1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in




















প্রাচীন কথা

উত্তরাপথের পথে, পর্ব - ১
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়  






=* ভূমিকা*=


পটভূমি আর্যাবর্ত। কাল সপ্তম শতাব্দীর প্রথমপাদ। আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যের রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভুরা নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহে ব্যাপৃত। বিশাল এই ভারত ভূখণ্ড জুড়ে চলছে মাৎসন্যায়ের যুগ। শৈব ও শাক্তদের মধ্যে শাক্যমুনি ভগবান বুদ্ধের অহিংসার অমৃতবাণী বিস্তার লাভ করলেও রাজ্যলিপ্সা, ক্রুরতা, বিলাস ও সম্ভোগের নেশায় মদমত্ত রাজা ও সামন্ত প্রভুরা নিবৃত হয়নি যথেচ্ছাচার থেকে। উচ্চ বর্ণে জন্মের সুযোগ নিয়ে পরশ্রমজীবী ব্রাহ্মণেরা ভোগী ও ক্ষমতান্ধ ক্ষত্রিয়কূলের অনুগ্রহে ধর্মের নামে মিথ্যা অনুশাসন প্রয়োগ করে অবাধে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে। 

তবুও, শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অবাধ লাম্পট্য ও ভোগ-লালসার ঘন মেঘের মধ্যে দীপ্ত আলোকরশ্মির মতই প্রতিভাত হয়েছে জ্ঞান ও সাহিত, শিল্প, কাব্য-গীতাদির চর্চা; ঔদার্য্য ও শৌর্যের শাশ্বত গৌরব। বহির্বিশ্ব ছুটে এসেছে ভারতবর্ষের চিরায়ত ঐশ্বর্য থেকে জ্ঞানার্জনের আশায়। আবার, এ দেশের পার্থিব সম্পদের লোভে শক, হূণ ইত্যাদি বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীদের হাতে বারংবার আক্রান্ত হয়েছে কঙ্কণমালিনী ভারতবর্ষ। 

‘ঋদ্ধি ও ঐশ্বর্য না থাকলে লুন্ঠনকারীরা আসে না; নবতম মহিমা ঢেকে দিতে চায় পুরাতন মহিমাকে; জ্ঞান, বিজ্ঞান, শৈলীর বিলোপ-সাধন এবং তার অব্যবহিত পরে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার –- অভিযানের রীতি।’ যদিও এক শ্রেণীর রাজা ও সামন্তদের বিকৃত সম্ভোগের বলি হওয়াই ছিল রূপবতী নারীদের ললাট লিখন, তবুও আবহমান কালের অবমাননার শৃঙ্খল ছিন্ন করে নারী দেখিয়েছে তার পরম কল্যাণময়ী রূপ। প্রেম, মমতা, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার আলোকবর্তিকায় বিপথগামী পুরুষকে চিনিয়েছে শুভ ও কল্যাণময় পথরেখা। এ কাহিনীর চরিত্ররা কল্পনায় মূর্ত হয়ে আর্যাবর্ত ও উত্তরাপথ-এর সেই কুয়াশাচ্ছন্ন অতীত পথে ইতিহাসের বিস্তীর্ণ জনপদে বিচরণ করেছে। তারা বিভিন্ন ভাষাভাষির হলেও আমি তাদের মুখে একই ভাষা দেব। যবনিকা উত্তোলন করছি। 

********


(সুধী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য বিশেষ কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য --- সংস্কৃত ছিল সুধীসমাজের ভাষা, বৌদ্ধ পণ্ডিতরাও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। রাজপথ গুলি ছিল প্রশস্থ। সেগুলি প্রস্তর ও কঙ্করে নির্মিত ও নিয়মিত পরিস্কারের ব্যবস্থা ছিল। সাধারণ রাস্তা ঘাট ছিল কাঁচা। দূরপথে স্থানে স্থানে দীর্ঘিকা(দীঘি) ও বাগিচা থাকায় পথিকদের বিশ্রামের সুবিধা হত। অশ্ব, খচ্চর ও গো-শকট ছিল সাধারণ যান-বাহন, রাজা, সামন্ত প্রভু, শ্রেষ্টী ও ধণিক শ্রেণীর মানুষ হাতী ঘোড়া ও পালকি ব্যবহার করতেন; যুদ্ধে হাতী, ঘোড়া উট ব্যবহৃত হত। দেশে চোর- ডাকাত যথেষ্ট ছিল, কিন্তু চুরি ও অন্যান্য অপরাধের জন্য কঠোর সাজার ব্যবস্থা ছিল। গ্রামাঞ্চলে ঘন বসতি ছিল এবং গ্রামভিত্তিক সমাজে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ারের মাধ্যমে রাজা নিজের রাজ্যের সর্বত্র এবং রাজ্যান্তরে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতেন। শ্রেষ্ঠী ও বণিক সম্প্রদায় দেশে ও দেশের বাইরে বাণিজ্য করে সম্পদ বৃদ্ধি করতেন। ব্রাহ্মণরাই ছিলেন শিক্ষক, তাঁরা নিজেদের আশ্রমে উচ্চকুলের ছাত্রদের অর্থ বা জমির দখলিসত্বের বিনিময়ে বিদ্যাদান করতেন। জ্ঞান ও শিল্পচর্চায় অধিবাসীদের আগ্রহ ছিল। কৃষি ছিল সাধারণ মানুষের মূল জীবিকা, এছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস তৈরি ও যোগান দেবার পেশাতেও নানা শ্রেণীর লোক নিযুক্ত থাকত। নিম্ন শ্রেণীর অনার্যরা পশু পালন, শিকার ও দাসত্ব করত। দেশে ক্রীতদাস, সতীদাহ, সহমরণ ইত্যাদি প্রথার চল ছিল।) 

বিঃদ্রঃ – 

* হজরত মহম্মদ (৫৭০--৬৩২ খৃঃ) প্রায় ঠিক একই সময়েই (আনুমানিক ৬১০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ) দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মক্কায় ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন করেন। 
* হর্ষবর্ধন (৫৯০--৬৪৭ খৃঃ) ১৬ বছর বয়সে (৬০৬খৃঃ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। 
* গৌররাজ শশাঙ্কের রাজত্বকাল ৬০৬--৬৩৭খৃঃ। 

***************



(১)



গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর ত্রিবেণী-সঙ্গমে পূণ্যতীর্থ প্রয়াগ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর মকরসংক্রান্তিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ মানুষের ঢল নামে এখানে। অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেশীয় রাজা-মহারাজা, জমিদার, মজুমদার, শ্রেষ্ঠী, স্বার্থবাহ (বণিকদল), ধর্মপিপাসু হিন্দু, বৌদ্ধ ও নাগা সন্ন্যাসী প্রভৃতিরা প্রয়াগে আসেন ত্রিবেণী-সঙ্গমে স্নান করে পূণ্যার্জন করতে। কেউ কেউ বাণিজ্যিক লাভের আশায়, আবার কেউ বা নিছকই চিত্ত বিনোদনের নেশায়। অন্যান্য বারের মত এই বারেও তার অন্যথা হয়নি। 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। আকাশের নীল চন্দ্রতপ (চাঁদোয়া) জুড়ে পূর্ণ চন্দ্রের জ্যোৎস্না। সেই স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত স্বতঃপ্রবাহিণী তিনটি নদীর স্রোতধারা যেন দূরান্তর থেকে আসা তিন সহদোরা ভগ্নীর মতই একত্রে মিলিত হয়ে ফেনিল-উচ্ছল হয়ে উঠেছে। তাদের বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ধনীদের বিচিত্র বর্ণের বস্ত্রাবাস ও বিভিন্ন সাধারণ মানুষদের বাসোপযোগী অগণিত পর্ণাবাস নির্মিত হয়েছে। নদীতীর থেকে কিছুটা দূরে সারি সারি বিপণি নানা প্রদেশের বিপুল পণ্য সম্ভারে ঠাসা। সব থেকে বেশী খাদ্য সামগ্রী ও শীতবস্ত্রের বিপণি, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলিতে ক্রেতার ভিড়ও বেশী। 

পূর্ণকুম্ভ শুরু হতে এখনও পক্ষকাল দেরী আছে। এ বৎসর পূর্ণকুম্ভ উপলক্ষে বিশেষ উৎসব, সপ্তাহকাল আগে থেকেই মানুষের ভিড়ে জনপদটি এখন ভারি জমজমাট। ধর্মীয় উৎসব পালনের আনন্দময় পরিবেশের মধ্যে অতি সংগোপনে অন্য একটি নাটকের মহলাও অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, যা ভবিষ্যৎ আর্যাবর্তের ইতিহাসের পট পরিবর্তন ঘটাবে। 

পূর্ব-ভারতের পরাক্রমশালী রাজ্য গৌড়ের মহারাজ শশাঙ্কদেব তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে এই বৎসর পূর্ণকুম্ভের সন্ধিক্ষণে পুণ্যস্নান করতে কয়েকদিন আগেই প্রয়াগের কিছুদূরে এসে শিবির ফেলেছেন। সঙ্গে শুধু বিশ্বাসী কয়েকজন অমাত্য, পাচক, ভৃত্য ও মাত্র ছয়শো সুদক্ষ সৈনিক। পূণ্যতীর্থে এসে শশাঙ্ক কোন রাজবেশ ধারণ করেননি, তাঁর অত্যন্ত সাধারণ চেহারা ও উর্ধাঙ্গে একখানি মাত্র কাশ্মীরি দোশালা উত্তরীয়ের মত জড়ানো, পরণে গৌড়দেশের মিহি কার্পাশ সূতায় তৈরী পোশাকে তাঁকে কেউই মহামান্য গৌড়েশ্বর বলে চিনতে পারে না। তাঁর সঙ্গী দেহরক্ষীরাও কোন না কোন ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে। মহারাজের বসবাসের জন্য নির্মিত বস্ত্রাবাসটিও (তাঁবু) শিবিরের অন্যান্য গুলির মতই সাধারণ, বাইরে থেকে সহজে সেটিকে চিহ্নিত করা দুষ্কর। শশাঙ্ক তাঁর রক্ষীদলকে দূরে থাকার আদেশ দিয়েছেন, শুধুমাত্র প্রধান অমাত্য মহিম ভট্টর সঙ্গে কদাচিৎ বাক্যালাপ ছাড়া তিনি প্রায়শঃই মৌন থাকছেন। পরম শৈব শশাঙ্কদেব বেশিরভাগ সময়ই তিনি যেন তাঁর ইষ্ট দেবতা ভগবান শঙ্করের ধ্যানে মগ্ন। 

প্রায় একই সময়ে পদ্মাবতীদেশ মালব থেকে ত্রিবেণী-তীর্থে এসে পৌঁছেছেন মহারাজ দেবগুপ্ত। তাঁর শরীরে রাজসুলভ মহার্ঘ পোশাক, সঙ্গে রক্ষীবাহিণী ছাড়াও শতাধিক বাদ্যকর ও নৃত্য-গীত পটীয়সী বারনারী রয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখনো কুমারী। ত্রিশোর্ধ মহারাজের নৃত্য-গীত-বাদ্য প্রভৃতি ললিতকলা খুবই প্রিয়, এবং তিনি অত্যন্ত ভোগী ও কামুক। নিত্য নূতন অক্ষতযোনি নারী-শরীরের আস্বাদন করা তাঁর বিশেষ শখ; আর উৎকৃষ্ট সুরাপানে তাঁর বিন্দুমাত্র অরুচি নেই। অল্প বয়স থেকেই অপরিমিত সম্ভোগ ও সুরাপানের প্রভাবে মহারাজের চোখ দুটি অসম্ভব রক্তিম, এবং তাঁর দশাসই বপুর মধ্যপ্রদেশটি এই যৌবনেই বেশ স্ফীত। তাঁর সঙ্গে সব সময় দুই-চারটি সুন্দরী ও চাটুকার মোসায়েব থাকে, পিছনে সুন্দরী তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী (পানের বাটা বহনকারী দাসী) এবং ভৃঙ্গার, সুরাপাত্রও পিকদানি হাতে সদাব্যস্ত তিনজন পাদাৎ(তকমা পরা ভৃত্য)। 

দেবগুপ্ত প্রতিদিন মধ্যাহ্নে ঘুম থেকে উঠে থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নানা ভাবে জীবনকে উপভোগ করতে ভালবাসেন। প্রয়াগের এই পূণ্যভূমিতে এসেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। এত কিছু সত্বেও রাজনীতি ও যুদ্ধক্ষেত্রে মহারাজ দেবগুপ্ত যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ব্যক্তি। মাঝে মাঝেই তিনি সুরা-নারী ইত্যাদি হঠাৎ বর্জন করে বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যান, তখন তাঁর অন্য রূপ। একই মানুষের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী সত্ত্বার এমন বিরল সমাবেশ কদাচিৎ দেখা যায়। 

আজ দ্বিপ্রহরের পূর্বেই মহারাজ দেবগুপ্ত শয্যা ত্যাগ করেছেন। পাদাৎরা মহারাজের রাজকীয় পটাবাস(তাঁবু) থেকে নগ্নপ্রায় তিনজন মদিরাচ্ছন্ন তন্দ্রাতুর যুবতী ও সুরাপাত্র, ভৃঙ্গার প্রভৃতি আনুসাঙ্গিক দ্রুতহাতে সরিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যার আগেই বস্ত্রকর্মান্তিক (রাজার পোশাক-ঘরের প্রধান ভৃত্য) তাঁকে বিচিত্র বর্ণের পরির্বহে (রাজচিহ্ন পরিচ্ছদে) শোভিত ও নানা রত্নালঙ্কারে ভূষিত করে রাজ-দরবারের উপযুক্ত করে সাজিয়ে দিয়েছে, এবং আজ তিনি মদ্য স্পর্শও করেন নি। বর্ষীয়ান মহামন্ত্রী বিনায়ক, সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তাঁরা রাজপটাবাস-সংলগ্ন অস্তিকাগার(গোপন মন্ত্রণাকক্ষ)-এ উপস্থিত হয়ে সসম্ভ্রমে তাঁর আদেশের প্রতীক্ষা করছেন। 

মহারাজ আসন গ্রহণ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিনায়কের দিকে তাকালে, মন্ত্রী অভিবাদন করে বললেন, –-- মহারাজ, আপনার পরম মিত্র গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা মতই যথা সময়ে প্রয়াগে এসে অবস্থান করছেন। তাঁর গুপ্ত-অমাত্য কাল সন্ধ্যায় আমাকে জানিয়ে গিয়েছেন যে, তিনি আজ সন্ধ্যায় প্রচ্ছন্নভাবে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির আলোচনা ও পরামর্শ করতে আগ্রহী। তিনি যে কোন মুহূর্তে এখানে উপস্থিত হতে পারেন, তাই আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি। 

--- আমি এই সময়টির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম মহামন্ত্রী, দেবগুপ্ত বললেন, সেনাপতি সুরথ, গৌড়রাজের সর্বাঙ্গীন সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন তো! 

--- হ্যাঁ মহারাজ, আমি একশত সুদক্ষ সৈনিককে তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে এখান থেকে গৌড়ের শিবির পর্যন্ত সংস্থাপন করেছি। গুপ্তচর জানিয়েছে মহারাজ নিরস্ত্র হয়ে শুধুমাত্র তাঁর মহামাত্য মহিম ভট্টকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসছেন। 

--- বেশ, তোমরা প্রস্তুত থেকো, আর দেখো গৌড়েশ্বরের আতিথেয়তার যেন সামান্য ত্রুটিও না হয়। 

কথার মাঝেই দৌবারিক এসে জানালো, দুজন সন্ন্যাসী মহারাজ দেবগুপ্তের সাক্ষাৎ অভিলাষী। সেনাপতি সুরথ তৎক্ষণাৎ উঠে অস্তিকাগারের কিংখাবের বিতানক (তাঁবুর পর্দা) সরিয়ে একবার দেখেই মন্ত্রী বিনায়কের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ঘাড় নাড়লে বিনায়ক উঠে দাঁড়ালেন। সন্ন্যাসীবেশী মহারাজ শশাঙ্ক ও তাঁর প্রধান অমাত্যকে দেখে মালবরাজ নিজে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। পূর্বভারতের পরাক্রমশালী এই বন্ধু-নৃপতির শক্তি অপেক্ষা কূটনীতির বিশেষ বিচক্ষণতার প্রতি মালবরাজ বেশী শ্রদ্ধাশীল। 

প্রাথমিক সম্ভাষণ এবং ফল-মিষ্টান্নাদি দ্বারা অতিথি সৎকারের পর্ব শেষ হলে শশাঙ্ক বৃথা কালক্ষেপ না করে সোজাসুজি কাজের কথা শুরু করলেন।

--- মিত্র দেবগুপ্ত, আজ আমাদের এই পরামর্শসভার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, কিভাবে নিজেদের রাজশক্তিকে দ্রুত বর্ধিত করে সম্মিলিত ভাবে ভারতবর্ষের সর্ব বিষয়ে শ্রেষ্ঠ অঞ্চল এই উত্তরাপথের সমৃদ্ধশালী রাজ্যগুলিকে করতলগত করব এবং সেই সব বিজিত রাজ্যের সম্পদ আমরা আমাদের পূর্ব-প্রতিজ্ঞামত উভয়ে সমভাবে বন্টন করে নেব। আপনি উত্তর ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করলে আলোচনার সুবিধা ও পরবর্তী কৌশল নির্ণয় করতে সুবিধা হয়। 

--- মালবের মহামন্ত্রী বিনায়ক এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী জানেন, শশাঙ্কের কথা শেষ হলে দেবগুপ্ত বললেন, তিনিই আমাদের সমস্ত পরিস্থিতি উত্তমরূপে বোঝাতে পারবেন। 

বিনায়ক কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, --- হে রাজন, আর্যাবর্তের ঐশ্বর্যময় ও সম্পদশালী রাজ্যগুলি ভারতভূমির কন্ঠে যেন একটি বহুমূল্য রত্নখচিত কন্ঠহার, আর কান্যকুব্জ যেন সেই রত্নহারের মধ্যস্থিত হীরকখণ্ড। 

--- মহামাত্য, আপনি সংক্ষেপে আর্যাবর্তের রাজ্যগুলির ভৌগলিক অবস্থান আমাদের একটু ব্যাখ্যা করে দিলে আমাদের আলোচনা ও পরামর্শের পক্ষে কিঞ্চিৎ সুবিধা হবে। 

বিনায়কের কথার মাঝেই মহিম ভট্ট বলে উঠলেন, মহারাজদ্বয়ও তাঁর কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। বিনায়ক প্রস্তুত হয়েই এসেছেন, তিনি একটি পাকানো তুলোট কাগজে হাতে আঁকা মানচিত্র সামনের মঞ্চক (ছোট টেবিল)-এর উপরে বিছিয়ে দিলেন। মানচিত্রে নীল রঙে নদী ও লাল রঙের তারকা দিয়ে রাজ্য ও রাজধানীগুলিকে চিহ্নিত করা আছে। অঙ্কিত স্থানগুলির উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিনায়ক বললেন, --- এই দেখুন, আর্যাবর্তের একেবারে সুদূর উত্তর-পূর্বে গান্ধার (কান্দাহার), তক্ষশীলা ও মুলতান ছাড়াও উত্তরে হিমাদ্রি-কন্যা কাশ্মীর। মধ্যভাগে পূণ্যতোয়া যমুনার তীরে পাণ্ডবদের প্রাচীন রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ (দিল্লী)-র অনতিদূরে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য স্থান্বীশ্বর (থানেশ্বর), তারপর মধুপূরী (মথুরা)। এই দেখুন, প্রয়াগ ও মথুরার মাঝে গঙ্গা-যমুনার দোআব অঞ্চলে কান্যকুব্জ বা কনৌজ; আর তার ঠিক দক্ষিণে যমুনার অন্য তীরে আমাদের মালব ও তার রাজধানী অবন্তী (উজ্জয়িনী)। তারপর কাশী, কোশল এবং গুপ্ত বংশীয়দের রাজ্য মগধ, রাজধানী পাটলিপুত্র (বিহার ও রাজধানী পাটনা), অঙ্গদেশ এবং শেষে পূর্ব প্রদেশে আপনার রাজ্য গৌড় (উত্তর-পুর্ব বঙ্গদেশ) -- রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, পুণ্ডবর্ধন (উত্তর বঙ্গ), সমতট (পূর্ব বঙ্গদেশ) ও সৌহ্ম্য (পশ্চিমবঙ্গ, রাজার নামও ছিল সৌহ্ম্য), রাজধানী তাম্রলিপ্ত আর পাশে সমুদ্রোপকূলবর্তী কলিঙ্গদেশ (উড়িষ্যা)। একটু থেমে বিনায়ক বলে চললেন, --- পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের প্রথম লক্ষ্য উত্তরাপথের অন্যতম সমৃদ্ধশালী রাজ্য কান্যকুব্জ। কনৌজরাজ অবন্তিবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর যুবক পুত্র গ্রহবর্মা এখন সিংহাসনে আসীন; গত বৎসরই গ্রহবর্মা স্থান্বীশ্বরের পুষ্পভূতি বংশের হূণবিজেতা মহাপরাক্রমশালী মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের একমাত্র কন্যা আলোকসামান্যা সুন্দরী রাজকুমারীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সব দিক থেকেই যে আরও ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠেছেন তা আমাদের অবিদিত নেই। আমি মহারাজের আদেশে গত এক বৎসর যাবৎ গুপ্ত সংবাহক মারফৎ বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। রাজা গ্রহবর্মা অত্যন্ত রূপবান ও বিদ্বান হলেও রাজ্যশাসননীতি বা রণকৌশলে বিশেষ পারদর্শী নন। আশৈশব বিরাট ব্যক্তিত্ববান ও যশস্বী পিতার ছত্রছায়ায় থাকলে সচরাচর যেমন হয়ে থাকে তেমনই কিছুটা ব্যক্তিত্বহীন। এছাড়াও তাঁর সরলতা ও অসন্দিগ্ধ মনোভাব মানবিক গুণ হলেও রাজনীতির পক্ষে নিতান্তই বেমানান। 

বিনায়ক থামলে দেবগুপ্ত বললেন, --- মিত্র, আপনি তো সবই শুনলেন, কান্যকুব্জ জয় আমার বহুদিনের স্বপ্ন, আপনার সাহায্যে আমি যে কোন ভাবে তা জয় করতে চাই। আপনি কৌশল নির্ধারণ করুন। 

গৌড়রাজ এতক্ষণ গভীর মনোনিবেশ সহকারে মানচিত্রের খুঁটিনাটি দেখতে দেখতে সব শুনছিলেন। একটু চিন্তা করে নিয়ে গম্ভীর মুখে অভিভাষণ শুরু করলেন, 

--- আমার মনে হয় গৌড় ও মালব একজোট হয়ে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলেও আমাদের জয় সুনিশ্চিত নয়। দূরত্বের কারণে গৌড় ও মালব থেকে সৈন্যবাহিনী কান্যকুব্জে পৌঁছাতে যে সময় লাগবে তার অনেক আগেই শক্তিশালী স্থান্বীশ্বরের বিশাল সৈন্যবাহিনী সেখানে পৌঁছে যাবে। দুই সম্মিলিত শক্তির সামনে দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত আমাদের সৈনিকরা কতক্ষণ যুদ্ধ করতে পারবে বলা যায় না। তাছাড়া প্রাগজ্যোতিষপুরের (আসাম) রাজা কুমার ভাস্করবর্মার সঙ্গে স্থান্বীশ্বরের বিশেষ মিত্রতা রয়েছে, এই যুদ্ধে ভাস্করবর্মা ওদের সহায় হলে তিন দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে আমাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে বলেই আমি মনে করি। তাই এইভাবে পররাজ্য লোভে হটকারীতা করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনার কোন অর্থ নেই বলেই আমি মনে করি। 

--- তাহলে কি আমার স্বপ্নপূরণ হবে না মিত্র? দেবগুপ্ত নিরাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। 

--- তা তো বলিনি বন্ধু, আর্যাবর্তের স্বর্ণপ্রসবিনী রাজ্যগুলিকে করায়ত্ত করার স্বপ্ন আমিও দেখি যে! শশাঙ্ক মৃদু হেসে বললেন, তাই তো গত তিন বৎসর ধরে বিশ্বাসী রাজদূত মারফৎ অনেক পরিকল্পনার পর আজ আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। সাধারণ ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য না দেখিয়ে কৌশলে গুপ্তযুদ্ধ করে কনৌজ অধিকার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

--- কি রকম! কি রকম! দেবগুপ্ত কৌতূহলী হয়ে নড়েচড়ে বসলেন। 

গৌড়রাজ পাশের ছোট মঞ্চকে রাখা তাম্বুলকরঙ্ক (পানের বাটা) থেকে তাম্বুল নিয়ে মুখে পুরে আয়েস করে চিবোতে চিবোতে বললেন, 

--- সব সময় সৈন্যবাহিনীর পরাক্রমে যুদ্ধে বিজয়লক্ষ্মী লাভ হয় না বন্ধু, কৌশলে কূটঘাত (অন্তর্ঘাত)-এর মাধ্যমে শত্রুজয় রণকৌশলের একটি বিশেষ পন্থা; আমি এক্ষেত্রে সেই পন্থাই অবলম্বন করতে চাই। মহামতি চাণক্যর সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করুন মিত্র দেবগুপ্ত, “কঃ কালঃ কানি মিত্রাণি কো দেশঃ কো ব্যয়াগমোঃ। কস্যাহং কা চ মে শক্তিরিতি চিন্ত্যং মুহুর্মুহুঃ।।” অর্থাৎ, ‘সময় কেমন? কে মিত্র? কোন দেশ? আয়-ব্যয় কেমন? আমি কার এবং আমার শক্তি কেমন? এই সব বারবার চিন্তা করা উচিত’।

--- এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে যে ছয় শত সৈনিক আছে, তারা প্রত্যেকেই গুপ্তযুদ্ধে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আপনার শক্তির পরিমাণ কি বলুন? শশাঙ্ক জিজ্ঞাসা করলেন। 

মালবরাজ সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথের দিকে তাকালে সুরথ বললেন, গত শরৎকালের পূর্বে সংবাহকের হাতে আপনার পত্র পাবার পরই আমাদের মহামন্ত্রীর নির্দেশে গুপ্তযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী দুই সহস্রাধিক সশস্ত্র সেনানী স্বার্থবাহ, ও বিভিন্ন পেশার মানুষের ছদ্মবেশে কান্যকুব্জে গোপনে অনুপ্রবেশ করে অভিবাসী হয়েছে। আমার ইঙ্গিতমাত্র তারা নিজমূর্তি ধারণ করে যথোচিত ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করবে। আর এখন মালবের সৈন্যবাহিনী থেকে বাছাই করা তিন সহস্র কুশলী যোদ্ধাকে নিয়ে এসেছি এখানে। 

--- বাঃ! অতি উত্তম, শশাঙ্ক হৃষ্টচিত্তে বললেন, আপনার অমাত্যরা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন দেখছি! আমরা, মালব ও গৌড়ের বিশাল কোন সৈন্যবাহিনী নিয়ে এখানে আসিনি ঠিকই, কিন্তু আমার বিশ্বাস অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সঠিক সময়ে কৌশল প্রয়োগ করতে পারলে এই সামান্য শক্তি দিয়েই আমরা কার্যসিদ্ধি করতে পারি বন্ধু।

--- প্রয়াগে এখন মকরসংক্রান্তির মেলা চলছে, আর ওদিকে কনৌজের রাজা গ্রহবর্মার জন্মতিথি উপলক্ষে কান্যকুব্জ নগরীর ভিতরেও উৎসবের সমারোহ। আর একটি তাম্বুল মুখে পুরে আসনে গা এলিয়ে দিয়ে গৌড়েশ্বর বললেন, ত্রিবেণী-সঙ্গমের এই মেলা ছাড়াও কান্যকুব্জ সংলগ্ন গঙ্গার দোয়াব অঞ্চলেও ভারতের নানা রাজ্যের নানা পেশার মানুষের বিপুল সমাবেশ হয়েছে। এই সময় উত্তরাপথে শীতের প্রবল প্রতাপ, এবং রাত্রির তুলনায় দিনও অনেক ছোট। আজ মাঘী পূর্ণিমা, কুম্ভ মেলার শেষ দিন কৃষ্ণা চতুর্দশী। আমি অনেক হিসাব কষেই এই সময়টাকে বেছে নিয়েছি বন্ধু। এখন আমার শলা আপনারা শুনুন, মনে রাখবেন সময়ের বিষয়টিই কিন্তু সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এতটুকু যেন ভুলচুক না হয়। 

অতঃপর গৌড়েশ্বর নিম্ন-গম্ভীর কন্ঠে তাঁর কূটনৈতিক পরিকল্পনাটি ব্যক্ত করলেন। মালবরাজসহ উপস্থিত তিনজন অমাত্য গভীর আগ্রহ ও মনযোগের সঙ্গে তা শুনে যুগপৎ বিস্মিত ও চমৎকৃত হলেন।  

(ক্রমশঃ প্রকাশ্য)













1 comment:

  1. অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকলাম পরবর্তী সংখ্যার জন্যে !!

    ReplyDelete