে ঠাকুরদা দেখেছিলেন, এমনকী সুদর্শনাও দেখেছিলেন, ‘কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, যা ঘুমের মতো, মূর্ছার মতো, মৃত্যুর মতো ।’ মনে পড়ে মৃত্যুপথযাত্রী যতীনের কথা, ‘দেখার জনিসকে দেখতে পাবার সৌভাগ্য কি কম ?’ সে বলেছিলো, ’তারই ভালো লাগার ভিতর দিয়ে এই পৃথিবীটা আমি অনেক ভোগ করেছি ।’ আবার আত্মহত্যার কিনারায় দাঁড়ানো অভিজিৎ বলেছিলো, ‘সুন্দর এই পৃথিবী । যা কিছু আমার জীবনকে মধুময় করেছে সে সমস্তকেই আজ আমি নমস্কার করি ।’ আবার মরণোদ্যত জয়সিংহ বলেছে, ‘সুন্দর জগৎ’ । মরণমাধুর্য আর জীবনসৌন্দর্যে সে একাকার করে নেয় তার অন্তিম মুহূর্তগুলিকে । যখন বুঝতে পারি প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যু, তখনই জীবনকে নিজের মুঠোর মধ্যে ধরতে ইচ্ছে করে আরও । তবে, সে-মুঠো আমার ব্যক্তিগত মুঠো নয়, সে এক আত্মগত মুঠো, সেই আত্ম, যে কেবলই আমাকে নিয়ে আসতে চায় দৈনন্দিন আমি-র বাইরে । 


ভালোবাসা দিয়ে যে শত্রুকে জয় করা যায় তলোয়ার দিয়ে নয় ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’-এ বসন্ত রায় তা জানতে পেরেছেন পাঠানের মুখে । পাঠান ঘাড় নেড়ে চোখ বুজে বসন্ত রায়কে বলে, ‘একটি বয়েৎ আছে যে, তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায় ।’ বসন্ত রায় বলে উঠলেন, ‘কী বলিলে খাঁ সাহব ? সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায় ! কী চমৎকার !’ পাঠান এসেছিলো বসন্ত রায়কে মারতে । বসন্ত রায়ের সেতার শুনে পাঠানের শত্রু থেকে মিত্র হতে বেশী দেরী হয়নি । তাই সে বলেই দিলো এখানে আসার উদ্দেশ্য, ‘হুজুর, আশ্বাস পাই তো একটা কথা বলি । আমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রজা । মহারাজ আমাকে ও আমার ভাইকে আদেশ করেন যে আপনি যখন যশোরের মুখে আসিবেন, তখন পথে আপনাকে খুন করা হয়।’


‘রাজার্ষি’ তে ঈশ্বরের পদে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে দেওয়াতেই যে আত্মতুষ্টি হয় সে কথা ফুটে ওঠে স্বয়ং রাজার মুখে । রাজা ধ্রুবের আদেশমতে একবার মাথার মুকুট খুলছেন আবার পরছেন । ধ্রুব মহারাজের এই দুর্দশা দেখে হেসে অস্থির হচ্ছে । রাজা তখন হেসে বললেন, ‘আমি অভ্যাস করিতেছি । তাঁহার আদেশে এ মুকুট যেমন সহজে পরিতে পারিয়াছি, তাঁহার আদেশে এ মুকুট তেমনি সহজে খুলিতে পারি । মুকুট পড়া শক্ত, কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা আরও কঠিন ।’


‘চোখে বালি’তে বিনোদিনীর থেকে মোহমুক্তি ঘটার পর মহেন্দ্র বুঝতে পারলেন, যাবতীয় শান্তি প্রেম এবং স্নেহ পাওয়া যায় একমাত্র নিজের বাড়িতেই । বিহারীর আশৈশব অটলনির্ভর বন্ধুত্ব তাঁর কাছে দুর্লভতম অমৃত বলে মনে হয় । বিনোদিনীর পেছনে ছুটে এতকাল তিনি যে নিজেকেই অপমানিত করে চলেছেন, ‘আমি সর্ব্বাংশেই বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তবু আজ আমি সর্বপ্রকার হীনতা ও লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া ঘৃণিত ভিক্ষুকের মতো তাহার পশ্চাতে অহোরাত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছি, এমনতরো অদ্ভুত পাগলামি কোন শয়তান আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে ।’ তারপরই মোক্ষ্যলাভের কথাটা বের হয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে, ‘যাহা যথার্থ গভীর এবং স্থায়ী, তাহার মধ্যে বিনা চেষ্টায়, বিনা বাধায় আপনাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করিয়া রাখা যায় বলিয়া তাহার গৌরব আমরা বুঝতে পারি না – যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি ।’ 


দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট চরিত্রগুলি থেকে কি পাওয়া গেল তা এবার আলোচনা করে দেখা যাক -


অচলায়তন’এর গুরু তখনকার দিনের যে সামাজিক চিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন এবং যাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন শ্বেতসৌধ নির্মান করে তুলতে বলেছেন তা আজও প্রখরভাবে বিদ্যমান এই স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তরে । আজও দেখতে পাই আমাদের এই নব্য সমাজের বহু স্তরে দমন-পীড়ন, শোষন-বঞ্চনা, অত্যাচার-স্বৈরাচার নিরন্তর ঘটে চলেছে । 


গোরা যে চোখে ভারতবর্ষকে দেখেছে তা স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । আজও ভারতের বহুস্থানে ধর্মের পবিত্রতাকে বাইরের জিনিস করে তুলে অধর্ম করা হচ্ছে । বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গোধরা কাণ্ড, ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি নানান ঘটনা আজও ঘটে চলেছে । অর্থাৎ ধর্মের নামে অধর্ম করা চলেছে প্রায় সেই সমান তালেই । শিল্প দিয়ে, জীবন দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন দেখার সেই দৃষ্টি । দেশকালের মধ্যে রেখেও সবকিছুই দেশকালের বাইরে থেকে পাওয়া যায় যাতে । 


জীবনকে তার স্বরূপের মহিমায় দেখার জন্যে আমাদের কি কবি বা ভাবুকই হতে হবে ? আমাদের সাধারণ মানুষেরও দৃষ্টির মধ্যে অমলের সেই তরুণতা বা নবীনতা কি এসে পৌঁছতে পারে না কখনোও ? পারে কিন্তু পারছে না । আর পারছে না বলেই আমরা আজ সেই দেখার চোখটাকেই হারিয়েছি যে-চোখে অমল দেখতো । আমারা সেই দেখার চোখ হারাচ্ছি শৈশব থেকেই নানান চাপে পড়ে । পড়াশোনার চাপ, আধুনিক বাবা-মায়েদের পছন্দমাফিক নিজেদের গড়ে তোলার চাপ, সামাজিক পরিকাঠামোর চাপ, শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছুর চাপে পড়েই এখনকার শিশুরা হারিয়ে বসেছে তাদের কল্পনার জগৎটাকে । তারা এই জগৎটাকে আর দেখে না অমলের মতো করে । আর এখানেই অমলের চরিত্রটি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে এবং বিরাট একটা আঘাত হানছে আমাদের এই নব্য সমাজের কচিকাঁচাদের নবীন জীবনে । তারা হয়ে উঠছে এক একটা যন্ত্রমানব । আমরা যে ‘হাজার হাজার বাস্তবে খণ্ড খণ্ড করে একটার পর আর-একটাকে দেখে চলেছি’ – সেইখানেই আমাদের ব্যর্থতা ।


‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ এর পাঠান চরিত্রটিও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে আজকের এই নব্য সভ্য সমাজে । আজ আমরা স্বেচ্ছায় ভুলেছি যে, ‘তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়’ অর্থাৎ ভালোবাসা দিয়ে শত্রুর মন জয় যে করা যায় তা আজ আর মানতে রাজী নই । তার বদলে শিখেছি ‘মারের বদলে মার’ বা ‘রক্তের বদলে রক্ত’ । আমরা শান্তি চাই না । চাই নিজেদের শক্তিশালী প্রতিপন্ন করতে । যার পরিণামে হত্যালীলা আজ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে এই পৃথিবীর বুকে । আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজী নই । 


অন্যদিকে আবার যতই সভ্যতার শিখরে উঠি না কেন ‘চোখে বালি’র মহেন্দ্র আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । আমরা আজও ‘যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি’ । মহেন্দ্রর মতোই মোহমুক্তি ঘটার পর বুঝতে পারি, যাবতীয় শান্তি প্রেম এবং স্নেহ পাওয়া যায় একমাত্র নিজের বাড়িতেই । ‘রাজার্ষি’তে মহারাজের বলা কথা - ‘মুকুট পড়া শক্ত, কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা আরও কঠিন’ – এই চিরন্তন সত্য কথাটি কোনোকালেই প্রাসঙ্গিকতা হারায় না । 


অশীতি-উত্তীর্ণ জীবনের অন্তত ষটাধিক দশকের অবিচ্ছিন্ন নিরন্তর আত্মসন্ধিৎসা, আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মপ্রকাশের সমবেত ফল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর গল্প/উপন্যাস/নাটকের পুরুষ চরিত্রগুলি থেকে তাঁর দার্শনিক মনকে ছোঁয়া যায় । পাওয়া যায় তাঁর দূরদৃষ্টির প্রগাঢ় আভাস । স্বনির্মিত সেইসব চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি যা যা বলতে চেয়েছেন তার বেশীরভাগই আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । 








0 comments:

0

প্রবন্ধঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in




প্রবন্ধ



নাচনী---একটি ব্যক্তিগত অনুসন্ধান 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


( বলে রাখা ভালো, এটি উপসংহার নয়, ভূমিকা মাত্র। এই ধরণের একটি বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান সহজসাধ্য নয়, অতি অল্প সময়ে তাঁকে জানা এবং উপলব্ধি করা এবং তাই নিয়ে লেখালেখি বড় সহজ কাজ নয়। ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং ভালবাসা থেকে বিষয়টি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। অনুসন্ধান চলছে, চলা উচিত।) 


‘জয়মদনান্তক দক্ষ মখান্তক
জয় ত্রিপুরান্তক জয় শশীধারী।।
জয় বিষাণবাদক পিশাচ পালক
নীলকন্ঠ সুরহিতকারী।।‘


ঝুমুর সম্রাট ভবপ্রীতানন্দ ওঝার একটি পদের উল্লেখ করে এবং প্রথিতযশা ঝুমুর নৃত্যশিল্পী সিন্ধুবালা দেবীকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এই রচনা শুরু করি। ঝুমুর গানের আসরও তো শুরু হয় দেব-দেবী বন্দনা দিয়েই, যেমন এই পদের মাধ্যমে ভবপ্রীতানন্দ মহেশ্বর বন্দনা করেছেন। আর ভবপ্রীতানন্দ বা সিন্ধুবালা দেবী যে ঝুমুর গানের দেব-দেবী ...একথা কেই বা না জানেন! 



আদ্যোপান্ত পুরুলিয়া প্রেমী। পুরুলিয়ার আকাশ-বাতাস, রুক্ষ পাহাড়, কাঠফাটা রোদ, ফুটিফাটা মাঠ, ভাদু-টুসু-ঝুমুর সব ভাল লাগে। ভাল লাগে সহজ, সরল মানুষগুলিকে। আর ভাল লাগে তীক্ষ্ণ-মধুর ভাষাটিও। এ যেন একযোগে তীব্র টক, ঝাল আর মিষ্টির সমাহার। ‘পুরুল্যার বিটি ’---এই ভাললাগা থেকেই জানার আগ্রহ নাচনীদের সম্বন্ধেও।


একটু বড় হয়ে ওঠার সময় বাড়িতে রেডিও, রেকর্ডে গান শুনেছি অংশুমান রায়ের গলায়- ‘ সাঁঝে ফুটে ঝিঙ্গাফুল, সকালে মলিন গো’, কিংবা ‘ দাদা তোর পায়ে পড়ি রে’ ইত্যাদি গানগুলি। জেনেছি এই গানগুলিকে বলে ঝুমুর গান। গানের সুরের তালে ঝামরী ওঠে যে নৃত্য, তাই কি ঝুমুর নৃত্য, নাকি নাচের তালে তালে ঝামরী ওঠে যে সুর তাই ঝুমুর গান? অঙ্গাঙ্গীভাবে তারা এক অপরের সঙ্গে জড়িত।


মানভূমের বাসিন্দা হবার সুবাদে ঝুমুর গানের সঙ্গে পরিচয়টুকু ছিল, কিন্তু সেভাবে গান শোনা হয়ে ওঠেনি কখনও। কারণ অবশ্যই রক্ষণশীলতা। ওসব নিম্নলোকের পাড়ায়, নিম্নমানের গান আবার শুনতে যাওয়া কি! সুতরাং কাছে থেকে বসে সে গান শোনার সৌভাগ্য হয়নি কোনদিন। তবে, বাড়িতে কাজের সাহায্যকারিণী যে মহিলা আসতেন, আমরা যাকে বলতাম ‘সত্য দিদি’, তিনি আমাদের শুনিয়ে ছিলেন অনেক ঝুমুর গান। বাড়ির পিছনে রেললাইন আর তার ওপারে মাঠ পেরিয়ে সামান্য দূরের এক গ্রাম থেকে তিনি আসতেন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন মনে হয় তালিম পেলে সত্যদিদিও একজন ভাল ঝুমুর নর্তকী হতে পারতেন, হয়ত বা গায়িকাও। ভাদু-টুসু এসব গানও গাইতেন, তার কাছেই প্রথম শুনেছি। মানভূমের কেই বা না জানেন সে গান! সত্যদিদির কাছে শোনা একটি ঝুমুর গানের কয়েকটি কলি আমার এখনো মনে আছে---- 


‘আষাঢ় মাসে আষাঢ়ি
চৈত মাসে খেসারি
এত বড় পরব গেল বিফলে
আরে, তুরা খালি বাটি বাটি
হামকো না দিলি দুটি
হামি শুধু খালি মহুল সিঝা
তু দ্যাখ ধনী, হামি কেমন সিধা
আরে, আসছ্যে আষাঢ় শেরাবণ মাস
কিনব্য গরু, করব্য চাস
তখন খাবি প্যাট ভরে
তু, যাস না বাপের ঘরে......’


সত্যদিদি কোন কোনদিন কাজের শেষে হাতে সময় থাকলে জলের খালি ঘটি, ছোট ঘড়া কিংবা অন্য কিছু মাথায় চাপিয়ে নাচ দেখাতেন। আমরা সত্যদিদির ব্যালান্সের নাচ দেখতাম। কোনদিন পরনের কাপড়খানা গাছকোমর করে বেঁধে নিয়ে গামছাটি ওড়নার মত করে মাথার ওপর দিয়ে পিঠে ফেলে নিতেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর নাচ দেখতাম। এ সবই চলত তার কাজের পরে আমাদের মায়ের আড়ালে। সত্যদিদি বলতেন লাচনী লাচ, মানে নাচনী নাচ। আসলে, সত্যদিদি ঝুমুর গানের সমঝদার ছিলেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, যেভাবে ঝুমুর গান ও গানের শিল্পীরা বায়না নিয়ে ঘুরে ঘুরে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নাচা-গানা করতে যান, এই ছবিটি প্রথম পাই তারাশঙ্করের ‘আংটি চাটূয্যের ভাই’ ছোট গল্পে, যা পরে ‘পলাতক’ নামে ছায়াছবি হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ঝুমুর গানের নাচনীদের দুঃখময় যাপনের দিকটি ফুটে ওঠে ছোট গল্প ও ছায়াছবি উভয়ের মাধ্যমেই। তারাশঙ্কর ছাড়া জীবনরসে সম্পৃক্ত এই গ্রাম্য মানুষগুলির কথা আর কেই বা বলবেন... বসন, নসুবালাকেও তো তিনিই চিনিয়েছেন! 


তারপরেও লেখা হয়েছে কিছু গল্প, দু/একটা উপন্যাস। কিছু গবেষণাও হয়েছে। সেটা কতটা নাচনীদের জীবনের দুঃখের বারমাস্যা জানার জন্য, আর কতটা তাদের বৈধ-অবৈধ প্রেমজ জীবনের আকর্ষণে, তা বলতে পারব না। সম্প্রতি একটি বই পড়েছি--রসিক, লেখক সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বলতে কি, এই বইটি পড়েই আবার নাচনী সম্বন্ধে জানার আগ্রহ দ্বিগুণ হল। এটিও একটী উপন্যাস অবশ্যই, কিন্তু বইটির মূল আকর্ষণ আমার কাছে তার ভাষা। আগাগোড়া পুরুলিয়ার কথ্য ভাষায় লেখা বইটি। আর আছে আশ্চর্য্য সেই সমাজের প্রতিচ্ছবি। অল্প একটু হলেও আছে নিশারাণী নামের আড়ালে মানভূমের বুলবুল ঝুমুর গানের প্রথিতযশা শিল্পী সিন্ধুবালা দেবীর কথা। বইটির সমালোচনা করা আমার কাজ নয়, কিন্তু ভাললাগা টুকু জানাতে দোষ কোথায়!


রচনার শুরুতেই ভবপ্রীতানন্দের পদটি ‘রসিক’ বইটি থেকেই নেওয়া। 



কাকে বলে নাচনী, তারা কারা ?



সাধারণভাবে ঝাড়খন্ড যা ছিল একসময় মানভূম, সিংভূম এবং উড়িষ্যার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এক শ্রেণীর মহিলা গায়িকা ও নৃত্যশিল্পীদের দেখা যায় যারা পুরুষ ঢোলকবাদক বা নাগরের (প্রেমিক) সঙ্গে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। এই মহিলা শিল্পীকে বলা হয় নাচনী। পুরুষ সঙ্গীটি তার প্রেমিক বা নাগর এবং অবশ্যই নাচনীর নৃত্য-গীতের শিক্ষক, যিনি ‘রসিক’ নামে পরিচিত। সম্পর্কটি গুরু-শিষ্যার, সম্পর্কটি দুই প্রেমিক-প্রেমিকার, সম্পর্কটি মনিব-রক্ষিতারও। শুধু সম্পর্কটি নয় বিবাহিত দুই নরনারীর, যদিও প্রেমজ এবং দেহজ উভয় সম্পর্কই সেখানে বর্তমান। এ এক অদ্ভুত জীবনযাপন। একদিকে চরম নারীত্বের অপমান, আর একদিকে চরম আনন্দের উপাখ্যান।


ঝুমুর গানের উৎস নিয়ে আছে নানান কিংবদন্তী। কারো কারো মতে, ঝুমুর গানের সৃষ্টি মানভূমের বিখ্যাত পঞ্চকোট রাজবাড়িতে। কোন এক পঞ্চকোট রাজের মহিষী ছিলেন রানী বসুমতী। রানী বসুমতীর নৃত্য-গীতের শিক্ষক ছিলেন সুবল নামে এক যুবক। সুবল ছিলেন রানী বসুমতীর গোপন প্রেমিক। নৃত্য-গীত শিক্ষার আড়ালে তাদের প্রেমজীবনের আকাঙ্খা, ভালবাসাই প্রকাশিত হয় এই গানগুলির মাধ্যমে। এই কিংবদন্তীর আড়ালে কতটা সত্য লুকিয়ে আছে, আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে, যা রটে তা কিছু তো বটে ! মানভূমের ঝুমুর গানের পৃষ্ঠপোষকতা যে মানুভূমের পঞ্চকোট রাজপরিবার করেছেন, এও সত্য। মানভূমের রাজসভার সভা-গায়িকা ছিলেন বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সিন্ধুবালা দেবী। এই সম্মান তো সকলের ভাগ্যে জোটে না!


ঝুমুর গান মূলতঃ প্রেমের গান। নর-নারীর প্রেমলীলা, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মূল উপজীব্য বিষয়। গানের সুর, তাল মনে আনন্দের জোয়ার আনে, দেহে হিল্লোল আসে, অজান্তেই চরণ চঞ্চল হয়ে নৃত্য ভঙ্গিমার শুরু। তাই ঝুমুর গানে গান ও নাচ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।


নানান গবেষণা থেকে উঠে আসছে যে তথ্য, তাতে পাচ্ছি যে, গৌড়ীয় নৃত্যের একটি অঙ্গ বলা যায় এই ঝুমুর নৃত্যকে। দেবদাসী নৃত্যের একটি রূপও। বাংলায় যখন বৈষ্ণব যুগের সূচনা হল এবং বৈষ্ণবীয় ভাবের প্লাবন বয়ে গেল, তখন বাংলাতেও তার প্রকাশ ঘটল। মানভূম, সিংভূম, বর্ধমান, বীরভূম ইত্যাদি অঞ্চলে দেবদাসী নৃত্যের এই রূপ পরিবর্তিত হয়ে অন্য মাত্রা পেল। কোথাও কোথাও পৃষ্ঠপোষকতা করতে লাগলেন রাজপুরুষেরা, যেমন মানভূমের পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজা অযোধ্যাপ্রসাদ সিংহদেব একজন। পুরুলিয়া অঞ্চলে এই ঝুমুর নৃত্য-গীত বিশেষ সমাদর লাভ করল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়। 


কারা হন নাচনী ?


বাস্তবে, গরীব-গুর্বো যারা অতি নিম্নসম্প্রদায়ের হাঁড়ি, ডোম, বাগদী পরিবারের অরক্ষণীয়া কন্যা, কিংবা হাত-ফিরতি মেয়ে অর্থাৎ যে মেয়ের স্বামী ঘরে নেয় না, যাদের পেটে ভাত নেই, মাথার উপরে ছাদ নেই কিংবা মা-বাপ মরা মেয়ে, তাদের কিনে আনা হয় সেইসব পরিবার থেকে। অন্ততঃ আগে তাই হত। এখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ঝুমুর গান শিল্পের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার ফলে অনেকেই আসছেন এই পেশায়। গরীব বাবা-মায়ের একটি মেয়ের বদলে পরিবারের লোকেরা পান হয়ত কিছুদিনের ভাত, কিংবা মাথার উপরে ছাদটুকু করে নিতে পারেন। আবার অনেক সময় চুরি করেও আনা হয় তাদের। তারপর চলে নৃত্যগীতের শিক্ষা। একসময় সে কিছুটা শিখলে তাকে নিয়ে বসে নাচ-গানের আসর। নাচ-গানের আকর্ষণ, দুবেলা দুমুঠো ভাত আর প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটিও। হাতে খড়ি হয় তার নাচনী হিসাবে। পাশাপাশি চলে রসিকের সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক প্রেমের সম্পর্ক। অনেকে এই জীবনে মাতৃত্বের স্বাদও লাভ করেন। আবার করেনও না। কিন্তু রসিকের সংসারটি হয়ে ওঠে তার নিজের সংসার, রসিকের সন্তানদের কাছে সে নাচনী-মা। আবার এই জীবনে এভাবেই কেউ কেউ হয়ে ওঠেন একজন সত্যিকারের গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, যা তাকে দেয় সম্মান, কিছুটা অর্থও। অনেক সময় ওস্তাদ রেখে তাঁরা নৃত্য-গীত শিক্ষাও করেন। এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসেন সিন্ধুবালা দেবীর মত গায়িকা, যাঁকে রাজদরবারে নিয়ে যান খাতির করে, সভাশিল্পী করে। সকলেই হয়ত তা হতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যারা যে মানুষটি তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন যত্ন করে নৃত্য-গীত, তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তিতে আজীবন থেকে যান সেই এক রসিকের কাছে। অনেক নাচনী আবার চলে যান অন্য কারো সন্ধানে। এক আশ্চর্য্য নিরন্তর টানাপোড়েন চলে মানুষগুলির জীবনে। 


কিন্তু নাচনীর সঙ্গে এত রকম সম্পর্ক থাকলেও রসিকের পরিবারের চোখে তার সমাদর নাচনী হিসাবেই। একজন রসিকের নাচনী থাকা যেন তার পক্ষে সম্মানের বিষয়। রসিক গৃহে তার সমাদর নাচনী হিসাবে থাকলেও সে রসিকের প্রেমিকাই, স্ত্রী নয়। রসিকের গৃহে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটলেও, এমন কি চাষের কাজ করলেও পরিবারের হেঁশেলে তার কোন অধিকার থাকে না, নেই। হেঁশেলের অন্দরে তার যাতায়াত থাকে না, সেখানে সে ছোটজাতের মেয়ে। সেই অধিকার একমাত্র রসিকের কুলের বৌ বা ভাতের বৌ, যে কিনা তার বিবাহিতা স্ত্রী। নাচনীর নৃত্য-গীতের পরিবর্তে পাওয়া অর্থও সংসারে খরচ হয়, সেখানে কোন বাধা থাকে না, বাধা থাকে না কুলের বৌ বা ভাত কাপড়ের বৌটির স্বামীটিকে অধিকারের, কিন্তু বাধা আছে হেঁশেলে। এ বড় সম্মানের জায়গা, ছোটজাতের মেয়ে নাচনীর সেখানে কোন স্থান নেই।


কোন কোন সময় স্ত্রী এবং নাচনীর সম্পর্কটি হয় দু-বোনের মত। আবার সাপে-নেউলে যে হয় না এমন কথা তো বলাই যায় না, বিশেষতঃ স্বামীর সেই মহিলার প্রতি অনুরাগের কারণে। কিন্তু সম্পর্ক যেমনই হোক, বিবাহিতা স্ত্রীটি জানেন যে রসিকের সঙ্গে নাচনীর সম্পর্কটি হল কৃষ্ণের সঙ্গে রাধিকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক না থাকলে একজন রসিকের সঙ্গীতজীবন বৃথা। স্বামী তার একজন বড় রসিক--এই ভাবনা স্ত্রীটিকেও ভাবিত করে বৈকি! নইলে নাচনীকে প্রথম দিন নিয়ে আসার পর স্বামীর ঘরে তুলে দেবার দায় বা নিয়মটুকু যে রসিকের স্ত্রীরই, সেখানে কোন জারিজুরি খাটে না। বড় অদ্ভুত নিয়ম এই সংসারের! একদিকে বুক ভাঙ্গে তো অন্যদিকে গড়ে। 


আবার এক একজন রসিক নাচনী রাখার নামে মেয়েদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণে এক পরিবারের সাতজন ভগিনীকে পরপর নাচনী রেখেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী হিসাবেও তিনি বিশেষভাবে নন্দিত ছিলেন। তাঁর নামটি উহ্যই থাক।


রসিকের সংসারে নাচনীর যত সম্মানই পান না কেন, মৃত্যুতে তার সিকিটুকুও পান না। অন্ততঃ আগে পেতেন না। একে তো নাচনীরা আসতেন বা এখনও আসেন প্রায় নিম্নসম্প্রদায় থেকে, অতিনিম্নবিত্ত পরিবার থেকে যেখানে মেয়েটিকে রসিকের হাতে তুলে দিতে পারলে কিছু অর্থের সংস্থান হত সেই পরিবারের। এমত অবস্থায় রসিকের পরিবারে পরম্পরা অনুযায়ী নাচনীর আগমন স্বাভাবিক হলেও রসিকের স্ত্রীর চোখে , বিশেষত তার সন্তানদের চোখে নাচনী বিশেষ সমাদর, ভালবাসা পান না। মায়ের সামনে অন্য এক মহিলার প্রতি পিতার অনুরাগ বা আকর্ষণ যাই হোক না কেন, সন্তানকে পীড়িত করে। তাই মৃত্যুতে নাচনীর প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন না কিংবা সেই রাগ বশতঃই দেখান না। সবার উপরে আছে দারিদ্র্য। রসিকের জীবিতকালে নাচনীর মৃত্যু হলে রসিকের কিছুটা দায় থাকে, কিন্তু অবর্তমানে তা থাকে না। নাচনীর পরিবারগুলি অর্থনৈতিক ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত, তার উপরে আছে সমাজের শুচি-অশুচির বিধান। একেবারে সমাজের নিম্নতম জাতির পরিবার থেকে আগত মহিলাদের শবানুগমন বা শবকে শ্মশানে নিয়ে যেতে রাজী হন না কেউই। গ্রামের সেই নিম্নতম পরিবারের কোন মানুষ এসে সেভাবেই ফেলে দিয়ে আসেন মৃত শব। কিন্তু এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি এবং সামান্য কিছু হলেও অর্থনৈতিক অবস্থানের বদল হওয়ার জন্য মৃত্যুর পর দাহ নিয়ে ততটা আগের মত প্রতিক্রিয়া দেখান না। যদিও, পারলৈকিক ক্রিয়া হিসাবে এই ফেলে দিয়ে আসার কোন বিধান কোনকালেই ছিল না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকেই নাচনীদের প্রতি এই অবিচার করা হয় বা হত।


এসবই জেনেছি এক ঝুমুর শিল্পীর কাছে, যিনি নিজে ঝুমুর গান করেন, ঝুমুর গানের উপরে একটি তথ্যচিত্রে ঝুমুর শিল্পী হিসেবে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর প্রতি এবং পুরুলিয়ার এক বন্ধু যিনি সেই সুযোগ করে দিয়েছেন, উভয়ের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। 


অনেকসময় ঝুমুর গানে শোনা যায় তাদের জীবনে দুঃখের বারমাস্যা। ঝুমুর গান মূলতঃ প্রেমের গান হলেও সারাজীবন সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলি তাদের দৈনন্দিন দুঃখের কথা ব্যক্ত করেন গানের মাধ্যমে। আবারো ‘রসিক’ বইটি থেকে এমনই একটি গানের পদ দিয়ে জীবনরসে সম্পৃক্ত মানুষগুলির সুখ-দুঃখ, বেদনা, মান-অপমানকে বুঝে নিতে চেষ্টা করি। রচনাটি কোন রসিকের জানা নেই, প্রচলিত হতে পারে।



বৈশাখ মাসেতে নবীন বৎসর           প্রচন্ড ঝড়ে উড়াইল ঘর
                            যায় যেন সব দলিয়া
জ্যৈষ্ঠ মাসেতে ঐ ভাঙ্গা ঘরেতে         থাকি যেন আঁখি মুদিয়া।
আষাঢ় মাসে মেঘ ডাকে              ঘন ঘন ভয়ে সদা হয় প্রাণ উচাটন
শ্রাবণেতে জল ঝরে অবিরল,       ঘর পড়ি যায় ভাঙ্গিয়া।।
ভাদ্র আশ্বিন শরৎকাল        গরিবের ঘরে নাই থাকে চাল
                    ক্ষুধানল উঠে জ্বলিয়া
পূজি অন্নপূর্ণা দেশ অন্ন শূন্যা,     হাহাকার আছে ঘেরিয়া।
কার্তিক মাসেতে ক্ষেত্রে থাকে ধান        মনে বুঝি দুখ হল অবসান
                             বাঁচিব এবার খাইয়া
অগ্রহায়ণ মাসেতে ঋণ ফাঁস এসে          ধরে গলা যেন চাপিয়া ।।
পৌষ মাসে বহে উত্তরি বায়        শীতে থর থর কাঁপে কায়
                          ক্ষণে ক্ষণে যায় টলিয়া
খাদ্যহীন হয়ে বস্ত্রহীন হয়ে জীয়ন্তে থাকি যে মরিয়া......


এ যেন ফুল্লরার বারমাস্যা। নিজ জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সাধারণ মানুষগুলির দুঃখ প্রতিফলিত হয় গানের ভাষায়। আশ্চর্য্য যাপনের অন্তরালে থাকা মানুষগুলির কষ্টকর জীবনযাপন ও প্রেমময় জীবনের সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি এই ভালবাসা দেখে বিস্ময়বোধ ও শ্রদ্ধা একই সঙ্গে না জানিয়ে তো পারি না!


তাঁরা ভাল থাকুন, সঙ্গীতময় হোক তাঁদের জীবন।

0 comments:

0

বিশেষ প্রতিবেদনঃ মনোজিৎকুমার দাস

Posted in





বিশেষ প্রতিবেদন



শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ সুচিত্রা ভট্টাচার্য 
মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের চালচিত্র অঙ্কনের নিপুন কথাশিল্পী 
মনোজিৎকুমার দাস 



সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের নর নারীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বর্তমান যুগের নীতিবোধের ক্রমোবনতি, নৈতিক অবক্ষয়, নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণার চালচিত্র বাংলা সাহিত্যে সুনিপুন ভাবে তুলে আনা কথাসাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য ( ১০ জানুয়ারি ১৯৫০- ১২ মে ২০১৫) ৬৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ১২ই মে স্থানীয় সময় রাত ১০ টা  ৪৫ মিনিটে কলকাতার ঢাকুরিয়ার নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লোকান্তরিত হলেন। 

সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিশ শতকের সত্তর দশক থেকে একুশ শতকের চলতি দশক পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বাস্তবচিত্র তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে তুলে ধরেছেন মেধা, মনন ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তিনি গত শতকের সত্তর দশক থেকে ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে উপন্যাস রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।

বাঙালি, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নর নারীর আটপৌরে জীবনের কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা ছোটগল্প ও উপন্যাসগুলিতে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল: কাছের মানুষ, দহন, কাঁচের দেওয়াল, হেমন্তের পাখি, নীলঘূর্ণি, অলীক সুখ, গভীর অসুখ, উড়ো মেঘ, ছেঁড়া তার, আলোছায়া, অন্য বসন্ত, পরবাস, পালাবার পথ নেই, আমি রাইকিশোরী, রঙিন পৃথিবী, জলছবি, যখন যুদ্ধ ভাঙ্গন কাল, আয়নামহল ইত্যাদি।

সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে- মেঘপাহাড়, সুহেলি, ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ে, দাগবসন্তি খেলা, আলোছায়া, তুতুল, ইত্যাদি।

অন্যদিকে, তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থগুলি হল: তিন মিতিন, কেরালায় কিস্তিমাত, জনাথনের বাড়ির ভূত, জার্মান গনেশ, শুধু ভূত, ইত্যাদি।

তাছাড়া তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল: অচিন পাখি, অন্য বসন্ত, আঁধারবেলা, আছি, একা জীবন, এখন হৃদয়, গহীন হৃদয়, চেনামুখ অচেনা মুখ, জলছবি, দাবানলের দেশে, ধুসর বিষাদ, নীলঘূর্ণি, পরবাস, পালাবার পথ নেই, মন্থন, মাঝরাতের অতিথি, ময়নাতদন্ত, শুধু প্রেম, শূন্য থেকে শূন্য, শেষ বেলায়, শেষ শান্তিপুর লোকাল, সময় অসময়, সর্পরহস্য সুন্দরবনে, সুখ দুঃখ, হলুদগাঁদার বনে, ইত্যাদি। 

সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে দহন উপন্যাসের জন্য কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর শাশ্বতী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ননজনাগুড়ু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৬)। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলি হলো- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার(২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার (২০০২), ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার,শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার। তার বহু উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার আগে তাঁর ব্যক্তিজীবনের উপর স্বল্পপরিসরে তুলে ধরা যেতে পারে। সুচিত্রাভট্টাচার্য ১৯৫০ সালে ১০ই জানুয়ারি ভারতের বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিত্রালয় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। পড়াশোনা কলকাতার স্কুল ও কলেজে। তিনি কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক হন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। বিভিন্ন স্থানে চাকরি করার পর তিনি সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। লেখিকা হিসেবে সম্পূ্র্ণ রূপে সময় দেওয়ার জন্য তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। 

বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিপ্রক্ষিতে বাঙালির সমাজ জীবনের নারী পুরুষদের মধ্যে যে টালমালা অবস্থার সৃষ্টিহয়ে নানা ক্ষেত্রে যে ধরনের নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয়, পরিবারে বিশেষ করে যৌথ পরিবারে নানা নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণাতাঁর রচনাগুলির মূল উপজীব্য ছিল। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি বহু ছোট গল্প ছাড়াও চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। 

সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্কুলে পড়াশোনা কাল থেকেই সাহিত্যে প্রতি অনুরক্ত হন। তিনি একবার বলেছিলেন যে ক্লাস সিক্সে পড়াকালে ‘ ফুলশয্যা ‘নামে একটি গল্প লিখে সকলকে বিস্মিত করেছিলেন। যদিও তিনি সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাসাহিত্য জগতে পুরোপুরি ভাবে সম্পৃক্ত হন। আগেই বলা হয়েছে তার লেখা গল্প ও উপন্যাসে আটপৌরে জীবনের কথা উঠেএসেছে। সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর নিজস্ব চিন্তাচেতার আলোকে শহুরে মধ্য বিত্ত নারী পুরুষের পোড় খাওয়া জীবনের কাহিনী অতি বাস্তবতার আলো চিত্রিত করেছেন বলেই গল্প ও উপন্যাস এতটা পাঠক প্রিয় হয়েছে।

সুচিত্রার লেখাতে বারবারই ঘুরে ফিরে এসেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের আত্মিক দিক ও নানা জটিলতা। নারীদের নিজস্ব জগতের যন্ত্রণা এবং সমস্যার কথাও ফুটে উঠেছে তার লেখায়। 

তার বৃহত্তম উপন্যাস ‘কাছের মানুষ’ ছিল অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ। দারুণ চরিত্রায়নের কারণে যা প্রশংসিত হয়েছিল। ‘কাছের মানুষ’ উপন্যাসটিকে তাঁর মাস্টার পিস হিসাবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলো নিয়মিত কলকাতার দেশপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

মধ্যবিত্ত বাঙালি নর নারীর জীবনের চালচিত্র অঙ্কনের নিপুন শিল্পী সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মহাপ্রয়াণে অনেক অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি লোকান্তরিত হলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম তাঁকে বাংলা সাহিত্যে চির ভাস্বর করে রাখবে।





0 comments:

0

বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত

Posted in




বিশেষ রচনা




বৈষ্ণব সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ 
শৌনক দত্ত


সুস্মি থাকতে সুস্মির কাছে লেখা খুব একটা কেউ নিতো না। ওর চলে যাবার পর ওর লেখার কদর বেড়েছে। গতকাল রবীন্দ্র জয়ন্তীতে গিয়েছিলো বাসু। এর আগে বহুবার সুস্মি আর বাসু এসেছে নন্দনে, কেউ ফিরেও তাকায়নি। অথচ কাল বাসুর কাছে এগিয়ে এসে কত চেনা অজানা মুখ কথা বলে গেছে। কেউ কুশল বিনিময় করে গেছে। কেউ কেউ তো আবার সুস্মির লেখা চেয়ে বসেছে। বাসু আজ সকাল থেকেই সুস্মির লেখা নিয়ে বসেছে। অনেক লেখার ভীড়ে রবীন্দ্রনাথ ও বৈষ্ণবসাহিত্য শিরোনামে একটি লেখা পেয়ে থামে বাসু। তারপর পড়তে থাকে। 

রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রত্যুষকাল থেকে প্রদোষকাল পর্যন্ত বৈষ্ণবপদাবলীর অনেক অবিস্মরণীয় পংক্তি ভিন্ন ভিন্ন তাত্‍পর্যে রবীন্দ্রসাহিত্যে দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে বৈষ্ণবপদাবলীর আবেদন চিরকালের এবং সেই আবেদন মূলত সাহিত্যিক। বৈষ্ণব কবিতা তাঁর মতে বৈকুন্ঠের গান নয়। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বৈষ্ণব পদাবলীর সাথে। ষোল থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মাঝেই রচিত ভানুসিংহের পদাবলী। এই কাব্য রচনার প্রেরণা সম্পর্কে বলা যায়, বৈষ্ণব কবিতার ভাষা মাধুর্য তার ছন্দের ঝংকার তার অপরূপ রসবৈচিত্র্য তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনকে একেবারে উন্মথিত করে দিয়েছিলো। প্রশ্ন জাগে কবি কেন ভানুসিংহের আড়ালে থেকে এই কাব্য লিখেছিলেন? উত্তরটি খুঁজতে রবীন্দ্রনাথের নিজের কৈফিয়ৎ পড়া যাক।

রবীন্দ্রনাথ ১২৮৬ এ ভারতী-র শ্রাবণ সংখ্যায় লিখছেনঃ 'একটি প্রাচীন ভাষায় রচিত ভালো কবিতা শুনিলে তাহারা বিশ্বাস করিতে চায় যে, তাহা কোনো প্রাচীন কবির রচিত। যদি তাহারা জানিতে পারে যে, সে সকল কবিতা একটি আধুনিক বালকের লেখা তাহা হইলে তাহারা কী নিরাশ হয়।....এইরূপ অবস্থায় একজন যশোলোলুপ কবি-বালক কি করিবে?'

সুস্মি কি যশোলোলুপ ছিলো? বাসু অতীত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুস্মিকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই সুস্মির যশোলোলুপতা খুঁজে পায় না। কিচেন থেকে ঠান্ডা কফির মগ হাতে বাসু আবার পড়ায় ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রাধা কৃষ্ণের প্রেম লৌকিক প্রেমেরই বলিষ্ঠ প্রকাশ। এই প্রেম বিশ্বব্যাপী। এই প্রেমই অধ্যাত্মশক্তির রূপক। সৌন্দর্য ও প্রেমের পূজারী। রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে প্রেমের অতল গভীরতা ও সৌন্দর্যের অসীমতা খুঁজে পেয়েছেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে বৈষ্ণব কবিতার উদ্ধৃতির সংখ্যা বৈচিত্র্য খুব বেশি নয়, প্রয়োগ বৈচিত্র্যই বিস্ময়কর। কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তার মুষ্টিমেয় কয়েকটি শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবপদের প্রসিদ্ধ অংশ বিশেষ রবীন্দ্রসাহিত্যে নানাভাবে ঘুরে ঘুরে দেখা দিয়েছে। সংখ্যায় তারা সামান্যই। কিন্তু প্রত্যেকবার একই উদ্ধৃতি নব নব বক্তব্যের তাত্‍পর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। এর ফলে উদ্ধৃতির অংশটুকু কেবল উদ্ধৃতিমাত্র না হয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের সংস্পর্শে এসে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হয়ে উঠেছে।

বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে চন্ডীদাসই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় কবি। চন্ডীদাসের পদের অব্যক্ত অর্থগৌরবের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন তাঁর 'চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি' প্রবন্ধে। চন্ডীদাসের পদের ব্যবহারও রবীন্দ্রসাহিত্যতে স্বভাবতই বেশি। কারণ চন্ডীদাসের পদের অর্থ তাত্‍পর্যের সম্ভাবনা অনেক। চন্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগ বা নিবেদনের এক একটি পদের অংশবিশেষ সেই পদের আবেষ্টনী ভেদ করে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় বিভিন্ন তাত্‍পর্যে উপস্থাপিত হয়েছে। ভানুসিংহের রাধার উক্তিতে যেখানে অভিলাষ পূরণের ইচ্ছাই প্রবল করে দেখা দেয়, কৃষ্ণই যেন রাধার আনন্দবিধানের উপায়। কৃষ্ণের আহ্লাদের তিনি কারণ হন না। "বঁধূয়া, হিয়া পেরে আওরে মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মৃদু ভাষয়ি হমার মুখ পরে চাওরে।" সেখানে চন্ডীদাসের রাধা বলে- "বহুদিন পর বঁধূয়া এলে। দেখা না হইতে পরাণ গেলে। একে সহিল অবলা বলে।" পদাবলীর রাধা প্রিয়মিলনের সময় এত কথা বলতে পেরেছেন কি? যে রাধা বঁধূয়ার দর্শনে আনন্দে মূর্ছা যান, মিলিত অবস্থায় যিনি বিরহ অনুভব করেন, এ রাধা সে রাধা নন। 

লেখা থেকে চোখ তুলে দেয়ালে তাকায় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে চোখ পড়তেই বুকটা হু হু করে উঠে তার। সুস্মির অকাল প্রয়াণকে আজো সরল ভাবে মেনে নিতে পারেনি বাসু। শিঞ্চন তাকে এখনো মানসিক রোগী হিসেবেই ট্রিট করে। অথচ কাউকে সে বলতেও পারেনা, সুস্মি কোত্থাও যায়নি। সুস্মি তার সাথেই আছে, তার পাশে।


0 comments:

1

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক




আমার বারুদ-বেলা, পর্ব ২ 
স্বপন দেব



বিদ্যাসাগর কলেজে আমার একবছর পূর্ণ হল। ১৯৬৫ সাল। জহর লাল নেহেরু মারা গেছেন এবং তাঁর শূন্যস্থানে ইন্দিরা গান্ধী আসার আগে গুলজারীলাল নন্দা এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী সাময়িক ভাবে দিল্লির মসনদে আসীন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই আবার সারা ভারতব্যাপী সরকারি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, কমিউনিষ্ট পার্টির এবং তার ছাত্র-সংগঠন গুলির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক চিনপন্থী নেতৃবৃন্দকে বাছাই করে গ্রেফতার করা শুরু হল। বিদ্যাসাগর কলেজের যে ছাত্র নেতাটির বক্তৃতা শুনে আমি এই ছাত্র-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেই ছাত্র নেতা নির্মল ব্রহ্মচারীও গ্রেফতার হলেন। বউবাজারের বিপিএসএফ সদর দফতরে আমার আনাগোনা আগের থেকে অনেক বাড়লো আর সেইসঙ্গে বাড়লো বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র- সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন এসে গেল। কলেজের সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হবেন ছাত্র সংসদের সভাপতি। আর সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মত ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটে এবং এই তিনজন কেই হতে হবে প্রথম বর্ষের ছাত্র। বিদ্যাসাগর কলেজের ক্ষেত্রে এই প্রথম বর্ষের ছাত্রকেই সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রতিযোগিতা করতে হবে বলে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময় থেকেই বিপিএসএফ এক কৌশল অবলম্বন করতো। সেটা হল, পার্টির ঘনিষ্ঠ কোন পোড় খাওয়া ছাত্র-নেতাকে অন্য কলেজে ভর্তি করিয়ে তাকে সেখানে একবছর ধরে পরিচর্যা এবং নেতৃত্বের যোগ্য করে তোলা হত। তারপরে, দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় না বসে তিনি একবছর নষ্ট করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়ে সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রতিযোগিতা করতেন। সে বছর ও তাই হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে, উত্তর পাড়ার কোন এক কলেজ থেকে প্রফুল্ল চক্রবর্তী নামে একজন এসে ভর্তি হল বিদ্যাসাগর কলেজে এবং বিপিএসএফ-এর হয়ে তিনিই নমিনেশন দাখিল করলেন সাধারণ সম্পাদক পদে। এই প্রফুল্ল চক্রবর্তীকে দেখতে এবং তার হাব-ভাব মোটেও ছাত্র-সুলভ ছিলনা। পান খেয়ে দাঁত কালো করে ফেলা আমাদের চেয়ে বয়সে বোধহয় ৫/৬ বছরের বড়ো একজন ভর্তি হলেন আমার থেকে নিচু ক্লাসে এবং এসেই আমাদের খবরদারী চালাতে লাগলেন ! চালচলন ছিল একজন কারখানার শ্রমিকের মত ! 

এই প্রফুল্ল চক্রবর্তী কিন্তু সে বছর বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন নি। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের দ্বৈত-রেজিস্ট্রেশন থাকায় তার মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। আর এই প্রফুল্ল চক্রবর্তিই পরবর্তিকালে কানোরিয়া জুটমিলের ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে যাই হোক, ৬৫ সালে ট্রাম কোম্পানি এক পয়সা ভাড়া বাড়ালো। সারা কোলকাতা জুড়ে শুরু হল ট্রামভাড়া কমানোর দাবীতে আন্দোলন। মিটিং, মিছিল, পথসভা তো ছিলই তার সঙ্গে যুক্ত হল ট্রামে আগুন দেওয়ার ঘটনা। বিদ্যাসাগর কলেজের সামনের স্টপেজে ট্রাম এসে দাঁড়ালেই সমস্ত যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ট্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। দু’দিন পরেই বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে বসে গেল পুলিস-পিকেটিং। তখন অন্য-রাস্তা।রাতে বিদ্যাসাগর কলেজ হোস্টেলের ছাদ থেকে একটা ৫০০ ওয়াট বাল্বের পেছনটা খুলে পেট্রল ভরা হত। তারপরে, পেট্রলে সিক্ত একটা ন্যাকড়া দিয়ে পেছনটা ভালো করে বন্ধ করে যেই ট্রাম আসতো হোস্টেলের সামনে, ঐ ন্যাকড়ায় আগুন জ্বালিয়ে সেটি ট্রামের গায়ে বা মাথায় ছুঁড়ে মারা হত এবং সঙ্গে সঙ্গেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে যেত। রাতের ট্রামে লোকজন কম ই থাকতো এবং আগুন লাগার পর তাদের নামতে খুব একটা অসুবিধে হতনা। তবে ট্রামটি দমকল আসার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যেত ! 

বেশ কয়েকদিন এভাবে চলার পর পুলিশের জালে পড়ে গেলাম। ফিরছিলাম স্কটিশচার্চ কলেজের একটি গেট মিটিং-এ বক্তৃতা দিয়ে। স্কটিশের ছাত্র-সংসদের সম্পাদিকা তখন শিপ্রা ভৌমিক। পরবর্তীকালে যিনি শ্যামল চক্রবর্তীর স্ত্রী হয়েছিলেন। বয়সে আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ঐ স্কটিশচার্চ কলেজেরই আর একজন দাদা, দীপ্তেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও খুব প্রিয় ছিলেন আমার। স্কটিশ থেকে বিদ্যাসাগর কলেজে ঢোকার মুখেই পেছন থেকে কলারে হাত আর তারপরেই চ্যাংদোলা করে তুলে সোজা পুলিশের জিপে করে লালবাজার ! জীবনের প্রথম হাজত বাস। ভয় যে একেবারেই পাইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। খুবই নার্ভাস বোধ করছিলাম। কিন্তু হাজতে ঢোকানোর পরে দেখলাম আমার আগেই প্রফুল্ল চক্রবর্তীকেও ধরা হয়েছে। উনিই আমায় শিখিয়ে দিলেন, ওরা যাই জিগ্যেস করুক, তুই নিজের নাম, বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা ছাড়া আর কিচ্ছু জানিস না। খবরদার ! ভুলেও আর কারোর নাম বলবিনা ! তখনো রুনু গুহনিয়োগীর সাথে পরিচয় হয়নি আমার। আমাদের কেসের আই ও ছিলেন রবি কর বলে এক পুলিস অফিসার। একটা ঘরে আমাকে ঢোকানো হল। ভেতরে আরো জনা তিনেক ছিল। তাদেরই একজনকে জেরা শুরু করলেন রবি কর। বল কি জানিস ? সত্যি বলছি স্যার, কিচ্ছু জানিনা ! ক্যাঁথ করে এক লাথি। বল কি জানিস ? কিচ্ছু জানিনা স্যার ! আমি ছিলামই না ওখানে। তারপর, প্রথমে বেল্ট দিয়ে পরে কম্বলে মুড়ে লাঠি দিয়ে তাকে এমন বেধড়ক পেটানো শুরু হল যে তার তো দূরের কথা, আমারই বাথরুম পেয়ে গেল ! বলছি বলছি বলছি স্যার ! আর্তনাদ করে উঠলো লোকটি। বল এবার ! হাত দুটি জোড় করে সে পুনরায় বললো, আমি কিচ্ছু জানিনা স্যার !! এসব দেখে শুনে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হলেও প্রফুল্ল চক্রবর্তী আমাকে অভয় দিয়ে জানালো যে আজ ওরা নাকি আমায় পেটাবেনা। কারণ কাল আমাকে কোর্টে তুলতে হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমাকে তাদের হেফাজতে রাখার আর্জি পেশ করা হল এবং ম্যাজিস্ট্রেট সেটা মেনে নিয়ে আমাকে আরো পনেরো দিন পুলিশ-হাজতে রাখার নির্দেশ দিলেন। পুলিশের গাড়িতে চড়ে আবার ফিরে এলাম লালবাজার সেন্ট্রাল লক-আপে।

১৯৬৪ এর শেষে বা ১৯৬৫ এর প্রথমার্ধ থেকেই মাও-বাদ একটা লাইন হিসেবেই আসতে শুরু করে। চারু মজুমদারই এই লাইনের প্রথম সক্রিয় প্রচারক ও কর্মী ছিলেন। তাঁর মনে তখন ভারতের জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ২৮শে জানুয়ারী তিনি তাঁর প্রথম দলিল—“বর্তমান অবস্থায় আমাদের কর্তব্য” লেখা শেষ করলেন। এই লেখাতেই চারু মজুমদার পুরাতন পার্টি ফর্ম ভেঙে স্পষ্ট করে নির্দেশ দিলেন—প্রত্যেক পার্টি সভ্যকে অন্তত একটি করে পাঁচজনের সক্রিয় দল (Activist Group) তৈরি করতে হবে। দেখতে হবে এই দলের কেউ যেন পুলিশের চিহ্নিত লোক না হয়। গোপন বৈঠক ও পার্টির কাগজ-পত্র রাখার জন্য গোপন স্থান তৈরি করতে হবে। তৈরি করতে হবে নির্দিষ্ট যোগাযোগ-রক্ষাকারী ব্যক্তি। এই সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরই কোনও ব্যক্তিকে পার্টি সভ্য করা যাবে। গভীর প্রত্যয়ের সাথে তিনি বলেছিলেন, এই সংগঠনই আগামী যুগে বিপ্লব সংগঠনের দায়িত্ব নেবে। বিপ্লবী কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা কি হবে, এ প্রসঙ্গে চারু মজুমদার বলেন—ভারতের বিপ্লবের প্রচার আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য হবে কৃষি বিপ্লব সফল করা। 

(চলবে)

1 comments: