0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ অমলেন্দু চন্দ

Posted in

ব্যক্তিগত গদ্য





ফুটবল – বাঙ্গালী – বঙ্গাল 
অমলেন্দু চন্দ



টেরিকটের ময়লা পাঞ্জাবীটার বুকের বোতাম নেই, নিকুচি করেছে - বলে দূষ্মন্ত বেরিয়ে এলো হাওয়াই চটিটা গলিয়ে। দরজার বাইরেই পাড়ার দু তিনটে কুকুর - রকের ছায়ায় দিবা তন্দ্রার ঘোরে আরাম পেঁদাচ্ছিলো - দু তিনখানা চমকে ওঠা ঘেউ, দূষ্মন্ত চমকে উঠে লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল - একেই এত চাপ মাথায়, তার ওপরে আবার ইন্সটিঙ্কটের পাছায় ঘেউয়ের পয়জার, শালা খালি যেন মদ্দা গুলোকে খোজা করে দিলেই পাড়ায় শান্তি এসে যাবে, দূষ্মন্ত ঠিক করল এবারের ভোটে গাড়োল কাউন্সিলারটাকে আর ভোট দেবে না। কেউ যদি তার দায়িত্ব ঠিক ঠাক ... নিজে এতদিন ধরে দায়িত্ব টায়িত্ত্ব গুলোকে ইস্তিরি করা পায়জামা পাঞ্জাবীর মত থাক থাক করে সাজিয়ে রেখে সময়মতই পাট ভেঙেছে - এখন... অজান্তেই দূষ্মন্ত ময়লা পাঞ্জাবিটার বুকের বোতাম খুঁজল। সামনের বাসটায় উঠে পড়ল সে, পেছনে পরে রইল বৌমার স্বর – ও খোকন, দাদু কে বল মেটের ঝোল করেছি, দাদুর খেতে ভাল লাগে। খোকনের তখন কলেজের তাড়া – ‘তুমি বল না’ বলে সে পিট্টান দিয়েছে। 

আজকাল আর পেরে ওঠে না। খোলা রোদে গরম বাতাসে টাকের শরীরটা গরম হতেই খুলির ভেতরটা ঠাণ্ডা হতে শুরু করল - ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর। পলিটিক্যাল সাইন্সের শিক্ষক – ছিলেন। দেশভাগের রাজনীতি আর তাই নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টি গুলোর মানে তাদের নেতাদের কম্ম অপকম্ম গুলোকে নিয়ে একদিন রেস্ট রুমে বিশাল কচকচি, সেদিন ওর বাগ্মিতায় বেকায়দায় প্রিন্সিপ্যাল অব্দি, নাকাল হয়ে গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, আপনি আমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন। সেটা সত্তরের দশকের শেষ প্রান্ত। তারপর যথারীতি প্রাইভেট কলেজের গভারনিং বডির দোহাই, আপনার এইসব কথা তাদের কানে গেলে, বুঝতেই তো পারছেন, আমরা বজায় আছি অন্যের বদান্যতায়, সেটা বন্ধ হলে কলেজটা - প্রিন্সিপ্যালের পিতাঠাকুর কলেজটা খুলেছিলেন, অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে কলেজ স্পন্সর পেয়েছে একটা গোষ্ঠীর, পরের ধাপ পূর্ণ অ্যাফিলিয়েসান। সেদিন বিকেল পর্যন্ত দুষ্মন্ত ময়দানের তাঁবু গুলোর আশে পাশে ঘুরে বেরিয়েছিল। ও ফুটবল খুব ভালবাসে। নিজে খুব একটা খেলে নি, কিন্তু অনেক অপূর্ণ সাধের দ্বেষ ভেতরে উথলে উঠলে ও মাঠে চলে আসে দেখতে – আর ওই লাথালাথিটা যেন পরোক্ষে ওর অনেক কিছুকে ল্যাথাতে চাওয়ার বিকল্প চেহারা নেয়, আর তখন গোল হলে ও উল্লাসে ফেটে পড়ত – গো ও ও ও ল।

সেদিন নিজের শিক্ষা দীক্ষার প্রতি দায়িত্ত্বের একটা পাঞ্জাবীর পাট ভেঙ্গেছিল দুষ্মন্ত, রেজিগ্নেসান দিয়েছিল, এই বলে - যেটা শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি কষ্ট পেয়ে, (দুষ্মন্তের পরিবারের অনেকেই দেশভাগের বলি হয়, বিশেষ জেঠুদাদু আর তার ছেলে মেয়ে, ও পার ছেড়ে এ পারে আসেন নি সময়মত) সেটা আপনাদের রুটির লাথি খেয়ে ভুলতে পারব না। দেশভাগের আগে চলে আসার কারণ যে খুব আনন্দের ছিল এমন নয়। নানা কারণ ছিল, ভিটে থাকলেও হয়ত থাকা যাচ্ছিল না। আর এ দিকও যে খুব বুক বাড়িয়ে টেনে নিয়েছিল, এমনও নয়। ফলে কোথায় যেন একটা ছিন্নমূল তকমার বক্রতার মুখোমুখি হতে হত অহরহ। তবু একটু জমিন ছিল – রবীন্দ্রচর্চা, কবিতা, সংস্কৃতিচেতনা আর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এ সমস্ত বুঝতে বুঝতে পঞ্চাশের দশক শেষ হয়ে এসেছে। শহরের পথে সেই সময়ের অদ্ভুত সব শব্দ আর গন্ধও, পুনর্বাসন, জমি দাও-এর দাবি দাওয়ার সব আওয়াজ, অবর্ণনীয় সব দুর্দশার ছবি।

জেঠুদাদু, বাবার বড় ভাই। ঠাকুরদার দুটো বিয়ে ছিল, প্রথম পক্ষের সন্তান জেঠুদাদু বয়েসে বাবার থেকে প্রায় বছর আঠেরোর বড়। সেই জেঠুদাদুর - ছিন্নমূল, উচ্ছেদের যন্ত্রণা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই, আর তার সাথে বেঁচে থাকার লড়াই, সব একসাথে। ৪৭ এ আসেন নি, ভেবেছিলেন - কি ভেবেছিলেন, সেটা অবান্তর। মেলে নি সে হিসেব। পরে সেই ৫১ এ আসা। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন, ভূস্বামী রাতারাতি ভূমিহীন, সেও এক অদ্ভুত শ্রেনীচ্যুতি। সম্বলহীন অসহায়, স্বজনের কালীঘাটের ভাড়া বাড়িতে। দরজার বাইরে গলিতে এক চিলতে সকালের রোদে ঝিম মেরে জেঠুদাদুকে বহুদিন দেখেছে দুষ্মন্ত একটা বেতের মোড়া টেনে বসে থাকতে, সাইকেল বা রিক্সা গেলে সসংকোচে দীন মুখে প্রায় মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতেন মোড়া হাতে। 

বাবা চাকরি সূত্রে কলকাতায়, বাসা পেয়েছিলেন কালীঘাটে, তার মামার কল্যাণে। দুষ্মন্ত ওই বাড়িতেই স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সেরেছে, দেখেছে জেঠুদাদু ট্যাহা পয়সার সন্ধানে দিয়েছেন মুড়ি চপ তেলেভাজার দোকান। অথচ বাবার মুখে শুনেছে ওই জেঠুদাদু নাকি ছিলেন জবরদস্ত তালুকদার, তাল পুকুর ছিল আর ঘটিও ডুবত সেখানে। তবে জেঠুদাদুর মুখে তালুক মুল্লুকের গপ্পো কোনদিন শোনেনি। কান্তিময় বৃদ্ধ অনেক জোড়হাত দেখেছেন, কিন্তু গজনভী মেজাজের হয়ে যান নি। তাই এপারে এসে পরার পর জোড়হাত হয়ে থাকতে থাকতে একদিন চলে গেছেন। সব দেখেছে দুষ্মন্ত আর অধীর হয়েছে।

দুনিয়ার সমস্ত ভাগের পেছনের রাজনীতি – মধ্যস্বত্ত প্রথা, সেই নিয়ে আর এক রাজনীতি, পুনর্বাসন, তার ফলপ্রসূ হওয়া বা না হওয়ার দরুণ অনেক অসহায়তার নির্মম ছবি, সব কিছু যেন আড়াল হয়ে যেত ফুটবলের মাঠে। ইস্টবেঙ্গল – নামে কোথায় যেন একটা সেই হাতছানির সুর, সেই পুকুর পার, বাঁশ ঝাড়ের ঝুঁকে পরা পাতার তলা দিয়ে পথ, মাছের চাষ, গরু-বাছুর, মেঠো আলপথ, ধানক্ষেতের আলের পাশে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত দক্ষতায় জলে ভরা ক্ষেতের ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বে নির্ভুল নিশানায় ধানের চারার আঁটি গুলো ছুঁড়ে দেওয়া, জনেরা কাজ করবে যখন তখন ওই আঁটির থেকে গাছ ছাড়িয়ে নিয়ে মাটিতে অভ্যেসের অবহেলায় পুঁতে দেবে, সব সব যেন ওই নামটার মধ্যে কোথায় নিসচিন্দিপুরের হাতছানির মত।

দুষ্মন্ত নিজের মনেই হেসে ফেলে। ওই ক্লাবটার গোড়াপত্তনের সঙ্গে ও পারের যোগাযোগ অদ্ভুত, অন্তত ক্লাবটার ইতিহাস তাই বলে। ও একটু পড়াশুনো করেছে এ নিয়ে। ক্লাবের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সন্তোষের রাজা মন্মথ চৌধুরী জড়িয়ে ছিলেন, সে কথা পরে।

১৯১১ তে মোহনবাগান প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আই এফ এ শিল্ড জিতল। সেটা তখন রাজ-রাজত্বের সময়। ক্লাবের এ হেন সাফল্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চাগার দিয়ে উঠল নতুন এক অনুভূতির জোয়ারে। এদেশিরা নেটিভ, খালি পায়ে খেলে। সাহেবদের বদান্যতায় একটু আধটু, তার সঙ্গে আছে সেই সাহেবি কালচারের কলোনিয়াল প্রসারণ আর একীকরণের ব্যাপার তাই মাত্র দুটো ক্লাব ফার্স্ট ডিভিশন খেলতে পায়। এর মধ্যেই আবার কলোনিয়াল পলিটিক্স, বাংলা ভাগ করার চেষ্টা হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে, খোদ রাজাকে এসে অবস্থার সামাল দিতে হয়েছে। সে সময়ে কুমারটুলি সেকন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হলেও ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায় নি, কারণ দুটো দল – নেটিভদের – ফার্স্ট ডিভিশন খেলছে। তাই কুমারটুলিদের মত ক্লাব কে ওই সেই কুচবিহার ট্রফি খেলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হত। ১৯১৭, ১৯১৮ আর ১৯১৯ পর পর তিনবার কুমারটুলি সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়। 

সেটা ১৯২০ সাল। মোহনবাগানের ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট এর সঙ্গে একটা সংঘাত বাধল তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীর। সেই কুচবিহার ট্রফি তে মুখোমুখি হয়েছে মোহনবাগান আর জোড়াবাগান ক্লাব। এক অজানা কারণে জোড়াবাগানের স্টার ফুটবলার শৈলেশ বোস কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে তারিখটা ছিল ২৮শে জুলাই ১৯২০। চৌধুরীবাবুর অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বোস খেলতে পারলো না, জোড়াবাগান এবং মোহনবাগানের সাহেবী এবং আধা সাহেবী নিয়ম নিষ্ঠতার অজুহাত, চৌধুরী ক্ষেপে গেলেন।

ঈন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলে কথা, তায় তৎকালীন সব রাজা টাজা দের সাথে ওঠা বসা, কৃপানাথ লেনের শোভাবাজারের বাড়িতে বসে মিটিং হল সেদিনই। শোনা যায় রাজা মন্মথ চৌধুরী, বোস নিজে, অরবিন্দ ঘোষ, রমেশ চন্দ্র সেন – কে ছিলেন না সেই মিটিঙে। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল নতুন ক্লাব ১লা আগস্ট ১৯২০, নাম হল ইস্ট বেঙ্গল। একটা তথ্য অবশ্য নামকরণের পেছনে হয়ত কাজ করেছিল, মন্মথ চৌধুরী ছিলেন সন্তোষের রাজা, আজকের বাংলা দেশে সেই জায়গা, আর তার নামেই সন্তোষ ট্রফির নামকরণ। এরা সকলে নাকি জার্সির জন্য তুমুল তর্ক বিতর্ক করে সেই সময়ের হোয়াইটয়ে ল্যাডল এর চৌরঙ্গীর বিরাট অ্যারিস্টোক্র্যাটদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের শো কেসে ঝোলানো লাল-হলুদ একটা জামা পছন্দ করেছিলেন, আর সেটাই ক্লাবের রং হয়ে গেল। উত্তর কলকাতার কুমারটুলি পার্কে শুরু হল অনুশীলন আর খেলা। ১৯২৫ সালে প্রথম ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান মুখোমুখি হল, এর আগে ১৯২৪ এ ইস্টবেঙ্গল প্রথম যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেকেন্ড ডিভিসানে ক্যামেরুন বি নামে একটি ইংরেজদের ক্লাবের সঙ্গে। প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই বাজী মাত, ইস্টবেঙ্গল ১ মোহনবাগান ০, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের চলেছে বহু বহুকাল, যেন অনন্তকাল। রিটার্ন ম্যাচে ফলাফল উল্টো, মোহনবাগান এর প্রতিশোধ। 

ইস্টবেঙ্গল প্রথম আই এফ এ শিল্ডের সেকেন্ড ডিভিসানে জায়গা পেল আর এক রাজার বদান্যতায়। তাজহাট ক্লাবের মালিক রাজা গোপাল রায়ের চেষ্টায় ইস্টবেঙ্গল তাজহাট ক্লাবের স্থলাভিষিক্ত হল, মজার ব্যাপার এ নিয়ে মোহনবাগান আর আরিয়ান ক্লাব – অনেক জল ঘোলা করেছিল বলে শোনা যায়। 

নিয়তির পরিহাস, ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তারা তখন ক্লাবের জন্য ময়েদানে একটা জায়গে খুঁজতে আরম্ভ করেছেন, এমন সময়ে জানা গেল যে মোহন বাগান গ্রাউন্ডের পার্টনার ন্যাশনাল এ সি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সেটা ছিল বেহালার এক জমিদারের ক্লাব। মোহনবাগান তখন নিরবিচ্ছিন্ন পুরো জায়েগাটা ব্যাবহার করছে। ইস্টবেঙ্গল পত্র দিল তৎকালিন অথরিটিদের। মোহনবাগানের বিরাট প্রটেস্ট সত্ত্বেও ১৯২২ সালে কুমারটুলি পার্কের গোল পোস্ট তুলে এনে ন্যাশনাল এ সি’র রেড রোডের দিকের ভাগের মাঠে পোঁতা হল। রাইভ্যালরি শুধু মাঠেই ছিল না, মাঠের বাইরেও ছিল। ইস্টবেঙ্গল যখন ১৯২৪ এ যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হল, যেহেতু ক্যামেরুন ক্লাবের এ টিম অলরেডি ফার্স্ট ডিভিশন খেলছিল, তাই কথা উঠল ইস্টবেঙ্গলের উঠে আসার, কিন্তু যেহেতু আই এফ এর নিয়ম ছিল মাত্র দুটো টিম থাকবে আর সেই টিম দুটো ছিল মোহনবাগান আর আরিয়ান, তাই গভারনিং বডি’র মিটিঙে প্রস্তাব উঠল নিয়ম পরিবর্তনের, আর মোহনবাগান তার তীব্র বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু বাকি ব্রিটিশ ক্লাব গুলো সমর্থন করায় নিয়মের বদল হয়ে যায় আর ইস্ট বেঙ্গল প্রথম ডিভিসানে জায়েগা পায়।

বোধহয় এই রাজা মন্মথ রায়ের যুক্ত থাকার কারনেই ক্লাবটা এরকম ধারনায় বাঙ্গালদের ক্লাব হয়ে উঠল – অন্তত মেজাজের দিক থেকে, আর একটা নতুন ডাইমেন্সান এলো কলকাতার ফুটবল মাঠে – ঘটি বাঙ্গালের লড়াই। তারপর একদিন আইডেন্টিটির খোঁজে আসা পার্টিসানের পরের মানুষগুলো ইমোসন্যালি এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল।

১৯৪২ এ প্রথম আই এফ এ শিল্ড বিজয়, ১৯৫১ তে ডুরান্ড কাপ, তার মধ্যে তিনবার আই এফ এ বিজয়। এর মধ্যে কলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন ১৯৪২, ১৯৪৫, ১৯৪৬ – সব পার্টিসানের আগে। ১৯২৫ সালের এপিক প্রথম লড়াইয়ের কথা ক্লাবের ওয়েবসাইটে পেপার কাটিং এ দেখতে পাওয়া যায় – স্টেটসম্যানের রিপোর্ট। আর সেদিনের সেই লড়াইয়ে যে খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে বিবাদের দরুন ইস্টবেঙ্গলের জন্ম হয়েছিল সেই এস বোস খেলেছিল মোহনবাগানের হয়ে। আয়রনি। একমাত্র গোলটি করেন এন চক্রবর্তী। সেদিনের খেলায় মোহনবাগানের হয়ে একজন খেলেন – ভাদুরি, সম্ভবত দ্বিজদাস ভাদুরি। ২৭শে মে’র কাগজের কাটিং দেখাচ্ছে স্টেটসম্যান বলছে মাঠে একটা বিরাট ভিড় প্রত্যাশিত, আর ২৮শে মে’র ছবি দেখাচ্ছে গ্যালারিতে মাথা ছাড়া কিছু নেই। কলকাতার ফুটবল মাঠের সবচাইতে বড় ভিড় এই ক্লাবের সঙ্গেই জড়িত। ১৯৯৭ সালে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে – প্রায় ১৩১০০০ লোক জড় হয়েছিল ডার্বি কাপের সেমি ফাইন্যালে। 

দুষ্মন্ত ফিরে এল তার নিজের সময়ে। কিছুদিন আগেই পড়ছিল অধ্যাপক প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মারজিন্যাল মেন নামের বইটির একটি আলোচনা। কি ভাবে সব ছিন্নমূল আস্তে আস্তে এ পারের রাজনীতিতে একটা সম্ভাবনাময় বদলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার আলেখ্য। ও আবার হেসে ফেলে। সম্ভাবনাময় অস্তিত্ত্ব, নাকি এ আর এক জোটবন্ধন। 

মানুষের বাঁচার লড়াইয়ে এই সব ছিন্নমূল কাকা কাকিমা দাদা ভাই রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়ান লোক, ঝুড়ি মাথায় অপেক্ষায় থাকা মজুর, এমনকি একটু অবস্থাপন্ন হয়ে ওঠা লোকটা – কেউ বিচ্ছিন্ন নয়, সবাই এই লড়াইয়ের ময়দানে এক একটা প্রতীক, আর অবিরাম সেই দ্বন্দ্ব আর দ্বন্ধের খেল। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান – মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল। 

এই লড়াইয়ের মধ্যেই যেটা আন্তর্জাতিকতার সুর বাজিয়েছে, তা হল ১৯৫১ তে দিল্লি আর ১৯৬২ তে জাকার্তায় গোল্ড মেডাল। এখানেই শেষ নয়, ১৯৫৬ তে মেলবোর্নে প্রথম এশিয়ান নেশন হিসেবে অলিম্পিকে সেমি ফাইন্যাল খেলা। কলকাতার মাঠ গরবিনী জনমদায়িনী সেই সব ফুটবলারদের বৈশিষ্টের। ১৯৫১ তে ছিলেন ভরদারাজন, শৈলেন মান্না, নুর মুহাম্মদ, সন্মুগম, রুনু গুহ ঠাকুরতা, ভেঙ্কটেশ, সালেহ, মেওয়ালাল – সব অনবদ্য খেলোয়াড়। ফাইন্যালের জয়সূচক গোলটি করেছিল মেওয়ালাল। 

১৯৫৬ র দলের সদস্য ছিলেন তুলসিদাস বলরাম, পি কে ব্যানার্জী, থঙ্গরাজ, সমর (বদ্রু) ব্যানার্জী, কান্নন, কেম্পিয়াহ, নিখিল নন্দি, নুর মুহাম্মদ, লতিফ, রহমান – সব চাঁদের হাট। ১৯৫৬ সালে যখন পি কে ব্যানার্জী এই দলের সদস্য হন, তখন তার বয়েস মাত্র কুড়ি। টিমের গ্রীন হর্ন। আগের বছর কোয়াড্রাঙ্গুলার কাপে ঢাকায় গায়ে তুলেছেন ন্যাশনাল টিমের জার্সি। ক্লাব ফুটবলে খেলছেন মোহনবাগানে। সেমি ফাইন্যালের যাত্রা পথে ভারত হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া কে ৪-২ গলে। ভারতের পক্ষে হ্যাট্রিক করেছিলেন নেভাইল ডি সুজা। ফুটবলের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত একমাত্র এশিয়ান, যে অলিম্পিকে হ্যাট্রিক করেছে। সেমি ফাইন্যালে ইউগোস্লাভিয়ার কাছে ১-৪ গোলে হেরে যায়। অবশ্য এই যাত্রার শুরু ১৯৪৮ এর অলিম্পিকে, যেখানে টি আও এর নেতৃত্বে ভারত কোয়ার্টার ফাইন্যালে পৌঁছে হেরে যায়। 

১৯৬২ র দলে ছিলেন থঙ্গরাজ (মহমেডান স্পোর্টিং), জার্নেল সিং (মোহন বাগান), অরুণ ঘোষ (ইস্টবেঙ্গল), রাম বাহাদুর (ইস্টবেঙ্গল), প্রশান্ত সিন্‌হা (ইস্টবেঙ্গল), পি কে ব্যানার্জী (রেলওয়েস), চুনি গোস্বামী (মোহন বাগান) তুলসিদাস বলরাম (ইস্টবেঙ্গল), অরুময় নৈগম (মোহন বাগান)। কলকাতার মাঠের ক্লাব দুটো দিয়েছে অনেক। আর সেটাই ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ১৯৫৯ এর মারডেকা কাপে ভারতের রানার্স আপ হওয়া সেই যুগের শেষ বিজয়। লতিফ সেই টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। 

মোহনবাগানের গেল শতকের গোড়ার দিকের খেলোয়াড় ছিলেন। সেই সময় মাঠের প্রবাদপ্রতিম দ্বিজ দাস ভাদুরি। তিনি ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন চার বছর। গোষ্ঠ পাল খেলেন সেই বছর চারেক, তার পরেও খেলেছেন ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, সে সময়ের আরেক দিকপাল উমাপতি কুমার। এ ছাড়া করুণা ভট্টাচার্য, বেনি প্রসাদ, সতু চৌধুরী। ১৯৪২ সালে শৈলেন মান্না খেলতে শুরু করেন মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে। সঙ্গী টি আও। 

আটাত্তর বছরের দুষ্মন্তের বুকে আজও সেই সময়ের দাপানি রয়ে গেছে। চল্লিশের সেই একেবারে শুরুর দিকে বাবার সাথে মা আর পিসিমা কে নিয়ে কলকাতায় এসে পড়া। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গড়ের মাঠ উদ্বাস্তু শৈশবের সব বুনিয়াদি ব্যাপার স্যাপারের মাঝে নিজের অজান্তেই চলতে শেখা বাল্যকাল। রিফিউজি এডুকেসান স্কিম - রাজ্যের তৈরি করা বরিষা কলেজ, আজকের ভিভেকানন্দ কলেজে ভর্তি হওয়া। সেটা ছিল ১৯৫২। বেহালায় কলেজ করতে যেতে হত, কালীঘাট থেকে। কলেজ থেকে ফিরে চলে যাওয়ার জায়গা ছিল গড়ের মাঠ, আর ফুটবলের ক্লাবগুলোর আশে পাশে ঘোরাঘুরি। 

১৯৭০ এ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য হলেন। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের রাইভ্যালরির সেটা তুঙ্গের সময়। সেই অনন্য দিনটাকে আজও ভুলতে পারেন নি দুষ্মন্ত – ১৯৭৫ এর ২৯শে সেপ্টেম্বর। ইস্টবেঙ্গল হারিয়েছিল মোহনবাগান কে ৫-০ গোলের ব্যবধানে। শ্যাম থাপার সেই অনবদ্য ভলি কিকের গোল, দুটো গোলের মধ্যে একটাতে, সুরজিত সেনগুপ্তর বক্সের মাথা থেকে আচম্বিতে করা সপাটে কিকের গোল, আরও দুজনের দুটো গোল, বাসের মধ্যে দুষ্মন্তর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আজ অব্দি এত মার্জিনে দু ক্লাবের আর কোন খেলায় জয় পরাজয় হয় নি। সেটা ছিল আই এফ এ শিল্ডের ফাইন্যাল। 

সত্তর থেকে ছিয়াত্তর – দুষ্মন্তের বুকটা একটু ফুলে ওঠে আজও ভাবলে – যে বছর তিনি ইস্টবেঙ্গলের সদস্য হলেন সেই বছর থেকে শুরু করে একটানা ছ বছর ১৯৭৫ অব্দি ইস্টবেঙ্গল লিগ চ্যাম্পিয়ন, যেন দুষ্মন্তকে একটা শিল্ড দিয়েছিল এভাবে ক্লাব টা। এ ছাড়া ১৯৭০, ৭২ থেকে ৭৫ অব্দি আই এফ এ শিল্ড, দুষ্মন্তরাই তখন ময়দানের রাজা। সুকল্যান ঘোষদস্তিদার, বলাই রায়, সুভাষ ভৌমিক, প্রণব, পরিমল দে, কান্নন, কাজল ঢালি, নাইমুদ্দিন, প্রশান্ত মিত্র, উল্গানাথন। ১৯৭৬ এ এলো কয়েকটি তরুণ – জমাট খেলা। সুব্রত ভট্টাচার্য, সমরেশ চৌধুরী। কোরিয়ার পিঅং ইওঙ্গ এর সঙ্গে সমরেশ চৌধুরী সুভাষ ভৌমিকের সে কি খেলা, আজও মনে আছে। আরও কত জনের কথাই তো মনে পড়ে – সুধীর কর্মকার, আকবর, হাবিব, বিদেশ বোস, শেষ হয় না ভাবতে বসলে। 

আস্তে আস্তে মেজাজটা নরম হয়ে আসছিল বৃদ্ধের। কানে ভেসে উঠল বউমার গলা – খোকন দাদু কে বল মেটের ঝোল করেছি, এখন না বেরোতে। ছিয়াত্তর বছরের দুষ্মন্ত বাস থেকে নেমে ফেরার বাস ধরল। এক সময়ের কোথাকার মানুষ ঘরে ফেরার পথ ধরল। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – এটা লেখার সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ওয়েবসাইটের তথ্যবহুল পাতা ব্যবহার করা হয়েছে সে জন্য ক্লাবের কাছে কৃতজ্ঞ। এ ছাড়া আরও অনেক ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া হয়েছে তথ্যের প্রয়োজনে – সবাইকার কাছে আমি কৃতজ্ঞ;













0 comments: