11

অণুগল্প - মিতিল চক্রবর্তী

Posted in


অণুগল্প



ফটিক
মিতিল চক্রবর্তী


-- ফটিক, অ্যাই ফটিক ...
-- হ্যাঁ, যাই বড়মা।

মাত্র সাত দিন হলো ফটিক চক্রবর্তী বাড়ির নতুন সদস্য। বাড়ির কর্তা সুরঞ্জনবাবু একটি স্কুলের শিক্ষক। এই স্কুলেই ফটিক ভর্তি হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ওর বাবার এখন নতুন বৌ। আর ওর মা স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে একরত্তি ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে ঘরছাড়া। অভিমানে সুদূর আন্দামান থেকে পালিয়ে এসেছে ও। প্রথমে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়িতে উঠলো । একটা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলেই তিনি বলতেন – ফটিক আর পড়তে হবে না, ইলেকট্রিক বিল বাড়বে। ফটিক ওর কাছের মানুষ সুরঞ্জন স্যারকে একদিন বলে - স্যার সারা দিন অনেক কাজ করি। বাসন মাজা, বাজার করা, ঘর ঝাঁটপোছ। রাতটুকুই তো আমার পড়ার সময়।

সুরঞ্জন স্যারের বড় মায়া হয়। তিনি বলেন -তুই কাল থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবি। কোনও কাজ করতে হবে না। শুধু পড়াশোনা করবি। ফটিক অনেক কায়দা করে ঐ আত্মীয়র হাত থেকে ছাড়া পায়। মালপত্র গুছিয়ে চলে আসে সুরঞ্জন স্যারের বাড়ি। স্যারের দুই কন্যা দোলা আর পালকি। দুজনের সঙ্গেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফটিকের ভাব জমে যায়। দোলাকে দিদি আর পাল্কিকে বোন সম্বোধন করে। পালকি ওকে জিজ্ঞেস করে – কী করে আন্দামান থেকে পালিয়ে এলে? 

ফটিক শুরু করে তার গল্প। বলে- জাহাজে চড়ে পৌঁছলাম ভাইজ্যাগ। সেখান থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরলাম বিনা টিকিটে। যখন টিকেট চেকার আমার দিকেই আসছে আমি ভ্যানিস। দেখি ট্রেনের টয়লেটের সামনে কেউ আমের বস্তা রেখে দিয়েছে। সেখান থেকে আম নিয়ে বাথরুমে গিয়ে মনের সুখে খেলাম। এখানে টিকেট চেকার বা আমের মালিক কারো হাতেই ধরা পড়ার ভয় নেই। এরপর হাওড়া স্টেশনে নেমে অজানা শহরে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজ।

সুরঞ্জন স্যারের বাড়িতে একটা ছোটদের স্কুল আছে। স্যারের স্ত্রী ঐ স্কুলটি চালান। স্কুলবাড়ির দোতলার ঘরেই ফটিকের রাতের আস্তানা। বড়মা (সুরঞ্জন স্যারের স্ত্রী) ওকে খুবই স্নেহ করেন। ঐ ঘর থেকেই ফটিকের পড়া মুখস্থ করার স্বর ভেসে আসে। পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে গ্রাম্য মেঠো গান গাইতে গাইতে ও রোজ স্কুলে যায়। 

একদিন ভোরের আলো ফুটতেই ফটিক বনগাঁয় এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। একটা মস্ত বড় কাঁঠাল নিয়ে ফিরলো আর তার বীজ পুঁতে দিলো বাড়ির পেছন দিকে। বড়মা জিজ্ঞেস করলো – ট্রেনের টিকেট কেটেছিলি? ফটিকের সরল উত্তর – বড়মার মত সৎ হলে চার পাঁচ দিনের বেশি বাঁচা যাবে না। ফটিক হাতের কাজে খুব দড়। হঠাতই একদিন কয়েকটা তার দিয়ে হ্যাঙ্গার বানিয়ে ফেললো। নারকেল গাছের পাতা থেকে শলা তুলতে বসলো। বড়মা ভাবলো হয়তো ঝাঁটা বানাবে। কিন্তু ওগুলো দিয়ে বানালো বাহারি নক্সার কয়েকটি ঘুড়ি। একটা ঘুড়ির নাম দিল বৌ ঘুড়ি। সুরঞ্জন স্যার বললো – ফটিক তোর কোনদিন অভাব হবে না। বুদ্ধির জোরেই পেট চালাবি।

ফটিক সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। বাড়ির সবাই খুব খুশি। ফটিকের মুখ ভার। হয়তো মায়ের লাবণ্য মাখা মুখটা মনে পড়ছে। পরের দিন সকালে বড়মা ডাকলেন –ফটিক, অ্যাই ফটিক ... দোতলা থেকে কোন সাড়া এল না। বড়মা ওপরে গিয়ে দেখেন খাঁ খাঁ করছে ঘর। ফটিক নেই। ওর বিছানা, বাক্স কিচ্ছু নেই। কাউকে কিছু না জানিয়ে মায়ের কাছে হয়তো ফিরে গেছে। 

সেই সময় পোস্ট আপিস থেকে চিঠি আনতো ডাকপিয়ন আর ঘরে ঘরে ছিলো ল্যান্ডলাইন। মোবাইল জমানা শুরু হয় নি তখনো। বেশ কয়েক বছর বিরতির পর ফোন – 

- আমি ফটিক।
- ফটিক! কেমন আছিস বাবা?
- ভালো। সেদিন আমার ওভাবে চলে আসা উচিত হয় নি।
- যাবিই যখন বলে গেলি না কেন?
- তোমাদের বড্ড মায়া। বললে তোমরা আমাকে ফিরতে দিতে না।
- এখন কী করছিস?
- জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। সংসার সামলাচ্ছি। একটা মেয়েও হয়েছে। তোমাদের ভুলি নি বলেই ওর নাম রেখেছি পালকি। 
-আর কাজকর্ম কী করছিস?
-তোমাদের আশীর্বাদে বীজের ব্যবসা করে আমি আজ যথেষ্ট সচ্ছল। প্লেনের টিকেট কেটে রাখবো তোমাদের জন্য। তোমরা আন্দামানে এলে আমাদের মন প্রাণ ভরে যাবে।

ফোনের ওপারে বড়মার কপোল বেয়ে তখন ঝরছে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার নির্বাক আনন্দ ও ফটিকের প্লেনের টিকেট কেটে মাতৃঋণ শোধ করার প্রচেষ্টায় নীরব অভিমান। বড়মা অপলকে চেয়ে রইলো কাঁঠাল গাছটার দিকে। ভালোবাসার বীজ থেকে চারা আর সেই চারা আজ মহীরুহ হয়ে ফলভারে আনত। কাঁঠালের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালো বড়মা। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

11 comments:

  1. রবীন্রনাথের অতিথি মনে পড়ল। ভালো

    ReplyDelete
  2. Khub sundor....mon chuNye gelo...!

    ReplyDelete
  3. বাঃ বেশ ভাল গল্প। দ্বিতীয় সৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুশি হলাম দাদা।

      Delete
    2. খুশি হলাম দাদা।

      Delete
  4. Mityl,
    Khoob shundor!
    We all feel proud of you!!
    Kuttimamu

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুশি হলাম কুট্টি মামু।

      Delete