0

প্রবন্ধঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in



প্রবন্ধ 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট পুরুষ চরিত্রগুলির প্রাসঙ্গিকতকা 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী



আমাদের মনে আছে, ‘জীবনস্মৃতি’তে বলা সেই মানুষটির গল্প, যে বলতো ঈশ্বরকে তার চোখের সামনে সে বিজবিজ করতে দেখে । এমনটা যে দেখে, তার নিরন্তর সামীপ্য কাউকে বিব্রত করে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট । বিব্রত হতেনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । পছন্দ হতো না তাঁর কাজ-নষ্ট করে দেওয়া সেই খ্যাপা সংসর্গ । কিন্তু আমরা জানতে পারি, কোনো একদিন দুপুরবেলায় সেই একই মানুষের আবির্ভাবে ‘সম্পূর্ণ আনন্দিত’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি । সহৃদয় অভ্যর্থনায় ডেকে নিয়েছিলেন কাছে । 


‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময় । তারে জেনে তাঁর পান়ে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি ।’ 


অচলায়তন-এ আয়তনের গুরু ও দর্ভকদের গোঁসাই, শোনপাংশুলদের দাদাঠাকুর, পঞ্চকের দাদাঠাকুর-গুরু, অচলায়তনের দেওয়াল ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে তার ভিতের উপর নতুন সৌধ গড়ে তুলতে সবাইকে কাজে লাগিয়েছেন । রক্তকরবী-তে নন্দিনীর প্রেরণায় যক্ষপুরীর রাজা ধ্বজাপূজার দিনে ‘মহাপবিত্র ধ্বজদণ্ড’ ভেঙে আরও অনেক ভাঙ্গার সঙ্গী হতে আহ্বান জানায় নন্দিনীকে। সমাজের অচলায়তন ভেঙে তার উপর নতুন শ্বেতসৌধ নির্মাণ সম্ভব কি না কিংবা দমন-পীড়ণ, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-স্বৈরাচারের প্রতীক যক্ষপূরীর ধ্বংসসাধন কবে হবে, এই প্রশ্নের চাইতে ‘ওরে মন হবেই হবে’ –এই প্রত্যয়ই মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে উদ্বুদ্ধ করে । মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তাকে দুঃসাহসী করে তোলে । তাকে পৃথিবীর সব চাইতে শক্তিধর ‘রাজ’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার শক্তি দেয় । 


‘হিন্দুয়িজম’ – এর প্রবক্তা ‘গোরা’ পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত জাতি-বর্ণ-কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন করে ভারতবর্ষকে চিনিয়েছিলেন । গোরা আইরিশ বংশজাত । খ্রিস্টান মায়ের সন্তান হয়ে পালিত হলো সংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত আনন্দময়ীর আবেষ্টনে । গোরা ব্যাপটাইজড হয়ে খ্রিষ্টান হয়নি । গোরার বলিষ্ঠ দেহ, দৃপ্ত চলন, গম্ভীর কণ্ঠ, প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং সর্বাতিক্রমী চরিত্র বাঙালীর এমনকি কোনো ভারতীয়ের সঙ্গে মেলানো মুশকিল । স্বদেশের প্রতি অন্ধভক্তি গোরার । আচরণ প্রায় মৌলবাদী । রাস্তায় ঘাটে ইংরেজদের সঙ্গে মারামারি করার জন্য মুখিয়ে থাকে । তবে সে হিংসাবাদী নয় । সে সংগঠন তৈরি করে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে দেশের অভ্যন্তর দেখতে বেরিয়ে পড়ে, জেলেও যায়, তর্ক বিতর্ক লেখালিখিও চলে সেইসাথে । স্বদেশের প্রতি অন্ধভক্তি গোরার । আচরণ প্রায় মৌলবাদী । বিনয় বোঝে, গোরা হিঁদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না । সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এক খুব বড়ো রকম করে দেখে । হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতান্ত শৌখিন প্রাণ – অল্প একটু ছোঁয়াছুঁয়িতেই তা শুকিয়ে যায়, গোরা সেটা কিছুতেই মনে করে না । গোরা দিনের পর দিন গ্রামে কাটিয়েছে । সে দেখেছে ভদ্র শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে আমাদের দেশটা কেমন । গোরা দেখেছে, পবিত্রতাকে বাইরের জিনিস করে তুলে ভারতবর্ষে অধর্ম করা হচ্ছে । উৎপাত ডেকে এনে মুসলমানকে যে-লোক পীড়ন করছে তারই ঘরে জাত থাকবে আর উৎপাত স্বীকার করে মুসলমানের ছেলেকে যে রক্ষা করছে এবং সমাজের নিন্দাও বহন করতে প্রস্তুত হয়েছে তারই ঘরে জাত নষ্ট হচ্ছে ! এসব দেখেই গোরা নাপিতের ঘরে আহার সেরে বললো, ‘আমি তোমার এখানে দু-চার দিন থাকবো ।’ নাপিত জানে গোরা সেখানে থাকলে তাদের আর রক্ষা থাকবে না । গোরা এই ভয়কেই কাপুরুষতা মনে করে । গোরাকে আমরা বলতে শুনি, ‘আমি আজ ভারতবর্ষীয় । ......এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন ।’ 


গোরা একবার পরেশবাবুকে বলে, ‘অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না । অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অন্তকে আশ্রয় করেছেন – নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায় ? যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই । বাক্যের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ ।’ গোরার মুখের এই ভাষ্যের মধ্যে এক সত্যতা, এক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে । গোরা বারবার এই কথা প্রচার করে এসেছে যে, পৃথিবীতে অনেক প্রবল জাতি একেবারে ধ্বংস হয়েছে । ভারত কেবলমাত্র সংযমেই, কেবল দৃঢ়ভাবে নিয়ম পালন করেই, এত শতাব্দীর প্রতিকুল সংঘাতেও আজ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে এসেছে । আমরা দেখি, সুচরিতাকেই যেন বিশেষভাবে সম্বোধন করে গোরা বলে, ‘একথা নিশ্চয়ই জানবেন ভারতের একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সার্থক হবে । ভারত রক্ষা পাবে । আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ, আপনি ভারতবর্ষের ভিতরে আসুন, এর সমস্ত ভালমন্দের মাঝখানেই নেবে দাঁড়ান – যদি বিকৃতি থাকে তবে ভিতর থেকে সংশোধন করে তুলুন কিন্তু একে দেখুন, বুঝুন, ভাবুন, এর দিকে মুখ ফেরান, এর সঙ্গে এক হোন ।’ গোরার কণ্ঠে আমরা শুনি, ‘আমাদের ধর্মতত্ত্বে যে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধা প্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমরা জাগ্রত করতে চাই । আমি তার মাথা হেঁট করে দেবো না, নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলবো না, এই আমার পণ ।’ চরঘোষপুরের ঘটনার ভিতর দিয়ে গোরার সমাজদর্শন আজও প্রসঙ্গ হারায় না ।


‘ডাকঘর’ নাটকের অমল বলেছিলো, বড় হয়ে সে কি করবে । বলেছিলো, ‘যা আছে সব দেখব – কেবলি দেখে বেড়াব ।’ পিসেমশাই অবাক হয়েছিলেন শুনে । বলেছিলেন, ‘শোনো একবার ! দেখবে কী ? দেখবার এত আছেই বা কী ?’ সত্যিই তো, দেখবার এত আছেই বা কী ! জীবনের ছবি বলি বা প্রকৃতির, প্রাত্যহিক অভ্যাসে তাকে তো আমরা পেয়েই চলেছি প্রতি মুহূর্তে । সে তো আমাদের অতিপরিচিত আর তাই অতিজীর্ণ । এই যে আমরা বড় রাস্তাটা ধরে প্রত্যহ যাচ্ছি কিছু মানুষজন গাছপালা এবং দোকানপসারের পাশ কাটিয়ে, সেখানে নতুন করে দেখার আর কিছু বাকী থাকে নাকি ? আবার কোনো পিসিমা যাদি জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙেন, লেজের উপর ভর দিয়ে কাঠবেড়ালি যদি কুটুস কুটুস করে খেয়ে যায় খুদগুলো, কিংবা দূরে দেখা যায় কোনো এক পাহাড়চুড়ো, বাঁশের লাঠির আগায় পুঁটুলি বেঁধে ঘটী হাতে সেই পাহাড়ের দিকে যদি চলে যেতে থাকে একজন মানুষ । এসবের মধ্যে আমরা যা যা দেখি অমলের দেখতে পাওয়াটা যে আরও একটু এগিয়ে চলে । সে দেখে, পাহাড়ের উপর থেকে কাঁধে চিঠির থলি নিয়ে লন্ঠন হাতে নেমে আসছে এক ডাক-হরকরা, নদীর ধারে জোয়ারির খেত, আখের খেত, খেতের মধ্যে ঝিঁঝিঁপোকা, লেজ দুলানো কাদাখোঁচা । ঠাকুরদা শুনে বলেছিলেন, ‘অমন নবীন চোখ তো আমার নেই তবু তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখতে পাচ্ছি ।’ চোখের এই নবীনতা শুধু বয়সেরই নবীনতা নয় । সব বয়সের মধ্যে সে-নবীনতা উদ্যত থাকতে পারে । যে-কোনো বস্তু বা ঘটনাকে যখন সময়ের প্রবাহের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে দেখতে পাই তখনই চোখের নবীনতা আসে । বর্তমানের এই মুহূর্তটাকে যদি অতীত করে ভাবি কোনো ভবিষ্যতের দিকে সরিয়ে নিয়ে তবে সে তখনই এক নতুন রূপ ধরে । তার চারপাশে তৈরি হয়ে ওঠে এক মায়ামণ্ডল । তখনই দেখা যায় একই সঙ্গে মিলে যায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ । থাকার সঙ্গে মিলে যায় না-থাকা, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় মৃত্যু ।


‘রাজা’ নাটকে ঠাকুরদা দেখেছিলেন, এমনকী সুদর্শনাও দেখেছিলেন, ‘কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, যা ঘুমের মতো, মূর্ছার মতো, মৃত্যুর মতো ।’ মনে পড়ে মৃত্যুপথযাত্রী যতীনের কথা, ‘দেখার জনিসকে দেখতে পাবার সৌভাগ্য কি কম ?’ সে বলেছিলো, ’তারই ভালো লাগার ভিতর দিয়ে এই পৃথিবীটা আমি অনেক ভোগ করেছি ।’ আবার আত্মহত্যার কিনারায় দাঁড়ানো অভিজিৎ বলেছিলো, ‘সুন্দর এই পৃথিবী । যা কিছু আমার জীবনকে মধুময় করেছে সে সমস্তকেই আজ আমি নমস্কার করি ।’ আবার মরণোদ্যত জয়সিংহ বলেছে, ‘সুন্দর জগৎ’ । মরণমাধুর্য আর জীবনসৌন্দর্যে সে একাকার করে নেয় তার অন্তিম মুহূর্তগুলিকে । যখন বুঝতে পারি প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যু, তখনই জীবনকে নিজের মুঠোর মধ্যে ধরতে ইচ্ছে করে আরও । তবে, সে-মুঠো আমার ব্যক্তিগত মুঠো নয়, সে এক আত্মগত মুঠো, সেই আত্ম, যে কেবলই আমাকে নিয়ে আসতে চায় দৈনন্দিন আমি-র বাইরে । 


ভালোবাসা দিয়ে যে শত্রুকে জয় করা যায় তলোয়ার দিয়ে নয় ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’-এ বসন্ত রায় তা জানতে পেরেছেন পাঠানের মুখে । পাঠান ঘাড় নেড়ে চোখ বুজে বসন্ত রায়কে বলে, ‘একটি বয়েৎ আছে যে, তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায় ।’ বসন্ত রায় বলে উঠলেন, ‘কী বলিলে খাঁ সাহব ? সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায় ! কী চমৎকার !’ পাঠান এসেছিলো বসন্ত রায়কে মারতে । বসন্ত রায়ের সেতার শুনে পাঠানের শত্রু থেকে মিত্র হতে বেশী দেরী হয়নি । তাই সে বলেই দিলো এখানে আসার উদ্দেশ্য, ‘হুজুর, আশ্বাস পাই তো একটা কথা বলি । আমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রজা । মহারাজ আমাকে ও আমার ভাইকে আদেশ করেন যে আপনি যখন যশোরের মুখে আসিবেন, তখন পথে আপনাকে খুন করা হয়।’


‘রাজার্ষি’ তে ঈশ্বরের পদে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে দেওয়াতেই যে আত্মতুষ্টি হয় সে কথা ফুটে ওঠে স্বয়ং রাজার মুখে । রাজা ধ্রুবের আদেশমতে একবার মাথার মুকুট খুলছেন আবার পরছেন । ধ্রুব মহারাজের এই দুর্দশা দেখে হেসে অস্থির হচ্ছে । রাজা তখন হেসে বললেন, ‘আমি অভ্যাস করিতেছি । তাঁহার আদেশে এ মুকুট যেমন সহজে পরিতে পারিয়াছি, তাঁহার আদেশে এ মুকুট তেমনি সহজে খুলিতে পারি । মুকুট পড়া শক্ত, কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা আরও কঠিন ।’


‘চোখে বালি’তে বিনোদিনীর থেকে মোহমুক্তি ঘটার পর মহেন্দ্র বুঝতে পারলেন, যাবতীয় শান্তি প্রেম এবং স্নেহ পাওয়া যায় একমাত্র নিজের বাড়িতেই । বিহারীর আশৈশব অটলনির্ভর বন্ধুত্ব তাঁর কাছে দুর্লভতম অমৃত বলে মনে হয় । বিনোদিনীর পেছনে ছুটে এতকাল তিনি যে নিজেকেই অপমানিত করে চলেছেন, ‘আমি সর্ব্বাংশেই বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তবু আজ আমি সর্বপ্রকার হীনতা ও লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া ঘৃণিত ভিক্ষুকের মতো তাহার পশ্চাতে অহোরাত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছি, এমনতরো অদ্ভুত পাগলামি কোন শয়তান আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে ।’ তারপরই মোক্ষ্যলাভের কথাটা বের হয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে, ‘যাহা যথার্থ গভীর এবং স্থায়ী, তাহার মধ্যে বিনা চেষ্টায়, বিনা বাধায় আপনাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করিয়া রাখা যায় বলিয়া তাহার গৌরব আমরা বুঝতে পারি না – যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি ।’ 


দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট চরিত্রগুলি থেকে কি পাওয়া গেল তা এবার আলোচনা করে দেখা যাক -


অচলায়তন’এর গুরু তখনকার দিনের যে সামাজিক চিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন এবং যাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন শ্বেতসৌধ নির্মান করে তুলতে বলেছেন তা আজও প্রখরভাবে বিদ্যমান এই স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তরে । আজও দেখতে পাই আমাদের এই নব্য সমাজের বহু স্তরে দমন-পীড়ন, শোষন-বঞ্চনা, অত্যাচার-স্বৈরাচার নিরন্তর ঘটে চলেছে । 


গোরা যে চোখে ভারতবর্ষকে দেখেছে তা স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । আজও ভারতের বহুস্থানে ধর্মের পবিত্রতাকে বাইরের জিনিস করে তুলে অধর্ম করা হচ্ছে । বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গোধরা কাণ্ড, ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি নানান ঘটনা আজও ঘটে চলেছে । অর্থাৎ ধর্মের নামে অধর্ম করা চলেছে প্রায় সেই সমান তালেই । শিল্প দিয়ে, জীবন দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন দেখার সেই দৃষ্টি । দেশকালের মধ্যে রেখেও সবকিছুই দেশকালের বাইরে থেকে পাওয়া যায় যাতে । 


জীবনকে তার স্বরূপের মহিমায় দেখার জন্যে আমাদের কি কবি বা ভাবুকই হতে হবে ? আমাদের সাধারণ মানুষেরও দৃষ্টির মধ্যে অমলের সেই তরুণতা বা নবীনতা কি এসে পৌঁছতে পারে না কখনোও ? পারে কিন্তু পারছে না । আর পারছে না বলেই আমরা আজ সেই দেখার চোখটাকেই হারিয়েছি যে-চোখে অমল দেখতো । আমারা সেই দেখার চোখ হারাচ্ছি শৈশব থেকেই নানান চাপে পড়ে । পড়াশোনার চাপ, আধুনিক বাবা-মায়েদের পছন্দমাফিক নিজেদের গড়ে তোলার চাপ, সামাজিক পরিকাঠামোর চাপ, শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছুর চাপে পড়েই এখনকার শিশুরা হারিয়ে বসেছে তাদের কল্পনার জগৎটাকে । তারা এই জগৎটাকে আর দেখে না অমলের মতো করে । আর এখানেই অমলের চরিত্রটি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে এবং বিরাট একটা আঘাত হানছে আমাদের এই নব্য সমাজের কচিকাঁচাদের নবীন জীবনে । তারা হয়ে উঠছে এক একটা যন্ত্রমানব । আমরা যে ‘হাজার হাজার বাস্তবে খণ্ড খণ্ড করে একটার পর আর-একটাকে দেখে চলেছি’ – সেইখানেই আমাদের ব্যর্থতা ।


‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ এর পাঠান চরিত্রটিও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে আজকের এই নব্য সভ্য সমাজে । আজ আমরা স্বেচ্ছায় ভুলেছি যে, ‘তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়’ অর্থাৎ ভালোবাসা দিয়ে শত্রুর মন জয় যে করা যায় তা আজ আর মানতে রাজী নই । তার বদলে শিখেছি ‘মারের বদলে মার’ বা ‘রক্তের বদলে রক্ত’ । আমরা শান্তি চাই না । চাই নিজেদের শক্তিশালী প্রতিপন্ন করতে । যার পরিণামে হত্যালীলা আজ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে এই পৃথিবীর বুকে । আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজী নই । 


অন্যদিকে আবার যতই সভ্যতার শিখরে উঠি না কেন ‘চোখে বালি’র মহেন্দ্র আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । আমরা আজও ‘যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকে চরম কামনার ধন মনে করি’ । মহেন্দ্রর মতোই মোহমুক্তি ঘটার পর বুঝতে পারি, যাবতীয় শান্তি প্রেম এবং স্নেহ পাওয়া যায় একমাত্র নিজের বাড়িতেই । ‘রাজার্ষি’তে মহারাজের বলা কথা - ‘মুকুট পড়া শক্ত, কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা আরও কঠিন’ – এই চিরন্তন সত্য কথাটি কোনোকালেই প্রাসঙ্গিকতা হারায় না । 


অশীতি-উত্তীর্ণ জীবনের অন্তত ষটাধিক দশকের অবিচ্ছিন্ন নিরন্তর আত্মসন্ধিৎসা, আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মপ্রকাশের সমবেত ফল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর গল্প/উপন্যাস/নাটকের পুরুষ চরিত্রগুলি থেকে তাঁর দার্শনিক মনকে ছোঁয়া যায় । পাওয়া যায় তাঁর দূরদৃষ্টির প্রগাঢ় আভাস । স্বনির্মিত সেইসব চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি যা যা বলতে চেয়েছেন তার বেশীরভাগই আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । 








0 comments: