ছোটগল্প - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
পথভ্রষ্ট
সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
মাউন্ট ফুজির চুড়োর ওপর বসে বেড়ালটা জিভ দিয়ে লোম চাটছিল। কয়েক মুহূর্ত আগে আবার একটা লোনাজলের ঢেউ এসে ওকে ভিজিয়ে দিয়েছে।
মাৎশু-পিৎশুতে আলবাও মায়া তার মা'কে লুকিয়ে আবার ইন্তি-ওয়াতানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সভয়ে দেখছিল মাত্র দুশো ফুট নিচের উত্তাল জলরাশির দিকে।
ডিসেম্বর মাসের সাত তারিখেও দোকানের মাথায় ছোট্ট সাইনবোর্ডটা লাগাতে ঘেমে একশা হয়ে যাচ্ছিল কিম জং। তার নতুন শহর কলকাতাতে সেদিন তাপমাত্রা ছেচল্লিশের একটু বেশি।
জোকা সাব-পোস্ট-আপিসের পাশের নোনাধরা দ্বিতল বাড়িটার ছ'টা ঘরে আজ সত্যিই একান্ন জন বাসিন্দা। রান্নাঘরে প্রকাণ্ড ডেকচিতে ভাত সিদ্ধ হচ্ছে। তারই মাঝে কয়েকটা আলু তাদের হার-না-মানা মাথা উঁচু করে আছে। অনুজার পাশে নি-লু, নিপুণ হাতে কতগুলো মড়াখেকো পেঁয়াজের পচা অংশ বাদ দিয়ে কুচচ্ছে আর আনমনে ওদের বালি'র ভাষায় কী যেন একটা মিষ্টি গান গুনগুন করে গাইছে। নি-লু'র মেয়েটার তিনমাস বয়েস হল। এই বাড়িতেই জন্মেছে সে।
রান্নাঘরের জানলা দিয়ে একবার আড়চোখে দূরে তাকায় অনুজা। কী যে ভালবাসত ও এই সমুদ্রকে!
পৃথিবীতে এখন পাঁচভাগ জল, একভাগ স্থল। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে আঠাশ ডিগ্রি বেশি। স্থলভাগের ছত্রিশ শতাংশ এখন আগ্রাসী সমুদ্রের দখলে। বরফের পাহাড় গলেছে। যা ভয় করা হয়েছিল তার চেয়েও ঢের তাড়াতাড়ি গলেছে।
গতসপ্তাহের সরকারি তথ্য বলছে কলকাতা শহরের জনসংখ্যা আড়াই কোটি পার করেছে। দেশ, সীমানা, প্রাচীর, কাঁটাতার আজ সম্পূর্ণ নিরর্থক। ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ রাশিয়ায় শরণ নিয়েছে। আমেরিকার মানুষ আজ আফ্রিকাতে ঠাঁই খুঁজছে। চায়না, অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেক জলের তলায়। ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, বাংলাদেশের মানুষ মায়ানমার ও ভারতে। ভারতের মানচিত্রও পাল্টে গেছে; দক্ষিণে, ব্যাঙ্গালুরুর পর আর এক চিলতে মাটি পড়ে আছে। গুজরাত বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন একটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে।
না, কোনও সুনামি আসেনি। তিনবছর ধরে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে সমুদ্র, নির্মম ক্ষমাহীন। ধীরে ধীরে শুরু হয়েছিল কোটি কোটি মানুষের অভিপ্রয়াণ। বাকি দেশগুলো তা সহজে মেনে নেয় নি। কিন্তু গোলাবারুদ দিয়েও আটকানো যায়নি সেই জনসমুদ্রের স্রোত।
প্রথম ক'মাসের উন্মাদনার পর এক অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ করা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব শীঘ্রই ভেঙে পড়ে। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে সে দেশের প্রযুক্তিবিদ-গন। আটমাস পর, চরম নৈরাজ্য ও লক্ষাধিক মৃত্যুর শেষে গোটা পৃথিবীর সব দেশ এক চুক্তিতে সাক্ষর করে। রাষ্ট্রতন্ত্রের বদলে জন্ম নেয়, বিশ্বতন্ত্র। মনুষ্যস্বভাববিরুদ্ধ এই অকল্পনীয় ঘটনার পেছনে কারণ ছিল। কারণ, সেদিন বৈজ্ঞানিকদের অনুমানে পৃথিবীতে মানুষের আয়ু ছিল বড়জোর আর চারবছর।
কিম জং-এর মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। টাল সামলাতে না পেরে অস্ফুটে 'নুয়াই সিন' বলে সে দড়াম করে পড়ল তেলেভাজার দোকানি ও আশ্রয়দাতা বলরাম ঘোষের ঘাড়ে। 'শুয়ারের বা -!' পর্যন্ত বলার সাথেসাথেই কথা আটকে মুখটা তিন ইঞ্চি ফাঁক হয়ে গেল বলরামের। হঠাৎ চারপাশের পাখিগুলো চিৎকার করে উঠল। বড় রাস্তার লোকজন যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখল সুয্যিমামা হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে পশ্চিমে হাঁটা দিয়েছেন। মিনিট কুড়ির মধ্যে দুপুরের গনগনে রোদ কমে এলো। ঘড়িতে যখন আড়াইটে বাজছে, তখন কলকাতার আকাশ প্রায় অন্ধকার।
সেদিন, কয়েক সেকেন্ড আগে, ঠিক দুপুর বারোটায় বিভিন্ন দেশের দুহাজারেরও বেশি উপগ্রহ মিলিতভাবে সৃষ্টি করেছিল এক বিশালাকার ম্যাগনেটিক ফিল্ড; আর পৃথিবীর নানান দিক থেকেও প্রক্ষেপ করা হয়েছিল আরেক চৌম্বক ক্ষেত্র। দুটো প্রকাণ্ড থালার মতন এরা একে অপরের সাথে এক অভূতপূর্ব শক্তিতে মিশে যায়; সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সমান ক্ষেত্রফলের এক আড়াল, সূর্যের আকর্ষণের এক সাময়িক অন্তরায়।
সূর্যের আকর্ষণমুক্ত হওয়ার পরমুহূর্তে নিজের কক্ষপথ ছেড়ে জ্যা-মুক্ত শরের মতন এক স্পর্শকের গতিপথে ছিটকে যায় পৃথিবী। ঠিক দু'সেকেন্ড পর সেই চৌম্বকীয় অন্তরায় সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে অব্যাহত পৃথিবীর গতি ছিল প্রায় ২৫০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। ওদিকে, ঈর্ষায় রাঙা সূর্য ফের আপ্রাণ আকর্ষণে কাছে টেনে নিতে চাইছিল তার উষ্মান্বিত প্রেয়সীকে। পুরনো প্রেমিকের অমোঘ টানে গতি মন্থর হয়ে আসে পৃথিবীর।
সমগ্র পৃথিবীর মানুষ অপলকে চেয়ে থাকে। চার ঘণ্টার রাতের পর আসে পাঁচ ঘণ্টার দিন। পরের দিন আলো থাকে প্রায় আটঘণ্টা। পুরনো হিসেবে বারোদিন পর এক নতুন কক্ষপথে স্থিতি লাভ করে পৃথিবী, সূর্য থেকে আগের চেয়ে আরো আঠেরো লক্ষ কিলোমিটার দূরে।
কলকাতার বুকে সেই প্রথম তুষারপাত দেখল অনুজা। দূরে, মিনার্ভা গার্ডেনস ছাড়িয়ে আরও দূরে সরে গেছে সমুদ্রের জল। মেয়ে কোলে নি-লু'র চোখে খুশির জল।
পৃথিবীর তাপমাত্রা আকস্মিক ভাবে অনেকটা কমে গেছে। দুই মেরুর বরফ ক্রমশ বাড়ছে, সেখানে তাপমাত্রা হিমাংকের প্রায় চল্লিশ ডিগ্রী নিচে। সমুদ্রের জল নামছে। ধীরে ধীরে সলিল সমাধি থেকে উঠে আসছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, বিগ বেন।
উল্লেখযোগ্য আরও দুটো ঘটনা ঘটেছিল। সেই সুবিশাল চৌম্বক ক্ষেত্র নির্মাণে ইন্ধন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল পনের হাজারেরও বেশি পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি। বস্তুত, পনেরো হাজার তিনশ পঁচাত্তরটা।
আর ওই বারোদিনে পৃথিবীর আন্তর-আকাশে সূর্যের রশ্মি তীব্র বাঁক নিয়েছিল। তার ফলে ১৬০ - ২০০ ন্যানোমিটারের কিছু আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাবে অক্সিজেনের অণু চ্যাপম্যান চক্রে পড়ে তৈরি করে দিয়েছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাপের ওজোন।
সময়ের হিসেবও পাল্টেছে। নতুন কক্ষপথে এখন একদিনের হিসেব প্রায় ছাব্বিশ ঘণ্টা। বছর ঘুরতে প্রায় চারশোদিন। এবার, হয়ত কিছুটা সময় বেশি পাবে মানুষ। তবে, কতদিন? সে সময়কে কি সে কাজে লাগাবে?
আলবাও মায়াকে জড়িয়ে তার মা ইন্তি-ওয়াতানার পাশে নতজানু হয়ে বসে তার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করছে।
কিম-জং বাক্স গোছাচ্ছে। বলরাম ঘোষের সকাল থেকে আর পাত্তা নেই।
নি-লু আর অনুজার কান্না দেখে ছোট্ট মেয়েটাও গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। আর ওর কান্না দেখে হেসে ওঠে অনেকেই জোকার সেই সরু গলিটাতে।
মাউন্ট ফুজি'র চুড়ো থেকে এক পা এক পা করে নেমে আসছে বেড়ালটা।
আকাশে তখন পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। চাঁদটাকে যেন বড় ম্লান, বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে আজ। যেন লজ্জায়, অভিমানে সে অনেকটা দূরে সরে গেছে।
যেন ঘৃণায় সে মুখ কালো করে বলছে, ছি! এদের তো এই সুযোগ পাওয়ার কথা ছিল না!
0 comments: