বিশেষ রচনাঃ শৌনক দত্ত
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
বৈষ্ণব সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ
শৌনক দত্ত
সুস্মি থাকতে সুস্মির কাছে লেখা খুব একটা কেউ নিতো না। ওর চলে যাবার পর ওর লেখার কদর বেড়েছে। গতকাল রবীন্দ্র জয়ন্তীতে গিয়েছিলো বাসু। এর আগে বহুবার সুস্মি আর বাসু এসেছে নন্দনে, কেউ ফিরেও তাকায়নি। অথচ কাল বাসুর কাছে এগিয়ে এসে কত চেনা অজানা মুখ কথা বলে গেছে। কেউ কুশল বিনিময় করে গেছে। কেউ কেউ তো আবার সুস্মির লেখা চেয়ে বসেছে। বাসু আজ সকাল থেকেই সুস্মির লেখা নিয়ে বসেছে। অনেক লেখার ভীড়ে রবীন্দ্রনাথ ও বৈষ্ণবসাহিত্য শিরোনামে একটি লেখা পেয়ে থামে বাসু। তারপর পড়তে থাকে।
রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রত্যুষকাল থেকে প্রদোষকাল পর্যন্ত বৈষ্ণবপদাবলীর অনেক অবিস্মরণীয় পংক্তি ভিন্ন ভিন্ন তাত্পর্যে রবীন্দ্রসাহিত্যে দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে বৈষ্ণবপদাবলীর আবেদন চিরকালের এবং সেই আবেদন মূলত সাহিত্যিক। বৈষ্ণব কবিতা তাঁর মতে বৈকুন্ঠের গান নয়। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বৈষ্ণব পদাবলীর সাথে। ষোল থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মাঝেই রচিত ভানুসিংহের পদাবলী। এই কাব্য রচনার প্রেরণা সম্পর্কে বলা যায়, বৈষ্ণব কবিতার ভাষা মাধুর্য তার ছন্দের ঝংকার তার অপরূপ রসবৈচিত্র্য তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনকে একেবারে উন্মথিত করে দিয়েছিলো। প্রশ্ন জাগে কবি কেন ভানুসিংহের আড়ালে থেকে এই কাব্য লিখেছিলেন? উত্তরটি খুঁজতে রবীন্দ্রনাথের নিজের কৈফিয়ৎ পড়া যাক।
রবীন্দ্রনাথ ১২৮৬ এ ভারতী-র শ্রাবণ সংখ্যায় লিখছেনঃ 'একটি প্রাচীন ভাষায় রচিত ভালো কবিতা শুনিলে তাহারা বিশ্বাস করিতে চায় যে, তাহা কোনো প্রাচীন কবির রচিত। যদি তাহারা জানিতে পারে যে, সে সকল কবিতা একটি আধুনিক বালকের লেখা তাহা হইলে তাহারা কী নিরাশ হয়।....এইরূপ অবস্থায় একজন যশোলোলুপ কবি-বালক কি করিবে?'
সুস্মি কি যশোলোলুপ ছিলো? বাসু অতীত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুস্মিকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই সুস্মির যশোলোলুপতা খুঁজে পায় না। কিচেন থেকে ঠান্ডা কফির মগ হাতে বাসু আবার পড়ায় ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রাধা কৃষ্ণের প্রেম লৌকিক প্রেমেরই বলিষ্ঠ প্রকাশ। এই প্রেম বিশ্বব্যাপী। এই প্রেমই অধ্যাত্মশক্তির রূপক। সৌন্দর্য ও প্রেমের পূজারী। রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে প্রেমের অতল গভীরতা ও সৌন্দর্যের অসীমতা খুঁজে পেয়েছেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে বৈষ্ণব কবিতার উদ্ধৃতির সংখ্যা বৈচিত্র্য খুব বেশি নয়, প্রয়োগ বৈচিত্র্যই বিস্ময়কর। কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তার মুষ্টিমেয় কয়েকটি শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবপদের প্রসিদ্ধ অংশ বিশেষ রবীন্দ্রসাহিত্যে নানাভাবে ঘুরে ঘুরে দেখা দিয়েছে। সংখ্যায় তারা সামান্যই। কিন্তু প্রত্যেকবার একই উদ্ধৃতি নব নব বক্তব্যের তাত্পর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। এর ফলে উদ্ধৃতির অংশটুকু কেবল উদ্ধৃতিমাত্র না হয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের সংস্পর্শে এসে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হয়ে উঠেছে।
বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে চন্ডীদাসই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় কবি। চন্ডীদাসের পদের অব্যক্ত অর্থগৌরবের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন তাঁর 'চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি' প্রবন্ধে। চন্ডীদাসের পদের ব্যবহারও রবীন্দ্রসাহিত্যতে স্বভাবতই বেশি। কারণ চন্ডীদাসের পদের অর্থ তাত্পর্যের সম্ভাবনা অনেক। চন্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগ বা নিবেদনের এক একটি পদের অংশবিশেষ সেই পদের আবেষ্টনী ভেদ করে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় বিভিন্ন তাত্পর্যে উপস্থাপিত হয়েছে। ভানুসিংহের রাধার উক্তিতে যেখানে অভিলাষ পূরণের ইচ্ছাই প্রবল করে দেখা দেয়, কৃষ্ণই যেন রাধার আনন্দবিধানের উপায়। কৃষ্ণের আহ্লাদের তিনি কারণ হন না। "বঁধূয়া, হিয়া পেরে আওরে মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মৃদু ভাষয়ি হমার মুখ পরে চাওরে।" সেখানে চন্ডীদাসের রাধা বলে- "বহুদিন পর বঁধূয়া এলে। দেখা না হইতে পরাণ গেলে। একে সহিল অবলা বলে।" পদাবলীর রাধা প্রিয়মিলনের সময় এত কথা বলতে পেরেছেন কি? যে রাধা বঁধূয়ার দর্শনে আনন্দে মূর্ছা যান, মিলিত অবস্থায় যিনি বিরহ অনুভব করেন, এ রাধা সে রাধা নন।
লেখা থেকে চোখ তুলে দেয়ালে তাকায় বাসু। সুস্মির ছবির দিকে চোখ পড়তেই বুকটা হু হু করে উঠে তার। সুস্মির অকাল প্রয়াণকে আজো সরল ভাবে মেনে নিতে পারেনি বাসু। শিঞ্চন তাকে এখনো মানসিক রোগী হিসেবেই ট্রিট করে। অথচ কাউকে সে বলতেও পারেনা, সুস্মি কোত্থাও যায়নি। সুস্মি তার সাথেই আছে, তার পাশে।
0 comments: