4

ছোটগল্পঃ অদিতি ভট্টাচার্য্য

Posted in


ছোটগল্প 



ডাইনি ঝোরা
অদিতি ভট্টাচার্য্য



নিজের চোখকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না তোর্সা। দু তিনবার দেখার পরও। এ কি সেই ঝোরাটাই! এই অবস্থা তার এখন! কোথায় সেই উদ্দাম জলধারা, সেই কলকল আওয়াজ, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই প্রতিশ্রুতি! এ তো যেন নিজের অস্তিত্বই কোনোক্রমে টিঁকিয়ে রাখা। সরু সরু তিন চারটে জলধারা এ পাথরের খাঁজ, ও পাথরের ধার ঘেঁষে ওপর থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে। এ তো যেন শুধু জানান দেওয়া, হ্যাঁ আমি এখনও আছি, তবে এই জরাগ্রস্ত ক্ষয়ে যাওয়া শরীরে। যৌবনের সেই উচ্ছলতা? সে আজ অতীত, শুধুই স্মৃতি।

বিস্মিত হতাশ তোর্সা বসে পড়ল একটা পাথরের ওপর। ঝোরাটার নীচের দিকে। নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইল জলের দিকে। স্থানীয় দু’চারজন মানুষ অবাক হয়ে ওকে দেখতে দেখতে চলে গেল। না, এ ঝোরার জল কোনো কাজে ব্যবহৃত হয় না, এ ঝোরা পরিত্যক্ত, এ ঝোরা অভিশপ্ত। তেমনই শুনেছিল তোর্সা, যখন প্রথম এসেছিল এখানে। কেমন ছিল ঝোরাটা তখন? মনে আছে তোর্সার, খুব ভালো করেই মনে আছে। আর তাই ম্লান হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। সে কত বছর আগের কথা?

তোর্সা তখন ছাত্রী। এস্কারশনে এসেছিল। পাহাড়ি লতা গুল্মের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসা। ঝোরাটা তখন ছিল প্রাণ প্রাচুর্যেভরা কিশোরীর মতো। কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল। সে ছিল তখন সদা ব্যস্ত, তাড়া ছিল তখন তার বয়ে যাওয়ার, কে জানে কোন নদীর বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। তখন বর্ষা সবে বিদায় নিয়েছিল। চারদিকে আর্দ্র শ্যামলিমার ছবি। ঘন সবুজ পাহাড়ের গায়ে চওড়া সাদা ফিতের মতো ঝোরাটা দেখে তোর্সা মুগ্ধ হয়েছিল। অবশ্য নদী, ঝর্ণা এসবের সঙ্গে তোর্সার বরাবরই গভীর প্রেম। নদীর নামে নাম বলেই কি? তোর্সা জানে না, জানে শুধু ওর ভালো লাগার কথা।

ঝোরার জল ছিটিয়ে সবাই খেলায় মেতে উঠেছিল। হলই বা এস্কারশন, এটুকু ছাড় তো আছেই।

“কী পরিষ্কার জল দেখ, যেন একেবারে স্বচ্ছ, নির্মল,” বলেছিল তোর্সা।

“এত স্রোত তো, তাই এত পরিষ্কার,” উত্তর দিয়েছিল আরেকজন।

এত গতির কাছে মলিনতা হার মেনেছে। এত স্রোত যে সেখানে সে টিঁকতে পারে না, ভেবেছিল তোর্সা। আর ঠিক তখনই এক অদ্ভুত কাহিনি শুনে বিস্মিত হয়েছিল। 

অঞ্জলি ভরে ঝোরার জল পান করতে গিয়েছিল তোর্সা আর তাই দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিল ড্রাইভার। ড্রাইভার স্থানীয় যুবক। ঝোরার গল্প সে ছোটোবেলা থেকে শুনে বড়ো হয়েছে। বিশ্বাস, সংস্কারে আচ্ছন্ন তার মন তাই বাঁধা দিয়েছিল তোর্সাকে ঝোরার জলপান করতে। কী যেন একটা নাম বলেছিল সে ঝোরাটার, তনহি ঝোরা না কী যেন। ঠিকঠাক এখন আর মনে পড়ছে না তোর্সার। শুধু এটুকু ভালোই মনে আছে যে বাংলা করলে তার মানে দাঁড়ায় ডাইনি ঝোরা।

“ডাইনি ঝোরা!” ওরা সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

ঝোরা আবার ডাইনি হয় কী করে? গ্রামবাংলায় অনেক অসহায় মহিলাদের ডাইনি অপবাদ দিয়ে অত্যাচারের ঘটনা খবরের কাগজে স্থান পায় বটে কিন্তু তাই বলে একটা ঝোরা ডাইনি! তা কখনো হয় নাকি!

হ্যাঁ তাও হয়। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অশিক্ষা, কুশিক্ষার অন্ধকারে তাও হয়। এ অঞ্চলে ডাইনিতে বিশ্বাস করার লোকেরও কমতি ছিল না। তোর্সারা এরকম শুনেছিল বটে। ড্রাইভারের গল্পেও তারই প্রমাণ মিলেছিল। ড্রাইভারের কাছে অবশ্য গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।

কবেকার সে ঘটনা? না, সাল তারিখের হিসেব সে দিতে পারে নি। কাছেরই এক গ্রামের ছেলে সে, ঘটনাটাও সেই গ্রামেরই। কোনো এক সময় সেই গ্রামে একের পর এক গরু বাছুর মারা পড়ছিল। বিনা কারণেই নাকি। দিব্যি সুস্থ সবল পশুগুলো বেমক্কা দুমদাম করে মরে যাচ্ছিল। কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। সন্দেহ ছিল গ্রামেরই এক গরীব বুড়ির ওপর। ঋণ শোধ করতে না পারায় মহাজন বুড়ির গরু কেড়ে নিয়েছিল। বুড়ি নাকি তাকে শাপ দিয়েছিল। মহাজনই বলেছে এ কথা। সে গ্রামের মাতব্বর লোক, তার কথা তো আর ফেলনা নয়। কিন্তু এতেও বুড়ি শান্ত হল না। বলা নেই কওয়া নেই, গ্রামের পাঁচ পাঁচটা কচি বাচ্ছা মরে গেল। কান্নার রোল উঠল গ্রামে। যাদের কিছু হয় নি তারাও ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগল। অদ্ভুত ব্যাপার যে বাচ্ছাগুলো মারা গেছিল তাদের প্রত্যেকের বাড়ির আশেপাশেই বুড়িকে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। এরপর তো আর উপেক্ষা করা চলে না। গ্রামে বিচার সভা বসল। কী শাস্তি? ডাইনির তুলনায় সামান্যই। হয় জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা নয়তো মারতে মারতে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া। অবশ্য যদি মারের পর বেঁচে থাকে তবেই।

পাহারা বসল বুড়ির কুঁড়ের সামনে। কিন্তু কী করে যেন শাস্তির আগের রাতে পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে বুড়ি পালাল। না, শুধু গ্রামের বাইরে নয়, একেবারে এ দুনিয়ারই বাইরে। পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নীচে। ঝোরার নীচে পাওয়া গেল তার প্রাণহীন দেহ। একটা পাথরের খাঁজে আটকে ছিল আর ঝোরা তার নিরন্তর বয়ে চলা জলধারা দিয়ে তাকে স্নান করাচ্ছিল। হয়তো বা তাকে ধৌত করছিল, পরিশুদ্ধ করছিল। হয়তো নয়, তাই। ডাইনিরা মরার আগে তাদের বিদ্যে কাউকে দিয়ে যায়। এ ডাইনি নিজে তো মরে গেল কিন্তু বিষিয়ে দিয়ে গেল ঝোরাটাকে।

“তার মানে ঝোরার জল খেলে মরে যায় লোক?” অধৈর্য অবিশ্বাসী তোর্সা প্রশ্ন করেছিল।

না মরে যায় না, বেঁচেই থাকে। কিন্তু যারা এর জল পান করে তাদের মনে অহেতুক সন্দেহ, অবিশ্বাস, হিংসার জন্ম হয়। ছারখারে যায় তাদের জীবন।

জল খেলে প্রাণনাশ হয় বললে তোর্সা হয়তো অবিশ্বাস করত না। হয় এরকম অনেক সময়। কোনো কারণে কোনো ঝরণার জল বিষিয়ে যায়। তার কোনো কারণ থাকে। কিন্তু তাই বলে এখানকার জলপান করলে মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস, হিংসা আসে! অসম্ভব! কখনোই হতে পারে না। এ নেহাতই কুসংস্কার যা কোনো যুক্তি তর্কের ধার ধারে না।

উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠেছিল তোর্সা। শান্ত, নির্জন সেই স্থানে হাসিটা যেন বড়ো বেশী কানে লেগেছিল। শুধু ঝোরাটা কি বেশী কলকল করে উঠেছিল? তোর্সার হাসি দেখে যুগপত হতচকিত এবং বিরক্ত হয়েছিল ড্রাইভারটি। বিরক্তির কারণ এসব শহুরে লোকজনের অবিশ্বাস।

“দেখি খেয়ে ঝোরার জল কী হয়,” তোর্সা বলেছিল।

ড্রাইভার আরো অবাক হয়েছিল। বলে কী এ! তোর্সার বন্ধুরাও বারণ করেছিল, “কী দরকার খাওয়ার? আর কিছু না হোক পেট টেট খারাপ তো হতেই পারে।”

তোর্সা শোনে নি। ছোটোবেলা থেকেই বেপরোয়া এই মেয়েটা। আপন খেয়ালে চলে, নদীর মতোই। পান করেছিল তোর্সা ডাইনি ঝোরার জল, তাকিয়েছিল সবার দিকে উদ্ধত দৃষ্টিতে, ভাবটা ছিল, দেখি কী হয় আমার।

ড্রাইভারটা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে। তারপর নিজের ভাষায় কীসব গজগজ করতে করতে গাড়িতে ফিরে গেছিল।

এস্কারশন শেষ হয়েছিল। সবাই ফিরে গেছিল। ইউনিভার্সিটির পড়াও শেষ হয়েছিল যথাসময়ে। যে যার মতো পরবর্তী জীবন বেছে নিয়েছিল। কেউ চাকরিতে, কেউ গবেষণা, কেউ বা তখনই সাত পাকে বাঁধা পড়েছিল। যেমন তোর্সা। সম্পর্কটা অনেকদিনেরই ছিল, প্রায় বছর চারেকের। অরিজিৎ ওর থেকে ছ’বছরের মতো বড়ো ছিল। দুবাড়ি থেকেই কোনো আপত্তি ছিল না। কাজেই এম এস সি র রেজাল্ট বেরোবার পর পরই তোর্সার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল।

এ পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাকই ছিল, সব কিছু চলছিল মসৃণ গতিতে, যেমন চলার কথা ছিল তোর্সার কল্পনায়। তাহলে তোর্সার জীবনে আবার ডাইনি ঝোরা এল কী করে? কেনই বা এত বছর পরে আবার এখানে ছুটে আসা?

তোর্সার মনে প্রথম সন্দেহ, অবিশ্বাসের বীজ বপন বিয়ের আড়াই বছরের মাথায়। নীলাঞ্জনার সঙ্গে অরিজিতের ঘনিষ্ঠতাটা কি একটু বেশী চোখে পড়ার মতো নয়? অরিজিৎ কি পালটে যাচ্ছে? ভাবত তোর্সা, পরক্ষণেই আবার মনকে বোঝাত যে ধারণা নেহাতই ভিত্তিহীন। হঠাৎই মনে খচখচ করে বিঁধতে শুরু করেছিল ডাইনি ঝোরায় জলপানের স্মৃতি। তবে কি এইজন্যেই তোর্সা এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে? এই জন্যেই কি এই সন্দেহের জন্ম? অথচ নীলাঞ্জনা তো কত সহজভাবেই ওদের বাড়িতে আসে, ওর সঙ্গেও কথা বলে। কই কোনো জড়টা নেই তো ওর। নীলাঞ্জনা অরিজিতের অফিসেই কাজ করে, সেই সূত্রেই আলাপ।

কী যে অস্বস্তিতে কাটত দিন তোর্সার। সারা দিন ছটফট করে বেড়াত আর রাতগুলোও ছিল নিদ্রাহীন, যেন অকারণ লম্বা। ততদিনে ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এ ডাইনি ঝোরার জল খাওয়ারই ফল। বিষাক্ত জল অবশেষে এতদিনে ওর মনেও ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। নিজেকে বারবার দোষারোপ করেছে এই হঠকারিতার জন্যে। মনেপ্রাণে চাইত অরিজিৎকে বিশ্বাস করতে, সব সন্দেহ দূর করতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুজনের সম্পর্কের মধ্যে কেমন যেন একটা শৈথিল্য, দূরত্ব এসে গেছিল। এত বিষ ডাইনি ঝোরার জলে, ভাবত তোর্সা।

কিন্তু অবাক হওয়ার তখনও বাকি ছিল। একদিন একটা সামান্য কারণে দুজনের মতান্তর হল। কথার পৃষ্ঠে কথা অনেকদূর গড়াল। তোর্সা যখন অরিজিতের সঙ্গে নীলাঞ্জনার সম্পর্ক নিয়ে কথা তুলল, আশ্চর্য হয়ে দেখল অরিজিৎ অস্বীকার করার কোনো চেষ্টাই করল না। বরং বেশ ঠাণ্ডা গলায় বলল যে, ওই তোর্সাকে বলবে ভেবেছিল যে তোর্সার সঙ্গের সম্পর্কটাই আর ও টিঁকিয়ে রাখতে চায় না। 

অবাক হয়েছিল তোর্সা। তার মানে ওর অবিশ্বাস, সন্দেহ কোনো কিছুই অহেতুক নয়! সব সত্যি! সেই রাতেই চলে এসেছিল বাবা মার কাছে। তারপর শুরু হয়েছিল বিচ্ছেদের আইনানুগ পর্ব। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছিল এই ভেবে যে এ ক’বছরে ওর আর আর অরিজিতের সংসারে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব হয় নি। নাহলে তো সেই নিষ্পাপ, নিরপরাধকেও এ বিড়ম্বনা কিছুটা হলেও সহ্য করতে হত। আমাদের সমাজ তো রেহাই দেয় না শিশুদেরও।

দিন কেটেছে, তোর্সা আস্তে আস্তে সামলে উঠেছে ঝড়ঝাপটাগুলো। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর। সেই বেপরোয়া তোর্সা আর নেই যে বহু বছরের প্রচলিত বিশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে অবলীলায় পান করবে ডাইনি ঝোরার জল। সব কিছু খিলখিল হাসির তরঙ্গে ভাসিয়ে অস্বীকার করার শক্তি যেন বিলীয়মান। তার জায়গা যেন দখল করেছে কিছু অহেতুক বিশ্বাস, অনেকটা যেন সেই ডাইনি ঝোরার আশেপাশের গ্রামের মানুষগুলোর মতো।

মা, বাবা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন – সবাই অনেকবার তোর্সাকে বুঝিয়েছে যে এর সঙ্গে ডাইনি ঝোরার কোনো সম্পর্কই নেই। তোর্সার সন্দেহ কখনোই ভিত্তিহীন, অমূলক ছিল না। বরং আরো আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিচিত্র মানুষের মন। যে মেয়ে এক সময় এসব কিছুই বিশ্বাস করত না, সেই পরিস্থিতির চাপে সেই সব কিছু বিশ্বাস করতে লাগল। বোধহয় বিশ্বাস অবিশ্বাসের ফারাকটা খুব সূক্ষ্ম বলেই।

শুভার্থীরা উপদেশ দিয়েছিলেন পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকলে এরকমই হবে। এর থেকে বেরোতে হবে। আস্ত জীবন সামনে পড়ে। আবার নতুন করে শুরু করা যেতেই পারে। আজকাল বিচ্ছেদের ঘটনাও তো এমন কিছু নতুন নয়। কাজেই সামনের দিকে তাকানোই বুদ্ধিমানের কাজ, পেছনে নয়।

সামনের দিকে না তাকাতে পারারও তো কোনো কারণ নেই তোর্সার। তোর্সার জীবনে এসেছে আরেকজন, শঙ্খ। আলাপ আগেও ছিল, কিন্তু সেটা নেহাতই মৌখিক আলাপ। কালেভদ্রে কোথাও দেখা হলে যেটুকু সৌজন্য বজায় রাখতে হয় সেটুকুই। তোর্সার জীবনের এই ঝড়ের সময়ে আলাপটা কী করে যেন বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বাইরের ঝড় থামল, তোর্সার মনে থামে নি। তখনও শঙ্খ পাশে ছিল, স্বাভাবিকভাবেই, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে, তার বেশী কিছুর দাবী সে কখনো করে নি। সে কথা বরং তোর্সার বাবা, মার মনেই এসেছিল। মেয়ের কাছে বলেওছিলেন সে কথা। শঙ্খকেও বলেছিলেন কি বা শঙ্খর বাড়িতে? না হলে শঙ্খ আন্দাজ করল কী করে? মাসখানেক আগে তোর্সার সঙ্গে যবে শেষবার দেখা হয়েছে, সে ইঙ্গিত দিয়েছিল শঙ্খ, ইঙ্গিত দিয়েছিল এ এরকম একটা কথা উঠছে। কিন্তু এও বলেছিল যে, যা হবে তা তোর্সার ইচ্ছেকে সম্মান করেই। কোনোরকম চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেছিল। অফিসের কাজে কিছুদিন ব্যস্ত থাকবে, বাইরেও যেতে হতে পারে – এও বলেছিল। মাসখানেক তাই দেখ হয় নি। ফোনে যোগাযোগ হয়েছে।

এই মাসখানেক অনেক ভেবেছে তোর্সা। হিতাকাঙ্খীরা সবাই তোর্সার মা বাবার প্রস্তাবকেই সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু তোর্সাই মেনে নিতে পারে নি। ডাইনি ঝোরার জল তো সে খেয়েছে। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে ডিলিট করার ক্ষমতা আজও এই বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, উন্নত প্রাণীরও অধরা। তাহলে? তাহলে আবার একটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে আবার সেটা নষ্ট করা কি উচিত হবে? বাড়িতে যা ভাবছিল, এখানে এতদূরে এই ক্ষীণ ডাইনি ঝোরার পাশে বসেও তাই ভাবে। বোধহয় ঝোরাকেই জিজ্ঞেস করে, নাহলে এত বছর পরে হঠাৎ এখানে ছুটে আসা কেন? একা একা, বাড়ির সবাইকে চিন্তায় ফেলে?

“ওহ! এই সেই ডাইনি ঝোরা! সরু সরু গোটা তিন চার ধারা! এর এত ক্ষমতা!” চেনা গলার আওয়াজে চমকে উঠল তোর্সা।

পেছন ফিরে দেখল শঙ্খ।

“তুমি!”

“কী আর করা। তুমি তো হঠাৎ কী মনে হল চলে এলে এখানে। যেদিন তুমি রওনা দিলে আমি গেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। শুনলাম সব বৃত্তান্ত। চেষ্টা করে একখানা টিকিট জোগাড় করলাম, নেহাত সিজন নয়। দয়া করে বাড়িতে হোটেলের নামধামগুলো জানিয়েছিলে তাই এত তাড়াতাড়ি মোলাকাত হল। হোটেলে তো বলল ম্যাডাম দুবেলা ডাইনি ঝোরা দেখতে যান। এর জন্যে এত টান আর ওদিকে বাড়ির লোকের কী অবস্থা হচ্ছে সে খেয়াল আছে?”

“কেন অবস্থা হবে কেন? নিরুদ্দেশ যাত্রা তো আর করি নি। বলেকয়েই এসেছি, পরশু ফিরেও যাব। তোমার আসার কী দরকার ছিল?” তোর্সা বলল।

“দরকার?” শঙ্খ হাসল, বলল, “ওই একই দরকার। ডাইনি ঝোরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। কিন্তু এর নিজেরই তো করুণ অবস্থা।”

“এরকম ছিল না ঝোরাটা। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন অনেক জল ছিল। কী আওয়াজ!”

“আসলে চতুর্দিকের যা হাল! মানুষের মনে যা অবিশ্বাস, হিংসে, জটিলতা, কুটিলতা – এসব দেখে বোধহয় লজ্জায় মুখ লুকোতে চাইছে বেচারা। খামোখা একটা ঝোরাকে অপবাদ দেওয়া। আর মানুষের দেওয়া অপবাদের কত শক্তি দেখো, ঝোরাটার কী দশা!”

তোর্সা কোনো উত্তর দিল না। 

“আর তোমার একে এত ভয়! সত্যিই তুমি বিশ্বাস করো এইসব হাবিজাবি গল্প?” শঙ্খই আবার জিজ্ঞেস করে।

“করতাম না। একেবারেই করতাম না। তাই তো সব হেসে উড়িয়ে দিয়ে ঝোরার জল খেয়েছিলাম। কিন্তু ......”

“কিন্তু? কিন্তু কী?”

তোর্সা আবার চুপ।

“যা ঘটেছে তার সঙ্গে ঝোরার জল খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি কাউকে অবিশ্বাস করো নি, বরং সে তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় নি, তোমার বিশ্বাস ভেঙেছে। অনর্থক এসব উলটোপালটা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া।”

তোর্সা নীরবই।

শঙ্খর মনে হল এভাবে বলে কিছু হবে না। বোঝানোর চেষ্টা তো কম করা হয় নি। অনেকেই করেছে। শঙ্খ এগিয়ে গেল জলের দিকে। নীচু হয়ে আঁজলা করে জল তুলল। 

তোর্সা ছুটে এল, “কী করছ? ফেলে দাও জল।”

শঙ্খর ততক্ষণে সে জল পান করা হয়ে গেছে, বলল, “তোমার সমকক্ষ হলাম। দেখি এবার কী হয়। কার মনে অহেতুক কী জন্মায়, না আমিও ঝোরার জল খেলাম বলে তোমার চিন্তা দূর হয়। তোমার মনেও সন্দেহ, অবিশ্বাস, আমার মনেও তাই। ওই বিষে বিষক্ষয়ের মতো আর কী।”

তোর্সার মুখে কথা জোগায় না। এগিয়ে এসে শুধু শঙ্খর হাতটা ধরল।

4 comments:

  1. Apnar bornona shokti te kahini ti jibonto hoye uthechhe. Aaro likhun jaa dekhben tai likhun, hok se jhora kimba taar paare Mora niye bose thaka.

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. Osadharon sundor akta golpo. Lekhikar shoktishali likhonite golper goti ato sundor agiyeche je mon golper vetore dube jete baddho. Ato sundor akta golper jonno suprio lekhikake amar antorik dhonnobad o shuvechcha. Apnar aro aro golpo porar opekkhay roilam. Thanks.

    ReplyDelete