ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ-বেলা, পর্ব ২
স্বপন দেব
বিদ্যাসাগর কলেজে আমার একবছর পূর্ণ হল। ১৯৬৫ সাল। জহর লাল নেহেরু মারা গেছেন এবং তাঁর শূন্যস্থানে ইন্দিরা গান্ধী আসার আগে গুলজারীলাল নন্দা এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী সাময়িক ভাবে দিল্লির মসনদে আসীন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই আবার সারা ভারতব্যাপী সরকারি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, কমিউনিষ্ট পার্টির এবং তার ছাত্র-সংগঠন গুলির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক চিনপন্থী নেতৃবৃন্দকে বাছাই করে গ্রেফতার করা শুরু হল। বিদ্যাসাগর কলেজের যে ছাত্র নেতাটির বক্তৃতা শুনে আমি এই ছাত্র-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেই ছাত্র নেতা নির্মল ব্রহ্মচারীও গ্রেফতার হলেন। বউবাজারের বিপিএসএফ সদর দফতরে আমার আনাগোনা আগের থেকে অনেক বাড়লো আর সেইসঙ্গে বাড়লো বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র- সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন এসে গেল। কলেজের সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হবেন ছাত্র সংসদের সভাপতি। আর সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মত ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটে এবং এই তিনজন কেই হতে হবে প্রথম বর্ষের ছাত্র। বিদ্যাসাগর কলেজের ক্ষেত্রে এই প্রথম বর্ষের ছাত্রকেই সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রতিযোগিতা করতে হবে বলে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময় থেকেই বিপিএসএফ এক কৌশল অবলম্বন করতো। সেটা হল, পার্টির ঘনিষ্ঠ কোন পোড় খাওয়া ছাত্র-নেতাকে অন্য কলেজে ভর্তি করিয়ে তাকে সেখানে একবছর ধরে পরিচর্যা এবং নেতৃত্বের যোগ্য করে তোলা হত। তারপরে, দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় না বসে তিনি একবছর নষ্ট করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়ে সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রতিযোগিতা করতেন। সে বছর ও তাই হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে, উত্তর পাড়ার কোন এক কলেজ থেকে প্রফুল্ল চক্রবর্তী নামে একজন এসে ভর্তি হল বিদ্যাসাগর কলেজে এবং বিপিএসএফ-এর হয়ে তিনিই নমিনেশন দাখিল করলেন সাধারণ সম্পাদক পদে। এই প্রফুল্ল চক্রবর্তীকে দেখতে এবং তার হাব-ভাব মোটেও ছাত্র-সুলভ ছিলনা। পান খেয়ে দাঁত কালো করে ফেলা আমাদের চেয়ে বয়সে বোধহয় ৫/৬ বছরের বড়ো একজন ভর্তি হলেন আমার থেকে নিচু ক্লাসে এবং এসেই আমাদের খবরদারী চালাতে লাগলেন ! চালচলন ছিল একজন কারখানার শ্রমিকের মত !
এই প্রফুল্ল চক্রবর্তী কিন্তু সে বছর বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন নি। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের দ্বৈত-রেজিস্ট্রেশন থাকায় তার মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। আর এই প্রফুল্ল চক্রবর্তিই পরবর্তিকালে কানোরিয়া জুটমিলের ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে যাই হোক, ৬৫ সালে ট্রাম কোম্পানি এক পয়সা ভাড়া বাড়ালো। সারা কোলকাতা জুড়ে শুরু হল ট্রামভাড়া কমানোর দাবীতে আন্দোলন। মিটিং, মিছিল, পথসভা তো ছিলই তার সঙ্গে যুক্ত হল ট্রামে আগুন দেওয়ার ঘটনা। বিদ্যাসাগর কলেজের সামনের স্টপেজে ট্রাম এসে দাঁড়ালেই সমস্ত যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ট্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। দু’দিন পরেই বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে বসে গেল পুলিস-পিকেটিং। তখন অন্য-রাস্তা।রাতে বিদ্যাসাগর কলেজ হোস্টেলের ছাদ থেকে একটা ৫০০ ওয়াট বাল্বের পেছনটা খুলে পেট্রল ভরা হত। তারপরে, পেট্রলে সিক্ত একটা ন্যাকড়া দিয়ে পেছনটা ভালো করে বন্ধ করে যেই ট্রাম আসতো হোস্টেলের সামনে, ঐ ন্যাকড়ায় আগুন জ্বালিয়ে সেটি ট্রামের গায়ে বা মাথায় ছুঁড়ে মারা হত এবং সঙ্গে সঙ্গেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে যেত। রাতের ট্রামে লোকজন কম ই থাকতো এবং আগুন লাগার পর তাদের নামতে খুব একটা অসুবিধে হতনা। তবে ট্রামটি দমকল আসার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যেত !
বেশ কয়েকদিন এভাবে চলার পর পুলিশের জালে পড়ে গেলাম। ফিরছিলাম স্কটিশচার্চ কলেজের একটি গেট মিটিং-এ বক্তৃতা দিয়ে। স্কটিশের ছাত্র-সংসদের সম্পাদিকা তখন শিপ্রা ভৌমিক। পরবর্তীকালে যিনি শ্যামল চক্রবর্তীর স্ত্রী হয়েছিলেন। বয়সে আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ঐ স্কটিশচার্চ কলেজেরই আর একজন দাদা, দীপ্তেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও খুব প্রিয় ছিলেন আমার। স্কটিশ থেকে বিদ্যাসাগর কলেজে ঢোকার মুখেই পেছন থেকে কলারে হাত আর তারপরেই চ্যাংদোলা করে তুলে সোজা পুলিশের জিপে করে লালবাজার ! জীবনের প্রথম হাজত বাস। ভয় যে একেবারেই পাইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। খুবই নার্ভাস বোধ করছিলাম। কিন্তু হাজতে ঢোকানোর পরে দেখলাম আমার আগেই প্রফুল্ল চক্রবর্তীকেও ধরা হয়েছে। উনিই আমায় শিখিয়ে দিলেন, ওরা যাই জিগ্যেস করুক, তুই নিজের নাম, বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা ছাড়া আর কিচ্ছু জানিস না। খবরদার ! ভুলেও আর কারোর নাম বলবিনা ! তখনো রুনু গুহনিয়োগীর সাথে পরিচয় হয়নি আমার। আমাদের কেসের আই ও ছিলেন রবি কর বলে এক পুলিস অফিসার। একটা ঘরে আমাকে ঢোকানো হল। ভেতরে আরো জনা তিনেক ছিল। তাদেরই একজনকে জেরা শুরু করলেন রবি কর। বল কি জানিস ? সত্যি বলছি স্যার, কিচ্ছু জানিনা ! ক্যাঁথ করে এক লাথি। বল কি জানিস ? কিচ্ছু জানিনা স্যার ! আমি ছিলামই না ওখানে। তারপর, প্রথমে বেল্ট দিয়ে পরে কম্বলে মুড়ে লাঠি দিয়ে তাকে এমন বেধড়ক পেটানো শুরু হল যে তার তো দূরের কথা, আমারই বাথরুম পেয়ে গেল ! বলছি বলছি বলছি স্যার ! আর্তনাদ করে উঠলো লোকটি। বল এবার ! হাত দুটি জোড় করে সে পুনরায় বললো, আমি কিচ্ছু জানিনা স্যার !! এসব দেখে শুনে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হলেও প্রফুল্ল চক্রবর্তী আমাকে অভয় দিয়ে জানালো যে আজ ওরা নাকি আমায় পেটাবেনা। কারণ কাল আমাকে কোর্টে তুলতে হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমাকে তাদের হেফাজতে রাখার আর্জি পেশ করা হল এবং ম্যাজিস্ট্রেট সেটা মেনে নিয়ে আমাকে আরো পনেরো দিন পুলিশ-হাজতে রাখার নির্দেশ দিলেন। পুলিশের গাড়িতে চড়ে আবার ফিরে এলাম লালবাজার সেন্ট্রাল লক-আপে।
১৯৬৪ এর শেষে বা ১৯৬৫ এর প্রথমার্ধ থেকেই মাও-বাদ একটা লাইন হিসেবেই আসতে শুরু করে। চারু মজুমদারই এই লাইনের প্রথম সক্রিয় প্রচারক ও কর্মী ছিলেন। তাঁর মনে তখন ভারতের জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ২৮শে জানুয়ারী তিনি তাঁর প্রথম দলিল—“বর্তমান অবস্থায় আমাদের কর্তব্য” লেখা শেষ করলেন। এই লেখাতেই চারু মজুমদার পুরাতন পার্টি ফর্ম ভেঙে স্পষ্ট করে নির্দেশ দিলেন—প্রত্যেক পার্টি সভ্যকে অন্তত একটি করে পাঁচজনের সক্রিয় দল (Activist Group) তৈরি করতে হবে। দেখতে হবে এই দলের কেউ যেন পুলিশের চিহ্নিত লোক না হয়। গোপন বৈঠক ও পার্টির কাগজ-পত্র রাখার জন্য গোপন স্থান তৈরি করতে হবে। তৈরি করতে হবে নির্দিষ্ট যোগাযোগ-রক্ষাকারী ব্যক্তি। এই সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরই কোনও ব্যক্তিকে পার্টি সভ্য করা যাবে। গভীর প্রত্যয়ের সাথে তিনি বলেছিলেন, এই সংগঠনই আগামী যুগে বিপ্লব সংগঠনের দায়িত্ব নেবে। বিপ্লবী কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা কি হবে, এ প্রসঙ্গে চারু মজুমদার বলেন—ভারতের বিপ্লবের প্রচার আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য হবে কৃষি বিপ্লব সফল করা।
(চলবে)
জীবনের সোনা ঝরা দিনগুলি , স্বপনদা, আপনি তাহলে, ভালোই রক্ত ঝরিয়েছেন । আপনি নিশ্চয় কমঃ চারু মজুমদারের মেয়ে পৃথা মজুমদারকে চেনেন । শেষ অবধি জানার অপেক্ষায় রইলাম ।
ReplyDeleteবেলাল ।