Next
Previous
Showing posts with label বিশেষ নিবন্ধ. Show all posts
2

বিশেষ নিবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in





এক একটা সময়কে মনে পড়ে যায় তাদের সঙ্গে ওতপ্রোত কিছু অনুষঙ্গে। শরৎকালে বিশেষ একটা হলুদ রোদের ঝলমল টেনে নিয়ে যায় কোনও ছোটো বেলায়। পুজোর ছুটির আগে শেষদিন খালি পায়ে হেঁটে চলেছি ইশকুলে। কাল 'মহালয়া' হয়ে গেছে। আধোঘুমে, ঘোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মায়াবী স্বর। পাড়ার দুর্গাঠাকুর তৈরি হয়ে গেছে। শুধু রং পড়া বাকি। রোদের আলোটাকে বলি, 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়।' একটা সময়। বালক বয়সে এক সুন্দরীতমাকে দেখেছিলুম, যার শাড়ির রং ফিরোজা। মা বলেছিলেন। তার পর থেকে 'ফিরোজা' শুনলেই সেই নারীকে মনে পড়ে। তার মুখ কিছু মনে নেই। সময়টা আছে। বহু দিন পরে কোনও একটি সুগন্ধির সঙ্গে এক প্রিয়তমা নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়ে গেছে। আর কিছু নেই। থাকার মধ্যে শুধু সেই বিনিসুতোর মালা। সে রামও নেই। অযোধ্যাও। অগণন ভিখারির রাস উৎসব দিয়ে গড়া স্বপ্নের জীবন আমাদের। কালীদা সেই সব স্বপনকে কি মনে রাখে? জানি না। তবে আমাদের প্রজন্মের বঙ্গীয় বালকরা একজন 'স্বপন'-এর জন্য খানিকটা সময় মনের কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দেয়। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তাকে।

গত ​​​​​​​শতকের ​​​​​​​তেষট্টি-চৌষট্টি ​​​​​​​সাল ​​​​​​​নাগাদ ​​​​​​​আমাদের ​​​​​​​প্রথম ইশকুল ​​​​​​​যাওয়া ​​​​​​​শুরু ​​​​​​​হয়। ​​​​​​​আমি ​​​​​​​তখন ​​​​​​​তিন ​​​​​​​কেলাশ। ​​​​​​​পঁয়ষট্টির মধ্যেই আমাদের ইশকুল যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান একজন রহস্যময় লেখক। নাম, শ্রীস্বপনকুমার। তাঁর আসল নাম যে কী ছিলো, তখনও তা জানা যায়নি। পরে জানা গেছে তাঁর পৈতৃক নাম শ্রী সমরেন্দ্র নাথ পাণ্ডে। রাজশাহী থেকে কলকাতায়, এক আগন্তুক বঙ্গসন্তান। তিনি পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে ভূরি ভূরি জ্ঞান রাখতেন। ডাঃ এস এন পাণ্ডে নামে বটতলা থেকে প্রচুর 'ডাক্তারি' বইও বেরোতো তাঁর। অন্যদিকে 'শ্রীভৃগু' নাম নিয়ে জ্যোতিষের বই। ক্ষণজন্মা মানুষ ছিলেন তিনি। বিবিধ বিষয়ে দুহাতে লিখে বটতলার 'বাজার' আলো করে রাখতেন তিনি। পরবর্তীকালে এও জানা গেছে, যেমনই হোক, এই পরিমাণ বিপুল সংখ্যার গ্রন্থরাজির প্রণেতা দারিদ্র্য প্রপীড়িত জীবন কাটিয়েছেন। শেয়ালদা ইশটিশনের ওয়েটিং রুমে নিখরচায় আলো-পাখার সুবিধে পেতে সেখানে বসেই সারা রাত ধরে একেকটি চটি রচনা করতেন। 'গল্প' হিসেবে এই ঘটনার মাহাত্ম্যও কম নয়।

শোনা যেতো, জেমস হ্যাডলি চেজ সাহেব ( আট-নয় কেলাশে যাবার পর তিনি শ্রীস্বপনকুমারকে হটিয়ে আমাদের অধিকার করে নেন ) এবং সিডনি শেলডন সাহেব ছিলেন নাকি দুটি ‘নৈর্ব্যক্তিক’ ব্র্যান্ড। ব্যক্তিবিশেষ নন। এক দল অক্ষর কারিগর মিলেমিশে দিস্তে দিস্তে রোমাঞ্চকর সাহেবি দাস্তান ​​​​​​​ছাড়তেন বাজারে। আমাদের মতো বালকরা গোগ্রাসে গিলতো সে সব। 'আমাদের জীবনে 'নো অর্কিড ফর মিস ব্ল্যান্ডিশ' আবির্ভূত হবার আগে পর্যন্ত শ্রী স্বপনকুমারই ছিলেন দ্য কিং অফ ডিটেক্টিভ থ্রিলার। কিছুদিন আগে এক ​​​​​​​বন্ধুর ​​​​​​​সঙ্গে স্বপনকুমারকে নিয়ে ফোনে আড্ডা হচ্ছিলো। 'ল্যাখাপড়া' চুলোয় যাক, কে কতোগুলো স্বপন-সিরিজ 'শেষ' করতে পেরেছে তাই নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো অবিরাম। ন-দশ বছর বয়েসে প্রথম শ্রীস্বপনকুমার শুরু করি। তখন ​​​​​​​থেকে ​​​​​​​বারো-তেরো ​​​​​​​পর্যন্ত, ​​​​​​​সিরিজের ​​​​​​​পর ​​​​​​​সিরিজ, ​​​​​​​চৌষট্টি ​​​​​​​পাতার ​​​​​​​বহাদুর ​​​​​​​কা ​​​​​​​খেল ​​​​​​​আমাদের ​​​​​​​তৃষ্ণা ​​​​​​​মেটাতো।

যখন থেকে আমাদের হরমোন জাগতে শুরু করে, তখন থেকে একটা জিজ্ঞাসা বাজারে বেশ চালু ছিলো। মেয়েরা কি স্বপনকুমার পড়ে? মনে হয় পড়তো না। কারণ সে বিষয়ে তাদের থেকে কিছু শোনা যায়নি। সে কালে মেয়েদের ফ্রেমটাই ছিলো অন্য রকম। বাঁধা গতের বাইরে সব কিছুই 'অসভ্য'। এই বিশেষণটির এগজ্যাক্টলি যে কী তাৎপর্য ছিলো সেটা বুঝতে বুঝতে আমাদের 'বিয়ের বয়স' হয়ে যায়। যাঁরা 'ভূতপ্রেত' বা অলৌকিকের চর্চা করেন, তাঁরা বলেন সব কিছু নাকি 'বোঝা' যায় না। 'না বোঝার' মধ্যে যে 'বোঝা' সেটাই নাকি প্রকৃত জ্ঞান। শুধু ভৌতিক প্রপঞ্চ নয়, কাব্যিক সন্দর্ভেও এই কথাটাই চলে। সেকালে মেয়েদের সাইকিতে 'অসভ্য' বিশেষণটিও সে রকমই কিছু একটা ব্যাপার ছিলো হয়তো। কিন্তু শ্রীস্বপনকুমারের কী ভূমিকা ছিলো তাতে, সেটা পোয়েস্কার হয়নি কখনও।

রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়তুম ​​​​​​​তখন। ​​​​​​​সেখানে ​​​​​​​একটা ​​​​​​​বিষয় '​​​​​​​পড়ানো' হতো। তার ​​​​​​​সরকারি ​​​​​​​নাম ​​​​​​​ছিলো ​​​​​​​'মরাল ইন্স্ট্রাকশনস'। আমরা বলতুম ধর্মক্লাস। প্রতি সপ্তাহেই একটা-দুটো করে 'ধর্মক্লাস' থাকতো। দিনের ​​​​​​​শেষ ​​​​​​​পিরিয়ড। সেই সময়ে যে শিক্ষকমশায়ের আসার কথা তিনি একবার এসে বলে দিতেন, তোরা ক্লাসের দরজা বন্ধ করে গল্প কর। কিন্তু খবরদার কোনও হল্লা যেন না হয়। গোলমাল হলে এসে চাবকাবো। আমরাও সুবোধ বালক, শিক্ষকের কথা শিরোধার্য। শংকর নামে আমাদের এক সহপাঠী, তার কাছে ছিলো সীমাহীন স্বপনসমগ্র। ধর্মক্লাসের ​​​​​​​পবিত্র ​​​​​​​পরিবেশে সে পড়ে শোনাতো দীপক চ্যাটার্জি এবং রতনলালের রোমাঞ্চকর কীর্তিকলাপ। তারা ছিলো দেশি হোমস আর ওয়াটসন জুড়ি। ফর্ম্যাট বিচার করতে গেলে মোটামুটি দস্যু মোহন এবং কিরীটি রায়ের গরিব আত্মীয় বলা যেতে পারে। আমরা এক কথায় পুলকিত। রোমাঞ্চিত হয়ে শুনতাম। যেহেতু 'বিশ্বচক্র' সিরিজের বইগুলো ছিলো 'কঠোর ভাবে' 'কলেজ স্টুডেন্ট’দের জন্য, তাই সেখানে ডিটেক্টিভ ছাড়াও অনেক সুন্দরীদের আনাগোনা থাকতো। থাকতো সুচিত্রার মতো পিয়ানোতে বসা নায়িকা আর কমল মিত্রের মতো পাইপ ও ড্রেসিংগাউন ওয়ালা বাবারা। অধিকন্তু থাকতো যত্রতত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের উদ্ধৃতি (বাঙালির বাজার এতো সুন্দর আর কে বুঝতে পেরেছে?) । গপ্পোগুলো ছিলো মোটামুটি ভাবে শহর কলকাতার সীমারেখার মধ্যে। শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জের বর্ডার। অবশ্য আফ্রিকার জঙ্গল বা চিনের মরুভূমি, আফঘানিস্তানের পাহাড় বা ব্রাজিলের ক্রাইম সিন্ডিকেট থেকে বিচিত্র লোকজনের আনাগোনাও চলতো সমানে। কিন্তু আমাদের লেভেলের পাঠকদের বাদ দিলে, এই সব চরিত্রের ব্যাপার-স্যাপার খতিয়ে দেখার চেষ্টা ছিলো ভালো রকম 'ইনজুরিয়াস টু হেলথ'। পুলিশের চরিত্রগুলি ছিলো গবেট 'সুন্দরবাবু'র ছাঁচে। এই সিরিজগুলির প্রকাশনা ইত্যাদির অকুস্থল ছিলো বটতলা। সম্ভবত ঝামাপুকুর থেকেও বেরোতো।

মলাট ও ছবি আঁকতেন প্রধানত তুষার চ্যাটার্জি (তুকাচ) । কখনও প্রতুলচন্দ্রের ছবিও থাকতো ( আহা, প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যো , ওঁর মতো ইলাস্ট্রেটর বাংলায় আর আসেননি। হ্যাঁ, আমি সুধীর মৈত্র, পূর্ণ চক্রবর্তী বা নারায়ণ দেবনাথকে স্মরণে রেখেই বলছি)। পরের দিকে আঁকতেন নারায়ণ দেবনাথ। নায়িকাদের যে সব চেহারা বইয়ের মলাটে দেখা যেতো সেগুলি বেশ মনোহরণ। সবারই মুখের ডৌল সুচিত্রা সেনের মতো। তন্বী, পাফ দেওয়া কেশবিন্যাস, লবঙ্গলতা গোছের। চম্পাকলির মতো আঙুল (কেন এরকম বলা হয়, সিম্পলি জানিনা) দিয়ে পিয়ানো বাজাতেন তাঁরা। সচ্চরিত্র নায়করাই তাঁদের বিবাহ করতে পারতেন। সব মিলিয়ে দশ-পনেরো বছর বয়সের উৎসুক বালকদের জন্য সে সব ছিলো খুব উপাদেয় বস্তু। বিশ্বচক্র ছাড়া যে সিরিজগুলো মনে পড়ছে, যেমন, রক্তচক্র সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ, বাজপাখি সিরিজ ইত্যাদি। এই সিরিজগুলোতে নারায়ণ দেবনাথ এঁকেছেন। একটি ডার্ক চরিত্র ছিলো পাগল বৈজ্ঞানিক। যার কীর্তিকলাপ ছিলো টিপিক্যাল জিঘাংসু টাইপের। আর দাড়িটা থাকতো আমার মতো।

শ্রীস্বপনকুমার ​​​​​​​অবশ্য ​​​​​​​সেকালে ​​​​​​​নীহার ​​​​​​​গুপ্তের ​​​​​​​সামনে ​​​​​​​ম্লান ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​যেতেন। নীহার গুপ্তকে বেনামে বই লিখতে হতোনা। নিজের নামে তাঁর একটি বিপুল ও স্থায়ী বাজার ছিলো।‘বাংলা ​​​​​​​সাহিত্যের ​​​​​​​জনপ্রিয়তম’ ​​​​​​​পত্রিকা ​​​​​​​'নবকল্লোলে' তাঁর ​​​​​​​লেখা ​​​​​​​বাঁধা ​​​​​​​থাকতো। আমার ​​​​​​​এক ​​​​​​​বন্ধুর ​​​​​​​মতে ​​​​​​​ঐ ​​​​​​​কাগজটি ​​​​​​​রেশন ​​​​​​​কার্ডের ​​​​​​​থেকেও ​​​​​​​বেশি ​​​​​​​সংখ্যায় ​​​​​​​ছাপা ​​​​​​​হতো। ​​​​​​​অন্য আর ​​​​​​​এক ​​​​​​​জনের ​​​​​​​মতে ​​​​​​​বাঙালির ​​​​​​​সফ্ট ​​​​​​​পর্নো ​​​​​​​পড়ার ​​​​​​​আহ্লাদকে ​​​​​​​বৈঠকখানায় সাজিয়ে ​​​​​​​রাখার ​​​​​​​সুযোগ ​​​​​​​করে ​​​​​​​দিয়েছিলো ​​​​​​​এই ​​​​​​​পত্রিকাটি। গদ্য শৈলীর কথা যদি আসে, তাহলে বাংলা হলুদ মলাট বইয়ের ভাষার ​​​​​​​উৎস আসলে কে ​​​​​​​ছিলেন, স্বপনকুমার ​​​​​​​না নীহার গুপ্ত, ​​​​​​​তা ​​​​​​​নিয়ে অনেক ​​​​​​​মেধাবী ​​​​​​​আলাপও ​​​​​​​চলতো ​​​​​​​সেকালে।

মোদ্দা কথা, যাত্রায় স্বপনকুমার আর গোয়েন্দা চটির স্বপনকুমার আমাদের বাল্যকাল ভরিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের না ছিলো টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফ্ল্যাট বাড়ি, এসি বা বাইকের বিলাসিতা। ভোর ছটা থেকে ইশকুল। বিকেল চারটে থেকে মাঠে ফুটবল আর সন্ধে ছটা থেকে ন'টা দুলে দুলে 'পড়া করা'। উপরি বোনাস, ইশকুল থেকে বাড়ি, সর্বত্র প্রত্যহ মনে করিয়ে দেওয়া, আমরা চরম আবেগে 'উচ্ছন্নে'র পথে ভেসে যাচ্ছি। আজ বুঝছি, স্নেহময় পিতামাতা ও শিক্ষকদের ভবিষ্যদবাণী 'সত্য' প্রমাণ হয়েছে। নয়তো ধর্মক্লাসের সরকারি টেক্স্ট বই স্বামীজীর 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে'র আলোচনা না করে এই বয়সে শ্রীস্বপনকুমারকে নিয়ে এহেন স্মৃতিমেদুরতা কোন প্রবৃত্তিতে আসে? এ কি 'দেশদ্রোহ' নয়? হয়তো এই বিচ্যুতির জন্যই আমাদের না ​​​​​​​হলো ​​​​​​​'দীপক ​​​​​​​চ্যাটার্জি' ​​​​​​​হওয়া। ​​​​​​​না সেই কালজয়ী লেখকের চৌষট্টি পাতা চটির মলাটে আঁকা নায়িকারা আমাদের নসিব হলেন । যাঁরা যোধপুর পার্ক বা নিউ আলিপুর নামক নির্জন পাড়াগুলির বাগান ঘেরা প্রাসাদ আলো করে থাকতেন। আর অর্গান বাজিয়ে গাইতেন,

'স্বপন পারের ডাক শুনেছি
জেগে জেগে তাই তো ভাবি ...'
2

বিশেষ নিবন্ধ : সুস্মিতা বসু সিং

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


দেখতে নারী
সুস্মিতা বসু সিং



যারে দেখতে নারী, তার চলন বাঁকা...

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন – নারী-ই লিখেছি, বানান ভুল নয়... না’রি লিখিনি। কেন লিখেছি, সেই প্রসঙ্গেই আসছি। তবে হ্যাঁ, একটা কথা সবার আগে জানিয়ে রাখা ভালো। আমি কিন্তু একেবারেই পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদী নই। সঙ্গী হিসাবে পুরুষ ছাড়া জীবনধারণ করার কথা ভাবতেই পারিনা। সহজাত নারীবৃত্তি দিয়েই হয়তো পুরুষের সাহচর্য উপভোগও করি। কিন্তু একথা যেমন সত্যি, তেমনই আধুনিকমনস্ক নারী হিসাবে, ঘরে বাইরে সমানতালে নারীর স্বাধীনচেতা স্বাবলম্বী চরিত্র বৈশিষ্ট্যকেও সমধিক গুরুত্ব দিই, একথাও অনস্বীকার্য। আর যাবতীয় বিতর্কের সূচনা মনে হয় সেখান থেকেই।

নিজের কথাই বলি। আমার দিদিমা ছিলেন সেই যুগের বারো ক্লাস পাস। বাড়ির ছোটবউ, ছয় ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ী, ভাসুর ননদদের নিয়ে তাঁর ভরন্ত সংসার। অসম্ভব ভালো রান্নার হাত, সারদেশ্বরী আশ্রমিক বিদ্যালয়ের গরীব মেয়েদের জন্য নিজে হাতে ফ্রক, ব্লাউজ, সায়া বানিয়ে দেন, এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু তাই বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখা!! জানতে পেরে পুলিশ কমিশনার শ্বশুর প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বিয়ের আগে মেয়েটা যে নিজের ছোট মেয়ের সহপাঠিনী ছিলো! দেশ পত্রিকার দপ্তরীকে ডেকে পাঠিয়ে দিলেন কবিতা, ছাপার জন্য। শাশুড়ীর মুখ হলো ভার, তবুও মেনে নিলেন। কিন্তু বাড়ির ছোটবউ এরপর যা শুরু করলেন, সেটাতে আর চুপ করে থাকা দায় হলো। সেলাই জমা দেবার নাম করে বেরিয়ে, কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রিভলবার, কার্তুজ, দরকারী চিঠিপত্র, জরুরী কাগজপত্র, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়া শুরু করলেন বিপ্লবীদের কাছে। মেয়েদের একটা দল গড়লেন এই কাজ আরও বিস্তৃতভাবে করার জন্য। সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। শ্বশুরমশায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, শাশুড়ি রাগে ফেটে পড়লেন। শ্বশুরমশাই ছোটবউমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, তুমি কি করছো, তা তুমি জানো তো? দুর্দমনীয় মেয়েটার সম্মতিসূচক ঘাড়নাড়া দেখে কোমল হলো শ্বশুরের দৃষ্টি। বললেন, বেশ, তবে আমার নাতিনাতনিদের যেন অযত্ন না হয়। শাশুড়ী কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন এক্কেবারে।

এহেন দিদিমার তৃতীয় সন্তান আমার মা। দাদু প্রথম জীবনে মিলিটারিতে ও পরবর্তীকালে পুলিশে চাকরী করতেন বলে স্থায়ীভাবে বাড়ীতে প্রায় থাকতেনই না। তাই দিদিমার একক তত্ত্বাবধানেই বড় হয়ে ওঠা। অসম্ভব কমনীয় এক বহিরাবরণের অন্তরালে অদ্ভূত ঋজু নীতিনিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা মাকে একদিকে যেমন স্বাতন্ত্র দিয়েছিলো, তেমনিই এই একই কারণে মায়ের দুর্গতিরও অন্ত ছিলো না। বিয়ের আগে বি এ পাস করে স্কুলে পড়ানো, দক্ষিণী থেকে গান শিখে ও পরে দিলীপ কুমার রায়, সুচিত্রা মিত্রর কাছে গানের চর্চা করে মহাজাতি সদন, রবীন্দ্রসদন, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন দাপিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো মেয়ের বিয়ে হলো পঞ্চাশ জন সদস্যের এক যৌথ পরিবারে, যেখানে প্রগতির আলো প্রবেশ করতে সময় লেগেছিলো আরও প্রায় দুই দশক। সেখানে বিনা প্রতিবাদে যাবতীয় অন্যায় আবদার মুখ বুজে অন্য বউদের মতো মেনে নিতে পারতেন না বলে বেয়াড়া বউ-এর দুর্গতিও আটকানোর সাধ্য ছিলো না কারোর। সে বাড়িতে গান করা তো দূরের কথা, বাড়ির মেয়েদের গান শোনাটাই ছিলো একটা গর্হিত অপরাধ। আমার এঞ্জিনিয়র বাবা ফিলিপসের রেডিওর সঙ্গে কানেক্ট করে সারা বাড়িতে এখানে ওখানে বক্স লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঘড়ি মেলানোর ছুতো করে একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও-ও কিনে দিয়েছিলেন মাকে। সেখানে বাড়ির বৌদের বই পড়াও ছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। আমার র‍্যালিস ইণ্ডিয়া-র চেয়ারম্যান ঠাকুরদার বক্তব্য ছিলো, বাড়ির বউরা সব সময় নতুন নতুন শাড়ী পরে এক গা গয়না ঝমঝমিয়ে আহ্লাদ করে ঘুরে বেড়াবে... তাদের আবার এমন বেয়াড়া শখ থাকবে কেন?

এমন ‘সুবর্ণলতা’র যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি নিঃসন্দেহে। আজ প্রগতিশীল বাঙালী পরিবারে মেয়েরা অনেক স্বাধীন। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘তবু’ কিছুতেই পিছন ছাড়ে না। আর তাই, বাড়ির পুরুষটির আয় নারীটির আয়ের চেয়ে বেশী হওয়া উচিত। আর তাই, সংসারের সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব একান্তভাবেই নারীর একার। অসম্ভব, এখন ম্যাচের খুব ক্রুশিয়াল মোমেন্ট, এখন রুটি আনতে যাওয়া যাবে না, প্লিজ রাগ কোরোনা সোনা... একটা কিছু ম্যানেজ করো, প্লিজ। ও হো... কাল বনির এগ্‌জ্যাম বুঝি? সুইটহার্ট বেটা, গো অ্যান্ড স্টাডি... মাম্‌মা কে জ্বালিও না... বস যদি দুর্ভাগ্যক্রমে একজন নারী হন, তবে তো চাকরী জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নাইটপার্টি থেকে ড্রিংক করে আমি ফিরিতে পারি, ঠিক আছে... কিন্তু তাই বলে তুমিও!! না না জানি, সামান্যই, তবু... বিশেষ করে আজ যখন আমি যাইনি তোমার সঙ্গে!! আসলে আমার কিছুই না, কে আবার কি মনে করে, তাই বলছিলাম, আর কি!! কাম অন্‌, ডারলিং...ডোন্ট বি সো মীন, মিষ্টু আমার আপন মামাতো বোন। আচ্ছা, সোম যেন তোমার কেমন বন্ধু হয়? স্কুলের বন্ধু, বলেছিলে ...না? বাড়িতে কে কে আছে? বউ কি করে... না না... জাস্ট কৌতূহল, আর খি!! আরে, তুমি রাগ করলে নাকি? রাগলে তোমাকে এমন সুন্দর লাগে না... হেঁ হেঁ... নিজেকে আর...

কি? ভুল বলছি কিছু? তাহলেই বলুন!! যারে দেখতে নারী, অনাদিকাল থেকেই তো তার চলন বাঁকা... আর সেটা সিধে হওয়ার চান্সও জাস্ট নেইই...




0

বিশেষ নিবন্ধ : পল্লববরন পাল

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


আজ বসন্ত
পল্লববরন পাল



‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’

সুভাষদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আমার কবিতাও। আমাকে নিয়ে ওনার বিখ্যাত অনেক কবিতা আছে, যেমন – ‘কলকাতার বাঁড়ুজ্জে’ – মুশকিল হলো, আমার বিরোধীদের তো একটাই কাজ – মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে পাউডার-টাউডার মেখে বসে শুধু আমার কুৎসা করা, এছাড়া তো অন্য কাজকম্মো নেই, তাই ওরা বলে, ওটা নাকি সুভাষদার নিজের লেখা নয় – অনুবাদ - আসল কবিতাটা নাকি লিখেছিলো একজন তুরস্কের লোক – ইয়ে, কী যেন নাম, কী যেন নাম – জাজিম হিম্মত না নাজিম কী একটা – আমি অনেকবার বলেছি, এই বিরোধী ব্যাটাদের আসল পবলেম হলো, ওদের মাথার মধ্যে একটুও বেন নেই – ওই হিম্মতদা তো নাকি তুরস্কের কবি, তো বলুন তো, একজন তুরস্কের লোক জানবে কী করে যে আমরা বাঙালিরা ব্যানার্জীকে বাঁড়ুজ্জে বলি? হুঁ হুঁ, আসলে আসল হিম্মত একমাত্র আমার আছে, হ্যাঁ, আমারই আছে, তাই আমিই জানি যে হিম্মত কথাটাও আদপে বাংলা – আমাকে সুভাষদা নিজে বলেছিলেন যে, এটা ওনার নিজের লেখা আর আমাকে নিয়েই লেখা, ওসব হিম্মত-টিম্মত সব বুজরুকি – বিরোধীদের চক্কান্ত - আমি বিদেশ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার পরে আশিব্বাদস্বরূপ সুভাষদা এটা লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। না না, ১৯৫২ সালে নয়। যাহা বাহান্ন তাহাই বিরানব্বই। যারা বলছে বাহান্ন, দুষ্টুমি করে বলছে।

যাগ্‌গে, এই আমি ঘোষণা করে দিলাম আমার পিয় সুভাষদার কথায় – আজ বসন্ত। ফুল ফুটলো কি ফুটলোনা, সে নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবেননা। ব্যাস! আর অন্য কোনো কথা হবেনা, চোখ বন্ধ করে এবারে যান, সবাই ধেই ধেই করে নাচুন, কোমর দুলিয়ে গান করুন, আনন্দ করুন, নিজেরাই ফুল ফোটান - কারণ আজ বসন্ত। বসন্ত মানে শীত শেষ – দুঃখের দিন শেষ - পাতাঝরা শেষ - এবার পোরিবত্তন – নতুন পাতা, নতুন ফুল, নতুন আনন্দ – পোরিবত্তন মানেই আমি – আমি মানেই বসন্ত -বসন্ত মানেই উৎসব। উৎসব মানেই তেলেভাজায় বিশ্বদশ্যোন। বসন্ত মানেই সরস্বতীপুজো – ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’ - ভালোবাসার দিন – ভালোবাসুন - ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষকে ভালোবাসুন – বেশি বেশি ভালোবাসুন - দেখবেন, চীৎকার না করে সবাই যেন ওই ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’, মানে বড়ো বড়ো চোখে আপনাদের বিশ্বরূপ দশ্যোন করে, অর্থাৎ আপনাদের ভালোবাসার উৎসব উপভোগ করে – বেশি পোতিরোধ বা ট্যাঁফো করলে বুঝবেন নিশ্চয়ই বিরোধী পার্টি, মানে ভালোবাসার বিরোধী আর কি - তখন ঘাড় মটকে উপভোগে বাধ্য করাবেন, বুঝলেন? বিরোধীদের কোনো চক্কান্ত আমি বরদাস্ত করবো না।বন্ধুরা, আগেও ওদের আমলে বসন্তোৎসব হতো, কিন্তু সেটা হতো রক্ত নিয়ে হোলি খেলা – ওরা রক্ত নিয়ে উৎসব করতো - মানুষের রক্তে। কিন্তু বসন্তোৎসব আসলে ভালোবাসার উৎসব, সুতরাং ভালোবাসতেই হবে সবাইকে – ইট্‌স মাই অর্ডার, লাভ ইজ মাস্ট, নো কম্পোমাইজ - বসন্তোৎসব আবার রঙেরও উৎসব, ‘রঙ যেন মোর কর্মে লাগে’ - কাজেই আপনারা সবাই রঙিন হয়ে রঙবাজী করলে আমি একটুও বকা দেবো না। যান। বেরিয়ে পড়ুন। দুগ্‌গা দুগ্‌গা। 

বসন্তোৎসব মানেই শান্তিনিকেতন। রবিদা আমার কথাতেই তো বোলপুরে এই উৎসব শুরু করেছিলেন –দোলের দিন – উনি তো বাহ্মণঠাকুর নয়, বাহ্ম ঠাকুর ছিলেন – বাহ্ম আর বাহ্মণে তফাৎ আছে, একটা মুর্ধণ্য ‘ণ’য়ের – বাহ্মরা পুজো-টুজোয় বিশ্বাসী ছিলোনা, তাই রবিদাও সরস্বতীপুজো করতেন না, কিন্তু ওই আমার মতো উৎসব খুব ভালোবাসতেন, তাই দোলের দিনটাকেই উনি বেছে নিয়েছিলেন – গান লিখেছিলেন ‘দোলে দোদুল দোলে দুলনা’ – কবিতা লিখেছিলেন ‘দোল দোল দুলুনি রাঙ্গা মাথায় চিরুনি’ – দোল নিয়ে ওনার অনেক লেখা আছে, আমাকে পড়িয়েছিলেন – আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ঐ ‘ঝুলন’ কবিতাটা – ওটা পড়েই তো আমি সেই পোকাশ্যে গলায় কাপড় জড়িয়ে ঝুলনের একটিং করেছিলাম - ‘আমি পরাণের সাথে খেলিবো আজিকে মরণখেলা’ – না না, পরাণবাবুর সাথে আমার কোনো শত্তুতা নেই, মতপার্থক্য থাকতে পারে, উই আর ডেমোক্র্যাটিক কান্টি, আর আই বিলিভ ইন ডেমোক্র্যাসি অনলি – তো, ওই কবিতাটার মধ্যে বারকয়েক আছে – ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ –ঘুরে ঘুরে আসছে ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ - ওফ্‌, একদম শ্লোগানের মতো, শিরায় শিরায় যেন কাতুকুতু দেয় – অনেকটা আমার ওই ‘এপাং ওপাং ঝপাং/ পড়ে গিয়ে পটাং/ বাঁচাও বলে ঝপাং/ মুচকি হাসে এপাং’ কবিতাটার মতো – রবিদা আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন – ‘তোমার মতো যদি এরকম স্যাটাস্যট আমিও লিখতে পারতাম…’ বন্ধুরা, উনি এটা কবে বলেছিলেন জানেন? ওই যে, গান্ধীজীকে শরবৎ খাইয়ে অনশন ভাঙিয়ে ফেরার পথে – অতো সাল-তারিখ মনে থাকেনা আমার – মনে রাখিনা।

বাঙালি উৎসব পিয়। আমিই পোথম, যে বাঙালির এই উৎসবপিয়তাকে মর্যাদা দিয়েছি, বাঙলায় সত্যিকার উৎসবের মেজাজ পোতিষ্ঠা করেছি। কী বন্ধু, তাই তো? একটু জোরে ‘হ্যাঁ’ বলুন, সবাই শুনুক।শিল্প না হোক, শিল্প নিয়ে আমি পোত্যেক বছর উৎসব করি। সারদা থেকে টেট, ত্রিফলা থেকে ডেলো -কেলেঙ্কারির উৎসব। কামদুনি থেকে কাটোয়া – ধষ্যণ উৎসব। সিণ্ডিকেট থেকে মাটি, সাইকেল থেকে ক্লাব – সোনার বাংলা জুড়ে এখন শুধুই উৎসব। আমি জানি, সামান্য কিছু ইতিহাস বা পুরাণবাগীশ বিরোধীকণ্ঠ এখনও আমার এই বাঙলায় লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘাপটি মেরে আছে, যারা আপনাদের বিভ্ভান্ত করার চেষ্টা করবে, অবশ্য সবাই যে খারাপ তা নয়, বলবে – এই দোল উৎসব নাকি হিন্দুদের অতি প্রাচীন উৎসব – আমার মুসলিম ভাইবোনেদের বঞ্চনা করে মিথ্যে পুরাণের দোহাই দিয়ে সাম্পদায়িক সম্পীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে - রাজা হিরণ্যকশিপু আর তাঁর দুষ্টু বোন হোলিকার দুষ্টুমির গপ্পো শোনাবে – হোলিকাদহন-এর সাতকাহন – বিষ্ণুভক্ত পোহ্লাদকে জব্দ করতে, আগুনে পুড়িয়ে মারতে নিজের পোষাকেই আগুন ধরে গিয়ে পুড়ে ছাই হবে হোলিকা, পরদিন সকালে সবাই যখন দেখবে হোলিকা ইজ অনলি এ বার্ন্ট ডেডবডি – নো হাড় নো মাংস, অনলি ছাই, তখন আনন্দে সবাই হইহই করে সেই ডেডবডির ছাই নিজেরাই নিজেদের মাথায়-মুখে মাখাবে – এই নাকি হোলিখেলার শুরু!যত্তোসব আজগুবি। মুখে ছাই মেখে কোনোদিন উৎসব হয়? গা পিত্তি জ্বলে যায় শুনে। বন্ধুরা, একবার গিয়ে ওই বেনলেস পুরাণবাগীশদের মাথায় আর মুখে আলকাতরা বা ছাই যাহোক একটা লাগিয়ে জিগেস করুন তো - হিরণ্যকশিপু কোথাকার রাজা ছিলেন? – মুলতানের। এবার আমি আপনাদের জিগেস করি, বলুন, মুলতান কোথায়? – পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবে কারা থাকে? পাঞ্জাবীরা, যেমন বাঙলায় থাকে বাঙালিরা, বিহারে বিহারিরা। তো বন্ধু, পাঞ্জাবীদের ধর্মগুরু কে? বিষ্ণু নাকি গুরু নানক? একটু জোরে নানকের নামটা বলুন ভাই… পেসের ক্যামেরার মাধ্যমে ওই মিথ্যেবাদীরাও টিভিতে দেখুক, শুনুক -বিরোধীদের এই ধাপ্পাবাজিতে আপনারা যেন কেউ চমকাবেন না। পবলেম হলে সত্যিটা আমার থেকে জেনে নেবেন। না না ভাই, আমি আর সত্যের পোতীক-টোতীক হতে চাইনা, ওসব ব্যাকডেটেড, বরং মানুষ চাইছে সত্য এখন আমাকে পোতীক বানাক – মানুষের ডিম্যাণ্ড – কাজেই আমি মাথা পেতে আপনাদের সম্মান গোহণ করছি।

এই, কী বললি তুই? কী? চন্দগুপ্তর আমলে কালিদাসের লেখায় হোলির কথা আছে? কে কালিদাস? কোন পার্টির লোক? এই এই, যে বললো কথাটা, ওকে ধরো তো, ধরে নিয়ে এসো – ওই কীচন্দ গুপ্ত না কি একটা নাম বললো, পুরো নামটা বলারও সাহস নেই – ব্যাটা ওই গুপ্তরই গুপ্তচর নিশ্চয়ই, ওর পকেট-টকেট তল্লাসি করো, বোম-টোম থাকতে পারে – বন্ধুরা দেখুন, বলতে বলতে একটা পুরাণবাগীশ মিথ্যেবাদীকে ধরে ফেললাম – হুঁহ্‌, আমাকে চমকাতে এসেছে! আমাকে চেনেনা! আমি গোটা আণ্ডারওয়াল্ড কন্টোল করি, তোদের খতম করতে আমার এক মিনিট লাগবে রে শালা! স্যরি। এই, ওকে জেলে পুরে দাও, ওখানে ঘানিউৎসব করুক বাছাধন।

সে যাগ্‌গে-যাগ, বন্ধুরা, শান্ত হোন, বসে পড়ুন, ডিসিপ্লিন মেন্টেন করুন। এখন হোলি নিয়ে একটা গল্প বলবো আপনাদের – ভালোবাসার গল্প। এটা গল্প নাকি সত্যি, সেটা আপনারাই বলবেন – আগে গল্পটা শুনুন। আপনারা পুতনা রাক্ষসীর কথা জানেন - যে নিজের বুকের দুধে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিলো কিষ্ণকে – মারবে বলে, কিন্তু কিষ্ণ কি তাতে মরেছে? না বন্ধু, মরেনি – ওসব পাতি বিষ-টিষে কিষ্ণ কেন, আমাদের কেষ্টরও কিস্যু হয়না - তো সেই বিষ খেয়ে বাচ্চা কিষ্ণর গায়ের রঙ হয়ে গেলো কালো।সেই কারণেই কিষ্ণর আর এক নাম কালা। আমিও ছোটোবেলা খুব ফর্সা ছিলাম জানেন? আমাদের কেষ্টর মতো – ও অবশ্য ফর্সাই, তবে ওই যা এতো বিষ খায় যে ওর মাথায় একটু অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে গেছে আর কি। আমার বিরোধীরা আমাকে এতোবার এতো প্যাঁদান পেঁদিয়েছে, স্যরি, মানে পিটিয়ে পিটিয়ে সারা গায়ে কালসিটে ফেলে দিয়েছিলো, সেই থেকে আমারও গায়ের রঙ কালো। কিন্তু বন্ধুরা,পুতনার পার্টি যেমন পারেনি কিষ্ণকে মেরে ফেলতে, তেমনি আমার বিরোধী পার্টিও পারেনি আমাকে মেরে ফেলতে। কিষ্ণ বা আমার লাশ ফেলে দেওয়া এতো সহজ নয়। আমরা মানুষের সঙ্গে ছিলাম আছি থাকবো। আমরা অমর, চলমান অশরীরী। কিষ্ণর ছিলো নারায়ণী সেনা, চলমান অশরীরীর ছিলো ব্যাণ্ডরসেনা, আমারও আছে বান্দরসেনা। সে যাই হোক, যে কথা বলছিলাম - তো কিষ্ণ যখন একটু বড়ো হলো, ওর মনেও একটু ইন্টুবিন্টুর ইচ্ছে হলো - তো ওর মনে হলো, ও তো এতো কালো, রাধা বা তার সখিরা ওকে কি ভালোবাসবে? মায়ের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো। বিরক্ত হয়ে ওর মা বললো – যা, রাধাকে গিয়ে বল, তার ইচ্ছেমতো রঙ যেন তোর মুখে মাখিয়ে দেয় – সেই থেকে হোলি –ইন্টুবিন্টু - রঙ মাখামাখি। সেই থেকে কিষ্ণ আর রাধা আমাদের সবচেয়ে পপুলার হিরো-হিরোইন।উত্তম-সুচিত্রা। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, ওনারা বেঁচে থাকলে এমপি করে দিতাম, দুজনকেই একসাথে –লোকসভায় বাঙলা একের পর এক সুপারডুপারহিট স্টোরি দিতো। বাঙলা আবার ভারতসভায় সেষ্ঠ আসন নিতো। ইস্‌! হলোনা। নো পবলেম। আমি নতুন মহানায়ক মহানায়িকা তৈরি করেছি। তাদেরকে লোকসভায় পাঠিয়েছি। উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে আপনারা ভালোবাসেন। কিষ্ণকেও ভালোবাসেন।আমাকেও। জানি। কিষ্ণর মতো আমাকেও আপনারা শুধু ভালোই বাসেন না, পুজোও করেন, আমার ফটোতে রঙ মাখান – সেটাও আমি জানি।

বন্ধুরা, আপনাদের আর দেরি করাবোনা। ছুকছুক করছেন সবাই, বুঝতে পারছি। শুধু একটা কথা - এই দোল উৎসবে আপনারা যারা ভালোবাসতে যাচ্ছেন, রবিদার ওই ‘ঝুলন’ কবিতাটা মাথায় রেখে ভালোবাসবেন – যেখানে উনি বলছেন –

          ‘আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
           আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
           করি লুন্ঠন অবগুন্ঠন-বসন খোল।
                                    দে দোল দোল।’

আমি চাইনা, রবিদার কোনো অসম্মান হোক। আমি চাই, তাঁর কথা যেন আপনারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তারপর ডেলোর মতো কোনো কেলো-টেলো হলে আমি দেখে নেবো। নির্ভয়ে যান বন্ধুরা।উৎসবে মেতে উঠুন। আর শেষ করার আগে আমার সেই প্রিয় সুভাষদার কবিতাটার মতো করে বলতে চাই –

  ফুল ফুটুক না ফুটুক     আজ বসন্ত
ভাত জুটুক না জুটুক      আজ বসন্ত
শিল্প আসুক না আসুক      আজ বসন্ত
কাজ মিলুক না মিলুক       আজ বসন্ত
ইজ্জত থাকুক না থাকুক       আজ বসন্ত

বসন্ত আসুক না আসুক     আজ উৎসব

                তাই
                         এপাং ওপাং ঝপাং
2

বিশেষ নিবন্ধঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ

বাঁশী
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী



কেউ এটা সঠিকভাবে জানেই না। জানেই না যে, বাঁশী যারা বাজায়, তাদের কোনও কাজ নেই এ-সংসারে। আর কাজ যদি বা থাকেও, সে কাজটা তার কাজ নয়। তার বাঁশী বাজানোরই কথা ছিল, নেহাৎ কোনও প্রয়োজনে তাকে কাজটা করতে হচ্ছে। আমার মনে আছে, আমি যখন ওপাড়ায় থাকতাম – আমাদের ভাড়াবাড়ির সঙ্গেও বাড়িওয়ালার বিরাট মাঠ ছিল একটা, আর পিছনদিকটায় ছিল এক পরিত্যক্ত ভিটে, যেখানে অনর্থক একটা জঙ্গল ছিল, সেখানে ঘু-ঘু চরে বেড়াত। সেই বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তা গেছে, সেই রাস্তায় অলস দুপুরে মাঝে মাঝে এক বাঁশীওয়ালার দেখা পেতাম। সে আপন মনে বাঁশী বাজিয়ে যেত, কারও কাছে সে বাঁশী থামিয়ে পয়সাও চাইত না, কেউ তাকে পয়সা দেবার আগ্রহও দেখাত না। বস্তুত, বাঁশীওয়ালাকে পয়সা দিয়ে যেন অপমানও করা যায় না। ‘বাঁশী বাজায়’ মানেই সে এক উদাসী, সে মানুষকে ঔদাসীন্যের সঙ্গীত শোনায়। এই ঔদাসীন্যের মধ্যে আবার চরম এক ‘রোম্যান্টিসিজম্’ আছে, আছে চরম এক উপভোগ্যতা, যেখানে নিজেকেই বুঝি নিজে সবচেয়ে উপভোগ করে মানুষ।

গাঁয়ের বাড়িতে কমলিনী-দিদিকে দেখেছিলাম। তাঁর পিতা সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন, কিন্তু পুত্রী কমলিনীর বিয়ে দিতে পারেননি। আমি সজ্ঞানে যখন তাঁকে দেখেছি, তখন তাঁর সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়স। দেখতে তখনও বেশ সুন্দরী– সেটা অবশ্য এখন বুঝি। কেননা আমি যখন তাঁকে দেখেছি, তখন স্ত্রীলোকের যৌবন কিম্বা সৌন্দর্য বিচারের জ্ঞান হয়নি আমার। কিন্তু এখন বুঝি, সেই প্রথম-প্রৌঢ়তাতেও কী অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন তিনি। অথচ যৌবন-বয়সেই তাঁর যে কী হল, কেউ আমরা বুঝলাম না। তিনি নাকি স্বপ্নে এমন দেখেছেন – শ্যামসুন্দর কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁর আর বিয়ে করার উপায় নেই। এরই মধ্যে কমলিনী-দিদির ঠাকুমার গুরু এসেছিলেন বাড়িতে। তিনি ভারী রসিক ভক্ত বৈষ্ণব মানুষ – মনোহর দাস বাবাজি, বৃন্দাবনে তাঁর বাস। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই তাঁর সঙ্গে থাকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ স্বরূপ গোবর্ধন শিলা। বাবাজি তাঁর মালার থলিতে গোবর্ধন শিলা নিয়ে গলায় ঝোলান, আর শিষ্যবাড়িতে এসে ঠাকুরের চৌদলে সেই মূর্তি বসিয়ে ঝোলা থেকে সোনার চূড়া-বাঁশী বার করে শ্রীমূর্তির পাশে বাঁকা করে রাখেন, শিলার মাথায় পরিয়ে দেন নকল চুল, তার উপর শিখিপুচ্ছ গোঁজা।

বাবাজি-মশায়ের সেবার মাধুর্য দেখে কমলিনী-দিদি তাঁর কাছেই দীক্ষা চাইলেন। বাবাজি চমকে উঠলেন একেবারে। তারপর কমলিনীর পিতা সবিস্তারে জানালেন সব। এমনও বললেন – বাবা! মেয়ে আমার বিয়ে করবে না। বলে নাকি তার বিয়ে হয়ে গেছে শ্যামসুন্দরের সঙ্গে। তাকে অনেক বুঝিয়েছি আমি, সে শুনবে না। তা বাবা, টাকা-পয়সার অভাব আমার নেই। একটা মেয়ের ভাত, সবার পাত কুড়িয়েও হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ওর জীবন চালাবার পাথেয় নিয়ে চিন্তা করছি, বাবা! ও জীবন কাটাবে কী করে? কাজেই ওকে দীক্ষা দিন বাবা, ও কৃষ্ণের সেবা করুক, অন্ন ভোগ দিক, ঠাকুরের শিঙার করুক, সন্ধ্যাবেলায় পদাবলী কীর্তন শুনবো আমরা।

মনোহর দাস বাবাজি দু’দিন ধ্যানমগ্ন বসে থেকে পরের দিন বৈষ্ণবমতে দীক্ষা দিলেন কমলিনী-দিদিকে। দীক্ষার শেষে তাঁর গিরিরাজ গোবর্ধনকে সামনে বসিয়ে বাবাজিমশাই গিরিধারীর সোনার বাঁশীখানি কমলিনীর মাথায় ঠেকিয়ে বললেন – এই বাঁশী আমার শ্যামল সুন্দরের প্রতিমূর্তি। তুমি তোমার প্রাণের স্বামী ভেবে এই বাঁশীর উপর কৃষ্ণের পূজা-অর্চনা-শিঙার করবে। এই বাঁশীই তোমার বংশীধারী শ্যামসুন্দর কৃষ্ণ।

আমি কমলিনী-দিদির ঠাকুরের সিংহাসন দেখেছি ছোটবেলায়। তাঁর ঠাকুরের ঘরে দু’টি সিংহাসন। একটিতে অদ্ভুত একটি পাথরের উপর ‘মাউন্ট’ করা সেই গুরুদেবের দেওয়া কৃষ্ণ-প্রতিরূপিনী বাঁশীটি। অপর একটি সিংহাসনে রাধা-কৃষ্ণের পৃথক দু’টি যুগলমূর্তি। শুনেছি, বৃন্দাবনের গোবর্ধন-পাহাড় থেকে কমলিনী-দিদি একটি বড়ো ধরনের গিরিধারী শিলা আনিয়েছিলেন। কৃষ্ণের ভাব আনার জন্য তাতে খচিত হয়েছিল মিনে করা আঠায় লাগানো চোখ-মুখ-নাক, আর বাঁশীটি সযত্নে সন্নিবেশ করা হত সেই গিরিধারী গোপালের মুখের কাছে। তার সঙ্গে সারা সিংহাসন জুড়ে বন্য ফুলের সাজ। সেই বাঁশীখানিকে তখন সজীব মনে হত। যেন এখনই তান উঠবে বংশীধারীর ‘কুঞ্চিতাধরপুটে’। কমলিনী বিকেল হলেই বলতেন – আমার ঠাকুরের শিঙার করার সময়। এখন তাঁকে শৃঙ্গার-বেশে সাজাতে হবে; আর সেই সময়টাতেই বিগ্রহের অবস্থানে একটা পরিবর্তন ঘটাতেন কমলিনী-দিদি। পাশের সিংহাসন থেকে কৃষ্ণের অবয়বী মূর্তিখানি নিয়ে আসা হত গোবর্ধন-শিলার সামনে এবং সেই মূর্তির হাতের ফুটোর মধ্যে দিয়ে বাঁশীখানি গলিয়ে দিতেন কমলিনী-দিদি। ‘ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিম-ঠামে’ দাঁড়ানো এই কৃষ্ণমূর্তিটিকে একটু ব্যাঁকা-ত্যারচা করে অবস্থিত করার পর দিদি বলতেন – এই বাঁশী ছাড়া সারাটা দিন কেমন আভরণহীন মলিন লাগে মানুষটাকে, দেখেছো তো! আবার দ্যাখো, সেই শৃঙ্গারোজ্জ্বল বেশ, ‘অখিলরসামৃত মূর্তি’ – বাঁশী ছাড়া আমার কৃষ্ণকে মানায়ই না। বাঁশীটাই ওর সব, এই বাঁশীই তিনি।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম – তাহলে সারা দিনই বাঁশীটা দিয়ে রাখো না কেন ওই হাতের কুণ্ডলীতে? কমলিনী বলেছিলেন, সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটায় একবার দিই বটে। তখন ওর গোষ্ঠে যাবার সময়, গোরু চরাতে গেলে ওর বাঁশী লাগে। বলে কিনা – দাদা বলরামের শিঙা শুনলে গোরুগুলি বড্ড লাফালাফি করে, তাঁকে বলাও যায় না কিছু। কিন্তু বাঁশীর তানে ওরা একটু ঠাণ্ডা থাকে, বিকেল হলে গোরুগুলোকে এক জায়গায় আনতেও কাজে লাগে। আমি বলেছিলাম – কিন্তু তুমি তো আর সারাদিন বাঁশীটা দাও না তাঁর হাতে। কমলিনী বলেছিলেন, না দিই না। আমরা রাধারানীর সখীকুলের দাসী। মেয়ে বলে মেয়েদের কষ্টটুকু বুঝি শুধু। জননী যশোমতীর কত কষ্ট বলো! ছেলে গোরু চরাতে যাবে রাখালের বেশে, তার সঙ্গে গোপজনের আরও কত রাখাল, তবু তাঁর চিন্তা এই বুঝি কোনও গোরু তার পিছনের পায়ের লাথি মারল তাঁর ছেলের পায়ে, এই বুঝিকংসের লোক এসে ধরল তাঁর ছেলেকে, রাস্তা-ঘাট মোটেই ভালো নয়, হয়তো তুলেই নিয়ে গেল তাঁর ছেলেকে!

কমলিনী-দিদি বলতে বলতে একটু থামলেন এবার। আমি বললাম – তুমি সকালবেলায় তোমার ঠাকুরের হাতে একবার বাঁশী তুলে দাও, সেই সূত্রেই তুমি গোরু থেকে আরম্ভ করে কংসের কথা শোনাতে আরম্ভ করলে। কমলিনী বললেন – শোনাতে তো হবেই, ভাই! আমি ভাবছিলাম, ব্যক্তিগত ভালোবাসা কি ভীষণ স্বার্থপর হয়! এমনকি আমিও তাই। এই দ্যাখো না, জননী যশোমতী রীতিমতো নির্দেশ দিয়ে বলেছেন – অতগুলি গোরু নিয়ে যাবার সময় তোমার দাদা বলাই বলরাম সামনে-সামনে যাবে, ‘আর শিশু বাম ভাগে’, আর তুমি যাবে তাদের মাঝখান দিয়ে। অর্থাৎ গোরুর লাথির ছাট অন্য বাচ্চাদের গায়ে লাগে লাগুক, আমার ছেলেটির গায়ে যেন না লাগে – কমলিনী-দিদি মিহিসুরে গাইলেন – কংসের লোক অন্য ছেলে নেয় নিক, কিন্তু আমারটি যেন না নেয় –

বলাই ধাইবে আগে          আর শিশু বাম ভাগে
শ্রীদাম সুদম সব পাছে।
তুমি তার মাঝে যাইও        সঙ্গ ছাড়া না হইও
মাঠে বড় রিপুভয় আছে।।

কিন্তু এই যে বিরাট গোষ্ঠে যাবার প্রক্রিয়া, এখানে কত নির্দেশ, আদেশ, পরামর্শ – এখানে সবচেয়ে বড়ো কাজটা কিন্তু বাঁশীর – কমলিনী আসল রহস্য জানালেন এবার। এই বাঁশী মানে মায়ের হৃদয় নিশ্চিন্দি হল, তখন তো দূরভাষ ছিল না যেখবর নেবেন মা। তাই পদাবলী আরম্ভেই মার নির্দেশ হল – তুমি গোরুগুলির সামনে-সামনে যাবে না এবং খুব দূরেও যাবে না গোরু চরাতে, এমন দূরত্বে থাকবে যেখান থেকে তোমার বাঁশীর শব্দ শুনতে পাই আমি –

নিকটে রাখিও ধেনু               পুরিও মোহন বেণু
ঘরে বসি আমি যেন শুনি
কমলিনী-দিদি আবারও গেয়ে ফেললেন যাদবেন্দ্র দাসের পদকলি। সেই গ্রাম্য পরিবেশে এই বাঁশীর পদটি যে কি আর্তি বয়ে এনেছিল আমার কাছে, তা আমি পর্যন্ত জননী যশোমতীর সহমর্মিতায় বুঝেছিলাম যেন। কমলিনী-দিদি বলেছিলেন – এক অতিস্নেহময়ী জননীর কাছেই যেখানে বাঁশীর এত আবেদন, সেখানে আমার রাইকিশোরীর হৃদয়ে যে বাঁশী শতেক ঢেউ তুলে তরঙ্গিনী হয়ে ওঠে, ভাই! আমি প্রতিদিন বিকেলে আমার প্রাণের ঠাকুরকে নিয়ে আসি বাঁশীর সিংহাসনে। দাঁড় করিয়ে দিই গিরিরাজ গোবর্ধনের পাশে আর হাতে তুলে দিই সেই মোহন বাঁশীটি। আমার রাধারানী থাকেন অপর সিংহাসনে, অভিসারিকার বেশে। কৃষ্ণের বাঁশী বাজবে আর আমার বিনোদিনী রাইকিশোরী গাইতে গাইতে যাবেন –
ভালে ভালে বনি আওয়ে মদন মোহনিয়া
অধর-সুধা ঝরু মুরলী-তরঙ্গিনী
বিগলিত রঙ্গিনী-হৃদয়-দুকূল।

সে বাঁশী শুনলে আর ঘরে মন বসে না, ভাই! আমরা সকলে অভিসারিনী হয়ে পড়ি, রাধার সখীদের সঙ্গে খুঁজতে থাকি তাঁকে।




বাঁশী মানে এই অন্বেষণ। বাঁশী মানে সেই সুদূরের সুর, যা অনুক্ষণ পাগল করে আমাদের। অথবা বাঁশী মানে সেই অলৌকিক সুদূর, যার অপেক্ষায় এক অলৌকিক বিরহ-বিলাসের সুখের মতো এক ব্যথা অনুভব করি অহরহ। অথবা বাঁশী মানে সেই মধুর অতিক্রম, যেখানে সমস্ত নিয়ম ভেঙে পড়ে কেজো লোকের মর্মে শেল বিঁধিয়ে দিয়ে। কমলিনী-দিদি বলেছিলেন – সেদিন শারদী পূর্ণিমার রাত্রি ছিল। আকাশ-ভরা চাঁদচুয়ানো জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণ। সেই কোন হেমন্তকালে তিনি কথা দিয়েছিলেন গোপিনী-সখীদের – তোমাদের সঙ্গে মিলন হবে আমার। তোমরা অপেক্ষা কোরো প্রতিদিন। সেই সব নিশিদিন চলতে চলতে আজ শারদী রাত্রি এসেছে। গগনের চাঁদ সারা দিনের প্রতীক্ষায় থাকা পূর্বদিকবধূর গাল ছুঁয়ে দিল তার কিরণকরের স্পর্শে। দিকবধূর গালের লজ্জার লালিমাতে মেটে-লাল হয়ে উঠল পূর্বাকাশ – তদড়ুরাজঃ ককুভ-করৈর্মুখং / প্রাচী আবিলিম্পন্ অরুণেন শন্তমৈঃ। এমন মধুরতা দেখে কৃষ্ণ আর সইতে পারলেন না। তিনি বাঁশী বাজিয়ে দিলেন অশেষ ব্রজযুবতীদের উদ্দেশ্যে – জগৌ কলং বামদৃশাং মনোহরম্।

আর যেই না সেই বাঁশীর সুর হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে এল বৃন্দাবনের কুলযুবতীদের কানে – তখন রাত্রি আঁধার হচ্ছে কেবল, তখন এই বাঁশী শোনার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল – যে যে অবস্তায় ছিল, সেই অবস্থায় সমস্ত কাজ রেখে দৌড়তে আরম্ভ করল সেই বাঁশীর সুর লক্ষ্য করে – যে বাঁশী বাজল বনমাঝে কি মনোমাঝে। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া, একজন খেয়াল করল না যে অন্যজন কী করছে। এ যেন একান্ত ব্যক্তিগত এক সুরের আহ্বান, যাতে মনে হয় এ সংকেত শুধু আমরই জন্য, অথচ আমারই মতো অন্য আর একজনও সেই সুর-সংকেত শুনতে পায়, কেননা সে আমারই মতো আর একজন, কিন্তু কৃষ্ণের বাঁশী শুনলে সেই অন্য আর একজনকে খেয়াল থাকে না – সমস্ত আমিগুলো একসঙ্গে দৌড়োয়, সেই গতিতে দুলতে থাকে শুধু কানের দুল – অসঙ্গ সাক্ষীর মতো, বাঁশী শোনার পর অখিল যুবতীকুলের গতির শীঘ্রতার পরিমাপ করে যেন – আজগ্মুরন্যোন্যলক্ষিতোদ্যমাঃ / স যত্র কান্তো জবলোলকুণ্ডলাঃ।

কমলিনী-দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – এমন হয় কেন? এ কেমন পাগলপারা স্বভাব তৈরি হয় বাঁশীর সুরে যেখানে এতগুলো যুবতী মেয়ে, তারা যে যে-কাজ করছিল, সব ফেলে দৌড়োল – কেউ এক চোখে কাজল পরে, কেউ পায়ের নূপুর গললায় পরে, কারও ‘খসন বসন রসন চেলী / গলিত বেণী লোলনী। এ কেমন করে হয়? কমলিনী-দিদি গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন – এটা আমার গুরুর মুখে শোনা কথা। সেই আমার হাতে গিরিধারীর বাঁশী দিয়ে তিনি বলেছিলেন – বাঁশী হল সেই সুরের বঁড়শি, একবার সুরের সুতোয় তোর গলায় এসে বিঁধল, তো তুই যতই জলের মধ্যে ঘোরাফেরা কর, তোকে যেতে হবে তাঁর কাছেই। আমি এই আমার বাপের সংসারে আছি, তবু ধন্যি বাপ আমার! তিনি আমাকে হাতা-খুন্তি আর সন্তান জন্ম দেওয়ার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন, আমাকে শুনতে দিয়েছেন বাঁশীর সুর। আমার বাবাজিমশায় বাঁশীর জন্মকাহিনী শুনিয়েছিলেন একদিন – বলেছিলেন – যেদিন এই দেহ হবে বাঁশীর মতো, সেদিন সেই সুরের গুরু সুর সাধবেন এই বাঁশীতে।

কথাটা ভাল করে বুঝলাম না বলে কমলিনী বললেন – কৃষ্ণ ব্রজভূমির নায়ক, শতপুষ্পের কুঞ্জবনে তাঁর চলাফেরা, বৃন্দাতুলসী তাঁর সখী, গলায় বনফুলের মালা, এমন মানুষের কাছে প্রকৃতি হল সব চাইতে ভালোবাসার জিনিস। কৃষ্ণ প্রতিদিন বনভূমিতে আসেন, প্রতিটি গাছের কাছে যান, তাদের সুখদুঃখের কথা শোনেন, তাদের পরিচর্যা করেন। আর গাছেরাও তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। গভীর পারস্পরিকতায় প্রতিদিন তাঁদের কুশল বিনিময় হয়। কিন্তু এই গভীর আন্তরিকতার মধ্যেই একদিন সেই বিপর্যয় ঘটে গেল। কৃষ্ণ সেদিন বনভূমিতে প্রবেশ করে কাউকে ভালোবাসা জানালেন না, কোনও পত্রপুষ্পে অঙ্কন করলেন না তাঁর করাঙ্গুলির স্পর্শ। তিনি এসে উপস্থিত হলেন বংশমণ্ডপে বাঁশবনর ছায়ায় এবং তাকিয়ে রইলেন একটি বাঁশগাছের দিকে। বাঁশ গাছ বলল – হ্যাঁগো, এমন করে তাকিয়ে আছ কেন আমার পানে? কৃষ্ণ বললেন দুঃখ-স্বরে – একট জিনিস চাই তোমার কাছে, কিন্তু বড়ো কষ্টের সেই চাওয়া। বাঁশ বলল – বলো কী চাই তোমা, তোমাকে অদেয় নেই কিছু। কৃষ্ণ বললেন – আমি তোমার প্রাণ চাই। তোমাকে কাটতে হবে আমায়। বাঁশ খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল – তোমার কাছে সব সমর্পণ করে বসে আছি আমরা। এ দেহ কাটবে কী রাখবে, সব তোমার ই্চ্ছে।

কৃষ্ণ সেই বাঁশ গাছ কেটে খণ্ড খণ্ড করলেন। তারপর উপযুক্ত বংশখণ্ডটি নিয়ে তাতে ফুটো করতে আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণ এক-একটিফুটো করেন আর বাঁশী যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে। অবশেষে তৈরি হল বাঁশী, কৃষ্ণ ফুঁ দিলেন বাঁশীতে – তাতে থেমে গেল ব্রজভূমিতে গোরুর বিচরণ, ময়ূরের নৃত্য, পক্ষীকুলের কলকাকলি। ব্রজগোপীরা বললেন – মুখরিত এই বংশীধ্বনি শুনে মৃগ-পক্ষীদের মধ্যেই এমন আকুল অবস্থা, সেখানে আমরা ঘরে থাকি কী করে – কা স্ত্রাঈ তে কল-পদায়াত-বেণুগীতম্। আর সেই বাঁশ, যে নিজের জীবন দিয়ে বাঁশীর জীবন পেয়েছিল, সে অঝোরে কাঁদছিল এই ভেবে যে, কতট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে কৃষ্ণের কাছে, কৃষ্ণ বাঁশী ছাড়া এক মুহূর্তও থাকেন না। কৃষ্ণ বংশদণ্ডের জীবন নিয়ে বংশখণ্ডকে আপন জীবনে সর্বক্ষণের জন্য স্থান দিয়েছেন। এর জন্য একদিন কৃষ্ণের প্রিয়তমা সখীরাও ঈর্ষালু হয়ে উঠলেন বাঁশীর উপর, সর্বক্ষণ কৃষ্ণের হাতে থাকা বাঁশীর উপর – মুখরিত মোহন-বংশ।

একদিন গোপিনীরা জিজ্ঞাসা করলেন বাঁশীকে – কী রহস্যটা বলো তো। আমরাও তো সারা জীবনের তপস্যায় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হতে পারলাম না, অথচ তোমার এত সৌভাগ্য হয় কি করে? বাঁশী বলল – আমাকে তাঁর পছন্দ হওয়ার কারণ শোন – আমার ভিতরটা পুরো ফাঁপা, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই, আমি একেবারে জীবন-মুক্ত। তিনি যেমন চালান তেমনি চলি, যেমন বলান তেমনি বলি, আমি সব সমর্পণ করেছি তাঁর কাছে – ‘আমার লাজ ভয়, আমার মান-অপমান সুখ-দুঃখ-ভাবনা’। ভিতরটা এমন নির্গুণ হলে তবেই তিনি সর্বাংশে গ্রহণ করেন। গোপীকুল বুঝি শিক্ষা নিলেন বাঁশীর কাছে – লজ্জা-ভয়, আর্যজনের সমস্ত বিহিত পথ ত্যাগ করে তাঁরা যে এখন কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন – সেটা শুধুই বাঁশীর শব্দ শুনে।

কমলিনী-দিদির বংশীকাহিনটা ভালই লাগল, অন্তত সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল আরও। বাঁশীর প্রতীকটুকু কমলিনী-দিদি কৃষ্ণের একা্ত্মতায় ধরেছেন বলেই তাঁর সিংহাসনে সোনার বাঁশীখানি কৃষ্ণ হয়েই বসে আছে। আমি ভাবি, প্রতীক তো শুধু এখানেই নয়, আমার মহাকবিও তো বাঁশীকে ব্যবহার করেছেন কালের রাখালের হাত দিয়ে। আমি যেদিন এই গানখানা শুনেছিলাম – সেই যে মধ্যদিনে যখন পাখিরা গান বন্ধ করে দেয়, তখন কলের রাখাল যে বেণু বাজায়, সে গান শোনে রুদ্র – প্রান্ত-প্রান্তরের কোণে বসে – এ গান শুনে এক অলৌকিক ভয় যেন আকৃষ্ট করে মন; তবু এই ভয়ের মধ্যেও – হে রাখাল! বেণু তব বাজাও একাকী – সেই রাখালের কথা শুনি যেই, অমনই আমদের কৃষ্ণাবেশ ঘটে, কেননা তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে রাখাল ভাবাই যায় না কখনও। তাঁকেই শুধু ভাবা যায় যেন – কেউ যেখানে নেই, সেখানেও তাঁর বাঁশীর আবেদন ভেসে আসে তাঁর কাছে যাবার জন্য। কিন্তু এর চাইতেও বেশি অবাক হয়েছিলুম কালের রাখালকে পৃথিবীর অনন্ত উপরে সেই চিদাকাশের মাঝে ধেনু চরাতে দেখে। সেখানে সেই কোন সুদূরে জগৎসৃষ্টির আদিকেন্দ্রে সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা আর অফুরান নক্ষত্রের ধেনু চরে বেড়াচ্ছে সেই বাঁশীর সুরে – তিনি বাঁশী বাজাচ্ছেন –আর দিগন্তেউচ্চকিত গ্রহ-তারা-নক্ষত্রের দল মহাজাগতিক শৃঙ্খলায় চরে বেড়াচ্ছে – উপনিষদের ঋষি মঙ্গল উচ্চারণ করছেন –

এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমগৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ।

আমার কবি লিখলেন –

এই তো তোমার আলোক ধেনু সূর্য তারা দলে দলে –
কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে।

আবারও মনে হল সেই কমলিনী-দিদির কথাই – ওই বাঁশী আমার ঠাকুর। সেই কোন সুদূরে বসে আমার শ্যামল-কিশোর বাঁশী বাজাচ্ছেন, আর আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি পাগলের মতো – সুদূর বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী! আমি বলেছিলাম – জানো তো দিদি, তুমি তো বাঁশী নিয়ে এক ‘রোম্যান্টিক’ জগৎ তৈরি করে ফেলেছ। তাতে আমিও ভাবি – বাঁশীর একটা নিজস্ব জগৎ আছে সত্যি, সেখানে কেজো জগতের সমস্ত বাস্তব, সমস্ত শৃঙ্খলা শেন তুচ্ছ হয়ে যায়। সে বাঁশী যে শুনতে পায়, সে এক বিশৃঙ্খল মধুরতার টানে গা ভাসিয়ে দেয় এই পৃথিবীতে। তার সাথের সাথী হয় উদসী হাওয়া, নদীর জল। আর বিকীর্ণ পৃথিবীর প্রান্তর। তাকে যদি কাজের জগতে ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে শঙ্খের নিনাদ না হলে চলে না। আমার কবি লিখে গেছেন –

সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত
মধ্যাহ্ণে মাঠের মাঝেএকাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশী। ওরে তুই ওঠ্ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা। কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে।

কবিতা শুনে কমলিনীর মুখ ভার হল একটু। তারপর খানিক ভেবে বলল – তোমার যিনি কবি তিনি তো আমারও কবি। তবে কিনা আমার কবির স্বভাবের মধ্যে বাঁশীটাই সব, অন্যের জন্য তাঁকে শঙ্খ বাজাতে হয়, অন্যের জন্য তিনি বজ্রের মধ্যে বাঁশী রাখেন, পৃথিবীর হাজার অন্যতর কাজের প্রয়োজন আছে বলেই বাঁশীতে অন্য তান তুলতে হয়। কিন্তু সে আমার কবির স্বাভাবিক জগৎ নয়। তিনি নিজে সেই ছন্নছাড়া পাগলের দলে আছেন বলেই বাঁশী ছেড়ে শঙ্খ বাজাতে গেলে তাঁকে হাহাকার করতে হয়। তা নইলে ওই একই কবিতার মধ্যে তিনি লিখতেন না –

-- যেদিন জগতে চলে আসি,
কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি।
বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে
দীর্ঘ দিন দীর্ঘ রাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে
ছাড়ায়ে সংসারসীমা।

কবি ইচ্ছে কিন্তু এই বাঁশীতেই তিনি সেই সুরধ্বনি জাগিয়ে তুলতে চান যাতে গীতশূন্য অবসাদ-পুর জাগ্রত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সুর বাঁশীতে তৈরি হলেও বাঁশীর মধ্যে যেহেতু উদাসীন এক ছন্নছাড়া পাগলপারা ব্যাপার আছে, তাই বাঁশী দিয়ে শঙ্খনাদ হয় না, কবিও তা পারেন না। আমা কবির হাহাকার আছে এখানে। বলেছেন তো –

যে বাঁশীতে শিখেছি যে সুর
তাহারই উল্লাসে যদি গীতশূন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঙ্গীতে
কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
শুধু মুহূর্তের তরে – দুঃখ যদি পায় তার ভাষা...

দেখেছো তো ভাই, ‘যদি’ – কমলিনী-দিদি বললেন – ‘যদি’। আমি জানি বাঁশী দিয়ে বিপ্লব-বিদ্রোহ হয় না। বাঁশীর মধ্যে মোহিনী আছে গো, মোহিনী আছে! সে আকর্ষণ করে, পাগল করে, ঘরছাড়া করে – আমার ঠাকুরের মতো। কমলিনী-দিদি চৈতন্য-চরিতামৃতের কবির সুরে গান ধরলেন –

নীবি খসায় পতি আগে,      গৃহধর্ম্ম করায় ত্যাগে
বলে ধরি’ আনে কৃষ্ণস্থানে।
লোকধর্ম্ম, লজ্জা, ভয়,        সব জ্ঞান লুপ্ত হয়,
ঐছে নাচায় সব নারীগণে।।
কানের ভিতর বাসা করে,     আপনে তাঁহা সদা স্ফুরে
অন্য শব্দ না দেয় প্রবেশিতে।
আন কথা না শুনে কান,           আন বলিতে বোলয় আন,
এই কৃষ্ণের বংশীর চরিতে।।

আমার সামনে কমলিনী-দিদির এই গান গাইতে একটুও লজ্জা হল না। বুঝলাম, বাঁশীতে মজে আছেন কমলিনী। তবে এর চেয়েও বেশি আছে কিছু। এ তো যুবতীজনের কাছে কৃষ্ণের বাঁশীর আবেদন। এমনকি এই সূত্রে নদীয়া-বিনোদিয়া ঠাকুর চৈতন্যের কথাও বুঝি। কেননা তাঁরই গানের কলি গাইলেন তো কমলিনী-দিদি। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল ওই মহাপণ্ডিত বুড়োদের নিয়ে। তাঁরা কেউ অদ্বৈতবাদী দার্শনিক, কেউ ধুরন্ধর নৈয়ায়িক, কেউ বা বাঁশীর জন্য নিরাকার নির্গুন ব্রহ্মবাদিতা মাথায় রেখেও কৃষ্ণের বাঁশী না শুনে পারেন না। আমি কমলিনী-দিদিকে সেই অসামান্য শ্লোকরাশি শোনালাম, শুধু বললাম – বাঁশীর সুর নয় শুধু, আমার কৃষ্ণের বাঁশীর সুর – সেখানে তোমার মতো বাঁশী-সোহাগিনীর সঙ্গে নৈয়ায়িক মথুরানাথ তর্কবাগীশ, প্রতাপরুদ্রীয় বাসুদেব সার্বভৌম অথবা মধুসূদন সরস্বতীর কোনও তফাৎ নেই। মোহিনী বাঁশী সকলের মন একত্তর করে দিয়েছে; তুমি তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা বংশীসাধিকা কমলিনী-দিদি।



1

বিশেষ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


নৌকো নিয়ে সাত-সতেরো
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এক তরুণ কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলো,‘‘জেঠু,তুমি তো লেখো। তা, নৌকো নিয়ে কিছু লেখো না!’’ ঘটনাচক্রে তখন আমরা দুজনেই খেয়া নৌকায়গঙ্গা পার হচ্ছিলাম। হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তূ নৌকা নিয়ে সাতসতেরো কথা ফাঁদবার ইচ্ছেটা মাথায় থেকে গিয়েছিলো।

সপ্তাহে দিন দুয়েক গঙ্গা পারাপারের জন্য আমাকে নৌকায় চাপতে হয় সেই ছেলেবেলা থেকে।তার মানে এই নয় যে নৌকা সম্পর্কে আমার কিছু বলার অধিকার জন্মেছে। তবে অভিজ্ঞতায় ভর করে আর বইপত্তর নাড়াচাড়া করার সুবাদে এ নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা যেতে পারে ভেবেই এই সাত-সতেরো লেখা।গঙ্গার তীরেই তো জন্ম থেকে চুয়াত্তরটা বছর কাটিয়ে দিলাম। মাঝিদের সঙ্গে কত গল্প, ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের ইলিশমাছ ধরা দেখা, কৈশোরে নৌকায় চেপে অনেক দূর যাওয়া, সখের দাঁড় বাওয়া, নৌকায় দুর্গাপ্রতিমা ভাসান,নৌকার ছইয়ে বসে সারা রাত চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ভাসান দেখা কিংবা গঙ্গার বুকে নৌকার প্রতিযোগিতা (বাইচ) দেখার উত্তেজনা এখনও মনে পড়ে বৈকি!ছোটবেলায় দেখেছি, তখন মালবাহী ছোট বড় গাড়ির চল ছিলো না এখনকার মতন, বড় বড় নৌকা (গাদা বোট) বোঝাই হয়ে মালপত্তর আসতো বড়বাজার থেকে, গঙ্গার ঘাটে খালাস হতো। ইঁট, বালি প্রভৃতি ইমারতী জিনিসও নৌকা বোঝাই করে আসতো।আমার শৈশবটাও তো কেটেছে জেলেপাড়ায়, গঙ্গার ধারে। এখন আর খেয়া নৌকা আগের মতন নেই। হাল আর দাঁড়ের বদলে বসেছে ডিজেল যন্ত্র। নৌকা হয়ে গেছে ভটভটি।আশ্চর্য সমাপতনই বলবো। আমার জন্ম ও তারুণ্য গঙ্গাতীরে খেয়া ঘাটের গায়ে আর জীবনের উপান্তে পৌছে বাসা বেঁধেছি ঠিক তার উলটো পাড়ের গঙ্গাতীরে খেয়াঘাটেরই গায়ে।

আমরাতো সকলেই জানি যে,নৌকা হলো মানব সভ্যতার আদি জলযান।পৃথিবীর প্রায় সব মুখ্য ধর্মকাহিনীর প্রারম্ভিক পর্বের সূত্রপাত হয়েছে প্লাবনের মধ্য দিয়ে এবং সেই প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয়েছে। তাই সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে যাতায়াতের জন্য নৌকার উদ্ভাবন হয়েছিলো, যাকে বলা হত ‘ভেলা’। ভেলারই বিবর্তিত রূপ নৌকা। প্রাগৈতিহাসিককালের মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষে, অজন্তার গুহাচিত্রে এবং সাঁচিস্তুপে নৌকার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কালের স্রোতে কত স্থলযানের বিলোপ হয়েছে, মানুষ-চালিত যানের স্থান নিয়েছে যন্ত্রচালিত যান, কিন্তু জলযান নৌকার স্বকীয়তার বিলোপ হয়নি, বরং এর ব্যবহার বেড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে কিংবা এইবাংলায়, বিহারে নৌকা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ হামেশাই সংবাদপত্রে দেখতে পাই। কিন্তু বোধ করি পথদুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেশি হয়।

ছেলেবেলায় একটা কথা খুব বলতাম - ‘চল পানসি বেলঘড়িয়া’। কথাটা প্রবাদ হয়ে গেছে। কোনও কাজে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে চলার জন্য উৎসাহ-বর্ধক হিসাবে কথাটা বলা হয়। ‘পানসি’ মানে একধরনের নৌকা। কিন্তু পানসি বেলঘড়িয়ায় যাবে কেন, কি করেই বা যাবে? কারণ বেলঘড়িয়া অঞ্চলের অবস্থান তো গঙ্গাতীর থেকে প্রায় সাড়ে তিন/চার কিলোমিটার দূরে! আমি এই প্রবাদের অর্থ কোথাও পাই নি। তবে একটা সূত্র আমার মনে হয়েছে। নিমতা ও অন্যপাশে গঙ্গাতীরের গ্রাম আড়িয়াদহর মধ্যে যে অঞ্চলটার নাম বেলঘড়িয়া, সেটা প্রাচীনকালেছিলো পাট ও তরিতরকারি বানিজ্যের বৃহৎ কেন্দ্র। গঙ্গার তীরে আড়িয়াদহ থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। মাল খালাস ও বোঝাই করার জন্য খালাসিদের ডাকা হতো ঘন্টা বাজিয়ে। একটা বড় আকারের ঘন্টা বা বেল ছিলো, সেই ঘন্টার শব্দে মাল খালাসকারীরা জড়ো হয়ে যেতো।সেই থেকে নাম বেলঘড়িয়া। তো মনে হয় নৌকার মাঝি ও মালখালাসকারীরা ‘চলো পানসি বেলঘড়িয়া’ হাঁক দিতো ঘন্টার শব্দ শুনে।

এতো গেল প্রবাদের কথা। নৌকার কত নাম, কত ধরণ, আর তার কত অঙ্গ, কত সরঞ্জাম, তার ইয়ত্তা নেই। নৌকা, পানসি, বজরা, ডিঙ্গি, সাম্পান, ছিপ,নাও, গয়না,পাতাম, শ্যালো নৌকা, কোশা, গাদা বোট, ভড় ইতাদি। বৈঠা, হাল, পাল, দাঁড়, গলুই, ছই, গুন, লগি, পাটা, মাস্তুল, নোঙ্গর– ইত্যাদি শব্দগুলো যুক্ত নৌকার সঙ্গে – নৌকারই অঙ্গ। রূপকথার ‘ময়ূরপঙ্খী নাও’, কিংবা মনসামঙ্গলে বর্ণিত ধনপতি সওদাগরের ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’– এইসব সকলেই শিশুকাল থেকেই শুনে আসছে। আমাদের দেশের, বোধহয় সব দেশেরই, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, প্রবাদ, ছড়া, রূপকথা ও ধর্মীয় আচারে নৌকার বিশিষ্ট স্থান আছে যুগ যুগ থেকে। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবেই নৌকাকে দেখা হয়।মূলত পূর্ববঙ্গীয় লোকসঙ্গীতের একটা রূপ ‘ভাটিয়ালি’ গান সৃষ্টি হয়েছে নৌকা বাওয়াকে ঘিরে। নদীতে ভাটার টানে নৌকা বাওয়ার সময় নৌকামাঝিদের যে গান তাইই, ভাটিয়ালি গান।‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না’, কিংবা ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে / তর তরাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া’।পঞ্জিকা বিশারদরা গণনা করে সিদ্ধান্ত জানান দেবী দুর্গার আগমন কোন বছরে নৌকায়।আজকের যন্ত্র-যানের যুগেও যখন সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা নৌকা বাওয়ার গান শুনি ‘ওমাঝি বাইও, বাইওরে নাও বাইও / খরনদীর স্রোতে স্বপ্নের দেশে যাইও / হেঁই রে আকাশে আসে তুফান বড় ভারি, হেঁই রে ঢেউয়ের তালে তুফান নাচে, মরণ মহামারি/ হেঁইও হো, বল মাভৈঃ যাবোই খরনদীর পারে...” তখন যেন নৌকা বাওয়ার গান সব বাধা পেরিয়ে মানুষের লক্ষ্যেপৌঁছানোর প্রতীক হয়ে যায়।এ ভাবেইআমাদের সংস্কৃতিতে ‘নৌকা’ যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, চিরন্তন এক দার্শনিক সত্যের প্রতীকে। নদীতে স্রোতের পক্ষে বা স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা বাওয়া যেন মানবজীবনের ওঠা-পড়া, ভাঙা-গড়াজীবন-নদীর ওপারে পৌছানোর জন্য।

নৌকা নিয়ে দর্শন, রূপকথা, গল্পকথা থাক, এবার ইতিহাসে ফেরা যাক।ইউরোপীয়রা বৃহদাকার নৌকা নির্মাণের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করেছিলো তাদের সমুদ্র অভিযানের জন্য। কেমন আকার ছিলো ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামাদের সেই বৃহদাকার পাল তোলানৌকা, যাতে চেপে তাঁরা আমেরিকা, ভারতের সমুদ্রপথ আবিষ্কারের সাহসী অভিযানে বেরিয়েছিলেন তা বোঝার উপায় নেই, কল্পনায় আঁকা ছবি ভিন্ন। নব্বই জন সঙ্গী নিয়ে তিনটি নৌকায় দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। কলম্বাসের নৌকাটির নাম ছিলো ‘সান্তামারিয়া’। কেমন ছিলোকলম্বাসের ‘সান্তামারিয়া’র আকৃতি, তা অনুমান নির্ভর, কিন্তু বিশালাকারবত্রিশ দাঁড়ের আশি ফুট দৈর্ঘ্যের বিস্ময়-নৌকা ‘ভাইকিং’এর নমুনা কয়েকশো বছর পরে আবিষ্কৃত হয়েছে আর আজও তা অসলোর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

নৌকার সাতসতেরোয় রূপকথার প্রসঙ্গ ছুঁয়েছি, ‘ভাইকিং’এর বৃত্তান্তও রূপকথার মতন। মধ্যযুগে দারিদ্র ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত দেশ নরওয়ে জলদস্যুতার উদ্দেশ্যে ‘ভাইকিং’ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করেছিলো। ইউরোপের সাগরকূলের নানান প্রান্তে অতর্কিত অভিযান চালিয়ে খাদ্য, পণ্য ও সম্পদ লুন্ঠন করতো তারা।

বড় আকারের পালতোলা নৌকা, ইউরোপীয়রা যাকে জাহাজ বলতো, সেইরকম নৌকাতেইমাদ্রাজ থেকে পাড়ি দিয়ে জোব চার্ণক ভাগীরথীর তীরে ‘সুতানূটি’ গ্রামে (এখনকার শোভাবাজার) নোঙ্গর ফেলেছিলেন ১৬৯০এর ২৪শে অগস্ট। এদেশে ইউরোপীয়দের জলদস্যুতা, বানিজ্য বিস্তার আর তারপর উপনিবেশ স্থাপন, সবকিছুরই সূত্রপাত নৌকার সহায়তায়। এ আর এমন কি? মৃত লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলাপৌঁছে গিয়েছিলো স্বর্গের দেবতাদের কাছে নৌকা ভাসিয়ে,আর ইউরোপীয়রা এতবড় ভারত দেশটাকে জিতে নেওয়ার কৌশলের সূত্রপাত করলো সেই নৌকারই সহায়তায়! তারা কলকাতা দিয়েই শুরু করেছিলো। অতএব নৌকার কলকাতার কথাও বলি।

“বালিঘাটা এড়াইল বেনিয়ার বালা।

কালিঘাটে গেলো ডিঙ্গা অবসান বেলা”। 

কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের মনসামঙ্গলে ধনপতি সওদাগরের বানিজ্য যাত্রার বর্ণনা। তাহলে কালীঘাট দিয়ে ভাগীরথীর স্রোতধারা বয়ে চলতো ও নৌচলাচল হতো। এতো ষোড়শ শতাব্দীর বৃত্তান্ত।প্রাচীনকাল কেন, বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র তিনশো বছর আগেও এখনকার কলকাতার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা তখন রাস্তা ছিলো না, ছিলো খাল বা নদীর স্রোতধারা, যেখানে নৌচলাচল হতো। টাইম মেশিনে চেপে যদি যেতে পারতাম তিনশো বছর আগের ক্রীক রো’তে, হয়তো শুনতে পেতাম কুঁড়ে ঘরের জানালা দিয়ে কোনও গৃহবধু শুধাচ্ছে “কোথা যাও গো মাঝি”? কিংবা সার্কুলার রোডে, পড়ন্ত বিকালে কোনও ক্লান্ত হাটুরে ডাকছে “কুথা যাবেক গো মাঝি? সোঁদর বন যাবো গো, পাটায় একটুন জায়গা দিবা?” হ্যাঁ, এই রকমই তো ছিলো তিনশো বছর আগের কলকাতা। এখনকার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা, গলি তৈরি হয়েছে খাল বুজিয়ে।

নৌকা চলতো মানে নৌকাডুবিও হত। সে’কথাও বলা যাক। কলকাতা নগরীর পত্তনের আগে থেকেই “চাঁদপাল ঘাটের কাছে গঙ্গা থেকে একটা খাল বেরিয়ে হেস্টিংস স্ট্রীটের উত্তর দিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ভেতর দিয়ে সার্কুলার রোড পার হয়ে এন্টালির উত্তর গা হয়ে বেলেঘাটার লবণ হ্রদের ভেতর দিয়ে ধাপায় পড়তো” (তথ্যসূত্র – ‘কলিকাতা দর্পন’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র)। এখান দিয়ে নৌকা চলাচল করতো। এই খালগুলি বুজিয়ে কলকাতাররাস্তা, গলি হয়েছে কলকাতার নগরায়নের পরে। প্রবল ঝড়ের বেগে নাকি একবার অনেক নৌকা ভেঙে গিয়েছিলো, তাই এখন যে গলিটার নাম ক্রীক রো, সেটার নাম ছিলো‘ডিঙ্গা ভাঙা গলি’। এইসব বৃত্তান্ত সঠিক জানার উপায় নেই, কারণ তখন এদেশে সংবাদপত্রতো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরই তৈরি হয়নি। সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যস্যার ফ্রান্সিস রাসেলতাঁর একটা চিঠিতে ১৭৩৭ সালের৩০শে সেপ্টেম্বর রাত্রের এক মহা দুর্যোগের বর্ণনা লিখেছিলেন, যা লন্ডনের ‘জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন’-এর প্রতিবেদনে বেরিয়েছিলো। সেই রিপোর্ট মতে,‘‘কলকাতা ও আশপাশ মিলে নিহত মানুষের সংখ্যা ত্রিশ হাজার, পশু-পাখি অসংখ্য এবং ছোট বড় জাহাজ নৌকো ইত্যাদি কুড়ি হাজার ...।”(তথ্য সূত্র ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ )

ইতিহাসের কথা যখন বলছি, তখন উনিশ শতকের অভিজাত মহলের নৌকা ব্যবহারের দু’একটি চমকপ্রদ ঘটনা তুলে আনি।জর্জ এভারেস্ট, যাঁর নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, তিনি ১৮৪৩এর ১লা অক্টোবর দেরাদুন থেকে পুরোটা নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৩৫ দিন। ১৮০১এর অগস্ট মাসে তখনকার বড়লাট ওয়েলেসলি বারাকপুর থেকে নৌকা চেপে নদীপথে এলাহাবাদ পৌঁছেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৫মাস। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে যানা যায়, ১৮৫৬তে কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নৌকা চেপে, সময় লেগেছিলো দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া একশ’ টাকা। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে এলাহাবাদ, আগ্রা গিয়ে আগ্রা থেকে নৌকায় দিল্লী পৌঁছেছিলেন এক মাসে। যদিও তখন রেলগাড়ি চালু হয়ে গিয়েছিলো।

উইলিয়াম হিকি এদেশে অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে এসেছিলেন ১৭৭৭এ, তখন কলকাতার নগরায়ন সবে শুরু হয়েছে। ১৮০৯ পর্যন্ত হিকি দীর্ঘ বত্রিশ বছর কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফিরে গিয়ে চার খণ্ডে তাঁর স্মৃতিকথা (১৭৪৯ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত)প্রকাশ করেন, যেটি আদি কলকাতার সমাজ জীবন জানার জন্য এক অমূল্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৭৪৯-এ, মানে পলাশীর যুদ্ধেরও আট বছর আগে, কলকাতা তখন অজ গ্রাম মাত্র, আর ইংরাজরা সুতানূটিতে ঘাঁটি গাড়া বণিক মাত্র। হিকি তাঁর স্মৃতিকথা শুরু করেছেন এইভাবে - “১লা নভেম্বর, ১৭৭৭ সন। ভোর চারটে থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা প্রায় দুপুর আন্দাজ সাগরদ্বীপে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পানসি নৌকা এল, কর্নেল ওয়াটসন আগেই সেটি ভাড়া করে রেখেছিলেন কলকাতায় যাবার জন্য। বেলা দুটোর সময় আমরা সকলে মিলে পানসিতে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। পানসিতে যেতে আমার আপত্তি ছিলো, কারণ বাংলা দেশের এই বিচিত্র নৌকাটি এমনভাবে তৈরি যে তার মধ্যে সোজা হয়ে বসা যায় না। এমন কি পা ঝুলিয়ে একটু আরাম করে বসাও সম্ভব নয় ... তবু পানসির অভিনবত্বের জন্য এই অসুবিধাটুকু আমাদের সয়ে গেল। ছ’জন কালা আদমি(মাঝি) খুব জোরে জোরে দাঁড় বাইছিলো, পানসিও তরতর করে দুরন্ত বেগে। সন্ধ্যা ছটার সময় আমরা কুলপিতে এসে পৌঁছলাম ......। 

পানসি ভিড়ল...... বহু দূরে – প্রায় নয় মাইল লম্বা ও দু’মাইল চওড়া জলের একটা আস্তরের উপর দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতা শহরের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। আগাগোড়া জলের ওপর ছোট বড় শত শত জাহাজ ও নৌকা নোঙর বেঁধে রয়েছে। তারই ভিতর থেকে যেন কলকাতা শহর নদীস্নান করে গাত্রোত্থান করেছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে।”

এটা প্রায় তিনশ’ বছর আগেকার বর্ণনা। আজও কি হিকি বর্ণীত এই সৌন্দর্যবোধের কিছুমাত্র কম হয়েছে? এই সৌন্দর্যবোধের উৎস হয়ে মানবসভ্যতার প্রাচীতম জলযান নৌকা ভাসতেই থাকবে মানুষের কল্পনা আর শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-রূপকথা আর আমাদের দার্শনিকবোধ ও বিশ্বাসে। রবীন্দ্রনাথ যেমন ভাসমান নৌকার মধ্যে চলমান মানবজীবনকে দেখেছেন -

“মানুষের মধ্যে এক একটা মাঝি আছে-- তাহাদের না আছে দাঁড়, না আছে পাল, না আছে গুণ; তাহাদের না আছে বুদ্ধি, না আছে প্রবৃত্তি, না আছে অধ্যবসায়। তাহারা ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া স্রোতের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। মাঝিকে জিজ্ঞাসা কর, "বাপু, বসিয়া আছ কেন?" সে উত্তর দেয়, "আজ্ঞা, এখনো জোয়ার আসে নাই।" "গুণ টানিয়া চলনা কেন?" "আজ্ঞা, সে গুণটি নাই।" "জোয়ার আসিতে আসিতে তোমার কাজ যদি ফুরাইয়া যায়?" "পাল-তুলা, দাঁড়-টানা অনেক নৌকা যাইতেছে, তাহাদের বরাত দিব।" অন্যান্য চলতি নৌকা সকল অনুগ্রহ করিয়া ইহাদিগকে কাছি দিয়া পশ্চাতে বাঁধিয়া লয়, এইরূপে এমন শতশত নৌকা পার পায়। সমাজের স্রোত নাকি একটানা, বিনাশের সমুদ্র মুখেই তাহার স্বাভাবিক গতি। উন্নতির পথে অমরতার পথে যাহাকে যাইতে হয়, তাহাকে উজান বাহিয়া যাইতে হয়। যে সকল দাঁড় ও পালবিহীন নৌকা স্রোতে গা-ভাসান দেয়, প্রায় তাহারা বিনাশ সমুদ্রে গিয়া পড়ে। সমাজের অধিকাংশ নৌকাই এইরূপ, প্রত্যহ রাম শ্যাম প্রভৃতি মাঝিগণ আনন্দে ভাবিতেছে, "যেরূপ বেগে ছুটিয়াছি, না জানি কোথায় গিয়া পৌঁছাইব।’’ একটি একটি করিয়া বিস্মৃতির সাগরে গিয়া পড়ে ও চোখের আড়াল হইয়া যায়। সমুদ্রের গর্ভে ইহাদের সমাধি, স্মরণ স্তম্ভে ইহাদের নাম লিখা থাকেনা।”



[তথ্যসূত্র – ‘ভারতকোষ’, ‘কলিকাতা দর্পন ২য় খন্ড’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র, ‘কলিকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ – বিনয় ঘোষ, ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ]