0

ছোটগল্পঃ সুভাষ মিত্র

Posted in


ছোটগল্প 





সেলাম কোলকাতা 
সুভাষ মিত্র



অনেক বছর আগের কথা, ইংরেজি ১৯৬৯ সাল। দুই বছর আগে স্কুল গণ্ডি শেষ, খুব নিকট কয়েকজন বন্ধু মিলেই আমাদের আড্ডা। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল, কখন যে কি ঘটে যায় কেউ জানে না। রাস্তাঘাটে চলতে গেলে চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে সাবধানে চলতে হত, আমরা ওই কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু খুব সাবধানে থাকতাম, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মেপে মেলামেশা করতাম, শাসক দল, নকশাল, বিরোধী দল সবাই তুঙ্গে। এক এক পাড়া এক এক দলের দখলে, কোন পাড়ায় অচেনা মুখ দেখলেই নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ, কোন পাড়া থেকে আসছি, এ পাড়ায় কেন এসেছি, কি নাম, কোথায় বাড়ি, বাড়িতে কে কে থাকে,  যেন কোর্টমার্শাল হচ্ছে। স্কুল, কলেজ জীবনের খাতিরে আমরা একটা বড়সড় এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম, ভবানীপুর, কালীঘাট, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, এর বাইরে আমরা সহজে যেতাম না, কোন নিমন্ত্রণ বাড়ি এলাকার বাইরে হলে, সেখানের একজন আমাদের সঙ্গে পরিচিতি হিসাবে থাকতে হত। প্রায়শই খুন, লোপাট হয়ে যাওয়া লেগেই থাকত।

আমাদের প্রধান আড্ডা ছিল ম্যাডক্স স্কয়ার আর দেশপ্রিয় পার্ক। আমি, সুজয়, কালি, ধ্রুব, মলয়, বিভাস, এই কয়েকজন খুব অন্তরঙ্গ। অন্যরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত, তবে পাড়ার ও স্কুলের বন্ধু হওয়ার খাতিরে আমাদের সঙ্গে কোন তিক্ততা ছিল না। বরং কোন গণ্ডগোল হওয়ার উপক্রম হলে আমাদের সাবধান করে দিত। আমাদের বাড়ির শাসন, খুব কড়া থাকার জন্য আমরা প্রত্যক্ষ  ভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু নিজেদের বন্ধুদের মধ্যে কারো কোন বিপদে আমরা সকলেই সকলের সাহায্যে এগিয়ে যেতাম, 
কোন ভেদাভেদ ছিল না। 

এমন একটি দিনের ঘটনা, এখন যেটা যতিন দাস পার্ক, আগে তার নাম ছিল হাজরা পার্ক, হাজরা পার্কের কাছে একটি সিনেমা হল এখনো আছে, বসুস্রী, তার পিছনে একটি সিনেমা হল ছিল, নাম ছিল কালিকা, এখন সেটা নেই, ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। তখন আমাদের পকেটে পয়সা কম, পিতার হোটেলে থাকি, খাই, টিউশন করে মাসে যা পাই তাতে ভালোভাবে হাতখরচ চলে যায়। কালিকা হলে টিকিটের দাম কম ছিল, সেদিন ওই হলে একটা খুব পুরান বই চলছিল, মনে আছে নাম টা 'শ্রী ৪২০', ফাটাফাটি বই, রাশিয়া তেও হিট বই। বিকাল ৫টায় আরম্ভ, শেষ হতে রাত্রি ৮টা, তখন বেশির ভাগ বই ওই রকম সময়ই নিত। তখন সব সিনেমা হলেই বই শেষ হলে, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত শুনিয়ে দরজা খুলত। 

রাত্রি ৮টা দুই, আমরা বাইরে বেরুচ্ছি, একটা গোলমাল চেঁচামিচির আওয়াজ, একটি মাঝারি বয়সের ছেলে রোগা গায়ে একটা টিশার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে একটা ব্যাগ, দৌড়াচ্ছে, পিছনে তিনটি মস্তান গোছের ছেলে আগের ছেলেটির পিছনে তাড়া করে দৌড়াচ্ছে। আমরা বন্ধুরা একটু থমকে গেলাম, কয়েক সেকেন্ড, একটু সামনে থেকে আর্ত চিৎকার, বাঁচাও, মেরে ফেলবে। আমরা সাহস করে দৌড়ে গেলাম, বীভৎস দৃশ্য, তিনটি মস্তান বেপাত্তা, রোগা ছেলেটি মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে, কোমরের পাশে গভীর ক্ষত, রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। আমরা দেখলাম এই সময় ছেলেটির চিকিৎসা নিতান্ত দরকার, কেউ এগিয়ে আসছে না, আমদের মধ্যে দুইজন, কালি আর ধ্রুব, একটি রিক্সা থামিয়ে ছেলেটিকে পাঁজকোলা কোরে তুলে কাছেই একটি হসপিটাল এর দিকে রওনা হল, আমরা বাকি চারজন পিছনে অন্য ভাবে রওনা হলাম, হসপিটালে  পৌঁছে এমারজেন্সিতে নিয়ে গেলে, একজন মধ্য বয়স্কা সিস্টার, আমাদের কাছে সব শুনলেন, এমারজেন্সি  বেডে  শুইয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে একজন জুনিয়র ডাক্তার কে ডেকে আনলেন।  আমাদের আবার নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল আমরা আগে ছেলেটির চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে অনুরোধ করাতে আমাদের দিকে একটু বক্র দৃষ্টিতে দেখে আমাদের পাশের একটি ঘরে বসতে বলে, সিস্টার কে কিছু বললেন, আর ছেলেটিকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে হঠাৎ সেই মধ্যবয়স্কা সিস্টার বেশ ভয়ার্ত ভাবে এদিক ওদিক দেখে আমাদের বললেন, তোমরা কি করো, কোথায় থাকো। সব শুনে তিনি বললেন, আমারও তোমাদের মত দুটি সন্তান আছে, তোমাদের দেখে, কথা শুনে বুঝলাম, তোমরা নিরীহ, আহত ছেলেটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছো।খুব ভালো কাজ। কিন্তু এখন রাজনৈতিক হাওয়া খারাপ। আহত ছেলেটি এখন অজ্ঞান অবস্থায়, ছেলেটির জবানবন্দি নেওয়া সম্ভব নয়, ডাক্তার পুলিশে খবর দেবেন, তোমরা ঝামেলায় পড়বে আমার সঙ্গে এসো, পিছনে একটি ছোটো গেট আছে, আমরা যাওয়াআসা করি, সাধারণ লোক জানে না, তোমরা ওই গেট দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পার, পালাও। আর তোমাদের একজনের গায় জামাতে রক্তের দাগ লেগেছে, জামাটি খুলে ফেল, গেঞ্জি পরে চলে যাও, দেরি কোরো না। আমরা পড়িমরি করে সেখান থেকে চলে গেছিলাম, ছেলেটির কি হল আর জানার সৌভাগ্য হয় নি।

পরদিন সংবাদ পত্রে একটি ছোটো খবর দেখলাম, গতকাল নকশালদের ছুরিকাঘাতে, শাসক দলের একটি কর্মী খুন, কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তাহাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে ঊধাও, পুলিস তদন্ত চলছে, যারা আহত ছেলেটিকে হসপিটালে নিয়ে এসেছিল, তাদের পরিচয় এখন জানা যায় নি, তদন্ত চলছে।

0 comments: