0

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



একশো দশ বছর আগের এক সকাল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। কলকাতার যে রাস্তাটিকে অধুনা আমরা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ বা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ বলে চিনি, সেই পথের দৃশ্য। একটি মিছিল চলেছে সে পথ দিয়ে। একটু অদ্ভূত ধরনের মিছিল। যোগদানকারীদের সবার হাতে রাখী। যে যাকে পাচ্ছে, পরিয়ে দিচ্ছে। দোকানদার থেকে আরম্ভ করে পথচারী অবধি, ঘোড়ার গাড়ির মুসলমন কোচোয়ান থেকে নিয়ে নমঃশূদ্র দিনমজুর পর্যন্ত, কেউ বাদ যাচ্ছে না। 

মিছিলের সামনে হাঁটছেন শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত দীর্ঘকেশ এক শুভ্রকান্তি শালপ্রাংশু পুরুষ। তাঁর কন্ঠে আমাদের একটি অতি পরিচিত গান... ‘‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান।’’ রবীন্দ্রনাথ চলেছেন তাঁর নবরচিত গানখানি গাইতে গাইতে, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ নীতির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্বের পুরোভাগে। বস্তুত, এই রাখীবন্ধন শোভাযাত্রার পরিকল্পনাটি রবীন্দ্রনাথেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক ভাবে আলাদা করে দিয়ে ইংরেজ সরকার তার বিভাজন নীতি বাঙালির উপর আরোপ করতে চাইছে, সেই দুই সম্প্রদায়ের মৈত্রীবন্ধনকে দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টা এই আকালিক রাখীবন্ধন উৎসব।

এর মাস দুয়েক আগে কলকাতার টাউন হলে একটি বিশাল জনসমাবেশেও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই প্রথমবার তিনি সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন খোলাখুলি, এবং এমন একটি বিষয়ে, যা আজও আমাদের এবং আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশকে স্বততঃ বিব্রত করছে। ক্রান্তদর্শী কবি বুঝেছিলেন, এ সমস্যা ভারতবাসীর মনের এমন গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে, যাকে উচ্ছ্বেদ করা অতি প্রয়োজনীয় হলেও প্রায় অসম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের অসামান্য দূরদর্শীতার আরও বহু নিদর্শন আছে। ১৯৩০সালে, অর্থাৎ বলশেভিক বিপ্লবের মাত্র তেরো বছর পর লেখা রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যাপারে যে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, সেই সংশয় সত্য প্রমাণিত হয় তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচ্য নয়। এখানে আমরা উঁকি মারার চেষ্টা করবো সেই বিষয়টির অভ্যন্তরে, যার বিরূদ্ধে প্রতিবাদে সেই যুগপুরুষ সেদিন পথে নেমেছিলেন। মাপার চেষ্টা করবো তারপর থেকে কতখানি পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি, সেই দূরত্বটুকু।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ সেদিন সফল হয়েছিলো। ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়েছিলো বিভক্ত বাংলাকে পুনর্যুক্ত করতে। ১৯১১-র ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ স্বয়ং সে ঘোষণা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা যে হয়নি, আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস আজও দীর্ঘশ্বাস চেপে সে সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। ১৯৪৭-এ রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে এ দেশের ভৌগোলিক ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতো কি না, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু ঘটনা হল, স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরেও ভারতবর্ষ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিক্ষত।

যে দেশের সত্তর শতাংশ মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরোয় না, সেই দেশে যে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা থাকবে, তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আশ্চর্য এই, যে আজও এদেশের রাজনীতি সেই ধর্মোন্মাদনার উপর ভিত্তি করে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসে আছে। এখানে আজও রাজনৈতিক সম্মেলনে অন্য সম্প্রদায়ের উপর বিষোদ্গার করা হয়। মানুষকে প্ররোচনা দেওয়া হয় ধর্মস্থান আক্রমণ করার জন্য... এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে ধ্বংস করা হয় শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য! এও যে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ, তাই নিয়ে খুব বেশি দ্বন্দ্বের অবকাশ আছে কি?

প্রাকস্বাধীনতা যুগে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী বলা হতো। সেই অর্থে রাসবিহারী বসু, সুভাষ বোস থেকে শুরু করে ভগৎ সিং, বীর সাভারকর, সূর্য সেনরা সবাই সন্ত্রাসবাদী ছিলেন। কিন্তু আজকের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তাঁদের সমীকরণ করতে গেলে তাঁদের আত্মারা হয়তো ইংরিজিতে যাকে বলে ‘turning in their graves’, তাই-ই করবে।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভাবে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি জানতেন, বৃটিশ সিংহকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাড়ানো বহুদিন নির্জিত, ভগ্নমেরুদণ্ড ভারতবাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি চরমপন্থী বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন। আসলে, দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথও বোধহয় বুঝতে পারেননি যে স্বাধীন ভারত নিজেই অচিরে ধর্মীয় সন্ত্রাসের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠবে। তার জন্য কোনও বহিরাগত শক্তির প্ররোচনার প্রয়োজন হবে না।

কিন্তু এমন পরিস্থিতি হলো কেন? দেশভাগের সময়ে হওয়া দাঙ্গার পর তো প্রায় চার দশক এ আপদ ছিলো না। নব্বইয়ের দশক থেকে আবার মাথা চাড়া দিলো ধর্মোন্মাদনা। রামজন্মভূমি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাঙা হলো বাবরি মসজিদ, এবং তারপর থেকে শুরু হয়ে গেলো ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদের একের পর এক বিস্ফোরণ... আক্ষরিক অর্থে! এর কি খুব প্রয়োজন ছিলো এমনিতেই হাজারো আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষে?

রাজনীতিবিদদের কাছে হয়তো এর উত্তর আছে। আমাদের রাজনীতি ভোট আকর্ষণ করার জন্য কি কি করতে পারে, সে কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তবে ভাবার সময় বোধহয় এসেছে। ধর্মকে কি এই ভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোনও সদর্থক প্রয়োজন আছে? 

রবীন্দ্রনাথের মতে, নেই। এনিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কিছুটা মতবিরোধও ছিলো। স্বাধীন ভারতবর্ষের কোনও নির্বাচন তিনি দেখে যেতে পারেনি। কিন্তু তবু তিনি বুঝেছিলেন, অনগ্রসর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির স্বার্থও একসময় গিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে পরিণত হবে। তাই-ই হয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রদায় তোষণনীতি... আমাদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির আরেক অন্ধকার দিক।

এই ধর্মান্ধতার প্রতিকার কি? সেই চর্বিতচর্বনই আসবে আবার ঘুরে ফিরে – শিক্ষার বিস্তার, সমাজ সচেতনতার প্রসার, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু যে দেশে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মানুষও কন্যাভ্রূণ হত্যার মতন জঘন্য কাজে ব্যাপৃত হন, সেখানে এই সব ভারি ভারি কথাকে অন্তঃসারশূণ্য ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। বস্তুত, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এ দেশটা যেন বর্তমানে পশ্চাতাভিমুখে চলেছে। চারদিকে ধর্মের ধ্বজা উড়ছে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হচ্ছে আবহমান কাল ধরে চলে আসা মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর। জোরদার প্রচেষ্টা চলছে ভারতবর্ষের নাম পাল্টে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নামে নামাঙ্কিত করার...

রবীন্দ্রনাথের মতন অপরিমেয় মাপের মানুষ এযুগে আর জন্মান না। জন্মালে যে হতাশ হতেন, তাই নিয়ে বোধহয় বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে সেই সঙ্গে হয়তো প্রতিকারের চেষ্টাও করতেন। হয়তো পথে নামতেন মৈত্রীবন্ধন মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে। লিখতেন নতুন নতুন গান... 

সে সব করার সময় এখন আর কারও নেই। জীবন এখন বড় জটিল আর ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার চাপে প্রতিনিয়ত নিষ্পিষ্ট হচ্ছে মানুষের ঔচিত্যবোধ। যদি নাও হয়, তবু এক আপাত নিরাপত্তাবোধের ঘেরাটোপে মানুষের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকছে নিজের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের গণ্ডীর ভিতর। তার বাইরেটা দেখার ক্ষমতা বা আগ্রহ কোনওটাই নেই বেশির ভাগ মানুষের। আসন্ন বিপদের আঁচ পেলেও তাই খরগোশের মতন গর্তে মুখ ঢুকিয়ে থাকছি আমরা... কোনও রকমে বাকি জীবনটা নিরাপদে কাটিয়ে দেওয়ার আশায়।

ভরসা, শুধু নবীন প্রজন্মের উপর। তারা যদি একদিন রুখে উঠে বলে, নাহ! আর সহ্য করা হবে না এই সংকীর্ণতা, সেদিন হয়তো আমরাও তাদের কন্ঠে কন্ঠ মেলাবো। ততদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আকুতি জানানো যাক... ‘‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা... আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা!’’





0 comments: