বিশেষ রচনা
তিন এক্কে তাতা
সাম্য দত্ত
আপনি যদি মনে করেন, ভরপেট ভাত আর পাশে পাশবালিশ পেলেই একটি নিটোল ভাতঘুম সেরে নিতে পারবেন, তাহলে বলতে হয়, আপনি ঘুমিয়েই আছেন, এখনও ঘুমোতে শেখেননি। ঠিক যেরকম এবং যতখানি ঘুমলে তাকে তোফা ঘুম বলা চলে, সেরকম ঘুম এক তোফা- অর্থাৎ উপহার বিশেষ। ভাতের গরম আর পাশবালিশের নরম ছাড়াও আরেকটা জিনিস লাগে। এতক্ষণ যে বইটা পড়তে পড়তে চোখের পাতা বুজে আসছিল, সেইটা আড়াআড়ি বিছিয়ে দিন বুকের ওপর। এইবার চোখ বুজেই দিব্যি টের পাবেন, ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি আপনার মাথার কাছটিতে বসে ইকির-মিকির খেলছেন। আর পায়ে-পায়ে ঘুমপরী নেমে আসছেন আপনার চোখে। ব্যস! এরপর শুধু মনে মনে 'আয় ঘুম, যায় ঘুম, দত্তপাড়া দিয়ে' দু'কলি ভেঁজে নিন। ওই মনে মনে হলেই হবে। এই দেখুন, আপনি এক্কেবারে ঘুমিয়ে কাদা!
এত জোগাড়যন্ত্র করে যেই না একটা ফুরফুরে ঘুম এসেছে, নাকটাও হয়তো ফুরফুর করে বার দুই ডেকে উঠেছিল...বেমক্কা বারকতক হাঁচি হাঁচতে গিয়ে, হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ করে খাট থেকে প্রায় ছিটকেই পড়েছি। ধড়মড় করে উঠে বসে, চোখটোখ কচলে নিয়ে দেখি, একটা সাহেবসুবো গোছের লোক, পেন্সিলের মতো খাড়াই নাক আর সেই নাকে রসগোল্লার মতো চশমা, প্যাটপ্যাট করে আমার দিকে চেয়ে আছে। এইবার লোকটা তার পেন্সিলের মতো নাকটা কুঁচকে সিঙাড়ার মতো করে, ভয়ানক রকমের একটা ভেচকুরি কেটে বলল, "যাক বাবা, উঠেছ তাহলে!"
আমি খুব চটেমটে বললাম, "কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে কেন শুনি?" লোকটা বলল, "ওমা, তোমার নাক ডাকছিল যে!"
-তা'তে কী হলো?
-তাও বুঝি জানো না? শোনো, সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝেমাঝে এমন ভয়ঙ্কর নাক ডাকাত যে, সবাই তার উপর চটা ছিল। একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম মারতে লেগেছে। হোঃ হোঃ হোঃ..."
এইবার আমার বেজায় রাগ হলো, তেড়ে উঠে বললাম, "তুমি বাপু লোক ভালো নও!"
লোকটা অমনি মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করলে, "উঁহু.. লোক নয়, লোক নয়, আমার নাম হলো শ্রোডিঙ্গার। আমার নাম শ্রোডিঙ্গার, আমার ভাইয়ের নাম শ্রোডিঙ্গার, আমার পিসের নাম শ্রোডিঙ্গার।"
-তার চেয়ে বললেই হয়, তোমার গুষ্টিশুদ্ধু সবাই শ্রোডিঙ্গার।
লোকটা, থুড়ি, শ্রোডিঙ্গারটা একটু ভেবে বলল, "তা তো নয়। আমার মামার নাম কোয়ান্টাম। আমার মামার নাম কোয়ান্টাম, আমার খুড়োর নাম কোয়ান্টাম, আমার শ্বশুরের নাম কোয়ান্টাম।"
শ্বশুরের নাম কোয়ান্টাম শুনে কেমন যেন একটু সন্দেহ হলো। বললাম, "ঠিক বলছ?"
শ্রোডিঙ্গারটা আবার একটু ভেবে বলল, "না না, আমার শ্বশুরের নাম কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন।"
-যত্তসব বাজে কথা! তোমার নাম যাই হোক, আমার নাকে রুমাল ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে কেন?
একথা শুনে শ্রোডিঙ্গারটা মনে হলো খুব দুঃখ পেল। মুখখানা বেগুনভাজার মতো বিষণ্ণ করে বলল, "না হে, রুমাল নয়, ওটা আদতে একটা বেড়াল।"
-বেড়াল কীরকম?
-কীরকম শুনবে? তাহলে... অ্যায়! এই দেখ নোটবই, পেন্সিল এ'হাতে, এই দেখ ভরা সব কিলবিল লেখাতে। পড়ে দেখ দেখি, কিছু বোঝো কিনা!
পড়ে অবিশ্যি আমি কিছুই বুঝিনি, কিন্তু পাছে সেকথা বললে শ্রোডিঙ্গারটা আবার দুঃখ-টুঃখ পেয়ে বেগুনভাজার মতো বিষণ্ণ হয়ে যায়, তাই খুব খানিকটা ঘাড়-টাড় নেড়ে হুঁ হুঁ করে গেলাম।
শ্রোডিঙ্গার খুশি হয়ে বলল, "হ্যাঁ, বাক্সের মধ্যে বেড়ালটা যেই না ঢুকেছে, অমনি একখানা রেডিওঅ্যাক্টিভ এলিমেন্ট ছেড়ে দিয়েছি।"
-বেড়ালের তালব্য শ-এ আকার ল-এ আকার! তারপর?
-তারপর... হো হো হো... সেকথা বলতেও আমার বেজায় হাসি পাচ্ছে... রেডিওঅ্যাক্টিভ এলিমেন্টটা যেই অ্যাক্টিভ হবে, অমনি দিকে দিকে রেডিওবার্তা রটে যাবে... আর সঙ্গে সঙ্গে... হি হি হি...উফ্! গেল গেল, নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল... ফ্লাস্কের বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে এসে-
-পুসিক্যাট পপাত চ!
-এবং মমার চ! মার্জার মায়ের ভোগে! হা হা হা, ভাবো দেখি, কী মজার ব্যাপার!
-কিন্তু...রুমাল তাহলে আসছে কোথ্থেকে?
শ্রোডিঙ্গার এবার হঠাৎ হাসি-টাসি থামিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে বলল, "সেইখানেই তো হিসেবটা মিলছে না।"
-"মিলবে না কেন?" আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, "এ তো খুব সোজা হিসেব।"
-"না হে, তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবছ না। অঙ্কটা এলসিএমও নয়, জিসিএমও নয়। সুতরাং হয় ত্রৈরাশিক, নাহয় ভগ্নাংশ।" বলেই শ্রোডিঙ্গারটা ছকাছক করে মাটিতে একটা ছক কেটে বলল, "মনে কর, এলিমেন্টটা অ্যাক্টিভই হলো না আদৌ। তখন?"
-কোয়ায়েটলি ভেবে দেখলে, কোয়ায়েট পসিবল। তেজস্ক্রিয় আদপেও সক্রিয় হলো না, তার তেজ হয়তো আগাগোড়া নিষ্ক্রিয়ই থেকে গেল, নিষ্কৃতি পেলে না একটুও। এ তো হতেই পারে। পদার্থ অপদার্থের মতো আচরণ করতেই পারে।
-তাহলে তো বাতাসে বিষও মিশল না! ফলে বেড়ালটার কড়া জানও এযাত্রায় আর কড়কে গেল না।
-হুঁ! তাহলে বেড়ালটাকে এখন কী বলব? বেড়াল তো বেঁচে থাকতে পারে, আবার টেঁসেও যেতে পারে।
-পারেই তো! তাই, জীবিত বলতে পারো, মৃত বলতে পারো, আবার একসঙ্গে দুটোই বলতে পারো।
-দুটোই? কীরকম?
শ্রোডিঙ্গার এবার একচোখ বুজে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বিচ্ছিরি ভাবে হেসে বললে, "তাও বুঝলে না?"
আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মনে হলো, 'একসঙ্গে দুটোই' ব্যাপারটা আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে।"
শ্রোডিঙ্গার মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, বাক্স যতক্ষণ না খোলা হচ্ছে, দ্যা বেড়াল ইজ বোথ ডেড অ্যান্ড অ্যালাইভ।"
-তা তুমি বাস্ক খুলে কী দেখলে?
শ্রোডিঙ্গার খানিকক্ষণ চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, "ওইখানেই তো মুশকিল, হিসেবটা ওখানেই ঘেঁটে গেল। খুলে দেখলাম, বেড়াল-টেড়াল কিচ্ছুটি নেই। জীবিত, মৃত, জীবন্মৃত- কিস্যু লয়। তার বদলে, ওই রুমালটা পড়ে আছে।"
-ওইটে?
-হুঁ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, "তা, এতে মুশকিলের কী আছে? ছিল বেড়াল, হয়ে গেল রুমাল। ছিল ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।"
-ঠিক! ঠিক বলেছ। উত্তরটা মিলছিল না, তোমার ওই বইটা দেখতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
-আমার বই? ও, যেটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ওইটে?
-ইয়েস! ওই বইতেও ঠিক এই কথাটাই লিখেছে।
-কী লিখেছে?
-ওই তুমি যা বললে, "এ তো হামেশাই হচ্ছে।"
এইবার আমার বেজায় রাগ হয়ে গেল। বললাম, "তখন থেকে খালি আবোলতাবোল বকছ। দিলে তো মাথাটা গরম করিয়ে! আমার বাপু রাগ হলেই আবার খিদে-খিদে পায়। এখন কী খাই বল দেখি? দেখ না ফ্রিজিডেয়ারটা হাঁটকে, কিছু পাও কিনা।"
শ্রোডিঙ্গার আবার সেরকম ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসে উঠল। "উঁহু! সেটি হবার নয়, সে হবার যো নেই। ফ্রিজিডেয়ার বিলকুল ফাঁকা, কিস্যুটি নেই। তবে হ্যাঁ, এইটে মনে রেখো- নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?" বলেই আবার একটা ভেচকুরি কেটে জানলা গলে পালিয়ে গেল।
নেই বললেই হলো! শ্রোডিঙ্গারের কথায় প্রথমটা খুব রেগে গেসলাম। তারপর যেই মনে পড়ল, মামার আনা মিহিদানার হাঁড়িটা এখনও ফ্রিজেই আছে, অন্তত দুপ্পুর অবধি তাকে সেখানেই স্বমহিমায় বিরাজমান দেখেছি, অমনি রাগ-টাগ গলে জল হয়ে গেল। চুলোয় যাক শ্রোডিঙ্গার, হমারে পেটমে চুহা দৌড় রাহা হ্যায়।
ফ্রিজের একদম নীচের তাক থেকে মিহিদানার হাঁড়িটা যেন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তাক বুঝে, যেই না তাকে বগলদাবা করে তার ঢাকনা খুলেছি- আচমকা ফুটফাট দুমদাম ধুপধাপ শব্দে তাণ্ডব কোলাহলে সারা বাড়িটা একেবারে কাঁপিয়ে তুলল। মনে হলো যেন, যত রাজ্যের মিস্ত্রিমজুর সব একযোগে ছাদ পিটতে শুরু করেছে, দুনিয়ার যত কাঁসারি আর লাঠিয়াল যেন পাল্লা দিয়ে হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকতে লেগেছে। আমি তো ভয়ের চোটে হাঁউমাঁউ করে হাত থেকে হাঁড়ি-টাঁড়ি ফেলে দিয়ে, পড়ার বইয়ে যাকে 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' বলে, তারও এককাঠি ওপরে উঠে একেবারে 'কিংকংকর্তব্যবিমূঢ়' হয়ে হাঁ করে বসে রইলাম।
কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না, হঠাৎ একটা বিটকেল গুরুগম্ভীর আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠতে হলো। চেয়ে দেখি একটা দেড় হাত লম্বা বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ দাড়ি, আর মাথাভরা টাক। সেই টাকে আবার খড়ি দিয়ে কবিতা লিখেছে। বুড়োটার হাতে একটা হুঁকো, তা'তে কল্কে-টল্কে কিচ্ছু নেই, সেটাকেই দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে আমাকে দেখছে। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা রঙিন কাঁচ বের করে সেগুলো দিয়ে আবার কিছুক্ষণ দেখল। দেখা-টেখা শেষ হলে, তেমনি ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, "অন্তমিলটা মিলিয়ে দাও তো হে! চটপট!"
আমি দস্তুরমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, "মিল? কিসের মিল?"
-উঁহু উঁহু! 'কিসের'-এর সঙ্গে তো অনেক কিছুই মিল দেওয়া যায়। এই যেমন ধর- পিসের, সিসের ইত্যাদি প্রভৃতি। ও তো খুব সোজা, সবাই পারে। ওকথা বলছি না। ওই শ্রোডিঙ্গার যে লাইনটা বললে, তার সঙ্গে মিল দিয়ে একখানা লাইন ভেবে বের করো দেখি! তবে বুঝব, তুমি কেমন কবি!
ব্যাজার মুখ করে বললাম, "আমি ওসব পারি না।"
-"পারবে না? তুমিও পারবে না? ইস! তোমার ওপর যে বড্ড ভরসা ছিল হে!...নাহ্! তেত্রিশ বছর কাটলো, একটা মিল আর মিলল না।" বুড়োটা মনে হলো হতাশ হয়েছে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "তবে আমারও তোমার মতোই দশা হয়েছিল। তাই না প্রথম লাইনটা লিখতে পারলুম।"
-কীরকম?
-গল্পটা তোমায় বলিনি, না? আচ্ছা শোনো... আমার নাম কবি কালিদাস। আমি হলাম হাফটাইম কবি, বুঝলে?
-হাফটাইম কেন?
-আগে ফুলটাইম কাব্যচর্চা করতুম। তারপর আমার ব্রাহ্মণী সেনকো গোল্ডে খাতা খুললেন। তাই, এখন দিনের মিনিমাম একটা সময়, মিনি নামের মিনি সাইজের একটা মেয়েকে টিউশনি পড়াতে হয়। তা সেদিনও মিনিবাস থেকে নেমে মিনির বাড়ির দিকেই যাচ্ছি, এমন সময় চোখে ঝিলমিল লেগে গেল।
-কানা হয়ে গেলে নাকি?
-উঁহু! কানা নয়, মিহিদানা। মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে তা'তেই চোখ আটকে গেসল। কিনেই ফেললুম, এক হাঁড়ি।
-তাপ্পর?
-এমনিতে আমার ছাত্রীটিকে পড়ানোর বিশেষ ঝঞ্ঝাট নেই, বুঝলে? 'নদী শব্দের রূপ কর' বলে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়লেই হলো। মিনিও স্লেট নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে লেগে যায়। তা সেদিনও মিহিদানার হাঁড়িটা চেয়ারের তলায় রেখে সবে চোখদুটো বুজেছি, মিহি স্বপ্নের দানায় চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে, অমনি- ঠিক ওইরকম শব্দকল্পদ্রুম! বাসরে বাস! একলাফে চেয়ার-টেবিল ডিঙিয়ে ঘরের মধ্যিখানে গিয়ে পড়েছি।
-বলো কী!
-তবে আর বলছি কী! ঠাসঠাস দ্রুমদ্রাম শুনেই খটকা লেগেছিল। গোলমাল একটু কমলে পর, হাঁড়ি খুলে দেখি, ওমা! মিহিদানা কই, এ তো চীনেপটকা!
-অ্যাঁ!
-হ্যাঁ। আর তাই দেখেই না ওই লাইনখানা ভেবে ফেললুম! ওই মিহিদানা নেই দেখেই তো! রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি আবার স্বভাবকবি কিনা-
'নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?'
কিন্তু ওই এক লাইনই। মনের মতো একপিস মিল, সে অমিলই থেকে গেল। অনেক মাথা চুলকেও আর কল্কে পেলাম না। তা বাপু, একটু দেখবে নাকি মাথা খাটিয়ে?
এবার আমি বড় বাড়াবাড়ি রকমের বিরক্ত হয়ে গেলাম। "একে ওই শ্রোডিঙ্গার না কুলাঙ্গার কে একটা এসে কাঁচা ঘুমটা চটকে দিলে, তার ওপর হাঁড়ির মিহিদানা পটকা হয়ে ফাটতে লেগেছে, এত সব দেখেশুনে আমার আর কাব্যি-টাব্যি পাচ্ছে না। যাও তো বাপু, জ্বালিয়ো নাকো মোরে! বিদেয় হও, পথে যেতে যেতে ওসব ভাবার অনেক মওকা পাবে।"
এই অবধি যেই না বলেছি, বুড়োটা বেজায় উত্তেজিত হয়ে আট দশ পাক বনবন করে ঘুরে নিলে। "কী বললে, কী বললে? পথে যেতে যেতে? অ্যাঁ! তাই বললে তো? ওরে মা রে, মেশোমশাই রে, মিলেছে রে, মিলেছে! ও শ্রোডিঙ্গার, ভাই আমার, শুনে যা! মিল গয়া মিল !
'নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?
কহেন কবি কালিদাস, পথে যেতে যেতে।'
কেয়াবাত! ওরে বুধো রে! বিভূষণ-বিভীষণ-বিভূতিভূষণ সব বাগিয়ে নিয়েছি রে! 'কহেন কবি কালিদাস...' হুঁ হুঁ বাবা, 'পথে যেতে যেতে।' কেয়াব্বাত!
"হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি
চোরের মতন নন্দগোপাল চলছে গুড়ি গুড়ি"
অত খপরে আপনের কী মশয়? তবে, ধরেই যখন ফেলেছেন, তখন বলি- যাচ্ছিলুম ওই গড়ের মাঠে। কী করব বলুন? যার চোখে ঘুম নেই, পেটে খিদে... না, তা অবিশ্যি আছে, কিন্তু খাবার মতো কিচ্ছুটি নেই, গোদের ওপর বিষফোঁড়া দুটো উমনো আর ঝুমনো এসে যার কানের কাছে হযবরল বকে গেল- জানবেন সে বেচারা নন্দগুপির জীবনে আনন্দও নেই। আর যার পকেট গড়ের মাঠ, সে বেচারা ওই গড়ের মাঠ ছাড়া আর যাবেই বা কোথা? খোলা হাওয়া খেতে অন্তত ট্যাক্সো লাগে না বলেই তো শুনিচি!
কিন্তু চৌকাঠও মাড়াতে হলো না, উঠোনের দিক থেকে একটা প্রলয়ঙ্কর ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম দেরে দেরে দেরে হায় হায় প্রাণ যায় হোক কলরব’ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি- বাসরে! উঠোনময় যেন গাজনের মেলা বসেছে। একদল লোক, দেখে ভিনদেশী মনে হলেও কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল অথচ ঠিক চিনতে পারলুম না- তারা দিব্যি উঠোনখানা দখল করে বেজায় হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। ভাঁড়ার ঘরটা মেরামতির জন্য ইঁট আনিয়ে রাখা হয়েছিল, একটা গোলগাল রাজাগজার মতো দেখতে লোক সেই ইঁটের পাঁজার ওপর কেমন হুতুমথুম হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার পাশেই একটা ঠোঙায় করে বাদামভাজা রাখা, রাজার মতো দেখতে লোকটা তার থেকে মাঝেমাঝে দু’চাট্টে করে মুখে ফেলছে, ফেলেই আবার গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল কী যেন ভাবতে লাগছে! আমার কেমন সন্দেহ হলো, লোকটা খাচ্ছে বটে, কিন্তু যেন গিলছে না! এদিকে একদল লোক, বোধহয় এই রাজাগজাটার প্রজাই হবে, কান্নার সুরে একটানা বিলাপ করে যাচ্ছে:
হায় কী হলো
রাজা বুঝি ভেবেই মলো
ওগো রাজা মুখটি খোলো...
দেখেশুনে ব্যাপারস্যাপার তো কিছুই বোধগম্য হলো না! কাকে শুধোই ভাবছি, দেখি এককোণে দুটো লোক চুপটি করে বসে। তার মধ্যে যে লোকটা একটু বুড়োমতো, সে দেখি আমার সেই বইটা কোথ্থেকে কুড়িয়ে এনে ভারি মনযোগ দিয়ে পড়তে লেগেছে। ভাবলাম বলি, না জিজ্ঞেস করে আমার বইয়ে হাত দিয়েছে কেন? তা যেই না বুড়োটাকে ডাকতে গেছি, পাশের লোকটা চোখ বড়বড় করে আর মুখের সামনে আঙুল এনে ‘শশশশ’ গোছের আওয়াজ করল। কী আর করা? বাধ্য হয়ে তাকেই ফিসফিসিয়ে শুধোলাম, "বাপু হে, তোমরা কারা? আর এই যে উঠোনময় গাজনের মেলা বসিয়ে ফেলেছ, তোমাদের মতলবটা কী?
লোকটা প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, "শোনো খোকা, আমরা সক্কলে আসছি সেই গলদেশ থেকে। গলের নাম শুনেছ?
-হুঁ, শুনেছি বইকি! জ্যাঠামশাই বলেছেন, গলদেশের পুরোটাই রোম সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার...
-"পুরোটা? উঁহু... ঠিক পুরোটা নয়। একটা গ্রাম এখনও রোমানরা দখল করতে পারেনি।" লোকটা খুব গর্ব গর্ব মুখ করে বুক বাজিয়ে বলল, "সেই গ্রামের অধিবাসীবৃন্দের তরফ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করো। আমরাই এখনও রোমানদের ঠেকিয়ে রেখেছি।"
-ও, আর ওই লোকটা, ওই যে... রাজাগজার মতো দেখতে, উনি কিনি?
-ওই ইঁটের উচ্চাসনে আসীন আমাদের দলপতি মহামান্য ভাইটালস্ট্যাটিস্টিক্স। তাঁর ঠিক সামনে...ওই যে দেখছ...ওই বামনাকৃতি বীর যোদ্ধাটি হলেন আমাদের গ্রামের গর্ব, অ্যাস্টেরিক্স। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাণের বন্ধু ওবেলিক্স... আর ইনি হচ্ছেন জেরিয়াট্রিক্স, ইনি ম্যাট্রিক্স...
-তা ভালোমানুষের পো, তোমার নাম কী গো?
-অ্যাপেন্ডিক্স। আর আমার পাশে বসে আছেন, গ্রামের প্রধান পুরোহিত, শ্রদ্ধেয় শ্রী এটাসেটামিক্স। কিন্তু শশশশ... ওনাকে বিরক্ত করো না যেন, উনি এখন এই সঙ্কট থেকে আমাদের উদ্ধার করার উপায় খুঁজছেন।
-সঙ্কট? সঙ্কট কেন?
-সে অনেক কথা... আমাদের গ্রামের চারদিকে রোমানদের চারচাট্টে সৈন্যশিবির। তবু যে ওরা আমাদের সমঝে চলে, কেন জান? এই এটাসেটামিক্স এটার সাথে সেটা মিক্স করে এমন এক জাদু শরবত তৈরি করতেন, তাই খেয়েই আমাদের দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার মতন।
-কেমন? কেমন?
-আরে আমরা সবাই হাতি লুফি, খেলাচ্ছলে যখন-তখন। বাচ্চারা খুব কাঁদলে পরে, আনি দুটো রোমান ধরে। মনের সুখে মেরে - ধরে, ছেলেরা হাতের সুখ করে।
-বা রে! ভারি তো মজার ছেলেখেলা!
-"বললে বেশি ভাববে শেষে, এসব বুঝি ফেনিয়ে বলা।" বলেই অ্যাপেন্ডিক্স হঠাৎ যেন কেমন উদাস হয়ে গেল। "কিন্তু দারুণ দিনগুলো আচমকাই এভাবে নিদারুণ হয়ে যাবে, কে আর ভেবেছিল? একদিন সকালে উঠে...বয়স হয়েছে তো... এটাসেটামিক্স দেখলেন শরবতের ফর্মুলা কিছুতেই মনে পড়ছে না! ব্যস! গ্রামশুদ্ধু সক্কলে চোখে ধোঁয়া দেখতে লাগলাম।"
বলতে বলতেই দেখলাম অ্যাপেন্ডিক্সের মুখটা কেমন করুণ হয়ে গেল। শেষটায় আর সামলাতে না পেরে ‘হায় হায় প্রাণ যায় হায় হুকু হায় হুকু হায় হায়’ বলে ভেউভেউ করে কেঁদেই ফেললে। তাকে এমন আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে, আমারও চোখদুটো কেমন ভিজে ভিজে ঠেকছিল। ভাবছিলাম, শ্রোডিঙ্গারের সেই রুমালটা থাকলে এই সময় খুব কাজে দিত, এমন সময়-
বলা নেই কওয়া নেই, এটাসেটামিক্স যার নাম, সেই ভারিক্কি চালের বুড়োটা সুড়ুৎ করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দমাদ্দম করে নিজের বুকে গোটা দশ কিল মেরে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, "পেয়েছি, আমি পেয়েছি! ও ছোটকা, ইউরেকা! ওরে, কে আছিস? দৌড়ে গিয়ে চারণকবিকে ডেকে আন।"
-ও বাবা, তোমাদের মধ্যে আবার একজন চারণকবিও আছে নাকি?
-"আছে বইকি!" অ্যাপেন্ডিক্স জবাব দিলে, "সবুর করো না, এই এল বলে।"
বলতে না বলতে, দুটো লোক মিলে একটা কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল আর গোড়ালি অবধি লম্বা দাড়িওলা জন্তুকে ধরেবেঁধে হাজির করলে। জন্তু বলাই ভালো, কারণ একঝলক দেখে সে মানুষ না ভূত, বাঁদর না প্যাঁচা, সাম্প্রদায়িক না সেকুলার টের পাওয়া যায় না। এটাসেটামিক্স তাকে দেখেই তার কানেকানে কীসব কানাকানি করলে, তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল, "ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, এইবার চারণকবি মিঠেগলিক্স তার মিঠে গলায় আমাদের একটা গান শোনাবে। আশা করছি, এই গান আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার করবে।"
ওমা, এটাসেটামিক্সের কথা পড়তে পেল না, দেখি সবাই গুটিগুটি পালানোর মতলব করছে। কেউ বলে, "উনুনে শুয়োর রোস্ট করতে দিয়ে এসেছি, পুড়ে যাবে," তো কেউ বলে, "আমি যাই, এখনও অনেকগুলো মেনহির বিলি করা বাকি আছে।" হালচাল সুবিধার নয় বুঝেই বোধহয় এটাসেটামিক্স তড়িঘড়ি চারণকবির হাতে আমার বইটা গুঁজে দিলে আর মিঠেগলিক্সও গলা খাঁকারি দিয়ে বইয়ের একটা পাতা থেকে সুর করে পড়তে লাগলে:
"ওই আমাদের পাগলা জগাই নিত্যি হেথায় আসে
আপন মনে গুনগুনিয়ে মুচকি হাসি হাসে
চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধাক্কা লেগে থামে
তড়াক করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে।"
অবাক হয়ে দেখি, এতক্ষণ যারা পালাই পালাই করছিল, তারাই কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে শুনছে। ওদিকে, মিঠেগলিক্স কিন্তু থামেনি, একটানা গেয়েই চলেছে:
"ভীষণ রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোঁচা
'এইয়ো' বলে ক্ষ্যাপার মতো শূন্যে মারে খোঁচা।"
এই অবধি শুনেই অ্যাস্টেরিক্স, ওবেলিক্স, ভাইটালস্ট্যাটিস্টিক্স; যেখানে যত গল ছিল, কেউ আনন্দে তুড়িলাফ দিচ্ছে, কেউ বা ডন বৈঠক দিতে লেগেছে, কেউ আবার হুমহাম গুমগাম মুগুর ভাঁজতে ভাঁজতে দুমদাম পেশী ফোলাচ্ছে।
"উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িংবিড়িং নাচে
কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে।
এলোপাথাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুসধাপুস কত
চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মতো..."
গান থামামাত্র সবকটা গল, রাজা-প্রজা-বাচ্চা-বুড়ো-সেবাইত-পুরোহিত সবাই মিলে লম্ফঝম্প আর হইহল্লা জুড়ে দিলে:
"রোমান ধরে মারো, সবাই রোমান ধরে মারো
মাথায় ঢেলে ঘোল, ওদের উল্টো গাধায় তোল
কানের কাছে পিটতে থাকো চোদ্দ হাজার ঢোল।"
যেন রোমান ধরে ঠ্যাঙাবার জন্যে একযোগে সবার ঠ্যাং-এ সুড়সুড়ি, হাত নিশপিশ। কারো যেন আর তর সইছে না, 'নিঃশেষে প্রাণ' পরিস্থিতি পুরো। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, যেতে যেতে ওই মোটা ওবেলিক্স আবার আব্দার জুড়েছে, "আমাকে কিন্তু দুটো রোমান বেশি দিতে হবে, হুঁ! আগেরবার আমার ভাগে কম পড়েছিল।"
তালগোল আর ডামাডোল থামলে পর খেয়াল হলো, গোলমালের সুযোগে গলগুলো আমার বইটা নিয়েই চম্পট দিয়েছে। তা যাকগে! বইয়ের নামটা মনে রেখেছি, মামাকে বললেই এনে দেবে'খন। 'সুকুমার সাহিত্য সমগ্র।'