0

ব্যক্তিগত গদ্য - গৌতম দত্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য



ঋতু : মন ও প্রকৃতি
গৌতম দত্ত



“প্রকৃতি তাঁর নিজের ভক্তদের যা দেন, তা অতি অমূল্য দান। অনেক দিন ধরিয়া প্রকৃতির সেবা না করিলে কিন্তু সে দান মেলে না। আর কি ঈর্ষার স্বভাব প্রকৃতিরাণীর—প্রকৃতিকে যখন চাহিব, তখন প্রকৃতিকে লইয়াই থাকিতে হইবে, অন্য কোনও দিকে মন দিয়াছি যদি, অভিমানিনী কিছুতেই তাঁর অবগুন্ঠন খুলিবেন না।

কিন্তু অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাকো, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর এত অজস্রধারে বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে, দিনরাত মোহিনী প্রকৃতিরাণী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন, নূতন দৃষ্টি জাগ্রত করিয়া তুলিবেন, মনের আয়ু বাড়াইয়া দিবেন, অমরলোকের আভাসে অমরত্বের প্রান্তে উপনীত করাইবেন। ”

“বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।– ” - রবীন্দ্রনাথ।

কি অপূর্ব, তাই না!

মন-প্রকৃতি-ঋতু – এই তিনটে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় হলেও আমার ধারণায় এরা একে অপরের পরিপূরক। অভিধানের হয়তো অনেক অর্থ হয় আর সেগুলোর অনেক রকম ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে, কিন্তু আমি ঐ তত্ত্বজ্ঞানীদের দলে না গিয়ে আমার ভাবনাটাই বলি।

আমার তো শরীরে দখিন হাওয়া লাগলেই মনে পড়ে যায় সেই চিরন্তন প্রেমের আর তার সাথে সাথেই বিপরীত শব্দ বিরহের কথা। আপনাদেরও নিশ্চই এমনই অনুভব হয় ! এর জন্যে কি আমাদের ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে চাওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে? নিশ্চয়ই না। এই একটা উদাহরণের সূত্র ধরেই বলতে পারি যে এই মন-প্রকৃতি-ঋতু কেমন করে আমাদের অগোচরে আমাদের মনে বাসা করে ফেলে।

আমার ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার উপকন্ঠে এক শহরতলীতে। গাছ-গাছালি, ডোবা-পুকুর, মাঠ-ঘাট আর আকাশ-মাটিকে ছুঁতে পারতাম প্রতি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। বর্তমান জগতের প্রোমোটারী-রাজ তখনো অধরা। খুব সম্ভবতঃ এই ডাকাতিয়া শব্দটার সাথে পরিচয় ও ছিল না তখন। সেটা আমাদের অশেষ সৌভাগ্যই বলবো। প্রাণভরে আস্বাদ নিয়েছি এ সব কিছুরই। আজ আর বাড়ির জানালা দিয়ে পূবাকাশের প্রথম সূর্য-রশ্মি অথবা বিকেল বেলার কনে দেখা আলোয় ভরা, নারকেল গাছের মাথা লুপ্তপ্রায় এক স্বপ্ন। তাই মনও ছোট হয়ে গেছে !

আমাদের বাড়ির সামনে ছিল চওড়া কালো পীচঢালা এক পাকা সড়ক। তাই সেদিকটাকে আমি বলতাম শহর কলকাতা। আর আমার প্রাণের গ্রাম ছিল বাড়ির পেছন দিকে। রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর আর পূজোর ঘরের প্রশস্ত টালির চালা যেখানে শেষ হয়েছে তার পরে একটা ছোট্ট বাগান পেরিয়েই ছিল পুকুর। পাড়ার পুকুর। তাই সকাল থেকেই তার ঘাটে ঘাটে চলতো চলন্ত জীবন। শুধু ঋতুবদলে একটু আধটু সময়ের অদল বদল ছাড়া পুকুরপারে’র এই জীবন তার নিজের ছন্দেই চলতো।

ঘোর বর্ষায় যখন বৃষ্টির সুতীব্র ফোঁটাগুলো সজোরে জলের বুকে আছড়ে পড়তো তখন যে কি অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হল সেই পুকুরের বিস্তৃত জলে তার বর্ণনা করার ভাষা আমি এখনো আয়ত্ত করতে পারি নি। বৃষ্টিপাতের তীব্র শব্দে মন উঠতো নেচে। হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজতো দামামা। শুধু মনে হতো সেই কদম ফুলের গন্ধে কেউ যদি পাশে এসে বসে আমার এই অনুভবের স্বাদ একটু ভাগ করে নিত, কি মধুময় হয়ে উঠতো পৃথিবীটা তাহলে!

আর রাতের ঘন বৃষ্টিতে যখন সামনের রাস্তায় যান চলাচল যেত স্তিমিত হয়ে তখন কান পেতে শুনতাম শব্দের আরেক অন্য রূপ। গাছের পাতায় আর পুকুরের জলে পড়া সেই বৃষ্টির অব্যক্ত ধ্বনি কানের ভিতর দিয়ে পশে যেত মরমের অন্তঃস্থলে। একা ঘরে মিটমিটে সবুজ আলোয় মনে পরতো বারংবার :

“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়--
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার--
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব--
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥” – বর্ষার দিনে – মানসী – রবীন্দ্রনাথ।

ওই বয়সেও একলা শুয়ে শুয়ে চোখের ভেতরে ঘোরাফেরা করতো আমার কল্পনার রানী। আমার মানসীকে। হৃদয়ের সব কিছু যাকে উজাড় করে দেওয়া যায় সেই মানসসুন্দরীকে চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করতো :

“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী!
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
'কোথা আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি'। ” - নিরুদ্দেশ যাত্রা (সোনার তরী) - রবীন্দ্রনাথ।

ডাকি তো কত! কিন্তু আসে কে?

প্রকৃতিরানী শুধু আমার হৃদয় আর মনের খেলা দেখতেন অলক্ষ্যে থেকে। আর তাই এই লেখা লিখতে লিখতে বারে বারেই মনে হচ্ছে যে ঋতু বৈচিত্রের অনুষঙ্গেই যোগ দেয় আমাদের মন আর হৃদয়। এর জন্যে আধুনিক ভাষায় যাকে “এট্যাচমেন্ট” বলে, সেটার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না কখনও।





0 comments: