2

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক




বানরায়ণ, পর্ব ৬
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



জঙ্গলের পথ দিয়ে চলেছিলাম আমরা বত্রিশ জন। সঙ্গে নিজের জিনিষ বলতে পরনের চামড়া গুলো আর অস্ত্রশস্ত্র, মানে তীরধনুক আর বর্শা। এই সব পথ আমাদের অতি পরিচিত। কোথায় জল পাওয়া যায় আর কোথায় শিকার, সে সব আমাদের নখদর্পনে। যেখানে সেনা নিয়োগ শিবিরের কথা সম্বর্তরা বলে গিয়েছিলো, সে জায়গাটাও চেনা। মুন্দার আর কবেরু গাঁয়ের লাগোয়া যে দিগন্তজোড়া মহিষ চরার মাঠ, সেই মাঠে। তাম্বলি থেকে দিন দুয়েকের পথ।

কুবো পাহাড় পার হতেই দেখা হলো আরেকটা দলের সঙ্গে। এরা ছিম্বু গাঁয়ের লোক। আমাদেরই মতন জনা ত্রিশেক পুরুষ চলেছে কিষ্কিন্ধার রাজকীয় বাহিনীতে নাম লেখাতে। এদের সঙ্গে আমাদের বহুদিনের সুসম্পর্ক। তাম্বলি আর ছিম্বুর শিকারীরা বহুবার এক সঙ্গে শিকার করেছে। পরবের দিনে এগ্রাম ওগ্রামের যাতায়াত আছে। আমাদের পুরুষদের সঙ্গে ওদের মেয়েরা ঘর বেঁধেছে। উল্টোটাও হয়েছে। তাই ওরা সবাই প্রায় আমাদের সবার চেনা।

আমরা একসঙ্গে পথ চলা শুরু করলাম। এতজন একসঙ্গে চললে বনের পথে একটু অসুবিধা হয়। শিকার পালিয়ে যায়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যৎটা এতই অনিশ্চিত এবং উত্তেজক, যে সে বিষয়ে আলোচনা করার জন্য নতুন লোকের সান্নিধ্যের লোভ এড়ানো গেলো না। সম্বর্ত আর তার দল ছিম্বু গ্রামেও গেছে। একই কথা বলেছে ওদেরও। একই স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেই স্বপ্নের টানে এরাও বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে।

আমরা আলোচনা করতে করতে পথ চলছিলাম। ছিম্বু গ্রাম থেকে আমার বয়সী দু’জন ছিলো। দুরন আর মণ্ডু। দু’জনকেই আমি চিনতাম। ওরা দু’জন আর আমাদের গ্রাম থেকে মাহারু, গোর্তন আর আমি একটা আলাদা ছোট দল হয়ে গেলাম। বলা বাহুল্য, পাঁচজনের কারওই মা হয় বেঁচে নেই, নয় তো অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘর বেঁধে চলে গেছে। তাই আমাদের কারওই কোনও পিছুটান নেই। নতুন ভবিষ্যতের অজানা উত্তেজনার নেশায় মহানন্দে একসঙ্গে পথ চলা...

প্রথম রাতটা আমরা মুরুণ্ডি পাহাড়ের গুহায় কাটালাম। এই গুহাগুলো রাত্রিবাসের জন্য শিকারীরা যে সেই কোন কাল থেকে ব্যবহার করে আসছে, কেউ তার খবর রাখে না। মানুষের নিয়মিত উপস্থিতির স্পষ্ট চিহ্নের জন্য পশুরাও এই সব গুহা সাধারণত এড়িয়ে চলে। ব্যবহার করার মতন অনেকগুলো গুহা আছে। আমাদের পুরো দলটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে তিনটে গুহার দখল নিলাম। সে রাতের খাওয়া দাওয়া সঙ্গে যা ছিলো তাই দিয়েই মোটামুটি হয়ে গেলো। পথে আমাদের বুগা আর মঙ্গন ক’টা বনকুঁকড়ো মেরেছিলো তীর দিয়ে। সে গুলোকেও আগুনে ঝলসে সদ্ব্যবহার করা গেলো। তারপর গুহার ভিতর আগুন ঘিরে বসে কিছুক্ষণ অজানা ভবিষ্যতের জল্পনা... আর তারপর পথশ্রমে চোখ ভেঙে আসা ঘুম।

পরদিন সকাল থেকে আবার যাত্রা শুরু। তাড়াতাড়ি চললে রাতের আগেই পৌঁছনো যাবে মুন্দার গাঁয়ে। চলার গতি বজায় রাখার জন্য আজ আর কেউ বিশেষ কথা বলছিলো না। তাই অনেক রকম চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিলো। বার বার খালি মনে আসছিলো বুড়ো সোমুকের বলা সেই পুরুষের কথা... অনির্বাণ জ্যোতির্ময় পুরুষ... যে নিজের আলোয় আমাকে চিনে নেবে।

আজ শিকার করা প্রয়োজন। কারণ, সঙ্গের রসদ ফুরিয়ে গেছে। পথ চলতে চলতে দলের শিকারীরা তাই সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলো সে দিকে। কিন্তু কি যেন এক অজানা কারণে অদ্ভূতভাবে আরণ্যকরা সব চুপচাপ। যেন কেউ নেই কোথাও! গাছের মগডালে যে পাখিগুলো বসে থাকে ভোরবেলা, সেগুলোকে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না আমাদের শিকারীদের অভ্যস্ত চোখ। গেলো কোথায় সব?

বহু চেষ্টার পর কোনওক্রমে একটা বুড়ো হরিণ আর কয়েকটা খরগোশ শিকার করা গেলো। আমাদের পাগলা পাহান একটা কথা বললো, এবং সেটা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো আমুরি গ্রামে পৌঁছনোর পর। আমুরি গ্রামের লোকরা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আছে এই ‘নতুন উৎপাত’ কিষ্কিন্ধার সেনাশিবিরের উপর। কারণ, তাদের জ্বালায় নাকি সব শিকার এ অঞ্চল ছেড়ে পালাচ্ছে। তারা নাকি রোজ বড় বড় দল মিলে হই হই করে শিকারে বেরোয় আর যা চোখের সামনে পায়, তাই শিকার করে। আমরা বিস্মৃত কাল ধরে যে সব নিয়ম মেনে আসছি, অর্থাৎ শিকারী পশুদের শিকার না করা, ঘুমন্ত প্রাণীদের উপর অস্ত্রাঘাত না করা বা স্তন্যদায়ী মাদি পশুকে বধ না করা, সেই সব নিয়মের নাকি তারা পরোয়া করছে না।

মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। কেন এরা আমাদের হাজার হাজার বছরের পুরনো নিয়ম মানবে না? সে সব নিয়ম তো এমনি এমনি তৈরি হয়নি! জঙ্গলে তৃণভোজীর সংখ্যা শিকারী প্রাণীর থেকে অনেক বেশি। তাদের মাংসও শিকারীদের থেকে অনেক বেশী নরম, সুস্বাদু। এবং সব থেকে বড় কথা, জঙ্গলে শিকারীর সংখ্যা কমে গেলে তৃণভোজীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাবে, আর তখন জঙ্গলের গাছপালা, উদ্ভিদ আর তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য জুগিয়ে উঠতে পারবে না। এ কথা আমরা পরম্পরাগত ভাবে জানি। ঘুমন্ত প্রাণীকে যে মারতে নেই, সে কথাও কি কাউকে বলে দিতে হয়? কেমন যোদ্ধা এরা?

আমুরি গ্রাম থেকেও বেশির ভাগ জোয়ান পুরুষ চলে গেছে সৈন্যদলে নাম লেখাতে। যারা যায় নি, তারা চিন্তায় পড়েছে একটু। এভাবে আর বেশিদিন চললে এবার এদের রসদে টান পড়বে। তবে আশার কথা, আমদের তাম্বলি এ অঞ্চলের শেষ গ্রাম। এর পর আর কোথাও থেকে লোক আসার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ, এবার এদের শিবির গোটানোর সময় হয়ে এসেছে। সম্বর্ত বলেছিলো, আর দশ-বারো দিন থাকবে শিবির। তার মধ্যে পাঁচ দিন হয়ে গেছে। ওরা চলে যাবার পর চতুর্থ দিন আমরা বেরিয়েছিলাম।

আমুরি গ্রামের লোকেরা আমাদের আতিথ্য দিতে বিশেষ ঔৎসুক্য দেখালো না। ওদের নিজেদেরই টানাটানি। আমরাও খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না ওখানে রাত কাটাতে। আমুরি থেকে মুন্দার খুব বেশিক্ষণের পথ নয়। তাড়াতাড়ি চললে সূ্র্যাস্তের পরে পরেই পৌঁছনো যাবে। শেষ পথটুকু হয়তো মশাল জ্বালিয়ে চলতে হবে।

তাই হলো। সুর্যাস্তের পর মশাল জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ পথ চলার পর আমরা পৌঁছে গেলাম মুন্দার গাঁয়ে। বহুদূর থেকে কেমন যেন একটা লক্ষ লক্ষ মৌমাছির গুনগুনের মতন শব্দ ভেসে আসছিলো। যত এগোচ্ছিলাম, আওয়াজটা তত বাড়ছিলো। মুন্দারের কাছাকাছি আসার পর এত বেড়ে গেলো আওয়াজ, যে আমাদের কানে অসুবিধা হচ্ছিলো। এত জোর শব্দ শোনার অভ্যাস আমাদের জঙ্গলের মানুষদের কোনওদিন ছিলো না। সেই শব্দের মধ্যে যে কত শব্দ মিশে আছে, দূর থেকে সেটা বোঝা যাচ্ছিলো না।

মুন্দার পৌঁছে বুঝলাম, সে আওয়াজ সৈন্য শিবিরের। হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। তাদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি বহুদূর অবধি পৌঁছে যাচ্ছে এক অতিকায় মৌচাকের শব্দের মতন। সে শব্দের মধ্যে মানুষের কন্ঠস্বর এবং পশুর ডাক ছাড়াও আছে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে অস্ত্রের ঝনঝনা অবধি, আরও হাজার রকমের বিচিত্র শব্দের সমাবেশ। তখনও জানতাম না, এই শব্দই পরবর্তী বহুকালের জন্য হয়ে উঠবে আমার... আমাদের জীবনের আবহসঙ্গীত।

সে রাতটা আমাদের মুন্দার গাঁয়ের বাথান সংলগ্ন জমিতে খোলা আকাশের নীচে কাটলো। শিবিরে প্রবেশ নিষেধ, কারণ আমরা তখনও নথিভুক্ত সৈনিক নই। রাতের খাবার জোটানো একটু সমস্যা হয়েছিলো। সব গুলো গ্রামেই রসদের টানাটানি। সৌভাগ্যবশত আমাদের মোহক, পাহান আর ছিম্বু গাঁয়ের দুমনের সঙ্গে মুন্দারের সর্দার অম্বুর পরিচয় ছিলো খানিকটা। হরিণ আর খরগোশের ভেট পেয়ে অম্বু খুশি হলো, আর সেই সুবাদে মুখে দেওয়ার মতন কিছু ফল আর শুকনো মাছ জুটলো রাতে। 

পরদিন সকালে উঠে সৈন্যশিবিরের চেহারা দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম! আমরা যাকে মহিষচরা মাঠ বলতাম, সে মাঠে বোধহয় আর তিলধারণের স্থান নেই। সর্বত্র তাঁবু আর তাঁবু। সেই পূবদিকে, যেখানে আর তাঁবু নেই, সেখানে এদের বাথান। একদিকে গোরু-মোষ-ভেড়া-ছাগলের পাল। মাঝখানে চাঁচরির বেড়া। তার ওপাশে যে পশুর দল, তাদের আমরা কোনওদিন দেখিনি আগে। গোরু-মোষের থেকে আকারে বড়, লম্বা ঘাড়ের উপর কেশরের মতন লোম, আর রঙের বাহার! সাদা, কালো, খয়েরি, পাটকিলে, ছাই ছাই... কি রঙের যে সে পশু নেই, বলা কঠিন। দেখেই বোঝা যায়, আমাদের পরিচিত পোষা তৃণভোজীদের থেকে এদের তেজ অনেক বেশি। সত্যি কথা বলতে, যদি ঘাস খেতে না দেখতাম, হয়তো তৃণভোজী বলে পশুগুলোকে চিনতেই পারতাম না। পরে জেনেছিলাম, পশুগুলো ঘোড়া। এরা বলে অশ্ব।

একটু বেলায় শুরু হলো সৈন্যদলে নাম লেখানোর পালা। লেখাপড়া ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় ছিলো না এর আগে। শুধু জানতাম, বিন্ধ্যপাহাড়ের ওপাশের মানুষরা শুকনো তালপাতার উপর এক ধরনের কালো তরলে চোবানো পাখির পালক দিয়ে কি যেন আঁকিবুকি করে। সেই সব আঁকিবুকির নাকি অনেক দাম। দাম বস্তুটা সম্বন্ধেও আমাদের খুব স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। তাই এসব কথা শুনে আমাদের হাসি পেতো।

কিন্তু এখানে, এই সৈন্যশিবিরে এসে বুঝলাম এর প্রয়োজনীয়তা কোথায়। এত লোক যোগদান করছে রাজকীয় বাহিনীতে, তাদের সবার নাম-ধাম-বয়স ইত্যাদি মনে রাখা তো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সে সবের নথি থাকা প্রয়োজন। তাই লিখে রাখতে হয় সব কিছু। শুধু সৈনিকদের নাম-ধাম নয়, এই যে এত বড় শিবির, হাজার হাজার মানুষ আর পশু, তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ এবং আরও কত ব্যবহার্য জিনিসপত্র, সে সবেরও হিসেব রাখা প্রয়োজন। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে আমার এক মুহূর্তও লাগলো না। এবং সেই মুহূর্তে আমি ঠিক করে ফেললাম, ওটা আমাকে শিখতেই হবে।

সার দিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। সামনে একটা কাঠের পাটাতনের উপর বসে তিনজন লোক। এক একজন করে তাদের সামনে যাচ্ছে, তারা ভালো করে দেখছে, কি সব যেন জিজ্ঞেস করছে, লিখছে, আর তারপর তাদের আরেক দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কয়েকজন বিশাল চেহারার পাথুরে মুখওয়ালা লোক এই পুরো ব্যাপারটার তত্ত্বাবধান করছে। তাদের হাতে বড় বড় মোটা মোটা লাঠি। এবং গণ্ডগোল হলে সে লাঠি যে ঘাড়ে পড়তে সময় লাগবে না, সেটা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই সারবদ্ধ পিঁপড়ের মতন সুপরিচালিত হয়ে চলেছে নতুন সৈনিকের দল।

আমি গিয়ে পৌঁছতে তিনজনের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো। আমার শরীর চিরকালই বয়সের তুলনায় ছোটখাট। বোধহয় আমাকে দেখে বাচ্চা ভেবেছে। তখনও আমি জানতাম না যে এদের হিসেব অনুযায়ী আমার তখন ষোল বছর পেরিয়ে গেছে। তাই বয়স জিজ্ঞেস করাতে ঠিক করে বোঝাতে পারলাম না। এরা সন্দিগ্ধ ভাবে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করতে লাগলো। আমি প্রমাদ গুণলাম! নেবে না নাকি আমায়?

হঠাৎ পিছন থেকে পাগলা পাহানের গলা পেলাম। ‘‘ও খুব ভালো গাছ-পাহাড় বাইতে পারে। অনেক ওষুধ-বিষুধও জানে। ও আমাদের গুণীন সোমুক বুড়োর নাতি’’

তিনজন একবার পাহানের দিকে দেখলো। তারপর আমার দিকে তাকালো। একজন বললো, ‘‘যুদ্ধ খুব সহজ জায়গা নয় হে ছোকরা। একবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পড়লে অনেক বাঘা বাঘা পুরুষের হাঁটু কাঁপে। তুমি পারবে তো?’’

‘‘পারতে আমাকে হবেই।’’ আস্তে আস্তে বললাম আমি। ‘‘সেটাই ভবিতব্য।’’


2 comments:

  1. জমে ক্ষীর !! উত্তরোত্তর বাড়ছে আগ্রহের পারদ !! এরপর ??

    ReplyDelete
    Replies
    1. এরপর পরের সংখ্যার অপেক্ষা :)

      Delete