বিশেষ রচনা - শিবাংশু দে
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
তুমি নিজে ঝরে গেছো
শিবাংশু দে
.....এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনও রয়েছে, চিরকাল.... (বিনয়)
পঁচিশে বৈশাখ এখন একা আসেনা। অথবা একজন মাত্র মানুষের স্মৃতি নয় তা। রাজেন্দ্র চোলের মন্দির বা রাগ য়মনকল্যাণের মতো তা বহুদিন ধরে গড়ে উঠেছে তিলে তিলে। যে সব মানুষগুলি রবীন্দ্রছায়ার আশ্রয়ে থেকে, একের পর এক ইঁট গেঁথে, বাঙালির তথাকথিত সাংস্কৃতিক সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন, পঁচিশে বৈশাখে তাঁরাও ফিরে আসেন। মৌন, উজ্জ্বল, অশরীর, স্মৃতির মুখ হয়ে।
ধরা যাক কয়েকজনের কথা। তাঁরা সবাই ছিলেন কলকাতার মার্জিত, সম্পন্ন, বিত্তবান সংস্কৃতিধারকদের বৃত্ত থেকে বহুদূরে থাকা অস্বচ্ছল মধ্যবর্গের স্বপ্নদেখা তরুণ। কেউ লেখেন, কেউ গান করেন। পরবর্তীকালে এঁরা জনে জনে বাংলাসংস্কৃতির স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন কেই বা জানতো? ভবানীপুরের ছেলেগুলির জন্য মহানগরের কিছু সেঁকতাপ তবু রাখা থাকতো। কিন্তু ময়মনসিঙের দলছুট বাঙালটি তো একেবারে একা।
ব্রাহ্ম হলেও, শান্তিনিকেতনের অন্দরমহলে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিলোনা। বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে বেড়াতে যেতেন সেখানে। কিন্তু সেখানে যে গান শুনতেন তার কোনও প্রভাব তাঁর উপর পড়তো না। ''.... এক নম্বর কারণ হতে পারে যে, ঐ গানগুলির রস গ্রহণ বা উপভোগ করার ব্যাপারে আমার নিজের অক্ষমতা কিংবা দু নম্বর কারণ হতে পারে এই যে, যাদের মুখে ও গলায় ঐ সব গান শুনতাম, গানের মধ্যে রস সঞ্চারণে তাদের অক্ষমতা। আবার এই কথাটিও সত্যি যে তখনকার দিনে সঙ্গীতরসিকরা এবং সাধারণ শ্রোতারাও রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান এবং ঋতুসঙ্গীতগুলিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন না। এই সব গানগুলির প্রতি তাদের রীতিমতো অশ্রদ্ধাই ছিল।'' জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই। জানেন না মহানগরের নির্লিপ্ত আবহে এক টুকরো ছায়া অঞ্চল কোথায় পাওয়া যাবে। গান গাইতে খুব ইচ্ছে করে যে।
ওদিকে কবিযশোপ্রার্থী কিশোর সুভাষ মুখুজ্যে হেমন্তের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন কালো'দার কাছে। কালো'দা অর্থাৎ অসিতবরণ আকাশবাণীতে তখন তবলা বাজাতেন। যদি তিনি হেমন্তকে রেডিও'তে একটা গানের চান্স করে দেন। তাঁদের আড্ডার আরেক সদস্য সন্তোষকুমার ঘোষ। সবাই লেখালিখি করেন। খুব বেশি স্বপ্ন দেখতেন না তাঁরা। তবু তাঁদের সাফল্য? স্বপ্নের গল্পের মতো'ই।
ময়মনসিঙের তরুণটি ইন্দিরা দেবীর প্রশ্রয় পেলেও তখনও পর্যন্ত 'স্বরবিতান' নামের কোনও স্বরলিপি বইয়ের নাম শোনেননি। স্বরলিপি বুঝতেনও না। পরবর্তীকালে 'টাকা জমিয়ে' জর্জদা কিছু স্বরলিপির বই কিনে ফেলতে পেরেছিলেন এবং নিজে নিজে স্বরলিপি দেখে গান গাওয়ার অভ্যেসও হয়ে যায় তাঁর। একই গল্প ভবানীপুরের ছেলেটিরও, একই রকম। হেমন্ত বলতেন যে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের নাম 'স্বরবিতান'। তিনি দোকান থেকে স্বরবিতান কিনে আনতেন আর হারমোনিয়মে সুর টিপে গান বাঁধার মহলা চালিয়ে যেতেন। গুরুবাদী 'শুদ্ধতা'পন্থিদের পক্ষে রীতিমতো স্যাক্রিলেজ বলা যেতে পারে।
অনেকদিন পরে, সন্তোষকুমার ঘোষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অশোককুমার সরকারের 'ছেলে', যেমন ঘনশ্যামদাস বিড়লা ছিলেন গান্ধিজির মানসপুত্র। এই স্নেহের আতিশয্যে অমিতাভ চৌধুরীকে আবাপ ছাড়তে হয় এবং তাঁর জায়গায় বার্তা সম্পাদক হয়ে আসেন সন্তোষকুমার। সন্তোষকুমার নিজে কিন্তু যথেষ্ট সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু অর্থহীন তীক্ষ্ণ অহমবোধ তাঁকে বহু মানুষের কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিলো। এই ভাবেই জর্জদার সঙ্গে তাঁর প্রকটিত বিরোধে তিনি সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক কী কারণে তাঁর সঙ্গে জর্জদার এই কলহটি শুরু হয়েছিলো তা নিয়ে নানা উপকথা আছে। একটা মত বঙ্গ সংস্কৃতি মেলায় জর্জদার অনুমতি না নিয়ে শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁর নাম ঘোষণা করেছিলেন। অন্য একটি, সন্তোষকুমারের অতি পানাসক্তি দূরীকরণের জন্য সন্তোষঘরণীকে জর্জদা কিছু নিদান দিয়েছিলেন, যে'টা সন্তোষকুমারের পছন্দ হয়নি। তার পর আবাপ'তে (দেশ নয়) চতুর্থ পৃষ্ঠায় সকুঘ নামে সন্তোষকুমার যে কলমটি লিখতেন, সেখানে জর্জ'দার গায়ন ও অন্যান্য পদ্ধতি নিয়ে কিছু অকরুণ মন্তব্য করতে থাকেন। এই সুযোগে সঙ্গীতবোর্ডের কিছু প্রভাবশালী মানুষও জর্জ'দাকে একঘরে করতে আসরে নেমে পড়েন। আশ্চর্যের কথা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যিনি সম্ভবতঃ সঙ্গীতজগতে ও ব্যক্তিজীবনে জর্জদার নিকটতম সুহৃদ ছিলেন, তিনিও তাঁর প্রায় বাল্যবন্ধু সন্তোষকুমার'কে এই অকারণ বিতণ্ডা থেকে নিরস্ত করতে পারেননি। শান্তিদেব জর্জদার গায়ন নিয়ে খুব স্বস্তি'তে না থাকলেও প্রকাশ্যে বিরোধিতা কখনও করেননি, বরং সঙ্গীতবোর্ডের সেই 'কুখ্যাত' সার্কুলারের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে মতামত জানিয়েছিলেন।
একটা ছবি মনে পড়ে যায়। চাইবাসা থেকে আরো দক্ষিণে ঝিকপানি পেরিয়ে একটা জায়গায় চুনাপাথরের খনিঘেরা একটা দীঘি। গাছপালা, ছায়া, রোদ আর সুনীল আকাশের ব্যাকড্রপ। সেখানে সন্তোষকুমারের সঙ্গে আড্ডা জমেছিলো একটা হিমেল, উজ্জ্বল সকালে। সাতের দশকের শেষদিকে। সেখানে ছিলেন কৃত্তিবাস, কৌরবের কিছু প্রথম সারির নাম আর আমাদের মতো দু'চারজন চ্যাংড়া সদ্যোতরুণ। গুরুজনেরা যখন বারুণীদেবীর কৃপায় প্রমত্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির নো-হোল্ডস-বার আইকনসংহার করছিলেন, তখন এই অধম (তখন রক্তের গরমে জল ফুটে যেতো) সরাসরি চার্জ করে সন্তোষকুমার'কে। প্রসঙ্গ জর্জদা। থমকে যাওয়া সন্তোষকুমারের মুখে যে আতুরতা দেখেছিলুম সেদিন সেখানে কোনও প্রতিহিংসা দূরে থাক, আহত রক্তমাংসের খেদ ছাড়া কিছু দেখিনি। খুব নেভা স্বরে বললেন, "আমি কিন্তু তোমাদের থেকে অনেক বড়ো ভক্ত, জর্জদা'র।" আমি বলি, " এসব আপনার মত্ত প্রলাপ, আসলে কারণটা অন্য কোথাও।" তিনি মৌন হয়ে যা'ন। কিছুক্ষণ পরে যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলেন, " নাহ, আমি সত্যি বলছি।" পরে ভেবেছি ঐ রোগকাতর, প্রবীণ, উজ্জ্বল মানুষটির (চ্যালেঞ্জ করে বলতেন, গোটা গীতবিতান কমা-দাঁড়ি-ফুলস্টপসহ স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন এবং সত্যিকথা বলতে কি, তাঁর ভক্ত না হয়েও তাঁর থেকে বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে ধরণের পাঠপ্রতিক্রিয়া শুনেছি, মুগ্ধ করেছিলো) প্রতি এত রূঢ় না হলেও চলতো বোধ হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি প্রয়াত হ'ন। দু'বার খুব বেশি করে মনে পড়েছিলো। প্রথমবার, যখন সন্তোষকুমারের প্রয়াণে আয়োজিত একটি স্মৃতিসভায় একটা মস্তো প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছিলুম। দ্বিতীয়বার জর্জদা'কে নিয়ে ব্রাত্য বসুর নাটক দেখতে দেখতে। সেখানে সন্তোষকুমারের চরিত্রটিকে পুরোপুরি কমিক'রিলিফ ভূমিকায় আঁকা হয়েছে। হি ডিজার্ভড বেটার....
এতদিন পরে পিছন ফিরে দেখলে আমার মনে হয় চিরকুমার জর্জ'দা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন আগমার্কা ময়মনসিং। একটু উৎকেন্দ্রিকতার বীজও ছিলো তাঁর মধ্যে। মহানগরের পেশাদারি শিল্প জগতের পরিশীলিত, কিন্তু ঘাতক ঈর্ষার প্রবণতাগুলিকে কখনও সহজছন্দে গ্রহণ করতে পারেননি। গুরু'র থেকে এই শিক্ষাটি তাঁর শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। আর সন্তোষকুমার অনেক লড়াই করে কলকাতার সংবাদসাহিত্যের হিংস্র জগতে একটা নিজস্ব স্থান করে নিয়েছিলেন, কিন্তু অকারণ অহমবোধ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। জর্জদার নিজেকে 'হরিজন', 'ব্রাত্যজন' আখ্যা দেবার পিছনে নিঃসন্দেহে একটা ডিফেন্স মেক্যানিজম কাজ করেছে। তিনি তাঁর অপার জনপ্রিয়তা'কে অস্ত্র করে প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার সঙ্গে লড়ে গিয়েছিলেন। শিল্পী হিসেবে জর্জদার প্রতিভার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী সত্ত্বাটি ওতপ্রোত হয়ে যাওয়ায় তিনি বাঙালিমানসে একটি কাল্ট ফিগার হয়ে গেছেন।
সব মিলিয়েই তো কবি, বৈশাখের পঁচিশ তারিখ।
0 comments: