3

সম্পাদকীয়

Posted in





সম্পাদকীয়


এই সম্পাদকীয় যখন লিখছি, বাইরে তখন তুমুল ঝঞ্ঝা-বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হওয়া সাইক্লোন - উম্পান ১৩০ কিমি/ঘন্টা বেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শহরের উপরে। উন্মত্তা পৃথ্বী যেন প্রবল অসন্তোষে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছেন অবিশ্রান্ত। অতিমারীর দাপট কোথাও কমেছে, এমন নিশ্চিত খবর এখনও নেই। তারই মধ্যে গত একমাসে ভারত তথা বাংলা সংস্কৃতি জগতে একের পর এক নক্ষত্র পতন।

২৩ শে এপ্রিল ২০২০, ৭৫ বছর বয়সে চলে গেলেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ঊষা গাঙ্গুলী। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘রঙ্গকর্মী’ থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে মহাভোজ, রুদালি, কোর্ট মার্শাল ইত্যাদি নাটক বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একটা যুগের অবসান, নিঃসন্দেহে।

আশ্চর্য সমাপতন! এর ঠিক ক'দিন পরেই, ২৯শে এপ্রিল ২০২০,  ৫৩ বছর বয়সে চলে গেলেন ভারতীয় তথা বিশ্ব সিনেমা জগতের অন্যতম বলিষ্ঠ আর এক অভিনেতা, ইরফান খান। আমাদের আরও অনেক অভিনয় পাওয়ার ছিলো খানসাহেবের কাছ থেকে। অনেক বড়ো বড়ো ভারতীয় অভিনেতা যেখানে পিছিয়ে পড়েছেন, ইরফান খান সেই ভাষার বাধা অতিক্রম করে বিশ্বের দরবারে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। চুটিয়ে অভিনয় করেছেন বলিউড, হলিউড, তেলেগু, ব্রিটিশ ফিল্মে। জাতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, ৪ বার ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার,
২০১১ সালে পদ্মশ্রী পেয়েছেন ইরফান।

পরের দিন, অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল ২০২০, চলে গেলেন ঋষি কাপুর - বয়স হয়েছিলো ৬৮ বছর। জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা ১৯৭০ [মেরা নাম জোকার], জাতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ১৯৭৪ [ববি]। তিনিই সম্ভবত ছিলেন দি মোস্ট ন্যাচারাল অ্যাকটর অফ কাপুর ফ্যামিলি। ইন্দ্রপতন অবশ্যই। 

ওই দিনই ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন চুনী গোস্বামী। একই সঙ্গে
জাতীয় ফুটবল দলে ও রঞ্জি ট্রফি ক্রিকেটে বাঙলার অধিনায়কত্ব করেছেন। এমন প্রতিভা শতাব্দীতেও আসবে বলে মনে হয় না।

এই চলমান মৃত্যু মিছিলে ১৪ই মে যোগ দিলেন বাংলা সাহিত্য জগতের আরও দুই মহারথী। ১৯৯০ সাহিত্য অকাদেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত [তিস্তাপারের বৃত্তান্ত] ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক দেবেশ রায় এবং ভারতে আনন্দ পুরষ্কার[১৯৯৩,২০১৭], রবীন্দ্রভারতী ডিলিট[২০০৫], কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় – জগত্তারিনী পদক[২০১৮], বাঙলাদেশে - বাঙলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার[১৯৭০], একুশে পদক[১৯৮৫], স্বাধীনতা পুরষ্কার[২০১৫], জাতীয় অধ্যাপক[২০১৮] সম্মানে অভিহিত মহা নক্ষত্র আনিসুজ্জমান।

মৃত্যু মিছিল, তবুও জীবনও তো প্রবাহমান। ঝড়ের দাপটে ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছে ক্রমাগত। যদিও একথা মানতেই হবে, অতিমারীর কারণে লকডাউন না হলে এই সাইক্লোনে অবশ্যম্ভাবীভাবে আরও অনেক প্রাণ যেতো। যে নেয়, সে কিছু দিয়েও যায়! কোরোনা নিচ্ছে যেমন অনেক, ক'টা প্রাণ বাঁচিয়েও গেলো হয়তো। 

জীবন আছে, তাই মৃত্যুও আছে। নাট্যমঞ্চ তো খালি থাকতে পারে না! আর তাই অভিনয় চলতেই থাকে, আর এই সঙ্গে জীবনও...

সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

3 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনাথ সিংহ

Posted in



কোনখানে রাখবো প্রণাম

বীরভূমের যে গ্রামে এই অধমের বাড়ি সেই গ্রামের এক রেঢ়ো বামুনকে তামাম বাংলা চেনে। সরস্বতীর খাস তালুকের মণ্ডল প্রজা সেই বামুনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন 'গ্রামকে গড়ে তোলো, নইলে ভারতবর্ষ বাঁচবে না'। অনেকদিন পরে 1971 সালে সেই বামুন, - কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর, বিশ্বভারতীতে নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি বক্তৃতামালার তৃতীয়বর্ষের আমন্ত্রিত বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী'। বক্তৃতা মালায় তারাশঙ্কর চারটে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। চারটেই পড়েছি আর পড়তে গিয়ে দেখেছি তারাশঙ্কর কবি রবীন্দ্রনাথ এবং কর্মী রবীন্দ্রনাথের কথা বললেও মূলত তিনি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনা নিয়েই আলোচনা করেছেন, কর্মী রবীন্দ্রনাথ সেখানে প্রায় অনুপস্থিত বললে অত্যুক্তি হয় না। কর্মী রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও অনেকে অনেক আলোচনাই করেছেন, কিন্তু বিশেষ কিছু পড়া আর হয়ে উঠল কই! তাই সরাসরি রবীন্দ্রনাথের লেখা আর তার কর্মোদ্যোগের মাঝে যে পল্লী-সংগঠক রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি সেই রবিঠাকুরকে প্রণাম জানানোই এই লেখার উদ্দেশ্য।
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়

ভারতবর্ষ কবিকে দেখেছে ঋষি হিসেবে, মনীষী হিসেবে – ‘দুর্গৎ পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি’। ভারতের রত্নময় কবিকুলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন 'কোহ-ই-নূর'।

তরবোহপি জীবন্তি, জীবন্তি মৃগপক্ষিঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবন্তি।।

অর্থাৎ ‘গাছপালাও বেঁচে থাকে, পশুপাখিও বেঁচে থাকে, কিন্তু সত্যি বাঁচা সেই বাঁচে যার মন মননের দ্বারা জীবন্ত’। বস্তুতঃ মানুষের যথার্থ জীবন হচ্ছে মনস্বিতারই জীবন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন,- ‘মানুষ শুধু জীব নহে, মানুষ সামাজিক জীব। সুতরাং জীবনধারণ করা এবং সমাজের যোগ্য হওয়া, এই উভয়ের জন্যই মানুষকে প্রস্তুত হইতে হয়’। তিনি বলতেন মানুষ মনোবান, এ কথাটি মনে রাখা চাই। ‘শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি’ কে তিনি ‘শরমের ডালি’ বলে ধিক্কার দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বড় সহৃদয় মানুষ, একাধারে একজন যুগপ্রবর্তক চিন্তানায়ক, ঈশ্বরবিশ্বাসী ভক্ত (অন্তত জীবনের উপান্তে উপনীত হবার আগে অবধি), জ্ঞানতপস্বী শিক্ষাব্রতী এবং কঠোর কর্মযোগী। তিনি নিখিল বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের আনন্দময় উপস্থিতি অনুভব করতেন, তাই সমাজ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় মুক্তিই ছিল তার কাম্য।

তাঁর মনের কথা ছিল ~ “আমরা যেমনই মনে করি, আমাদের ভাই, আমাদের প্রিয়, আমাদের পুত্র, আমাদিগকে একটি জায়গায় বাঁধিয়া রাখে নাই; যে জিনিসটাকে সন্ধান করিতেছি, দীপালোক কেবলমাত্র সেই জিনিসটাকে প্রকাশ করে তাহা নহে, সমস্ত ঘরকে আলোকিত করে — প্রেম প্রেমের বিষয়কে অতিক্রম করিয়াও ব্যাপ্ত হয়"। রবীন্দ্রনাথ বলতেন "জগতের মধ্যে আমি মুগ্ধ, সেই মোহেই আমার মুক্তিরসের আস্বাদন-

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।"

সেই কোন ছোটবেলায় তিনি যে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ' লিখেছিলেন তার মর্মকথা ছিল – “এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া, এই সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছে তাহা হইতে লাফ দিয়া পড়িয়া সাঁতারের জোরে সমুদ্র পার হইবার চেষ্টা সফল হইবার নহে”

তাঁর চোখে ভারতবর্ষ ছিল 'গ্রামে-গাঁথা দুঃখী দেশ'। দেশের উন্নয়ন এবং গ্রাম পুনরুজ্জীবন ছিল তা&র চোখে সমার্থবোধক। আর তাই গ্রাম সংগঠনের মতো দুরূহ কাজের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহন করেছিলেন। ভারতে গ্রামন্নয়নে তিনিই পথিকৃৎ।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের অনুভব

বাল্যে-কৈশোরে দূর থেকে পল্লী প্রকৃতির শোভা দেখে কাব্যরচনার সুযোগ তার হয়েছে। কিন্তু গ্রামের লোকের দুঃখদৈন্য এবং বিবিধ সমস্যার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছ অনেক পরে, পিতৃনির্দেশে জমিদারী পরিচালনার কাজে গিয়ে, উনত্রিশ বছর বয়সে।

“আমি শহরের মানুষ, শহরে আমার জন্ম। আমার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার আদিম বাসিন্দা। পল্লীগ্রামের কোনো স্পর্শ আমি প্রথম-বয়সে পাইনি। এইজন্য যখন প্রথম আমাকে জামিদারির কাজে নিযুক্ত হতে হল তখন মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল, হয়তো আমি এ কাজ পারব না, হয়তো আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে। জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা-আদায়, জমা-ওয়াশীল— এতে কোনোকালেই অভ্যস্ত ছিলুম না; তাই অজ্ঞতার বিভীষিকা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। সেই অঙ্ক ও সংখ্যার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েও প্রকৃতিস্থ থাকতে পারব এ কথা তখন ভাবতে পারি নি"

ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ছিল অবিভক্ত বাঙলার নদীয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলায় বিস্তৃত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়েব-গোমস্তা-পাইক-বরকন্দাজদের পেরিয়ে প্রজাবর্গের অভাব অভিযোগের ক্ষুদ্রাংশই তাঁর গোচর হতো। নগরবাসী তরুণ কবির পক্ষে সেসব অভাব অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় করাই ছিল কঠিন। আমলাদের অত্যাচার এবং অন্যায় আদায় থেকে দরিদ্র গ্রামবাসীকে রক্ষা ছিল যেমন দুঃসাধ্য ব্যপার, তেমনি, যারা নিজেদের ভাল বোঝে না, উপকার করতে গেলে নিঃস্বার্থ শুভার্থীকে মন্দ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সন্দেহ করে, স্বজাতি বিদ্বেষে অন্ধ ‘নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ করতে যারা পুরুষাণুক্রমে অভ্যস্ত, তাদের মঙ্গল সাধনও ছিল কঠিন। এসম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল না।

“আমার জমিদারিতে নদী বহুদূরে ছিল, জলকষ্টের অন্ত ছিল না। আমি প্রজাদের বললুম, ‘তোরা কুয়ো খুঁড়ে দে, আমি বাঁধিয়ে দেব'। তারা বললে, ‘এ যে মাছের তেলে মাছ ভাজবার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা কুয়ো খুঁড়ে দিলে, আপনি স্বর্গে গিয়ে জলদানের পুণ্যফল আদায় করবেন আমাদের পরিশ্রমে! আমি বললুম, ‘তবে আমি কিছুই দেব না'। এদের মনের ভাব এই যে, ‘স্বর্গে এর জমাখরচের হিসাব রাখা হচ্ছে— ইনি পাবেন অনন্ত পুণ্য, ব্রহ্মলোক বা বিষ্ণুলোকে চলে যাবেন, আর আমরা সামান্য জল মাত্র পাব!'

আর-একটি দৃষ্টান্ত দিই। আমাদের কাছারি থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত উঁচু করে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলুম, রাস্তার পাশে যে-সব গ্রাম তার লোকদের বললুম, ‘রাস্তা রক্ষা করবার দায়িত্ব তোমাদের।' তারা যেখানে রাস্তা পার হয় সেখানে গোরুর গাড়ির চাকায় রাস্তা ভেঙে যায়, বর্ষাকালে দুর্গম হয়। আমি বললুম, ‘রাস্তায় যে খাদ হয় তার জন্যে তোমরাই দায়ী, তোমরা সকলে মিলে সহজেই ওখানটা ঠিক করে দিতে পারো। 'তারা জবাব দিলে, ‘বাঃ, আমরা রাস্তা করে দেব আর কুষ্টিয়া থেকে বাবুদের যাতায়াতের সুবিধা হবে!' অপরের কিছু সুবিধা হয় এ তাদের সহ্য হয় না। তার চেয়ে তারা নিজেরা কষ্টভোগ করে সেও ভালো। এদের ভালো করা বড়ো কঠিন।"

অসীম ধৈর্য এবং আন্তরিক মমতা নিয়ে তিনি ঐসব গ্রামের লোকের হৃদয় জয় করলেন। আমলাদের দাপট কমালেন, প্রতাপশালী দোষীকে শাস্তি দিয়ে, গুণী-দরিদ্রকে মান্য দিয়ে, অন্যায় আবদার বন্ধ করে। প্রত্যক্ষদর্শী প্রমথ চৌধুরী মশাই লিখে গেছেন, তিনি একবার আড়াই লক্ষ টাকার ‘ওজরী খাজনা’মুকুব করে দেন প্রজাদের দুরবস্থা বিবেচনা করে। এই রবীন্দ্রনাথকেই আমরা বভিন্ন নাটকে দেখতে পাই কখনও বা ধনঞ্জয় বৈরাগী রূপে, কখনও বা ঠাকুরদা। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের একটি অংশের উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে।

‘উদয়াদিত্য। আমার উপর মাধবপুর পরগনা শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। জান তো, দু বৎসর থেকে সেখানে কীরকম অজন্মা হয়েছে— আমি তাই খাজনা আদায় বন্ধ করেছিলুম। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন যেমন করে হোক টাকা চাই। --------

আমি মহারাজকে বললুম মাধবপুর থেকে টাকা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন’

আশ্চর্য্য হই না যখন দেখি ওই একই নাটকে অন্যত্র পাই

‘প্রতাপাদিত্য। দেখো বৈরাগী, তুমি অমন পাগলামি করে আমাকে ভোলাতে পারবে না। এখন কাজের কথা হোক। মাধবপুরের প্রায় দু-বছরের খাজনা বাকি— দেবে কি না বলো।

ধনঞ্জয়। না মহারাজ দেব না।

প্রতাপাদিত্য। দেবে না? এত বড়ো আস্পর্ধা!

ধনঞ্জয়। যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।

প্রতাপাদিত্য। আমার নয়!

ধনঞ্জয়। আমাদের উদবৃত্ত অন্ন তোমার, আমাদের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়। যিনি আমাদের প্রাণ দিয়েছেন এ অন্ন যে তাঁর, এ আমি তোমাকে দিই কী বলে?’

রবীন্দ্রনাথ সমবায় ব্যাঙ্ক খুলে তার মারফত অল্প সুদে কৃষকদের ঋণ দিয়ে তিনি মহাজনদের চড়া সুদের ঋণ-জাল থেকে তাদের রক্ষা করেন। ক্রমে তিনি প্রজাদের পিতৃতুল্য শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র হয়ে দাঁড়ান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন “আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার, হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।" শিক্ষার অভাবে অনাহারে মৃত্যুই হোক বা অবস্থার গতিকে হীন হয়ে থাকা, কোনো কিছুর জন্যই তিনি ভাগ্যদোষের দোহাই দেবার বিরোধী ছিলেন। তিনি স্পষ্ট বলতেন অনেক স্থলেই এটা নিজের অপরাধ। দুর্দশার হাত হইতে উদ্ধারের কোনো পথই নাই, এমন কথা মনে করাই মানুষের ধর্ম নয়। মানুষের ধর্ম জয় করিবার ধর্ম, হার মানিবার ধর্ম নয়। মানুষ যেখানে আপনার সেই ধর্ম ভুলিয়াছে সেইখানেই সে আপনার দুর্দশাকে চিরদিনের সামগ্রী করিয়া রাখিয়াছে। মানুষ দুঃখ পায় দুঃখকে মানিয়া লইবার জন্য নয়, কিন্তু নূতন শক্তিতে নূতন নূতন রাস্তা বাহির করিবার জন্য। এমনি করিয়াই মানুষের এত উন্নতি হইয়াছে। যদি কোনো দেশে এমন দেখা যায় যে সেখানে দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ অচল হইয়া পড়িয়া দৈবের পথ তাকাইয়া আছে তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, মানুষ সে দেশে মানুষের হিসাবে খাটো হইয়া গেছে”।

রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতেন ~

“আমাদের দুঃখের লক্ষণগুলিকে বাহির হইতে দূর করা যাইবে না, দুঃখের কারণগুলিকে ভিতর হইতে দূর করিতে হইবে। তাহা যদি করিতে চাই তবে দুটি কাজ আছে। এক, দেশের সর্বসাধারণকে শিক্ষা দিয়া পৃথিবীর সকল মানুষের মনের সঙ্গে তাহাদের মনের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া। ... আর জীবিকার ক্ষেত্রে তাহাদিগকে পরস্পর মিলাইয়া পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে তাহাদের কাজের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া। ... অর্থাৎ শিকড়ের দ্বারা যাহাতে মাটির দিকে তাহারা প্রশস্ত অধিকার পায় এবং ডালপালার দ্বারা বাতাস ও আলোকের দিকে তাহারা পরিপূর্ণরূপে ব্যাপ্ত হইতে পারে, তাহাই করা চাই। তাহার পরে ফলফুল আপনিই ফলিতে থাকিবে, কাহাকেও সেজন্য ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতে হইবে না।”

আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও উত্তর ও পুর্ববঙ্গের পৈতৃক জমিদারীর গ্রামগুলিতে রবীন্দ্রনাথের গ্রাম সংগঠনের কাজ প্রথম আরম্ভ হয়েছিল। তাঁর কথাতেই এর স্বীকৃতি পাই ~ "আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে-- মনের আনন্দে কৌতূহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল"। আর তাঁর মনে জন্ম নিল এই দুঃখদৈন্য দূর করার আকাঙক্ষা। তারপর থেকে তিনি চেষ্টা করতেন - "কী করলে এদের মনের উদ্‌বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে"। কিন্তু একটা ব্যপারে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি মনে করতেন - "আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে।" আর তাই কী করলে এদের মধ্যে জীবনসঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই তখন তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করাছিলেন "এদের উপকার করা শক্ত, কারণ এরা নিজেকে বড়ো অশ্রদ্ধা করে"।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ হৃষ্টচিত্তে স্মরণ করেছেন যে 'পল্লীজীবনের আবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে'' তাঁর জীবনের 'জীবনের আনন্দ উৎসাহ সাহিত্য' গড়ে ওঠার কথা। ''নগরের বাইরে পল্লীগ্রামের সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে' কাটানো দিনেই তিনি 'আমাদের দেশের সত্যিকার রূপ কোথায় তা অনুভব করতে' পেরেছেন। আর উপলব্ধি করেছেন যে গ্রামের লোকরা 'কতবড়ো অভাগা'। 'তখন পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনের যে পরিচয়' তিনি পেয়েছিলেন তাতে অনুভব করেছিলেন যে, 'আমাদের জীবনের ভিত্তি রয়েছে পল্লীতে'। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন "আমাদের দেশের মা, দেশের ধাত্রী, পল্লীজননীর স্তন্যরস শুকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকদের খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য নেই, তারা শুধু একান্ত অসহায়ভাবে করুণ নয়নে চেয়ে থাকে।" 'তাদের সেই বেদনা, সেই অসহায় ভাব' রবীন্দ্রনাথের 'অন্তরকে একান্তভাবে স্পর্শ করেছিল'।

মনে হয় সেই সময়েই তাঁর মনে হয় সমাজের রাষ্ট্র নির্ভরতা কমানোর কথা। তিনি লিখেছেন "তখন কেবলই মনে হত জনকতক ইংরাজি-জানা লোক ভারতবর্ষের উপর— যেখানে এত দুঃখ, এত দৈন্য, এত হাহাকার ও শিক্ষার অভাব সেখানে কেমন করে রাষ্ট্রীয় সৌধ নির্মাণ করবে। পল্লীজীবনকে উপেক্ষা করে এ কী করে সম্ভব হয় তা ভেবেই উঠতে পারি নি।...আমার জীবনের মধ্যে পল্লীগ্রামের দুঃখ-দুর্দশার যে চিত্রটি গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল, আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল, বিচলিত করেছিল, আমার সেই হৃদয়ের কাজ সেখান হতেই শুরু করবার একটা উপলক্ষ পেয়েছিলাম"। 

তাঁর চিত্রা, চৈতালি এবং বিসর্জন ওই সময়কার রচনা। কিন্তু গরীব প্রজার শ্রমের অন্নে ভাগ বসিয়ে অলস জীবন যাপনে তাঁর ধিক্কার এসেছিল, তাদের আর্থিক ও সামাজিক দূর্গতি মোচনের জন্য কী করা যায় এই ছিল তাঁর দুশ্চিন্তা। তাঁর ঐ সময়কার লেখাতে আমরা পাই ~

এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা — এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা —
-------
বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা — সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্যমাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি”।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়ন প্রয়াস

গ্রামসংগঠনের আর্থিক সঙ্গতি রবীন্দ্রনাথের ছিল না। ওরই মধ্যে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি আশ্রম বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে, তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে, আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন আধুনিক উন্নত প্রথায় 'কৃষিবিদ্যা আর গোষ্ঠবিদ্যা শিখে আসতে'। উদ্দেশ্য 'পল্লীর কাজ করতে হবে'। গ্রামসংগঠনের কাজ কোথা থেকে আরম্ভ হবে তা একরকম ঠিক ছিল কেবল অভাব ছিল কর্মীর এবং প্রাথমিক খরচ চালাবার টাকার।

পল্লী উন্নয়নে তাঁর প্রথম উদ্যোগ ছিল একক; 1899 সালে তিনি শিলাইদহে উন্নত কৃষিকাজ প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জমিদারের কুঠিবাড়ির আশপাশে কৃষিজমিতে তিনি নতুন ধরনের ধান, আমেরিকান ভুট্টা, নৈনিতালের আলু, পাটনার মটর, ভিন্ন ধরনের আখ এবং কপির চাষ করেছিলেন। এ বিষয়ে নিজেই নিজের ব্যররথতাকে পরিহাস করে লিখেছেন - "শিলাইদহে কুঠিবাড়ির চার দিকে যে জমি ছিল প্রজাদের মধ্যে নতুন ফসল প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে নানা পরীক্ষায় লেগেছিলেম। এই পরীক্ষাব্যাপারে সরকারি কৃষিবিভাগের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা অত্যধিক পরিমাণেই মিলেছিল। তাঁদের আদিষ্ট উপাদানের তালিকা দেখে চিচেস্‌টরে যারা এগ্রিকালচারাল্‌ কলেজে পাস করে নি এমন-সব চাষিরা হেসেছিল; তাদেরই হাসিটা টিঁকেছিল শেষ পর্যন্ত।" তার এই 'বহুব্যয়সাধ্য ব্যর্থতার প্রহসন' নিয়ে বন্ধু জগদীশচন্দ্র উপহাস করতেন। কিন্তু তাঁর নিজের মনে হয়েছিল 'শিক্ষার অঙ্গরূপে এই ব্যর্থতাও ব্যর্থ নয়'।

আজ বাংলাদেশে মহম্মদ ইউনুসের হাত ধরে যে মাইক্রোফাইনান্সিং বিশ্বের দরবারে সমাদর লাভ করেছে তার বীজ কিন্তু রবীন্দ্রনাথই বপন করেছিলেন। পাতিসরে তিনি স্থাপন করেছিলেন কৃষিব্যাঙ্ক। উদ্দেশ্য ছিল চাষিরা যাতে সহজে ঋণ পায়। 

আমেরিকা থেকে ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিতে একটি কৃষি গবেষণাগার খুলেছিলেন, ভালো বীজ ও সার দিয়ে চাষীদের কিছু আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছিলেন। কুঠিবাড়ি সংলগ্ন প্রায় আশি বিঘা জমিতে তিনি কৃষি খামারও গড়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখযোগ্য অভিমুখ পরিবর্তন ঘটে। এই পর্বে তাঁর মূলমন্ত্র ছিল "দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতকগুলি পল্লী লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক্‌ স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে, সেখানে কর্মে ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেইখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা গ্রামের বিবাদ ও মামলা মিটাইয়া দিবে।" 

তাঁর উদ্যোগ এবার সমাজের লোকেদের সামিল করে। আর এই উদ্যোগে তাঁর পাশে সহযোগী হিসেবে এলেন শচীন্দ্রনাথ অধিকারী, কালীমোহন ঘোষ এবং আরো কয়েকজন। এই পর্বে তাঁর লক্ষ্য ছিল গ্রামকে স্বনির্ভর করে তোলা এবং সমাজ জীবনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই পর্বেই আমরা দেখি যান্ত্রিক চাষের প্রয়াস; পাতিসরে 'কলের লাঙল' দিয়ে শক্ত এঁটেল মাটি চষার ব্যবস্থা করা হয়।সামাজিক সংহতি বিধানের লক্ষ্যে গ্রামগুলিতে মণ্ডলীতে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি মণ্ডলীতে একজন অধ্যক্ষ নয়োগ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের জমিদারী অন্তর্ভুক্ত বিরাহিমপুর পরগনাকে পাঁচটি এবং কালিগ্রাম পরগনাকে তিনিটি মণ্ডলীতে ভাগ করা হয়। এই পর্বে যে সমস্ত কাজ হাতে নেওয়া হয় সেগুলিকে মোটামুটি এভাবে ভাগ করা যেতে পারে - 1) চাষীদের জন্য স্বল্পসুদে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা; 2) কৃষিকে আধুনিক অবস্থায় উন্নীত করা; 3) সর্বজনীন সুযোগ সুবিধা, যেমন রাস্তা, কুয়ো, ইত্যাদির বিস্তার এবং রক্ষণাবেক্ষণ; 4) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; 5) স্বাস্থ্যবিধি ও সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন; এবং 6) সালিশি বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন।
শান্তিনিকেতন – শ্রীনিকেতন - বিশ্বভারতী

তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ধরা পরেছিল, বহুযুগের অনভ্যাসে দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে ভুলে গেছে বলেই তাদের এই দুর্গতি। দেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত, তাই প্রথমেই চাই সুশিক্ষার ব্যবস্থা; শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, যে শিক্ষায় মন মুক্তি পায় সেই শিক্ষা দিতে হবে তাদের। কিন্তু তার জন্য চাই অন্যত্র আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা, যেখানে গুরু শিষ্য নিভৃতে তপস্যা করবেন সমবেত ভাবে। তাঁর গ্রাম সংগঠনের কাজে শহরের সভায় বক্তৃতা দিয়ে প্রবন্ধ লিখে দেশের যুবকদের গ্রামসেবার জন্য আবেদন জানিয়ে যখন ফল হল না, তখন নিজেই অতীতের তপোবনের আদর্শে ভারতের পুনরুজ্জীবনের জন্য মানুষ গড়ার কাজে নামলেন। এ সম্বন্ধে তাঁর মনে হয়েছিল "ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে-একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না। এই শিক্ষার জন্যে আশ্রমের দরকার, যেখানে আছে সমগ্রজীবনের সজীব ভূমিকা”।

শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত হল ব্রহহ্মচর্যাশ্রম (১৯০১ খ্রীঃ)। রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কয়েকজন আদর্শ অধ্যাপকও এলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তখন পর্যন্ত কাজে না লাগলেও জমিদারীর অভিজ্ঞতার মত এই আশ্রম বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাও রবীন্দ্রনাথের গ্রামসংগঠনের কাজে লেগেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বভারতী (১৯১৮ খ্রীঃ)। বিশ্বভারতীর মুখ্য উদ্দেশ্যগুলির একটি ছিল শিক্ষাকে দৈনন্দিন সমাজের সাথে যুক্ত করা। 

"ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র, তাহার কৃষিতত্ত্ব, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠাস্থানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থান অধিকার করিবে। এই বিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গো-পালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল-লাভের জন্য সমবায়প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হইবে”।

১৯২১ খ্রীঃ রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকায় বক্তৃতা দিতে যান তখন তাঁর সঙ্গে গ্রামোন্নয়নে উৎসাহী ইংরেজ যুবক লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট-এর পরিচয় হয়। ডরোথি স্ট্রেট নামে এক আমেরিকান মহিলা এল’মহার্স্টকে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে তিনি সুরুল-এ এসে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করেন।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “এই কাজে আমার বন্ধু এল্‌ম্‌হার্‌স্ট্‌ আমাকে খুব সাহায্য করেছেন। তিনিই এই জায়গাকে একটি স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র করে তুললেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে একে জড়িয়ে দিলে ঠিক হত না। এল্‌ম্‌হার্‌স্টের হাতে এর কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল”। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন "গ্রামের কাজের দুটো দিক আছে। কাজ এখান থেকে করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও করতে হবে। এদের সেবা করতে হলে শিক্ষালাভ করা চাই"। ... "সমগ্র দেশ নিয়ে চিন্তা করবার দরকার নেই। আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোটো গ্রাম। এদের মনকে পেতে হবে, এদের সঙ্গে একত্র কাজ করবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সেটা সহজ নয়, খুব কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন। আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোটো আদর্শ তৈরি হবে।" "তোমরা কেবল কখানা গ্রামকে এইভাবে তৈরি করে দাও। আমি বলব এই কখানা গ্রামই আমার ভারতবর্ষ। তা হলেই প্রকৃতভাবে ভারতকে পাওয়া যাবে।"

বিশ্বভারতী সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সময় যার নাম ছিল ‘সুরুল কৃষি সমিতি’ ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শ্রীনিকেতন গ্রামোন্নয়ন সমিতি’। শ্রীনিকেতন নামটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছিল তা শুধু কৃষির উন্নতির মত কোন সীমিত অর্থে নয়, পল্লীজীবনের সর্বাঙ্গীন উন্নতি করে গ্রামে গ্রামে লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনবার শুভপ্রয়াস।
গ্রামোন্নয়ন চিন্তা

গ্রামোন্নয়ন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার প্রথম সম্পূর্ণ প্রকাশ তাঁর ‘স্বদেশি সমাজ’ প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি দীর্ঘ এবং তাতে নানা বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছিল। এই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলে ১৯০৪-এ। প্রবন্ধটি রচনার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল প্রদেশব্যপী অনাবৃষ্টি ও জলকষ্ট, কিন্তু এর বিষয়বস্তু ছিল ব্যপক এবং একটি স্বয়ংক্রিয় কার্যসূচীর প্রস্তাবও এতে ছিল। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন জলকষ্ট ও অন্যান্য সমস্যার নিরাকরণে স্বেচ্ছাসেবামূলক স্বাবলম্বী প্রচেষ্টা। প্রবন্ধের সূচনাতেই তিনি লিখেছিলেন "আমাদের চিন্তার বিষয় এই যে, পূর্বে আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, যাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত—দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না”? রবীন্দ্রনাথ বরাবরই চেয়েছের সমাজের রাষ্ট্রনির্ভরতা কমাতে। তাঁর উপলব্ধি ছিল যে এতে সমাজের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে। তিনি লিখেছেন ~ 

"আমাদের দেশে যুদ্ধবিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য রাজা করিয়াছেন, কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বন্যার মতো বহিয়া গেল, তবু আমাদের ধর্ম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে পশুর মতো করিতে পারে নাই, সমাজ নষ্ট করিয়া আমাদিগকে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া করিয়া দেয় নাই। ... সমাজ বাহিরের সাহায্যের অপেক্ষা রাখে নাই এবং বাহিরের উপদ্রবে শ্রীভ্রষ্ট হয় নাই। ... নিশ্বাস লইতে যেমন আমাদের কাহাকেও হাতে-পায়ে ধরিতে হয় না, রক্তচলাচলের জন্য যেমন টৌনহল-মিটিং অনাবশ্যক — সমাজের সমস্ত অত্যাবশ্যক হিতকর ব্যাপার সমাজে তেমনি অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে ঘটিয়া আসিয়াছে। আজ আমাদের দেশে জল নাই বলিয়া যে আমরা আক্ষেপ করিতেছি, সেটা সামান্য কথা। সকলের চেয়ে গুরুতর শোকের বিষয় হইয়াছে, তাহার মূল কারণটা। আজ সমাজের মনটা সমাজের মধ্যে নাই। আমাদের সমস্ত মনোযোগ বাহিরের দিকে গিয়াছে।”

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমৃত্য এক আশাবাদ কাজ করে গেছে। 'স্বদেশী সমজ'-এ তিনি লিখছেন ~ “আমি স্বদেশকে বিশ্বাস করি, আমি আত্মশক্তিকে সম্মান করি। আমি নিশ্চয় জানি যে, যে উপায়েই হউক, আমরা নিজের মধ্যে একটা স্বদেশীয় স্বজাতীয় ঐক্য উপলব্ধি করিয়া আজ যে সার্থকতালাভের জন্য উৎসুক হইয়াছি, তাহার ভিত্তি যদি পরের পরিবর্তনশীল প্রসন্নতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি তাহা বিশেষভাবে ভারতবর্ষের স্বকীয় না হয়, তবে তাহা পুনঃপুনই ব্যর্থ হইতে থাকিবে”। 

তিনি চেয়েছিলেন সমাজপতিরা মিলিত হয়ে “কোনো প্রকার নিষ্ফল পলিটিকসের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচরভূমি’ প্রভৃতি সম্বন্ধে কর্মসূচী গ্রহণ করবেন।” অন্যত্র তিনি একথার প্রতিধ্বনি করেছেন ~ “আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের যেখানে হোক একটি গ্রাম আমরা হাতে নিয়ে তাকে আত্মশাসনের শক্তিতে সম্পূর্ণ উদ্‌বোধিত করে তুলি। সে গ্রামের রাস্তাঘাট, তার ঘরবাড়ির পারিপাট্য, তার পাঠশালা, তার সাহিত্যচর্চা ও আমোদ-প্রমোদ, তার রোগীপরিচর্যা ও চিকিৎসা, তার বিবাদনিষ্পত্তি প্রভৃতি সমস্ত কার্যভার সুবিহিত নিয়মে গ্রামবাসীদের দ্বারা সাধন করবার উদ্যোগ আমরা করি”


প্রেক্ষিত ও প্রয়োগ এর সীমাবদ্ধতা

গ্রামীণ কুটির শিল্প সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ প্রায় একই রকম মত প্রকাশ করতেন, কিন্তু বৃহত শিল্প বা আধুনিক যন্ত্রশিল্পের একেবারেই কোনো প্রয়োজন নেই এ-কথা রবীন্দ্রনাথ মানতেন না। যান্ত্রিক সভ্যতা রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত ছিল না, কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন ছাড়া কোনো দেশই সমৃদ্ধ হতে পারে না।

"চাকা অসংখ্য শূদ্রকে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই চাকাই চরকায়, কুমোরের চাকে, গাড়ির তলায়, স্থূল সূক্ষ্ম নানা আকারে মানুষের প্রভূত ভার লাঘব করেছে। এই ভারলাঘবতার মতো ঐশ্বর্যের উপাদান আর নেই, এ কথা মানুষ বহুযুগ পূর্বে প্রথম বুঝতে পারলে যেদিন প্রথম চাকা ঘুরল। ইতিহাসের সেই প্রথম অধ্যায়ে যখন চরকা ঘুরে মানুষের ধন উৎপাদনের কাজে লাগল ধন তখন থেকে চক্রবর্তী হয়ে চলতে লাগল, সেদিনকার চরকাতেই এসে থেমে রইল না। এই তথ্যটির মধ্যে কি কোনো তত্ত্ব নেই। ... বিজ্ঞান মর্তলোকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে এ কথা যদি ভুলি, তা হলে পৃথিবীতে অন্য যে-সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হব।

"বড়ো কলের দ্বারাও মানুষকে ছোটো করা যায়, ছোটো কলের দ্বারাও করা যায়। এঞ্জিনের দ্বারাও করা যায়, চরকার দ্বারাও। চরকা যেখানে স্বাভাবিক সেখানে সে কোনো উপদ্রব করে না, বরঞ্চ উপকার করে– মানবমনের বৈচিত্র্যবশতই চরকা যেখানে স্বাভাবিক নয় সেখানে চরকায় সুতা কাটার চেয়ে মন কাটা যায় অনেকখানি। মন জিনিসটা সুতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।"

রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব খুব সীমিত ক্ষেত্রের বাইরে কার্যকর হয় নি। পতিসর-এ তাঁর নিজের জমিদারীতে স্বদেশী সমাজ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন এবং পরে শ্রীনিকেতন থেকে বোলপুর অঞ্চলে কিছুটা কাজ হয়। কিন্তু সারা দেশে ব্যপকভাবে শিক্ষিত সমাজের নেতৃত্বে কোনো কর্মধারা গৃহীত হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রস্তাব দিয়েছিলেন 1904-এ আর জমিদারি প্রথার বিলোপ হয় 1955য়। মাঝের পঞ্চাশ বছরে গ্রামের নেতৃত্ব যারা নিতে পারতেন তাঁরা শহরে চলে এসেছিলেন। গ্রাম থেকে উদবৃত্ত অর্থ শহরে এসে ব্যয়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনাতে জমিদারদের নেতৃত্বের আশা ছিল কিন্তু জমিদারি প্রথা সম্বন্ধে তখনো তিনি কিছু বলেন নি।

ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ মূলত সারস্বত সাধক, - চিন্তা, চেতনা, নীতি, নৈতিকতা, রুচি, সংস্কৃতির বাগদানই সে সাধনার লক্ষ্য। কিন্তু চিন্তায় মননে রবীন্দ্রনাথ তো মনুষয়ত্বের পরপূর্ণতারও সাধক। তাই কর্মে প্রবৃত্ত না হয়ে তার নিস্তার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের চিন্তার প্রতি পরতে মিশে ছিল দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা। আর সেই দেশের অধিকাংশ মানুষইতো গ্রামবাসী এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষিনির্ভর। তাই পাতিসরে, শিলাইদহে, শ্রীনিকেতনে তাঁর প্রশিক্ষণের অভিমুখ ছিল কৃষি ও গবাদি পশুপালন। গ্রামীন শিল্প যার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শ্রীনিকেতন ছাড়া শান্তিনিকেতন অপরিপূর্ণ অবাস্তব। আর তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - 

'বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। ... আজ মানুষকে বলতে হবে, "তোমার এ শক্তি অক্ষয় হোক; কর্মের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে জয়ী হোক।' ... মানুষের শক্তির এই নূতনতম বিকাশকে গ্রামে গ্রামে আনা চাই। এই শক্তিকে সে আবাহন করে আনতে পারে নি বলেই গ্রামে জলাশয়ে আজ জল নেই, ম্যালেরিয়ার প্রকোপে দুঃখশোক পাপতাপ বিনাশমূর্তি ধরছে, কাপুরুষতা পুঞ্জীভূত। চার দিকে যা দেখছি এ তো পরাভবেরই দৃশ্য। ...এ যুগের শক্তিকে যদি গ্রহণ করতে পারি তা হলেই জিতব, তা হলেই বাঁচব।

এইটেই আমাদের শ্রীনিকেতনের বাণী।'

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

Posted in



২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২। কলকাতায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ইন্দ্রপতন। প্রয়াত সত্যজিৎ রায়। তার কিছুদিন আগেই তিনি ভূষিত হয়েছেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কারে। এর পর পরই তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর হাতে তুলে দেয় ‘ভারত রত্ন’; হাতে তুলে দেয় বলা ভুল, কারণ সত্যজিৎ ততদিনে একপ্রকার কোমায়। অতএব, তাঁর অজ্ঞাতেই তাঁকে ভূষিত করা হয়। এত অব্দি এসে যদি ব্যাপারটি থেমে যেত, তাহলে আজ আমার এই প্রবন্ধটি লেখার সুযোগ হতো না, প্রয়োজনও পড়তো না। কিন্তু, ‘ভারত রত্নে’ থেমে না থেকে সরকার বাহাদুর সত্যজিতের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মানিত করলেন ‘ভারতীয় রেনেসাঁর শেষ প্রতিনিধি’ উপাধিতে।

কাট টু ১৫ই মে, ১৯৯২। দিল্লীতে আয়োজিত হয়েছে একটি সেমিনার, সত্যজিতের উপর; সাহিত্য, সঙ্গীত নাটক, এবং ললিত কলা অকাদেমির যুগ্ম পরিচালনায়। এই মুহূর্তে বক্তব্য রাখছেন স্বনামধন্য নাট্যকর্মী এবং চলচ্চিত্রাভিনেতা উৎপল দত্ত। তাঁর বক্তব্যটির শিরোনাম ছোট একটি প্রশ্ন, ‘Ray, Renaissance Man?’ বক্তব্যের শুরুতেই নিজের স্পষ্টভাষে উৎপল বাবু প্রশ্ন রাখছেন, সত্যজিতকে যে ভারতীয় রেনেসাঁর প্রতিনিধি বলা হল, এই ‘ভারতীয়’ রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল ঠিক কবে? বা এই ‘ভারতীয়’ রেনেসাঁ আর কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক দেখা যেতে পারে? হয়তো রাম মন্দির – বাবরি মসজিদ কাজিয়াতে রেনেসাঁ বাস করে? বা রাজস্থানে কোনও বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়াতে? বা নিদেনপক্ষে আমাদের দারিদ্র ও অশিক্ষা তার মুকুট? 

প্রবন্ধের মূল বিষয়ে প্রবেশ করার মুখে এই অবতারণাটুকুর প্রয়োজন ছিল। আমার এই আলোচনা কথা বলবে উৎপল বাবুর উপরোক্ত ওই সন্দর্ভটি নিয়ে। তাঁর ক্ষুরধার উইট এবং শ্লেষ দিয়ে উৎপল দত্ত একটি সরকারি আলোচনাসভার মধ্যেই আক্রমণ করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে, সত্যজিৎ বিষয়ে। যদিও তাঁর এই ভাষণের মূল প্রেক্ষিত ছিল সত্যজিতের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘শ্রদ্ধাজ্ঞাপন’, সামগ্রিকভাবে বক্তব্যে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে –

১। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও শিল্পমাধ্যম বিষয়ে সরকারি উদাসীনতা

২। ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’ কথাটির অপ্রাসঙ্গিকতা

৩। সত্যজিতের ছবিতে যে বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়, তাদের আদৌ ‘রেনেসাঁ-ফিচার’ বলা যায় কিনা।

বলাই বাহুল্য, উৎপল বাবুর পুরো আলোচনাটিই সত্যজিৎ রায়কে কেন্দ্র করে। আমার প্রবন্ধটি সেই ভাষণের একটি পাঠ বলতে পারেন। উৎপল দত্তের বক্তব্যটি কেবল একটি সেমিনারের পেপার হয়েই থেকে যাবে, এতে আমার বিশেষ আপত্তি। আজকের দিনেও শিল্পচর্চায়, চলচ্চিত্রপাঠে, এবং সর্বোপরি, সত্যজিৎ রায়ের চর্চায় আমরা যারা নিযুক্ত, তাদের কাছে সহজ ভাষায় এই আলোচনাটি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করেছি, তাই লিখছি। 

নিজের জীবনের শেষদিকে একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় দর্শক এবং সাধারণ জনমানসে তাঁর ছবির প্রতি যে মনোভাব, তা নিয়ে হতাশার সুর শোনা গিয়েছিল সত্যজিতের কণ্ঠে। নিজের দেশে সম্মানিত হওয়া থেকে সত্যজিৎ বরাবরই ব্রাত্য ছিলেন। কলকাতা বা বিভিন্ন বড় শহরে তাঁর ছবির মুগ্ধ দর্শক যথেষ্টই ছিলেন বটে, বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি তাঁর ছবির প্রচার এবং তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা দেখিয়েছে বটে, কিন্তু ভারতের মতো বিরাট দেশে তাদের পরিসর আর কতটুকু? বরং, সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সম্মাননা, বা নিদেনপক্ষে তাঁর ছবিগুলিকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার যে উদ্যোগ, তা কিছুই দেখে যেতে পারেন নি সত্যজিৎ। ভারতে এমন ইতিহাস নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেও রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য ছিলেন এই দেশে, এই বাংলায়। তবু বলা যায়, বিদেশে তাঁর নোবেল-প্রাপ্তি এই বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছিল। সত্যজিতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইউরোপীয় পুরস্কারও – কান, ভেনিস, বার্লিনের প্রাপ্তি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রদত্ত ডক্টরেট, ফ্রান্সের লিজিয়ন অফ অনর – কিচ্ছু করতে পারে নি। কারণ ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্করক্ষা বা প্রতিযোগিতায় ভারত সরকারের কোনও বিশেষ লাভক্ষতি নেই। এই সমীকরণ একমাত্র বদলাতে পারে আমেরিকা, এবং হয়ও তাই। অস্কার ঘরে আসার পরেই বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি; বর্ষিত হয় ‘ভারতীয় রেনেসাঁর প্রতিনিধি’ এবং ‘ভারত রত্ন’। উৎপল বাবু কথাতেই বলি, “Men in coma cannot refuse awards”!

সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে ভারত ও আমেরিকার মিল আরও একটি জায়গায় – তাদের দ্বিচারিতায়। চলচ্চিত্রে এবং চলচ্চিত্র-প্রদর্শনে বিখ্যাত দেশগুলির মধ্যে আমেরিকাই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যা সত্যজিতের প্রায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই সে’দেশের দর্শকদের দেখায় নি (অন্তত সে সময় অব্দি) ‘কমার্শিয়াল’ভাবে। বরং তাদের বোঝাপড়া খুব সহজ – ‘আমরা আপনার কদর করি, সম্মাননাও জানাচ্ছি। তবে আপনার কাজের বিশেষ প্রয়োজন নেই এখানে। এবার আসুন।’ রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ উৎপল বাবুর মতো শিল্পী যাকে ‘trash’ বলছেন, আমেরিকার জনসাধারণও খাচ্ছে সেসবই। অস্কার আসছে সেই বিরাট পপুলিস্ট ফিল্মের বাজারের তুলনায় খুবই ছোট একটি সংস্থা থেকে। 

ভারত সরকারও সে’ সময়ে এই ধরণের ‘শ্রদ্ধা’ প্রদর্শনে প্রায় অজাতশত্রু। এদিকে ‘ভারত রত্ন’, ‘নবজাগরণের প্রতিনিধি’; ওদিকে ‘সিকিম’ ছবিটি ব্যানড তখনও। সত্যজিৎ প্রয়াণে সরকারি টিভি চ্যানেলে তাঁরা সত্যজিৎ-নির্মিত ছবি দেখিয়ে যে অঞ্জলির ব্যবস্থা করলেন, তাতেও পদে পদে ডায়ালগ কাটা, সিন উড়িয়ে দেওয়া। ‘তিন কন্যা’ হয়ে গেল ‘Two Daughters’, ‘ঘরে বাইরে’র বহু সংলাপ একধারসে বাদ। এবং আরও মজার, সরকারের পক্ষ থেকে ‘সদ্গতি’র স্ক্রিনিং বন্ধ করতে চাওয়া হয়েছিল, কারণ ছবিতে নাকি বহুবার ‘চামার’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। মনে পড়ে যায় বার্নার্ড শ’য়ের কথা, যিনি বেচারা তাঁর একটি নাটকে ‘bloody’ শব্দটি ব্যবহার করায় নীতিবাগীশ ইংরেজ মঞ্চে নাটকটি প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ছিল ব্যানড ছিল। ‘সদ্গতি’র ‘চামার’ নিয়েও ভারত সরকার প্রেমচন্দ এবং সত্যজিৎ, দুজনেরই উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রায়। কাজেই ব্যক্তিপুজা, অথচ সেই ব্যক্তির কাজের প্রতি ঔদাসীন্য, এমনকি বিরুদ্ধতা – এ’ই বারবার পরিলক্ষিত হয়েছে আমাদের দেশে। এখনও অবস্থা পাল্টেছে কি? 

সত্যজিতের সঙ্গে সরকারের এই সংঘাত খুব নতুন কিছু নয় অবশ্য। ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’র প্রিমিয়ার দেখতে এসে এক সরকারি একজেকিউটিভ সত্যজিতকে তাঁর উদ্বেগ জানিয়েছিলেন, ভারতের এই দারিদ্র বিদেশে দেখালে আপনার আবার শেষটায় সম্মানহানি হবে না তো? সত্যজিতের উত্তর ছিল, যদি দেশের এই দারিদ্র সহ্য করতে আপনার কোনও সম্মানহানি না হয়ে থাকে, তাহলে তা দেখাতে আমার সম্মানহানির কোনও প্রশ্নই নেই। সত্যজিতের সামাজিকভাবে সচেতন ছবিগুলিকে সরকারের পক্ষ থেকে এর পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে, সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। শুধু সত্যজিৎ কেন, প্রায় কোনও সচেতন পরিচালকই সেই সমাদর পান নি যা পেয়েছে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘হিট’ ছবিগুলি, ‘মেনস্ট্রীম’ ছদ্মনাম নিয়ে। যে-কোনো উঠতি পরিচালকের ক্ষেত্রেই সরকার সমান ‘উদারতা’য় বলেছে, তিনি স্বাধীনভাবে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন, কোনও বাধা নেই। কিন্তু এই উদাসীন উদারতাই যে মূল বাধা, প্রযোজনা থেকে শুরু করে প্রচার থেকে হলে এবং টিভি চ্যানেলে জায়গা পাওয়া – সবেই যে সরকার পরাঙ্মুখ হয়ে থাকলে (এবং সেই ঔদাসীন্য ‘মেনস্ট্রীম’কে না দেখালে) প্রতিযোগিতা অসম হয়ে ওঠে, বলার অপেক্ষা রাখে না। 

প্রসঙ্গান্তরে, আমরা চলে আসি আমাদের আলোচনার দ্বিতীয় ধাপে – বস্তুত, যে অবান্তর একটি সম্মানসূচক শব্দবন্ধকে কেন্দ্র করে উৎপল দত্ত তাঁর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন, তাতে – ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’। এটি একটি ‘মিসনোমা’। উৎপল বাবু তা-ই প্রমাণ করছেন, এবং সেই সূত্র ধরে আমরাও যদি একটু খতিয়ে দেখি, এই শব্দবন্ধের প্রাথমিক পরিসরই অত্যন্ত ঘোলাটে। সাহিত্য-শিল্পের সঙ্গে পরিচিত থাকার সুবাদে হয়তো আমাদের অনেকেরই মনে এই ধারণা জন্ম নেয়, যে ‘রেনেসাঁ’ ধারণাটি মূলতঃ এই বৌদ্ধিক পরিসরেই প্রযোজ্য। কিন্তু আদপে তা নয়। সমাজের বৌদ্ধিক বা শৈল্পিক পরিসরটি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক খোলনলচে বদল ও নবজাগরণের একটি প্রকাশ মাত্র। উল্লেখ্য, ‘রেনেসাঁ’র মূলে থাকে একটি বৈপ্লবিক বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্ষমতায় উত্থান, কুক্ষিগত ‘ফিউডাল’ ক্ষমতার অবসান এবং একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি। রামমোহন-ডিরোজিও খ্যাত যে বিখ্যাত বাংলার নবজাগরণ, তাকেই ঐতিহাসিকরা একটা সময়ের পর রেনেসাঁ না বলে রিফর্ম মুভমেন্ট বলা শুরু করেছিলেন, কারণ ইংরেজ সরকার তাদের শাসনকালে বুর্জোয়ার উত্থান ঘটতে দেয় নি মোটেই ( সাধারণের যে উত্থান ইংল্যান্ডে দেখা যায় চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে, সামাজিক তথা রাজনৈতিক পরিসরে, এবং শুধুমাত্র বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে নয়)। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে তাই ‘রেনেসাঁ’ শব্দটি যে আরোই অপ্রযোজ্য, একধরণের ‘idle talk’, অন্ততঃ এই যুক্তিতে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি আমরা। 

তবু, প্রশ্ন থেকেই যায় – বাংলার ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি সত্যজিতের মৃত্যুর পর তাঁর সূত্রে যে ‘রেনেসাঁ’র ব্যবহার করা হয়েছে, তার তো নিশ্চয়ই কোনও কারণ থাকবে। সেটি কী? উৎপল বাবু তাঁর আলোচনায় সন্ধানান্তে এই ধারণাতেই উপনীত হন, ‘রেনেসাঁ’র মধ্য দিয়ে হয়তো বা সরকার যে কাজটি সহজে সারতে চাইছিল, তা হল, সত্যজিতের এই বহুমুখী প্রতিভাকে এক কথায়, সহজে, একটি মাত্র বিশেষণে বেঁধে ফেলা। রেনেসাঁ’র এ হেন ব্যাখ্যা অজ্ঞতার ফসল হলেও, ভেবে দেখুন, খুব অসম্ভব নয় সাধারণ মস্তিষ্কের পক্ষে। সৃষ্টির, সৃজনশীলতার ঘূর্ণাবর্ত দেখলেই তাকে সর্বগ্রাসী একটা লেবেলে দাগিয়ে দিতে ‘রেনেসাঁ’র মতো মুখরোচক শব্দ মেলা ভার! আমরা নিজেদের অজ্ঞানতায় কতবারই এমন আলগাভাবে ‘রেনেসাঁ’র ব্যবহার করেছি, তাকে সম্যক না জেনেও। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক, সামাজিক সচেতনতার সামনে অবশ্য সে গুড়ে বালি। 

সত্যি কথা বলতে, ‘রেনেসাঁ’র কোনও আংশিক প্রকাশ বা অভিব্যক্তি হয় না। হয় তা সামগ্রিক, না হয় তা নেই। পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ আদর্শ মেনে ধর্মের কাঠগড়া ছেড়ে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন অভিব্যক্তিকেও যদি আমরা রেনেসা’র একটি খুঁটি হিসেবে ধরি, ভারতে আজও হয়ে চলা ধর্মীয় দলাদলি, কুসংস্কার, অন্ধ ভক্তির সামনে সে নিমেষে বানচাল হয়ে যায়, বাকি খুঁটির কথা তো বাদই দিলাম। কাজেই, সত্যজিতের প্রেক্ষিতে ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’ শব্দবন্ধটি আমরা নির্দ্বিধায় সরিয়ে রাখতে পারি। 

পড়ে থাকে ব্যক্তি সত্যজিৎ পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি। নিঃসন্দেহে সেগুলি ব্যক্তিমানুষকে আখ্যানের কেন্দ্রে রাখার (রেনেসাঁর একটি বৈশিষ্ট্য) কিছু উৎকৃষ্টতম নিদর্শন। ‘অপু ট্রিলজি’ হোক, বা ‘দেবী’র সেই নববধূই হোক, ‘জন অরণ্য’র সোমনাথ, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র সিদ্ধার্থ, ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দু – যেই হোক, কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষ এবং তার ‘ফ্রী উইল’-এর একটি আভাস থাকে সত্যজিতের কাহিনীতে। অনেক সময়েই হয়তো সেই ‘ফ্রী উইল’ পরিহাসের বস্তু হয়ে ওঠে। এবং এখানেই সত্যজিৎ তাঁর চরিত্রদের সমাজবিচ্ছিন্ন স্বাধীন না দেখিয়ে সমাজব্যবস্থার ফসল, বা অনেক্ষেত্রে শিকার হিসেবেও দেখিয়েছেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার নিচে নিচে চোরাস্রোতের মতো সত্যজিৎ গড়ে তোলেন এক নিরবচ্ছিন্ন ‘পলিটিকাল ন্যারেটিভ’। ‘জলসাঘরে’ যেমন বিশ্বম্ভর রায়কে স্বাধীন একটি চরিত্র হিসেবেও পাঠ করা যায়, তেমনই পাঠ করা সম্ভব জমিদারী-শাসনের পতন ও নববিত্তবানদের উত্থান। ‘গণশত্রু’তে ইবসেনের মতো সত্যজিৎ তাঁর ডাক্তারকে গল্পের শেষে সমাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা একজন একাকী চরিত্র হিসেবে দেখান না; বরং কিছু মানুষ একজোট হচ্ছে তাঁর লড়াইয়ের সাথী হতে, তার আভাসই পাওয়া যায়। ‘শাখা প্রশাখা’র বিত্ত ও নীতির সংঘাত হোক, কি ‘আগন্তুক’এর সভ্যতার সংকট, মানুষ কোথাও একা বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় সত্যজিতের চলচ্চিত্রে। আধুনিক সমাজের চিত্রকর হিসেবে একজন শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সত্যজিৎ বারবার। 

নিজের সৃষ্টিতে মানুষের অবস্থা ও অবস্থানের বিষয়ে তাঁর যে সচেতনতা, তা নিঃসন্দেহে ‘হিউম্যানিস্ট’; তবে তাঁর দেশের বা সমাজের সামগ্রিক জাগরণের অভাবে ‘রেনেসাঁ’র মতো এক না-ঘটা আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে বাঁধা অমূলক, ভিত্তিহীন; এমনকি ‘রেনেসাঁ’ শব্দটির ভুল ধারণা ও প্রয়োগে হিতে বিপরীত হতে পারে – সত্যজিতের ছবিগুলি পরিণত হতে পারে মিউজিয়ামের শো-পিসে, বাঙালীর ‘নস্টালজিয়া’ পার্বণের একটি বিষয়। এমনটাই মনে করেছিলেন উৎপল দত্ত। তাঁর মতে, “Renaissance is an inadequate term for Ray. He was a moment in the conscience of man.” মানুষের বিবেকের চিরজাগ্রত একটি মুহূর্ত। 

(লেখাটির মূল সুত্রঃ উৎপল দত্ত রচিত ‘Ray, Renaissance Man?’ শীর্ষক ইংরাজি প্রবন্ধ; সীগাল থেকে প্রকাশিত ‘On Cinema’ বইটির অংশ।)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


জন্মের মধ্যেই রয়েছে মহাবিস্ফোরণের ঘনঘটা। তাকে কি ইতিহাস বলবো! পৃথিবী পেরিয়ে এসেছে এভাবেই আরও অনেক অনেক সৃষ্টি এবং প্রলয়মুহূর্ত। কিন্তু ইতিহাস এবং সম্যক উপলব্ধির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস অনেকটা গল্পের মতো। শুনতে শুনতে শিহরিত হওয়া যায়, কখনও উল্লসিত হওয়া যায়। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা নিয়ে বোধহয় গল্পগাছা হয় না। প্রকৃতির কাছে মানুষ বড়ো অসহায়। শুধু স্পর্শ দিও না, অন্তরে রেখো। এভাবেই বললেই কি নিরাময় হয়! চারপাশে শুধু নীরবতা আর নীরবতা।

হয়তো এই সময়ে লেখা নয় তবু ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হল। একজন তরুণ কবি লিখছেন, – 

"পাখির কণ্ঠে বাজছে শোন গীতবিতান
নামিয়ে রাখা বিষাদগুলি উড়ন্ত খই" 
(সৌরভ চট্টোপাধ্যায়) 

তখনই মনে এল কথাটা। একমাত্র পাখিই কি পারে! আমরা কেন পারি না! ওই তো বিষাদগুলো উড়ছে। উড়ছে এবং পুড়ছে। দিনান্তের চুল্লিটাতে নিখাদ হচ্ছে। পড়ে থাকছে গোধূলিরঙের ছাই। তাকে গায়ে মেখে সন্ধ্যা সেজে উঠছে হাসতে হাসতে অপরূপ রাত্রির সাজে। অন্ধকার আজ তার হাত ছাড়বে না। 

তো এখন এমন একটা সময়, মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন ঘুরছে না। থেমে আছে আশ্চর্য এক বিন্দুতে। কখনও মনে হচ্ছে আমরা সবাই একই বৃত্তে অথচ কেন্দ্রহীন হয়ে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবনের অর্থ খুঁজছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে – আছি তো! কারণ জীবন যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, বেঁচে থাকাটাও তখন অনুভব করা কঠিন হয়ে পড়ে। বা এই যে থাকা, একে কি সেই বেঁচে থাকা বলে! প্রতিটি দিনের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা। পৃথিবী ঘুরছে আর আমরা নাকি ঘরে বসে লড়াই করছি অজানা অচেনা এক শত্রুর সঙ্গে। ঘরে থাকলেই জয় করা সম্ভব। সে যুদ্ধের শেষ কোথায় আমরা জানি না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস তো বইছে। সে বলছে – তুমি আছো। বিষাদ-বেদনা মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে নিজস্ব নিদ্রা থেকে। সে বলছে – তুমি আছো তো! ক্রোধ-কান্না আশ্বিনের মেঘের মতো, আসে যায়, এঘর ওঘর করে। প্রেম-বিরহ, শুদ্ধ শ্বাস, শুদ্ধ রাগ তারাও। বলছে – তুমি আছো তো !

অথচ এই থাকা-নাথাকার দ্বন্দ্বগুলো যখন বড় বেশি পেয়ে বসে তখন অবসাদ আসে। জড়িয়ে ধরে। তারও তো একটা মুক্তি চাই! কোথায় যেন বেজে উঠলো, – "অরূপ, তোমার বাণী/অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি।।" তখনই মনে হলো এই তো আমার নিরাময়। সকল দুঃখ মাঝে আমার উছলে ওঠা জীবন বাইছে যে সুর, যে সুরলহরীর তরী, সেই তো আমার সকল দুঃখহরা। এইটুকু অন্তত বাঁচা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, – "গানের সুর যেন অসীমের সঙ্গে একমুহূর্তে একটা যোগাযোগ ঘটে যায়। এমনটি আর কিছুতে হয় না।"( রাণী চন্দকে এক চিঠিতে )।

তো এভাবেই ভেসে ভেসে আমরা একটু নিরাময় খুঁজছি। একটু একটু করে অসীমের দিকে হাত বাড়িয়ে জীবনের অনিশ্চয়তাকে ভুলে থাকতে চাইছি। তাহলে যে গাইতে পারে না, তার কী হবে! তিনি বললেন– ওরে তার জন্যেই তো রয়ে গেল আমার বাণী। সেই বাণীর মধ্যে নির্মোহ ডুবে যেতে যেতে কখন যেন মনে প্রশ্ন এল– মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রাণের সূচনা হয় কীভাবে! মহাবিশ্বের এক বিস্ময় নিয়ে সেও তো বেঁচে আছে। আমরা কেন পারবো না! দেখো মৃত্যুই লালন করছে জীবনকে অথচ জীবন জানতেই পারে না মৃত্যুকে কেমন দেখতে! এই আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে পড়ে জীবন নাহয় আরেকটু মর্মে বাঁচুক। বলছেন, – "শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,/মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।।" এইতো। স্পর্শে জেগে উঠছে প্রাণ। ব্যক্তিগত শোকের স্রোত পেরিয়ে কখন যেন ভেসে উঠলো তার ছায়া। তাকে জড়িয়েই কেটে গেল একটা গোধূলি। জীবন থেকে মৃত্যু হল খেয়া পারাপারের খেলা। একটি নক্ষত্রের খেয়া। তিনি পেরিয়ে গেলেন আর আমাদের রেখে গেলেন এপারে। কিন্তু খেয়াকে বাইছে কে! এই গূঢ় প্রশ্নের উত্তর মেলে না। শুধু বয়ে যাওয়া। বইতে বইতে, বাইতে বাইতে নদীটি আকাশ হয়ে যায়। আকাশের ঘর বাড়ি বংশ পরিচয় নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা অবশ্য নেই। শুধু মাঝে মাঝে প্রাণের পরশটুকু দিও। এই তো সামান্য চাওয়া।

মৃত্যুকে নিয়ে কেন যে মন এমন খেলা খেলতে বসে! আসলে সত্যের খোঁজ যখন আমরা করতে বসি তখনই কেউ যেন বলছেন – এ এক মহাবিস্ময়। মৃত্যুকে বাদ দিয়ে জীবন কখনও বাঁচে না। এর মধ্যে দাঁড়িয়েই নানারকম উপলব্ধি। তাদের নিয়েই নিরাময় খোঁজা। ঠিক বিষাদ নয়, এমন একটা অবস্থা, থেকে থেকে যেন নিজেকে খোঁজা। খুঁজতে খুঁজতে বর্তমানের মুখোমুখি হওয়া। কে এই বর্তমান! আচ্ছা, অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যিনি, তিনিই কি বর্তমান! তাঁকে কি ঠিক চেনা যায়! কবি বলছেন– যা নেই, তাকে সাজাতে আমাদের কখনও উপকরণের অভাব হয় না। যার একখানি ছেঁড়া কাপড়, সেও ওই নেইকে গয়না পরাতে বসে। তার তখন যে কি অফুরন্ত ঐশ্বর্য! এতো সবার বোঝার বিষয় নয়। একমাত্র তিনিই জানেন। 

এই প্রহেলিকার মধ্যে পড়ে দিশাটাই গেল। আবার পাখির কাছে গেলাম। যে পাখির কণ্ঠে থেমে থেমে বেজে চলেছে মুহূর্তের অনিবার্যগুলো। বেজে চলেছে – "ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে/চলো তোমার বিজনমন্দিরে।।" এই বিজনে ওই বর্তমানের একটা ঝলক, অথবা তার একাংশ। ইনি অতীতের গর্ভ থেকে বেরিয়ে যেই না পা ফেললেন বিশ্ব চরাচরে, ভবিষ্যৎ তাকে বিচ্ছিন্ন করলো। এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হতে পারে। যার মধ্যে ওড়ার বাসনা যখন জন্ম নেয় বুঝে নিতে হবে এ হল পাখিত্ব। যখন হিংস্রনখ বেরিয়ে আসে বিদ্যুতের ফলার মতো, বুঝে নিতে হবে এ হল পশুত্ব। এভাবেই মানুষের ব্যক্তিত্বে বিচিত্র সব আচরণের সমাহার। – আপনি কি এবার একটু নৈঃশব্দ্যের গন্ধ পাচ্ছেন! তাহলে ওই দেখুন কালের মুখর বাঁশিটি বেজে চলেছে আরও নীরব সুরে। রাত্রির গূঢ়তা, আঁধারের মাহাত্ম্য, মধ্যে আরও আরও কত প্রাচীন অন্ধকার! দেখুন তার পরশখানি কেমন লাগছে!

আত্মজনেরা বললো – পাতার ভাঁজে তোমার জন্যে একটা কাগজের নৌকো রাখা আছে। আমি ভাবলাম গীতবিতানের খাঁজে আমার তো শৈশব রাখা ছিল, তাকে কে কখন নৌকো বানিয়ে তুললো! তাদের খুঁজতে একবার মাটিতে একবার অন্তরীক্ষে তাকাতেই শূন্য থেকে চোখ নাচালো সেই শৈশব। তাকে লালন করতে করতে বুকের মধ্যে একটা ছলাৎ, বেজে উঠলো নদীর অতলও। তাহলে কি শৈশব এখন বার্ধক্য পেরোবে! শৈশবের জল থই থই জীবন একটা নৌকোয় উঠে আজও ভেসে যেতে চায়। জীবন এমন, মাঝে মাঝে কীকরে যে বয়সকে তুচ্ছ করা শিখে নেয়, বুঝতেই পারি না। আর সে নৌকো যদি কাগজের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সেই নৌকো নিয়ে বয়স পেরিয়ে গেল আরও কিছুটা সময়। স্মৃতি উপচে ভেসে যাচ্ছে নৌকোর সঙ্গে মন। ভাসতে ভাসতে গেয়ে চলেছে – "আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ !/খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।" এই ভাসমান জলের উপর ছোট ছোট ঢেউগুলো মধ্যবিত্ত। খুলবো খুলবো করে সবটুকু কি আর খোলা যায়! ঢেউ নিয়ে খেলা, খেলার মধ্যে ঢেউ ঢেউ আরও কত প্রহর কেটে যায়! অন্তরের দরজা খোলার প্রয়াস চলতেই থাকে। আগন্তুক হাওয়া এসে দোলা দেয়। দোলাচলকে একটু নাড়িয়ে একটু দুলিয়ে দিয়ে দেখছে– কেউ কি এল! কে এল না! "বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ, কেমনে দিই ফাঁকি!/আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি।।"

তো সেই আধেক নিয়েই পাতার শিরায় একটা শিরশির এসে বসলো, বলছে গন্ধবিতান। আমার বিতানঘরে তখন বায়না ধরেছে ইচ্ছেকুসুম। বাকল খুলে বসা এক গানপরি। গীত হচ্ছে আরও হলদে বাটা হাতের চেটোয় অরূপ নির্জনতা। এভাবেই একফালি জমি ছিন্নপাতায় ভরে ওঠে।। মর্মর ধ্বনি ওঠে ফুঁপিয়ে। কিছুটা কান্নার মতো। কান্না বললে আবার অশ্রুনদীটা চলে আসে। আমার নির্জন কুলুকুলু বয়। অন্ধকারে আমার শরীরও নির্জন। অন্তঃপুরের নির্জনতা ছুঁয়ে রচনা করে ফেলে একখানি মহাসঙ্গীত – "আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে।।" ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তো চলেছি। মারের সাগর পাড়ি দিচ্ছি। মাভৈঃবাণীর ভরসাটুকু ঢেউ হয়ে বুকে এসে লাগছে। ভয় ভেঙে যাচ্ছে। অভয়নগর, অভয়ারণ্য পেরিয়ে ছায়াবটের দাঁড় বেয়ে। 

নির্জনতার কোনও ছলনা থাকতে পারে কি! পারে না, এমন বিশ্বাস নিয়েই একটু বাঁচতে চেয়েছি। আদিগন্ত মায়াভরা নক্ষত্র, তাদের কোলে একটু মাথা রেখে বিদ্যুতের ছক টানা দেখছি। তখনই মেঘে মেঘে ছলনার ছল ছলকে ছলকে উঠলো। আরও বিচিত্র হল অনন্তের সেই বৃষ্টিবিলাস। যে জালের মতো বিস্তার করে জড়িয়ে ধরছে মোহতাপ। মন তাকে উপেক্ষা করতে চায়। মন চায় এই চরাচর আরও বিস্তৃত হোক। "আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে" আজ এই মুহূর্তে নিবেদন করতে চাই তার কাছে নিজেকেই। চরে এসে বসলো নিরাবরণ বেলাশেষের যাপনটুকু। সে কী অসামান্য তার গায়ের রঙ, রূপের বিভা একেবারে ব্যাখ্যাতীত। তবুও যে ব্যথার পূজা শেষ হবার নয়! কারণ যাপন তার দীর্ঘ চুলে এখন বিলি কাটছে। সে সুগন্ধি নিয়ে সাজাতে বসেছে কবেকার বিদিশাকে। শ্রাবস্তীর সবুজ শরীর অবুঝ হয়ে উঠছে কারুকাজ দেখে। সুর লয় তালহারা বাঁশিটা কেন যে বারবার দূরে সরে যায়! তাকে ছেড়ে বাঁচবো কীকরে! 

আমার বিজনঘরে নিশীথতারে অঘুমের বসত দেখেও অবাক হতে হয়। এসেছিল সে শূন্য হাতে। তার পরিজন সংসার ব্যক্তিত্বের অভাব বুঝতে দেয় না। কিছুই সে আগলে রাখছে না। শূন্য থেকে আরও শূন্যে আমাদের জেগে থাকা মুহূর্তগুলো বাঁধন খোলা কণ্ঠে বারবার গেয়ে উঠছে – "জানি জানি বন্ধু, জানি –/ তোমার আছে তো হাতখানি।।" সেই হাত দিয়েই জীবন ও মৃত্যু দুদিক থেকে আমাকে টানছে। তোমার সঙ্গে নাহয় কাটবে আমার এই আকাশ অন্ধ করা আরও কিছুটা নির্জনতার বেলা। কাটতে কাটতে দিন হয়ে উঠবে হৃদয় আপন করা। তোমার সঙ্গে এসব আয়োজন পূর্বনির্ধারিত। এমনটাই বাতাস জানে। বলেছিলাম তাকে। কিন্তু ওই যে নির্ভরতার খাঁজে কোলাহলকে ডেকে বসলাম, সে আর বারণ মানছে না। জীবনপুরের গল্প শোনাবে বলে অনন্তকে সাবানজলে ধুয়ে গন্ধ এবং ধ্বনি জুড়ে স্বরূপ করে তোলে। এটাই যে তার রূপ-অরূপের খেলা, সে ছাই কে জানতো! 

এখন আপনি মায়ায় আপনি রসের গুনে রাত্রি এসে বসে। তার সাফল্য, তার ব্যর্থতা, সে শোনাবে। আমরা মুগ্ধ হবো বলে বেদনার রুদ্ধদল নদীর কূলে রেখে আসি লুকিয়ে। নদীটি বইছে কিন্তু আপন খেয়ালে। কবি বললেন – এই নদীটি আমার রচনা। হা পোড়া কপাল, এ বিশ্বের সবকিছু যার নিজের রচনা তার আবার আলাদা একটা নদী কী ! তবু আমরা কান পেতে শুনি – "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।" আমরা রয়েছি সেই অনন্তের দিকে চেয়ে। বসন্ত একটা পাতার কুড়েঘর বানিয়ে রেখেছে মনাঞ্চলে। রেখেছে রাত্রির মতো বিচিত্র সব রাগের সমাহার দিয়ে। যেন অমৃত সুধাপাত্র সব। মনের যত তরঙ্গ এখানে এসে বনতরঙ্গের সঙ্গে মেশে। এর কোনও ক্ষয় নেই, শেষ নেই। "অনন্ত আলয় যার কিসের ভাবনা তার–"! এই নির্ভাবনায় ঘরের মধ্যে বিশ্বটি রচনা করি। আর মন্তব্যে লিখে রাখি নিজের নামহীন গোত্রহীন আশ্চর্য আত্মপরিচয়।

লিখে তো রাখছি, কিন্তু একে কি লেখা বলে! অনেকদিন ধরেই তিনি বলছেন – এই যে পৃথিবীর উপর তোমাদের এত মোহ, এর পরিণাম জানো! কী মুসকিল, আমাদের কাজ আমরা করেছি, মোহ আবরণ নিয়ে ভাবনার কাজ শুরু হল কবে! জীবনকে কেমন করে দেখবো, বাইরে থেকে না ভেতরে দাঁড়িয়ে! আবার বাইরে যে দাঁড়াবো, তার তো একটা পথ চাই। এই সামাজিক জীবনের সঙ্গে বিশ্বের যে যোগ তাকে বুঝবো কেমন করে! পথ কোথায়! যখন খুঁজতে বসেছি সব পথ নিপথ হয়ে গেল! কিন্তু থেমে থাকলে তো চলবে না। 

এক অমীমাংসিত দুঃখের মধ্যে দাঁড়িয়ে আনন্দকে আহ্বান করি। সে আসে কিন্তু আসে না, কারণ জগতে যে যেমন আছে, যার যেমন আছে তাকে সেভাবে মেনে নেওয়া তো আমাদের স্বভাব নয়। একটু তাকে মেনে নিতে পারলেই আত্মার সঙ্গে মন, মনের সঙ্গে বস্তু-অবস্তুর সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠতো। একজন চালক বারবার নিপথে চালিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, আরেকজন চালক পথ দেখাচ্ছেন আঁধারে-ইঙ্গিতে। এই দুই চালকের মধুর খেলায় আমাদের রাত্রিধর্ম বিচ্যুত হতে বসে। তবু থামলে তো চলবে না। দীর্ঘ জীবনপথে নিরাময়ের সুর যেখানে বাজে সেখানে একটা পান্থনিবাস আছে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন তাকে! চলুন না একসঙ্গে একটু খুঁজে দেখি! কিন্তু আমাদের খোঁজাটা কেমন হবে! রবীন্দ্রনাথ "জীবনস্মৃতি"তে বলছেন –

"আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার-জলে-উৎসর্গ-করা পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্র-যোগে বিদ্যাপতির 'ভরা বাদর মাহ ভাদর' পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টির মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম।"

দেখুন কখনও সূর্যোদয়ের প্রথম আলো এসে পড়ছে, কখনও পূরবী থেকে বেহাগ হয়ে সূর্যাস্তের নরম গোধূলি মেখে নদীটি প্রবাহিত হচ্ছে, আর আমাদের সুরে সুরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে আশ্চর্য নিরাময়ের দিকে। সেই থেকে আমরা ভেসে চলেছি। ভেসে উঠছে আকাশে সোনার খেলনার মতো পুতুলের ঘর-গৃহস্থালি। ভেসে উঠছে ডুবে যাওয়া গানতরীখানি, ঢেউ খেলছে চাঁদের সঙ্গে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ! 

হৃৎপিণ্ডের ঘড়িটি এখনও বাজছে। তরঙ্গ যেখানে বইতে পারে না সেখানে একটা আর্তনাদ থাকে। জটিল ভাষা তার, কিন্তু হৃৎপিণ্ড সে কথা বলে না। সে বলছে সময়। সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে এই বাঁধনকে। বর্ণহীন যে অন্ধকার, তার উপর আছড়ে পড়ছে প্রবহমান দুঃখগুলো, সঙ্গে রয়েছে দু'টুকরো জ্যোৎস্নার মিনতি। কে যে কখন কার সঙ্গী হবে এভাবে কি বলা যায়! যেতে যেতে যেতে সেই অকল্পের সঙ্গে দেখা। বলছে – 

"মনে করো চতুর্দিকে মৃত্যুর নষ্ট আবরণ নিয়ে,
হাজার মাইল স্পিডে, আমি
দৌড়চ্ছি প্রেমের অস্পষ্ট সীমারেখার দিকে।" 
(শ্যামল জানা)

তারপর যেতে যেতে যেতে মনে করুন, মৃত্যুর আবরণটা। ধরা যাক সরীসৃপ হয়ে উঠল সেই মৃত্যুও। সেও খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে আবার নিজের মতো একটা রঙের পোশাক! আচ্ছা এই রঙ কি ভেষজ! রঙে রঙে ভরে উঠছে মৃত্যুনিকেতন। মেলা বসেছে হৃৎপিণ্ডের মাঠে। তাহলে কি এই প্রেম আবার মহার্ঘ্য হয়ে উঠবে! তাহলে কি অস্পষ্ট সীমারেখাটা আবার! খসে পড়তে পড়তে ভূপৃষ্ঠের অতীত বরাবর গেয়ে উঠবে,– "তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে –/আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,/তোমার প্রেম হত যে মিছে।।" আমরা আবার একটা নিরাময়ের সূত্র ধরে স্নান বিষয়ক জ্যামিতির ভেতর নেমে যাবো নিশ্চিন্তের শ্বাস নিতে নিতে। মধ্যে পুরে দেবো আমাদের ভূভারত সুধাময় সাঁতারের কলিগুলো।

আনারকলির ঝরে পড়া রোদ্দুর আর এই সত্য। কেউ আড়াল করছে তাকে, কেউ শিল্প করে তুলছে মিথ্যার মিথ জড়িয়ে। আলোয়ানটা কবে যে জীর্ণ হয়ে গেছে তা ভেবেও দেখছে না। আরও নতুন এক মিথ্যের জন্যে আরও মিথ, আরও মিথিকাল কান্নার প্রয়াসে তীব্র করোনার গন্ধ, গন্ধহীন ফসফরাসের যুদ্ধ, ছড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে আশরীর দৃষ্টির মধ্যে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বলে উঠছে – দূরে থাকুন, দূরে থাকুন। অথচ ভীষণ ইচ্ছে করছে ইচ্ছেকে জড়িয়ে ওম নিই। ইচ্ছে করছে আরও কিছু সত্যকে আড়াল করার নিমিত্তে এই স্পর্শকাতর ঠোঁট জীবন্ত হয়ে উঠুক আনন্দরূপ অমৃতের উপর। ভাবছি সেই বেশ ভালোর দিনগুলো থেকে টুপ টুপ পেড়ে নেওয়া দীর্ঘের চেয়ে কিছুটা ছোট অথচ মনে হবে ভিক্ষার ঝোলা হাতে রাজা ও ভিখারি …।

কালখণ্ডে এই মৃত্যুর এখন আর কোনও রঙ হয় না। এখন নৈঃশব্দ্য থেকে শব্দের ভ্রূণ খুন করে আনা ভাষা সৃষ্টি করছে যে বিশ্বজগৎ, তার একটাই রঙ – পিঙ্গল বর্ণের ভয়। ভয়ে ভয়ে বলিপ্রদত্ত জন্মের লীলাগুলো লতার মতো ঝুলছে। ঝুলন্ত পায়ের কাছে বিস্ময়। কবি হাসছেন। তাঁর হাসির মধ্যে এক উজ্জ্বল উদ্ভাস। এখানেই মনেহয় দেখা হয়েছিল একদিন। তাঁর কথা আজ খুব মনে পড়ে। বুকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি যে বলতেন – 

"মনুষ্যের সকল উপলব্ধি তাহার মনুষ্য অস্তিত্বের কথনভুবনের নহে। ইহার মধ্যে পক্ষীর কুজন, নদীর বহিয়া যাওয়া, আঁধারের গাঢ়ত্ব, নক্ষত্রের ফিসফিসানি, মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য, অগ্নির দহন, স্মৃতি বিস্মৃতির দিগন্ত, অশরীরীদের আবেদন, তৃপ্তি অতৃপ্তি, রঙ নিঃরঙ, কারণ অকারণ, লক্ষাধিক বছর আগেকার এক সান্ধ্যবৃষ্টিপাত, জোনাকি ইত্যাদি সকলকিছু মিলিয়া রহিয়াছে।" (অপাবৃণু ‌।। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়) 

এই মহামিলনের মধ্যে মহামাননীয় নিরাময় আমাদের যে ঘোর ধাঁধায় ফেললেন। আমাদের সামান্য উপলব্ধির যে জ্ঞান সেখানে লোভ, কাম, স্বাচ্ছন্দ্য, সাফল্য ইত্যাদি ভোগের কোনও ব্যবস্থা না রেখেই তিনি হাসতে হাসতে চলে যেতে চাইছেন! এ কোন্ অমীমাংসিত দুঃখের মধ্যে আমাদের দিশা খুঁজে ফেরা! তাহলে এই যে আমরা, আমরা কেউ কারো নই এমনই এক আমরা, মনুষ্যপ্রজাতির মহা ঘোর সংকট লইয়া কাতর হইতেছি, ইহা কি ব্যক্তিসুখের অভাবজনিত কারণেই উদ্বেলিত হওয়া নয়! মহামান্য বিবেক ক্ষমা করিবেন। সত্য বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর।

অবচেতনার জ্যোৎস্নায় ভাসছে সেই প্রত্নবীজ। বীজের আধার হল রাত্রি। রাতের গরিমা ফুঁসে উঠছে বুদবুদে। নীল বুদবুদ ভরে উঠছে চেতনার শিস জড়িয়ে। কালের অনন্ত প্রবাহ, বয়ে চলেছে এক একটা জন্মের ভেতর। প্রতিটি জন্ম অদৃশ্য তরঙ্গের মতো। নিষিক্ত রাত্রির তেজ দেখে নতমুখ মৃত্যু এবার ফিরে যেতে চায় কালের গহ্বরে। যেখানে এই চোখ এই দৃষ্টি এই অভ্যাস দিয়ে সব কিছু অনুভব করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বাইরেই রয়েছে সেই প্রাণপ্রবাহ, সেই সংসার ও ধর্ম , সেই রূপ, সেই অবয়ব,স্বপ্নমায়া। শুধু কি তাই! সেখান থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে আরেক উচ্ছ্বাস – "ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে,/দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে।।" আমরা যে তাকেই শুনতে চাই। অরূপসুন্দরে পৃথিবী ভরে উঠুক, নিখিল সংসার আবার মিলন-অঙ্গন হয়ে উঠুক। কলুষমুক্ত হোক এই বিশ্বসমাজ। পাখিরা গেয়ে উঠুক তরঙ্গে মিলনের স্বর তুলে।

তো চিরদিন কি এমনই কাটবে! তা তো নয়। তবু যেন মন মানছে না। ভেতরের অস্থিরতা বাইরে এসে পড়ছে। বাইরে থেকে প্রকাশ-অপ্রকাশের মধ্যে এসে পড়ছে নিতান্ত অন্তর্গত অনুভবগুলো। তিনি বলছেন – দ্যাখো বাপু, সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর মতের কোনও মিল নেই। সংসারে স্বামী-স্ত্রী একমতে চললে সংসার কি চলবে! কক্ষনো না। সংসার হল বিরোধের মধ্যে সৃষ্টির এক লীলাক্ষেত্র। এই যে পৃথিবীর এত এত কবিতা, গান কে রচনা করে! কান পেতে শোনো, তোমাদের নিত্য ঝগড়া তার শেষে ওই মিলনরাগটিই বাজছে। "অসীম আকাশ নীল শতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,/তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে।।" এই হল আনন্দধাম।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সঙ্গে তিনি এক আশ্চর্য আঁধার নিয়ে খেলছেন! আমার আমির সঙ্গে যেমন আমি, আরেক আমি। এই যে ছায়া ছায়া দৃশ্য-অদৃশ্যের এক আধা বাস্তব আধা কল্পনা এর মধ্যেও একধরনের শুশ্রূষা রয়েছে। নিজেকে অতল জলের আহ্বানে ছেড়ে দিতে পারলেই হল। সে তো আবহের ছড় টেনেই চলেছে। একে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না, আবার এই সংশয়টুকু নিয়ে আর কিছুটা পেরিয়ে যেতে পারলেই কালের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ঘাট দেখা দিল কি দিল না কী এসে যায় ! –

"ঘোর অন্ধকারে আর সীমানা সরে না
পারাপারে শুধু তার নীরব বিস্তার
থেকে থেকে জলজ বাতাস
আর ঠায় বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ
ধেয়ে আসে, কেঁপে আসে–নিজস্ব মর্জিতে…"
(মন্দার মুখোপাধ্যায়) 

এরপরও কবি বলছেন মনের সীমানার কথা, সীমানা ভাঙার কথা। ভাঙে! ভাঙা যায় নাকি? বাতাসের বিপ্রতীপে একটা বিরল উজান উঠছে। ভেসে যাওয়ার আগে অন্তর ভাসমান...।

ঠিক এই সময়ে অনেককেই দেখছি নানাভাবে বন্ধনের মুক্তি খুঁজছেন। আসলে একে ঠিক নিরাময় বলা যাবে কি! মানুষের ভেতরে নিয়ত বন্ধন এবং বাঁধনহারার টান রয়েছে। মানুষ ভাবছেন এ এক বন্দিদশা। এই বন্ধন থেকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেই মুক্তি, সেই মুক্তিকে খুঁজছেন। কিন্তু আমরা আত্মার মুক্তির কথা যদি বলি, তা কি এভাবে সম্ভব! প্রতিদিন যারা মানবিকতার নামে নানারকম উস্কানি দিচ্ছেন, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ছড়াচ্ছেন, চেতনার কথা বলে নানারকম বন্ধনের বেড়া বাঁধছেন সেটাও কি বন্দিদশা নয়! তাহলে আজ কেন মানুষ ছটফট করছেন! এই প্রসঙ্গে ভীষণ ভাবতে ইচ্ছা করছে, তিনি বলেছিলেন – 

"মনুষ্যত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেবতার উপলব্ধি মোহমুক্ত হতে থাকে, অন্তত হওয়া উচিত। হয় না যে তার কারণ, ধর্ম সম্বন্ধীয় সব-কিছুকেই আমরা নিত্য বলে ধরে নিয়েছি।… সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম, আর ধর্মকেই করে আঘাত। তার পরে যে বিবাদ, যে নির্দয়তা, যে বিচারবুদ্ধিহীন অন্ধসংস্কারের প্রবর্তন হয় মানুষের জীবনে আর-কোনো বিভাগে তার তুলনা হয় না ।" (মানুষের ধর্ম ।। রবীন্দ্রনাথ)

কেউ বলছেন, স্নেহের মধ্যে যে অ-মুক্তি তার মতো বন্ধন আর নেই। তাহলে স্নেহ থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে তো! এই বিলিকাটা দিনের কোনও কোনও মুহূর্তে কোথাও কোথাও গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। চলতেই থাকে। নীরবতার মধ্যেও যেমন কোলাহল। মানুষের প্রেমে এত অপ্রেম, এত সন্ত্রাস! আমরা দেখছি মহাসংকটের কাল এখন, তো প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে গাইতে হবে এমন একটি মহামিলনের গান যা আমাদের সমস্ত সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আত্মার মুক্তি সেখানেই। আপনি আমাদের শোনালেন – "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা।।/বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব,/জাগে অরণ্য রবিবারচন্দ্রতারা।।" দুঃখের মাঝে আনন্দকে অনুভব করা খুবই কঠিন,তবু আমাদের বাগানে নিত্য যে ফুল ফোটে তা দিয়েই সমস্ত আরাধনা। আর কান পেতে শুনতে থাকা সেই অমোঘ মূর্ছনা, – "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে/ মিলাব জীবনগানে।।" আহা ! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো ! 

কিন্তু সমাজের গায়ে আট হয়ে বসে আছে মিথ্যে অহংকার। তিমিরঘন অবিশ্বাস। জ্বলজ্বল করছে বিশ্বসংসার, গ্রহ-তারা। সে পোশাক খুলবে কে! খিদের কি কোনও শেষ আছে! বা ভালোবাসা! সে আসলে কোথায়! আমরা কতটুকু বুঝি! চাঁদ ওঠার ভাষা বুঝি! জ্যোৎস্নার স্বরলিপি দেখে গাইতে পারি! এই যে – "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।।" এই বিস্ময়েরও কি কোনও শেষ আছে! অসীম রহস্যের মধ্যে জীবন যখন পথ হাঁটতে শুরু করে তখন এই একার মধ্যে আর কোনও বিভেদ নেই, কোনও হিংসা নেই, দ্বেষ নেই, ক্রোধও নেই। সব কিছুর মধ্যে থেকে সব কোলাহল স্তব্ধ করে বহুর মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। 

অবশ্য পুরোটাই নির্বোধের বয়ান। জীবনে অতি মহৎ ও অতি চালাকের চেয়ে একটু নির্বোধের মতো বাঁচা। এর মধ্যে যে কি আনন্দ আছে সহজে বোঝানো যাবে না। নির্বোধ হতে কোনও প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না। কোনও যুদ্ধ নেই, হত্যা নেই, ষড়যন্ত্র নেই। যেমন করে আকাশ গায়, যেমন করে বাতাস বয়, অনেকটা সেভাবেই নির্বোধের ধারা। প্রবাহিত হতে চায় উন্মুক্ত চরাচরে। কিন্তু সেখানেও যে কত বাঁধা! এই যে মন বলছে – "আজি মম অন্তরমাঝে সেই পথিকেরই পদধ্বনি বাজে,/ তাই চকিতে চকিতে ঘুম ভাঙিল রে।।" এর মধ্যে যে আনন্দ, সেখানে চমকটা হল ভেতরের আলোড়ন। পাতায় পাতায় হিল্লোল। কিন্তু নির্ঘুমের কি ঘুম কখনও ভাঙে !

হচ্ছিল নির্বোধের কথা, তার নিজস্ব কিছু কান্না আছে। সে চোখের জল তার অন্তরের ভালোবাসা। সে যখন ঝরে তখন প্রবাহিত করুণার মতো নিজেই নিজের। কেউ মুছিয়ে দিতে আসবে না। কারণ নির্বোধের কান্না বৃষ্টিতে ঝরে। নির্বোধের গান শুধু বাতাস শুনেছে। আমরা আলাদা করে তাকে চিনতে পারিনি বলে সহমর্মিতা জানানোর ভাষা কোথায় পাবো! কোন্ ছন্দে তাকে দোলাতে দোলাতে বলবো - ভালো থেকো, সুস্থ থেকো, ঘরে থেকো! আমাদের সে হৃদয় কোথায়, যে বলতে পারে – 

অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো।।

পথের ধুলোয় বুক পেতে রয়েছে যে গৃহখানি সেই-ই তোমার একান্ত আশ্রয়। তবু কেন নিজেকে নিঃস্ব ভাবছো! সব ফুরিয়ে গেলেও অদৃশ্য এক দান ঠিক তোমার সামনে। তুমি দুহাত পেতে গ্রহণ করতে পারছো না বলে নিজেকে নিঃস্ব লাগছে। মৃত্যু আপন পাত্রে ভরে যে প্রাণকে বহন করে নিয়ে চলেছে সে তো তোমারই প্রাণ, তুমি অস্তিত্বে সাড়া দিতে পারছো না বলে নিষ্প্রাণ ভাবছো। সবার মাঝে সকলকে নিয়ে তুমি আছো, সেই তো তুমি!

যেন ভোর এসে রাতের পাতলা চাদর সরালো। আর আমরা একটু একটু করে স্বপ্নগুলো প্রশ্নচিহ্নে রেখে ভোরের শিশির ভেজা মুখ দেখবো বলে চোখ মেলছি। এক নীরব অথচ সপ্রভ নীরবতা ঘসে ঘসে তুলে দিচ্ছে রাতের ব্যর্থতাগুলো। নিত্য তোমার ভেতরে এক তুমি ফুল হয়ে ফুটে উঠতে চাইছে, অথচ তাকে তুমি প্রকাশ হতে দিচ্ছো না। কেন ! নিত্য তোমার ফুলবনে তুমি তারই সুগন্ধ হয়ে আছো। বুঝতে পারছো না। পখি ডাকছে। পাখির কণ্ঠে বেজে উঠছে সেই গীতবিতান। বিতানের তান আনন্দের সঙ্গে সঙ্গত করছে। মিশ্ররাগে বেজে উঠছে সুরবাহার। শুধু বেজে ওঠা, আর বাজিয়ে তোলা। সুদূর পারের ডাক এসে কানের কাছে রাত্রির বর্ণনা দিচ্ছে। যেন সে আমার আকাঙ্খার চাঁদ, সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আতর ঢেলে বসে আছে খোলাপিঠ নিয়ে। এঘর ওঘর করছে তার বহুজন্মের ঘ্রাণ। তবু যেন মনে হয় তার ইশারা টপকে অন্য আরেকজন, আরও রমণীয়। বলছে –

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।।

দরজা খুলে একটা একটা সিঁড়ি। আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে শূন্যের দিকে। কিছুটা মহাশূন্যের মতো। হয়তো ছাদ পেরোলেই তাকে ধরে ফেলা যাবে। কিন্তু ভয়। ঘর-সংসার ঢলঢল ইচ্ছা-অনিচ্ছা মান-অভিমান পেরিয়ে সমস্ত ডাক গ্রাস করতে থাকে। এসব ছেড়ে যাওয়াই হল না। তাহলে বিশ্বলোকের সাড়া মিলবে কীকরে! শুধু রাত্রির অপেক্ষায় এক একটা দিন পেরিয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে দ্বিধা লাগে, রাত্রি না রজনী! মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অচেনা লাগে, মনে হয় চাঁদের কুঁড়ি থেকে শৈশব ফুটে সেই যে হারালো তাকে আর রচনা করতে পারি না। চাঁদ জ্যোৎস্না হয়ে গেল, আর জ্যোৎস্না হল মায়া। দরজা খুলে ছাদ থেকে আর একপাও সামনে এগুনো হল না।

সাতকাহন প্রলাপের মধ্যে যদি সংকটকে একটু ভুলে থাকা যায় সেও কম কীসে! নিরন্নের নির্জনতার মতো গাঢ় শোক বুকে নিয়ে কারও ডাকবাক্সে চিঠি হতে মন আর সায় দেয় না। প্রেম ছিল প্রথম কৈশোরের খেলা। যৌবনে তাকে কত রঙে দেখা! এখন কি আর কেউ ভলোবাসার কথা বলবে যে অমরত্ব পণ করে বসবো! এই তো ফুরিয়ে এল। একপাশে অপাবৃণু, অন্যপাশে গীতবিতান আর সামনে সুদূর বিস্তৃত পথ ও পথের ইশারা। সঙ্গে জুটে যাচ্ছে ঝরাপাতার আপ্যায়নগুলো। বিষাদের সুরে লাগছে গোধূলির ঝিরিঝিরি দোলা। যেন মনপবনের আপনি পেখম মেলা। ছেঁড়া ছেঁড়া গ্রাম পেরোতেই আবার পিছুডাক। দূরে টিমটিমে সেই কৈশোরের আলো, আমাকে ডাকছে। ইশারার মধ্যে কেমন এক ঘোলাটে রঙ। আর ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না। এখন অন্ধকারকে বড় চেনা মনে হয়, আর বারবার মনে পড়ে – 

ফুল দিয়ে বড়ো সহজ বলানো মিথ্যা
মায়ারঙ তার ভণিতায় অভিষিক্তা
ফুলটুল নয়, জ্বালো আগুনের ফুলকি
আগুনের নেই প্রসাধনী রঙ
ছায়ার ঘোমটা আড়াল, বরং
পুড়ে খাক হয়ে জানাবে ঠিক কি ভুল কি।
(পল্লববরন পাল)

এই ঠিক ভুলের মধ্যেও যেন বারবার মনে হচ্ছে একা একা পুড়ে নিখাদ হচ্ছে সময়ের নীলাভতা। মেঘের কোল ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। সঙ্গে চলেছে বৃষ্টি বৃষ্টি খোলা গায়ের নিবিড় কৈশোর। রোমান্স জাগে। ওকে কি তেমন চেনা চেনা লাগে! হয়তো না। তবু চেনা-অচেনার দোদুলে মনটা দুলতেই থাকে। এমন একটা ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ মনে হল বাইরে কি নিশীথ এসে দাঁড়ালো! না নিশীথিনী! সেকি বৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি খেলছে! কবি ডাকলেন – কে? কে ওখানে? – নিরুত্তর। 

কবি আবার বললেন – কি ? তোমার চাই কি?

হিম হিম জ্যোৎস্নার মতো একটা ঠাণ্ডা হাওয়া জানলায় গলা বাড়িয়ে দিয়ে কী এক মায়াময় কণ্ঠে হাসতে হাসতে বললো – তোমায় দেখতে এসেছি গো!

কবি আবার বললেন – কেন?

সে চুপ করে থাকে। বৃষ্টি এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে। এক মহামিলনের দৃশ্য ভেসে ওঠে।

কবি ভাবছেন – নক্ষত্রের সঙ্গম।

কবি নিজের সঙ্গে কথা বলতে বসেন। কথোপকথন চলতেই থাকে। যতক্ষণ কথারা জীবিত ততক্ষণই সত্তার আলোড়ন। আমাদের নিজের মধ্যে নিজের বেঁচে থাকা। দূর থেকে একটা বাঁশির সুর ভেসে আসছে অন্ধকারের পাতা সরিয়ে। আমি কান পেতে থাকি, যেন বাঁশিটি বলছে – 

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?

তাঁকে দেখার জন্যে চোখছুট দৃষ্টির বুলেট গিয়ে বিঁধলো হাওয়ায় ওড়া আঁচলের বুকে। চেয়ে থাকার বয়স বাড়তে বাড়তে একঢাল ঘনচুল অরণ্য আর বাউলপনার গল্প নিয়ে বসলো। ‌ঝাউ ঝিরঝির পাতার কাব্যে সুর বসবে কি বসবে না ভাবতে ভাবতে সুজাতার পায়েস হাতের উপর গড়িয়ে লজ্জাবতী লতার মতো জড়িয়ে ধরলো উৎসর্গ। গাছকোমরে ঝনঝন করে উঠলো বন্ধ ঘরের চাবির তোড়া। এই বুঝি তিমিরঘন অন্ধকার কেটে নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে পৃথিবীর নরম শুশ্রূষা! নাহলে…!

এখানে স্রষ্টার আর কোনও ভূমিকা নেই। সৃষ্টিই নিজের হাতে তুলে নিয়েছে সংসারের নিয়মবিধি, কিছুটা নিয়তি। নিজের অস্ত্রে নিজেই কেটে কেটে ফালাফালা করছে ইতিহাস, ইতিহাসের পদাবলি। পদে পদে যার এলানো খোঁপার মতো পড়ে রইলো শব্দের অনুভূতি। সংকোচের কোনও বিহ্বলতা নেই। ঊরুতে বাজছে অনতিদূরের সন্ধ্যাতারা। সারা শরীরে নূপুর বাজিয়ে ফিরে যাওয়া সেই একই গোধূলি। স্বর্ণচাঁপা রঙের আদর জমা হচ্ছে পদ্মপাতায়। লগ্ন আসন্ন। এরমধ্যেই শুরু হবে আমাদের বিবাহপর্বের ইহকাল পরকাল। আপনার কিন্তু আসা চাই-ই চাই। না এলে…!

নীরব নিঃসঙ্গতার মধ্যে আমাদের সেই আবার একা হয়ে পড়া। একান্তের কত বিচিত্র কাহিনি।

0 comments:

6

প্রবন্ধ - সুশীল সাহা

Posted in


এ জীবনে পেয়েছি অনেক বড় মাপের মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। শুধু মেলামেশার আগ্রহাতিশয্যে নয়, নানা কাজের সূত্রেও বহু গুণী মানুষের স্নেহধন্য আমার জীবন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ফাদার দ্যতিয়েন, গেজা বেথলেনফ্যাল্ভি, শান্তিদেব ঘোষ, বাদল সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অমিয় দেব, পূর্ণেন্দু পত্রী, সত্যজিৎ চৌধুরী, তরুণ সান্যাল, মনোজ মিত্র, হাসান আজিজুল হক, সুধীর চক্রবর্তী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, দেবেশ রায়— আরও কত মানুষ! এই তালিকার শীর্ষে রাখব আমার শিক্ষাগুরু, খুলনার মুহম্মদ কায়কোবাদ স্যারকে। তিনি অবশ্য ‘সেলিব্রিটি’ মানুষ নন। সব সময়েই থেকে গিয়েছেন আলোকবৃত্তের বাইরে। এছাড়া আছেন গৌরীশংকর দে, রাইচরণ পাল, প্রদ্যোৎ চন্দ্র গুপ্ত, দিলীপ দাশগুপ্ত, আরও কত মানুষ! এঁরাও তেমন নামী মানুষ নন। কিন্তু আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে এঁদের অবদান অনেক, কোনও দিনও ভুলে যাবার নয়। এঁরা আমার গানের দীপে আলো জ্বালিয়েছেন। এঁরা আমার পরম প্রিয়জন ও পথপ্রদর্শক। এঁদের ছত্রছায়ায় ছিলাম ও আছি বলে জীবন এখনও আলোয় আলোকময়। নানা ঘটনাবৃত্তের মধ্যে এঁদের কাছাকাছি এসেছি, জীবন হয়েছে মধুময়। বাবাকে হারিয়েছি তো সেই কবেই! সহোদর দাদাকেও— অকালে। তাই হয়তো ঘরের বাইরের এই মানুষগুলোর মধ্যে খুঁজে ফিরেছি আশ্রয়ের শান্তিনীড়। সৌভাগ্য, পেয়েছি অনেক, দু’হাত ভরে তাঁরা দিয়েই গিয়েছেন। অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। কার কখন যাবার সময় ঘনিয়ে আসে, কে জানে! বুক মোচড়ানো অশেষ দুঃখময় এই হারানো। এই তালিকায় অতি সম্প্রতি যাঁর নাম যুক্ত হল, তিনি আমার পরম প্রিয় দাদা, অভিভাবক। দেবেশ রায়।

এই ক’দিন আগেও যিনি ছিলেন তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি নিয়ে, আজ তাঁর ছবিতে ফুলের মালা। আমারও সমস্ত সত্তা জুড়ে স্বজন হারানোর শোকের ছায়াচ্ছন্ন মেঘ। এই মেঘের আস্তরণ ভেঙে কী করে রচনা করব এই প্রয়াণলেখ! ঠিক এমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, নীরেনদা, ইলিয়াসভাই, পূর্ণেন্দুদা, মণীদা, তরুণদা, ফাদার দ্যতিয়েন, শান্তিদা, বাসুদেবদা, রাইচরণদা, প্রদ্যোৎদা আর দিলীপদার প্রয়াণবেলায়।

১৯৮১ সালে কোনও এক সময় বন্ধু বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘পরিচয়’ অফিসে গিয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সেই প্রথম দেখা। দেবেশবাবুর স্ত্রী কাকলি রায়ের সংগ্রহ করা কয়েকটা গণসংগীতের ক্যাসেট আনতে যাই সেদিন। আমরা দু’জন তখন হাবরায় এক গানের দলের সদস্য। গান বলতে মূলত গণসংগীত, তার সঙ্গে নাচের দৃশ্যায়ন। সেদিন সৌম্যকান্তি ওই মানুষটার সঙ্গে বিশেষ কিছু কথা হয়নি। দপ্তরের কাজে ব্যস্তও ছিলেন। আগের বছর ‘বারোমাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্ব পড়ে মাথাটা ঘুরে গেছে। এ কী লেখা! উত্তরবঙ্গের একটি অবহেলিত জনপদের কী বর্ণনা ! বিস্ময়কর। প্রান্তিক মনুষ্যজীবনের এমন অসহ বর্ণনা পড়লে কার না মাথা ঘোরে! তার আগে সত্তরের গোড়ার দিকে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’ পড়েই বুঝেছিলাম বাংলা গদ্যের সব্যসাচী মানুষটির আয়ুধের কত ধার! গল্প উপন্যাস কেবল নয়, প্রবন্ধ, রিপোটার্জেও সমান দক্ষ তিনি। তবু তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন হল ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ (১৯৮৮) প্রকাশিত হওয়ার পরে। অনতিকাল পরেই ওই বইটির জন্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁকে এক যোগ্য আসনে বসবার অধিকার দেয়। অবশ্য তিনি এসবের তোয়াক্কা করেন নি কোনও দিন। সুদূর মফস্‌সল শহর জলপাইগুড়ির আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপনা করা ছাড়া, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে চুটিয়ে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু নিজের লেখকসত্তাকে সব সময় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। লেখালিখি ছাড়া চুটিয়ে দেশবিদেশের বইপত্র পড়েছেন। এ সবই জেনেছি অনেক পরে।

প্রথম দেখার প্রায় এক দশকেরও কিছু পরে ফের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। সেই সময় কলকাতার সাহিত্য অকাদেমির বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজনে রাজশাহী থেকে আসার কথা হাসান আজিজুল হকের। তাঁরই নির্দেশে অকাদেমির অফিস থেকে দেবেশবাবু আমাকে ফোন করেন। হাসানভাইয়ের কলকাতায় যথাসময়ে আসার ব্যাপারে তাঁকে নিশ্চিন্ত করি। বনগাঁ সীমান্ত থেকে তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে এসে কলকাতার চৌধুরী গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিই। তিন দিনের ওই সেমিনারের প্রত্যেক দিনই সেখানে গেছি। অনুষ্ঠান পরিচালনায় দেবেশবাবুর সক্রিয় তৎপরতা ছিল রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। সেই সময় বা তার কিছু দিন পরে হাসানভাইয়ের সঙ্গে দেবেশদার বল্মীক আবাসনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে হতবাক। বইয়ের পাহাড় চতুর্দিকে। মাতৃসমা কাকলি বৌদিকে প্রথম দেখি সেদিনই। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপালের কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে ছিলাম সেদিন। আমার অসহায় অবস্থা দেখে বৌদি আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে যান। তখনই জানতে পারি তাঁর গানের স্কুল ‘গান্ধার’-এর কথা। লেক টাউনের ওই স্কুলে তখন তিনি নিত্য তৈরি করে চলেছেন রবীন্দ্রগানের অনুরাগী ছাত্রছাত্রী। সেদিনই জানতে পারি সুদূর মফস্‌সল শহর জলপাইগুড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁর গান শেখার কথা, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যলাভের কথা। দেবব্রত বিশ্বাসের মতো মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও জেনেছিলাম। সেদিন দেবেশদার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি ঠিকই, কিন্তু পরে তাঁকে ফোন করতেই অনর্গল অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। সেদিনের কথা শেষ করেছিলেন একটি আপ্তবাক্য দিয়ে, ‘আপনার বৌদিকে কোন মন্ত্রবলে আপনি জয় করেছেন ভাই?’ অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে কিছুতেও ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলাতে রাজি করাতে পারিনি। বয়সে অনেক ছোট কাউকেও দেখেছি ‘আপনি’ সম্বোধন করতে। বুঝেছি এটাই তাঁর রীতি।

নব্বইয়ের দশকে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকা ও প্রকাশনা কলকাতার সাহিত্যজগতে বেশ সাড়া জাগায়। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে ওঁদের অফিস। নানা কারণে ওখানে যেতাম মাঝে মাঝে। মূলত অরুণ সেন এবং পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছেই যেতাম। আর যেতাম পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্না দেবের কাছে। সেই সময় দেবেশদার সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকবার, কথাও। দেখা হলেই বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেন। বিনা কারণে বড় মাপের মানুষদের বাড়িতে যেতে সব সময়েই দ্বিধাবোধ করতাম। তত দিনে তাঁর অনেক লেখাই পড়ে ফেলেছি। যেতে তো পারতামই, কিন্তু কেন যাব, এই অজুহাত খুঁজতে খুঁজতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল।

২০০০ সালের গোড়ার দিকেই হবে, আমার পরম বন্ধু সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। ওঁর চিকিৎসার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করতে সাত জন বিশিষ্ট মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্র বিভিন্ন সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয়। পুরো ব্যাপারটিই ছিল আমার মস্তিস্কপ্রসূত। ওই আবেদনপত্রে সানন্দে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বাদল সরকার, তরুণ সান্যাল এবং দেবেশ রায়। শুধু স্বাক্ষর করা নয়, সেদিন দু’হাজার টাকার একটা চেকও আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে তাঁর ওখানে নিত্য যাতায়াতের শুভ সূচনা হল। যতই যাই, টের পাই বৌদির কাছে আমার একটা স্থায়ী ঠাঁই তৈরি হয়ে গেছে। এক দিন দেবেশদা বলেই ফেললেন, ‘আপনি আসবেন বলে আপনার বৌদি একটা স্পেশাল জিনিস রান্না করে রেখেছে।’ এ যে কত বড় পাওয়া তা কেবল আমিই জানি।

একটা ব্যাপার তত দিনে বুঝে গেছি যে বড় মাপের মানুষদের কাছে অকারণে গিয়ে বিব্রত বা বিরক্ত করা উচিত নয়। তাঁরা ব্যস্ত মানুষ, কাজের মানুষ। তাঁদের সমস্ত সময়টাই সৃজনের। তাঁরাও যে আড্ডা দিতে ভালবাসেন, কিছুটা সময় রাখেন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কাটাতে, সেটা তখনও মাথায় আসেনি। শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষদের দেখেছি কী ভাবে প্রশ্রয় দেন অজস্র মানুষকে। অগণিত সভা সমিতি নাটক দেখার মধ্যেই তিনি কাজ করে যান নিরলস ভাবে। কিন্তু দেবেশবাবু তো আর শঙ্খদা নন। তাই ওঁর কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করতাম। তত দিনে ওঁর লেখা ‘যযাতি’, ‘মানুষ খুন করে কেন’, ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’, ‘সময় ও সমকাল’ ইত্যাদি পড়েছি। যত পড়েছি, ততই নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি মেরেছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই যখন দেখি তাঁর সম্পাদনায় জীবনানন্দের নানা অপ্রকাশিত লেখা গ্রন্থাকারে ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। সাহিত্য অকাদেমি থেকে তাঁর সম্পাদনায় ‘রক্তমণির হার’ শিরোনামে দেশভাগ ও স্বাধীনতা বিষয়ে দুটি গল্প সংকলন বেরিয়েছিল। বাংলা-সহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় লেখা অনন্য সংকলন। দেবেশদার লেখা ভূমিকাটি ছিল অসাধারণ। তাঁর জহুরির চোখ আর অসামান্য মেধা ও মননের সংযোগে সেই সংকলন দুটি বাংলা ভাষার অনন্য সম্পদ। পরবর্তীকালে দেশভাগ নিয়ে যে কাজগুলো নিজে করেছি, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই বইটাকেই সামনে রেখে এগিয়েছি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার পথপ্রদর্শক।

পরে তাঁর সঙ্গে নানা সভা-সমিতিতে দেখা হয়েছে। দেখা হলেই অনুযোগ করতেন, কেন যাই না তাঁর কাছে! বৌদি অনেক দিন ওঁর কাছে আমার খোঁজ করেছেন জেনে মনে অপরাধবোধ হয়। তবু যাওয়া হয় না। কারণ খুঁজতে খুঁজতে একবার সত্যি সত্যি তাঁর কাছে যাওয়ার একটা কারণ ঘটল। আমার একান্ত প্রিয়জন, ঢাকার নিশাত জাহান রানা বাদল সরকারের ‘রক্তকরবী’ পাঠের একটি সিডি বার করেছে। ও চায় কলকাতায় সাড়ম্বরে ওর একটা প্রকাশ অনুষ্ঠান করার। এই অনুষ্ঠানে দেবেশবাবুকে আনার প্রস্তাব দিলাম। দেবেশদা সানন্দে রাজি হলেন। তিনিই সিডি উদ্বোধন করবেন। বাদলবাবুর উপস্থিতিতে অভিনীত হবে পথসেনা-র নাটক ‘রক্তকরবী’। গান গাইবেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও অর্ঘ্য সেন। বেশ একটা জমজমাট অনুষ্ঠান। শিয়ালদহ লোরেটো স্কুল চত্বর সেদিন উপচে পড়েছিল কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে। দেবেশদা বললেন চমৎকার। অনুষ্ঠান শেষ হলে একান্তে ডেকে বললেন ওঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে। এই ডাক কী অগ্রাহ্য করা যায়! গেলাম একদিন। তাঁর ও বৌদির পরম সমাদরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম। একটা ব্যাপার সহজেই বুঝে গিয়েছিলাম, অপরিসীম মেধা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বৌদি তাঁর মনপ্রাণ ঢেলে পরম যত্নে দেবেশদাকে আগলে রেখেছেন। সংসার সামলে দুই ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন, পাশাপাশি নিজের সংগীতপিপাসা মিটিয়েছেন অজস্র ছাত্রছাত্রী তৈরি করে। গান শেখা যে কেবল গান গাওয়ার জন্যে নয়, অনুভবের, সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত তাঁর হাতে তৈরি সংগীতায়তন ‘গান্ধার’-এর সুচারু অনুষ্ঠান বিন্যাসে, ধারাভাষ্যের সুমিত প্রয়োগে।

দেবেশদার কাছে নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ ঘটল তাঁর একটি বই প্রকাশের কারণে। তখন আমি প্রকাশক মারুফ হোসেনের অভিযান পাবলিশার্স-এ যোগ দিয়েছি। মারুফের অত্যাগ্রহে ওঁকে একদিন প্রস্তাব দিতে যাই এবং অত্যন্ত ভরপুর আনন্দ নিয়ে ফিরে আসি। তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। অভিযান থেকে প্রথমে তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন বেরোয়। বইয়ের শিরোনাম ‘অল্প কিছু আলো, আমাদের ভালো থাকা নিয়ে কথা বলা’। এই বইয়ের নির্মাণপর্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে লেখাগুলো মন দিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম, এবং ঔপন্যাসিক ও গল্পকার দেবেশ রায়কে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম। সেই সময়ে তিনি তাঁর সুবৃহৎ উপন্যাস ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’ নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন। প্রায়ই আমাকে নানা নথিপত্র দিয়ে তার সত্যতা যাচাই করতে বলতেন। অনেক সময় খবরের কাগজের কাটিং দিয়ে তার উৎস সংগ্রহ করার কাজ দিতেন। নানা রকম বই, বিশেষ করে বাংলাদেশের বই সংগ্রহ করে দিতে বলতেন। সেগুলো তাঁর হাতে দিতে পেরে খুব আনন্দ পেতাম। তাঁর চোখেমুখেও ফুটে উঠত মহাতৃপ্তি। সেই সময় তিনি আমাকে তাঁর অভিভাবক হিসেবে আখ্যা দেন। অনেকের সামনে এই ব্যাপারটি ব্যক্ত করতে দেখলে খুব লজ্জা পেতাম। কিন্তু তিনি যে কতখানি আন্তরিক ছিলেন তাঁর অকপট ভাষণে তার প্রমাণও পেয়েছি। এই সময় ‘অভিযান’ থেকে আমার সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের অন্য সিনেমা’ গ্রন্থের ছ’টি খণ্ড একসঙ্গে বেরোয়। বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয় গোর্কি সদনে মহা সমারোহে। অতিথি হিসেবে আসেন বাংলাদেশের সম্মাননীয় চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলাম এবং অবশ্যই তিনি। সেদিন তাঁর ভাষণে খুব উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। লেখক হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে মনে হয়েছিল যেন পায়ের তলায় যেন একটু একটু করে জমি পাচ্ছি। দেবেশদা একদিন বাড়িতে ডেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দিয়েছিলেন ওই বই সম্পর্কে। তাঁর উৎসাহে অনতিবিলম্বে আর একটি বইয়ের কাজ করি। বইয়ের নাম ‘ছেড়ে আসা মাটি’। বেশ ক’টি মূল্যবান লেখার সংকলন। সব ক’টিই স্মৃতিচারণ। এই বইয়ের জন্যে তাঁর কাছে থেকে একটি লেখা পাই। বইটি বেরোলে তিনি পরমাদরে নানা কথায় অভিনন্দিত করেছিলেন। এই লেখাটি পরে ‘খড়ি’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আমার সম্পাদিত ‘দেশের বাড়ি’ গ্রন্থে সংকলিত করি। বই হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন।

তত দিনে বাংলাদেশের অভিজাত মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এর সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে। এই কাগজের সূত্র ধরেও দেবেশদার বাড়িতে ঘন ঘন যাবার সুযোগ ঘটল। মূলত লেখা চাইতেই যেতাম। কখনওই খালি হাতে ফিরিনি। কত রকম লেখাই না তিনি দিয়েছেন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এমনকি ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখে দিয়েছেন। পত্রিকাটা খুব পছন্দ করেছিলেন তিনি। কলকাতা থেকে যখন এর একটি সংস্করণ বেরোতে শুরু করে তখন এর সম্পাদক ছিলেন শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পত্রিকার সৌকর্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেশদা একবার আমার কাছে তাঁর মনের একটি গভীর ও গোপন ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বিনা সম্মান দক্ষিণায় এই কাগজের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, নীরেনদা যেমন আছে থাকবেন। সহকারী হিসেবে তিনি আমাকে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন দুই বাংলার মুখপত্র হিসেবে এই কাগজটাকে তিনি তৈরি করে দেবেন। খুবই লোভনীয় এই প্রস্তাব, অন্তত আমার কাছে সেদিন মনে হয়েছিল। তাঁর এই প্রস্তাব আমি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। যদিও তার কোনও সদর্থক জবাব পাইনি। অবশ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সেতুবন্ধন’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন এবং বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটা সীমিত পরিসরে বহুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল আমৃত্যু।

নিয়মিত বাগুইআটির বল্মীক আবাসনের বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে একদিন বৌদিকে বললাম একটা স্মৃতিকথা লেখার জন্যে। আমাকে অবাক করে তিনি জানালেন, ওটা নাকি ইতিমধ্যেই তিনি অনেকটা লিখে ফেলেছেন। একটা চমৎকার নামও দিয়েছেন— ‘জীবন জুড়ে গান’। যে মানুষটা রাতদিন গৃহকর্মের পাশাপাশি কেবল গান নিয়েই থেকেছেন, তাঁর বইয়ের নাম তো এমনই হওয়া সঙ্গত। যথাসময়ে একদিন দেবেশদার নির্দেশে বৌদির স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপি ‘এবং মুশায়েরা’ প্রকাশনার সুবল সামন্তকে দিয়ে আসি। বৌদি কেবলই আক্ষেপ করতেন, ‘এই বই একটাও বিক্রি হবে না’। তাঁর ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে বইয়ের প্রথম সংস্করণ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। যথারীতি বইটির একটি কপি আমি উপহার পেয়েছিলাম। এর বইয়ের যে কদর হবে, সেই বিশ্বাস আমার ছিল এবং তা প্রমাণিতও হয়ে যায়। বইটা হাতে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি, ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ রিভিউও লিখি। পত্রিকা হাতে আসার পর পরই দেবেশদা-বৌদির কাছে যাই, সসঙ্কোচে পত্রিকাটা দিই। ভেবেছিলাম দিয়েই চলে আসব। কিন্তু তা হল না। আমাকে বসিয়ে রেখে পুরো রিভিউটা দুজনে পড়লেন। দেবেশদা পিঠ চাপড়ে দিয়ে একটা কথাই বলেছিলেন, ‘বাহ’। বৌদি খুব খুশি হয়েছিলেন, তাঁর দু’একটা কথাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, তাঁর না বলা কথাগুলো যেন আবার লিখতে শুরু করেন। রাজিও হয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন বইয়ের আর একটি সংস্করণ বেরোলে তাতে তিনি কিছু সংযোজন করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করেই একদিন তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

বৌদির মৃত্যুর কিছু দিন বাদে সল্ট লেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে গান্ধার-এর একটি অনুষ্ঠান হয়। প্রতি বছরই ওই সংস্থার উদ্যোগে একটি করে অতি উচ্চমানের অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথের গানের ডালি দিয়ে নানান ভাবনাসমৃদ্ধ অনুষ্ঠান। দেবেশদার সক্রিয় প্রভাব থাকত সেই সব আয়োজনে,অবশ্য সবটাই তিনি করতেন আড়াল থেকে। এই আয়োজনে আর এক জনের অবদানের কথা না বললেই নয়, তিনি শঙ্খ ঘোষ। বহু যত্নে তিনি এক-একবার এক-একটি বিষয় নির্বাচন করে দিতেন। শুধু তাই নয়, সেই বিষয়ের অনুকূলে রবীন্দ্রনাথের গানও বাছাই করে সাজিয়ে দিতেন। সেই সব অনুষ্ঠান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন তার উচ্চতা কোন পর্যায়ের! বৌদির অবর্তমানে গান্ধার-এর অনুষ্ঠান শেষ হল তাঁরই গাওয়া ‘পথে চলে যেতে যেতে’ গানটি পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসার মধ্য দিয়ে। কেমন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হল আমার।

তত দিনে দেবেশদা তাঁর শ্রবণশক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতো মানুষ কথা শুনতে পাচ্ছেন না, এ বড় কষ্টের ব্যাপার তখন। মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠাই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসে। দেখা করি। কানে মেশিন লাগিয়ে আমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেন, কথা বলেন। আমাদের ঠোঁট নাড়া দেখে কথা কিছুটা বুঝতে পারেন। সে এক প্রাণান্তকর ব্যাপার। তবু আমার যাওয়া বন্ধ হয় না। বিশেষ করে পরিচিত তেমন কেউ কলকাতায় এলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় ওঁর কাছে। সময়টা কেমন উড়ে যায়। সারা বাড়িতে বৌদির স্মৃতিমাখা অনুভূতি। দেবেশদা হয়তো বুঝতে পারতেন, কিছু বলতেন না। 

ওঁর মতো মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা পাওয়া। কিন্তু সব পাওয়াকে ছাপিয়ে গেল তাঁর একটি উপহারে। এক দিন আমাকে ডেকে হাতে তুলে দিলেন তাঁর একটি সদ্যপ্রকাশিত বই ‘তিনটি নভেলা’। বইটি তিনি আমাকেই উৎসর্গ করেছেন। বিস্ময়ের পরে বিস্ময়। লিখেছেন, ‘সুশীল সাহা দুই বাংলার স্বনির্মিত সেতু প্রীতিভাজনেষু’। এ যে আমার জীবনের কত পাওয়া, সে কথা আমি কী করে বোঝাই। সেই সত্তর সালে দেশ ছাড়ার পর থেকে নিরন্তর ছেড়ে আসা দেশটার জন্যে যে নানান রকম কাজকর্মে লিপ্ত থেকেছি একেবারে নীরবে নিভৃতে, তার যেন এক অন্য স্বীকৃতি এই উৎসর্গপত্রের লেখা। এমন করে অনেকেই মূল্যায়ন করেছেন পরবর্তী কালে, কিন্তু দেবেশদার এই ঘোষণা যেন আমাকে অনেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। জন্মভূমির জন্যে এই আকুতি আমার আজও ফুরায়নি, হয়ত ইহজীবনে ফুরাবেও না।দেবেশদা কী ভাবে যেন বুঝতে পেরেছিলেন। 

তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল যে যখনই তাঁর কাছে যে কাজেই গিয়েছি, তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা থেকে শুরু করে লেখালিখির ব্যাপারে সহযোগিতায় আমাকে ভরিয়ে দিয়েছেন। প্রিয় বন্ধু ও ভাই কৌশিক জোয়ারদার আর বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম গোর্কি সদনে গত বছর। আসার কথা ছিল শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, অরুণ সেন আর দেবেশদার। অনিবার্য কারণে সে দিন আসতে পারেন নি শঙ্খদা, পবিত্রদা আর অরুণদা। আমরা খুব আশাহত হয়ে পড়েছিলাম। তবে সেদিন দেবেশদা সবার অভাবকে ছাপিয়ে আমাদের পূর্ণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শরীর ভাল যাচ্ছিল না, মধুসূদন মঞ্চে নাটক দেখে ফেরার পথে সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন। তবু আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি, করেননি।

এত মধুর সম্পর্কের মধ্যেও একটা আক্ষেপ আজ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা দিয়েই এই আত্মকথন শেষ করব।

হাসান আজিজুল হক সাহেবের ছোট উপন্যাস ‘বিধবাদের কথা’ একটু অন্য রকম ভাবে বার করেছিলাম বছর কয়েক আগে। কিন্তু সেই বই পাঠক সমীপে আসার আগেই প্রকাশক সোমনাথের অকালমৃত্যু হয়। বইটা তাই নতুন করে প্রকাশ করার জন্যে দে’জ পাবলিশার্স-এর শরণাপন্ন হই। ওঁরা সাগ্রহে রাজি হন। আগের সংস্করণের কিছু কিছু বিচ্যুতি সংশোধন করে একটা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি। এই বইয়ের কথা জানতে পেরে দেবেশদা ওই উপন্যাস সম্পর্কে একটি মননঋদ্ধ লেখা আমাকে দেন। এই বইয়ে মূল উপন্যাসের সঙ্গে কয়েকজন আলোচকের লেখা সংযোজিত হয়েছিল। এই লেখকদের মধ্যে ছিলেন অশ্রুকুমার সিকদার, দেবেশ রায়, সাধন চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ সাহা এবং ইমতিয়ার শামীম। এই কারণেই বইয়ের নামকরণ করা হয় ‘বিধবাদের কথা: নানা পাঠে’। গত বছর পুজোর পরে বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি আমার হাতে আসে একটু দেরিতে। দেবেশদাকে বই প্রকাশের খবরটা এক মোবাইল বার্তায় জানাই। তিনি বইটি দেখতে চান। কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। প্রধান কারণ, বইয়ের কপি তেমন বেশি পাইনি। যা পাই তার সিংহভাগ পাঠিয়ে দিই হাসানভাইকে। দেবেশদা-সহ অন্যান্য লেখকদের বই দেওয়া হয়নি। যা হোক বই যখন হাতে এল তখন সারা পৃথিবী করোনা-কবলিত। আমাদের জীবনেও নেমে এল ‘লকডাউন’। আমার আর যাওয়া হল না বল্মীক আবাসনে। দেওয়া হল না বইটা।

এবং এক দিন এসে পড়ল ১৪ মে। সে দিন বিকেলে চলে গিয়েছেন আমার আর এক প্রিয়জন, আনিসুজ্জামান। তার পর একটু রাতের দিকেই চলে গেলেন দেবেশদা। খবর পেলাম পরদিন সকালে। চোখের সামনে নেমে এল স্বজন হারানোর এক কালো ছায়া। হৃদয় জুড়ে বেজে উঠল একটি গান, ‘ঝরাপাতা গো ঝরাপাতা গো, আমি তোমার দলে’।

কেন এই গান ? কে জানে !

6 comments: