undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
জল রেখা ৮
নন্দিনী সেনগুপ্ত
‘আরেকটু ভাত, আরেক টুকরো মাছ দিই তোকে রবি’... বলতে থাকেন এষা... ‘উফফফ, একহপ্তা যা গেলো তোর দাদাকে নিয়ে। কিছু রান্নাবান্নাও তো ঠিকভাবে করিনি কদিন। একদম ঠিকসময়ে যেন ভগবান তোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বড় অসহায় লাগছিল একা একা। ওরাও বা কলকাতা থেকে কদ্দিন যাতায়াত করে সামলাতে পারতো বল। ঠিক সময়ে যেন ঠাকুরই সব যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। ডাক্তারও ভালো বলতে হবে বল! বুঝতে পেরেছিল যে ভিতরে ভিতরে একটা অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে তখন’ ...
‘তুমি অখন খাইতে বইসা যাও বৌঠান! নাহ, আমারে আর ভাতমাছ দিওনা...’ হাত নাড়ে রবি।
‘কেন রে, এসেছিস থেকে দেখছি, কিছুই ঠিকমতন খাসনা তুই! নেহাৎ রোজ হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি চলছিল বলে সময় করে বলা হয়নি। আজ তোর দাদা বাড়ি আসায় এই একটু রাঁধলাম। কেন খাবিনা, ভাল হয়নি রান্না?’... ধমকে ওঠেন এষা।
‘কি যে কও, তোমার রান্না ভাল হইবো না! হেয়ার লেইগ্যা না গো...’ মুখ নিচু করে রবি... ‘তুমি যে আমার বদভ্যাস করাইয়া দিতাসো। হ্যাষে আশ্রমে ফিরা সিদ্ধভাত কি আর আমার মুখে রুচবো। এইখানে এদ্দিন থাকুম ভাবিনাই তো। দাদার এই অবস্থা দেইখা... তোমারে একা ফালাইয়া কেমনে যাইতাম...
এষা চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, ‘হ্যাঁ রে রবি, ওখানে বুঝি তোর খাওয়ার ভারি কষ্ট? তাহলে আর ফেরত গিয়ে কাজ নেই বাপু। তুই এখানেই থেকে যা। ভালই হয়েছে, তুই নীরুকে একটু অঙ্ক করাবি। ও সব বিষয়েই ভাল, কিন্তু একটু অঙ্কভীতি আছে। তোর দাদা তো সহজে কথা বলে না। সারাদিন মুখে কুলুপ এমনিতেই। নীরুকে বিশেষ পড়া দেখাতো না কোনওদিন। আর এখন তো নানা বিধিনিষেধ আছে ডাক্তারের। ব্যস... আরও চুপচাপ হয়ে গেছে সে। ভালই হবে, তুই থেকেই যা। এখানে কতকিছু করতে পারবি তুই। এতখানি জায়গা বৈঠকখানা ঘরে; তুই একটা কোচিং ক্লাস খোল। ঐ অজ পাড়াগাঁয় ফেরত যাস নি তুই আর’... পুরো কথা শেষ হয়না, তার আগেই রবি হাসতে শুরু শুরু করে। একেবারে প্রাণ খোলা হাহা করা অট্টহাস্য।
এষা অপ্রস্তুত বোধ করেন। বলেন, ‘কেন রে? আমি কি কিছু ভুল বললাম? তোর কি ভাল লাগবে না এদ্দিন পরে যখন আবার এলি, আবার আমাদের সঙ্গে থাকতে? আমি জানি রে, তুই যতদূরেই থাকিস, তুই সর্বদা আমাদের কথাই ভাবতিস। জানিস... আমার পেটের শত্তুর বড়খোকা যখন ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, আমার শোকের উপর হয়েছিল অভিমান। ভাবতাম, তুই কি খবর পাস নি এতবড় অঘটনের? কী পাষাণহৃদয় তোর যে এই খবর পেয়েও তুই একটিবার এসে দাঁড়ালি না আমার সামনে!’...
রবি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। বলে, ‘পাইসিলাম বৌঠান। খবর পাইসিলাম, কিন্তু প্রায় একবছর পরে। ভাবলাম এদ্দিন পরে কোন্মুখে আইসা খাড়ই! তাছাড়া... তুমি তো সব জানো না... কমলের লগে আমার মনান্তর... শুধু যে রাজনৈতিক মতের অমিল, তা নয়। মনে হইতো, মায়ের প্যাটের ভাই হইলে কি আর সবাই আপন হয়! তুমি, দাদা, তোমরা হইলা আমার কাছে দেবতুল্য... কিন্তু কমল..., থাউক গিয়া, অহেতুক বিষের টুকরা ঘাঁটতে ভালো লাগে না বৌঠান। এদ্দিন পরে তোমার সামনে আইলাম, কারণ খবর পাইসিলাম যে তোমরা ঐ বাড়ি ছাইড়া আইয়া এইখানে বসত করতাসো। ভালো করসো, খুব ভালো করসো এইখানে আইয়া। ফ্রেস জায়গা। শহরের ক্যাচকেচি থিক্যা অনেক ভাল। দেইখো, দাদায় সাইরা উঠবো শীঘ্র! কিন্তু আমার থাকনের উপায় নাই। বোঝলা নি, আশ্রমে কয়ডা পোলা... অনাথ, কি কমু... খাওন জোটেনা, কিন্তু কি মাথা অঙ্কে! হ্যাগো পড়াই, হ্যাগো যা খাওন জোটে, আমিও তাই খাই। কি কমু বৌঠান, দেইখো একদিন... অরা একটু সুযোগ পাইলে দ্যাশের মুখ উজ্জ্বল করবো। আমারে কাইল যাইতেই হবে। আশ্রমের লোকেরা খুবই চিন্তা করবে নচেৎ। যদিও একখান ফোন দিসি পোস্টমাস্টারের কাছে, তাও... একদিন বরং তোমরা আইসা দেইখা যাও আমাগো কর্মকাণ্ড। সব্জিবাগান করসি নিজেরা, অনেক প্ল্যান করসি, বোঝলা নি। তবে ফান্ড লাগবো, হেই লেইগা কিছু সাহায্য, তদ্বির করতে কলকাতায় গিয়াই খবর পাইলাম যে তোমরা এইখানে আইয়া পড়সো। ভাবলাম আশ্রমে ফিরবার আগে একবার দেইখ্যা যাই তোমাগো। আইস্যা তো দেখি...
‘ভাগ্যিস এসেছিলি ঐদিন। নইলে যে আমি কি করতাম একা একা!’... একটুখন চুপ থেকে ভুরু কুঁচকে মুচকি হেসে বলেন এষা ... ‘হ্যাঁ রে রবি, আমাদের সবার খবর তোকে কে দিতো রে?’
‘হ... হেইডা অখনও জানো না? সুবিমল... সুবিমলেরে মনে নাই তোমার? আমার লগে ইস্কুলে পড়তো। নন্দীবাগানের দিকে অগো বাসা। হ্যার আপন দাদা দিলীপদায় আবার দাদার খুব বন্ধু আছিলো। দিলীপদা মারা গেলো গতবছর। সুবিমল মাঝে মাঝে যায় আমাগো আশ্রমে। অনেক হেল্প করে। তবে আগে এত যোগাযোগ ছিল না। আমি হগ্গলের লগে কাট-অফ কইরা দিসিলাম। সুবিমলের ঘোরনের নেশা। ও আমাগো আশ্রমের গ্রামের পাশে জঙ্গলে ঘুরতে গেসিলো। ঐ পিকনিক পার্টি আরকি! যেমুন যায় মাইনষে। পাশে আশ্রমও দেখতে আইসিল শখ কইরা। হঠাৎ আমারে দেইখা চিনা ফালায়! যদিও দাড়ি-গোঁফ রাখসি, তাও ছোটবেলার বন্ধু... ঠিক চিনছে। অরে দিব্যি দেওয়াই, কাউরে য্যান না কয় আমার খবর। তাও হয়তো কেউ কেউ জানছে। দাদা তো জানতো আমার খবর, আমি জানি। কিন্তু আমারে বিরক্ত করে নাই কখনও। থাউক গিয়া... আমি সংসারে ফিরতে চাই নাই বৌঠান... আমি ভালই আছি, বিশ্বাস কর। আমি এইভাবেই ভালো থাকি। আমার লেইগ্যা ভাইবো না। ঐ অনাথ শিশুগুলিরে, তুমি যদি একবার দেখতা বৌঠান... বুঝতে পারতা যে ক্যান আমি আর ফিরতে চাইনা সংসারে! তোমার যখনই কিছু প্রয়োজন হবে, আমি পোস্টমাস্টারের নম্বর দিয়া গেলাম। আশ্রমের পাশেই। আশ্রমের নিজস্ব ফোন নাই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমি খবর পাবো। আমি পুনরায় ফোন করবো তোমারে। ভাইবো না। সব ঠিক হইয়া যাবে। আর নীরু দিদিমণিকে আজই আমি অঙ্ক করাবো, সে বুদ্ধিমতী... নিশ্চয়ই সে ভালো অঙ্ক পারবে। এখন উঠি। গপ্পো কইরা আঁইঠা হাত শুকাইলো, এক্কেরে য্যান ছোটবেলার মতন। তুমি অখন খাইয়া লও। বেলা যায়’... একটানা বলে থামে রবি। তার মুখে এক অদ্ভূত পরিতৃপ্তির হাসি।
0 comments: