1

স্মৃতির সরণী - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


স্মৃতির সরণী



কেভেন্টার আর রোজ মিল্ক
পিনাকী চক্রবর্তী


একবার বাবা, মা আর দিদির সাথে দেরাদুন থেকে ফিরছি। আমার বয়েস তখন খুব সম্ভব দুই বা আড়াই বছর, কারণ দিদির তখন ডিপথেরিয়া ধরা পড়েছিলো, আর সেই ঘটনাটা আমাদের পরিবারের একটা ল্যান্ডমার্ক। তখন ডিপথেরিয়া হলে কমই সারতো। আর যাদের সারতো, তাদের অনেকেরই গলার ট্র্যাকিয়া (শ্বাসনালী) কেটে, একটা আধুলী সাইজের ফুটো করে নিশ্বাস ফেলার ব্যবস্থা করতে হতো। ভগবানের দয়ায়, আমার দিদির সেই স্টেজে গিয়েও গলায় কাটাকুটি কিছু করতে হয় নি। ওষুধেই সেরেছিলো ওর ডিপথেরিয়া, মিরাক্যুলাসলী। কিন্তু সে যাই হোক, সেই সময়ে দিদির বয়েস ছিলো ছয়। সুতরাং অঙ্কের হিসাবে তখন আমার দুই বছরেরটি হবার কথা...

আমার এ সব শোনা কথা। দিদির শরীর হঠাৎ দেরাদুন বেড়াতে গিয়ে খারাপ হয়ে পড়ে। ওখানকার ডাক্তার রোগীর অবস্থা বিশেষ ভালো না বুঝে তাড়াতাড়ি কলকাতায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে বলেন। সেকালে কলকাতা ডাক্তারীর দিক থেকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বোধহয় এখনকার তুলনায় বেশী উন্নত ছিলো। তাই তাড়াহুড়ো করে যা টিকিট পাওয়া গিয়েছিলো সেই নিয়েই আমরা ফিরছিলাম। কি ক্লাস, কি ট্রেন এতশত কথা আমার মনে নেই, থাকার কথাও না।

তবে আমার মনে আছে ট্রেনের দুদিকের জানালার ধারে টানা লম্বা সীট ছিলো, আর তাতে বসার অংশের নিচে নারকোল ছোবড়ার গদি ছিল (একটা কোণা ফাটা ছিলো, আর তাই গদির কম্পোজিশনটা জানা গিয়েছিল)। বগির মাঝখানেও ওই জানালার ধারের সীটের সমান্তরাল করে দুটো পিঠোপিঠি সীট ছিলো। পরে জেনেছি এগুলো তখনকার সেকেন্ড ক্লাসে পাওয়া যেত।

আমি ছিলাম মা-র জিম্মায়। আমাকে জানালার পাশে বসিয়ে মা উদ্বিগ্ন ভাবে দিদির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সারাটা রাস্তা এলো। মা আমাদের বাড়ির পাওয়ার জেনারেটর। মাকে এরকম অবস্থায় আমি আগেও দেখিনি, তার পরেও না। আর বাবা দিদিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেন দিনরাত। আমাদের কামরায় আমরা ছাড়া লোক একেবারেই ছিলো না, কারণটা (এখন বুঝেছি) সম্ভবত আর্থিক। দ্বিতীয় আর তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়ার মধ্যে অনেক ফারাক হতো হয়তো সেকালে ...!

সেই সময়ে সন্ধ্যে বা সকাল রাত্তিরে ট্রেন কোন একটা বড় স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আমাদের জানালার ঠিক পাশে একটা বিশাল সাহেবী মার্কা চায়ের স্টল ছিলো। কাঁচের জানালার ডিসপ্লে-তে দেখা যাচ্ছিলো থরে থরে বড় বড় কাপ প্লেট সাজানো আছে। কাপগুলোর গায়ে নীল দিয়ে কিসব ছাপটাপ দেওয়াও ছিলো। পরে জেনেছিলাম স্টেশনটা ছিল মুঘলসরাই, আর চায়ের দোকানটা ছিলো কেভেন্টারের টী স্টল...

চা কিম্বা চায়ের কাপ নয়, আমার যেটা নজর টেনেছিলো সেটা হল ওখানে সাজানো ছোট ছোট বোতলে রোজ মিল্ক। নামটা জানা বা মনে রাখা আমার বয়েসে সম্ভব ছিলো না, কিন্তু নির্ভুল ওই চেহারাটা মনে আছে। আর ওটা খাওয়ার যে একটা অদম্য ইচ্ছে হয়েছিলো, সেটা আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। না, ঠিক অদম্য নয়, কারণ দমন তো করেছিলাম, দিদির ক্লান্ত মুখ আর মা বাবার চোখে অপরিমেয় বিষাদের দৃষ্টি দেখে। বাচ্চারা অনেক কিছুই বোঝে, আমরা শুধু বুঝি না যে ওরা বোঝে...

অনেকদিন পরে, ১৯৮৩ সালে (আমার তখন ২৯ চলছে) অফিসের কাজে বরোদায় গেছি, ট্যুরে। আমাদের রিজিওনাল অফিস মকরপুরা রোডে। তার গেটের ঠিক উল্টোদিকে দেখি কেভেন্টারের বেশ লম্বা চওড়া একটা আউটলেট। এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে সেখানে গিয়ে আগেই সেই রোজ মিল্ক এক বোতল নিয়ে চোঁচা করে টেনে শেষ করে ফেললাম। তারপরে ধীরে সুস্থে মুখ মুছতে মুছতে আবার রাস্তা পার হয়ে অফিসে ঢুকলাম, সেই আমলের চীফ জিওলজিস্ট ডক্টর রাজুর সাথে মিটীং করতে। ভয়ানক কড়া ধাতের লোক ছিলেন, শুনেছি। ওঁর সাথে দেখা করার আগে লোকে একবার করে নিজের নাম, বাবার নাম, নিবাস ইত্যাদি জরুরী তথ্য ঝালিয়ে নিত মনে মনে, না হলে পকেটে একটা কাগজে করে লিখে রেখে দিত। প্রচণ্ড ঝাড় খেলে এইসব মনে করিয়ে দেবার লোক পাওয়াও তো দুষ্কর হবে...!!! আমার কিন্তু মাথায় কেভেন্টার, মুঘলসরাই, ডিপথেরিয়া, সেকেন্ড ক্লাস কামরা - এই সব উল্টোপাল্টা জিনিষই ঘুরছে তখনও। সে যাত্রা বকু্নি খেতে হয় নি, অবশ্য। রাজু সাহেব বরং নিজের গাড়ি দিয়ে আমাকে অংকেলেশ্বর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তথ্যানুসন্ধানে। বড় ভালো লোক ছিলেন গো, কেন যে লোকে ভয় পেত ওঁর নাম শুনলে, সেটা ভালো করে বুঝলাম না।

যাই হোক, পরের দিনও এই কেভেন্টারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। তার পরের দিনও তাই। তার পরের দিন ফেরত চলে এলাম নিজের জায়গায়। এর পরের বার বরোদা এলাম বোধহয় ১৯৯৬ বা ৯৭-তে। আবার ট্যুর (আসলে আমি বরোদাতে পোস্টেড হই নি কখনও, যখনই যাই – গিয়েছি ট্যুরে)। এবার দেখলাম কেভেন্টার না, দোকানের নামটা পালটে রাখা হয়েছে বরোদা ডেয়ারী। রাস্তা অর্ধেকটা পার হয়ে চলে এসেছিলাম, কিন্তু হতাশ হয়ে ফেরত চলে গেলাম। বরোদা ডেয়ারীতে যাব বলে তো আমি বরোদায় আসি নি ... ভাগ্যিস রাজু সাহেব ১৪ বছর আগেই ডেকে নিয়েছিলেন। না হলে আমার স্বপ্নের রোজ মিল্ক আর খাওয়া হতো না...







1 comment: